কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১০৮   

 

আজ সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি অভিনব সংবাদ আমাকে এক অভূতপূর্ব ভাবনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। জীবন সম্পর্কিত ধারণায় একটি নতুন দিগন্তের ইশারা উঁকি মেরে গেল। এবং আজ ৯ নভেম্বর দুপুর দেড়টার সময় কালিমাটি অনলাইন ১০৮ সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে বসে সেই সংবাদটা এড়িয়ে যেতে পারলাম না।

ঘটনাটা রাজস্থানের ভরতপুরের। দুটি চরিত্র। মীরা ও কল্পনা। দুজনেই নারী। মীরা ছিলেন একটি স্কুলের শারীরশিক্ষার শিক্ষিকা এবং কল্পনা তাঁরই ক্লাসের ছাত্রী। আমরা এর আগে বিভিন্ন ঘটনা সূত্রে জেনেছি ও শুনেছি, শিক্ষক ও ছাত্রীর মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রণয়ের সঞ্চার হয়েছে, বস্তাপচা নীতিকথার তোয়াক্কা না করে তারা পরস্পরকে ভালোবেসেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে বিয়েও করেছে। বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের সম্পর্ক নিন্দিত হতো, তাদের সমালোচনা করা হতো, আবার এমনও হয়েছে, পাত্রপক্ষ ও পাত্রীপক্ষ এই সম্পর্ক মেনে নিতেও অরাজী ছিল। এখন অবশ্য ব্যাপারটা আদৌ কোনো জটিল সমস্যা নয়, এমন বহু সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সমাজ তাতে আর বিরোধিতা করেনি। কিন্তু শিক্ষিকার সঙ্গে ছাত্রীর সম্পর্ক! অর্থাৎ সমকামিতার সম্পর্ক! আমরা সবাই জানি যে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই তা ছিল নিতান্তই অবৈধ সম্পর্ক এবং আইনের বিচারে দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমরা পড়েছি, আমরা জানি, যখনই যে আয়তন অচল হয়ে যায়, তখন সেই অচলায়তনকে ভেঙে ফেলতে হয়। এবং বলা বাহুল্য, বিশ্বের ইতিহাস সেই ভাঙনের যাবতীয় তথ্যকে নিজের বুকে বেঁধে রেখেছে। সাধারণভাবে একটি কথা প্রচলিত আছে, যেখানে যত বাধা, সেখানে তত প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। আর এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে কোনো বাধাই সামলাতে পারে না। আর পারে না বলেই, বিশ্বে বিভিন্ন দেশে, সম্প্রতি আমাদের দেশেও সমকামিতা আর অবৈধ নয়। দন্ডনীয় অপরাধ নয়। কিন্তু আইনের বিচার সমাজ মানতে বাধ্য হলেও তাকে সহজে স্বীকৃতি জানাতে পারে কই? আর তাই এখনও আমাদের দেশে সমকামি সম্পর্কের কথা বা ঘটনা শুনতে পেলেই সাধারণ মানুষের মনে একটা বিতৃষ্ণা জাগে, স্বাগত জানাতে দ্বিধা জাগে। আর সমকামি বিয়ে তো এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশের আইনে স্বীকৃত নয়, যদিও বিশ্বের অনেক দেশেই আইনত স্বীকৃত।

আর এখানেই এসেছে রাজস্থানের ভরতপুরের ঘটনায় এক নতুন মোড়। যেহেতু সমকামি বিয়ের সম্পর্ক এখনও বে-আইনী আমাদের দেশে, দন্ডনীয় অপরাধও বটে, তাই কল্পনার সঙ্গে প্রণয়সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য, বাধ্য হয়ে, মীরাকে তার  লিঙ্গ পরিবর্তন করতে হয়েছে, তাকে নারী থেকে পুরুষ হতে হয়েছে, মীরা নাম মুছে ফেলে তাকে আরভ কুন্তল নামে পরিচিতি অর্জন করতে হয়েছে। আর তারপরেই কল্পনার সঙ্গে আরভের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষত মীরার এই লিঙ্গ পরিবর্তনে কল্পনা অস্ত্রপচারের সময়ে আরভের সঙ্গেই ছিল বরাবর। এবং কল্পনা একথাও সাংবাদিকদের জানিয়েছে, সে মীরাকে ভালোবেসেছে এবং বিয়ে করতে চেয়েছে। মীরা যদি লিঙ্গ পরিবর্তন করে আরভ না হতো, তাহলেও সে মীরাকেই বিয়ে করত। এবং এখন মীরাই যেহেতু আরভ, তাই সে আরভকে বিয়ে করেছে।

আমি নিশ্চিত রাজস্থানের ভরতপুরের এই ঘটনার কথা ইতিমধ্যে অনেকেই জেনেছেন। কিন্তু তাঁরা কি একথাটা কখনও ভেবে দেখেছেন, মীরা অথবা আরভ, একই ব্যক্তিমানুষ, সে ভালোবেসেছে কল্পনাকে। যখন সে মীরা ছিল তখনও ভালোবেসেছে, আবার আরভ হয়েও ভালোবেসেছে। অন্যদিকে, কল্পনা, ভালোবেসেছে সেই ব্যক্তিমানুষকে, যে একদা মীরা অর্থাৎ মহিলা ছিল এবং পরবর্তীতে আরভ অর্থাৎ পুরুষ হয়েছে। সুতরাং ব্যক্তিমানুষ কিন্তু বদলায়নি, একই আছে, তাহলে কেন তাদের পারস্পরিক প্রণয় সম্পর্কের মাঝে সমাজ এবং আইনের বিচারে বিপত্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে? আমার আরও প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি কোনো ব্যক্তি মানুষকে বিচার করব তার শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কেন্দ্র করে? সে পুরুষাঙ্গের অধিকারী, অথবা স্ত্রী-অঙ্গের অধিকারী, তার ওপর ভিত্তি করে? নাকি আমরা কোনো ব্যক্তিমানুষকে বিচার করব তার শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিন্তা-ভাবনা, মেধা ও বোধের পর্যালোচনা করে? কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার মধ্যে সমাজ নাক গলায় কোন অধিকারে? কোনো পুরুষ বা মহিলাকে তার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য কেন বাধ্য করা হবে লিঙ্গ পরিবর্তন করতে? আমরা কেন ভুলে যাই, প্রতিটি পুরুষ ও মহিলার বুনিয়াদি পরিচয়, সে মানুষ? এবং শুধু পুরুষ বা মহিলাই নয়, সমাজে বিশেষিত প্রতিটি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিও মূলত মানুষ! আর প্রতিটি মানুষেরই থাকে একটা মস্তিষ্ক, এবং সেই মস্তিষ্ক ‘মন’ নামে একটি অনুভূতিকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। সেই মনের চাওয়া-পাওয়া যারা বোঝে না, বিদ্রুপ করে, অপরাধ বলে মনে করে, প্রশ্ন জাগে, তাদের মানসিক বিকাশ কি আদৌ হয়েছে? নাকি তারা এখনও অপরিণত অবস্থায় আছে?

 

অগ্রহায়ণের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই সবাইকে।   

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

 

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী ২৫  




এই পর্ব থেকে আবার আমাদের বিশ্বভ্রমণ শুরু হচ্ছে। যে যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গার  ছবি আমরা এখনো অব্ধি একেবারেই ছুঁইনি, এবারে আমি সেইসব জায়গাগুলো একে একে আলোচনায় আনার চেষ্টা করব। দেখুন, এ পর্যন্ত আমরা এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অফ্রিকা – এই সব মহাদেশ  কোন না কোনভাবে অলোচনায় এনেছি (সব জায়গা নয়)। কিন্তু ছুঁয়েও দেখিনি শুধু অস্ট্রেলিয়া। তাই এই পর্বে আমরা অস্ট্রেলিয়ার ছবি নিয়ে আলোচনা করব।

অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া, নিউ গিনি আর কিছু ছোট দ্বীপপুঞ্জ – এই নিয়ে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ। এবং আপনারা নিশ্চয় জানেন যে অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি থাকা সত্বেও নিউজিল্যান্ড কিন্তু কোনভাবেই এই মহাদেশের অংশ নয়। নিউজিল্যান্ড (এবং বিশ্বের আরো কিছু দ্বীপ) পৃথিবীর কোন মহাদেশেরই অংশ নয়। কিন্তু আমাদের আলোচনার সুবিধের জন্য আজ আমরা এই আলোচনায় নিউজিল্যান্ডকেও টেনে নেব।

আমি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের প্রায় ৩০টা মত ছবি দেখেছি। নিউ গিনি বা তাসমানিয়ার কোন ছবিই দেখিনি। অতএব এই মহাদেশের ছবি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা কম। সেই কম অভিজ্ঞতা নিয়েই আজকের আলোচনা। প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার যে যে ছবির নাম উল্লেখ করতেই হয় – ওয়াক অ্যাবাউট (১৯৭১), পিকনিক অ্যাট হ্যাঙ্গিং রক (১৯৭৫), ব্রেকার মোরান্ট (১৯৮০), গ্যালিপলি (১৯৮১), ক্রোকোডাইল ডান্ডি (১৯৮৬), প্রুফ (১৯৯১), দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব প্রিসিলা (১৯৯৪), বেব (১৯৯৫), শাইন (১৯৯৬), দ্য ক্যাসল্‌ (১৯৯৭), চপার (২০০০), মুলা রুজ (২০০১), ল্যান্টানা (২০০১), র‍্যাবিট প্রুফ ফেন্স (২০০২), টেন ক্যানোজ (২০০৬), অস্ট্রেলিয়া (২০০৯), এনিমাল কিংডম (২০১০), টুমেলা (২০১১) ও দ্য গ্রেট গ্যাটস্‌বি (২০১৩)। এবং নিউজিল্যান্ডের – দ্য পিয়ানো (১৯৯৩), হেভেনলি ক্রিচারস (১৯৯৪), হোয়েল রাইডার (২০০২) ও বয় (২০১০)। এর থেকে আজ আমরা অস্ট্রেলিয়ার চারটে ও নিউজিল্যান্ডের দুটো ছবি বেছে নেব। তবে ক্রোকোডাইল ডান্ডি বা অস্ট্রেলিয়া-র মত বক্স অফিস হিট ছবি আমি বাছব না, আমার বাছাই হবে জীবন ও আর্ট হাউজের মিশ্রণ।  সেই লিস্টে থাকবে - ওয়াক অ্যাবাউট (১৯৭১), ব্রেকার মোরান্ট (১৯৮০), প্রুফ (১৯৯১) ও র‍্যাবিট প্রুফ ফেন্স (২০০২) [অস্ট্রেলিয়া] এবং দ্য পিয়ানো (১৯৯৩) ও হোয়েল রাইডার (২০০২) [নিউজিল্যান্ড]।

