কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

চিত্রা মুদগলের গল্প

 

প্রতিবেশী সাহিত্য

চিত্রা মুদগলের গল্প  

(অনুবাদ : মিতা দাশ)




 

লেখক পরিচিতিঃ জন্ম: ১০ডিসেম্বর ১৯৪৪ 'এগমোর', চেন্নাইতে। তাঁর শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে তাঁর নিজ গ্রাম নিহালি খেদা, জেলা উন্নাও (উত্তরপ্রদেশ)এ। প্রাথমিক শিক্ষা ভিলে পার্লে (মুম্বাই) এবং নিজ গ্রাম নিহালি খেদাতে হয়েছিল। বাকি পড়াশুনা মুম্বাই ইউনিভার্সিটিতে এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষা এসএনডিটি-তে চিঠিপত্র কোর্সের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী সুধাদো রাস্বামীর কাছে 'ভারতনাট্যম'-এর পাঠও নেন।

চিত্রা মুদগাল, তাঁর অভিজ্ঞতা এবং তাঁর সময়ের বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ সততার সাথে চিত্রিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি ৩৭টিরও বেশি বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর বহুল আলোচিত এবং বহুল প্রশংসিত উপন্যাস ‘আঁওয়া'

হিন্দি সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি। গুজরাটি, মারাঠি, তেলেগু, ওড়িয়া, বাংলা, তামিল, পাঞ্জাবি, অসমীয়া, উর্দু, মালয়ালম, ইংরেজি, ইতালীয়, জার্মান এবং চেক ভাষায় অনেক কাজ অনুবাদ ও প্রকাশিত হয়েছে।

সম্মাননা: হিন্দি একাডেমির 'সাহিত্যকার সম্মান' (১৯৯৫), ইন্দু শর্মা কথা সম্মান (২০০০), হিন্দি একাডেমির 'সাহিত্যকৃতি সম্মান' (২০০০), "আঁওয়ার" জন্য উত্তরপ্রদেশ হিন্দি ইনস্টিটিউটের 'সাহিত্য ভূষণ সম্মান' (২০০০), মধ্যপ্রদেশ সাহিত্য একাডেমির 'বীর সিং জুদেব সম্মান' (২০০২), ব্যাস সম্মান (২০০৩), চক্রধর সম্মান (২০০৫-০৬), শ্রীমতি রত্নীদেবী গোয়েঙ্কা সম্মান (২০০৫-০৬), শিখর সম্মান (২০০৭) এবং মীরা স্মৃতি সম্মান (২০১০)।

 

 

পাঠ

অদূর ভবিষ্যতে সরকারের পতনের সম্ভাবনা রাষ্ট্রের সরকারি নেতা ও  কর্মচারীদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। সে ঠিক করেছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়ে দেশের শিশুদের নিয়ে চিন্তা করা আমার কর্তব্য। কখনও  হবে না'র চেয়ে দেরি করা ভাল। এখন তিনি তার নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর সাথে দেখা করবে এবং তাদের সাথে সরাসরি কথার মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন। এতে অনেক চাপ সৃষ্টি হবে। শিশুদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ মানে পিতামাতার সাথে সরাসরি যোগাযোগ। তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ।

সরকারী কর্মচারী তার দলবল নিয়ে একটি স্কুলে পৌঁছলেন।

নির্ধারিত কর্মসূচী মোতাবেক প্রার্থনা শেষ হওয়ার সাথে সাথে, শিশুদের ক্লাসে যাওয়ার আগে, সরকারী কর্মচারী স্নেহ ভরা কণ্ঠে শিশুদের উদ্দেশে বলছিলেন:--

"আমার বাচ্চারা তোমরা তোমাদের নিজের চারপাশের পরিবেশটি কে পরিষ্কার রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে নিজেকে পরিষ্কার রাখা আরও গুরুত্বপূর্ণ! পরিচ্ছন্ন থাকলে, তোমরা সুস্থ থাকবে।' তোমরা অবশ্যই নিজের বইয়ের পাঠটি পড়েছো।"

বাচ্চারা কৌতূহল নিয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। বইয়ের মুখ যদি ওরা দেখতো তবে না ওরা সেই লেখাটা পড়তো!

সরকারি কর্মচারী তাদের খোলা মুখ উপেক্ষা করেন। গ্রামের ছেলেদের খারাপ আচরণের পরিণতি কী হতে পারে? তিনি এখানে তাদের মুখ বন্ধ করতে আসেননি। যে লক্ষ্যে এসেছেন সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যান। তারাও এগিয়ে গেল। তিনি তার গলা পরিষ্কার করে বললেন :--

"নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখলে পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা অর্থহীন। হ্যাঁ, নিজের পরিচ্ছন্নতা মানে নিজের শরীরের পরিচ্ছন্নতা। পাশাপাশি কাপড়-চোপড়ের পরিচ্ছন্নতা। অপরিচ্ছন্নতা মারণ রোগের জননী। রোগও হতে পারে মারাত্মক। বেশিরভাগ চর্মরোগ হয় শারীরিক অপরিচ্ছন্নতার কারণে। সময়মতো সাবধান হওয়াটা খুবই জরুরি।"

"বল, কী জরুরী? বল, বল, লজ্জা করো না! সতর্ক হওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"

আধমরা কণ্ঠে একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে কথাগুলি উচ্চারণ করলো। সরকারী কর্মচারীর মুখ উজ্জ্বল। 

-"তাহলে কি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?" তিনি নিজেই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, "নিয়মিত শুদ্ধ জল দিয়ে গোসল করা উচিত। শরীরের আবৃত অংশ বিশেষভাবে পরিষ্কার করা উচিত। বগল, ঘাড়, কানের পেছনে ইত্যাদি পরিষ্কার করাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমরা কি কিছু বুঝতে পেরের?"

