কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৩

সম্পাদকীয় - কালিমাটি অনলাইন / ০৪

সম্পাদকীয়



সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতি মুহূর্তে চলছে মেধা ও মননের চর্চা। বাস্তব বা কোনো ভাবনা বা কোনো প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ও উচ্চতায় বিস্তর পরীক্ষা ও নিরীক্ষা। কথা আর কথায় উপচে পড়ছে বিশ্বের প্রতিটি কোণ এবং তার আনাচ-কানাচ। জগত জুড়ে এত কথা, এত কথন – ‘কালিমাটি অনলাইন’এর এই সংখ্যা থেকে আমরা শুরু করছি একটি নতুন বিভাগ – ‘কালিমাটির কথনবিশ্ব’। ‘কবিতার কালিমাটি’, ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ এবং ‘ছবিঘর’ তো যথারীতি থাকছেই। এর পাশাপাশি এই নতুন বিভাগে নিয়মিত প্রকাশ করা হবে বিভিন্ন বিষয় ও ভাবনার গদ্য –ব্যক্তিগত গদ্য, আত্মউন্মোচনের গদ্য, প্রসারণের গদ্য, বহুরৈখিক চলমান গদ্য...। আসলে প্রতিটি মানুষের কথনবিশ্ব তো আলাদা আলাদা। প্রত্যেকের দেখার চোখ আলাদা, মনের চোখ আলাদা, এমন কি কোন্‌ ‘অ্যাঙ্গেল’ থেকে উঁকি মারবেন, তাও আলাদা আলাদা। আর আমরা ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতেই তুলে ধরতে চাইছি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের কথন, কথনবিশ্ব। ‘কালিমাটির কথনবিশ্ব’। আমরা নিশ্চিত, এই সব প্রকাশিত গদ্যগুলি সম্পর্কে স্বাভাবিক কারণেই আপনাদেরও মনেও অনেক আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের পরিসর সৃষ্টি হবে। এবং আপনারা আপনাদের কথনবিশ্ব নিয়ে উপস্থিত হবেন ‘কালিমাটির কথনবিশ্ব’-এ।



‘কবিতার কালিমাটি’ ২৭তম সংখ্যায় মোট ৩১টি কবিতা, ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ ১২তম সংখ্যায় ১৫টি ঝুরোগল্প, ‘কালিমাটির কথনবিশ্ব’ ১তম সংখ্যায়৬টি গদ্য ছাড়াও ‘ছবিঘর’-এ ১১ জন শিল্পীর ১০টি আলোকচিত্র এবং ১ টি অঙ্কনচিত্র প্রকাশিত হলো। আপনাদের কাছে আগেও অনুরোধ করেছি, আবার বিনীত অনুরোধ, আপনারা প্রকাশিত কবিতা-ঝুরোগল্প-আলোকচিত্র ও কথনবিশ্ব সম্পর্কে আপনাদের অভিমত অবশ্যই জানান ‘কমেন্ট বক্স’-এ। সেইসঙ্গে ‘কালিমাটি অনলাইন’কে আরও সমৃদ্ধ করুন আপনাদের স্বরচিত পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক মননশীল কবিতা, ঝুরোগল্প, গদ্য ও আলোকচিত্র পাঠিয়ে।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : kalimationline100@gmail.com

প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :
0657-2757506 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Parvati Condominium, Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.



<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


কালিমাটির কথনবিশ্ব 


এই সংখ্যায় রয়েছে সমীর রায়চৌধুরী, সুবীর সরকার, দেবতোষ দাশ, অনুপম মুখোপাধ্যায়, অরূপরতন ঘোষ এবং প্রশান্ত গুহমজুমদারের লেখা।

০১ সমীর রায়চৌধুরী

ভিন্ন কথনকেতার খেলা
সমীর রায়চৌধুরী


চারিদিকে অসত্য কথন, মিথ্যাচার, ক্ষমতার রহস্যাবৃত কথাস্রোত সচেতন মানুষকে দগ্ধ করে। এক আস্তিক বিপন্নতা দেখা দেয়। লেখার মাধ্যমে সে তার কথন বিশ্বকে ব্যাপ্তি দেয়। পুনর্নির্মাণ করে তার সত্যদ্রষ্টা সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ।

ধারণাময় এই ধরিত্রীর মাইক্রোস্তরে যতই প্রবেশ করা যায়, দেখা যায়, বহু সংকেত এমনই যে, বাস্তব জগতে বা প্রাত্যহিক কাজেকর্মে তা তেমন কাজে লাগে না। তবু তা প্রয়োজনীয় নয়, একথাও বলা যাবে না। অস্বীকার করা যাবে না, ব্যক্তি মনের সৃজন জগতের মুক্তির একটি পরিসর নির্মাণে তার ভূমিকার কথা।

এমনই অনেক টুকরো-টাকরা নিয়ে আমি ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পটি লিখতে গিয়ে দেখেছি, পাঠকদের মনকে তা আনন্দ দিয়েছে অনায়াসে এবং পাঠকেরা তা সহজ ভাবে গ্রহণ করেছেন। এই ধরনের অমীমাংসেয়তাকে গ্রহণ করবার জন্য পাঠকদের সৃজনশীল মন অপেক্ষায় থাকে। এখানে তাঁদের সৃজনশীল মন অনায়াসে খেলতে পারে। অর্থাৎ একটা খেলাধুলার পরিসর তাঁদের চাই। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, জহর সেন মজুমদারের ‘হৃল্লেখ বীজ’, মিহির চক্রবর্তীর ‘গ্যেডেলের অসম্পূর্ণতা তত্ত্ব’, রবীন্দ্র গুহর ‘কি লিখি কীভাবে লিখি’, আমাদের ভাষায় এই একই কারণে। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজস্ব কথনবিশ্ব নির্মাণ করেছেন। আর একজন সাংবাদিকের প্রতিবেদন থেকে এখানেই এই টেক্সটগুলির পার্থক্য।

মুখোশ পরা কথাবার্তার অন্তরালে ক্ষমতার উঁকিঝুঁকি গ্রাহ্যতার এলাকায় বাধার সৃষ্টি করে। প্রসঙ্গত, গতকালই আমার পাশের বাড়ির প্রতিবেশী পুরী বেড়াতে গেলেন। অথচ এই বর্ষার সময় সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে। এমন কি তাঁরা ফেরার পথে অনেক সংকটেও পড়তে পারেন। বালেশ্বরের কাছে রেললাইন বর্ষার জলে প্রায়ই ডুবে থাকে। আমি এই সময় একবার পুরী বেড়াতে গিয়ে বুঝেছি, প্রকৃত সংকট কাকে বলে। এই সংকট কিন্তু, যেমন সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে, ‘সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়’, সেই অপেক্ষাটুকুরও সুযোগ দেয় না। তবু কিছু মানুষ জেনেশুনে এই সময়ই সমুদ্রের মুখোমুখি হয়, তার ভয়ংকর রূপের সঙ্গে পরিচিত হবে বলে। আসলে আমাদের ব্যক্তিমন প্রতি মুহূর্তে একটি ভিন্ন কথনকেতার অপেক্ষায় থাকে।

আমার নিজের এই বৃদ্ধ বয়সে অনেকেই বলেন যে, অনেক তো হলো, এখন কিছুটা ঢিমেতালে লেখালেখি করা দরকার এবং বিশ্রামের প্রয়োজন অনেক বেশি। অথচ আমার সৃজনশীল মন জানে, লেখালেখিতেই আমি আমার যৌবন ফিরে পাই। কেননা, আমি আজও নীরবতার রহস্যসন্ধানী।

০২ সুবীর সরকার

অরুণেশ : বহুপ্রজ এক আবহমানতা
সুবীর সরকার
বসন্ত ঋতুতে কবে খুন হয়ে গিয়েছিল রাধা
বয়স বাহান্ন হলে একা কাঁদে কিশোরী ধর্ষিতা...

                                            (অরুণেশ ঘোষ)

(ক)

অরুণেশ ঘোষ (১৯৪১-২০১১)। সারাজীবন উত্তরবাংলার প্রান্ততম নিভৃত গ্রামে জীবন কাটিয়েও মেধামনন ও লেখালেখি দিয়ে আলোড়ন তুলেছেন বাংলা সাহিত্যচর্চার ভরকেন্দ্রে। কলকাতা কেন্দ্রিক হাততালি তোষামোদ-প্রিয়তার বৃত্তকে প্রান্তের নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য দিয়ে বরাবর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন তিনি। আর ক্রমে এভাবেই নির্মাণ করেছেন নিজস্ব ভাষাবিশ্ব। কবিতা, গদ্য,‌ অনুবাদকর্ম, নাটক রচনায় তিনি আজীবন সৎ থেকেছেন। কথা বলেছেন সরাসরি। জীবনের অন্ধকারময় নরক ঘেঁটে তুলে এনেছেন আশ্চর্য এক জীবনের গল্প। ধারাবাহিকতাহীন আদ্যন্ত এক ধারাবাহিকতাই যেন। ‘শব ও সন্নাসী’, ‘গুহা মানুষের গান’, ‘বিপথিক’, ‘দীর্ঘ নীরবতা’ তাঁর উল্লেখ্য কাব্যগ্রন্থ। পাশাপাশি লিখেছেন ‘সন্তদের রাত’, ‘অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রা’, ‘জীবনের জার্নাল’, ‘জীবনানন্দ’-এর মতোন অসামান্য সব গদ্যের বই। জীবন, মিথ, ইতিহাস, কিংবদন্তী মেশানো থরে থরে সাজানো প্রশ্নের ভিতর তুলে ধরা ভয়াবহ মানবজীবন, সভ্যতার জলছবি সেই সব গদ্যগ্রন্থের ভিতর খুঁজে যাই আমরা। র‍্যাঁবোর কবিতার অনুবাদ করেছেন তিনি –- ‘মাতাল তরণি’। রয়েছে ছোটগল্পের সংকলন, যে বইটির অন্যতম সম্পদ অরুণেশের দিনলিপি টুকরো। এছাড়া নাটকও লিখেছেন – ‘বর্বরের তীর্থযাত্রা’ । রয়েছে প্রবন্ধের বই -- ‘কবিতার অন্ধকার যাত্রা’। বহুপ্রজ এই মানুষটি প্রয়াত হন ২৪ আগষ্ট,২০১১।



(খ)

অরুণেশ সেই বিরল প্রজাতির লেখক, যিনি পাঠকের চিন্তাবিশ্বে আলোড়ন তুলে অনিবার্য সব প্রশ্নের সামনে দ্বিধাহীন দাঁড় করিয়ে দেন। ঘুম, ঘাম ও থোরবড়িখাড়া মৈথুননিদ্রাআহারসর্বস্ব জীবনের বাইরে আরো আরো সুপ্রসারিত জীবনের দিকে বুঝি যাত্রা শুরু হয় পাঠকের। অরুণেশের কবিতাকে অনেকেই অশ্লীলতায় আটকে দিতে চেয়েছেন, যা পুরোটাই আদতে যুক্তিহীন এক অশ্লীলতাই যেন।

(গ)

কত বিচিত্র সব চরিত্র অরুণেশের লেখায় ভিড় করে আসে। বেশ্যা, বেশ্যার দালাল, গণিকাপলীর বৃদ্ধা মা। কমরেড কেরু, সুহাসিনি মাসী, নির্বাসিত কুষ্ঠরোগীনি, সুবলের চাটের দোকান, বিশাল মাঠের ওপর দিয়ে ছুটন্ত বিপন্ন এক মানুষ যাকে তাড়া করছে আততায়ীর কুড়ুল। ত্রাস, নরকের নারকীয়তাকে তুমুল তুলে আনেন অরুণেশ। উত্তরবাংলার মিথ, লোকসংস্কৃতি, ইতিকথা, প্রান্তিক মানুষেরা বরাবরই সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর লেখায়। রাজবংশী ও দেশীয় মুসলিম জীবনের যাপনবৃত্তকে মেলে ধরেছেন তিনি। বাল্যকালে বহুবার গিয়েছেন পূর্ববাংলার টাঙ্গাইল – এর দাদুবাড়িতে। তার প্রভাব পড়েছে অরুণেশের জীবন ও কবিতায়। তাঁর গড়ে ওঠায়। মানুষ ও প্রকৃতির অত্যাশ্চর্য বর্ণময়তা। সংশয় সংকট আর মাথা-ভর্তি হাহাকার নিয়ে ছুটে গেছেন তিনি জীবন ও নিম্নবর্গীয়দের মাঝে। এখানেই তাঁর স্বকীয়তা।

এলুয়া ফুটিল আসিল বান
কাশিয়া ফুটিল গেইল বান।
                                   
(উত্তরবাংলার লোকপ্রবাদ)
(ঘ)

অরুণেশ প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্ম। তাঁর জীবনবোধ ও দর্শনকে বুঝতে হলে জরুরী তাঁর সৃষ্টিকর্মকে স্পর্শ করা। গল্পসমগ্র–এর শেষে অরুণেশের দিনলিপি পড়লে আবিষ্ট হয়ে যেতে হয়। অরুণেশ হাংরি কিনা, অ্যাংরি কিনা, অশ্লীল কিনা -- সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না; শুধু এটুকুই বলা যায়, অরুণেশ বহুপ্রজ আবহমানতা নিয়ে আদ্যন্ত এক অকপট মানুষ, জীবন ও সৃষ্টিকর্মে।

০৩ দেবতোষ দাশ

ঋতুচক্র
দেবতোষ দাশ
কথায় কথায় যাঁরা রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করেন, তাঁদের বেশ বিরক্তিকর লাগে। শিল্পীর মৃত্যুর সত্তর বছর পরেও, তাঁর সম্পর্কে একটিও নতুন কথা না বলে, কেবল পুনরাবৃত্তি করাটা এক ধরনের মৌলবাদী অশ্লীলতাও বটে। আত্মজীবনী, দু-একটা চিঠি, গোটা তিনেক নাটক, খানকতক কবিতা, সাড়ে তিনখানা গপ্পো (মূলত যেগুলো সিনেমা হয়েছে), আর একগুচ্ছ গান (বড়জোর খানকুড়ি) –- রবিবাবুর বিপুল সৃষ্টি থেকে এইটুকুই তাঁদের মূলধনী ফুটানি। বেশ কিছু বাচাল বাঙালি এভাবেই অশ্লীলভাবে অথচ বিরাট আত্মগব্বে বেঁচেবর্তে আছে। তবে এই রবি-পাঁচালি পাঠে এমনও কেউ থাকেন, যিনি ভাবনার দ্যুতিময়তায় চমকে দিতে পারেন, পুনরাবৃত্তির থোড়-বড়িকে বাতিল করে নতুন কোনো অর্থের উদ্ভাস ঘটাতে পারেন –- যেমন এর অন্যতম নিদর্শন ঋতুপর্ণ ঘোষ।

বিশ বছর আগে ‘হীরের আংটি’ ও ‘উনিশে এপ্রিল’ দেখে কিঞ্চিৎ ইশারা ও ইঙ্গিত টের পেয়েছিলাম যে, এমন কেউ বাংলা সিনে-দুনিয়ায় আসতে চলেছেন, যিনি দুধে-ভাতে বং 'বই'-এর বাইরে সত্যিকারের আভাঁগার্দ ফিল্ম বানাতে পারবেন, আজ নয় কাল। সচেতনভাবে ন্যারেটিভ ভেঙে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারবেন দর্শককে। কালক্রমে আমার সে আশা ফুটিফাটা হয়েছে, আমার ব্যক্তিগত আশ হয়তো মেটেনি, কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ঋতুর কাজে তাঁর একটা সিগনেচার ছিল। বাক্স-অফিসের তোয়াক্কা না করে, গত বেশ কয়েক বছর অন্য-যৌনতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ছবি বানিয়ে নিজেকে বিপন্ন করে তুলতেও যে ধক লাগে, ঋতুর তাও ছিল। তিনি নিজেও জানতেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচশো ফিল্মের মধ্যে তাঁর কোনো ছবি জায়গা পাবে না, ফিল্মমেকার হিসেবে তিনি বিরাট কোনো সাফল্য পাবেন না; কিন্তু দুঃস্থ, আলুভাতে বাংলা ছবিকে সাবালক করার ইতিহাসে তাঁর নামটি থাকবে।

কিন্তু ঋতুর অনন্যতা অন্যত্র –- তিনি কেবল একজন চিত্রপরিচালক নন, তিনি মাত্র একজন খণ্ড বুদ্ধিজীবী নন, তিনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির এক বিরল তার্কিক মেধা, এক সংবেদনশীল মানুষ, যাঁর সঙ্গে দু-দণ্ড ঝগড়াহীন আলোচনা করা যায়, তর্ক করা যায়। ঋতুর বিরল সাহিত্যবোধই তাঁকে সৃষ্টিশীল করেছে, মৃত্যুর পর সৌমিত্রবাবুর এই যথার্থ উপলব্ধিটাই বারবার কানে বাজছে। অবিরল ঋতু-পাঁচালির মাঝে দামি ঠেকেছে। রবীন্দ্রনাথ ও মহাভারত প্রায় যেন অবসেশন, এমনই মগ্ন পাঠক তিনি। কুরোশোওয়ার 'রান'-এর অতলান্ত খাদের দৃশ্যে তিনি খুঁজে পান রবীন্দ্রনাথ। গান্ধারী যখন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যান, পিটার ব্রুক কোনো অলৌকিক ব্যঞ্জনায় নেপথ্যে ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথের ‘ফাল্গুনী’ নাটকের গান-- “ধীরে বন্ধু, গো, ধীরে ধীরে চলো তোমার বিজনমন্দিরে” –- আবিষ্কার করে তিনি মোহিত হন।

ঋতুচক্র সম্পূর্ণ হলো না, কারণ বিশ বছরের ক্রিয়েটিভ জীবন বৃত্তরচনার পক্ষে যথেষ্ট নয়, আরও বিশ বছর সৃষ্টিশীল থাকলে হয়তো আমার সাধ মিটতো, ঋতু বানিয়ে ফেললেও ফেলতে পারতেন ন্যারেটিভ তহেস-নহেসকারী বাংলা ছবি। ইঙ্গিত ছিল, সত্যিই ছিল। যে ভাবনার দ্যুতিময়তা দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম, এদিক ওদিক সেই সব স্পার্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাঁর টুকরো লেখায়, সাক্ষাৎকারে। ২০০০ সালে মিলেনিয়াম-মাতামাতির কালে এক প্রশ্নের জবাবে ঋতুর উত্তর-স্ফুলিঙ্গ আমার পায়ের পাতা থেকে সেরিব্রাল-অর্ধগোলক পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিল। প্রশ্ন ছিল, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় নারী আপনার মতে কে? ঋতুর উত্তর ছিল –- রবীন্দ্রনাথ!