তবে শুরুর আগে একটা কথা। ওপরের ছবির লিস্ট দেখে আপনারা ভাবতেই পারেন যে সত্তর থেকে নব্বই দশক অব্ধি এত ছবির নাম কেন? এবং কেন তার আগেকার কোন ছবির নাম নেই? আসলে, ইউরোপে যে নব্য বাস্তব সিনেমার ঢেউ এসেছিল চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে, অস্ট্রেলিয়ায় সেটাই এসে লাগে সত্তরের দশকে – স্থায়ী হয় নব্বইয়ের দশক অব্ধি। এবার নিশ্চয় বুঝেছেন আমার এই লিস্ট বানানোর কারণ। অস্ট্রেলিয়ার নিউ ওয়েভ ছবির একটা অংশ জুড়ে আছে  ওখানকার আদিবাসী বা অ্যাবঅরিজিনাল মানুষদের আদিম জীবন ও তাদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ মানুষের পার্থক্য। সেটা আমাদের লিস্টেও বুঝতে পারবেন। 

একদম শুরুর দিকের অস্ট্রেলিয়ান নিউ-ওয়েভ ছবির কথা বললে ‘ওয়াক অ্যাবাউট’-এর কথা আসে। নিকোলাস রোগের ১০০ মিনিটের ছবি। বেশির ভাগ শুটিং হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গল ও পরিত্যক্ত অঞ্চলে যাকে ওখানে আউটব্যাক বলা হয়ে থাকে। সিডনি শহরের এক কিশোরী ও তার ভাই স্কুল ছুটির পর তাদের বাবার সঙ্গে এইরকম এক আউটব্যাকে বেড়াতে আসে। কিন্তু সেখানে আসার পর হঠাৎ তাদের বাবা তাদের দিকে এলোপাথারি গুলি ছুঁড়তে থাকে। কিশোরী তার ভাইকে নিয়ে পাহাড়ে গিয়ে লুকোয়। সেখান থেকে দেখে তাদের বাবা তাদের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে নিজেকে গুলি করে মেরে ফেলে। সে এই কথা তার ভাইকে বলতে পারে না কারণ তার নাবালক ভাই এই পুরোটাই একটা খেলা ধরে নিয়েছে। কিন্তু এবার তো বাড়ি ফিরতে হবে। সেই পরিত্যক্ত জংলা অঞ্চল থেকে চিনে ফিরতে গিয়ে তারা রাস্তা হারিয়ে ফেলে। পথিমধ্যে দেখা হয় এক আদিবাসী কিশোরের সঙ্গে। ওদের আকারে ইঙ্গিতে বলা হাত মুখে নড়া দেখে  সেই আদিবাসী কিশোর তাদের সঙ্গে পথ চলতে থাকে, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে। নিজে ক্যাঙারু বা মোষ শিকার করলে এদের তার ভাগ দেয়। একদিন সেই কিশোর তাদের আদিবাসী প্রথায় সারাদিন নেচে এই কিশোরী মেয়েটিকে প্রেম নিবেদন করে, সঙ্গম করার অনুমতি চায়। মেয়েটি বুঝতে না পেরে ভয়ে এক ভাঙা ছাউনির ভেতরে ঢুকে যায়। সারাদিন নাচার পর আদিবাসী কিশোর একে নিজের অপমান হিসেবে দেখে আত্মহত্যা করে। তার দেহ গাছে ঝুলতে থাকে। পরের দিন ভাই-বোন হাঁটতে হাঁটতে এক ফেলে দেওয়া খনির কাছে আসে। সেখানে কোন একজন তাদের শহর যাবার রাস্তা বলে দেয়।

এই ছবির প্রথম পাওনা হল কিশোরীর ভূমিকায় ১৭ বছরের জেনি অ্যাগুটারের দারুন অভিনয়। কৈশোরের চঞ্চলতা ও বয়ঃসন্ধির লজ্জা, এই দুয়ের মিশেল তার চরিত্রে। দিদি হিসেবে ভাইকে বাঁচানোর আকুলতা। পরের পাওনা নিকোলাস রোগের পরিচালনা ও ক্যামেরা। এই ছবিতে দুটোই উনি সামলেছেন। সিনেমার প্রয়োজনে কিছু বিতর্কিত শট্‌ করা দরকার ছিল, সেগুলো উনি নির্দ্বিধায় করেছেন। সভ্য মানুষ ও অসভ্য মানুষের সংজ্ঞার সীমারেখা মুছে দিয়েছেন। বক্স অফিসে এই ছবি খুব খারাপ করেছিল, কিন্তু আজ এই সিনেমা পৃথিবীর সেরা ছবিগুলোর অন্যতম। 

৮০ এবং ৮১ সালে অস্ট্রেলিয়ার দুই বিখ্যাত সিনেমা ‘ব্রেকার মোরান্ট’ ও ‘গ্যালিপলি’ যুদ্ধের আবহ নিয়ে বানানো। দুই সিনেমাই দর্শকের কাছে টানটান  উপস্থাপন। কিন্তু সামাজিক মনস্তত্ব ও ড্রামা হিসেবে ব্রেকার মোরান্ট-কে খানিক এগিয়ে রাখতেই হয়। ১৯০২ সালে ব্রিটিশ মিলিটারিতে তিনজন অস্ট্রেলিয়ান লেফটেনান্টের কোর্ট মার্শাল এবং ফাঁসি হয় – হ্যারি মোরান্ট, পিটার হ্যানকক ও জর্জ উইটন। এদের দোষ ছিল যে এরা অ্যাংলো-আফ্রিকান যুদ্ধের সময় বেশ কয়েকজন আফ্রিকান নিরীহ মানুষকে খুন করে। এদের বিচারের সময় এরা একবারও দোষ অস্বীকার করেনি, বরং ঐ মানুষদের কেন মারা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছিল। এক সত্যি ঘটনা অবলম্বনে টানটান এই সিনেমায় এই তিন ফাঁসির আসামী লেফটেনান্টদের অস্ট্রেলিয়ান হিরো ও শহীদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। দুর্দান্ট কোর্টরুম ড্রামা, উত্তেজনা এবং বেশ গোছানো আর্গুমেন্ট। যদিও ঐতিহাসিক কিছু বিচ্যুতি আছে, কিন্তু সিনেমা হিসেবে দারুন। এক কথায় যা যুদ্ধের সার্বিক অপ্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেয়। এক প্রশ্ন খাড়া করে – যুদ্ধের সময় নীতিকথা বলতে কী বুঝব?  

ব্রেকার মোরান্ট আমার ভাললাগা ছবির তালিকায় আরো এক কারণে। এর  সিনেমাটোগ্রাফি। ১০৭ মিনিটের এই ছবির লং শট, প্যানোরামিক শট, ক্লোজ শট এবং ফোকাসড্‌ শট, ক্যামেরার অ্যাঙ্গল - বেশ ভাল। কিছু সিনে রঙের কনট্রাস্ট এবং সিনে এগিয়ে যাবার গতি ভাল লাগে। সবশেষে, শক্তিশালী অভিনয়ের কথা না বললে এই ছবির প্রতি অবিচার হবে। কোর্ট মার্শালে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে ‘we shot them under rule 3-0-3’ বলা – এডওয়ার্ড উডওয়ার্ডের এই অভিনয় ভোলা যায় না।

প্রুফ ছবির পাওনা এর অদ্ভুত থিম। উপরি পাওনা হুগো উইভিং ও রাসেল  ক্রো’র ফাটাফাটি অভিনয়। হুগো এখানে এক অন্ধ ফটোগ্রাফারের ভূমিকায়। সে ছোটবেলা থেকেই সন্দিহান। তার মনে হয় আশেপাশের সবাই তার অন্ধত্বের সুযোগ নিচ্ছে। হয় তাকে ঠকাচ্ছে নয় তাকে দয়া করছে। বড় বয়সে সে তার চারপাশের ছবি তোলে, কাউকে জিজ্ঞেস করে সেখানে কী দেখা যাচ্ছে। তারপর  ছবিটা ব্রেল অক্ষরের সাথে লিখে রাখে। এগুলো তার ভবিষ্যতের ‘প্রুফ’ হিসেবে রাখতে ভালবাসে। হুগোর পরিচারিকা সিলিয়া এইসব কাজে হুগোকে সাহায্য করে এবং হুগো তার সান্নিধ্য উপভোগ করে। কিন্তু একদিন এদের দুজনের মাঝে এসে উপস্থিত হয় রাসেল। ব্যস্‌, সিনেমা জমে যায়।

জসলিন মুরহাউজের ৮৬ মিনিটের এই ছবি উপভোগ্য। প্রতি চরিত্রে চ্যালেঞ্জ। মনস্তত্ব। মানুষের সঙ্গে মানুষের জটিল সম্পর্ক। অন্ধত্ব সত্বেও প্রতি চরিত্রকে খুব কাছাকাছি পর্যবেক্ষন। শুধুমাত্র মনস্তাত্তবিক থিমের জন্যই এই ছবিকে সেরা অস্ট্রেলিয়ান ছবির দৌড়ে রাখতেই হবে।

আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, দেশের তরুণদের জীবনের সঠিক অর্থ  বোঝানোর জন্য এবং সহিষ্ণুতা শেখানোর জন্য আমি কী কী সিনেমা দেখতে বলব, তাহলে আমার তরফ থেকে একটা নাম অবশ্যই হবে ‘র‍্যাবিট প্রুফ ফেন্স’।  শুধু নিউ-ওয়েভ সিনেমা নয়, এই ছবি অস্ট্রেলিয়ার এক হারিয়ে যাওয়া অমানবিক প্রথার জীবন্ত দলিল। আদিবাসী (অ্যাবঅরিজিনাল) বাচ্চাদের নিয়ে বিশ শতকের শুরু থেকে মোটামুটি ষাটের দশকের মাঝামাঝি অব্ধি অস্ট্রেলিয়ার কী নির্মমতা চলেছে, এই ছবি দেখলে তা খানিক বোঝা যায়। এই ছবি নেওয়া  হয়েছে ডোরিস পিলকিংটনের ‘ফলো দ্য র‍্যাবিট প্রুফ ফেন্স’ নামক উপন্যাস  থেকে, যা এক সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা। লেখিকার মা এবং তার আরো দুই বোনকে, সবাই আদিবাসী, ছোটবেলায় তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এক সেটলমেন্ট ক্যাম্পে। উদ্দেশ্য, শ্বেতাঙ্গ পরিবারের কাজের মেয়ে হিসেবে তাদের তৈরি করা। কিন্তু সেই তিনটি মেয়ে সেই ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসে। তারা প্রায় ন’সপ্তা ধরে ১৬০০ মাইল হেঁটে আবার তাদের  ঘরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। এই দীর্ঘ সময় তারা অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত খরগোশ আটকানোর কাঁটাতারের বেড়া ‘র‍্যাবিট প্রুফ ফেন্স’ বরাবর হাঁটে। দীর্ঘ দুর্গম পথ। এই নিয়েই সেই উপন্যাস। এবং উপন্যাসের ছায়ানুসারে ফিলিপ নয়েসের দেড় ঘন্টার এই বিখ্যাত ছবি।

সোজাসাপ্টা সিনেমা। আদিবাসী বাচ্চাদের ভাল অভিনয়। এবং আউটডোর ক্যামেরার কাজ। এই তিনে মিলে এই ছবিকে অস্ট্রেলিয়ান ছবির কিংবদন্তী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।  

এবার নিউজিল্যান্ডের ছবি ‘দ্য পিয়ানো’। এক মূক যুবতী আদা এবং তার  নাবালিকা মেয়ে ফ্লোরা স্কটল্যান্ড থেকে দীর্ঘ জাহাজ যাত্রা শেষ করে নিউজিল্যান্ডের এক সমুদ্রতটে এসে পৌঁছয়। তাদের সঙ্গে তাদের জিনিষপত্র এবং এক পিয়ানো। আসলে আদা এক পিয়ানোবাদক। নিউজিল্যান্ডের ধনী ব্যবসায়ী স্টুয়ার্টের কাছে স্ত্রী হিসেবে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেই নতুন স্বামীর কাছে বহু বছরের বোবা আদা তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে। উদ্দেশ্য, এক উন্নত জীবনযাত্রা। কিন্তু সেখান পৌঁছনোর পর আদা তার পিয়ানো শিক্ষকের সঙ্গে এক অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পরে।

সাহসী থিম ও হোলি হান্টারের অস্কার পুরস্কার পাওয়া অভিনয়। কিন্তু শুধু সেটাই এই ছবির একমাত্র পরিচয় নয়। এর আসল কাজ লুকিয়ে আছে সিনেমাটোগ্রাফি-তে। ভাবুন, সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে এক বড় নৌকোয় পিয়ানো আনা হচ্ছে। কখনো ঢেউ পিয়ানো ঢেকে দিচ্ছে, আবার তা দেখা যাচ্ছে। হোলি পিয়ানো বাজানোর সময় তার শিক্ষক তার পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করছে, যেটা শরীর থেকে দু’ফুট দূরে রাখা ক্যামেরার ১৮০ ডিগ্রি ঘোরানো ক্লোজ শটে  অনায়াসে উঠে আসছে। পিয়ানোর রিড বরাবর ক্যামেরা ঘুরতে ঘুরতে একটা রিড ফাঁকা। কাট্‌। আর বারবার সমুদ্রের তীরে রাখা সেই পিয়ানোর মোটিফ। জেন ক্যাম্পিয়নের প্রায় দু’ঘন্টার এই সিনেমা আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। উপভোগ করেছি গ্রীক ভাস্কর্যের মত আদরের দৃশ্যগুলোও। আপনারাও দেখুন।

নিউজিল্যান্ডের অ্যাবঅরিজিনাল বললে মাওরি সম্প্রদায়। তাদের রীতি-নীতি, বহু শতকের কুসংস্কার। আর সেই কুসংস্কার ভাঙতে বদ্ধপরিকর তাদেরই এক কিশোরী মেয়ে। এই নিয়ে ‘হোয়েল রাইডার’। মাওরি সম্প্রদায়ের নেতা হয়  একমাত্র ছেলেরা। কিন্তু এক মাওরি কিশোরী ‘পাই’ তার জমজ ভাই মারা যাবার পর ১২ বছর বয়সে নেতা হবার জন্য তার ঠাকুমা ও কাকার সাহায্যে ট্রেনিং নিয়ে নিজেকে তৈরি করে ফেলে। তার রক্ষণশীল দাদুকে মানিয়ে নিলেই সে এবার নেতা হতে পারে। কিন্তু তার জন্য দরকার শক্ত কিছু পরীক্ষা পাস করা। তারপর?

নিকি কারো-র ১০১ মিনিটের সিনেমা এর প্রধান চরিত্র কিশা ক্যাসল হিউজেসকে (পাই-এর ভূমিকায়) মাত্র ১৩ বছর বয়সেই স্টার বানিয়ে দিয়েছিল। সিনেমার শুটিং হয়েছিল হোয়াঙ্গারা নামক এক জায়গায়, যেখানে মাওরি-রা থাকে, এবং অকল্যান্ডে। নেতা হিসেবে তুলে ধরার জন্য ক্যামেরা পাই-কে ঠিক মাঝখানে রেখে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ঘুরেছে। নিচু অ্যাঙ্গল থেকে পাই-এর ছবি তুলেছে যখন পাই কিছু বলছে। ক্লোজ শটে পাই-এর কান্না দেখিয়ে তাকে মানুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চেয়েছে। একটা গোষ্ঠীর ভেতর প্রত্যাশা,  মতপার্থক্য ও হতাশা, এমনকি জেনারেশন গ্যাপ-এর দৃশ্যও ক্যামেরার চোখ এড়ায়নি।

কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মনে হয় পাঠক-পাঠিকার নিশ্চয় এতক্ষণে চোখে  পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া এবং বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডে মহিলা পরিচালক ও ছবির মুখ্য চরিত্রে মহিলার প্রাধান্য। এর কারণ নিউজিল্যান্ডের আইন। নিউজিল্যান্ড  পৃথিবীর প্রথম দেশ যেখানে মহিলাদের সমানাধিকার দেওয়া হয়েছিল। ১৮৯৩ সালে এই দেশে মহিলাদের ভোটদানের অধিকার দেওয়া হয় এবং ১৯১৯ সালে মহিলাদের পার্লামেন্টে যাবার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সালে এদেশে এক আদিবাসী মাওরি মহিলা এম-পি হয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়াও এ ব্যাপারে খুব একটা পিছিয়ে নেই। এক সমালোচক হিসেবে তাই ইচ্ছে করেই আমি এই মহাদেশ ও দেশের মহিলাদের কিছু উল্লেখযোগ্য সিনেমা আনন্দের সঙ্গে সামনে রাখলাম।   

(ক্রমশ)  

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরজী ছবি : চতুর্থ পর্ব  






 

কলকাতায় আরও ৭০ মিমির প্রেক্ষাগৃহের উদ্ভবঃ এলিট

 

ষাটের দশকের মাঝামাঝি দাদা একদিন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডের ‘এলিট সিনেমায় Becket ছবিটি দেখে এসে বললেন, “জানিস, ‘এলিট’টাও ৭০ মিমি করছে!” এলিটে প্রথম কয়েকটি দেখা ছবি ৩৫ মিমিই ছিল, অবশেষে ১৯৬৬-তে বাবা-মা’র সঙ্গে রাত্রীর শোতে দেখি ৭০ মিমির হাসির ছবি, ১৯৬৫ সালের The Great Race। আরম্ভেই পর্দায় লেখা ফুটে উঠল For Mr Laurel and Mr Hardy! আমি তো দারুণভাবে উৎসাহিত! ঐ জুটি ততদিনে আমার অতি প্রিয় হয়ে উঠেছে! মোটর গাড়ির ‘রেস’, নিউ ইয়র্ক থেকে প্যারিস, মূল দুই প্রতিযোগী দুঃসাহসিক সব খেলা দেখিয়ে বিখ্যাত লেসলী (ভূমিকায় টোনি  কার্টিস) আর তার প্রতিপক্ষ পাগল বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারক প্রোফেসার ফেট ও তার আজ্ঞাবহ ম্যাক্স (ভূমিকায় জ্যাক লেমন ও পিটার ফক) – এই দুই চরিত্রই লরেল-হার্ডি অনুপ্রাণিত। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাহসী মহিলা সাংবাদিক ম্যাগী দুবোয়া (অভিনয়ে ন্যাট্যালি উড)। ১৯০৮ সালে অনুষ্ঠিত বাস্তবিক এরকম একটি মোটর-দৌড় ছবির কাহিনীর উৎস। সাম্প্রতিক-দেখা যন্ত্রণাদায়ক ৭০ মিমি ছবি Lawrence of Arabia (৪র্থ পর্ব দেখুন)-র পর এই মজার ছবিটি ছিল তাজা হাওয়ার ঝাপটা! দ্বিতীয়বার ছবিটি কয়েকদিন পরেই আবার দাদার সঙ্গে এলিটে দেখি। দাদা তো উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, “আবার দেখব! এত ভালো!” কাহিনির দ্বিতীয়ার্ধে মোটামুটি মিনিট-কুড়ির মধ্যে যে ভাবে বিখ্যাত, এবং ততদিনে অন্তত তিনবার হলিউডে চলচ্চিত্রায়িত, The Prisoner of Zenda-র (আমাদের ঝিন্দের বন্দী) পুরো ঘটনাসমূহ হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে তা’ ছবির অন্যতম আকর্ষণ। সত্তরের দশকে ছবিটি তৃতীয়বার দেখেছিলাম বাবার সঙ্গে, তবে এবার প্রেক্ষাগৃহ ছিল নিউ মার্কেটের ‘গ্লোব সিনেমা, যার কথা পরে বলব।

