কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১০৬




 

বিগত শতাব্দীর ১৯৮৫ সালের ১১ জুলাই মারণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছিলেন বাংলা কবিতার বিশিষ্ট প্রতিবাদী কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ৬৫ বছর বয়স, মনে হয়, নিতান্তই কম বয়স, অন্তত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবির ক্ষেত্রে। বিশেষত যে সময় থেকে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন, তখন আমাদের দেশে ছিল ঘোর দুঃসময়, আবার যখন তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন তখনও ছিল সেই একই সময়, এবং আজ নতুন শতাব্দীর ২২ বছর চলাকালীন সময় আরও আরও খারাপ হয়েই চলেছে। শুধু নিজেদের দেশে নয়, সারা বিশ্ব জুড়ে যে মনুষ্যত্ববিরোধী কর্মকান্ড আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্য  করছি, অত্যাচার ও শোষণের যে ভয়ঙ্কর নমুনা সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার, অমানবিকতার হিংস্র মুখটি তুলে ধরার জন্য আজ খুব খুব প্রয়োজন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অকুতোভয় কবিদের, প্রয়োজন ভারভারা রাওয়ের মতো কবিদের।

দু’বছর আগে ২০২০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর জন্মশতবার্ষিকী ছিল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। বিগত শতাব্দীর ১৯২০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বর্তমানের বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরে। পরবর্তী সময়ে তিনি থিতু হয়েছিলেন কলকাতায়। তাঁর লেখা প্রথম কবিতার বই  প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪২ সালে, যখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বাইশ। কবিতা  বইয়ের শিরোনাম ছিল ‘গ্রহচ্যুত’। তিনি কলকাতার রিপন কলেজে পড়তেন এবং ক্লাসে শিক্ষক রূপে পেয়েছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু এবং কবি বিষ্ণু দে’কে। কবিতা লেখার প্রথম পর্যায়ে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন বিষ্ণু দে’র কবিতায় এবং  অবশ্যই কবি এলিয়টের। তারপর অবশ্য তিনি নিজস্ব ডিকশন গড়ে তুলেছিলেন। এবং সেই ডিকশনে তিনি অক্লান্তভাবে লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা। তিনি সারাটা জীবন ধরে সচেতনভাবে লক্ষ্য করেছেন কৃষক-শ্রমিকের বিপর্যস্ত দিনযাপন, হতদরিদ্র মানুষের ওপর সবলের নির্যাতনের বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই, দেশভাগের নিদারুণ ট্র্যাজেডি, হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎস চেহারা, তেভাগা আন্দোলনের লড়াই, নকশাল আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচার। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রতিটি কবিতায় একদিকে যেমন তুলে ধরেছেন শাসক ও শোষকশ্রেণীর হিংস্র এইসব ক্রিয়াকলাপ, অন্যদিকে তাঁর কলম সরব ও প্রতিবাদী হয়েছে যাবতীয় অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। 

শুধুমাত্র কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা কবি ভারভারা রাও নয়, আমাদের দেশের আরও অনেক ওনেক কবি সাহিত্যিক এভাবেই রুখে দাঁড়িয়েছেন বিভিন্ন অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আমরা তাঁদের সবার প্রতি যথার্থই শ্রদ্ধাশীল, কেননা তাঁরাই আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা।  

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব 

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২৩    




আজ হলিউডের স্বর্ণালী যুগের প্রিয় অভিনেতাদের নিয়ে আলোচনা করব যারা আমাদের মাঝে আর নেই। অবশ্য এই লিস্ট আমার কাছে বেশ দীর্ঘ কারণ সেই  সময় অনেক অভিনেতাই ছিলেন যাঁদের অভিনয় আমার পছন্দের তালিকায়  একদম ওপরের দিকে। এবং তখন আরো একটা কারণ ছিল (যেটা একটু পরে  বলব) যার জন্য একজন নায়ক আরেকজনের কোন এক বিখ্যাত অভিনয় হয়ত স্বচ্ছন্দে করে দিতে পারতেন, কিন্তু চুক্তিবদ্ধতার জন্য তা করে উঠতে পারেননি। তো, যাইহোক, স্বর্ণালী যুগের প্রিয় অভিনেতাদের প্রথম নাম বাছতে গেলে তিনজন নায়কের নাম উঠে আসবে – হামফ্রে বোগার্ট, ক্লার্ক গ্যাবল ও জেমস্‌ স্টুয়ার্ট। এঁরা প্রত্যেকেই প্রায় সমসাময়িক দিকপাল অভিনেতা, প্রত্যেকের  ঝুলিতে প্রচুর হলিউড ক্লাসিক। ক্লার্ক গ্যাবলের ‘ইট হ্যাপেন্‌ড ওয়ান নাইট’ ও ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ নিয়ে এবং জেমস্‌ স্টুয়ার্টের ‘ইটস্‌ আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’  নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু নিজের অভিনয় আর ক্যারিশমা দিয়ে প্রায় প্রতি ছবি হিট করানোর জন্য আমার প্রথম পছন্দ হামফ্রে বোগার্ট। দ্বিতীয় পছন্দ বেছে নিতে গেলেও বেশ কয়েকটা নাম আসবে – স্পেন্সার ট্রেসি, কেরি গ্রান্ট ও মার্লন ব্রান্ডো। এখান থেকেও বেছে নেওয়া কঠিন। কিন্তু কঠিন চোয়াল ও পাওয়ার-হাউজ অভিনয়ের জন্য আমি বাছব মার্লন ব্রান্ডো। তৃতীয় পছন্দ বাছতে গেলেও দুটো নাম আসবেই – লরেন্স অলিভিয়ার এবং গ্রেগরি পেক। কিন্তু এই স্থানের জন্য নায়কোচিত উপস্থিতি ও ভরাট গলার গ্রেগরি পেক আমার একমাত্র পছন্দ। ওপরে উল্লিখিত আটজন নায়ক ছাড়াও সিডনি পয়টিয়ার-কে এই লিস্টে রাখতে পারলে ভাল লাগত। তো, প্রথম তিন স্থানে ওপরের যাদের রাখতে পারলাম না তারা সবাই রইলেন স্পেশাল মেনশন লিস্টে। আর চলচ্চিত্রের নির্বাক জমানায় সিনেমাকে জনপ্রিয় করার জন্য স্ল্যাপস্টিক কমেডির প্রাণপুরুষ চার্লি চ্যাপলিন ও বাস্টার কিটোনকে প্রথমেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

তবে বোগার্টকে দিয়ে শুরুর আগে কয়েকটা কথা। যেটার ইঙ্গিত একটু আগে দিলাম। হলিউডের খানিক ইতিহাস দিয়েই শুরু করতে হবে, নইলে খেই থাকবে না। ১৯১৮ সালে হলিউডে এক বড় প্রোডাকশন হাউজ শুরু হয় – ওয়ার্নার ব্রাদার্স। এর সমসাময়িক আরো দুটো স্টুডিয়ো একে একে চালু হয় – প্যারামাউন্ট পিকচার্স এবং ফক্স ফিল্ম। ১৯২৩ সালে ওয়াল্ট ডিজনি শুরু করলেন ডিজনি স্টুডিয়ো। ১৯২৪ সালে বিখ্যাত মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার। এরা বেশিরভাগ সিনেমা বানাতে শুরু করে। এরপরে পরেই ১৯২৫ সালে স্বাধীনভাবে কাজ করতে থাকা কিছু প্রোডিউসার এবং এইসব বিখ্যাত প্রোডাকশন হাউজের ভেতর এক লড়াই শুরু হয়। এরপর হলিউডের স্বর্ণালী যুগে (মোটামুটি ১৯২৮ থেকে ১৯৪৯ অব্ধি যখন সবাক চলচিত্র পুরোদমে চলছে) গিয়ে এইসব প্রোডাকশন হাউজ ভেঙে বা জুড়ে দিয়ে আটখানা মুখ্য স্টুডিয়ো বা প্রোডাকশন হাউজ পড়ে থাকে যারা সিনেমা বাজারের ৯৫ শতাংশ নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়, অর্থাৎ এরাই বেশিরভাগ হলিউড ছবি বানাতে শুরু করে। ছোটখাট প্রোডিউসাররা হারিয়ে যায়। সেই আটখানা স্টুডিয়ো হল – এম-জি-এম, প্যারামাউন্ট, ফক্স (যারা ১৯৩৫ সালে জুড়ে গিয়ে ‘20th সেঞ্চুরি ফক্স’ হয়ে  যায়), ওয়ার্নার ব্রাদার্স, আর-কে-ও, ইউনিভার্সাল, কলাম্বিয়া এবং ইউনাইটেড আর্টিস্টস। ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে এই আটখানা স্টুডিয়ো একবছরে ৩৫৮টা ছবি প্রকাশ করেছিল। বোঝাতে পারলাম, এরা সিনেমার বাজার কীভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছিল? এরা কী করত, কোন এক নায়ক বা নায়িকাকে বেশ  কিছু বছরের জন্য মোটা টাকার বিনিময়ে চুক্তিপত্রে সই করিয়ে রাখত, ফলে সেই সময় সেই নায়ক বা নায়িকা অন্য কোন স্টুডিয়োর সিনেমায় কাজ করার অনুমতি পেত না। সেই সময়ের জন্য সে হয়ে যেত ঐ স্টুডিয়োর বেতনভুক কর্মচারী। যেমন হামফ্রে বোগার্ট, শুরুতে কিছু বছর ফক্সের সঙ্গে থাকলেও তারপর উনি চুক্তি করেন ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সঙ্গে, ফলে ১৯৪৯ অব্ধি উনি কিন্তু ওয়ার্নারের ডিস্ট্রিবিউশনে যুক্ত থাকা ছবিই শুধু করে গেছেন, অন্য কোন স্টুডিয়োর নয়। আবার ক্লার্ক গ্যাবল চুক্তিবদ্ধ ছিলেন মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের সঙ্গে। ওনার প্রায় সব ছবিই এই স্টুডিয়ো থেকে। অবশ্য ‘ইট হ্যাপেন্‌ড ওয়ান নাইট’-এর সময় এম-জি-এম ওনাকে কিছু মাসের জন্য কলাম্বিয়া পিকচার্সের  কাছে ধার দিয়েছিল। যদিও তার জন্য এম-জি-এম মোটা টাকা নিজের পকেটে পুরেও ছিল (সেটা একটা অন্য গল্প, এখানে বলার দরকার নেই)। এই চুক্তির কারণেই আমি এখনো মনে করি যে স্বর্ণযুগের বিভিন্ন সময় তৎকালীন নায়ক বা  নায়িকারা যে যে ছবিতে অভিনয় করেছেন, তা হয়ত আরেকজন অনায়াসেই করে দিতে পারতেন, বা আরেকটু ভালোও করতে পারতেন – শুধুমাত্র চুক্তির কারণেই সেই সময় করে উঠতে পারেননি। ফলে মাত্র কোন এক বিখ্যাত সিনেমার ওপর নির্ভর করে সেই সময়ের নায়ক-নায়িকাদের বিচার করা উচিৎ নয়।