০৪ অনুপম মুখোপাধ্যায়

অনলাইনে কবিতা চর্চার ব্যাপারে
অনুপম মুখোপাধ্যায়


অনলাইনে কবিতা চর্চার ব্যাপারে আমি নিজেই এখন সন্দিহান। কয়েকটি মাত্র স্থান আছে, যেখানে নিজের কবিতা দিতে ইচ্ছে করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিতে ইচ্ছে করে না। সোশ্যাল নেটওয়র্কগুলিতে বাংলা কবিতাকে তরল থেকে অতিতরল করে তোলা হচ্ছে। মুড়ি এবং মিছরির ভেদ থাকছে না। আন্তর্জালে বাংলা কবিতাকে নিয়ে আমার অনেক আশা আছে, স্বপ্ন আছে। সেগুলো সহজে মরবার নয়। আবার কিছু হতাশাও পাকাপাকি হয়ে আছে। আন্তর্জাল একজন তরুণ কবির কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে, যদি তিনি সত্যি নিজের প্রতিভার দর্পণ হিসেবে তাকে ব্যবহার করেন, হাততালি কুড়োবার বাসনা তাঁর না থাকে। ফেসবুক এই কারণেই একটি ধারালো অস্ত্রের চেয়ে বিপজ্জনক। যে কোনো সোশ্যাল নেটওয়র্কই তাই। খুব সহজেই আপনি হাজার খানেক ‘বন্ধু’ সংগ্রহ করে ফেলতে পারেন। আপনি যদি মেয়ে হন, ব্যাপারটা আরো সহজ। এবার যদি দিনের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় সাইটটিতে দেন, অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করবেন। অনেকের কবিতায় একনিষ্ঠভাবে লাইক দিলে বা ‘অসাধারণ’ ‘অসামান্য’ ইত্যাদি বললে, বিনিময়ে নিজে কবিতা পোস্ট করলেই ১০০-১৫০ লাইক পেয়ে যাবেন। তখন কি আপনি লক্ষ্য করবেন যে, ২০০০ বন্ধুর মধ্যে মাত্র ১০০ জন কবিতাটি ছুঁয়েছেন, তা-ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে নয়? হয়তো সেটা ভাবতে ভালো লাগবে না। বরং এতে আপনার অহং এমন একটা স্তরে যেতে পারে, যা মঞ্চের সাফল্যও আপনাকে দেবে না। কবি হিসেবে অংকুরোদ্গমের আগেই মৃত্যু ঘটবে।

সোশ্যাল নেটওয়র্কে জনপ্রিয় হয়ে উঠে একটা সময় হয়তো সমসাময়িক কবিতার দিকে না তাকিয়েই আপনি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বেন। নিজের কবিতা নিজেই প্রকাশ করে, নিজের পাঠক সংগ্রহ করার সুযোগ আন্তর্জাল দেবে, কিন্তু তার আগে নিজেকে প্রস্তুত করা দরকার। সেই প্রস্তুতি আন্তর্জালের বাইরে হওয়াই ভালো। গলির ক্রিকেটকে টেস্ট ক্রিকেট ভাবার ভুল না হলে, ঘটে যাবে। হ্যাঁ পাঠক, ফেসবুকের কবিতা পোস্টিংকে আমি ওই চোখেই দেখি... গলির ক্রিকেট। যেখানে সম্পাদক নামক পেশাদার আম্পায়ারটি নেই। আপনি আউট হলেন কিনা, ছয় মারলেন না চার মারলেন না কট হয়ে গেলেন... আপনি নিজেই বিচার করবেন, কারো মতামত অপছন্দ হলে তাকে বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেবেন। আন্তর্জাল একজন তরুণ কবির কাছে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে, যদি তিনি সম্পাদকের ভূমিকাকে মেনে না নেন। পেশাদার সম্পাদক মানে যে বেতনভূক সম্পাদক নন, বলা বাহুল্য। তবে... ২৪ x ৭ কবিতাকর্মী তাঁকে হতে হবে।

এই মুহূর্তে ব্লগ এক অনিবার্য ব্যাপার একজন তরুণ কবিরা কাছে। যদি তিনি কাউকে খুশি না করে নিজের একটি জগত গড়ে তুলতে চান, ব্লগ তাঁর একমাত্র অপশন মনে হয়। নিজের ব্লগে তিনি নিজের সৃষ্টিসুখের উন্মাদনাকে যেমন খুশি উপস্থিত করতে পারেন। সেই ব্লগে তারপর তিনি আমন্ত্রণ জানাতে পারেন পাঠকদের। তাঁকে নিজের কবিতা নিয়ে প্রকাশক বা সম্পাদকদের দরজায় দরজায় আর ঘুরে বেড়াতে হবে না। নিজের কবিতার দায়িত্ব এখন তিনি নিজে নিতে সক্ষম। দুই বাংলা মিলিয়ে বেশ কিছু তরুণ কবি আজ এই পথে হাঁটছেন। আজ তাঁরা খাদক নন, উৎপাদকের ভূমিকায়। অবশ্য জবাগাছের পাশাপাশি বিছুটিও এক উৎপাদক, কারণ সেও ক্লোরোফিলের অধিকারী।

আলাদা করে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার কথাও আজ আর বলার দরকার নেই। প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা বলে কিছু হয় কিনা, সেই প্রশ্নে না গিয়েই বলি, নিজের কবিতা প্রকাশের ভার নিজে পেলে সেই কবি স্বয়ং এক প্রতিষ্ঠানের নাম হয়ে ওঠার সুযোগ পান।

তবে এখানেও আসে স্ব-সম্পাদনার প্রশ্ন। ঠিক সোশ্যাল নেটওয়র্কের মতোই ব্লগেও আগে নিজের কবিতার জায়গাটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া ভালো মনে হয়। কবিতা লিখতেই পারেন, কিন্তু সেই কবিতা প্রকাশের সময়ে একটা অধিকারের প্রশ্ন হয়তো আসে। লোককে নিজের কবিতা পড়ানোর অধিকার কি আপনি অর্জন করেছেন? সেটা যাচাই করছেন কী করে? এখানেই কবিতার আন্তর্জাল পত্রিকাগুলি অনিবার্য। সেখানে আপনার যোগ্যতার একরকম বিচার হয়। সেই বিচারকে গ্রহণ অথবা প্রত্যাখ্যানের দ্বারা আপনি নিজের কবিতা সম্পর্কে একটা অবস্থানে আসতে পারেন। একটি আন্তর্জাল পত্রিকাকে কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু শক্ত হাত রাখতেই হয়। না হলে সে ব্যক্তিগত ব্লগ অথবা ফেসবুকের আরেক সংস্করণ হয়ে যাবে। বা মুক্তমঞ্চের মতো কোনো ফোরাম। পত্রিকার গুণ তার থাকবে না।

আবার ইদানীং এমন ব্লগজিনের আবির্ভাবও হচ্ছে, যার সম্পাদক নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলতে সেটির জন্ম দিয়েছেন। অন্য ব্লগকে অনুসরণ এবং অনুকরণ তার মূলমন্ত্র, আলাদা কোনো দর্শন নেই। কেন সেই পত্রিকার উদ্ভব ঘটানো হলো, তিনি স্বয়ং বলতে পারবেন না, হয়তো বলবেন বাংলা কবিতার স্বার্থে তিনি এর জন্ম দিয়েছেন। দেখা যাবে সেখানে অন্যের কবিতা ছাপার অন্যতম শর্ত সেই সম্পাদকের কবিতা অন্য পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সুযোগ তৈরি করা। এবং ইদানীং সত্যিই অনেকে তাঁর কবিতা ছাপতেও শুরু করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পাচ্ছেন। বিনিময়ে উদ্যোক্তার কবিতা ছাপছেন। ফেউয়ের বদলে তিনি বাঘ হয়ে উঠছেন, এবং তার কারণ নিতান্তই তাঁর কবিতা নয়। যোগাযোগের এবং বিনিময়ের এই অভিশাপ ছাপা পত্রিকার ভুবন থেকে আন্তর্জালে প্রবেশ করেছে।

আবার কিছু অনলাইন পত্রিকা প্রথম থেকেই কবিতার নির্বাচনে নির্মম হতে চেয়েছে। একটি কবিতা নির্বাচিত হলে তিনটি কবিতা হয়তো বাতিল হয়েছে। একটি ওয়েবজিন বা ব্লগজিন সেটা করতে পারে। ফেসবুকে যে গ্রুপম্যাগগুলি আছে, তারাও পারে। কোনো ফোরামে বা ফেসবুকের ওপেন গ্রুপে সেই সুযোগ নেই। আবার একটি ফোরাম বা গ্রুপ জনারণ্যে আপনাকে নিজেকে যাচাই করার অন্য সুযোগ দেবে। রাস্তায় পড়ে থাকা হীরের টুকরোকে লোকে চিনে নেবেই, এই আশা আপনাকে দেবে। সেটা খুব সহজ পরিসর নয়।

শুধু আত্মপ্রকাশ নয়। আন্তর্জালের সুবাদে অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক অভিশাপ দূর হবে। টাকার অভাবে অনেকে বই করতে পারেন না। আবার নিজের টাকায় (তা-ও প্রয়োজনের দ্বিগুণ মূল্যে... আপনার বই প্রকাশক বিক্রির জন্য মোটেই করছেন না) বই করে, নিজের টাকায় সেই বই নিজের বাড়িতে ট্রান্সপোর্টে আনিয়ে, খাটের তলায় রাখতে হয়। সেই বই তারপর নিজের টাকাতেই লোককে পাঠাতেও হয়, নিজেই ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হয় তা কেমন লাগল। সেইসব দিন থেকে কবিরা মুক্তি পেতে পারেন আজ। ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’ পদ্ধতি এসে গেছে। আপনি নিজের পান্ডুলিপি নিজে কম্পোজ করে একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটকে দিতে পারেন। তারা সেই বই আন্তর্জালে প্রকাশ করবে। কোনো পাঠক যদি বই হিসেবে পেতে চান, তারা অর্ডার পেলে মূল্যের বিনিময়ে পাঠিয়ে দেবে। আপনিও নিজের বই নিজে কিনে কাউকে দিতে পারেন উপহার হিসেবে বা আলোচনার জন্য। এই পদ্ধতি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়তো নয়, তবে অসাধু প্রকাশকের লোলুপতা থেকে ভবিষ্যতের কবির মুক্তির পথ অবশ্যই।

তবে যে কবি স্বয়ং প্রকাশকের কাছে টাকা নিয়ে বই দেন, এই পন্থা তাঁর জন্য নয়। কিন্তু সেই কবির সংখ্যা কত? এবং বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কি আদৌ তাঁদের মুখের দিকে চেয়ে আছে? বাণিজ্যিক কবিতা... সাধারণ মানুষের কবিতাবিমুখতা দেখে এই ধারণাটাকে সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছু মনে হয় না। অথচ এই ধারণাকে আঁকড়ে থেকেই সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতা হাস্যকর এবং অবান্তর হয়ে পড়ে। আবার এও একটা প্রশ্ন : বাংলা ভাষায় এই মুহূর্তে ২৫ জন মানুষেরও কি কবিতা পড়ার ক্ষমতা, এবং তা নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আছে?

একটা কথা স্পষ্ট করেই বলি? আন্তর্জাল যে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ, এ নিয়ে খুব সন্দেহের সুযোগ আজ আর বোধহয় নেই। তালপাতার যুগ থেকে যেমন ছাপাখানা, লেটার প্রেস থেকে যেমন ডিটিপি, তেমন ভাবেই এসেছে আন্তর্জাল। এ অনিবার্য বিবর্তন বলেই আমি মনে করি। একে অস্বীকার করলে জীবনের এবং প্রাণের বিকাশের ধর্মকেই খারিজ করা হয়। একজন নগণ্য কবিতালেখক হিসেবেই এটা আমার ধারণা।


০৫ অরূপরতন ঘোষ

অচেনা শহরে, কবিতায়
অরূপরতন ঘোষ



যে কোনো অচেনা শহরে কবিতা লুকিয়ে থাকে, এমনই বিশ্বাসে বহুবার ঢুকেছি নানান শহরে। কখনও ভোরে, কখনও বা দুপুর-রাত্রে। সেখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা –- দু’চারদিন এদিক ওদিক দ্রষ্টব্যস্থল ঘুরে সময় ভালোই কেটে গেছে।

আত্রেয়ী নদীর পাড়ে। সামান্য দূরে শহরের আলো দেখা যায়। রিক্সায় হাসপাতালের পাশের রাস্তায়... জমিদার বাড়িতে। মৃদু গুঞ্জন ওঠে। কেয়ারটেকার ব্যস্ত রাতের রান্নায়। তার পাশে বসি। দু’চার দিন ভালোই কেটে যায়।

*********

আবার আলস্য আসে। সীমাহীন কর্মহীনতা, কখনও। উত্তেজনা হয়। উত্তেজনা বাড়ে, কমে। শহরতলির ট্রেনে, স্থৈতিক রশ্মির টান। লক্ষ্য করি, আরোহীর জামার চমৎকার রঙ... খুশি খুশি মনে হয়। দেখি ট্রেনের কামরায় লেখা ক্রোধবাণী। বাংলায় ও অস্পষ্ট অক্ষরে –- “রঞ্জিত মাতাল চুল্লু খায়। বউকে মারধোর করে। অজয় মাতাল রঞ্জিতের বউকে নিয়ে নিয়েছে”। আসন্ন সূর্যাস্তের মধ্যেই সেই দিন বাড়ি ফিরে আসি আমি।

*********

আকস্মিক ও দ্রুত
এক সমুদ্র রাতে এসে দাঁড়ায়, কিছু
ক্ষয়ক্ষতি করে
নগরীর প্রান্ত বরাবর
উড়ে যায় নীল শার্ট, রবারের মতো
ষাট ওয়াটের আলোয়
তাকেই দোনলা বন্দুক বলে ভাবি –-

অ্যাশট্রেটিও চলাফেরা করে ঘরের ভিতর
যেন ক্ষীণ আশ্বাসবিন্দু
জেগে ওঠে...

গতির ধারণাসমূহ, শূন্য বেগের হিসাব
সরল দোলগতি ইত্যাদি
আজ প্রয়োজনীয় আলোকাভাবে
এই ঘরে, স্বাদু নিরীক্ষার মতো মনে হয়!