এলিটে এরপর ৭০ মিমিতে ১৯৬৭ সালে ২ বার দেখি (প্রথমে দাদা, তারপর বাবার সঙ্গে) সম্ভবত আমার দ্বিতীয় যুদ্ধের ছবি, ১৯৬৫ সালের Battle of the Bulge। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির ভয়ঙ্কর ‘টাইগার ট্যাঙ্ক বনাম আমেরিকার, তুলনায় ক্ষুদ্রকায় ‘শার্মান’ ট্যাঙ্কের যুদ্ধ  এই ছবির মুখ্য আকর্ষণ। একাধিক দৃশ্য এখনও মানসচক্ষে ভাসেঃ একের পর এক টাইগার ট্যাঙ্ক দিয়ে জার্মান সৈন্যদলের রাস্তায় পড়া একটি ছোট্ট শহর সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া; মিত্রপক্ষের জন্য অস্ত্র নিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন, একের পর এক ‘টানেল পড়ছে রেলপথে, হঠাৎ একটি টানেল থেকে বেরোবার মুখে কামান উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে টাইগার ট্যাঙ্ক!  প্রাণপণে ‘ব্রেক’ টেনেও রক্ষা পেলো না দীর্ঘ ট্রেনটি – পর্দা অন্ধকার করে ধোঁয়া আর কান ধাঁধানো বিস্ফোরণের শব্দ। এছাড়া মুগ্ধ হয়েছিলাম জার্মান কর্নেল হেসলারের ভূমিকায় রবার্ট শ-র অভিনয়ে। যে শহরটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, তার ধ্বংসস্তূপ দর্শন করছেন হেসলার। হঠাৎ তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল বন্দুকের গুলি। ভাঙা বাড়ীর আড়াল থেকে তাঁকে তাক করেছে এক ক্ষুব্ধ কিশোর। জার্মান সৈন্যরা ছেলেটি ও তার বাবাকে ধরে নিয়ে এলো হেসলারের সামনে। ছেলেটিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হেসলার ঠাণ্ডা গলায় হুকুম দিলেন, “ছেলেটাকে ছেড়ে দাও। কিশোর চরিত্রটির সঙ্গে দর্শকও হাঁপ ছেড়ে বাঁচছে, অমনি এল দ্বিতীয় হুকুম, “বাবাকে গুলি করে মারো!”

মনে হয়, ঐ একই বছরে এলিটে দেখি টমাস হার্ডির উপন্যাস অবলম্বনে ঐ ১৯৬৭ সালেরই ছবি Far from the Madding Crowd। ছবিটি মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়রের হওয়াতে মেট্রো সিনেমায় এর ট্রেলর দেখেছিলাম, অন্য কোন ছবি দেখতে গিয়ে। ৭০ মিমি ছবি, তাই মেট্রোর বদলে, এবার জ্যোতি নয়, নতুন ৭০ মিমি প্রেক্ষাগৃহ এলিট। উপন্যাসটি দাদাদের কলেজে পাঠ্য ছিল, তাই বাবা-মার সঙ্গে তিনি এবং আমি গেলাম। হার্ডি আবার আমার মার প্রিয় ঔপন্যাসিক! হার্ডির উপন্যাসসমূহের কালানুক্রমে Far from the Madding Crowd অপেক্ষাকৃত আগের দিকে লেখা। তাঁর নির্মম বিয়োগান্তিক বিশ্ব-দর্শনের ইঙ্গিত এখানে আছে বটে – নায়িকা বাথশেবার তিন প্রেমিকের মধ্যে দুজনের মৃত্যু ঘটবে, আদপে মিঃ বোল্ডউড বাথশেবাকে বিয়ে করার প্রাক্কালে বাথশেবার প্রেমিক-স্বামী সার্জেন্ট ট্রয়কে অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরে আসতে দেখে (ঘটনাচক্রে সবাই মনে করেছিল ট্রয় মৃত) নিজের প্রেম ব্যর্থ হবার সম্ভাবনায় দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে গুলি করে হত্যা করবেন তাঁর প্রেমের প্রতিদ্বন্দীকে। অবশেষে বাথশেবাকে লাভ করবে কৃষক গেব্রিয়েল ওক।

মা-বাবার ছবিটি পছন্দ হয় নি একেবারেই, বিশেষ করে নায়িকার চরিত্রে জুলি ক্রিস্টীর অভিনয়। আমি সেই ১০ বছর বয়সে এ কাহিনীর মর্ম কি আর বুঝব? পরে, কলেজে পড়াকালীন বাবার সঙ্গে ছবিটি আরেকবার ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে অবস্থিত প্রেক্ষাগৃহে দেখেছিলাম। সেবারেও তেমন ভালো লাগেনি।

পরের বছর, ১৯৬৮-তে এলিটে দেখলাম ১৯৩৯ সালে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত, আর এখন ৭০ মিমি প্রোজেকসানে, হলিউডের যুগান্তকারী ছবি, মার্গারেট মিচেলের উপন্যাস-ভিত্তিক Gone with the Wind। দাসপ্রথা-বিলুপ্তিকরণের জন্য আমেরিকার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই কাহিনী আজও বিতর্কিত। সে প্রসঙ্গে না গিয়েই বলছি যে এক দ্বাদশ-বর্ষীয় কিশোরের পক্ষে Gone with the Wind ছিল এক চোখ-ধাঁধানো অভিজ্ঞতা। যেমন অসাধারণ চিত্রগ্রহণ, তেমনই অভিনয়! যথারীতি, মেট্রোতে এর ট্রেলর দেখানো হয়েছিলো। পরে ৮০-র দশকের শেষে বা ৯০-এর শুরুতে ছবিটি নিউ এম্পায়ারে আবার মুক্তি পায়, কিন্তু আর ৭০ মিমিতে নয়। সেই চৌকো ৩৫ মিমি প্রোজেকসান।

সম্ভবত ১৯৬৯-এ এলিটে দেখি ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে সঙ্গীতবহুল ১৯৬৮ সালের Oliver। নাম-ভূমিকায় শিশু-অভিনেতা মার্ক লেস্টারকে খুবই ভাল লেগেছিল। আর পিঠ দিয়ে আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন অপরাধী বিল সাইকসের ভূমিকায় অলিভার রীড। এছাড়া উপভোগ্য অভিনয় করেছিলেন ফ্যাগিনের চরিত্রে রন মুডি, আর ‘আর্টফুল ডজার’-রূপে জ্যাক ওয়াইল্ড।

১৯৭২-এ বাবা-মা এলিটের ম্যানেজার মিঃ দারুওয়ালার সম্মতি নিয়ে আমাকে দেখতে নিয়ে গেলেন ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্দিষ্ট ১৯৬০ সালের Spartacus। আমার বয়স তখন ১৫! প্রাচীন রোমে দাস-বিদ্রোহের এই রোমহর্ষক চিত্রায়নে ছিলেন একাধিক স্বনামধন্য অভিনেতা। তাছাড়া তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপট খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো। ‘এ্যাডাল্ট মার্কার কারণ মূলত নায়িকা ভারিনিয়ার (জীন সিমনস) সঙ্গে নায়ক স্পার্টেকাসের একাধিক – তখনকার বিচারে – রগরগে প্রণয়-দৃশ্য।

সত্তরের দশকে এলিটে আরও দেখেছি পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত সুপারহিট ১৯৬৯ সালের ছবি Mackenna’s Gold। প্রিন্ট শতছিন্ন হওয়ায় এত জমাটি ছবি তেমন জমে নি। প্রথম যখন এই এলিটেই ছবিটি মুক্তি পায়, শুনেছি টিকিটের অবাধ কালোবাজারী চলেছিল।

বলা উচিত যে এলিটে ৭০ মিমি ছাড়াও অসংখ্য ৩৫ মিমির অসাধারণ ছবি দেখেছিঃ প্রিয় অভিনেতা জন ওয়েন অভিনীত একাধিক ছবি, তার মধ্যে ১৯৭০ সালে ২ বার দেখেছি ১৯৬৯ সালে যে ছবির জন্য তিনি জীবনের একমাত্র ‘অস্কার পান, সেই True Grit। ছবির শীর্ষবিন্দুতে মার্শাল কগবার্ন-রূপী ওয়েন একা চারজন ডাকাতকে আক্রমণ করছেন, ঘোড়ায় চড়ে, লাগাম নিজের দাঁতে নিয়ে, একহাতে পিস্তল, আরেকহাতে রাইফেল! অবিস্মরণীয় দৃশ্য! এই ছবি বাবা রাতের শো তে দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন তার আগে চার দিনে ১০৪-টি অঙ্ক কষিয়ে আমাকে নাকের জলে-চোখের জলে ভাসাবার পর! তবে ঐ ১০৪-টি অঙ্ক কষার সুফল পেয়েছিলাম সেবার ইস্কুলের অঙ্ক পরীক্ষায় ৮০% নম্বর পেয়ে। এর পর সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে True Grit-এর পরবর্তী কাহিনীচিত্র, ১৯৭৫ সালের Rooster Cogburn দেখি এলিটেই, ৭০ মিমি প্রোজেক্সানে। তবে মূল ছবির তুলনায় জন ওয়েনের সঙ্গে ক্যাথারিন হেপবার্নের মতো শক্তিশালী সহ-অভিনেত্রী থাকা সত্বেও ছবিটি আমাকে হতাশই করেছিল।

৩৫ মিমির আরও ছবি এলিটে, পুনর্মুক্তির পর, ১৯৬৫/৬৬ সালে দেখেছি বিখ্যাত পরিচালক সেসিল বি ডি মিলের সার্কাস নিয়ে ১৯৫২ সালের The Greatest Show on Earth যাতে প্রথম দেখি অভিনেতা চার্ল্টন হেস্টনকে। পরে ১৯৬৯-এ দেখব ঐ পরিচালকের আরেক যুগান্তকারী ছবি, ১৯৫৬ সালের The Ten Commandments, যাতেও চার্ল্টন হেস্টন ছিলেন, মোসেসের ভূমিকায়। সত্তরের শেষে দেখেছি ডি মিলের ১৯৪৯ সালের আরেক বাইবেল-ভিত্তিক ছবি Samson and Delilah। Ten Commandments-এর পর এই ছবি অতিদীর্ঘ আর ক্লান্তিকর লেগেছিল।

 

ষষ্ঠ পর্বঃ গ্লোব

 

সম্ভবত ১৯৬৬ সালে নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে মধ্য কলকাতায়, নিউ মার্কেটের উল্টো দিকে, পুনর্বার আত্মপ্রকাশ করে মেট্রো-লাইটহাউসকে টক্কর দেবার উপযুক্ত গ্লোব। বাইরে আলোকিত অক্ষরে জ্বলতঃ Home of 20th Century Fox, United Artists। আর ছবি প্রক্ষেপণের জন্য, সম্ভবত কলকাতায় এই প্রথম, দেখা গেল, পর্দা নয়, plastic paint করা সাদা দেওয়াল, যা ঢাকতে ওপর থেকে নেমে আসত বিচিত্র আকারের ধূসর পর্দা, অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহের মতো চৌকো নয়।

এই পুনঃসংস্কৃত হলে প্রথম মুক্তি পেল এলিজাবেথ টেলর, রিচার্ড বার্টন ও রেক্স হ্যারিসন অভিনীত ১৯৬৩ সালের ছবি Cleopatra, যাকে প্রযোজনা করার বিপুল খরচ টানতে গিয়ে 20th Century Fox নাকি দেনার দায়ে ডুবতে বসেছিল! ছবিটি আজ অবধি দেখা হয় নি, আর ১৯৬৬-তে তো দেখার প্রশ্নই ছিল না! সেন্সর ছবিটিকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারণ করেছিল।

দাদা প্রথম গ্লোবে, সম্ভবত ১৯৬৬-তে, নিয়ে গেলেন দেখতে ১৯৬৫ সালের Those Magnificent Men in Their Flying Machines। ১৯১০ সালে, এরোপ্লেন যখন শৈশব অবস্থা কাটিয়ে ওঠে নি, সেই সময়, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে অতি প্রভাবশালী লর্ড রন্সলি (অভিনয়ে রবার্ট মর্লি) তাঁর জামাই-হবার-অভিলাষী সেনাধিকারিক রিচার্ড মেসের (জেমস ফক্স) পরামর্শে লন্ডন থেকে প্যারিস অবধি এক বায়ু-দৌড়ের ব্যবস্থা করেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এখন লুপ্ত প্রাশিয়া, ফ্রান্স, ইটালি, আমেরিকা, এবং জাপানের প্রতিযোগীরা। দারুণ মজার এবং উত্তেজক ছবি, বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা তাদের জাতীয় চরিত্রের প্রতিভূ হয়ে ওঠায় তাদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া ছবিটিকে আরও উপভোগ্য করে তুলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নীতিজ্ঞান-বর্জিত স্যার পার্সির (টেরি টমাস) মজার-মজার কূটকৌশল আর রিচার্ড, লর্ড রন্সলি-কন্যা প্যাট্রিশিয়া (সারা মাইলস), আর আমেরিকার প্রতিযোগী অর্ভিল নিউটনের স্টুয়ার্ট ওইটম্যান) ত্রিকোণ প্রেম। ৭০ মিমি প্রক্ষেপণের প্রকাণ্ড পর্দায় পুরো ব্যাপারটি আরও জমিয়ে তুলেছিল।

এরপর, ১৯৬৬-তে গ্লোবে মুক্তি পেল ইংরেজী-বাংলা-হিন্দীতে দেখা যাবতীয় ছবির মধ্যে আমার দ্বিতীয় সবচেয়ে প্রিয় ছবি, কিন্তু তার প্রসঙ্গে আসব এই ধারাবাহিক লেখার সবশেষে, আমার প্রথম সবচেয়ে প্রিয় ছবির সঙ্গে, যার উল্লেখ দ্বিতীয় কিস্তিতেই করেছি।

গ্লোবে এরপর, ১৯৬৭-তে, দাদা দেখতে নিয়ে গেলেন বহু তারকা-খচিত মজার ছবি, ১৯৬৩ সালের It’s a Mad, Mad, Mad, Mad World। দেখুন, বিদেশী ছবি কিরকম আগে-পরে এদেশে মুক্তি পেতঃ ১৯৬৫-র ছবি এলো আগে, ১৯৬৩-র ছবি পরে। একদল মানুষ এক মৃতপ্রায় ব্যক্তির মুখ থেকে কোন এক W-এর তলায় অনেক ডলার পোঁতা আছে শুনে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে ছুটে চলে সেই W-এর খোঁজে, কেউ গাড়ীতে, কেউবা চালাকি খাটিয়ে প্লেন ভাড়া করে, যদিও সে এমন আদ্যিকালের প্লেন যে তাতে চড়ে স্বামী-স্ত্রী দেখে যে নীচে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ীগুলো তাদের ভাড়া-করা প্লেনকে পেছনে ফেলে ছুটছে! অবশেষে, অকূস্থলে পৌঁছে সবাই দেখে যে চারটে নারকেল (নাকি তাল?) গাছ পাশাপাশি, মাঝের দুটো এমনভাবে একে অপরের ওপর হেলে রয়েছে যে সব মিলে তৈরি হয়েছে একটা ঢ্যাঙা W! তার তলা থেকে টাকা উদ্ধারের পরেও চলে প্রতিযোগিতা, কে সবটা নিয়ে পালাবে! যিনি সবার মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, অভিনয়ে স্পেন্সার ট্রেসি, তিনিই শেষ অবধি প্রায় সফল হন, কিন্তু সবাই তাঁর পেছনে ধাওয়া করে। যতদূর মনে পড়ে, টাকা কারুরই ভোগে লাগেনি।

গ্লোবে ষাট আর সত্তরের দশকে এত ছবি দেখেছি যে ঠিক বলতে পারব না সবচেয়ে বেশী ইংরেজী ছবি দেখেছি এখানে না মেট্রোয়! তার মধ্যে পরের দিকে অনেকগুলোই ৭০ মিমি প্রোজেকশানে ছিল না, যেমন এলিটের ক্ষেত্রে হয়েছিলো। আপাতত ৭০ মিমি ছবির কথাই বলি।

ভাল লেগেছিল ১৯৬৭ সালে তৈরি, এখানে পরে মুক্তিপ্রাপ্ত, Hugh Lofting-সৃষ্ট চরিত্র অবলম্বনে Doctor Dolittle। যাঁর নামে গল্প, সেই ভেটেরিনারি ডাক্তার জন্তুজানোয়ারদের চিকিৎসাই শুধু করেন না, তাদের সঙ্গে কথাও বলতে জানেন! সার্কাসে নাকি চিড়িয়াখানায় বন্দী, নিজের স্বাভাবিক আবাসের জন্য কাতর এক সীলমাছকে ডাক্তার ঘোমটা পরিয়ে মানুষ সাজিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেন, ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয় মানুষ খুনের দায়ে। আদালতে ওটি যে সীলই ছিল, মানুষ নয় সাব্যস্ত হবার ফলে ডাক্তারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়ে বিচারক শেষ মুহূর্তে ডাক্তারকে মানসিকভাবে অস্থিতিশীল আখ্যা দিয়ে পাগলা গারদে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেন! যে ঢাকা ঘোড়ার গাড়ী করে তাঁকে গারদে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তা থেকে তাঁকে নাটকীয়ভাবে উদ্ধার করে তাঁরই পোষা পশুপাখীরা! এরপর – বা আগে – আছে ডাক্তারের এক সার্কাস মালিকের সঙ্গে মিলে তাঁর দুই-মাথাওয়ালা Pushmepullyu-র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা, আর শেষে ডাক্তারের সমুদ্র-যাত্রা, এমন এক অদ্ভূত দ্বীপে যেখানে রাজত্ব করেন কৃষ্ণাঙ্গ দশম উইলিয়ম শেক্সপীয়র! একেবারে শেষে ডাক্তার চাঁদেও যাবেন, এবং ছবির শেষ দৃশ্যে ডাক্তার পৃথিবীর বুকে নামবেন চাঁদের মথের পিঠে চেপে! ডাক্তারের ভূমিকায় ছিলেন My Fair Lady-খ্যাত রেক্স হ্যারিসন, মুখ্য নারী চরিত্রে সামান্থা এগার, আর সার্কাস মালিক হয়েছিলেন পরে ৮০-র দশকে ‘গান্ধী’ পরিচালনা করে খ্যাত রিচার্ড অ্যাটেনবরো। ১৯৯৮ সালে ডাক্তার ডুলিটল-কে নতুন করে পর্দায় রূপায়িত করেন এডি মার্ফি।

১৯৭০-এ গ্লোবে মুক্তি পায় যিশুখ্রিস্ট-কে কেন্দ্র করে ছবি, ১৯৬৫ সালের The Greatest Story Ever Told। যিশুর ভূমিকায় ছিলেন ম্যাক্স ভন সাইডো, ১৯৫৬ সালে The Ten Commandments-এ মোজেস করে বিখ্যাত চার্ল্টন হেস্টন করেছিলেন দীক্ষাগুরু জন, আর যা এই ছবির সম্বন্ধে অনেকেই বলেন, শেষাংশে উপস্থিত হন প্রায় সমস্ত হলিঊডঃ এমন কি সাধারণত যিনি ওয়েস্টার্ন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি ছবিতে অভিনয় করে বিখ্যাত, সেই জন ওয়েনকেও দেখা গেল রোমান শতানীক-অধিনায়কের বেশে! আমার মনে সবচেয়ে দাগ কেটেছিল শয়তানের ভূমিকায় ডোনাল্ড প্লেজেন্সের সংযত অভিনয়, বিশেষ করে যিশু বন্দী হবার পর যেভাবে শয়তান পীটারকে, যিশুর ভবিষ্যদ্বাণী-অনুযায়ী, যিশুকে অস্বীকার করার প্ররোচনা দিচ্ছে।

এই ১৯৭০-এর বড়দিনের ছুটিতে গ্লোবে আসে জেমস বন্ড-স্রস্টা ইয়ান ফ্লেমিং-এর ছোটদের জন্য লেখা গল্প Chitty Chitty Bang Bang-এর ১৯৬৮ সালে করা চলচ্চিত্রায়ন। মূল গল্পের সঙ্গে কয়েকটি চরিত্রের নাম ছাড়া ছবির গল্প ফ্লেমিং-এর আখ্যান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ছোটদের জন্য ভিন্ন স্বাদের গল্পের লেখক রোয়াল্ড ডাহল। বাস্তবের সঙ্গে রূপকথার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি হয়েছিলো এক মুগ্ধ-করা ছবি যা গ্লোবে চলাকালীন তিন হপ্তায় দেখি তিনবার! মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন সেই ১৯৬৮-তে দেখা Mary Poppins থেকে পরিচিত ডিক ভ্যান ডাইক, নায়িকা চরিত্রে স্যালি অ্যান হোস (বেশ মিষ্টি দেখতে, কিন্তু গানের গলা – যদি তাঁর নিজের হয় – মেরী পপিন্স-সাউন্ড অব মিউজিক খ্যাত জুলি অ্যান্ড্রুজের ধারেকাছে নয়। শিশু-অভিনেতা দুজন ভালই, তাদের ঠাকুরদাদার ভূমিকায় লায়োনেল জেফ্রীস দারুণ, আর মূল প্রতিপক্ষ – বাস্তব অংশে নয়, ভ্যান ডাইক অভিনীত মিঃ পটসের বলা রূপকথায় – যার মধ্যে পটস রেখেছেন নিজেকে, বড়লোকের মেয়ে আর পটসের দুই ছেলেমেয়ের বন্ধু ট্রুলি (স্যালি অ্যান হোস), ঠাকুরদাদা, সবাইকে – ভালগেরিয়ার ব্যারন বম্বি-রূপে জেমস বন্ডের এক ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ গোল্ডফিংগারের ভূমিকায় অভিনয় করা গার্ট ফ্রোব এবং ব্যারনেস-রূপিণী অ্যানা কোয়েল; দুজনেই খুব ভাল। আর সমস্ত ছবি জুড়ে এককালে মোটর গাড়ীর দৌড়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে আবর্জনার মাঝে পড়ে থাকা একটা গাড়ী, যাতে ব’সে পটসের ছেলেমেয়ে দুটি খেলত, এবং  যেটা বিক্রী হয়ে যেতে উপক্রম হয়েছিলো। ছেলেমেয়ের গাড়িটির প্রতি ভালবাসা দেখে পটস এক অপ্রত্যাশিত উপায়ে অভাবের সংসারে টাকার ব্যবস্থা করে সেটিকে কিনে মেরামত করে ঝকঝকে করে তোলেন। এবার ট্রুলিকে নিয়ে পটস এবং তাঁর দুই সন্তান বেড়াতে যান সমুদ্রের ধারে। এখানে বসে পটস বলতে শুরু করেন তাঁর গল্প। ব্যারন বম্বি জাহাজে করে এসেছেন ‘চিটি চিটি ব্যাং ব্যাং (গাড়ীর নামকরণ পটসের) চুরি করতে, কারণ সে এক প্রায়-অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ী – প্রয়োজনে সে জলে জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, আবার অবস্থামতো আকাশেও উড়তে পারে! বম্বির চরেরা ঠাকুরদাদাকে ভুল করে অপহরণ করায় চিটি বাকীদের উড়িয়ে নিয়ে যায় ভালগেরিয়ায় (সে নিজের স্টিয়রিং নিজেই ঘোরায়; পটস বলেন, “চিটি জানে কোথায় যেতে হবে, আমি জানি না!”) ভালগেরিয়ার ব্যারনেস শিশুদের সহ্য করতে পারেন না, তাঁর এক অশিব ছেলেধরা আছে, যে বাচ্চা দেখলেই তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে প্রাসাদে বন্দী করে। পটসের দুই সন্তান তার দ্বারা অপহৃত হয়। কিভাবে পটস-ট্রুলি এবং ঐ রাজ্যের অসংখ্য সুড়ঙ্গে-লুকিয়ে-থাকা শিশুর দল তাদের উদ্ধার করে, তাই হল রূপকথার শীর্ষবিন্দু, যার পর কাহিনী ফেরত আসে বাস্তবের জগতে, কিন্তু সেখানেও অবশেষে ঘটে মোহিনী ইচ্ছাপূরণ, দুই মা-হারা শিশু ট্রুলির মধ্যে পায় তাদের মা’কে!

বাস্তব আর কল্পনাকে পদেপদে সুন্দর ভাবে মিশিয়েছেন চিত্রনাট্যকার। শুরুতে আবিষ্কারক পটসের অভাবী সংসারে ঠাকুরদা-বাবা-ছেলেমেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের, এবং প্রথমে দুই শিশুর বাবার জন্য স্বার্থত্যাগ, আর তার বিনিময়ে কৃতজ্ঞ বাবার তাদের সখ মেটানোর চেষ্টা মর্মস্পর্শী। আধ-পাগলা আবিষ্কারকের সঙ্গে প্রথমে মনোমালিন্য হলেও, পরে দুই শিশুর টানে তাদের একে-অপরের প্রতি বিরূপতা দূর হওয়া ট্রুলি, আর সবশেষে পটসেরই এক আপাত-ব্যর্থ আবিষ্কারের অপ্রত্যাশিত সাফল্যে সংসারে দারিদ্র্যের অবসান – সমস্ত কিছু বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। উইকিপিডিয়া পড়ে জানলাম যে ছবির নির্মাতারা ‘মেরী পপিন্সে’র সফল জুটি জুলি অ্যান্ড্রুজ আর ডিক ভ্যান ডাইককেই আবার আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত সঙ্গতভাবে জুলি বলেন যে ট্রুলির চরিত্রটি মেরী পপিন্সের (এবং, আমি যোগ করব, ‘সাউন্ড অব মিউজিকের মারিয়ার) পুনরাবৃত্তিই হয়েছে – সেই মায়ের (এবং ‘মেরী পপিন্সে বাবা-মা দুজনেরই) স্নেহ-বঞ্চিত শিশুদের মূল মহিলা-চরিত্রের মধ্যে তাদের মাকে খুঁজে পাওয়া! তাই জুলি এই ছবিতে থাকতে অসম্মত হন। আসেন মঞ্চে My Fair Lady এবং The Sound of Music-এ জুলি-অভিনীত এলাইজা ডুলিটল আর মারিয়া চরিত্রদুটিতে জুলির বদলি হিসেবে কাজ-করা স্যালি।

৭০ মিমি ছবি গ্লোবে এরপর দেখেছি প্রায় সবই যুদ্ধের ছবি। যেমন, ১৯৭১-এ পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ১৯৬২ সালের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংক্রান্ত ছবি The Longest Day। অভিনব ব্যাপার – ৭০ মিমি প্রোজেকশানে সাদা-কালো ছবি! যথারীতি, এই জাতীয় ছবিতে যা হয়, অভূতপূর্ব তারকা সমাবেশ ছিল। আমার দেখার কারণ ছিলেন আমার হলিউড ‘হিরো জন ওয়েন! এর পর দেখেছি ১৯৭০ সালে তৈরি দুটি ছবি, জর্জ সি স্কট অভিনীত Patton আর আমেরিকা-জাপানের যৌথ উদ্যোগে তোলা ১৯৪১-এ পার্ল বন্দরের ওপর জাপানী আক্রমণের উপাখ্যান Tora! Tora! Tora!