হামফ্রে বোগার্ট (১৮৯৯-১৯৫৭) ছিলেন যেমন প্রতিভাধর, তেমনি বিশৃঙ্খল। প্রচন্ড সিগারেট ও মদ্যপান করতেন। ফলে উনি ক্যানসারে মারা যান মাত্র ৫৭ বছর বয়সে। নইলে আরো কিছু অনবদ্য ছবি দর্শকরা ওনার থেকে নিশ্চয় পেত। অবশ্য ওনার উল্লেখযোগ্য সিনেমার লিস্ট দেখার মত - হাই সিয়েরা (১৯৪১), মল্টিজ ফ্যালকন (১৯৪২), কাসাব্লাঙ্কা (১৯৪২), টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট (১৯৪৪), দ্য বিগ স্লিপ (১৯৪৬), ট্রেজার অব সিয়েরা মাদ্রে (১৯৪৮), ইন আ লোনলি প্লেস (১৯৪৯), দ্য আফ্রিকান কুইন (১৯৫১), দ্য কেইন মিউটিনি (১৯৫৪), সাব্রিনা (১৯৫৪) ইত্যাদি। যদিও একটু আগেই বললাম যে মাত্র একটা ছবি দিয়ে কোন নায়ক-নায়িকার বিচার করা উচিৎ নয়, কিন্তু আপাতত স্থানাভাবের জন্য আমরা ওনার একটাই ছবি নিয়ে আলোচনা করব – দ্য আফ্রিকান কুইন।

এই ছবি আমি কতবার দেখেছি এখন মনে নেই। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে ল্যাপটপে এই ছবি চালিয়ে চা খেতে খেতে দেখতাম। আমার অন্যতম ফেভারিট ছবি। জন হাস্টনের সিনেমা, সুতরাং উত্তেজনা থাকবেই। এবং অ্যাডভেঞ্চারের পেছনে চার্লি ও রোজের (ক্যাথরিন হেপবার্ন) অব্যক্ত প্রেমের কাহিনী। রোজ ও  তার দাদা আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মিশনারি হিসেবে বাচ্চাদের লেখাপড়া  শেখান এবং প্রতি সপ্তায় তাদের জীবনধারনের প্রয়োজনীয় সরবরাহ করে এক মাঝি চার্লি, তার ‘আফ্রিকান কুইন’ নামক এক ছোট বোটে। ব্রিটিশ ও জার্মানির  যুদ্ধ আরম্ভ হলে চার্লি দু’ভাইবোনকে বলে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু  তারা সেই পরামর্শ কানে তোলে না। ফলে জার্মান সেনার হাতে রোজের দাদা অত্যাচারিত হয় এবং কিছুদিন পরেই মারা যায়। তারপর চার্লি রোজকে তার সেই ছোট বোটে নিয়ে পালিয়ে যায় এবং প্রতিজ্ঞা করে তারা অত্যাচারী জার্মানদের শিক্ষা দেবে। মূলত সেখান থেকে এই অ্যাডভেঞ্চার ছবি শুরু হচ্ছে। এবং শেষ হচ্ছে মৃত্যুদন্ডের মুখে দাঁড়িয়েও যখন বোগার্ট ও হেপবার্ন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিনেমাটা আপনাদের দেখা দরকার। বিশেষ করে চার্লি হিসেবে বোগার্টের ডাউন-টু-আর্থ মেক-আপ।       

মার্লন ব্রান্ডো (১৯২৪-২০০৪) যে কোন সমালোচকের পছন্দের তালিকায় একদম ওপরের দিকেই থাকবেন কারন স্তানিস্লাভস্কি-র ‘মেথড অ্যাক্টিং’-এর  একদম শুরুর দিকের উল্লেখযোগ্য অভিনেতা বললেই ব্রান্ডোর নাম আসতে বাধ্য। এই মেথড অ্যাক্টিং ব্যাপারটা সাধারণ অভিনয়ের থেকে খানিক আলাদা।  শিল্পের নিরিখে অভিনয়কে ‘আর্ট অব রিপ্রেজেন্টেশন’ হিসেবে দেখানো হয়, কিন্তু সেটাই মেথড অ্যাক্টিং ‘আর্ট অব এক্সপেরিয়েন্সিং’ হিসেবে তুলে ধরে। কোন এক  চরিত্রের অভিনয় ফুটিয়ে তোলার জন্য সচেতন-অবচেতন মনে সেই চরিত্রে ঢুকে যাওয়া, তাকে অনুভব করা, তার জন্য দরকার পড়লে সিনে কিছু অদলবদল ঘটানো, সেই হল মেথড অ্যাক্টিং। ব্রান্ডো সেই ঘরানার একদম প্রথম দিকের অভিনেতা। (আগের কয়েক পর্বে এখনকার যাদের অভিনয় নিয়ে লিখেছি, তাদের মধ্যে ডাস্টিন হফম্যান, রবার্ট ডি-নিরো, গ্যারি ওল্ডম্যান, কেট ব্ল্যাঞ্চেট এই মেথড অ্যাক্টিং-এর উল্লেখযোগ্য নাম। ভারতীয় অভিনেতা প্রয়াত ইরফান খানের অভিনয়ও মেথড অ্যাক্টিং।) ব্রান্ডোর মেথড অ্যাক্টিং ছড়িয়ে আছে অন্তত ৪০টা ছবিতে, যার মধ্যে আমার পছন্দ - এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার (১৯৫১), ভিভা জাপাটা (১৯৫২), জুলিয়াস সিজার (১৯৫৩), অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট (১৯৫৪), সায়োনারা (১৯৫৭), মিউটিনি অন বাউন্টি (১৯৬২), আগলি আমেরিকান (১৯৬৩), দ্য গডফাদার (১৯৭২), লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস (১৯৭২), অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ (১৯৭৯), এ ড্রাই হোয়াইট সিজন (১৯৮৯) ইত্যাদি। যদিও শেষদিকের সব ছবিতেই উনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। অলোচনার জন্য ওনার যে ছবি সমালোচকরা চোখ বুজে বেছে নেন, সেটার নাম ‘দ্য গডফাদার’। কারণ এই সিনেমায় ওনার দুর্দান্ত অভিনয় এবং সাহসের সঙ্গে  অস্কার পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া, দুটোই ছিল। কিন্তু আমি আজ বাছব কাজানের ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’, যেটা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয় গডফাদারের শেকড়  কোথায় লুকিয়ে। অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট আরো এক কারণে উল্লেখযোগ্য। এই ছবির থিম নিয়ে পরবর্তীকালে কত যে সিনেমা হয়েছে, সেটা গোনা যাবে না।  

টেরি মালয় একজন ফাইটার এবং বর্তমানে ডকে কাজ করে। জাহাজের ডকের  দুর্নীতিগ্রস্থ মালিক জনির বিভিন্ন অসাধু কাজ দেখে এবং এক নিরীহ কর্মীর খুন দেখে সে জনির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সাহসে ভর করে কোর্টে গিয়ে সাক্ষী দেয়। ফলে তাকেও চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। কিন্তু এবার কর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে, তারা টেরিকে না নিয়ে কাজে যাবে না ঠিক করে। টেরির নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়। এই ছবির মুখ্য পাওনা কাজানের পরিচালনা, ব্রান্ডোর অভিনয় এবং তার যোগ্য সঙ্গতে নবাগতা নায়িকা ইভা মারি সেইন্ট। একটা সিন এখনো মনে পড়ে। ডান ভুরু কাটা মেক-আপে পুরো ডকভর্তী লোকের সামনে ব্রান্ডোর সেই চিৎকার ‘ডু ইউ হিয়ার দ্যাট? আয়াম গ্ল্যাড হোয়াট আই হ্যাভ ডান’। পাওয়ারহাউজ। ওনাকে ছাড়া গডফাদার মানায় না।  

হলিউডের উত্তমকুমার যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে সেটা একমাত্র গ্রেগরি পেক (১৯১৬-২০০৩)। যেন নায়ক হবার জন্যই জন্মেছিলেন। ওনার নায়ক সত্ত্বা মাঝে মাঝেই ওনার অভিনেতা সত্বাকে ঢেকে দিয়েছে। মনে রাখার মত অনেক  সিনেমা আছে, কিন্তু তার ভেতরেও আমার বাছাই হল - দ্য কিইজ অব দ্য কিংডম (১৯৪৪), স্পেলবাউন্ড (১৯৪৫), দ্য ইয়ারলিং (১৯৪৬), ক্যাপ্টেন হোরেশিও হর্নব্লোয়ার (১৯৫১), ডেভিড অ্যান্ড বাথশিবা (১৯৫১), দ্য স্নোজ অব কিলিমানজারো (১৯৫২), রোমান হলিডে (১৯৫৩), মোবি ডিক (১৯৫৬), গানস অব নাভারোন (১৯৬১), কেপ ফিয়ার (১৯৬২) এবং টু কিল এ মকিংবার্ড (১৯৬২)। আজ এই শেষ ছবি নিয়েই আলোচনা করব।

অ্যাটিকাস ফিঞ্চ নামক এক উকিল, আলাবামার এক বিপত্নীক দু’সন্তানের বাবা, কোর্টে ডিফেন্ড করছেন এক কালো মানুষকে যার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে  ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এবং বাড়িতে তিনি সন্তানদের শেখাচ্ছেন কুসংস্কার থেকে দূরে থাকার জন্য। এই নিয়েই ‘টু কিল এ মকিংবার্ড’। কোর্টে উত্তমকুমারের জাজ হিসেবে ও উকিল হিসেবে ছবিগুলো যে যে পাঠকের পছন্দের তালিকায় একদম ওপরে, তাদের কাছে অনুরোধ এই সিনেমা দেখুন। মনোযোগ দিয়ে দেখুন একদম শেষদিকে কোর্টে পেকের সাড়ে ছ’মিনিটের একটানা সংলাপ (ক্লোজিং আরগুমেন্ট) যা মাত্র একটাই টেকে নেওয়া হয়েছিল, এবং মূলত যে অভিনয়ের জন্য পেক অস্কার পেয়েছিলেন। 

হলিউডের প্রাক-স্বর্ণযুগ প্রসঙ্গে একজনের কথা না বলে পারছি না। বাস্টার কিটোন (১৮৯৫-১৯৬৬)। স্ল্যাপস্টিক কমেডির প্রাণপুরুষ। আরেক প্রাণপুরুষ চার্লি চ্যাপলিনের কথা আমরা সবাই জানি। এমনকি ওনার ‘মডার্ন টাইমস’  আমি এক হলিউড ক্লাসিক হিসেবে এর আগে আলোচনাও করেছি। কিন্তু কিটোনের নিঃশব্দ ছবি নিয়ে কখনো কিছুই লিখিনি। বিশেষ করে কিটোনের ওয়ান উইক (১৯২০), কপ্‌স (১৯২২), শার্লক জুনিয়র (১৯২৪), দ্য জেনেরাল (১৯২৬) এবং দ্য ক্যামেরাম্যান (১৯২৮) অনবদ্য বললেও কম বলা হয়। এর ভেতর আমার ফেভারিট ‘দ্য জেনেরাল’ কারণএই সিনেমায় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ  অদ্ভুতভাবে কমেডির মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমার মতে এই সিনেমাও পৃথিবীর প্রথম ২০-২৫ ক্লাসিক লিস্টে থাকা উচিৎ। 

এইসব অভিনেতাদের পাশাপাশি গোটা পৃথিবীর স্বর্ণালী যুগের চারজন অভিনেতাকে বেছে নেব যাঁরা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। সেই হিসেবে  প্রথমেই এই তালিকায় আসবেন ফেলিনির পছন্দসই ইতালিয়ান অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রৈয়ানি, তারপর বার্গম্যানের প্রিয় সুইডিশ অভিনেতা ম্যাক্স ভন সিডো, সদ্যপ্রয়াত ফ্রেঞ্চ অভিনেতা জাঁ লুই তান্তিনিও, এবং এশিয়া থেকেও একজন আসবেন এই লিস্টে – কুরোশাওয়ার বেশিরভাগ ছবির জাপানি চরিত্রাভিনেতা তোশিরো মিফুনে।

মার্সেলো মাস্ত্রৈয়ানি (১৯২৪-১৯৯৬) বললেই ইতালির এমন এক অভিনেতাকে বোঝায় যিনি প্রায় ছ’দশক ধরে প্রায় ১৫০টি ছবিতে অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন।  ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অন্য এক কারণেও বটে – বিভিন্ন দেশের অভিনেতারা  খ্যাতি পাবার পরেই হলিউডের ডাকে সেখানে পাড়ি দিতেন, কিন্তু উনি কোনদিন সেটা করেননি। ইতালির অভিনেতা হিসেবেই থেকে গেছেন। মাস্ত্রৈয়ানি বললেই যে যে সিনেমা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হল - লা ডোলচে ভিটা (১৯৬০), ডাইভোর্স ইতালিয়ান স্টাইল (১৯৬১), লা নোটি (১৯৬১), দ্য অ্যাসাসিন (১৯৬১), এইট-অ্যান্ড-হাফ (১৯৬৩), ইয়েস্টারডে টুডে অ্যান্ড টুমরো (১৯৬৩), ম্যারেজ ইতালিয়ান স্টাইল (১৯৬৪), সানফ্লাওয়ার (১৯৭০), দ্য বিগ ফিস্ট (১৯৭৩), এ স্পেশাল ডে (১৯৭৭) ইত্যাদি। খুব প্রাণচঞ্চল অভিনেতা ছিলেন। সোফিয়া লোরেনের সঙ্গে আটখানা ছবিতে অভিনয় করে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। ওনার ‘লা ডোলচে ভিটা নিয়ে এই ধারাবাহিকের ১৩ নম্বর পর্বে আলোচনা করেছিলাম, সুতরাং আজ আর ওনার অন্য কোন ছবি নিয়ে লিখব না।

ম্যাক্স ভন সিডো (১৯২৯-২০২০) বললে আমার চোখে প্রথমেই দুটো ছবি ভাসে – বার্গম্যানের সুইডিশ ছবি ‘সেভেন্থ সিল’ আর উইলিয়ম ফ্রিডকিনের হলিউড ছবি ‘দ্য এক্সরসিস্ট’। সেভেন্থ সিলের সাহসী নাইট যে মৃত্যুর সাথে দাবা খেলছে  আর এক্সরসিস্টের সেই ধর্মযাজক যে অশুভ আত্মা তাড়াতে এসেছে। এক্সরসিস্ট আমার জন্মেরও আগের ছবি, কিন্তু তার ভয়াবহতা যেন প্রতি প্রজন্মকেই ভীত করে তোলে। আমি এই ছবি প্রথম দেখেছিলাম স্কুলজীবনে। সত্যি বলছি, একমাসের ঘুম নষ্ট হয়ে গেছিল। যাইহোক, যে যে সিনেমায় সিডো মনে রাখার মত কাজ করেছেন, সেগুলো - দ্য সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭), দ্য ভার্জিন স্প্রিং (১৯৬০), থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি (১৯৬১), উইন্টার লাইট (১৯৬৩), শেম (১৯৬৮), দ্য প্যাশন অব আনা (১৯৬৯), দ্য এক্সরসিস্ট (১৯৭৩), পেলে দ্য কনকারর (১৯৮৭) ও এক্সট্রিমলি লাউড অ্যান্ড ইনক্রেডিবলি ক্লোজ (২০১১)। এখান থেকে যে কোন একটা ছবি নিয়ে লেখা যায় কারন সবকটা ছবিই বেশ ভাল। কিন্তু কিছুদিন পরেই আমি প্রিয় পরিচালকদের নিয়ে আলোচনা করব, যেখানে বার্গম্যান থাকবেন। তখন এর ভেতর একটা ছবি বেছে নেব।

যিনি প্রায় পাঁচ দশকের বেশি সময় ফ্রান্সের ছবিতে অভিনয় করেছেন, ফ্রান্সের নব্য-বাস্তব ঢেউ বললে যার অভিনয় প্রথমেই ভেসে আসে, তিনি জাঁ লুই তান্তিনিও (১৯৩০-২০২২)। ওনার সেরা ছবিগুলো আমায় বাছতে বললে -  অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান (১৯৫৬), দ্য ইজি লাইফ (১৯৬২), এ ম্যান অ্যান্ড এ ওম্যান (১৯৬৬), দ্য গ্রেট সাইলেন্স (১৯৬৮), দ্য ম্যান হু লাইজ (১৯৬৮), মাই নাইট অ্যাট মডস্‌ (১৯৬৯), Z (১৯৬৯), দ্য কনফরমিস্ট (১৯৭০), দ্য লাস্ট ট্রেন (১৯৭৩), থ্রি কালারসঃ রেড (১৯৯৪), দ্য সিটি অব লস্ট চিল্ড্রেন (১৯৯৫) এবং অ্যামোর (২০১২)। দ্য কনফরমিস্ট নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু আরেকটা সিনেমা নিয়ে সামান্য একটু আলোচনা না করলে তান্তিনিওর কেরিয়ারের সেই মাইলস্টোন ছবি বাদ পড়ে যাবে - এ ম্যান অ্যান্ড এ ওম্যান। ক্লদ লুলুশের ১০২ মিনিটের রোমান্টিক ছবি। এক বিপত্নীক ও এক বিধবা, দুজনে তাদের বাচ্চাদের স্কুলে একে অপরকে দেখে ও প্রেমে পড়ে। কিন্তু প্রেম এগিয়ে চলার সাথে তাদের বিবাহিত জীবনের স্মৃতি তাদের প্রেমের পথে এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনবদ্য রং ও ক্যামেরার কাজ। কিন্তু এই ছবির আসল বাঁধুনি এর অভিনয়ে, যেটা খুব নিপুণভাবে নায়ক-নায়িকা ফুটিয়ে তুলেছেন। এই সিনেমার পরেই তান্তিনিওর নাম আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে।  

মাস্ত্রৈয়ানির জাপানি সংস্করণ বললে এককথায় তোশিরো মিফুনে-র (১৯২০-১৯৯৭) নাম উঠে আসবে। সারা জীবনে ১৫০-র বেশি সিনেমায় অভিনয়, কুরোসাওয়ার সঙ্গে ১৬টা ছবি এবং জীবনের বেশির ভাগ সময় জাপান ছেড়ে হলিউডে পা না বাড়ানো। অবশ্য, ৬০ বছর বয়সে উনি আমেরিকায় গিয়ে ‘শোগান’ নামক এক সিরিয়ালে অভিনয় করেছিলেন। মিফুনে প্রধান যে যে  ছবিতে অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন - ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল (১৯৪৮), রসোমন (১৯৫০), সেভেন সামুরাই (১৯৫৪), সামুরাই ট্রিলজি (১৯৫৪-৫৫-৫৬), থ্রোন অব ব্লাড (১৯৫৬), দ্য হিডন ফোর্ট্রেস (১৯৫৮), য়োজিম্বো (১৯৬১), হাই অ্যান্ড লো (১৯৬৩), রেড বিয়ার্ড (১৯৬৫), রেবেলিয়ন (১৯৬৭) ইত্যাদি। এর বেশিরভাগ ছবিতেই অবশ্য মিফুনে যোদ্ধার চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন যেটা তার স্বাভাবিক দক্ষতা ছিল। কুরোসাওয়া ছাড়াও উনি হিরোশি ইনাগাকির প্রচুর সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যদিও প্রায় সব সমালোচক ওনার রসোমন বা সেভেন সামুরাই নিয়েই আলোচনা করেন, আমার বাছাই কিন্তু ‘য়োজিম্বো’।  বুদ্ধিদীপ্ত থিম, কোন এক গ্রামে সাঞ্জুরো নামক এক সামুরাই (যোদ্ধা) এসে দেখেন সেখানে দুই ক্ষমতালোভী গ্যাং-এর ভেতর লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে সাধারণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। উনি ঠিক করেন এই দুই গ্যাং-কে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেবেন যাতে ওরা নিজেরা লড়াই করে শেষ হয়ে যায় আর সাধারণ মানুষ শান্তিতে থাকতে পারে। এখানে লড়াই ঝগড়ার খারাপ দিক ও ক্ষতিকর দিকগুলো কুরোসাওয়া নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যাতে সাধারণের মনে হিংসার ভয়াবহতা ভেসে ওঠে। মিফুনের অভিনয় অনবদ্য। সেই কর্কশ গলা, যা যোদ্ধা হিসেবে ওনাকে আরো গ্রহ্ণযোগ্য করে তোলে। এবং মিফুনের নিয়মানুবর্তিতা – রোজ সকাল ছ’টায় মেক-আপ সমেত সিনেমার সেটে পৌঁছে যাওয়া।    

তাহলে এই অব্ধি। সবাই পুজোর উৎসবের দিনগুলো আনন্দে কাটান। পুজোর পর আমরা আবার আলোচনার টেবিলে ফিরব স্বর্ণযুগের অস্তমিত নায়িকাদের অভিনয় নিয়ে। 

 

 

 


ব্র্যাড ওয়েইসম্যান

 

Ôএক কবির শোণিত (জাঁ ককতো, ১৯৩২)

(ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী)




১৯৬৩ সালে মৃত্যুর দুই বছর  আগে, বিখ্যাত ফরাসী কবি ও চলচ্চিত্রকার জাঁ ককতো ২০০০ সালের উদ্দেশ্যে ভাষণ শিরোনামে সেলুলয়েডে তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা ব্যক্ত করেন। এই আলোচনায় দৈনন্দিনের জাঁ ককতো এবং শিল্পী ককতোর ভেতর তিনি একটি সীমারেখা টানেন। এই আলাপনে তিনি বলেন, Ôএকজন কবি যেন সেই কাজের হাত যে তার নিজের চেয়েও গভীরতর কোন কর্মে লিপ্ত হয়, যে কাজ সে নিজেই খুব ভাল জানে না, এক রহস্যময় শক্তি তাকে অধিকার করে রাখে এবং যে শক্তি সম্পর্কে সে নিজেই ভাল জানে না!’

ককতোর অর্ন্তনিহিত এই দ্বিধা-বিভক্তি তাঁর ‘অর্ফিক ট্রিলজি’-র সিনেমা ত্রয়ীতে ফিরে ফিরে আসে। এবং এই ট্রিলজির প্রথম সিনেমাই হচ্ছে ‘এক কবির শোণিত বা লো স্যাং দ্যুন পোয়েত (Le Sang d’un poète- The Blood of a Poet) | ট্রিলজির বাকি দু’টো ছবি হচ্ছে Ô Orphèe-1950’ Ges ‘Le testament d’Orphée- 1960|Ô প্রতিটি সিনেমাতেই মৃত্যু যেন স্বপ্ন ও দৃশ্যরাজির রাজ্যের অপরিহার্য দুয়ার হয়ে দাঁড়ায়, আর সেই রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে ব্যক্তির সচেতন সত্ত্বাকে বাদ দিয়েই কেবল ঢুকতে পারা যাবে। ‘এক কবির শোণিত’ পরিচালক ককতোর নির্জ্ঞান মানসের অনিয়তাকার ভূদৃশ্যে প্রথম অভিযান, যেন বা মানব অবচেতনের পাতাল কুঠুরি খুঁড়ে সম্ভাব্য অর্থ দ্যোতনার মহামূল্যবান রত্নরাজি বের করে আনা। এই সিনেমায় প্রদর্শিত চিত্রকল্পগুলো  ককতোর কর্মজীবনে বারবার ফিরে আসবে। ফিরে আসবে আরো পরিশীলিত হয়ে।

ÔLe Sang d’un poète  নির্মাণের সময়ে ততদিনে ককতো ফরাসী সংস্কৃতির ‘বিপজ্জনক শিশু (enfant terrible)’ হয়ে উঠেছেন। কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট, নকশাকারসহ বহুমাত্রিক পরিচয়ে তিনি ইতোমধ্যেই পরিচিত। আধুনিক ফরাসী সঙ্গীত সুরকারদের দল ‘ছয়জনা - Les six’-কে তিনিই জনপ্রিয় করে তোলেন। এই ছয় সুরকার ছিলেন ওরিক, দ্যুরে, হোনেগের, মিলহৌদ, প্যুলেন্স এবং তেইলেফেরে। এঁদের মধ্যে ওরিক ‘এক কবির শোণিত‘-এর জন্য ওরিক সুর সৃষ্টি করেন। বস্তত: সিনেমার রাজ্যে ককতোর পথ চলতে আসা লুই বুনুয়েল এবং সালভাদর দালির শৈল্পিক প্রচেষ্টার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবে যারা কিনা বৈপ্লবিক দুই সিনেমা ‘আন্দালুসীয় সারমেয় ১৯২৯  (Un Chien Andalou), Ô এবং স্বর্ণ যুগ ১৯৩০ - L’age d’or’ বানিয়েছিলেন এবং এই সিনেমাদ্বয়ের কারণে দূর্বোধ্য এবং নিরীক্ষাধর্মী ছবির নির্মাতা হিসেবেও সমালোচকদের তকমা অর্জন করেছিলেন। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নির্মিত এই সিনেমাটি প্রদর্শিত হতে পরবর্তী ১৫ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যেহেতু ইতোমধ্যেই বুনুয়েল এবং দালির কাজ নিয়ে প্রচুর হৈ চৈ বা তর্জন-গর্জন শোনা যাচ্ছিল।

এক কবির শোণিত মূলত: একটি রূপকধর্মী আত্মজীবনী। ককতো এই ছবিকে ব্যখ্যা করেন ‘শুধুমাত্র নিজের গভীরে অবগাহন, না ঘুমিয়েই স্বপ্ন দেখার কৌশল ব্যবহার, যেন বা আঁকাবাঁকা একটি মোম যা প্রায়ই রহস্যময় ভাবে নিভে যায় এবং মানবদেহের নিশীথরাতে বাহিত হয়। সেখানে এ্যাকশনগুলো ইচ্ছা খুশি একে অন্যের সাথে সংযুক্ত এবং এতই দূর্বল এক নিয়ন্ত্রণাধীন যা কিনা কেউ কোনভাবেই মনে আনতে পারবে না এবং বিশেষত: অপ্রাকৃত ঘটনাবলীর বাস্তববাদী তথ্যচিত্র হিসেবে মনে ত’ আনা যাবেই না (জাঁ ককতো, দ্য ডিফিকাল্টি অফ বিয়িং, নিউইয়র্ক: মেলভিল হাউস পাব্লিশিং, ২০১৩, পৃষ্ঠা: ৪৫)। একরৈখিক কোন আখ্যান বলার আকাঙ্ক্ষামুক্ত হয়ে ককতোর  চিত্রকল্পরাজি গোটা স্ক্রিন জুড়ে ভাসে ও ঘুরে বেড়ায় এবং শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব, অভ্যন্তরীণ যুক্তির কাছেই যেন তারা নিবেদিত থাকে। ‘ইতিহাসের চেয়ে পুরাণকে আমি সর্বদাই শ্রেয়তর জ্ঞান করেছি যেহেতু ইতিহাস হচ্ছে সত্য দিয়ে গঠিত যা অবশেষে মিথ্যেয় পর্যবসিত হয়, যখন কিনা পুরাণ হচ্ছে মিথ্যে দিয়ে নির্মিত যা সবশেষে সত্যে পরিণত হয়,’ ককতো বলেন।  Ôএক কবির শোণিত’ কোন গল্প নয় বরং কিছু সারিবদ্ধ চিত্রকল্প যারা একটি অন্যটিকে প্রতিফলিত করে। এই সিনেমায় ককতোর নায়ক যে চিত্রশিল্পী (এনরিক রিভেরো নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন) একজন মহান সংগ্রামী। ক্রুদ্ধ এনরিক তাঁর নিজের আঁকতে থাকা একটি প্রতিকৃতির মুখ মুছে ফেললে (হয়তো নিজের আঁকা নিজের কাছেই পছন্দ হচ্ছে না বলে) দেখতে পান যে প্রতিকৃতিটি তাঁর হাতের তালুতে এসে জায়গা নিয়েছে এবং বাতাসের জন্য কাঁদছে। নিজেকে তখন তিনি নিজেরই হাত/মুখ দিয়ে স্পর্শ করেন যা মূলত: একটি আত্মরতিমূলক দেহভঙ্গি। সবশেষে তিনি প্রতিকৃতিটি মুছে একটি ধ্রুপদী ভাস্কর্যের গায়ে লাগালে সেই ভাস্কর্যের দেহে লাগানো প্রতিকৃতি তখন শিল্পীকে একটি পূর্ণাবয়ব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গভীরতর স্বপ্নরাজ্যে অবগাহণ করতে বলে। শুরুতে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও, শিল্পী একটি করিডোরে হামাগুড়ি দিয়ে এবং দরজার ফুটো দিয়ে নিষিদ্ধ বস্তু  দেখায় মত্ত হয়ে ওঠেন। আর এই দেখন প্রক্রিয়ার সময় শিল্পী যেন অন্ধকারে হারিয়ে যান।

কি দ্যাখেন এই শিল্পী? একজন মেক্সিকান বিপ্লবীর ফাঁসি হয়েছে, বারবার সেই বিপ্লবীর ফাঁসি হচ্ছে। চাবুক হাতে এক নারী একটি শিশুকে শেখাচ্ছে কিভাবে উড়তে হয়। এক পুরুষের ছায়ামূর্তিকে দেখা যাচ্ছে আফিম টানার পাইপ প্রস্তুত  করছে (ককতো নিজে সারাজীবন তাঁর আফিমের নেশার সাথে যুদ্ধ করেছেন)। নিশ্চল-গতি একটি ছবিতে অর্দ্ধ-জৈবিক, অর্দ্ধ-প্রতীকী জীবনমুখী পুষ্পসম্ভার দেখা যায়। পলায়নের এই চিত্রকল্গগুলো শিল্পীকে যেন আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায় যা অবশ্য তিনি পরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং উল্টে দেন, নিজের আত্ম-বিনাশী কাজগুলো রহিত করে নিজেরই যেন পুনর্জন্ম ঘটান।

শিল্পী এরপর অন্য দিকে তাঁর যাত্রা হতে ফিরে আসেন এবং ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফ্যালেন। ‘মূর্তি বা বিগ্রহ ভাঙা’র মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে নিজের মত হয়ে ওঠার ঝুঁকি নেয়, সিনেমাতে বলা হয় এবং তারপর ঠিক তেমনটিই ঘটতে থাকে। ভাস্কর্যটির পায়ের কাছে স্কুলবালকেরা খেলা-ধূলা ও বরফের ভেতর মারামারি করতে থাকে যতক্ষণ না একজন মারা যায়। সহসা এক ফিটফাট দম্পতিকে দেখা যায় মৃত বালকটির দেওে উপর তাস খেলতে ঠিক যেমন অপেরা দেখার বক্সে বসে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অপেরার দৃশ্যকেই উপেক্ষা করে যায়। পুরুষ তাস-খেলুড়েটি (আমাদের শিল্পী) মৃত বালকের পকেট থেকে হৃদয়চিহ্ন অঙ্কিত তাস বা টেক্কাটি বেরর এবং এক কালো দেবদূত এসে বালকটিকে ‘শুষে নেয়’ এবং বালকটি অন্তর্হিত হয়।

সবশেষে, নারী তাস-খেলুড়ে (আগে যে ভাস্কর্য ছিল) পুরুষটির হাত থেকে হৃদয়চিহ্ন অঙ্কিত টেক্কাটি নিয়ে নেয় এবং পুরুষটি নিজেই নিজেকে আবার গুলিবিদ্ধ করে। দর্শক-শ্রোতৃবর্গ করতালিতে ফেটে পড়ে। সবশেষে সেই  ভাস্কর্য/কাব্যলক্ষী বিশ্রামে চলে যান এবং একটি ভূ-গোলক ও একটি বীণা দোলাতে থাকেন আর ককতো একেই কিনা অভিহিত করেন ‘অমরতার নৈতিক শ্রান্তি’ হিসেবে।

এই সব চিত্রকল্প থেকে আমরা কি বুঝতে পারি? ককতো আমাদের সব কিছু ভেঙ্গে বলতে খুব আগ্রহী নন। তিনি লিখেছেন, এক কবির শোণিত স্বপ্ন বা প্রতীকরাজি থেকে কিছুই গ্রহণ করে না... এর ব্যখ্যা করতে গেলে অগণিত বিষয় ব্যখ্যা করতে হবে। আমাকে যদি সেসব প্রশ্নের একটিরও উত্তর দিতে হয়, তবে আমার পক্ষে সেই উত্তর দেয়াটা খুবই কষ্টকর হবে (জাঁ ককতো, টু স্ক্রিনপ্লেইজ: লন্ডন, মেরিওন বোয়্যার্স পাবলিশিং, ১৯৮৫)। একথা বলে কবি যেন দর্শকের মনে বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিটের মত কান্ড ঘটান। ‘এক কবির শোণিত’ মূলত: যেন এক ধাঁধাঁ যে তার নিজের শর্তেই টিঁকে থাকে, এক দিকে মুক্ত ও প্রসারিত এবং যে কোন ধরনের ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ বিরোধী। এই সিনেমাটি যেন এক দৃশ্যকাব্য যার  ছন্দ আছে তবে কোন যুক্তি নেই।

ককতো, যেন বা এক আনন্দময় আত্ম-বৈপরীত্যে, আরো বলেন, Ôএই ছবিটির সংক্ষিপ্ত- সার বলতে কিছু নেই। আমি নিজেই শুধু এর কিছুটা ব্যখ্যা দিতে পারতাম। আমি আপনাদের বলতে পারতাম যে কবি নির্জনতা তাঁর নিজের কাছেই এত গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি যখন বাঁচেন তখন এতই তীব্রতার সাথে কিছু সৃষ্টি করেন যে তাঁর কোন সৃষ্টির মুখ তাঁরই হাতে একটি ক্ষতের মত লেগে থাকে এবং তিনি সেই মুখটিকে ভালবাসেন, আসলে নিজেকে ভালবাসেন; সেই ভালবাসা এত পরম যে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি দ্যাখেন যে মুখটি এক আগন্তÍকের মত তাঁর দেহে সেঁটে আচে, এবং তখন তিনি মুখটির হাত থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা চালান এবং এটা তিনি করেন ভাস্কর্যটিতে মুখটি স্থাণান্তর করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে, এবং তখন এই ভাস্কর্যটি জীবন্ত হয়, প্রতিশোধ নেয়, এবং তাঁকে ভয়ানক সব অভিযানের দিকে ঠেলে দেয়। আমি আপনাদের বলতে পারতাম যে বরফের গোলা নিয়ে বালকদের এই মারপিট আসলে কবির ছোটবেলা এবং যখন কবি খ্যাতি অথবা তাঁর ভাগ্যের সাথে তাস খেলছেন, তখন তিনি তাঁর শৈশব থেকে কিছু এনে প্রতারণা করছেন যা আসলে বরং তাঁর নিজের কাছ থেকেই নেয়া উচিত ছিল। এরপর আমি আপনাদের আরো বলতে পারতাম যে নিজস্ব পার্থিব খ্যাতি অর্জনের জন্য কবি যখন চেষ্টা করছিলেন, তিনি মূলত: Ôঅমরতার মরণশীল ক্লান্তি’র ঘেরে নিক্ষেপিত হয়েছিলেন এবং কবি এসময় অনুরুদ্ধ হয়েছেন প্রতিটি বিখ্যাত সমাধি বা কবর দ্বারা। এবং আপনাদের একথাগুলো বলাটা আমার ঠিক হবে, এবং ভুলও হবে, যেহেতু এই কথাগুলো ঘটনাবলী এবং দৃশ্যকল্পসমূহের পরে লেখা কোন পাঠ্যবস্ত হবে... যদি আমরা প্রত্যেকে এই ছবিতে যার যার নিজস্ব অর্থ খুঁজে পাই, তাহলে আমি বিবেচনা করব যে আমার উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে  (জাঁ ককতো, At the Theatre du Vieux-Colombier, January 1932, via the Wellington Film Society) |Ô

প্রায় ৫৫ মিনিটের এই ছবির পরিচালনা, চিত্রনাট্য রচনা ও সম্পাদনা করেছেন জাঁ ককতো এবং আবহ সঙ্গীত নির্দেশ করেছেন জর্জেস ওরিক। অভিনয় করেছেন এনরিক রিভেরো, লি মিলার, বারবেত্তে, পলিন কার্টন।

 

 


দেবলীনা চক্রবর্তী

 

সলমন রুশদি এবং স্বাধীনতার ৭৫ বছর

 

(তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ, অমর উজালা)  




ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর মহা সমারোহে উৎযাপন করা হলো সারাদেশে ‘অমৃত মহোৎসব’ নামে। ঠিক একই সঙ্গে বিশ্বের বহু আলোচিত ঔপন্যাসিক ও  সাহিত্যিক সলমন রুশদি তাঁর জীবনের ৭৫ বছর উৎযাপন করছেন, যখন সারা সাহিত্যমহল তাঁর নোবেল পুরস্কারের ঘোষণার অপেক্ষায়, ঠিক তখনই তাঁকে  আহত হতে হলো এক অমানবিক অশালীন ও কট্টরপন্থী সমাজের হাতে। 

১৯৪৭ সালে ১৯ জুন মুম্বাই শহরে জন্মেছিলেন স্যার আহমেদ সলমন রুশদি। তিনি জন্মসূত্রে একজন কাশ্মীরি মুসলিম পরিবারের ছিলেন। তিনি নিজেকে 'মিডনাইটস্ চিলড্রেন' বলে চিহ্নিত করেন। আসলে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসের নাম 'মিডনাইটস্ চিলড্রেন' যেখানে ১৯১৫ থেকে ১৯৭৭ সালের ভারত চিত্রিত। এই ঐতিহাসিক উপন্যাসে ভারতের স্বাধীনতা এবং ওই তিন দশকের মধ্যবর্তী সময়ের ইতিহাস, মুখ্য ঘটনাবলী এবং সেই সময়ের ব্যক্তিত্ব সমূহকে একত্রিত করেছেন। এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র আচার ফ্যাক্টরিতে কাজ করা শ্রমিক সেলিম শিনাই এবং তার তিন প্রজন্মের জীবন ও অনুভব প্রকাশিত হতে হতে পাঠককে পৌঁছে দিয়েছে শ্রীনগর, অমৃতসর, আগ্রা, মুম্বাই ও করাচী এই সব জায়গায়। তার সাথে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেমন - ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ক্যাবিনেট মিশন, দাঙ্গা, মুসলিম লীগ, জলিওয়ানাবাগ হত্যাকান্ড, পাকিস্থান যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন - সব কিছুর বর্ণনা আছে।