প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে শিশুরা উচ্চ করতালিতে সরকারি কর্মচারীর বক্তব্যকে স্বাগত জানায়।

আনন্দিত সরকারী কর্মচারী প্রোগ্রামের পরবর্তী পর্বে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি তাঁর হাত দিয়ে স্কুলের প্রতিটি ছাত্রকে একটি গোসলের সাবান, একটি ধোয়া কাপড়ের সাবান এবং একটি সুন্দর খাদির তোয়ালে উপহার দেবেন।

একমাস পরে, তিনি আবার এলাকার সমস্ত বিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীর সাথে দেখা করার পরে, তিনি শারীরিক পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে তাঁর পাঠ কতটা বাস্তবায়ন করেছে, তা জানতে চান।

কৌতূহল ভরা বাচ্চারা উৎসাহের সাথে তোয়ালে রাখা ফয়েল-মোড়ানো সাবান-বারগুলো অঞ্জুরিতে এমন ভাবে ভরে নিল যেন কেউ তাদের হাতে দুটি সাবানের জায়গায় ইমারতি জিলাপির ডোনা ভরে দিয়েছে।

এক বা দুটি অধৈর্য শিশু, তাদের জায়গায় পৌঁছানোর আগে, তাদের নখ দিয়ে ফয়েলে একটি ছিদ্র তৈরি করে গন্ধভরা আঙ্গুল নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে ঘ্রাণ নেয়। ওরা তাদের নখগুলির গন্ধ নিয়েই ওরা তাতেই বেশ খুশি।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, একমাস পর সরকারি কর্মচারীরা পরিদর্শনের জন্য একই স্কুলে আসেন। প্রতিনিয়ত শিরোনামে থাকার মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সরকারি কর্মচারীকে দেখে শিশুদের চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু ওদের কাছে কার্ডবোর্ডের বাক্সগুলো না দেখে উনি কয়লার মত পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন।

সরকারি কর্মচারী একে একে বাচ্চাদের ডাকতে থাকে। আদর করে তার গোলগাল মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, সে সাবান কীভাবে ব্যবহার করলো ও পছন্দ হল কী? মজা পেল কী? কিন্তু তাদের পোশাক এত নোংরা কেন? দুর্গন্ধে ভরা কেন?

জবাবে, কয়েক ডজন শিশু অবিচ্ছিন্ন নীরবতায় দাঁড়িয়েছিল। তাদের চোখ পায়ের আঙ্গুল ছুঁয়ে আছে, ওরা চোখ তুলতে পারছে না। ওরা পায়ের আঙ্গুল দিয়ে স্কুলের গোবরে ঢাকা মেঝে আঁচড়াতে থাকে। অনেক কষ্টে কেউ কেউ সাহস জোগালো। তারা বলল মা তাদের কাছ থেকে সাবান ও তোয়ালে ছিনিয়ে নেয়। জানি না তাদের মা সেগুলো কী করেছে!

চিন্তিত হয়ে পড়ে সরকারি কর্মচারীর। কী পড়বে এরা ছাই? ছোটখাটো জিনিসও শেখার জন্য ওরা প্রস্তুত নয়। সবাই অজুহাতে একই কথা ব্যবহার করছে।

তারপরে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র, সতীশ, যে দেখতে তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার ছিল, কাছে এসে তার হতাশা কাঁধে তুলে নেয়। জিজ্ঞেস করলেন নিজের গর্জন-তর্জনের পর নিজের বিরক্ত কণ্ঠে মাধুর্য যোগ করে বললেন- 

-"এসো, সতীশ বলো! তুমি কি সাবান দিয়ে অনেক স্নান করেছিলে?"

সতীশের ঘাড়ভাঙ্গা ডালের মত বেঁকে গেল।

"লজ্জা করো না, সতীশ! আমাকে বল! ভাই, আমরা ঠিক তোমার মা বাবার মতো - দ্বিধা করো না।"

সতীশ সাহস সঞ্চয় করল। সে তার ভীত মুখে উপরের দিকে তাকাল।

"সাবুন কি বাট্টি ... বাট্টি ওর আঙ্গোছা মাই পানসারি কি দুকানওয়া মে লে জাকে বেচে আয়!"

"ওটা বিক্রি করে এলো? কেন?" সরকারি কর্মচারী ভ্রুকুটি তুলে বললেন।

"মা বললেন... বললেন, সরকারও অনেক ঠাট্টা করে - গোসল করে কি পেট ভরে?

"মানে?"

"আমার মা বলল, একটা সাবানের বাট্টি আর একটা তোয়ালের দামে তোমায় দুদিনের আটা আসবে। তুই গোসল করবি নাকি রুটি খাবি?"

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন