কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

কালিমাটি অনলাইন / ১০

সম্পাদকীয়



ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কাকতালীয়, কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, একই সঙ্গে প্রকাশিত হলো ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ১০তম সংখ্যা এবং ‘কালিমাটি’ মুদ্রিত পত্রিকার ১০০তম সংখ্যা। ‘কালিমাটি অনলাইন’ শুরু হয়েছিল এ বছর মার্চ মাসে। অর্থাৎ তার বয়স হলো মাত্র দশ মাস। আর ‘কালিমাটি’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১৩৮৬ সালের বৈশাখে বা ইংরেজি ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে। বয়স হিসেব করলে দাঁড়ায় পঁয়ত্রিশ। একটি বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের এই যে দীর্ঘ যাত্রা বা ‘জার্নি’, বিশেষত ১০০ ম্যাজিক সংখ্যা স্পর্শ করা, এটা একটা ‘মাইলস্টোন’ বলা যেতে পারে। আবার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনাও বটে। আর এই ম্যাজিক সংখ্যা ও মাইলস্টোন স্পর্শ করার নেপথ্যে আছে অনেকের অনেক শ্রম, ধৈর্য, উৎসাহ ও ভালোবাসা। আছে অনেক বেদনা, সহিষ্ণুতা, লড়াই ও দায়বদ্ধতা।


জামশেদপুর থেকে প্রকাশিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকার এতদিন টিকে থাকা, সত্যিই এক আশ্চর্য ঘটনা! ১০০তম সংখ্যার ‘সম্পাদকীয়’তে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি – “বহির্বঙ্গে বসবাস করে, যেখানে প্রতিদিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বাংলা ভাষার প্রসার, বাংলা মাধ্যম ইস্কুলগুলিকে সমানেই গুটিয়ে ফেলা হয়েছে এবং হচ্ছে, ভাষা শিক্ষার অভাবে ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য পড়ার কোনো প্রস্তুতি নিতে পারছে না নতুন প্রজন্ম, সেখানে একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের এত বছর ধরে বেঁচে থাকা, আমাদের মনেও এনে দেয় এক আশ্চর্য চমক, মুগ্ধতা। আমরা উপলব্ধি করি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে আমরা কখনও বিচ্যুত হইনি। এবং সেইসঙ্গে আমরা চেষ্টা করে এসেছি, ‘কালিমাটি’কে কীভাবে আরও মননশীল করে তোলা যায়, কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায় বৃহত্তর বৃত্তের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে”।


বিগত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন এবং এখনও আছেন, তাঁদের সবার কাছে ‘কালিমাটি’ ঋণী ও কৃতজ্ঞ। সবার প্রতি ‘কালিমাটি’ জানায় আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের বিভিন্ন বিভাগে আমরা প্রতি সংখ্যায় নতুন নতুন কবি, গল্পকার, নাট্যকার, গদ্যকার ও শিল্পীর সৃষ্টি ও সৃজন প্রকাশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি। বলা বাহুল্য, সম্প্রতি অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে তাঁদের লেখা ও শিল্পকর্ম পাঠাচ্ছেন। এবং আমরা তা নিয়মিত প্রকাশও করছি। সেইসঙ্গে আমরা আরও আশা করছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাভাষী অন্যান্য কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরাও তাঁদের লেখা ও শিল্পকর্ম পাঠাবেন। তাঁদের যোগদানে ও সহযোগিতায় ‘কালিমাটি অনলাইন’ আরও সমৃদ্ধ হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই সংখ্যায় ‘ছবিঘর’ বিভাগে কিছু তরুণ শিল্পীর অঙ্কনচিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। সেইসঙ্গে আছে প্রবীণ শিল্পীদের ছবি। এঁরা সবাই প্রতিভাবান শিল্পী। এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করতে হয়, এবার স্লাইড শো-তে যে পাঁচটি ছবি প্রদর্শিত হয়েছে, তা আমাদের এক তরুণ শিল্পী রূপকের শিল্পকর্ম।


প্রসঙ্গত জানাই, আপনারা কবিতা, ঝুরোগল্প, কথনবিশ্ব’র জন্য প্রবন্ধ বা নিবন্ধ, অণুরঙ্গ’র জন্য নাটক ইত্যাদি যে লেখাই পাঠাবেন, অনুগ্রহ করে বাংলা ‘অভ্র’ ফন্টের ‘বৃন্দা’তে কম্পোজ করে পাঠাবেন। অন্য কোনো বাংলা ফন্টে কম্পোজ করে পাঠালে আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হব।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kalimationline100@gmail.com / kajalsen1952@gmail.com