আরেকটি পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধের ছবি গ্লোবে দেখেছি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, তবে তা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নয়, ১৮৩৬ সালে ঘটা টেক্সাস বিদ্রোহের সময় মেক্সিকান সৈন্যের কাছে টেক্সিয়ানদের সাময়িক পরাজয় নিয়ে ১৯৬০ সালে তৈরি জন ওয়েন প্রযোজিত, পরিচালিত, এবং অভিনীত The Alamo।

১৯৭৬-এ পার্ক স্ট্রীট অঞ্চল থেকে কলকাতার উত্তর-পূর্বে সল্ট লেকে নিজস্ব বাড়ীতে উঠে যাবার পর সেখান থেকে সকাল ৭ঃ৩০-এ ফরাসী ভাষা শিখতে আসতাম পার্ক স্ট্রীট-ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের সংযোগস্থলে পার্ক ম্যানশন্সে অবস্থিত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। ক্লাস সেরে মধ্য কলকাতায় দুপুরের শোতে ছবি দেখা প্রায়ই হতো। গ্লোবে দু-বার – একবার একা, দ্বিতীয়বার ঐ আলিয়ঁসে পাঠরতা বেথুন কলেজের তিন বান্ধবীর সঙ্গে – দেখেছি ১৯৬০ সালে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে ‘অস্কার-প্রাপ্ত বিখ্যাত My Fair Lady। ছোটবেলায় (ষাটের দশকে) ছবিটি এলিটে এসেছিল, তবে বাবা-মা আমাকে বাদ দিয়েই দেখে এসেছিলেন, এবং অন্তত মা’র ছবিটি খুব-একটা ভাল লাগেনি। ইতিমধ্যে ইস্কুলের একাদশ শ্রেণীতে ছবির উৎস যে নাটক, বার্নার্ড শ রচিত Pygmalion, সেটি কাউন্সিলের পরীক্ষায় পাঠ্যরূপে আসে। খুব জানা কাহিনী, আর ব্রিটিশ কাউন্সিলের  প্রেক্ষাগৃহে পরে ১৯৩৮ সালের সাদা-কালো চলচ্চিত্রায়নটিও দেখা ছিল, অভিনয়ে লেসলি হাওয়ার্ড ও ওয়েন্ডি হিলার। কিন্তু কি সেখানে আর কি অ্যালান জে লার্নারের করা এই সঙ্গীতবহুল নাট্যরূপে – যা পরে চিত্রায়িত হয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পায় – নেই নাটকের ভাবালুতা-বর্জিত উপসংহার, যেখানে এলাইজা তার শিক্ষাগুরু হিগিনসের সংস্রব ত্যাগ করে বিয়ে করছে হাবাগোবা কিন্তু তার প্রেমে পাগল ফ্রেডিকে। দুটি ছবিতেই এলাইজা-হিগিনসের মিলনের দিকেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। তবে, My Fair Lady-তে, এক জেরেমি ব্রেট অভিনীত ফ্রেডিকে বাদ দিলে (যিনি পরে আশির দশকে শার্লক হোমস হয়ে ছোট পর্দা কাঁপাবেন!), প্রত্যেকের অভিনয় নিখুঁত, গানগুলো অতি সুখশ্রাব্য, এবং ছবিটি সামগ্রিকভাবে অতীব মনোরঞ্জনকারী। শুধু এলাইজার (অভিনয়ে অড্রি হেপবার্ন) মুখের গানে, যিনি মঞ্চে চরম সফলতার সঙ্গে চরিত্রটি রূপায়িত করেছিলেন, এবং যার গলার গানের ভক্ত আমি সেই ১০ বছর বয়স থেকে, সেই জুলি অ্যান্ড্রুজের অভাব পদে-পদে বোধ করেছি! মার্নি নিক্সন, যিনি ছিলে অড্রির নেপথ্য কণ্ঠ, গায়কী এবং স্বরক্ষেপে জুলিকেই মনে করান, এবং ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্কে তিনি মঞ্চে এলাইজার ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন (ঠিক যেমনটি করেছিলেন ‘চিটি চিটি ব্যাং ব্যাং-এর স্যালি অ্যান হোস; আপনাদের মনে থাকবে যে ঐ ছবিতে স্যালি ছিলে জুলির বদলি অভিনেত্রী)।

১৯৭৮-এ সকালের ফরাসী ক্লাস সেরে ছুটলাম নিউ মার্কেটে গ্লোবে লাইন দিতে। সেদিন সকাল থেকে সেখানে খুলছে আরেক যুগান্তকারী ছবির অগ্রিম বুকিংঃ ১৯৭৭-এর Star Wars। এই কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক রূপকথার ট্রেলর দেখেছিলাম একাধিকবার, ঐ My Fair Lady এবং অন্যান্য ছবি দেখার সময়। গিয়ে দেখি কাউন্টার খোলার অনেক আগে থেকেই লাইন সিনেমার পাশের গলিতে দীর্ঘায়িত হয়েছে। দুরু-দুরু-বক্ষে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর গম্ভীর মুখ করে এসে দাঁড়ালেন এক পুলিশম্যান। লাইনের ওপর চোখ বুলিয়ে দু’জনের দিকে আঙুল তুলে তিনি উচ্চারণ করলেন একটাই শব্দ, “নিকলো!” বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গেল দুই ছোকরা, বোঝা গেল টিকিট কিনে তার কালোবাজারী করা তাদের পেশা! শোনা গেল মাথা পিছু চারটের বেশী টিকিট দেওয়া হবে না। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে যখন কাউন্টারে পৌছলাম, বললাম, “তিনটে ২ টাকা ৪৫। (আজকের দিনে এই Star Wars saga-র কোন ছবি এলে কত টাকা খরচ করতে হয় একটা টিকিটের জন্য?) অমনি পেছন থেকে আকুতি, “ও দাদা, আমাদের হয়ে একটা নিয়ে নিন না, আপনাকে দাম দিয়ে দেব। লাইনে দাঁড়িয়েই কালো বাজারী নিয়ে যা দেখেছিলাম, সেই দৃশ্য মনে কু গাইল। বললাম, “না দাদা, নিজের টিকিট নিজে কিনুন!”

বাবা-মাকে নিয়ে শো-এর দিন গ্লোবে উপস্থিত। বাড়ীতে তখন ‘স্টেটসম্যান নেওয়া হত, তার সমালোচক উচ্ছ্বসিত ছবির কাহিনী এবং চিত্রায়ন নিয়ে। কিন্তু এই অতিপ্রচারের ফলেই বোধহয় তেমন মন ভরল না, শেষে কি রকম যেন ভাবাবরোহের অনুভব হলো! অথচ, আশির দশকের গোড়ায় যখন এই গ্লোবেই মূল ছবির পরবর্তী কাহিনীর চিত্রায়ন দেখলাম, The Empire Strikes Back (১৯৮০), দারুণ লাগলো! এ তো সেই গুগাবাবা-র চেয়ে হীরক রাজার দেশে বা গুপী-বাঘা ফিরে এল বেশী ভালো লাগার মতো!

বিদেশ থেকে ১৯৮৮-তে ফেরার পর হবু-শ্যলিকা-শ্যালককে নিয়ে গ্লোবে দেখি স্পিলবার্গ-সৃষ্ট দুর্দান্ত চরিত্র ইন্ডিয়ানা জোনসের তৃতীয় অভিযান Indiana Jones and the Last Crusade (১৯৮৯) । এই অনবদ্য সৃষ্টির প্রথম কিস্তি, Raiders of the Lost Ark (১৯৮১) এই গ্লোবেই মুক্তি পেয়েছিল, তখন দেখা হয় নি। অক্সফোর্ডে কলেজে ভিডিওতে দেখে আমি মুগ্ধ! ওদেশে একটি টিকিটে দুটি বা তিনটি ছবি দেখানোর চল ছিল – বলা হত double বা triple bill। সেইভাবে ওখানকার ABC Cinema-য় একসঙ্গে দেখলাম Raiders আর ১৯৮৪-তে মুক্তিপ্রাপ্ত, ভারতের প্রেক্ষাপটে – এবং ভারতে নিষিদ্ধ – Indiana Jones and the Temple of Doom, যাতে পরাধীন ভারতে ঠগীদের সঙ্গে সংঘাতে নামছেন ইন্ডিয়ানা, তিনটি অমূল্য শিবলিঙ্গ উদ্ধার করতে। প্রধান দুই প্রতিপক্ষের চরিত্রে অমরীশ পুরী (কাপালিক) এবং অ্যাটেনবরোর গান্ধী ছবিতে পণ্ডিত নেহরু করে খ্যাত রোশন শেঠ (দুরাচারী মন্ত্রী)। ছবিটি নিয়ে আমার বিলিতী সহপাঠীদের সন্ত্রস্ত অপরাধবোধ দেখে সকৌতুকে বলেছিলাম, “একজন ভারতীয় – বিশেষ করে বাঙালী – হয়ে এই ছবি যতটা উপভোগ করেছি, তা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তোমরা তো আর আমার মতো সেইসব ‘কাপালিকের কবলে জাতীয় গল্প পড়ে বড় হও নি!” দুর্ভাগ্যক্রমে ছবিটির পরিচালক স্পিলবার্গ স্বয়ং রাজনৈতিক শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে এই দ্বিতীয় ছবিটিকে তাঁর ত্যাজ্য সন্তানের পর্যায় রেখেছেন!

তৃতীয় অভিযানে ইন্ডিয়ানার বাবারূপে আমরা পাচ্ছি জেমস বন্ড-রূপে খ্যাত শন কনারিকে। যে পবিত্র পাত্র (Holy Grail) থেকে যিশুখ্রিস্ট তাঁর সর্বশেষ নৈশভোজের সময় পান করেছিলেন, এবং তিনি ক্রুশে বিদ্ধ হবার পর যে পাত্রে আরিমাথিয়ার জোসেফ যিশুর শোণিত রক্ষা করেছিলেন, সেই পাত্রের খোঁজে এই অভিযান, যে পবিত্র বস্তুর পেছনে ধাওয়া করেছে হিটলার এবং তার ঘৃণ্য নাৎসি সতীর্থরা। দুটি অবিস্মরণীয় দৃশ্যের কথা বলিঃ শত্রুদের প্লেন ধাওয়া করেছে ইন্ডিয়ানা ও তার বাবাকে। হঠাৎ জোনস সিনিয়র তাঁর ছাতাটি খুলে তেড়ে গেলেন সমুদ্রতীরে বসে থাকা পাখীর দলের দিকে। ভয় পেয়ে পাখীরা উড়ে গেল আকাশে, প্লেনের প্রপেলারের সঙ্গে একের পর এক পাখীর ধাক্কায় ভেঙে পড়ল প্লেন! দ্বিতীয় দৃশ্যঃ বার্লিনে চলছে নাৎসিদের পৌরোহিত্যে বই-পোড়ানোর উৎসব। তার মাঝখানে অতর্কিতে স্বয়ং হিটলারের মুখোমুখি ইন্ডিয়ানা (হ্যারিসন ফোর্ড) । হতভম্ব ইন্ডিয়ানা ঐ নরপিশাচের সামনে তুলে ধরে পবিত্র পাত্রের সন্ধান-সম্বলিত পুঁথিখানি! বিনা বাক্যব্যয়ে হিটলার বইটি নিয়ে তাতে স্বাক্ষর করে দেয় নিজের নাম!