*********

কবিতায় কয়েকটি বিন্দু মাত্র উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এদেরই শক্তিকে হ্রাস করতে থাকি ক্রমাগত। বাস গুমটিতে, রক্ত, কফ্‌, পানের পিক, লজেন্স বিক্রেতার বয়ামে চোখ রাখি। গোপনে। সামান্য দ্বিধাগ্রস্ততায়। অচেনা শহরে, দু’চার দিন সময় ভালোই কেটে যায়।

আহরিত তথ্যের এই স্বীকৃত রূপ একটি অন্তর্মুখি উত্তেজনা তৈরি করে। চক্ষু বিস্ফারিত হয়। শ্রুতির বিকল্পভাব সজাগ ও প্রখর হয়ে ওঠে। ছায়াগুলি ঢুকে আসে মনের ভিতর। ভিতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। এই সংক্ষিপ্ত ও ঘনসংবদ্ধ রূপ... তারই সামনে ঝুঁকে পড়ি দিনান্তে, অচেনা শহরে।

০৬ প্রশান্ত গুহমজুমদার

প্রশান্ত গুহমজুমদার
কাচঘরের আখ্যান



মধ্যবিত্ত যাপনের পরিচিত কিছু সংকট আছে। দেশকালে সে সব হয়তো কিছুটা অন্যরূপ পায়, বিষয়গুলি কিন্তু মূলত একই থাকে। সে সব সহ্য করাও বহু সময়ে অতি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আবার নশ্বরতার সব থেকে বড় সুবিধা, সব সময়ে হারাই হারাই ভাব। যা পাওয়া যায়, কোঁচড়ভর্তি করার জন্য তড়িঘড়ি। আর বিস্মিত হওয়া। আর জেগে থাকার ইচ্ছা। এই যে প্রবল গ্রীষ্মে কালচে পাতার আড়ালে হলুদ হয়ে আসছে ফল, একেবারেই নিভৃতে, নির্বিকারে, সেটুকু দেখতেই কি কম আনন্দ! আঙুলের ডগায় একটু একটু হারিয়ে যাচ্ছে পরিচিত দাগগুলো, সে আবিষ্কার কি কম বিস্ময়ের! এই যে ওই মেয়েরা, আমাদের ঘরের আর পাঁচটা মেয়েদের মতোই, অথচ আমাদের নয়, তাদের নানান ভাবে জানতে পারা, সংশ্লিষ্ট হওয়া, কম কথা! নানান ভাবে আমাদের বাবু-জীবনে রস সঞ্চার করা, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অর্থনৈতিক পুষ্টির যোগান দেওয়া, পরিচিত সামাজিক উঠোনটাকে একটু সভ্যভব্য রাখার জন্য নিয়ত শরীর পাত করা, আমাদের সাদাটুকু কিছু অতিরিক্ত পমেটমসমৃদ্ধ করে রাখার জন্য আরও একটু বর্ণময় হয়ে ওঠার ছলে প্রতিদিন কালো হয়ে থাকা, ক্ষণনির্বিশেষে দুয়ার অবারিত রাখা –- ওই মেয়েদের এ সব ইতিবৃত্ত অন্য আরেক আলোর প্রান্তে দাঁড়িয়ে জানতে পারাও তো এক প্রাপ্তি।


সৈয়দ আনোয়ারা হক এই পরিসরে আমাকে টেনে এনেছেন। রাজশাহীর এক আলোচনাসভার শেষে যখন প্রীতি আর ভালোবাসায় ‘ব্যবহৃতা’ শীর্ষক সমীক্ষা উপন্যাসটি আমার স্ত্রী তানিয়া আর আমাকে উপহার দিলেন, বিস্মিত হইনি। যেহেতু ইতিমধ্যেই তাঁর স্বভাবজ উষ্ণতায় আমরা যুগবৎ প্লাবিত, ঋদ্ধ, আপনজন। বইটি পাঠ করার পর, এই অকিঞ্চিৎকর বেঁচে থাকাটা কি তারপর একটু তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে উঠল না সে পাঠে! ইতিহাসে, ধর্মে, এমন কি বর্তমানেও কি আমরা জেনে যাচ্ছি না, পুরুষের অন্যতম অস্থাবর সম্পত্তি নারী! যে স্থানে সে নারী ঘটনাক্রমে স্থাপিত, যে গোষ্ঠী বা পরিবারে সে প্রণেত্রী (!) রূপে পরিচিত হতে চলেছে, সেখানেও সে কি আদপে অস্থাবর সম্পত্তির অধিক কিছু! বংশধরের অস্তিত্বের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে বিবাহপ্রথাকে সামাজিক মান্যতা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে নারীকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলার যে প্রয়াস পুরুষের, এ সব সন্দেশ পুরুষশাসিত সমাজে বেঁচে থাকা আমার ভিতর কি গোপনে সব সময়ই ক্রিয়াশীল থাকে না! Ecclesiastes-এর সেই চরম বিভ্রান্তিকর উক্তি, “...এবং মৃত্যুর চাইতেও তিক্ত দেখি নারীকে, যাঁর হৃদয় হচ্ছে ফাঁদ আর জাল, এবং তাঁর হাতগুলি বেড়ী...”, সেই তাঁদের নিয়ে, এমন কি তাঁদের মধ্যে অধিকতর ব্যবহৃতা, অধিকতর গোপন অথচ প্রয়োজনীয়, পরিত্যক্তা অথচ নিয়ত শোষিতা সেই নারীদের বিষয়ে সৈয়দ আনোয়ারা হক যখন কিছু কালাতিপাত করেন, সে বিবরণ তুলে আনেন নির্দ্বিধায় শব্দে শব্দে, অভিভূত হই। নশ্বরতাকে আরও একবার ধন্যবাদ দিই, এই দাহ সহ্যের সময়কাল অসীম নয়। নতুবা এই আলোছায়ার জীবন থেকে দূরেই থাকতাম, সেই জীবন যে মূল ধারার সঙ্গে বিলীন হতে স্বতই উদগ্রীব, অথচ হায়, নানান তত্ত্বে বা ক্ষমতার কূটকৌশলে দেশকাল নির্বিশেষে প্রান্তবাসিনী। তাঁদের নিজেদের একলা ঘরে মর্যাদা নেই, মানবিক বিকাশের সমস্ত পথ তাঁদের জন্য রুদ্ধ অথচ প্রগতির রথের চাকায় তাঁরা প্রতিক্ষণে ব্যবহৃতা। পুজোমন্ডপে তাঁদের দুয়ারের মাটি অতি গুরুত্ব পায়, অথচ সমাজের কোনো স্তরেই তাঁরা স্বীকৃত নন, তাঁরা নরকের দ্বার মাত্র। তথাকথিত প্রগতির রথকে সচল রাখতে তাঁদের যতই অবদান থাকুক না কেন, সে জঙ্গম ছবিতে তাঁরা এতটুকুও প্রকাশিত নন।

এতসব চিড়বিড়ে কথা তো ভুলেই থাকতে চাই। অন্তত চাইতাম। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে...! বেশ তো আছি রসেবশে, স্নেহে অথবা যৌনতায়! কিন্তু সৈয়দ আনোয়ারা হক দিলেন না সে স্বস্তিটুকু। কী ভাবে তিনি সক্ষম হলেন? কী তাঁর অভিপ্রায়? সে কি কেবল মধ্যবিত্তের ভদ্রাসনটুকু সামান্য নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য? নাকি ওই সব অন্ত্যবাসিনীদের খুব নিকটে আমাদের টেনে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে? কিংবা সে সব কিছুই নয়! তাঁদের নিয়ে আসা, তুলে আনা, একেবারে গৃহস্থের তক্‌তকে আড্ডাঘরে তাঁদের দাঁড় করিয়ে, আমাদের পুরুষদের হাতেগড়া নাড়ুর মতো সাধের সুপুষ্ট আলোবাতাসকে আরও সামান্য পূর্ণ করা! যেন বলা, এই দেখ এঁদের, এঁরা তোমারই পরিজন। এঁদের অস্বীকার করে তোমরা যে শুধু অসম্পূর্ণ হয়ে থাকছো তাই নয়, ভবিষ্যৎটিকেও ঠেলে দিচ্ছো গভীরতর অন্ধ কূপের দিকে। তোমরা পরিত্রাণ চাইছো, অথচ দেখ, সে পথ কতটাই না অপূর্ণ, খন্ড!

‘বাইরের মেয়ে’, ‘বেশ্যা’, ‘বারবণিতা’ কিংবা ‘যৌনকর্মী’, ‘পতিতা’, ‘আদিম শ্রমজীবী’ বা ‘ব্যবহৃতা’ –- যে শব্দেই এই আপাদমস্তক নারীদের অভিহিত করা হোক না কেন, তাঁরা ওই দুয়ারে দাঁড়ান অর্থাভাব, মেয়েদের সম্পর্কে আসভ্যতা প্রবাহিত ধারণা, ভোগবাদী মানসিকতা, পুরুষের প্রতারণা ইত্যাদি ইত্যাদির নিস্পেষণে। স্বভাবিক ভাবেই তাঁদের সামাজিক অবস্থান ভিন্ন হয়। যদিও উন্নতিশীল দেশসমূহের প্রান্তিক মানুষ, এমন কি যৌনকর্মীদের মধ্যে কাজ করে চলা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা American Jewish World Service (AJWS)-এর প্রেসিডেন্ট রুথ মেসিঞ্জার-এর নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণ অনুধাবনযোগ্য। “...In some ways, these women are much like me: they work hard and they care about their kids. But our lives are radically different in one fundamental way. These women are denied the basic human rights I’ve always had: protection from violence, access to healthcare, and the opportunity to earn a living however I choose. অন্য দিকে এঁদের নিয়ে কিছু ক্রুদ্ধ শব্দ, মরমী প্রতিবেদন, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ ইতিপূর্বে পাঠের সুযোগ আমার হয়েছিল। বিচলিত হয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি, আর এক ধরনের হতাশা মাথা নেড়েছে সর্বক্ষণ। কোনো পথ, নিরসনের, ওই যাপনের, খুঁজে পাইনি। আজ বলতে দ্বিধা নেই, তাঁদের অবিরাম আদিম শ্রমের ক্লান্তি ক্লেদ মালিন্য ধুয়ে যাবে চিরকালের জন্য, পৃথিবীর তাবৎ সামাজিক মানচিত্রে তাঁরা সমস্তরে উঠে আসবেন, এমন অপরূপ গোসলের খোঁজ তাঁরা কোনোদিন পাবেন না, এমন প্রতীতি হয়েছে।


তাহলে ‘ব্যবহৃতা’র মতো একটি সমীক্ষা উপন্যাসের দু’ মলাটের মধ্যে বিধৃত অন্ধ সে জীবনের যে চালচিত্র, সেখানে কেন বারবার বিচরণ করি! কোনো উদ্ধারের প্রকল্প কি আশা করেছিলাম সেই ১৪৪ পৃষ্ঠার শব্দে শব্দে? দু’এক কথায় চেষ্টা করা যাক সেই কারণসমূহ কিছু জানানোর।

১) আদ্যন্ত মরমী পর্যবেক্ষণ। একজন বেশ্যার এই ভারতীয় উপমহাদেশে সাজপোশাক বা প্রসাধন কেমন, তার একটা নিখুঁত পোট্রেট তিনি তুলে ধরতে পারেন, “...চোখের গাঢ় কাজল একেবারে লেপ্টে চোখের খোড়ল ঢেকে ফেলেছে। মুখের টকটকে লাল লিপিস্টিক ঠোঁট ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দু’পাশে। গালে গোলাপি রুজ দুই গাল জুড়ে। নাকে চকচকে নকল সোনার নাকফুল নাকের ফাতনা প্রায় আবৃত করে ফেলেছে। রুক্ষ চুল বুকের দু’পাশে ছড়ানো। পরনে টকটকে হলুদ শাড়ি। গলায় নকল সোনার হার। শ্যামলা পায়ে সোনালি ফিতের স্যান্ডেল...”। যার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আবার অনায়াসে ভাবতে পারেন, “ওদের তো মা বলে সম্বোধন করা উচিৎ”।

২) মধ্যবিত্ত সীমাবদ্ধতার অসংকোচ প্রকাশ, “...যে বিছানায় শরীর বেচাকেনা হয়, সেখানে বসতে আমার শরীর কেমন ঘিনঘিন করতে লাগলো”। অথবা “...অতিশয় ভয়ে সেই নলে মুখ রেখে আমি পেপসিতে চুমুক দিলাম”। কিংবা, “...একজন যৌনকর্মীর এরকম আলিঙ্গন আমার ভালো লাগেনি”।

৩) সামাজিক লাম্পট্যের উন্মোচন, “...একজন সতী নারীর আত্মহত্যার চেয়ে একজন চরিত্রহীন মানুষের এ সমাজে বেশি প্রয়োজন”। আবার, “...নারীর মর্যাদা এবং সতীত্ব নিয়ে তাদের ভাবার কোনো সময় নেই। শুধু তাদের ঘরের নিজের নিজের বউ এবং মেয়েগুলো সতী থাকলেই হলো। তাদের সতীচ্ছেদ করবে পৃথিবীর একজন মাত্র পুরুষ, ব্যস...”।

৪) আন্তরিক উচ্চারণ, “...যখন তার নিজের শরীর লেপ্টে আছে ফেলে আসা শৈশব, ফেলে আসা খেলার সাথীরা, দুধের গন্ধ লেগে আছে তাদের কচি মুখে। নরক তাহলে কাকে বলে?” কিংবা তাঁর ভাবনা, এই মেয়েটি “...কি একজন যৌনকর্মী নাকি একজন মা? নাকি এই দুই মিলিয়েই সে একজন নারী?”

৫) উত্তর প্রজন্মের জন্য আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে একজন রেসিডেন্স বেইসড্‌ পতিতার কথাগুলি আবার মনে করতে পারি, যেখানে তিনি অক্লেশে বলছেন, “...আমাদের ক্লায়েন্টদের প্রায় প্রত্যেকে, বলতে গেলে পঁচানব্বই ভাগই বিবাহিত। বাড়িতে তাদের স্ত্রীরা আছেন। তাদের আমরা ঝুঁকিহীন জীবনযাপনে সাহায্য করছি। তাদের এসটিডি আর এইডস্‌-এর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখছি। এ সাহায্য চোখে দেখা যায় না বটে, কিন্তু এটি একটি বিশাল সাহায্য, দেশের স্ত্রীদের সুস্থ রাখার জন্য”। অথবা লেখিকার একান্ত উদ্বেগ, “...তাদের মনোজগতের ধসের সাথে কারও পরিচয় হচ্ছে না। তারা নিজেদের ভেতর নিজেরাই মরে যাচ্ছে। তারা বড় হওয়ার সাথে সাথে কীটদষ্ট হয়ে যাচ্ছে”।

৬) প্রবল কনজিউমারিসম্‌-এর বিরুদ্ধে সোজাসাপটা কথা, “...এই যে দেশব্যাপী বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি, এটাও কি একটা যৌনব্যবসা নয়? ...যেখানে পণ্যদ্রব্য আর নারীকে এক পাতে কেনা হচ্ছে”। অথবা, একজন বাইরের মেয়ের ক্ষুব্ধ উচ্চারণ, “...আমরা হচ্ছি অসামাজিক পণ্য”।

৭) অতিজীবিত এক দার্শনিক প্রশ্ন, “...না কি এসব কিছু না, সব কিছু একটা ক্ষমতায়নের বলয়ের ভেতরে ঘূর্ণিত হচ্ছে?”

৮) এবং ওই আসভ্যতা বুনো জলের প্রবল স্রোতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন গবেষকের অপূর্ব মানবিক ক্ষেদ, “...এখন আমার বুকের ভেতরে যেন সেই ফারাও-এর বুকের ফাটল! অসংখ্য অজস্র ফাটল। আর সেই ফাটলের ভেতর দিয়ে যেন পায়রার মতোন একেকটা জিনিস উড়াল দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে! বেড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রতি আমার আশা, আমার বিশ্বাস, আমার শ্রদ্ধা, আমার প্রেম, আমার আস্থা। তারা সব বেড়িয়ে যাচ্ছে আর হারিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। ...পুরুষের প্রতি, যে পুরুষ আমার বাবা, আমার স্বামী, আমার পুত্র, তাদের প্রতি কেন এরকম মনোভাব আমার হচ্ছে!” সসাগরা এই ধরণীর একজন নারীর এই অনুভবে বিস্তৃত সামাজিক জীবনের অপর লিঙ্গ কি কোনোদিনই ভাবিত হবে না! উত্তরপৃথিবীতে তাহলে কি আমরা সবাই বেশ্যা (!) হয়ে যাব! অথবা এখন-ই তাই?