আসলে এই আত্মকথাত্মক ম্যাজিকাল রিয়ালিজম উপন্যাস তাঁকে এক উত্তরৌপনিবেশিক সাহিত্যের প্রধান উপন্যাসকারের মর্যাদায় উন্নীত করেছে এবং এরপরই তিনি ১৯৮১ সালে বুকার পুরস্কার পান। ১৯৯৩ সালেও এই উপন্যাসের জন্যই আবার বুকার ওফ বুকার্স সম্মানে ভূষিত করা হয়। এমনকি ২০০৮ সালে তাঁকে বেস্ট অফ বুকার সম্মান ও ব্রিটেন তাঁকে 'স্যার' উপাধি দেয়।

উপরিউক্ত উপন্যাস ছাড়া সলমন রুশদির ঝুলিতে আরো যে মণিমুক্ত আছে  তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য স্যালিমার দ্যা ক্লাউন, শেম, দ্যা গ্রাউন্ড বেনেথ হার ফিট, গোল্ডেন হাউস, দ্যা সেটনিক ভার্সেস প্রভৃতি। তাঁর লেখা কমপক্ষে ৩০টি বইয়ের মধ্যে ফিকশন, নন-ফিকশন, উপন্যাস,  এমনকি ছোটদের জন্য লেখা বইও আছে। তিনি নিজের ছেলের জন্য হারুন অ্যান্ড দ্যা সী ওফ স্টোরিস লিখেছেন।

ব্যঞ্জনাপূর্ণ কাব্যিক ও যুক্তিপূর্ণ হাস্যবোধের নিরিখে নিজের কথা বলতে সক্ষম  রুশদি তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্যা সেটনিক ভার্সেস’ ১৯৮৮ সালে ব্রিটেনে ও ১৯৮৯ সালে আমেরিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরই সাহিত্য ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক হট্টগোল শুরু হয়ে যায় এবং সাথে সাথে তার নামে ফতোয়া জারি হয়, করেছিলেন ইরানের তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা রুহোল্লা খোমেইনি। অপরাধ ‘ধর্মদ্রোহ’। খোমেইনি মারা গিয়েছেন, কিন্তু ‘ফতোয়া’ জারি থেকেছে  বছরের পর বছর। সলমনের মাথার দাম রাখা হয়েছে প্রায় ৩০ লক্ষ ডলার। তাঁর জীবন সংশয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। তাঁকে এই কারণে ঠিকানা বদল করতে হয়  বারবার এবং জীবন সুরক্ষার জন্য নজরবন্দিও থাকতে হয়। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি, সর্বসমক্ষে রুশদির ওপর হামলা হয়, ছুরিকাঘাত করা হয়।

স্পষ্ট লেখনীর জন্য প্রশংসিত রুশদি ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘সে সময়ে ইসলাম তেমন কোনও বিষয় ছিল না। কেউ অত ভাবতও না। এখন যেটা হয়েছে, পশ্চিমের মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল। বইটা সম্পর্কে সত্যিই ভুল বোঝা হয়েছিল। সত্যি, লন্ডনের দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের নিয়ে লেখা”। এক বিখ্যাত সংবাদ মাধ্যমের আলাপচারিতায় তাঁকে প্রশ্ন করা হয় যে, তিনি কি ধর্মে বিশ্বাসী নন?

উত্তরে তিনি বলেন: “মিডনাইটস্ চিলড্রেন-এর এক ঠাকুরদার চরিত্রের মতো  তিনিও মনে করেন। উপন্যাসে ঠাকুরদা বলেন যে, ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে, কারণ তাঁর অন্তরে যেখানে ঈশ্বরের বাস ছিলো সেখানে ধীরে ধীরে ছিদ্র দেখা যাচ্ছে”।    

“আসলে আমি এটা কখনোই বলি না যে ধর্ম আমার জীবনে কোন গুরুত্বপূর্ণ  বিষয় নয়, কিন্তু আমি একদমই ধার্মিক নই”।

তিনি তাঁর বিতর্কিত উপন্যাস সমন্ধে বলেছেন –“আমাকে যদি এই উপন্যাস সম্বন্ধে কিছু বলতে বলা হয়, তাহলে এক লাইনে এই কথাই বলবো - এটি  সম্পূর্ণ রূপে রূপান্তরের কথা, পরিবর্তনের কথা। এই পরিবর্তন হলো যখন সমাজ এমন কোন বদলের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায়, তখন তার প্রভাব ব্যক্তি, জাতি ও তার সংস্কৃতির ওপর পড়ে, আর এখানে সেইরকম পরিবর্তনের কথাই বলা হয়েছে”।

তিনি তাঁর আলাপচারিতার শেষে তাঁর বিরোধিতার সময়ের বিভীষিকাময় দিনের  কথা উল্লেখ করে ব্যথিত হয়েছিলেন।

 

 

 

 

 


শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

নকশাল আন্দোলন ও ভারতবর্ষের ছাত্র-রাজনীতি




"প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা" - সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই লাইনটি আজও ঘোরে ছাত্রদের মুখে মুখে, আজও উঠে আসে প্রতিবাদীর পোস্টারে। মূলত সত্তরের দশকে এই ধরনের নানা প্রতিবাদী কবিতা সৃষ্টি করেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। শুধু কবিতাই নয়, সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্যের অন্যান্য উপাঙ্গও। সাহিত্য যে চিরকালই  সমাজের দর্পণ তা তো আমরা বারবার দেখে এসেছি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে।  কিন্তু বিরল ঘটনা হলো, সত্তরের দশকের একটা আন্দোলন কীভাবে আজ  পঞ্চাশ বছর পরেও প্রাসঙ্গিক? অথবা বলা যায়, একটি গণ অভ্যুত্থান কীভাবে সমগ্র দেশের রাজনৈতিক চেহারাটা পাল্টে দিল? হ্যাঁ, আমি বলছি নকশাল  আন্দোলনের কথা - স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষে মনে হয় এরকম ব্যাপক আন্দোলন আর সংগঠিত হয়নি, যেখানে সর্বস্তরের মানু্ষ, বিশেষ করে যুব ও ছাত্রসমাজ সমগ্র আন্দোলনের অভিমুখটাই বদলে দেয়।

৫০এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ৬০এর দশকের প্রথম দিকে খাদ্য আন্দোলনের হাত ধরে দীনেশ মজুমদার, বিমান বসু, শ্যামল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ছাত্র নেতারা  উঠেছিলেন ঠিকই, তবে সমগ্র ছাত্র সমাজের মধ্যে এই আন্দোলন সেইভাবে  ছড়িয়ে পড়েনি। তার অনেক কারণের অন্যতম হলো তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নমনীয় মনোভাব ও সংশোধনবাদ তত্ত্ব। ১৯৬৬ সালের আগে বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন বলতে একমাত্র ছিল AISF এবং ধীরে ধীরে খাদ্য আন্দোলন এবং সমসাময়িক কিছু রাজনৈতিক পরিস্থিতির সূত্র ধরেই এই AISF এর মধ্যেই আদর্শগত বিভাজন দেখা যায়। একদল বা পুরনো পন্থীরা সংশোধন বাদের  উপরই আস্থা রাখে, অন্য দল ধীরে ধীরে গণ আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের পথ বেছে  নেয়। এর চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৬৬ সালের ২২-২৩শে সেপ্টেম্বরে বাংলা বন্ধে। ৬৬এর মার্চ মাস থেকেই বেশিরভাগ ছাত্র সমাজের মধ্যে দ্রুত রেডিক্যালাইজেশন দেখা যায় এবং এর প্রভাব পড়তে থাকে শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যেও। তখনও CPM তৈরী হয়নি, এরা মূলত left CPI নামেই পরিচিত ছিল, যারা অনেক বেশী মিলিট্যান্ট ছিল।  



সেই সময় এলিট কলেজ ছিল প্রেসিডেন্সি এবং প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের মধ্যে এই রেডিক্যালিজিমটা অনেক বেশী ছিল। এছাড়াও ছিল সিটি, বঙ্গবাসী, সুরেন্দ্রনাথ।  এইসব ছাত্র ছাত্রীরা অংশ নেয় ২২-২৩ সেপ্টেম্বরের বাংলা বন্ধে। আর এইসব কলেজের ছেলে মেয়েদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে দলে দলে বাকী কলেজগুলিও অংশগ্রহণ করে এবং ধীরে ধীরে এই আন্দোলন আরও জঙ্গিরূপ নেয়। ছাত্র  ছাত্রীরা শুধু যে এই আন্দোলনকে কলেজ প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ রাখে তা নয়, এটা প্রথমে ছড়িয়ে যায় শহরের অসংগঠিত শ্রমিক সমাজের মধ্যে, যেমন প্রথম প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা কলেজ স্ট্রিটের বই কর্মীদের নিয়ে ইউনিয়ন বানায় এবং বিভিন্ন দাবী দাওয়া পেশ করা শুরু করে। শুধু এই নয় এই ছাত্র ছাত্রীরা ধীরে ধীরে ছোট কল-কারখানাগুলিতে গিয়েও সংগঠন বানাতে থাকে এবং এইসব ঘটনা কিন্তু নকশালবাড়ির আগে থেকেই হতে শুরু করে। এই সব আন্দোলনে  নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন অমল সান্যাল, অসীম চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব হালিম  রণবীর সমাদ্দার প্রমুখ ব্যক্তিরা। তৎকালীন সরকার আন্দোলনের বিশৃঙ্খলা বিশেষত কমিউনিস্ট মনোভাব দেখে এইসব ছাত্রদের কলেজ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আন্দোলনের তেজ আরও বেড়ে যায় এবং যা ভবিষ্যতে ছাত্র  যুব বিদ্রোহী আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। এরপর যুক্তফ্রন্ট সরকার আসার পর ছাত্র বহিষ্কার রদ করা হয়, যা ছাত্রদের মনোবল আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট বিরোধী মনোভাব দেখা যায় যখন ক্ষমতায় এসে তারা ছাত্র আন্দোলন বন্ধ করতে চাইল, যারা সরকারের আসার আগে পর্যন্ত ছাত্রদের বাহবা দিচ্ছিল তাদের এই মনোভাব ছাত্র সমাজ ঠিক মেনে নিতে পারলো না। আর আগেই বলেছি তখন রেডিক্যালিজিম মানেই CPIM, ছাত্ররা যাদের খুব কাছের মনে করত, কিন্তু সরকারে আসার পর এহেন আচরণে তারা কিছুটা বিক্ষুব্ধ হলো। সারা বাংলায় ছাত্ররা যেভাবে সংগঠন তৈরী করছিল ও বলা ভালো যাদের হাত ধরে ৬৬র ঐতিহাসিক বাংলা বন্ধ সাফল্য পেল, তারা হঠাৎ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে যাওয়াটা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। এর ফলে ছাত্ররা ধীরে ধীরে আরও রেডিক্যাল হয়ে উঠল এবং এর সঙ্গে অনুঘটকের কাজ করলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ। Cpim সরকারে এসে সশস্ত্র আন্দোলন থেকে সরে আসা এবং নেতৃত্বের মিশ্র মনোভাবে ছাত্রদের একটা বড় অংশ মনে করলো পার্টি সমঝোতা করছে।

পার্টির মিশ্র মনোভাবের দরুন নেতৃত্বের এক অংশ বেরিয়ে All india  coordination committee of communist revolutionaries তৈরী করলেন,  যার মধ্যে ছিলেন চারু মজুমদার, শিবকুমার মিশ্র, এস তিওয়ারি, বিহারের  সত্যনারায়ণ সিংহ প্রমুখ। এঁরা পার্টি স্ট্রাকচার ফিরিয়ে আনতে চাইলেন এবং সমস্ত ইলেকশন, ট্রেড ইউনিয়ন বয়কটের ডাক দিলেন, যেখানে মিলিটান্ট ছাত্র  সমাজ বেশ কিছুটা অক্সিজেন পেল। বিশেষত নকশাল আন্দোলনের যে জনপ্রিয়তা একটা overehelming socio structural reformation বা mass movement সেটা ছিল মূলত ৬৭-৭০ সাল পর্যন্ত, এটাকে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। বিশেষ করে ৬৮ সালের ম্যাকানমারা বিক্ষোভের সময় ছাত্র রাজনীতি যেভাবে উত্তাল হয়ে পড়ল স্বাধীন ভারতে তার নজির বড়ই কম। এরপর আসে সেই ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি যখন ক্ষমতায় ছিল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। নকশালবাড়ির পর এই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় বাংলার বিভিন্ন গ্রামে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডেবরা ও গোপীবল্লভপুরের আন্দোলন। সন্তোষ রানা ছিলেন সেইসময় মেদিনীপুরের এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তাঁর কাছ থেকে জানা যায় তৎকালীন সরকার চাইছিল এই আন্দোলন খানিকটা দমিয়ে দিতে। বলাই বাহুল্য, সমঝোতা করতে চারুবাবু বা কানু সান্যালরা মেনে নিতে পারেননি। সিপিএম-এর উদ্দেশ্য ছিল জবরদখল জমি ফিরিয়ে নেওয়া, তার বদলে সরকার  সমস্ত সাহায্য করবে। কিন্তু নকশাল নেতৃত্ব তা কিছুতেই মানতে চাননি।  তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার দেখা করেছিলেন চারু মজুমদারের সাথে,  এই মর্মে সঙ্গে ছিলেন দেবব্রত বন্দোপাধ্যায় land reform secretary হিসেবে।

এই নকশালবাড়ি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রচুর স্কলাররা যোগদান করেন। বিশেষ করে চারুবাবুর লেখা এইট মোনোগ্রাফ বা আটটি চিঠি যা ছিল নকশালদের একমাত্র রুলবুক সেইসময়ে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতের মত দরিদ্র প্রধান দেশের আর্থ সামাজিক রূপরেখা পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ  দলিলও বটে। এই মহান আদর্শকে পাথেয় করে দিকে দিকে ছাত্র যুবকরা এই  আন্দোলনে যোগদান করে। সিপিআই ও সিপিআইএম বিপুল সংখ্যক কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র যুবকরা নকশাল আন্দোলনের শরিক হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ সহ ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত এলাকায়। দক্ষিণ ভারতে এই আন্দোলনের মূলত নেতৃত্ব দেন ভেম্পাতাপু সত্যনারায়ণন, নাগী রেড্ডি এবং  পোলা রেড্ডি। বিহারে এই আন্দোলন মূলত ছড়িয়ে পড়ে ১৯৭০ সালে জগদীশ মাহাতোর হাত ধরে যিনি মাস্টার সাহেব নামে বিখ্যাত ছিলেন। মূলত ৭০ সালের পর এই আন্দোলনের জঙ্গি রূপ বেড়ে যেতে শুরু করে এবং কেন্দ্রীয় সরকার তথা ইন্দিরা গান্ধীর সরকার মিলিটারি নামিয়ে হোয়াইট টেরর শুরু ক’রে  নকশালিদের মারতে থাকে। রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে অত্যাচার করে হত্যা করা হয় চারু মজুমদারকে এবং সরকার তার শবদেহ দাহ করে রাত ফুরানোর আগেই। তাঁর বাড়ির লোক পর্যন্ত থাকতে পারেননি তাঁর শেষকৃত্যে।  আস্তে আস্তে নকশাল নেতৃবৃন্দ তথা কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল সবাই অ্যরেস্ট হওয়ায় কিছুটা দিশাহীন হয়ে পড়ে এই আন্দোলন। ৭২ সালের পর থেকে cpi(ml) ভেঙে অনেক ছোট ছোট পার্টি তৈরী হয় বিভিন্ন জেলায় এবং তারা আজও নিম্নবিত্ত, দলিত ও দরিদ্র শ্রেণীর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের ২১টি রাজ্যে তাদের সংগঠন বিস্তৃত হয় এবং মনে করা হয় ভারতের ভৌগলিক এরিয়ার ৪০ শতাংশ অঞ্চলে বিভিন্ন ভাবে তাদের সংগঠন আছে। ৯২০০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে তারা রেড করিডোর স্থাপন করেছে।



অত্যধিক জঙ্গি মনোভাব এবং নেতৃবৃন্দের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে ৭০-৭১ সালের পর এবং যা তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও সুবিধা করে দেয় এই আন্দোলন দমনের। কিন্তু চারু মজুমদারের নীতি বা আদর্শ, তিনি যে শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা তৎকালীন ছাত্র যুবককে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছে তা ভারতবর্ষে কোনো  রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার পর করতে পারেনি। এই আন্দোলন মুখ থুবড়ে  পড়লেও আন্দোলনের কারণ বা সদিচ্ছা মানুষের মধ্যে চিরকালীন। শুধু  সেইসময় বলে নেয় এই ৬৭-৭০এর আন্দোলন আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতির অভিমুখ পরিবর্তন করে দেয় পরবর্তীকালে। ছাত্ররা মূলত রাজনীতিতে উৎসাহিত হয় এবং দেশের স্বার্থে রাজনীতিতে যোগদানের উপযোগিতা অনুভব করে মূলত নকশাল আন্দোলন এর পর থেকেই। পরবর্তী কালে বামফ্রন্ট সরকার গঠন করায় ছাত্র রাজনীতির ভিত্তি প্রস্তর সুদৃঢ় হলেও সমগ্র দেশে এর বীজ বপন হয় এই নকশাল আন্দোলনের প্রভাবেই। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাধীনতার পর প্রথম ও এখনো অব্দি শেষ বিপ্লব এই নকশাল আন্দোলনই, যেখানে ব্যাপক হারে গণ অভ্যুত্থান দেখা যায়। সুতরাং  বলাই বাহুল্য, এই আন্দোলন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে আপাত ব্যর্থ হলেও আগামীর জন্য যে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিয়ে গেছে, সে কথা অনস্বীকার্য।


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরেজী ছবি – দ্বিতীয় পর্ব


১৯৬৩-র ডিসেম্বরে স্কুলে প্রথম শ্রেণীর বাৎসরিক পরীক্ষা শুরু হবে। নভেম্বরে, মা লিখছেন, আমার টার্জান-প্রীতি দেখে মন অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য আমায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই পূর্ণতে, রবিবার সকালে Scaramouche ছবির অসাধারণ তরোয়াল-খেলা দেখাতে।[1] রাফায়েল সাবাতিনির ১৯২১ সালের উপন্যাসের ওপর আধারিত ১৯৫২ সালের এই জমাটি ছবিটি অবশ্য উৎস-আখ্যান থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে, যা জেনেছি ১৯৭০/৭১ সালে ছবিটির পুনর্মুক্তির সময় বইটি পড়ে, যদিও ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপট দুটিতেই আছে। ৬৩-তে সঙ্গে ছিলেন মা, মাসিমা, আর দাদা। সত্তরের দশকে মেট্রোতে আবার দেখলাম বাবা-মা’র সঙ্গে। ঐ একই দশকে এক রবিবার সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রেক্ষাগৃহে তৃতীয়বার ‘স্ক্যারামুশ’ দেখলাম, মা ও এক খুড়তুতো দাদার সঙ্গে। ছবির চরম সময়ে নায়ক অঁদ্রে ও প্রতিপক্ষ দ্য মেইনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ নাকি চলচ্চিত্রে দীর্ঘতম, প্রায় সাত মিনিট ধরে, যা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে হয়! চাইলে ইউ-টিউবে এই যুদ্ধ দেখে নিতে পারেন।

তবে, সেই ১৯৬৩-তে, মূল ছবির আগে তো সেই টার্জানের ছবির ট্রেলরঃ Tarzan’s Fight for Life (১৯৫৮)! টার্জান লড়ছে এক প্রকাণ্ড অজগরের সঙ্গে! কিন্তু বিধি বাম! দাদা গম্ভীরভাবে বললেন, ওটা দেখানো হবে রবিবার ৮ তারিখে, আর তোমার পরীক্ষা শেষ সোমবার ৯ই! অতএব দেখা হবে না! সে দুঃখ ঘুচলো ৮০-র দশকে ব্রিটিশ টেলিভিশনে ছবিটি দেখে!