গ্লোবে এই ছবিটি দেখতে গিয়ে একটি বাড়তি অভিজ্ঞতা হয়েছিল। হলের লবিতে রাখা ওজনের যন্ত্রে চড়েছিলাম আমরা তিনজনই। আমাদের পরেই এক হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক উঠলেন তাতে; পয়সা ফেললেন, হাতে পেলেন ওজন-ছাপা টিকিট। সেটি দেখে আমাদের কাতর স্বরে প্রশ্ন করলেন, “আপনাদের কত ঊঠল?” যে যার ওজন (কোনটাই খুব কম নয়!) বলতেই, তিনি আর্তনাদ ছাড়লেন, “আমার একশো কে জি!” তারপর ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান!

গ্লোবে সেই ষাটের দশক থেকে একাধিক ৩৫ মিমির ছবিও দেখেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ

       ১৯৬৮-তে ১৯৬৬ সালের কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক Fantastic Voyage। এক বৈজ্ঞানিকের মস্তিস্কের ক্লট গলাতে একটি সাবমেরিন সহ একদল মানুষকে জীবাণুর আয়তনে ঠিক ৬০ মিনিতের জন্য ক্ষুদ্রায়িত করে বৈজ্ঞানিকের শরীরে প্রবিষ্ট করা! ৬০ মিনিটে কাজ শেষ না করলে জাহাজসহ সবাই স্বাভাবিক আয়তনে ফিরে গিয়ে রোগীর শরীর ভেদ করে বেরিয়ে আসবে! লবি থেকে জোর করে কিনেছিলাম ছবির কাহিনী-বলা বাংলা পত্রিকা (সম্ভবত আশ্চর্য), যার পেছন মলাটে ছিল বিধায়ক ভট্টাচার্যের অমরেশকে নিয়ে একমাত্র উপন্যাস অমরেশ চন্দ্রাহত হলো-র বিজ্ঞাপন! যথাসময়ে দাদার সঙ্গে কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে অধুনালুপ্ত ‘বুক সার্ভিস থেকে আড়াই টাকা দিয়ে সংগ্রহ করেছিলাম সে বই। Fantastic Voyage-এ অভিনয় করেছিলেন বেন হুর-এ মেসেলা-চরিত্রে খ্যাত স্টীভেন বয়েড, খলচরিত্রে ডোনাল্ড প্লেজেন্স, এবং নার্সের চরিত্রে Raquel Welch (শরীর প্রদর্শনের সুযোগ ছিল না, অতএব, কেন যে এঁকে রাখা হয়েছিলো কে জানে!) প্রমুখ।

       ১৯৬৯-এ দেখেছি কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক (আমার কাছে) ডিস্টোপিয় স্যাটায়ার, ১৯৬৮ সালের Planet of the Apes, মূল চরিত্রে ‘টেন কমান্ডমেন্টস, ‘বেন হুর-খ্যাত চার্ল্টন হেস্টন। একদল নভোচারীর নেতা তিনি, তাঁদের মহাকাশযান বিকল হয়ে আছড়ে পরে এমন এক গ্রহে যেখানে বনমানুষেরা সভ্য আর মানুষ জংলী জানোয়ার, বনমানুষদের শিকারের লক্ষ্য! শেষে নভোচারীদের নেতা জানতে পারেন যে তিনি অন্য কোন গ্রহ নয়, এসে পড়েছেন ভবিষ্যতের পৃথিবীতেই, যেখানে মানুষ মারণযুদ্ধে নিজের সভ্যতা ধ্বংস করার পর,’যোগ্যতমের বেঁচে থাকা-র নিয়মে বনমানুষেরা বিবর্তিত হয়েছে ক্ষমাতাবান সভ্য জীবের স্তরে!

       ১৯৬৯-এ চন্দ্রাবতরণের পর গ্লোবে এসেছিল তা নিয়ে তথ্যচিত্র। তখন দেখা হয় নি, পরে রবিবার সকালের শোতে সেখানে দেখেছি ১৯৬৯-এর Footprints on the Moon।

       ১৯৭০-এ ১৯৬৭ সালের A Challenge for Robin Hood। বাবা-মার কাছে এরল ফ্লিন রূপায়িত রবিন হুডের ছবিসমূহের গল্প অনেক শুনেছি। এটি আমাদের যুগে তোলা রবিন-আখ্যান।

       ১৯৭০-এই আবার, আমার প্রিয়তম হলিউড-স্টার জন ওয়েন এবং রক হাডসন অভিনীত আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ঠিক পরের সময়ের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের The Undefeated। এক সপ্তাহ চলাকালীন শেষদিন শেষ রাতের শোতে বাবার সঙ্গে দেখেছিলাম, কারণ সপ্তাহের প্রথম দিকে পেট খারাপ হয়েছিলো। বাবা বলেছিলেন, “তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো! জন ওয়েন কি মনে করবে? ‘আমার ভক্ত কিনা পেট হড়কে আমার ছবি miss করল!’”

       ১৯৭১-এ দেখি জন ওয়েন অভিনীত ১৯৭০ সালের, সেই গৃহযুদ্ধ-উত্তর সময়ের প্রেক্ষিতে আরেক দারুণ ছবি, Rio Lobo। এখানে আবার অন্য সমস্যা! ভারতীয় সেন্সর ছবিটিকে দিয়েছে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মার্কা! আমার বয়স তখন ১৪! বাবা গম্ভীরভাবে নিদান দিলেন, “আমি কোন আইনভঙ্গ হোক, তা চাই না!” এখানে মা আসরে নেমে ধমকের সুরে বললেন, “যেতে দাও তো দুই ভাইকে!” রাতের শোর টিকিট কেটে দুরু-দুরু বক্ষে (গ্লোবে আবার এই অবস্থা হবে ১৯৭৮-এ Star Wars-এর টিকিটের জন্য লাইন দিয়ে!) দাদার পেছনে-পেছনে গিয়ে, যেই তিনি চেকারের হাতে দুট টিকিট ধরিয়েছেন, আমি পাশ কাটিয়ে সোজা ভেতরে! হলে ঢুকে দাদা বললেন, “যাক, বুদ্ধি হয়েছে এতদিনে!” পরে ছোট পর্দায় ছবিটি দেখেও ভারতীয় সেন্সরের মানসিকতা বোঝা সম্ভব হয়নি। দুই প্রধান নারী চরিত্রের একজনের এক ঝলক নগ্ন বক্ষদেশ প্রদর্শন তো ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল! তার পরেও ‘A’? জমাটি Western, শুরুতেই grease and bees, চর্বি আর মৌমাছি ব্যবহার করে অভিনব রেল-ডাকাতি, আর তারপর ঘটনাবহুল এক অ্যাডভেঞ্চার। খলচরিত্রে অভিনেতা মাইক হেনরিকে দেখে খানিকটা বিমূঢ় হয়েছিলাম, কারণ এর আগে তো তাঁকে টার্জানরূপেই দেখেছি!

       ১৯৭৫ নাগাদ গ্লোবে দেখি প্রথমে দাদার সঙ্গে, তারপর বাবা-মাকে নিয়ে Big Jake (১৯৭১) যেখানে জন ওয়েনের সঙ্গে অভিনয়ে আছে তাঁর দুই ছেলে প্যাট্রিক আর ইথান, দ্বিতীয়জন জন ওয়েনের বেশী বয়সের সন্তান হবার কারণে জন ওয়েনের নাতির ভূমিকায়! এটাও কোন অজ্ঞাত কারণে ‘Adult’ মার্কা ছিল!

       মার সঙ্গে দেখেছি ১৯৮৩ সালের কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক রূপকথা Krull। কলকাতার বনেদি প্রেক্ষাগৃহের কি অধঃপতন এতদিনে! একে তো সত্তরের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পর সব শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত হল পাখা লাগাতে বাধ্য হয়। এরপর ক্রমাগত লোকসানের বাজারে বিদ্যুৎ বিলের খরচ বাঁচাতে শোর আরম্ভে খানিক ক্ষণ এ সি চালিয়ে তারপর তা বন্ধ করে পাখা চালানো। Krull দেখার সময় তো পাখাও বন্ধ করে দেওয়া হলো!

       মার সঙ্গেই গ্লোবে আরও দেখেছি এক বিচিত্র ধরণের ছবিঃ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কার্টুন Heavy Metal (১৯৮১)!

       গ্লোবে সর্বশেষ দেখা ছবি বোধহয় ১৯৯১ সালের উপভোগ্য রহস্য ছবি, F/X 2: The Deadly Art of Illusion, যা দেখেছিলাম স্ত্রী, শ্যালিকা ও শ্যালককে নিয়ে।

সবশেষে আবার বলি, এই গ্লোবেই মোট চারবার দেখা ছবিটির কথা বলব আলাদা ভাবে, কারণ সেটি আমার দেখা যাবতীয় ছবির মধ্যে (ইংরেজী-বাংলা-হিন্দী) দ্বিতীয় সবচেয়ে প্রিয়। ছবিগুলির সবার শেষে তার পোস্টারই শুধু রাখলাম!