৯) পৃথিবীর প্রায় সমস্ত প্রান্তে, এই বারবণিতারা আইনরক্ষকের হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তাঁদের জরিমানা হচ্ছে; এমন কি সমাজসভ্যতাকে পরিচ্ছন্ন রাখার অজুহাতে কাজের ক্ষেত্র থেকে, বাড়ি থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। উন্নত বা উন্নতশীল দেশে অসম নীতির কারণে আইনরক্ষকদের লম্বা হাতে কত অনায়াসেই না তাঁরা বিভিন্ন সময়ে নিগৃহীতা হতে থাকেন, ধর্ষিত হন, এমন কি তাঁদের ব্যক্তিগত জিনিসপ্ত্র কন্ডোমসমেত বাজেয়াপ্ত করা হয়। একজন শ্রমজীবী, সভ্যতার মোড়কে ঢাকা একটা সমাজে কেন এমন ব্যবহার পাবেন, ‘ব্যবহৃতা’ এই জরুরি প্রশ্নটিকেও রেখেছেন আমাদের সামনে। একজন দক্ষ সমাজকর্মীর কাছে তাইল্যান্ড-এর বারবণিতার উচ্চারণ দেশনির্বিশেষে সমস্ত যৌনকর্মীর, “Nothing about us, without us.” “If we intend to develop policies that are fair and just, we must collaborate with sex workers’ themselves to afford them the dignity that they and all of us deserve. It’s time for sex workers’ rights to be an integrated part of the global human rights agenda.” তাঁরা Freedom of movement to migrate, Freedom to access quality health services, Freedom to work and choose one’s occupation, Freedom to associate and unionize, Freedom to be protected by the law, Freedom from abuse and violence, Freedom from stigma and discrimination কেন পাবেন না, এই প্রশ্ন সামান্য অন্যভাবে সৈয়দ আনোয়ারা হক-ও উত্থাপন করেছেন। এখানেই তিনি সার্থক, হয়তো অনন্যাও। প্রস্তাবটি শুধু যৌনকর্মীদের সংগঠনসমূহের কাছে নয়, এমন কী তাবৎ নারীবাদী নেত্রীদের কাছেও নয়, বরং এই সরল জিজ্ঞাসা সমস্ত পতিতাদের তরফে সভ্য শিক্ষিত মরমী মানুষের কাছে, অতীব শক্তিমান রাষ্ট্রের কাছে। এ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন এসেছে।

বইটির প্রচ্ছদশিল্পীকে হার্দ্য অভিনন্দন, একটি চমৎকার প্রচ্ছদ পাঠকদের উপহার দেওয়ার জন্য। ‘শুদ্ধস্বর’ এমন একটি প্রকাশ-এর জন্য গর্ব বোধ করতেই পারেন।

[এই সমীক্ষা উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল গত ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। প্রকাশক : শুদ্ধস্বর, ৯১ আজিজ সুপার মার্কেট, (৩য় তলা), শাহবাগ, ঢাকা, বাংলাদেশ। বইটির বিনিময় মূল্য ২২৫ টাকা। প্রচ্ছদশিল্পী : শিবুকুমার শীল।]

<<< কবিতার কালিমাটি / ২৭ >>>


কবিতার কালিমাটি / ২৭

কবিতা লিখেছেন ভূমেন্দ্র গুহ, সমীর রায়চৌধুরী, বারীন ঘোষাল, দোলনচাঁপা চক্রবর্তী, মেঘ অদিতি, হাসান রোবায়েত, অনুপম মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চক্রবর্তী, রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, ঊর্মি খান, কাজল সেন, মাসুদার রহমান, উমাপদ কর, সোনালি বেগম, নন্দিনী ভট্টাচার্য, অলোক বিশ্বাস, অত্রি ভট্টাচার্য, সাজ্জাদ সাঈফ, লিপিকা ঘোষ, দেবযানী বসু, সুবীর সরকার, শুভ্রনীল সাগর, বিশ্বজিৎ, চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়, রোশনি ইসলাম, ছন্দম মুখোপাধ্যায়, দীপঙ্কর গোস্বামী, সন্দীপন দাশ, ইন্দ্রাণী সরকার, অজিত দাশ এবং নীতা বিশ্বাস।

০১ ভূমেন্দ্র গুহ

তিন বার
ভূমেন্দ্র গুহ

অভিশপ্ত হয়ে আছি সারাটা শরীরে।
এ-শরীর অভিশপ্ত, রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বুঝে নিতে থাকি।
রমণীর শরীরের সুকৃপণ রন্ধ্র থেকে উর্ধ্বপাদ-অধোমুন্ড হয়ে
এক বার বেরোতে গিয়ে ঢের পাপ করা গেছে, যেহেতু সম্যক কষ্ট, যেহেতু সমূহ
রক্তপাত ফলিয়ে তুলেছি, রমণীটি ছোট হোক, বড় হোক, যে-রকমই হোক;
ছিলুম যথেষ্ট নোংরা, ঝিল বিল ম’রে যাওয়া নদীর বিশাল মোহনা থেকে উঠে।
এবং দ্বিতীয় বার সেই গর্ভপ্রদেশের অন্ধকার বিছানায় রক্তের লোমে-অনুলোমে
নিজেকে নির্দিষ্ট দেখে : অসম সংগ্রাম ফের পৃথিবীতে পা রাখতে, হেরে যেতে থাকা
সইতে ফের পায়ে-পায়ে হেঁটে যেতে পৃথিবীর রাস্তার উপরে –- নিঃস্ব রক্তপাতে –-
যদিও এ-বার তা অন্য চেহারায়। তিন-বারের-বার ঠিক শ্মশানের নিকটের নদী—
জল, তিল, ভাঙা কুঁজো, ধোঁয়ানো চিতার কাঠ, শ্মশানবন্ধুরা, দিশি মদ,
অবিকল জলের মতোন জেগে ওঠা–- রক্ত নয়–- সাদা জল আনকোরা বাঁশের ডগায়
অবিরল –- সাদায়-কালোয় ঢাকা মাথা ফেটে গেলে।
অতএব কালাকেষ্ট যে-পালা গাইছে, তা মাথুর, ঠিক চ’লে যাওয়া নয়,
স্বর জলের উপরে
ভেসে যাচ্ছে মৃদুমন্দ সেই মোহনার জলে, যা এখন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে সহসা—
অভিশপ্ত শরীরের অভিশাপ শোক হচ্ছে আগুনের পবিত্র নির্মোকে।


০২ সমীর রায়চৌধুরী

নানা রঙের সিন্ডিকেট
সমীর রায়চৌধুরী


একজন ভাবুক ব্যক্তি মানুষের কাছে ভাববিশ্বই তাঁর ভূখন্ড
একজন ইসলামিস্ট্‌ মনে করেন ইসলাম তাঁর কৌম
সীমার দু’পারে ভাষা আন্দোলনে শরিক বা বিশ্বাসী যাঁরা
বাংলা ভাষাই তাঁদের ভূখন্ড
তা বলে তাঁরা নাস্তিক নন
নেটিজেন সুকুমার চৌধুরী মনে করেন
বহির্বঙ্গ আজ অপ্রাসঙ্গিক
বন্ধু ফণিশ্বরনাথ রেণু নেপালের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন
পিকাসোকে দেখা গেছে স্পেনের গৃহযুদ্ধে
তাঁর ভাববিশ্বের টানে

আজ অনেক জুয়াড়ির খেলার জায়গা বেটিং সিন্ডিকেট
এক কোটি টাকা মানে খোঁকা
তার বেপরোয়া জুয়ার দান
তাকে ক্রিকেটের ভি আই পি বক্সে দেখা যায়
বা মন্ত্রীত্বের গদিতে

একজন কবির কাছে যুক্তির বাইরে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া
আর কোনো গত্যন্তর নেই

এক শূন্য থেকে আর এক শূন্যের দিকে চলেছি আমরা

না লিখতে পারার কষ্টের চেয়ে লেখকের আর কোনো কষ্ট নেই

বহুদিন পর একটা কবিতার বই বেরিয়েছে
তবু সে ভয়ে ভয়ে

০৩ বারীন ঘোষাল

দুসরা কবিতা
বারীন ঘোষাল



চাই দেখতে সেই স্বপ্ন বিছানাটা আর সেই মেয়েটা কে কাকে পাতে
আরও চাই সোনা-দিন নিশা আর নিশাদিন পদ্যে পোড়া সাপ ও অবাক
মেয়েছেলেটির চাই ওলোট পালোট শরীরের হাতে মুখ আর মুখড়ায় হাতের অমিল
ধরো ফুলটুল আছে চাই প্রজাপতি-নেই দৃশ্যে আমাকে বাজালো স্বকাল
আবার করে মনে পড়তে চাই আমার অলীক গল্পরা কেউ পড়ুক
আর দ্যাখো উম্‌ম্‌ম্‌ম্‌
                          না
                          দাঁড়াও
চাই আঁকো মেমারি স্টেশন নামের গজবগুলো
টেন টেন টায়োস্কোপে কাঁপা বন্দীশে চাই জলশহরের আরো আয়ু
সে কি আমার জন্য মারুক আমাকে মারতে চাই হাড় গোড় জিরো জিরোতে

আমার সময়ের বেগুনটারি থেকে দিনবাজারের দিকে ডাহিন গণিকাপথের দরজাগুলিতে চাই চাই চাই নক করছে যে যুবক সে তো বোবায় পড়া এত পাখিহাঁস এত কিসের দুসরা কবিতা দি লু বয় যদি শব্দের ভেজা যায় শুকিয়ে ঝ’রে পড়ে এভাবে নাউনেরা প্রোনাউন বেশে এত আমি
        স্বপ্ন বিছানা         মেয়েটা
                    দিননিশা        পদ্যে পোড়া সাপ
মেয়েছেলেটি                 শরীর                     হাত মুখ
         ফুল                  প্রজাপতি                 আমাকে
                                                                      মেমারি স্টেশন
                 টায়োস্কোপ                জলশহর
সে           আমার      আমাকে        হাড়      গোড়
     আমার      বেগুনটারি     দিনবাজার      গণিকাপথ     দরজা
                               যুবক                            পাখিহাঁস
    দুসরা কবিতা                           লু                           শব্দের ভেজা


এই খসা ছবিটা পলক ফুরায় দুসরা কবিতা হয়ে নিঃশব্দ –- এই শব্দে থাক


০৪ দোলনচাঁপা চক্রবর্তী

দুটি কবিতা
দোলনচাঁপা চক্রবর্তী



দৃষ্টিবিভ্রম – ৪৭


সাঁতারের সময় ফুরিয়ে আসছে
             দুপাড় ভেঙে জল ছিটানোর মৌ
কুউ বলে উঠে এলো বারান্দায়

এখন বালিতে কোনো ঘোড়া নেই। ঘোড়াদের ভাই-বেরাদর নেই।

গম ছেটানোর মতো নিরীহ ইচ্ছেগুলো
ঘুরপাক খায়

কাঁচা আমের বোল
ঘাড়ের যন্ত্রণা পাকিয়ে তুলছে রোদে



দৃষ্টিবিভ্রম – ৪৮

আবছা হয়ে এলো বালিঘড়ি

বিবাহকুসুমে, ঢেউ ভাঙছে বিকেলের রোদ

নোনা হাওয়ার
        পরতে পরতে ছই

দূর থেকে, ভাটিয়ালি গেয়ে ওঠে
        রক্ত-মাংসহীন চাঁদের নাবিক



০৫ মেঘ অদিতি

কখনও হয়নি দেখা চন্দনের বন...
মেঘ অদিতি


নীল খামে ভেসে আসে সকালের গান


রবি তার মাথায় স্নেহমাখা আলোহাত রাখে। চারপাশ ভেসে যায় –- গান আর কবিতায়। কিশোরী ধীরে এসে দাঁড়ায়, তারুণ্যের দরজায়। মেলে ধরে তার পদ্মদল। ঝুলবারান্দায় তখন উঠে আসে জেসমিন। চিক্কণ পাপড়ি রাতজেসমিনের খুব গন্ধমাখা এক হলুদ বিকেল সেদিন। সে সুবাসে, সে আভায় তার হৃদয়ে বাজে সুর, কাজলচোখে এসে পড়ে মায়াদৃষ্টি।
মুহূর্তে তরুণীর লঘু পা, তরুণীচঞ্চল হরিণী। অতঃপর নীলখাম। লেখা থাকে--

ভালোবাসি, বড় ভালোবাসি
ভালোবাসি, জন্মের মতো
ভালোবাসি, মৃত্যুর মতো…

অল্প কিছু শব্দ, তাতেই তার শ্বাস আটকে যায়, পরক্ষণে স্পন্দন দ্রুতগামী হয়। উদাস চোখ আনমনা। দূরের সবুজে চেয়ে থেকে, হয়ে ওঠে তা -- সমুদ্রঢেউ।



আবার মিলায় যে চোখ, ওই বিকেল হাওয়ায়




স্পর্শ নয়, গন্ধ নয়। চোখ থাকে শুধু চোখে। অরণ্য মুখরিত শব্দ বকুলে। অনুচ্চে তরুণী কি বলেছিল, বড় ভালোবাসি?

তরুণ শোনেনি। তরুণীও জানে না তরুণ হৃদয়ে জেগেছিল কোনো শব্দ প্রহর। দ্রুত নিঃশেষিত আরেকটি হলুদ বিকেল ফুরিয়ে যায় তারপর কেবল অদর্শনে। আসে তীব্র প্রতীক্ষার এক শীতল রাত। রাত পেরিয়ে পরদিন ম্লান ভোর।

তাকে আর কখনো দেখেনি সে তরুণী সজল চোখ
কাজল ধুয়ে গেলে বুঝি পড়ে থাকে শুধু জলের সিম্ফনি!


অচেনা বাতাস, ভেসে যায় কার শব্দরেণু…



এখন মধ্যদিন। আবারও সে রবি’তে লীন, সে ধারণ করে রবিকে তার জীবন ভারে। নৈবেদ্য রাখে সে গানের রেকাবে। তাতেও মন অস্থির হলে গীতবিতান সরিয়ে তুলে নেয় অমিয়গরল অনন্ত সোপান এক শূন্য ভুবন। সেখান থেকেই তার জানালায় একদিন বর্ষা আসে; নীলগিরির খোঁজে। পূর্বজন্মের চিঠির বদলে বৈদ্যুতিনচিঠি আসে কবিতায়, গানে। কথা বলে গানের দোহার । কামিনী গন্ধ মেখে বলে যায় --

অলক্ষ্যে ছুঁড়েছ তীর হৃদয়ে আবার?
উঠেছে ঘূর্ণি তুমুল
জাগরী কে তুমি
তন্ত্রিতে বাজাও কেন অলৌকিক সুর!

নিউরণে বৃষ্টিস্নান, হৃদয়ে পাতার মর্মর। ধারাস্নানে ভিজে ওঠে নগরী রাতপ্রহর। তার শরীর ফুঁড়ে বেরোয় উড়ান ডানা। উর্ধ্বাকাশে চিত্রার্পিত তার দৃষ্টি যখন, তখনই ছোবল তোলে এক বিষধর।


কখনো হয়নি দেখা, চন্দনের বন অথবা তোমারে...

আপরাহ্ণিক রাগিনী বেলা। প্রহরের শেষ গান। থেকে থেকে ডেকে যায় বিষাদপাখি। ক্লান্তির ভাঁজে জমে ওঠে কালশিটে শিরা। তারই গায়ে এসে পড়ে কনেদেখা আলো। সে হলুদ আভায় তাকে দেখায় বালিকার মতো। লক্ষণগণ্ডির বাইরে পা রাখতে ভরসা হয় না, তবু বার বার সে অমোঘ ডাক, ফেরানো কি যায়!

সে ভেসে যায়, তাকে ভাসিয়ে নেয় এক জ্যোৎস্নাপ্রবল রাত। চন্দনের বনে বনে বেজে ওঠে অলৌকিক সুর।

যেতে যেতে খানিক পোড়ে তার ডানা
যেতে যেতে দলে যায় সে নিশিকুসুম...
রাত তাই তার চাদর গুটিয়ে নেয় ক্রমে

ওই সম্মোহনে যত সে ছুটে যায়... যায় ছুটে...
তখনই মিলিয়ে যায় শেষতম দূর শুকতারা...

সে তখন বালিকা থেকে কিশোরী হয়। কিশোরী ছুটে চলে চন্দনগন্ধমাখা পোড়া ডানা নিয়ে। তার ডানার আঁচে পুড়তে থাকে তার হৃদয়। সে ধীরে ধীরে তরুণী হয়, যৌবনপ্রাপ্ত হয়

হৃদয় ফুঁড়ে ওঠে লাভা... সে মধ্যবয়সে পৌঁছায়।
হৃদয় ছাই হলে সেখানে পড়ে থাকে নিস্তব্ধ কবিতা...

০৬ হাসান রোবায়েত

দুটি কবিতা
হাসান রোবায়েত

এপিটাফ


যতদূর সন্ধ্যা হলো সিঁড়ি
পাথরের কোনো কোনো দাগ পাঁচিল টপকাতেই
                                                   ছায়া...
কম্পার্টমেন্টে যে ট্রেন
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জাদু লাল হয় সিগন্যাল

দুটো বেঞ্চ
ছানা গজিয়ে জারুল ভাঙছে ডানায়
আঙুল নিভিয়ে বৃষ্টি
কাল যারা বর্ষাতি হাতে মাঠ ভুলে ছিল পায়ে

এপিটাফ শূন্য ছিল
জিরাফের হাওয়া ভেঙে ভেঙে হেঁটে যায়
                                              নদী


দূরত্ব

দূরত্বের নাম
পাখি

মেয়েটা ব্লাউজ এঁকে
বুঝে নেয় কুয়োতলা

চশমায় পথ হারিয়ে
বাবা পাশের বালিশে

সমস্ত সকাল মিউট
ভাঙা রোদ
দেওয়ালের ফ্রেম

০৭ অনুপম মুখোপাধ্যায়

ফলের ভগবান
অনুপম মুখোপাধ্যায়


এক
এক
ঙেহুল্লো
রং আর প্রথমতা ১ হয়ে উঠছে

কী করে
কী করে
এক গ্রামের বাসক গাছ আরেক গ্রামের স্নানে এসে মিশছে

জমা কফ মিলিয়ে যাচ্ছে
অনেকে সুস্থতায়
অদ্বিতীয়
হচ্ছে

মডেলরা
রোদ ফেলে
পাছা ফেলে
মাই থাই পুংদন্ড ফেলে
মেপে নিচ্ছে ক্যানভাসের

খরচ

ক্যানভাস ছেড়ে উঠে যাচ্ছে
সোসাইটির
আলোর ছোপগুলো

৪ ডিগ্রী হেলে থেকে চলছে সংসার

পোকার আপেল
কীটের সংসার
কিছু অব্দি ছাড়ানো বেদানার খোসায়
বিভিন্ন বাতাস নিয়ে ঢুকতে পারছি না

আমি

বেরোতে...

ফলের ভগবান
তুমি আমাকে ভুলিয়ে দিচ্ছ কেন

তুমি

এই পিচ্ছিলতায়

আমাকে ১মাত্র ঝুলিয়ে যাচ্ছ
কে

০৮ প্রদীপ চক্রবর্তী

বঙ্গবিজেতা
প্রদীপ চক্রবর্তী



অপলকা জলমগ্ন চন্দ্রমাতে
এক অদ্ভুত সর্বত্রগামিনী চোখ,
এখানে আরেকবার চোখের দেখা—
ছিঁড়ে গেছে...
যে বিন্দু জনপদ যে নদীর বিন্দু শস্যগোলা—
নিষ্প্রদীপ অভিসারে চতুর শিকারি বসে থাকে অপেক্ষায়

এই অন্তর্গত লেখ্য আলো -- রক্তমাংস
যুযুধান বাঁচা...
যদি খেলা যায়
উচ্চাকাঙ্খী যুবক     তারও ঠোঁটে আজ মেঘলা অর্গান
উঞ্ছ ঠোঁটে লাল নীল বিষঠুংরি
শারীরিক চেতনা ঠেলে বহুদিন পর তুমি এলে

বাড়িটা থাকুক আজ। খুঁটোবাঁধা গরুটি দেখিয়ে
কিসের ব্যঞ্জনায় সর্বত্রগামিনী আয়ুষ্কাল দেখাব তোমায়...
ঘরে চাল বাড়ন্ত। এদিকে কীটাণুকীটের মতো ঘোরতর
এক রঙিন বিন্দু থেকে রোমন্থন।
এই বঙ্গে অব্যক্ত যে থাকা যায়,
অবলীলায় সম্প্রসারিত আদালতের কনিষ্ঠ কেরানি
ক্রমে পরিস্ফুটিত গ্রন্থকার—
... ‘অ্যাই পানিপাঁড়ে’ –- খিটখিটে আগুন
তুই অবশেষে লক্ষ্মীবিলাসের গন্ধে চাকরি পেলি...!

০৯ রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রমণতা
রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়


শ্রমণ আঙুলে দর্পণহীন ব্যাকরণ। করণের গায়ে এত স্মৃতার্ত ছাপ। বিন্যাসের ভেতর লতিয়ে উঠছে অবিন্যস্ত অক্ষর

পারাহীন রহস্যে মোড়া এই চলমান লিপি কার কথা লিখে রাখে? কোন্‌ লেখমালা থেকে গড়িয়ে পড়ে পাথরকোঁদা বীজ

বোধিসত্ত্বের কপালে যেদিন ঘর ছাড়ার স্বত্ব লেখা হলো, আমি সাধ্যমতো ধাক্কা দিয়েছি তোমার শীতার্ত সিংহাসনে

মুখ ফিরিয়ে রাখলেই দেখাটা উহ্য হবে এমন তো নয়। বিচ্ছিন্নতার দায় তোমারও কিছুটা

শুধু যদি বহনের জন্যই এতটা বাহিত হতে পারো, তবে কেন পাখিদের ঠিকানা মিলছে না

উষ্ণতা খুঁজতে বেরিয়ে এত যে পরিযায়ী যাপনের পাল্লা দিচ্ছ, কোথায় লিখবে তার ভিক্ষুকাহিনী

আমাদের সিদ্ধার্থরা প্রতিদিন ঘরছাড়া। জন্মান্তরহীন বার্তা নিথর দাঁড়িয়ে থাকে প্রতীকের পাশে। মধ্যবিত্ত নদীর গায়ে লাগে দার্শনিক শ্রমণতা



১০ ঊর্মি খান

গন্তব্যহীন পাথরসময়
ঊর্মি খান


এখানে শুধুই শূন্যতা!
বিষণ্ন সমুদ্রের বিহ্বল ঢেউ বৃক্ষের মতো স্থির
কাঠ ঠোকরার মতো ঠুকরে যাচ্ছি ঢেউগুলো...

আমার আকাশ নেই পাহাড় নেই
দেবতা নেই প্রজাপতি নেই
...
শুধু শরীরের কালচে দাগগুলোতে হাহাকার

আমার প্রেম নেই কবিতা নেই
ঘাসফুল নেই ঘুম নেই
...
আছে শুধু একগুচ্ছ পরিপাটি অন্ধকার

১১ কাজল সেন

আমাদের সান্ধ্যভ্রমণ
কাজল সেন


বয়ে নিয়ে যাওয়া শহরের ব্যস্ততায়
আমাদের সান্ধ্যভ্রমণ
ভেজা ভেজা নারীদেহ ভেজা কাঠ ভেজা দাঁড়কাক
তুমি রফা বললেই আমার দফা
তোমার ১লা অগ্রহায়ণ আমার ৩১শে মার্চ
কতদিন যে দেখা হয়নি ফসফরাস মুখ

ভদ্রপুরুষরা এখন এখানে দীর্ঘকালীন মস্করায়
মেয়েদের দীর্ঘ গ্রীবায় একটানা সুরেলা গীতবিতান
আহা রে কী যে নিপুণ তোমার হাতছানি
জমেছে অথৈ মেঘ
বগলবন্দি হয়ে আসছে পার্বতীর শাড়ি
তাহলে এখন রাত ক’টা
বারোটা বাজে কি
বারোটা বাজলেই তো সকালের শুরু
সুপ্রভাত সুপ্রভাত
শরীরে এবার শান্তি নিয়ে এসো শুক্রাচার্য মহারাজ

উড়তে উড়তে তবেই না উবে যায় বয়োবৃদ্ধ ডানা
ঠান্ডা জলে জেগে থাকে কচি ডাবের স্মৃতি
জল
এত জল
এত পরিণত জল
গড়াতে গড়াতে বল
ব্যস্ততার শহরে
কখন যে টপকায় আমাদের সান্ধ্যভ্রমণ 



১২ মাসুদার রহমান

সুমনের গান
মাসুদার রহমান


যেভাবে জারুলফুল প্রিয় তালিকায় চলে আসে
প্লেয়ারে বাজে এক সন্ধ্যায়
সুমনের আধভাঙা চাঁদ

সেভাবেই সিলিং-এর লকটাতে সূর্য ঝুলে থাকে

একটা বৃষ্টি বিকেলে
লেখা হয় হিমুদের আত্মহত্যা কলা

রাঁধুনিক হাতে কলাবিদের কাঁচা-কলা তরকারি হচ্ছে

আত্মকলা রবীন্দ্র যাত্রার মাঝপথে
অ্যাবাউট টার্ণ হয়ে বার বার সুমনই গাইছে 

১৩ উমাপদ কর

যেটা লিখতে চাইলাম
উমাপদ কর

যেটা লিখতে চাইলাম সে কেমন কলম থেকে ভূত হয়ে গেল
যা বলতে চাইলাম তার সমাধির পরে লাল দোপাটি
যেমন হাসতে চাইলাম তার বাহ্যিক ঝলক কর্পূর
শব্দটাই মনের অতল হারানো, পংক্তিটা যজ্ঞের পোড়া কাঠে লুকোনো
আর বাক্যটার কথা জানে সকাল সাড়ে এগারোটার বাক্যহার কোকিল
নিদেন একটা ধ্বনিটুকরো পুকুরের মাঝে পড়তে পারতো
আমি দুলে যেতে পারতাম ঢেউয়ে ঢেউয়ে
একটু হলেও পাড়ের কাছে এসে নিঃশ্বাস নিতে পারতাম
দমবন্ধ ভাবটা একটু হলেও কাটতো
কিংবা বন্ধই হয়ে যেতে পারতো নীলটুকু, চোখ থেকে আকাশ...



১৪ সোনালি বেগম

বক্স-ক্যামেরা
সোনালি বেগম


থমকে থাকা পথ-হিমালয়।
প্রথম চা-এর কাপ হাজার বছর আগে
কৃষ্ণজল ঢেলে তৃপ্ত মিসুরী-মিসিসিপি নদীর ধারে।
স্পেন-এর বিশাল অ্যাকোয়ারিয়াম জলে গ্রন্থিবন্ধন দুলে ওঠে
ভেসে যায় খড়কুটো ঝড়ের দাপটে ---
গৃহসুখ সে তো আদা রসুন মশলার স্বাদে এলোমেলো
ভোরের পাখির গানে মুগ্ধতা ছেয়ে থাকে।
তাপদগ্ধতায় ফেটে চৌচির খেত
এখন ভাবতে হবে শ্বাসপ্রশ্বাস পৃথিবীর।
নদীর তীরে ‘বোট হাউস’ কলরোল দিনরাত
‘ববিন’-এর সুতোয় টান চলমান সেলাই-মেশিন।
জলের খোঁজে মাটির কোলে অন্তহীন ফেরা
ডুমুরগাছে প্রজাপতি ফড়িং স্টোর-রুম অবিচল।
শক্ত চোয়ালে লেগে থাকে ক্রুরতার ছায়া ---
বক্স-ক্যামেরায় ধরা থাক কিছু গুচ্ছ ফুল ও চাঁদতারা

১৫ নন্দিনী ভট্টাচার্য

অনেকটা আলিবাবার মতোন
নন্দিনী ভট্টাচার্য



তুমি ভিনদেশী তাঁরা নয়, বোধহয় ভিনদেশী প্রজাপতি
উড়ে এসেছিলে ফাগ-ফাগুয়ায়
বোতাম খোলা বুকে, বেঁধেছিলে ঘর
আজ পা বাড়ালে নিজের পথে অচিন পাখি হয়ে

শুঁয়োপোকা দিব্যি বাড়ছে মনে, পাখা গজায় গজায় ভাব
শুধু কন্যে তোমার অভাব
একলা থাকে রাত, শুকনো গলা ঢোঁক
কন্যে "জল পাই কোথা ?"

আর স্বপ্নে ছুঁয়ে তুমি
আর আসে না ঘুম...
হাতড়াই সোনা, মুক্তা, মানিক...
ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে বলি... 'চিচিং ফাঁক'!

১৬ অলোক বিশ্বাস

সম্পর্ক
অলোক বিশ্বাস


দীঘার হোটেলের আকাশে ম্যাকিনটশ মেলা আছে। যাদের সঙ্গে ধীবরদের সম্পর্ক আছে কিনা ভাবি। ভাবতে গিয়ে দেখি মাছেরা প্রচুর ভিজলেও তাদের ম্যাকিনটশ লাগে না, লাগে আমাদের। হোটেলের আকাশটাকে ধরে সমুদ্রের কাছে নিয়ে যেতেই সমস্ত ম্যাকিনটশ উড়ে যায়। এবার ধীবর ও ম্যাকিনটশের সম্পর্কের মাঝখানে কেউ থাকে না। যে কোনো প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন উপভোগ করি কেননা সমুদ্রের মাছেদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ট্রলারগুলো ঘরে ফিরে আসার সঙ্গে নার্ভ সিস্টেম ও উচ্চফলনশীল ফসলের সম্পর্ক রচিত হয়। আমরা দেখতে পাই বর্ষাতি পরেও একজন মানুষ ভিজে যাচ্ছে, অন্যজন বর্ষাতি না পরেও ভিজছে না। আর একটি বিড়াল সমুদ্রের সাধারণ কথাকে ঘোলা করে দিয়ে লুটিয়ে পড়ছে

১৭ অত্রি ভট্টাচার্য

অদ্বৈতচন্ডাল
অত্রি ভট্টাচার্য



(১)
যে-ই মধ্যমা পড়ুক, মধ্যমা ওঠাক –- কুকুরেরা
স্তম্ভ মনে রাখে। পাদানিতে দৃশ্য শুইয়ে ক’মিনিট এইখানে বসে, আগাছা নিড়োয়—
প্লাস্টিকপেন্টের গন্ধ মূলতঃ ওদের বেগুনী তালু থেকেই
কেয়ারীকে দূষিত করছে। সংসারের দুরন্ত লোমে জড়াচ্ছে হাওয়া—
চারটি ছিটের জামা আমাতে ওড়ে –- ওদের মা ঘুঁটে দেয়
পিচকারির মতো সিংহ লাফিয়ে পড়ে আনিমিয়ার মরশুম
মাথার কাছেই এসে, গা-ঝাড়ার দিন। মাঝে মাঝে
সশব্দ ডাব চুঁইয়ে অমৃতআদর পড়ছে চিবুকে
চামড়ায় চামড়া ঠেকে আছে।
ক্রমশ-য় ব্লার চাঁদনীঅক্ষর।

(২)
আপাত ঘুমিয়ে পড়ি জলে শ্যামবিবেক লুকাই
দিনপনেরো চলকে যাচ্ছি, ডুগডুগিতে
উঠে আসছে দৈনন্দিন ভালুক।
ছন্দটি বাজছে এখনো চামড়া-রা আরও টান সমস্ত বাড়িতে
বাঁ-হাতে ব্যাগ-ও আছে তার রাজবেশ নেই—
কবজিতে দাগ আছে না-পোড়ারকমের পোড়া
জল হতে হতে এই রান্নাঘরে
অপবিত্রের হাঁটুও ডোবে না।
লক্ষ্মী আছেন, তিনি

না থেকেই বা যাবেন কোথায়?

(৩)
জঙ্গলটি বিছানা নিয়েছে –- ওকে তুড়ি মারছে অর্ধবৃত্তাকার
গলায় দ্বৈপায়নকাঁটা, স্বাতীজল আর আড়বাঁশী।

এ আর নৈঃশব্দ্যে নেই একে শেষ করো
এ একধরনের আত্মরতি সবিশেষ করে
তাম্বুলের জন্ম দেয় এঁকে
অবিশ্বাস কোরো—

রাতের হাঁড়ি দিয়ে সোহাগা মেপো না

স্তবকল্যাণে আমাদের নিয়তি বেদম হলো।

বাখারিতে বাঁধা প্রত্নবীজ
এমন চৈত্যের দিনে

পাঠবৈঠকীর ধুলো ঝাড়া যায়।

১৮ সাজ্জাদ সাঈফ

দুটি কবিতা
সাজ্জাদ সাঈফ



পিত্তের অসুখ



তুমি অধরাই থেকে যাও, কাশবনে, পাতার চত্বরে; বমনের প্রেত
এসে পেট গুলিয়ে দিলে আরো একবার পান করি ধাঁধারস অমৃত
মনে, সুপুরি ছেঁচা ঝরঝরে রস, তুমি যথারীতি বমনেই আসো
ঘুঙুর বাজাও, এ'ও বোধ করি পিত্তের অসুখে তোমার এই সব
বিনে ইস্যুতে আসা যাওয়া নুনের ছিটা বৈ আর কিছু নয়, অনাসৃষ্টির
কলকব্জা দেয়ালে মেরুন মৃৎশিল্প, যত ছুঁতে চাই কল্পিত ঘর
পাশে ধীর গতি নদীর মতো ছবিময় তোমার চিবুক তত সরে যায়;
আহ্লাদ জাগে চরের মতো হাত রাখা যেত হাতে, পাশ ফেরা মুখের

আদলে কাটাকুটি করা স্কেচটাতে তোমার হাতটুকু বাদ না গেলে,

এ'ও বেশ পুরনো খবর; আজ অপারেশানে যাচ্ছি তমা!



তপোবন



আড্ডা-স্টল হতে কিছু দূরে পৌরসভার স্ট্রিটল্যাম্পে আলোকে রহিত দেখে আমাদের আমোদ বাড়ে, পাহাড়ের ছায়াপাত শাবকের মতো ছিটিয়ে রয়েছে সড়কদ্বীপের ঘাস, ছুঁয়ে দেখি ঋণের দায়ে উদাসীন ম্যাপ কাঁপছে পেছনে, দু’ধারে কোতোয়াল খাড়া; সেই অনিশ্চিত স্নানদহনের মতো দ্রুতবিধে তোমায় মনে করি আর খাওয়ার ডাক পড়লে বাংলোর রাধুনীর হাতে লুচি পরোটার হাওয়া উড়তে দেখি, যেন ধুতির গিঁটে অভ্রখনির ঢেলা যেন শুকপাখিদের রতিপাথরের মালা শাপ মোচনের তদবির মুখে আহারের মৌমাছি তাড়িয়ে শিউলি ঝরার প্রথা ত্বরিত করে; চেতনা পাঠে সহমরণের স্পর্ধায় যারা ফুঁড়ে উঠেছিলো শিশিরের তপোবন, তাদের তর্জনী উষ্মায় নড়ে আর গ্রীষ্মরজনীর ক্লান্ত শিশুদের খৎনার কাঠে উগড়ে ফেলি ইশারাময় মৃত্যুর পণ্য--

সৌম্যের বুকে আলিঙ্গনের দাগ, পিছমোড়া বাঁধি আগ্রাসনের ব্যাধ!



১৯ লিপিকা ঘোষ

পাড়
লিপিকা ঘোষ


আজকের দিন টা কিরকম বিষণ্ণ । তেমন বোঝা যাচ্ছে না একটা সকাল হল । মেঘলা পড়ছে নদীর ধার ঘেঁষে ; বাতাস ভারী বা গুমোট কিছু নয় , জলে ঘূর্ণি নেবে কি না...... পা ডুবিয়ে বসে থাকতে থাকতে অল্প ছলাৎ নিল । ওপাড় টা এখনো ধোঁয়াটে । মাঝির দেখা নেই । নৌকোয় অল্প দোলা । ওপার আবাদ জমিন , এপার ভাঙ্গন ......

২০ দেবযানী বসু

হারানো ইউবাঁক
দেবযানী বসু



তেলেসিদ্ধ মুরগির মিছিল মাথার ম্যাপ ধরে এগোয়। জ্বর, মাথাব্যথা, অ্যালজোলামের ভাঙচুর... গল্পচ্ছলে কলম রক্ত ঋণে জর্জর। কুয়াশাহীন শীতের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা পোষায় না। বুদ্বুদরা ভারি ভারি মেঘ মাথায় পার হচ্ছে ‘আস্তেলেডিস’দের সতর্কতা। সচিত্র সংলাপ ধান মাঠ স্বাভাবিকভাবে পেরোতে পারে না। প্রতিবারই ভাগশেষ অশেষ রয়ে যায়। ফুলেরা ঘরে বাইরে স্কুপ ও স্তূপ বানাতে ব্যস্ত। প্রতিটি ওভারটেক বসকে কেন্দ্র করে, প্রতিটি বয়ানে ঢালি ময়ান। আগুন রঙকোষ হারাচ্ছে যুগের দোষে।

২১ সুবীর সরকার

আখ্যান
সুবীর সরকার



নদীর ভিতর নদী শুয়ে থাকে। নদীর মধ্য থেকে তুমুল এক নদী উঠে আসে। হাই তোলে। পায়ে পায়ে গড়িয়ে যায় রাস্তা। গলিপথ। তস্য গলি। বস্তির বাচ্চারা গান গায়। গানের গায়ে জড়িয়ে যায় খিস্তিখেউড়। আবার এক একদিন সীমাহীন এক প্রান্তর হয়ে ওঠে পৃথিবী। বাতিদান বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নামে। রক্তের দাগ অনুসরণকারী পাখিদের ডানার নিচে কাচপোকা, ফড়িং। জীবন কাঁটাগাছের দিকে পাশ ফেরে। দেশাচারের নকশির ভিতর হরেকরকম মানুষজন। বিলাপরত স্কুলবালিকা। গান বাজনার তারসে সংক্রমণতায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া মাঠ প্রান্তর থেকে উড়ে আসে প্রজন্মপীড়িত কথকেরা। তারপর লোককথার ঢঙে গল্প এগোতে থাকে। অন্ধকারে নদীর পাশে তখন ভূতুড়ে ভাটিখানা। আর চোখে জল আসতেই মাতালেরা সব প্রেমিক হয়ে যায়। প্রান্তবাসীর হাতে হাতে বাঁশি ঘোরে। বাঁশি বেজেও ওঠে আচমকা। তখন হেরম্ব বর্মন উঠে দাঁড়ায়। মহামানব হতে পাবার সুযোগ হেলায় সরিয়ে দিয়ে সে ধুলো-মাটি আর মানুষের অ্যাখ্যানমালা সাবলীল বলে যেতে থাকে। অবিরাম তাঁতকল ঘোরে। আর নদীর মধ্যে থেকে তুমুল এক নদী উঠে আসে।

২২ শুভ্রনীল সাগর

তিনটি কবিতা
শুভ্রনীল সাগর



এ জার্নি উইথ টু হানড্রেড এন্ড সিক্স বোনস-১

বলতে দ্বিধা নেই যে আমার ঠিকানায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমরা তবু দিনের পর দিন খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে যাচ্ছি! এ মন মধ্যপদলোপী মৃগনাভ পিঁপড়ে যাত্রা -- কোনো মানে আছে, থাকতে হয়?

অঘ্রাণে আড়ি পেতে বুঝে নিও খসড়া জীবন। তারাময় ফিস্ ফিস্ যদিও শেখায়নি চোখটেপা অনুভূতি, কিন্তু তার মানে তো এই নয়, আমার টুথপেস্টের মুখটা হারিয়ে যাবে! যে রাত মশারি টাঙানো, নাক্ষত্রিক -- নিয়ন আদলে তুমি সেই অকারণ পত্রের প্রথম। তরুলতা ততোধিক সর্বনাম সহায়, যতটা দেওয়াল দ্বিধায় গোলাপি কশেরুকা। গায়ের গন্ধ তুলে নাও অনার্য পিতা, চাঁদরূপী গাঙুর বানান আমি শিখে নেবো। আপাতত গরু ঘাস খেয়ে চলে যাক। অবশ্য মাকরিক মনোক্লেশ প্রকারান্তে যতিচিহ্নহীন দ্বিতীয়া প্রণয়, থরো থরো...

লিবিয়া, তুমি কি অ্যাভাস্ট ইউজ কর...



এ জার্নি উইথ টু হানড্রেড এন্ড সিক্স বোনস-২

নীল বেড়ালের যে গল্পটা ভুলে গেছি, তাতে ছিল ডালিম গাছ। পাতা-প্রহর মনে নেই, তবু জানি ছায়াদের কথা মনে হবে। যে-জীবন রোদের, রাতের -- তার সাথে কার হবে দেখা? আমার সঙ্গে দেখা হয়নি অথচ বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। ভেজার নাম করে খানিকটা কেঁদে নেওয়া ভালো...

চিঠিতে লিখেছি লাল ফুল আর কতিপয় রঙের ধারণা। তবে ঘরে ফেরা ঘড়ির কাঁটার উল্টো কিনা, ভেবে দেখব। কই, তোমাদের বেজোড় তারিখের কথা বলনি তো আমাকে! তাই বুঝি ধানটুনি অমন অভিমানী হলো। কথা হলে তাকে ছুঁতে বলো গ্রীষ্মের চিলেকোঠা...

অনেকটা হাঁটা হলে কমে আসে ফেরার আকুতি। মনে হয়, পেছনটা ভুলতে চাই ভোরের লাহান। সেটা বাবুই জন্ম, বিবিধ বিষাদ নাকি আঁতুড় দাগ? কাছে এসো, করগুনে বলে দেব কত ঢেউ ভৈরবে...

এই চাঁদ ঝরে গিয়ে চিঠি হবে...



এ জার্নি উইথ টু হানড্রেড এন্ড সিক্স বোনস-৩

চোখ এঁটো করে দাও। আমি তার কথা ভুলে যাচ্ছি, যদিও তাহার কথা ভুলে যেতে নেই। রাত্রে কাঁদলে ভুলের মৃত্যু জাগে, উড়ে যায়...



এও কি ভেবেছো কখনো? কথারা দূর সম্পর্কের আত্মীয়া -- স্নানে গেলে হাতপাখা একলা পড়ে থাকে! বেশ -- ফড়িঙের কথা ভাবি, ব্যাঙের ছাতাও। কথা নেই বার্তা নেই, এই যে রোদ হয়ে নাড়িয়ে দিচ্ছ জ্যৈষ্ঠের তালপাতা -- আমি তো আগেই বলেছি উহা ফেরত দেব...

মানুষ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। কারণ, এরা নারকেল ভেঙে খেতে জানে -- বর্ষাবদলে অভ্যস্ত। আমি তখন গাধার সঙ্গে ছিলাম। কথা প্রসঙ্গে সে বলছিলো, বোঝা বইতে তার আর ক্লান্তি আসে না। বললাম, তা কীভাবে? বলল, আমি জানি আমি বোঝা বই। আমার বাদাড় নয় তোমাদের মতো বেজন্মা চৈত্রহীন...

দয়া করে একশ টাকা, পাঁচশ টাকা ভাংতি দিন...


২৩ বিশ্বজিৎ

‘তারপর’ সম্পর্কিত
বিশ্বজিৎ



(১৯)

সামান্য মোহ জুড়ে অসামান্য বনবাস
ছুটিয়ে মারছে, স্নিগ্ধ করছে
টুটি চেপে ধরে জীবন শেখাচ্ছে
ভঙ্গিতে ভঙ্গিতে লিখিয়ে নিচ্ছে
অবিরল, অবিরাম
আহামরি নিঃশ্বাসের রঙ...

(২০)

পায়চারি পায়চারিতে
রিপিট হচ্ছে
ভুলে থাকা গান।
প্রিয়জনের আবহ ধরে
লগ্ন কেটে যাচ্ছে
ধূসর প্রতিগল্পের মতো...

২৪ চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়

ঘুম
চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়


ঘাগুলো থেকে চুঁয়ে পড়া রক্ত পূঁজ
আর জ্বালা সব জড়ো করে
ঠোঙায় মুড়ে ফেলে দিলাম
অনেক অনেক দূরে –- দৃষ্টির অদৃশ্যে –-
গোলাপের গন্ধ নড়ে চড়ে বলে উঠলো
আমাকেও কি –-

চমকে উঠলাম –-
তারপর আর একটা মোড়কে তাকে পুরে
ভালো করে দলা পাকিয়ে
ছুঁড়ে দিলাম শূন্যে
মাধ্যাকর্ষণকেও কাটিয়ে সে চলে গেল

এবার আমি নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমোবো।

২৫ রোশনি ইসলাম

ভেসে আসে
রোশনি ইসলাম



(১)

বর্ষার মেঘ-গর্জন
         ঘন অরণ্য
বিস্তৃত আকাশ
উঁচু টিলা
রহস্যময় ক্রন্দন
ভেসে আসে --


(২)

আকাশে আশ্চর্য সব নক্ষত্র
            ধূমকেতুর ঝরে পড়া স্মৃতি
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা...
তখন সবকিছু ভুলে
            স্বপ্ন দেখতে থাকি
            নার্সারি রাইম নাচ গান...
                       ভেসে আসে
                                বাতাসে


২৬ ছন্দম মুখোপাধ্যায়

দেশ
ছন্দম মুখোপাধ্যায়



(১)

আমি থেকে গেছি। একটা বিশুদ্ধ হাওয়ার গ্রামে। এখানে দিব্যি নির্জনে সূর্যাস্ত দেখা যায়। তবে ভেবেছিলাম, যাদের জিভে ঢেলে দেব নতুন মহুয়ার স্বাদ, তার চলে গেছে। হে আমার বহু ব্যবহৃত ভালোবাসারা!


(২)

সে একজন বুড়ো নাবিক। তাকে সকলেই ভুলতে চায় এবং ভুলেও গেছে। কিন্তু বুড়োর নানা পথগামী বাতাসকে, বন্ধুদের, বন্দরের সকালকে ভীষণ মনে পড়ে। এমন কি জলবেশ্যা নোরাকেও। মরার আগে এই সোহাগী তাকে বলেছিল শেষবার সমুদ্রে, গভীর নীলে যাওয়ার কথা।

২৭ দীপঙ্কর গোস্বামী

ফক্কাবাদ
দীপঙ্কর গোস্বামী


ছক্কার দেশে পুট নিয়ে ঝগড়া করছিল ওরা
মই ঘিরে বিষের রাজত্বে
অবস্থা বেগতিক হলে শেষে
পাঞ্জার শুরু হলো লড়াই
ছক্কা ও পুট দু’দিকে রইল পড়ে।

এ দৃশ্যপটের নীরব সাক্ষী কবি
মই থেকে সতত যে শত হস্ত দূরে
তাঁর পাঞ্জা বড় দুর্বল
পারে কেবল কাগজে-কলমে খেলতে।

ছক্কার দেশে পুট নিয়ে ঝগড়া করছিল ওরা
কবি বিড়ম্বিত ছিলেন শব্দ নিয়ে

ছক্কা ফক্কা হলে পুট হয়
পুট ফক্কা হলে ছক্কা
আর যাবতীয় ফক্কাবাদের অনুশাসক – পাঞ্জা! 

২৮ সন্দীপন দাশ

অললিতা
সন্দীপন দাশ



(১)

অলৌকিক ইনল্যান্ড কার্ডের মধ্যবর্তী কমলা
মহাসেনের মতো রাস্তার ওপারের আলো কেন্দ্রাতিগ ইশকে
সুপার ডায়নামোর শব্দের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
দাঁড় টানা ফুৎকারের মতো পাতার ঠোঁটে লেগে থাকা শিশির
কৌটো ভর্তি আনমন। তুমি মন্দিরে পশ্চাৎ দেশে পাওয়ার খুঁজে পাবে,
ডাব তখন জলতরঙ্গের মতো গুপ্তপুরে। অথচ।

(২)

হাসির পিঠে হাসি গাড়ির নিচে লেখা দ্বার অবারিত
বারির সন্ধ্যায় দিক অন্ত হাঁটলে... না হাঁটলে...পাবে স্ট্যান্ডিং
পালিশ ঠিক পুকুরটার ওইপারে সিগারেট আর ছিপ
যদিও কাচ ঠেলে দিলেই প্রেমিকার টা টা ফুল এবং ফুলস্টপ
জার্নি টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি

এ সবই পাগলের পিঠে লেগে থাকা খালটার গন্ধ।

(৩)

ন আস্তিক কন্ঠে আ পান করছে মাঠ, তুমি তবু বসে।
তুমি তবু তবু। গ্রাফিক্স টিমটিম। একদম পিছনের সিটে।
দম ফুরানো আইসক্রিম। চৌরাস্তার গাড্ডাটা।

ভ্যাজাল এবং ফুঁ-এর মতো চশমার কাচটা; বেঞ্চগুলো সরাতে
হবে, ক্যারামের ঘুঁটি একলা ঘুরছে উত্তর দিকে মুখ করে
ডিমের পোচের মতো

২৯ ইন্দ্রাণী সরকার

পরমধন্যা
ইন্দ্রাণী সরকার



জল দাও, আমায় জল দাও---
তৃষ্ণার্ত মনে সন্তর্পণে চোখ
রেখে মিটিয়েছি সাময়িক ক্ষুধা,
জোৎস্না শিবিরে ধংসস্তূপে
পড়ে থাকা অগণিত কথামালা।
বিশ্বাস মেনেছি চরিত্রহীনতায়,
লুক্কায়িত লোলুপ বাসনার জাল।
দাবি রাখে প্রাণদানে, তুচ্ছ সে
অজুহাত আত্মসমর্থনের প্রচেষ্টা।
স্রষ্টা যিনি তাঁর পদস্পর্শে ধন্য
জীবন, তাকে কেবা দাবি রাখে
ভন্ডামির মুখোশে আবৃত মনন!
পরমধন্যা নতজানু হয় আশীর্বাদে
চাঁদের ত্রহ্যস্পর্শের অবসানে।



৩০ অজিত দাশ

দুটি কবিতা
অজিত দাশ



বিরহ দর্শন


কল্যাণীয়া চলে যাবে...

মিথ্যে ঠাকুরের নাম নিয়ে
সর্বনাশ করি প্রেমের

সিঁদুর কৌটোর মতো
বিশেষ ‘রঙ’ জমিয়ে দেখি
দস্যুতা ছেড়ে ধূপ-চন্দন
ভালোবাসেন বন্ধ্যা ঈশ্বর

আমি রক্তজবা তুলে নিই
উঠোনের এক কোণে
তুলসী ছিঁড়ে হাতে নিয়ে ডাকি
কল্যাণীয়া দেখো?
ঠাকুরঘর পাশ কাটিয়ে
তোমার শুদ্ধ অভিমান ভালোবাসি...


কমলারঙের রোদ

শেষ কবে এসেছিলে জলপাইগুড়ি? শুনেছ, দিদি এসেছে! একটা কালো বোতল, ছিপি খুলে এক আধটুকু দিয়েছে মুখে তুলে -- হাপিত্যেশ জীবনীশক্তি। এখন বেকার বসে থেকে লাভ নেই, জানালায় তাকালে আকাশের চেয়ে স্পষ্ট চোখে ভাসে জোড়া সুপারি গাছ, দিদির নাকফুল হারিয়ে যাওয়া বিকেল, শ্মশানের জংলায় এদিক ওদিক ঘোরা। তুমিও কি স্পষ্ট আকাশ দেখ...! কেমন আছে আজিমপুর? গোরস্থানের আনুষ্ঠানিকতা? লবণ জলে ভেসে যাওয়া শরীর, ব্যস্ত দিনের অজুহাত, পুরনো হয়ে গেছে সব। ভাঁটফুলে মাখা মৃতের সন্ধি মনে রাখার গল্প করো। পারলে, তুমিও পাঠিয়ে দিও একটু অন্যমনস্ক স্মৃতি কিংবা কমলারঙের রোদ।





৩১ নীতা বিশ্বাস

বি লাফ
নীতা বিশ্বাস


কষা ছকগুলো
নিছক ঠাট্টা হয়ে নি-ছক
কষাস্বাদ কষে কম্বলধোলাই
স্বাদ-ফেরে একটা
মেয়ের জীবনের জ্যামিতি
ও জিওমাট্রা তুমি
ভাবতেই পারবে না
বদলে যাওয়ার রসিকতা

রসিকচাঁদ বদনী ধনি
ধ্বনিময় ঝুমুর ঝমঝম
বদলে গেল ‘বস’
নিশিমিটিং এবং সজ্ঞের সিঁড়ি
ফুটোভাঁড়ে ভবানীভবন
পাঁচতারা এ সি যতদিন
টানতে পারছে
ততদিনই ভবিষ্যৎ স্ত্রীয়াচারে
চৌকস বোকামি জেনেও

<<< কালিমাটির ঝুরোগল্প / ১২ >>>







কালিমাটির ঝুরোগল্প / ১২


ঝুরোগল্প লিখেছেন সমীর রায়চৌধুরী, মেঘ অদিতি, সোনালি বেগম, সাধন চট্টোপাধ্যায়,  শ্রাবণী দাশগুপ্ত, লিপিকা ঘোষ, নবেন্দু বিকাশ রায়, রিমা দাস, নীতা বিশ্বাস, অর্ঘ্য দত্ত বক্সী,  পম্পা বিশ্বাস, ঊর্মি খান, অর্ক চট্টোপাধ্যায়, অলোকপর্ণা এবং অপরাহ্ন সুসমিতো।

০১ সমীর রায়চৌধুরী

বাদামতলার ভুবন
সমীর রায়চৌধুরী


...কেউ কেউ বলেন, এ জি বেঙ্গলের ভুবন। আবার কেউ কেউ বলেন, নন্দীগ্রামের ভুবন। শেষপর্যন্ত বাদামতলায় তিনি যে জমিটা কিনেছিলেন, তার একদিক দিয়ে হাই-টেনশন বিদ্যুতের তার চলে গিয়েছিল বলে, ওই জমিটা কেউ কিনছিল না। শেষে ভুবনই কিনলেন।

ভুবন গল্প বলেন। গান শোনেন। কবিতা আওড়ান। সারক্ষণ মুখে মুখে কবিতা তৈরি করেন। তাঁর দুই মেয়ে হবার পর দেখা গেল, কিছুতেই আর ছেলেপুলে হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এক বড় গাইনিকের শরণাপন্ন হলেন। অনেক পরীক্ষার পর ধরা পড়ল, ভুবনের স্পার্মে ক্যানসার হয়েছে। ডানদিক ও বাঁদিকের দুটো আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা করে দেখা গেল, বাঁদিকের বিচিতেই তার এই রোগ হয়েছে।

ভুবন এখানে এসে থামেন। কেননা, গাইনিক তাঁকে বলেছিলেন, বিচির একটা ভালো বাংলা প্রতিশব্দ আছে –- ‘বৃষণ’। সেই থেকে ভুবনও তাঁর গল্পে বৃষণ শব্দটি ব্যবহার করতেন।

ভুবনের ফার্স্ট স্টেজ আর বড় চাকরি, গাইনিকরা তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন টাটা ক্যানসার ইনস্টিটিউটে, পরবর্তী চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য। ট্রেনে সারা রাস্তা গান গাইতে গাইতে গেলেন ভুবন। যেন কিছুই হয়নি। তারপর হাসপাতালে পৌঁছে দেখলেন, তাঁর ডাক্তার একজন পুরুষ, কিন্তু ডাক্তারের সঙ্গে রয়েছেন প্রচুর সুন্দরী নার্স। তাঁরা অধিকাংশই মহারাষ্ট্র ও কেরলের মেয়ে। তবে একজন বাঙালিও ছিলেন। তিনি ভুবনের গানগুলো অনুবাদ করে অন্যদের বলে দিতেন।

ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, আপনাকে একটা বৃষণের মোহ ছাড়তে হবে ভুবনবাবু। ভুবন বললেন, আপনারা যা ভালো বুঝবেন, তাই করবেন। অপারেশন থিয়েটারেও গান গাইতে গাইতেই অ্যানেস্থেশিয়ার কারণে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

ঘুম যখন ভাঙল, যিনি প্রধান নার্স, তিনি বললেন, আপনার অপারেশন সাকসেসফুল, চিন্তা করবেন না! বিভিন্ন বিভাগ থেকে অন্যান্য ডাক্তাররা এসেও ভুবনকে দেখে নিজের নিজের মন্তব্য মেডিক্যাল চার্টে লিখে রাখলেন। যিনি গাছ গাছড়ার স্টেরয়েড নিয়ে কাজ করছেন, তিনি এসে বললেন, আপনি ফিরে গিয়ে নিয়মিত কাঁচা হলুদ আর আখের গুড় খাবেন। ঠিক কতটা খেতে হবে, তিনি তাঁর প্রেসক্রিপসনে লিখে দিলেন। আর যিনি প্রধান গাইনিক, তিনিও তাঁর ওষুধ লিখে দিলেন।

দশদিন পর ভুবন ছাড়া পেলেন হাসপাতাল থেকে। ইতিমধ্যে ভাবতে ভাবতে ভাবতে ভুবন মনে মনে তাঁর মনের মতো একটি কবিতাও সৃষ্টি করে ফেলেছেন। কবিতার শেষ দুটি লাইন –- “একটি আমার নিঃস্ব / আরেকটিতে সারা বিশ্ব”।

ভুবনের চিকিৎসার যে ফলাফল, অর্থাৎ দুটি বৃষণের মধ্যে একটির বাদ যাওয়া এবং একটির থেকে যাওয়া, যেন মহাজগৎকথার সঙ্গে ভুবনের অস্তিত্বের মিলেমিশে যাওয়া!

০২ মেঘ অদিতি

ক্যারমে করতোয়া রঙ
মেঘ অদিতি


ধুলোর পাশে ফুলের গুটি
তাই নিয়ে মন আঁটাআঁটি

গাইতে গাইতে বাউল চলে যায় দূরে। হিজলতলা ছাড়িয়ে, মেঠো পথ ধরে করতোয়ার দিকে সে বাউল শূন্যে মিলায়। গান আর শোনা যায় না, কেবল তার রেশ থেকে যায় বহু সময় ধরে বাতাসে, মনে। আবিরের ভাষা ভাষা চোখ ভাষাহীন চেয়ে থাকে ওই দিকে। তার মনে হয়, এ কোনো সাধারণ বাউল নয়। সে নিজেকে যেমন ছড়িয়ে দিয়েছে প্রকৃতির মাঝে, তেমন ডাকও দিয়ে গেছে আবিরকে। হিজলতলে পড়ে থাকে তার গল্প লেখার খাতা, হাতের কলম পড়ে থাকে ধুলোয়। খেললি খেলা খেলার ঘরে... বাউলের কন্ঠ আবিরকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে আর নয়, আর কোনো খেলা নয়। এবার এসে গেছে সেই ডাক। আচ্ছন্ন আবির উঠে দাঁড়ায় হিজলতলা থেকে, গোধূলিবেলায় পায়ে পায়ে এগোতে থাকে করতোয়ার দিকে।

হঠাৎ আবিরের চোখ খুলে যায়। চটকা ভেঙে অবাক চোখে সে তাকিয়ে দেখে, গোধূলি তো নয়, সবে ভোরের আলো ফোটার আভাস চারদিকে! আর হিজলতলা কোথায়, এ তো মেলবোর্ণের রিজার্ভেয়রে তার স্টাডিরুম! রাত মুছে আলো হয়ে আসা নতুন দিনের শুরু। অথচ তার কী হলো! সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? তাই বা কী করে হয়, ওই গান তো সে এর আগে কখনো শোনেনি! এ কোন্‌ সুদূরের ডাক!

টেবিলে পড়ে থাকা জন লিন্ডসের বইটা সে বন্ধ করে, হাইলাইটারটা পেন হোল্ডারে রাখতে রাখতে খেয়াল করে, স্লিপ মোডে চলে গেছে তার ট্যাবলেট পিসি। দ্রুত তাকে জাগিয়ে কাউকে মেইল পাঠায় সে। এ সময়টা টুকটাক পড়ার পাশাপাশি সে পার্সোনাল মেইল চেক করে। কখনো অন্যের জানালা থেকে ডাক এলে সাড়াও দেয়। আজ সেদিকে আর নজর নেই। উল্টোদিকের জানালা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক বালিকাদের বাড়িয়ে দেওয়া রিনিঝিনি হাতগুলো তাকে বিন্দুমাত্র টানছে না। পিসি বন্ধ করে সে তার শোবার ঘরে যায়। রোজিকে দেখে, আবিরের মাথার বালিশটাকে পাশবালিশের মতো করে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমন্ত সমৃদ্ধর মুখটা দেখতে সে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। টিন-এজ ছেলে, ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ঘুমিয়েছে। বড় ছেলে সম্বুদ্ধ স্টাডি ট্যুরে দূরের এক শহরে আছে। সমৃদ্ধর ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আবির আপন মনে হাসে। কিচেনে গিয়ে এক মগ ব্ল্যাক কফি বানায়। টোস্টারে কড়া করে দুটো টোস্ট করে কফি নিয়ে জানালার ধারে বসে। খেললি খেলা খেলার ঘরে... এই এক ঘোরের ভেতর দিয়ে কফি শেষ করে সে প্রতিটি ঘর হেঁটে বেড়ায়। গিজার চালিয়ে শাওয়ার নেবার বদলে শীতল জলে স্নান সারে অন্যমনস্কতায়। কাজে বেরোবার ব্যাগটা গুছিয়ে সদর দরজা লক করে বেরিয়ে আসে।

ক্লোভিস রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে রিজার্ভেয়র স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ট্রেন ধরে ফ্লিন্ড্রারস স্ট্রিটে নামে। উদ্দেশ্যহীনভাবে সোয়ারসন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন নিজেকে রিচমন্ড স্টেশনের সামনে আবিষ্কার করে হতভম্ব মুখে। চেপে বসে এবার সে আরেক ট্রেনে, অজানার দিকে। কতটা সময়, আবির জানে না, হঠাৎ ট্রেনে বসেই সে দেখতে পায় একটা নদী। দেখা মাত্রই ভীষণ উত্তেজনা। নদীটা তাকে টানছে। ঠিক তখন ট্রেন স্টেশনে থেমে যায়। আবির নামে। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে নদীর খোঁজ করে। একটা ছোট রাস্তা পেরোতে সে পেয়েও যায় নদীর দেখা। ক্যারম নদী। আবিরের সমস্ত শরীরে আবার ঝাঁকুনি। ক্যারম না করতোয়া? তার শৈশবের নদীটার নাম তো করতোয়া! বর্ষায় আকাশ ভরা মেঘ, মেঘের পায়ে বর্ষার নূপুর আর করতোয়া আবিরকে কী রকম পাগল করে দিত। বৃষ্টিতে ভিজে ছোট্ট আবির গামছা পেতে মাছ ধরত। ছোট ছোট পুঁটির মাঝে উঁকি দিত বৌ-মাছ। তার গা ভর্তি ডোরা ডোরা গয়না। মাছগুলো এনে মা-কে লজ্জা লজ্জা মুখে বলত, মা... বৌ-মাছগুলো কড়া করে ভেজে দিও তো! মা-র দুই ভ্রূ-র মাঝে তখন আলোর মতো জ্বলে উঠত স্নেহ। মা... আহ... মা গো...

চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে থাকে ক্যারম নদীর তীরে। হঠাৎ পকেট হাতড়ে বের করে আনে ঘরে ফেরার চাবিটা।

টুপ করে ফেলে দেয় নদীতে। তারপর একে একে ওয়ালেট, হাতঘড়ি, সেলফোন। ক্যারমের তীর ঘেঁষে সে হেঁটে চলে।

তার ঠোঁট দুটো বিড়বিড় করে --আই হ্যাড টু টেক আ ব্রেক ফ্রম এভরিথিং, এভরিথিং...

করতোয়ার তীর ঘেঁষে বাতাসে ঢেউ তুলে বাউলও কি গায়, ডুবে দেখ মন ভবকূপে

*********

পুনশ্চ: গল্পে নদী ঘিরে এক শহরের খোঁজে অপরাহ্ণ সুসমিতোর মন্ট্রিয়ল শহরে গিয়েছিলাম। তারপর লুনা মেলবোর্ণে ক্যারম নদীর খোঁজ দিল আবিরকে। শুভম লুনা রুশদী!

০৩ সোনালি বেগম

পোস্টমর্টেম
সোনালি বেগম



ঘাটশিলায় পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গিয়েছে সুবর্ণরেখা নদী। স্থানীয় মানুষজনের বিশ্বাস যে, এই নদীর বালিতে সোনা মেলে। নদীর মাঝখানে বড় বড় বিশালাকার পাথর। আশ্বিনে নদীর দুপার জুড়ে কাশফুলের সমারোহ।

নদীর ধারে আশ্বিনের ঝলমল রোদ্দুরে ভাসছে দুটি নিষ্প্রাণ বিবস্ত্র দেহ। বছর ঊনিশ কুড়ির দুটি সদ্য যুবতী। নদীর উল্টোদিকে ছোটনাগপুর মালভূমি। সবুজের সমারোহে টিলাগুলি জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। ‘এরা কারা?’ কেউ সন্দেহ ছুঁড়ে দিল। ‘টুরিস্ট’! ‘কি হয়েছিল?’ ‘গতকাল এদের দুজনকে রঙ্কিনী মন্দিরে দেখেছিলাম,’ একজন রুক্ষ এলোমেলো পোশাকের যুবক বলল।

‘তুই চুপ কর,’ একজন জিন্স পরিহিত যুবক, সম্ভবত অটোরিকশাচালক।

ইতিমধ্যে পুলিশ এসে গেছে। সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে সরে যেতে থাকল... কয়েকজন আদিবাসী মহিলা ও পুরুষ ভয়ার্ত হয়ে ছুটে পালাতে গেল, কিন্তু পুলিশ ওদের গ্রেপ্তার করে ভ্যানে তুলে নিল। ‘শোন্, লাশ দুটোকে সাবধানে তোল্, পোস্টমর্টেম-এর জন্য,’ একজন পুলিশের হুকুম।

‘কাজ নেই কম্ম নেই, দু-দুজন সোমত্ত মেয়ে ঘর ছেড়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,’ অন্য একজন পুলিশের মন্তব্য। ‘দিনকাল খারাপ, নারী স্বাধীনতা! এখন বোঝ ঠ্যালা! এরা ভদ্রঘরের সন্তান! ছ্যা!’

দুপুর গড়িয়ে এলো ক্রমশ । দুর্গাপুজোর পনের দিন বাকি। জাগ্রত রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরে বিন্ধ্যপুজা আর আদিবাসীদের ইন্দ মেলা শুরু হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যের গাঢ় অন্ধকারে আদিবাসী যুবক-যুবতীরা মাদলের তালে তালে নাচতে থাকল...



০৪ সাধন চট্টোপাধ্যায়

ট্যাটুর হাত
সাধন চট্টোপাধ্যায়


ছুটে এখানে আশ্রয়। দোকানঘরটার বাড়তি চালাটুকুর নিচে। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে নেমে ছিল কিনা! টু-হুইলারটাও ঝটপট। ছেলেটি লাফিয়ে ঢুকে পড়ল। ওকে চিনি না। বিশ-বাইশ বছরের কচি আদুরে মুখ। গাড়ির বডি ভিজছে। ছিটকোচ্ছে জল। কী করি! বৃষ্টি ধরছে না –- ধরছে না –- ধরছে না। দেখি, ছেলেটির স্বাস্থ্যল বাহুর পেশিতে নীলচে ট্যাটু। চিত্তির-বিচিত্তির। নেমেছে কনুই তক্‌।

--কত নিল ট্যাটু করতে? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম। পছন্দের একজন সেজে।

--পাঁচ হাজার।

--সময়?

--দু ঘন্টা।

--ব্যথা কেমন লাগে?

বৃদ্ধের দলে ফেললেও, ছেলেটি আগ্রহে জবাব দিল, --যারা জিম করে, পেশিগুলো শক্ত আর বাড়ন্ত, তাদের একটু ব্যথা লাগবে। না হলে কম।

--চাইলে তুলেও ফেলা যায়?

--হ্যাঁ, তখন খরচ পঞ্চাশ হাজার। সময় দশ মিনিট। লেজার অপারেশন হয় কিনা!

--ব্বা!

--ক্রিকেটার কোহ্‌লির হাতে দেখেছি। শখে তাই করালাম!