১৯৬৪ সালে দাদা ও আমার এক কাকার সঙ্গে লাইটহাউসে দেখলাম আমার প্রথম হারকিউলিসের ছবি, Hercules in the Center of the Earth (১৯৬১, এখন ছবিটি Hercules in the Haunted World নামেই বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়)।[2] হারকিউলিস (অভিনয়ে রেগ পার্ক) থিসিয়াসের সঙ্গে নরকে যাচ্ছেন বিস্মৃতির পরশপাথর আনতে যা দিয়ে তাঁর প্রায়-অচেতন প্রেমিকা ডিয়ানিরার চেতনা ফেরানো যাবে। প্রতিপক্ষ রাজা লিকো (রূপায়নে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সারুমান আর কাউন্ট ডুকু, আর আমাদের কাছে ড্র্যাকুলা-রূপে-খ্যাত অসামান্য অভিনেতা ক্রিস্টোফার লী)। পরিচালক মারিও বাভা। দাদা নাক সিঁটকে রেগ পার্ক সম্বন্ধে বললেন, “স্টীভ রিভসের কাছে কিস্যু না!” পরে স্টীভ রিভসকে হারকিউলিস-রূপে দেখব।

হারকিউলিস সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়ে এবার দাবী করলাম, ঐ লাইটহাউসেই (নাকি তার পাশে নিউ এম্পায়ারে?) আমাকে Jason and the Argonauts (১৯৬৩) দেখানো হোক। জেসন কিভাবে সুবর্ণ ভেড়ার লোম উদ্ধার করবে, তার গল্প, তার দলে আছেন হারকিউলিস (যদিও এখানে তিনি পার্শ্বচরিত্র)। কোন অজ্ঞাত কারণে (ছবিটি নাকি ভালো হয়নি!) আমার ইচ্ছে মঞ্জুর হলো না। বরং মাসতুতো বড়দার সঙ্গে পাঠানো হলো সেই পূর্ণতে স্যর ওয়ালটার স্কটের উপন্যাস-আধারিত ১৯৫২ সালের Ivanhoe দেখতে। আচ্ছা, বিদেশী ছবির একটা ব্যাপার কি আমার সমবয়সী পাঠকদের, ছোটবেলায় আমার যেমন অস্বস্তিকর লাগত তেমনই লাগেনি? একাধিক চুম্বনদৃশ্য! ‘আইভানহো’তে তো বটেই, এর আগে ‘স্ক্যারামুশ’ও বড়দের সঙ্গে বসে দেখতে এই কারণে কিরকম যেন লাগতো! এখনকার দর্শকরা হয়তো এ কথা শুনে খানিকটা কৌতুকই বোধ করবেন! ‘আইভানহো’র তারকা সমাবেশ কিন্তু দেখার মতোঃ রবার্ট টেলর, জোন ফনটেন, এলিজাবেথ টেলর, এবং প্রতিপক্ষের চরিত্রে জর্জ সান্ডার্স! ভালো কথা, সত্তরের দশকে মিনার্ভায় (পরে ‘চ্যাপলিন’) Jason and the Argonauts দেখার সাধ মিটিয়েছিলাম একাই!

১৯৬৪ বছরটি আমার ইংরেজী সিনেমা দেখার ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ! বাংলা ছবি দেখার স্মৃতিচারণে বলেছি যে আমার প্রথম দু-বার দেখা ছবি ছিল ১৯৬০-৬১-তে শেষ পর্যন্ত । এই ৬৪-তে দাদা স্কুলের ‘ফাদার’-এর কথা শুনে আমায় নিয়ে গেলেন লাইটহাউসে ১৯৬২ সালের ছবি Hatari দেখতে! ছবির তিনটি ‘চরিত্র’ আমার ঘুম কেড়েছিলঃ অভিনেতা জন ওয়েন, এবং তিনি যে গাড়িতে আছেন সেটি ঢুঁ মেরে ওল্টাবার প্রচেষ্টারত দুটি গণ্ডার! এদের মধ্যে গণ্ডার-দুটিই প্রাধান্য পেয়েছিল অনেকদিন ধরে! প্রথম দেখার পর আবার পাশের নিউ  এম্পায়ারে যাই বাবার সঙ্গে গণ্ডার-দর্শনে! ১৯৬৬-তে বসুশ্রী সিনেমায় রবিবার সকালে বাবার সঙ্গে তৃতীয়বার ছবিটি দেখি। এরপর সত্তরের গোড়ার দিকে ‘হাটারি’ পুনর্মুক্তি পায় ‘এলিট’ সিনেমায়। আবার গেলাম বাবার সঙ্গে! আবার ৭৩/৭৪-এ মিনার্ভায় পঞ্চমবার! ৯ই ডিসেম্বর ১৯৬৪ তারিখ দিয়ে মা’ লিখেছেন যে ‘মাথায় হাটারির বীজ পুঁতে গেছে, এবার গাছ গজাবে।’ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫-তে মা লিখছেন যে মন্ত্র পড়ে গণ্ডারকে দেবতা বানিয়ে পূজাও করা হয়েছে। ‘রাত্রে শোবার সময়, “নমঃ গণ্ডারং – ভূতের হাত থেকে বাঁচাও গণ্ডার,” বলে শোয়!’ ঐ বছরে আমার জন্মদিনের কেকের ওপর একটি ছোট গণ্ডারের আকৃতি রেখে বাবা আমায় চমকে দিয়েছিলেন! ছবিটি এত হিট করেছিল যে ত্রিকোণ পার্কের উল্টোদিকে সেই সময় ‘হাটারি’ নামে যে রেস্তোরাঁটি খোলা হয়েছিল, তা মনে হয় আজও আছে!

ছবির কথা অনেক হলো, আরও হবে। এবার প্রেক্ষাগৃহ-সম্বন্ধে কিছু বলি। লাইটহাউসে দেখলাম প্রথমে চকোলেট-রঙের পর্দা সামনে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেটা দু-দিকে দু-ভাগ হয়ে সরে গেলো, সামনে এলো বিশেষ ‘ডিজাইন’-করা,  লাল আলোয় উদ্ভাসিত আরেকটি পর্দা, আর বেজে উঠলো এক বিশেষ signature tune। মানে, প্রদর্শনী এবার শুরু হবে। সুরটি শেষ হলেই লাল পর্দা দু-দিকে সরে গিয়ে শো শুরু হতো – বিরতির আগে এবং বিরতির পরেও, মূল ছবি শুরুর আগে এই একই ভাবে দুটি পর্দা আর সুরের ইঙ্গিত চলতো। লাইটহাউস, নিউ এম্পায়ার, এবং চৌরঙ্গীর ওপর টাইগার – এই তিনটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল একক মালিকানাধীন, নাম ‘হুমায়ুন থিয়েটার্স’। লাইটহাউস ছিল সবচেয়ে বিলাসবহুল, হলের মধ্যে মেঝের ঢাল ছিল স্ক্রীনের দিকে উঁচু, সেখান থেকে ঢাল ছিল নীচের দিকে। লাইটহাউসের দো-তলায় একটি পথ ছিল যা দিয়ে পাশের নিউ এম্পায়ারে যাওয়া যেত। নিউ এম্পায়ার ছিল অপেক্ষাকৃত কম বিলাসবহুল, একটিই লাল-আলো-ফেলা ডিজাইন করা দু-ভাগ হয়ে যাওয়া পর্দা দিয়ে স্ক্রীন ঢাকা থাকত। আর স্ক্রীনের পেছনে ছিল মঞ্চ। অনেক সময়, রাতের শো বাদ দিয়ে হতো নাটক বা সঙ্গীত/নৃত্যানুষ্ঠান। সবচেয়ে অভিনব ব্যাপার, অন্যান্য সিনেমা-হলে সবচেয়ে সস্তা আসন (তখনকার ভাষায় ‘দশ আনার সীট’) থাকতো একেবারে স্ক্রীনের সামনে। নিউ এম্পায়ারে এই আসনগুলি ছিল তিনতলায়! তাই, ইংরেজী ছবি দেখার জন্য এই হলের মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের বাঁধা ১ টাকা ৪০ পয়সার সীট নিউ এম্পায়ারে খানিকটা মহার্ঘ হয়ে যেত। টাইগার ছিল সস্তার হল – বেতের চেয়ার, মাথার ওপর ঘুরতো পাখা। লাইটহাউস-নিউ এম্পায়ারের মতো শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণের বালাই ছিল না! সাধারণত, লাইটহাউস, নিউ এম্পায়ারে হয়ে যাওয়া ইংরেজী ছবিই টাইগারে পুনর্মুক্তি পেত, যেমন পেয়েছিল ‘হাটারি’। এছাড়া দেখানো হতো অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে আগে হয়ে যাওয়া ইংরেজী ছবি। টাইগারেও একটি ডিজাইন-করা পর্দা ছিল – আর স্ক্রীন সাধারণ চতুষ্কোণ থেকে ‘সিনেমাস্কোপে’ পরিণত হবার সময় টাইগারের স্ক্রীন জোরে ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ করে উঠত! Signature tune অন্য দুটি হলের মতোই বাজত। লাইটহাউস, অন্যান্য সিনেমা-হলের মতো দো-তলা, সবচেয়ে দামী আসন ছিল দ্বিতলে। ত্রিতলিকা নিউ এম্পায়ারের কথা আগেই বলেছি। টাইগার ছিল একতলা!

 



[2] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=47481032