ছেলেটি হেসে হাল্কা কৈফিয়ৎ গোছের জবাবের পর, চাবি লাগিয়ে, গাড়িটার শরীর মুছে সার্থকতায় চলে গেল। তখন বৃষ্টি ধরতে চলেছে।

ঘন্টাখানেক বাদে, ঠান্ডা আবহাওয়ায় ফের এ-পথে ফিরে এসে দেখি, চালাটা ফাঁকা। এই স্পটেই দু’জন ছিলাম। কয়েক ঘন্টার ব্যবধ্যানে। বৃষ্টি হঠাৎ নামলে। ছেলেটা ট্যাটুর শখ আজন্ম ধরে রাখবে? তখন লেজার অপারেশন একলাখ, সময় আরও সংক্ষিপ্ত! উন্নত প্রযুক্তিতে এক সেকেন্ডে। একটা বুদবুদের আয়ুষ্কালে।

শখভোগ্যা বসুন্ধরায় ক্রমাগত বুদবুদের বৃষ্টি ঝরতে থাকে। হাজার, লক্ষ, মিলিয়ন ডলারের। শ্যামল, বাদামি, পীত –- নানা বর্ণের হাতগুলো শুধু বদলায়।

০৫ শ্রাবণী দাশগুপ্ত

আমি ও মেমসাহেব
শ্রাবণী দাশগুপ্ত



লম্বা ডান্ডার নিচে বাঁধা ন্যাতাটা দিয়ে মুছছিলাম। ওরা বলে মপ্‌। মেমসাহেব জিজ্ঞেস করল, “কি নাম?” বললাম, “আমনি গো আমনি!” মেমসাহেব হেসে বলল, “ও! কাছেই থাকো? কতদিন কাজ করছ গেস্টহাউসে?” মেমসাহেব ভালো করে হিন্দীও বলতে পারে না, আমি তো দেহাতি। মেমসাহেব এখানে প্রথমবার এসেছে, সাহেবের অফিসের কাজ। ঘর পরিষ্কার করে পর্দাটর্দা সব টেনে দিলাম। মেমসাহেব চশমাচোখে কাগজ পড়তে পড়তে আমার কথা জানতে চাইছিল। কি হবে? বরটা মাল টেনে মরে গেছে কবেই। চার চারটে বাচ্চা বিইয়েছি। বড় করলাম তো! সব একলা। মেয়েটার বিহা দিয়েছি আগের বছরে। ছেলেটা মেট্রিক লিখেছিল, ফেল হয়েছে। মেমসাহেবের চোখ কপালে, “ওমা, কেউ বলবে গো তোমায় দেখে!” আড়চোখে দেখি। আমার সব পাটপাট। ইস্তিরি করা। পা দুটো কোদালের ফাল। বরটা বলত। তবু বাঁশঝাড়ে তিরিতিরি। সুন্দরার মরদটা কবে থেকে মজে বসেছে। আস্কারা দিই না, তাই। বললাম, “আপনার বালবাচ্চা ইশকুলে যায়?” মেমসাহেব হেসেই খুন। রোগাপাত্‌লা, ফুট্‌ফুটে, ছোটছোট দাঁত, চিক্‌চিক্‌ চশমা, “একটাই, চাকরি করে যে। অনেক দূরে থাকে।” খুব চমকে উঠলাম। মেমসাহেব বলল বলেই আমিও আরো বেশি করে, “হায় ভগবান! শুরুতে ভেবেছিলাম আপনার নতুন বিহা। কত সুন্দর আপনি।” মেমসাহেবের ছোট পায়ের পাতায় কালো নখপালিশ। মুখে নীল ওড়না চেপে দুলে দুলে হাসছিল, “ধ্যাত্‌। কী যে বলো।” খুশি দেখছি আমার মতোন। ভালোই হলো। আমি ডান্ডা টেনে টেনে চকচকে মেঝের আনাচকানাচ মুছি। আরশি পালিশ, মুখ দেখা যায়। টেবুল থেকে নিয়ে যন্ত্রটা দিয়ে খুট্‌ করে ঠান্ডা মেশিন চালালো মেমসাহেব। সোফার পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি ডান্ডা। ঘরটায় আস্তে আস্তে শীত... আমি ঢিলেমি করছি। মেমসাহেব বুঝতে পারছে? নরম হাসছে, “হো গয়া? একটু জলদি। দরজাটা বন্ধ না করে দিলে যে ঠিকমত...।” জানি তো। সেলাম ঠুকে দরজা বন্ধ করে বেরোতেই ভক্‌ করে গায়ে গরম হল্কা। মেমসাহেব কি ঘুমোবে এখন? আমি ডান্ডাওলা মপ্‌ টানি লম্বা গেস্টহাউসের বারান্দা ধরে। আকাশ তেতে পুড়ে খাক্‌। কম্বল গায়ে? মুন্নি বলল, “হেই আমনি, পাগলের পারা হাসছিস কেন?” আঁচলটা ঠেসে ধরলাম ওর গালে। “দ্যাখ তো, চুরি করলাম... আরাম না?”

০৬ লিপিকা ঘোষ

ঘর
লিপিকা ঘোষ


‘কি জাত?’

‘অ্যাঁ? হিন্দু’

‘উ তো নোয়া সেন্দুর দেইখ্যেই বুঝনু তুমি মোদের হেঁদু ঘরের বহু বিটি, জাত কি?’

রমা অস্বস্তি নিয়ে আসেপাশের সহযাত্রীদের দিকে তাকায়। সকলেই নির্বিকার। কেউ ট্রেকারের দুলুনিতে ঢুলুনি নিচ্ছে।

‘ঠাকুর?’

‘অ্যাঁ? না তো’

রমা বোস বিয়ের পর রায়চৌধুরী। কোনো কুলেই ঠাকুর পদবী নেই। যে সহযাত্রীটি এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জিজ্ঞেস করছেন, তাকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল রমা। গ্রাম্য দরিদ্র প্রৌঢ়া। মাথায় ডগডগে সিঁদুর। কপালে আবার তিলক কাটা। গলায় কণ্ঠি। রমা’র বড় ননদ ও’র সিঁদুর পরা দেখে বলত ‘মাসকাবারি সিঁদুর লাগবে রে ভাই তোর বউয়ের’। সে বড়ই ঝাঁ চকচকে আধুনিকা। দুর্গা পুজোর অঞ্জলি দেওয়ার সময় ছাড়া দিদিভাইয়ের মাথায় সিঁদুর দেখেনি রমা।

‘তা লি মাহিষ্য?’

কী মুশকিলেই না পড়ল সে!

‘আমরা চাঁই মোড়ল’

‘ও, আমরা কায়স্থ’। এতক্ষণে বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি জবাব দিল রমা।

‘কি বুইল্যে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, উনিও ঠাকুর’ -– জবাব দিলেন সদ্য ঢুলুনি ভাঙা সহযাত্রীটি। অবাক হয়ে তাকাতে উনি বললেন, ‘এ দেশে বামুন কায়েত ভাগ নেই দিদি, উঁচু গেরস্থ ঘর মানেই ঠাকুর’।

রমা ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে না পেরে সেই চাঁই গিন্নিকে বলল, ‘যা ভাব কাকী, ঠাকুর ভাবলে ঠাকুর, নইলে তোমারই ঘরের মেয়ে’।

‘তয়? বুইল্যেছিলাম না, এ মেইয়্যে ঠাকুর ঘরের বহু বিটি’

হঠাৎ ট্রেকারের পেছন থেকে পুরুষ আওয়াজ। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে, গেরুয়া ধরনের ময়লা এক ফতুয়া পরা গ্রাম্য প্রৌঢ়ো। দরবেশ সাধু তো নয়! বেশ গৃহস্থ। কপালে সেই তিলক, গলায় কণ্ঠি। ইনি তবে বোধহয় চাঁই কর্তা ।

‘শিক্ষে দিইক্ষে কইরেছো, লয়?’ চাঁই গিন্নির প্রশ্ন।

‘অ্যাঁ?’

রমাকে দেখে কি এদের খুব অশিক্ষিত মূর্খ গোছের কিছু মনে হয়েছে? লাল ধুলোর হাত থেকে বাঁচতে মেরুন স্কার্ফটা দিয়ে মাথা ঢেকে নিল রমা। শাড়ির আঁচলে সামাল দেওয়া যায় না।

‘তয় মোদের ভাষায় বুইলছো যি?’

আবার ঢুলুনি থেকে জেগে পাশের যাত্রীটি উত্তর করেন, ‘ওরা জানতে চাইছে আপনি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত কি না’!

‘ওঃ, না গো কাকী’, এবার একটু মজা করেই বলল রমা, ‘বোষ্টুমি আর হতে পারলাম কৈ’

‘দেইখল্যে, এ মেইয়্যে মেইয়্যে লয় গো’ আবার চাঁই কাকার গলা।

সব্বোনাশ, প্রথমে ঠাকুর, এখন কি বলে বসবে না কি ‘দেবতা নিশ্চয়’! ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে একশা রমা। এ কোন্‌ দেশে চাকরি করতে এলো সে!

এবার একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেকারটা থামল স্টেশন মোড়ে। হুড়মুড় করে একরাশ পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে ট্রেকারের পেছন দিকের সিট থেকে নামল চাঁই কর্তা। রমার সঙ্গে সঙ্গে চাঁই কাকীও নামে। হঠাৎ হাত জোড় ক’রে সামনে চাঁই কর্তা, ‘আমি জগন্নাত মন্ডল। হুই যি ফুলারপুর গিরামে বাস। বিপিএল-এ নাম আছে। কিন্তুক তুমার কাকীর নামে ঘরের টাকাটুক এখুনও পাইনি। তুমি একটুক দেইখ্যো বিটি’।

হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে রমা।

‘তুমার কাকীর নাম ছিরিমতি মন্ডল, টিরেন এল আমরা যাই গো বিটি...’ বলতে বলতে দৌড় লাগালো জগন্নাথ আর শ্রীমতি মন্ডল। ‘তুমার কাকীর নামটা মুনে রেইখ্যো বিটি...’

ঢুলুনি যাত্রীটি ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মিটি মিটি হাসি। ‘কি বুঝলেন? ওরা ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘরের কথা বলছে। ওরা জানে, আপনি এখানে কোন্‌ ডিপার্টমেণ্টে এসেছেন, একটু সামলে চলবেন’, বলেই হন হন ক’রে হাঁটা লাগালেন ভদ্রলোক।

রমা ধীরে ধীরে রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকে। ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর পাওয়ার প্রথম অধিকার শুধু মেয়েদেরই। কৃষ্ণচূড়ার গাছ লালে ঢেকে আছে। একটু উড়ে এসে পড়ল ওর সিঁথি বেয়ে। মাসকাবারি সিঁদুর। হাসি পেয়ে গেল ওর। বড় ননদ মস্ত আর্কিটেক্ট। বিশাল এক নিজস্ব অফিস। মস্ত বড় বড় ইমারত বানায়।

কৃষ্ণচূড়ার লালে বিকেলের পড়ন্ত রোদের লাল মিশছে। তীব্র হুইসল। ‘টিরেন’ ছেড়ে যায় জগন্নাথ মন্ডলের। ফুলারপুর গ্রামের শ্রীমতীর সিঁথির লালে এ জগন্নাথ ঘর খোঁজে...

০৭ নবেন্দু বিকাশ রায়

অনিমেষের ব্লগ
নবেন্দু বিকাশ রায়

চিত্রার্পিত চাহিয়া রহিল অনিমেষ। এক প্রকারের স্রোত তাহার সুষুম্নাকান্ডের ভিতর দিয়া বহিয়া গিয়াছিল কি? ‘কিকি’ এই নাম তাহাকে অস্বস্তিতে ফেলিয়াছে অথবা নামের সহিত অনুভূমিক ওই মিনিমালিস্ট তীর সে ঠিক ঠাওর করিতে পারিতেছে না। অপিচ তাহার সকরুণ ত্রাস এমনই যে অনিমেষ ভাবিতে বসে, অফিসের কেহ এই কান্ড ঘটায় নাই তো? যদিও তাহার ব্লগের সম্বাদ অনিমেষ সঙ্গত কারণে কাহাকেও জানায় নাই তথাপি বিস্ময়কে সে কিছুতেই বাগ মানাইতে পারিতেছে না...

ঠিক কোন ঐশী নির্দেশে মাস দু’য়েক পূর্বে সে লিখিতে শুরু করিয়াছিল তাহা অস্পষ্ট কিন্তু তাহার কাহিনীর একা সেই ছিল লেখক পাঠক ও সমালোচক। পাঠক এইক্ষেত্রে উপভোক্তাও বটে। যদিও প্রচলিত যে পর্ণোগ্রাফি এক হাত দিয়া পড়িতে হয়, তথাপি সে এই মিথ তাচ্ছিল্য করিয়াছে, তাহার লক্ষ্য ছিল মেধাবী একপ্রকারের ক্ষরণ। স্বভূম হইতে বহুদূর শহরে চাকরী করিতে করিতে তার জীবনের সবথেকে যৌন সম্ভাবনাময় বৎসরগুলি চলিয়া যাইতেছে, প্রিয় বান্ধবীরাও ন’মাসে ছ’মাসে হয়তো একবার এই চত্বরে আসিবার সুযোগ পায়, এই প্রেক্ষাপটে সে যদি বাসায় ফিরিয়া ল্যাপটপে দু’চারিটি উত্তেজক গল্প লিখিয়া আত্মমৈথুন করিয়া সুখী হয় তাহাতে কাহারই বা কি বলিবার থাকিতে পারে? কালক্রমে সেই অভ্যাস যদি ব্লগে আত্মপ্রকাশ করিয়াও ফ্যালে তাহা হইলেও অনিমেষকে দোষ দেয়া অনুচিত।

অনিমেষ তাহার ব্লগের নাম রাখিয়াছিল, ‘মৌনজীবন’। নিজের মনে মনেই হাসিয়াছিল।

অনিমেষের স্টাইল ছিলো তাহার নিজস্ব। লেখা শুরু করিবার কিছুদিন পরপরই সে হাতেনাতে ফীল করিতে পারে যে প্রতিটি যৌনতার গল্প একই রকম। সেই শুরুর দিকে শৃঙ্গার, তারপর কথোপকথন, এক রাউন্ড পি.ও.ভি-র উত্তর মিনিট চারেক অ্যানাল... অনিমেষ কিছুদিনের মধ্যেই বোর হইতে শুরু করিল। সে কাগজে লিখিত না, কম্পিউটারে টাইপ করিত, ফলত পছন্দ না হইলে বিভিন্ন অংশ বদলাইবার সুযোগ ছিল তাহার। এই পর্যায়ে সে উপলদ্ধি করিয়াছিল ক্রিয়েটিভিটি আসলে কল্পনা ও ট্রায়াল-এন্ড-এরর এর অভূতপূর্ব দড়ি-টানাটানি। সে একদিন একখানি ধর্ষণের গল্প লিখিয়া ফ্যালে এবং লক্ষ্য করে অন্তিম লাইনে একটি নিসাড়, শীতল দেহের উল্লেখ কিভাবে লেখাটিকে টিটকিরি মারিতে থাকে। গল্পটি তার ব্লগে আপলোড করিয়া অনিমেষ যারপরনাই আনন্দিত হয়, ডায়াগোনালি ২০ ইঞ্চি পর্দার দিকে তাকাইয়া থাকে এবং ভাবে সে যেন এক আশ্চর্য দ্বীপ আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে। এইভাবেই দিনে দিনে তাহার ব্লগ ডাগর হইয়া উঠিতেছিল। অনিমেষ বস্তুতপক্ষে একটি উপন্যাস লিখিবার কার্যেও হাত ঠেকাইয়াছিল। তবে অনুপ্রেরণার অভাবে বেশিদূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। ছোট, শাণিত, যৌন বর্ণনাময় আখ্যানই ছিল তাহার চা-এর পেয়ালা।

...রবিবারের সকালে সে যখন ব্লগখানি খুলিয়া দেখিল ‘কিকি’ নামক তাহার প্রথম পাঠক শীর্ষোক্ত মন্তব্যটি করিয়াছে অনিমেষ ঠিক বিশ্বাস করিতে পারিল না। একই লাইনে তিনবার বিস্ময়চিহ্ন! বিস্ময়ের এ কী অপচয়! পিচুটি চোখে লইয়া অনিমেষ দেখিতেছে, তাহার গল্পের প্রথম প্রতিক্রিয়া, তাহার ব্লগের মেইডেন ফীডব্যাক। অথচ কিছুতেই যেন তাহার ত্রাস ও বিস্ময় কাটিতেছে না। একখানি ব্যক্তিগত দ্বীপ ছিল তাহার। জাহাজ অবতরণ করিতে পারিবে এমন বন্দরও বানাইয়াছিল সে সেই দ্বীপে, অথচ যখন প্রথম জাহাজটি ভোঁ করিয়া জেটিঘাটে আসিয়া দাঁড়াইল সে নাবিকগণকে চিনিতে পারিতেছে না। অনিমেষ ‘কিকি’র মন্তব্য মুছিয়া ফেলিবে এমনই ভাবিয়াছিল। কি দরকার তাহার পাবলিসিটি লইয়া? সে তো বেশ নিজের মতো করেই আছে। অনেকগুলো ফেক আইডি বানাইয়া নিজের ‘মৌনজীবনে’র গল্পে নিজেই মন্তব্য করিত অনিমেষ। ইহাতে হয়তো তাহার লেখক সত্ত্বা আরাম পাইতো কিম্বা কেবল ব্লগটিকে সাজাইয়া তুলিবার চেষ্টা ছিল তাহার। অনিমেষ নজর রাখিত যাতে মন্তব্যগুলি সজীব ও বুদ্ধিমান হয়, দিনের শেষে নিজের সাজান গোছানো ব্লগ দেখিয়াই তাহার যেন রেতঃস্খলন হইয়া যাইত প্রায়। তবে অনিমেষ জানিত তাহার এই আনোখা প্রাইভেট ব্লগিং বেশীদিন চলিতে পারে না। যেভাবেই হউক একদিন তাহার এই ব্লগ সংসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবেই করিবে। ইহা লইয়া একটু লজ্জামিশ্রিত গর্বের ভাবও ছিল তাহার। সামান্য দ্বিধাও কি ছিল না তাহার বুকে?

...একে একে আগের মন্তব্যগুলো মুছিতে শুরু করিল অনিমেষ। দীর্ঘক্ষণের কাজ সন্দেহ নাই। তবে এই কাজ তাকে করিতেই হইবে। একে একে মুছে যাইতেছে AK47, চিচিং FUCK, অসহ্য নীলা ও কামরূপের কমেন্টগুলো... দ্বীপ হইতে অনিমেষসমূহ মুছিয়া যাইতেছে।