প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :

0657-2757506 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002,
Jharkhand, India

<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


০১) অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী


যিশু-জীবনের দু’টি আবৃত অধ্যায় : কিছু ভারতীয় যোগসূত্র


এ-কথা আমাদের সবারই জানা আছে যে, বাইবেল অথবা খ্রীস্টীয় শাস্ত্রগুলিতে যিশুর জীবনের ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। সে-ইতিহাসে ছেদ পড়েছে যিশুর বারো বছর বয়সের পর থেকে। তারপর প্রায় আঠারো উনিশ বছরের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। কিশোর যিশুর পরেই পাওয়া যাচ্ছে একেবারে ত্রিশ বছরের যুবক যিশুর কথা। এই ফাঁকটি স্বভাবতই গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কারণ, মানুষের মানসিক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পর্বটির অনুল্লেখ প্রশ্ন না জাগিয়ে পারে না। যিশু খ্রীস্টের জীবনের দ্বিতীয় রহস্যাবৃত পর্বটি হচ্ছে তাঁর ক্রুশারোহণের পরবর্তী অধ্যায়। খ্রীস্টান শাস্ত্রগুলির মতে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ‘মৃত্যুর’ পর তাঁর ‘পুনরুত্থান’ হয় ও তিনি ‘কবর’ থেকে উঠে ছ’ সপ্তাহ পৃথিবীতে ছিলেন, এরপর এক পাহাড়ের ওপর থেকে তিনি সোজা আকাশে উঠে মিলিয়ে যান। বাস্তববুদ্ধি দিয়ে অবশ্যই এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।

যিশুর জীবনের এই দু’টি আবৃত বা বিতর্কিত অধ্যায় সম্পর্কে যে-সব কাহিনী বা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, তার কয়েকটির সঙ্গে প্রাচীন ভারতবর্ষ আর হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের নানা অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। খ্রীস্টীয় পুঁথিপত্রে অনুল্লেখিত ঐ দু’টি পর্বে যিশু ভারতে এসেছিলেন কিনা -- এ বিতর্ক বহু দিনের। অন্য যে কোনো বিষয়ের মতোই এই বিতর্কটিও দুটি দিক দিয়ে বিবেচ্য -- তথ্যের দিক, আর তত্ত্বের দিক। তথ্যের দিক দিয়ে বিচার করা প্রয়োজন, যিশুর ভারতে আগমনের কি কোনো বস্তুগত প্রমাণ পাওয়া যায়! আর তত্ত্বগতভাবে দেখতে হবে, খ্রীস্টধর্মের দর্শন ও সিদ্ধান্তগুলিতে ভারতের তৎকালীন ধর্ম ও মতবাদগুলির কোনো তাত্ত্বিক প্রভাব আছে কিনা! এই দু’টি দিক সম্পর্কেই অবশ্য বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ বর্তমান পরিসরে নেই, আমরা শুধু কয়েকটি সূত্রের উল্লেখ এখানে করবো।

জিজ্ঞাসু কিশোর থেকে মানবপুত্রে উত্তরণ 


 
ল্যুক লিখিত সুসমাচারের ‘মন্দিরে বালক যিশু’ বিষয়ক অধ্যায়ে ইহুদিদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ‘তারণোৎসব’ উপলক্ষে যিশুর মা-বাবার তাঁকে নিয়ে জেরুজালেমে যাবার কথা আছে। সেখানে বারো বছর বয়সী যিশুকে মন্দিরের শাস্ত্রীদের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা করতে দেখতে পান তাঁর মা-বাবা। তারপর যিশুকে নিয়ে তাঁরা যথারীতি ন্যাজারেথে ফিরে এলেন ও এই বালক বয়সে ও জ্ঞানে দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে লাগলেন এবং ক্রমে ক্রমে ঈশ্বর ও মানুষের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন, এ- পর্যন্তই উল্লেখ পাওয়া যায়। এর পর খ্রীস্টীয় সাহিত্যে যিশু-জীবনের যবনিকা উত্তোলন হচ্ছে তাঁর ত্রিশ বছর বয়সে। ম্যাথু লিখছেন, যিশু যখন জর্ডন নদীর তীরে জন দি ব্যাপটিস্টের কাছে দীক্ষা নিতে যাচ্ছেন, তখন তিনি পূর্ণবয়স্ক যুবা। জনের মতো দীক্ষকও এই তরুণকে বলছেন, “আমারই উচিত আপনার কাছে দীক্ষাগ্রহণ করা, আর আপনি এসেছেন আমার কাছে!” কিন্তু কী ভাবে কবে কোথায় যিশু এই পরিণতি ও খ্যাতি অর্জন করলেন, সেই মধ্যবর্তী ইতিহাস কিছুই পাই না আমরা।

এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যিশুর জীবনের এই সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা তাঁর উন্মেষপর্ব, একটি জিজ্ঞাসু কিশোর থেকে পরিত্রাতা খ্রীস্ট হয়ে ওঠার পর্ব, যে প্রস্তুতিপর্ব সম্পর্কে খ্রীস্টীয় সাহিত্যগুলো বিশ্বকে অন্ধকারে রেখেছে। কোন্‌ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ন্যাজারেথের বালকটি মানবপুত্র যিশু হয়ে উঠলেন, খ্রীস্টান পন্ডিতদের নিজেদের কাছেই তার কোনো জবাব নেই, এটা একটু অদ্ভুতই মনে হয়। এ-কথা অবশ্য আমরা শতাধিক বছর ধরে জানি যে, রুশ পর্যটক [কেউ বলেন ডাক্তার, কারও মতে গুপ্তচর] নিকোলাস নটোভিচের লেখা একটি বইয়ে যিশু-জীবনের এই অজ্ঞাতপর্বটি সম্পর্কে কিছু সংবাদ পাওয়া যায়। ১৮৯৪ সালে বইটি প্রথম ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়, তারপর ইংরেজি, জার্মান, স্পেনীয় ও ইটালিয়ান ভাষায়ও অনূদিত হয়। ইংরেজি সংস্করণটির নাম ‘দি আননওন লাইফ অব জেসাস ক্রাইস্ট’।

১৮৯০ সাল নাগাদ নেপাল, তিব্বত ও কাশ্মীরের নানা মঠে ও গুম্ফায় ঘুরে বেড়াবার সময় নটোভিচ লাদাখের রাজধানী লে শহরের উপকন্ঠে বিশাল বৌদ্ধ মঠ হিমিস গুম্ফার গ্রন্থশালার এক লামার কাছ থেকে জানতে পারেন, সেখানে তিব্বতী ভাষায় লেখা একটি পুঁথির কয়েকটি প্রতিলিপি আছে, যাতে প্রাচ্যদেশে যিশুর জীবনযাপনের কাহিনী রয়েছে। তাঁর বইয়ের ভূমিকায় নটোভিচ জানিয়েছেন, এটি নাকি পালিভাষায় লেখায় মূল পুঁথির তিব্বতী অনুবাদ, যা তিনি একজন লামা ও এক দোভাষীর সাহায্য নিয়ে নোটবুকে নিজের ভাষায় লিখে নেন। নিজের বইয়ে এই শ্লোকগুলিকে তিনি কাহিনীর পারম্পর্যের খাতিরে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন। তাঁর প্রকাশিত বইটিতে চোদ্দটি অধ্যায়ে শ্রেণিবদ্ধ ২৪৪টি স্তবক রয়েছে। ভারতের ও নেপালের ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ ইতিহাসকারদের লেখা যে-পুঁথিটি নটোভিচ হিমিস গুম্ফায় দেখেছিলেন, তার নাম, তাঁর অনুবাদে - ‘দি লাইফ অব সেন্ট ইশা; দি বেস্ট অব দি সানস অব মেন’। এটিতে বর্ণিত কাহিনীর অনেক ঘটনা আবার বাইবেলের বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়।

এবার এই বইটিতে বিবৃত কাহিনীটি বলা যাক। বালক যিশু বা ইশার তেরো বছর বয়সে, যে সময়ে সে-দেশে বিবাহিত জীবন শুরু হয়, তাঁর মা-বাবার কাছে কন্যাপক্ষের লোকজনদের যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। এই সময়েই বালক ইশা গোপনে তাঁর পিতার গৃহ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। নিজেকে অধ্যাত্মবিদ্যায় পারঙ্গম করে তুলতে চেয়ে মহান বুদ্ধের নীতিসমূহের পাঠ নিতে তিনি জেরুজালেম থেকে বেরিয়ে একদল বণিকের সঙ্গে সিন্ধুদেশের দিকে রওনা হন। ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য চোদ্দ বছরের ইশা সিন্ধুপ্রদেশের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে ঈশ্বরের প্রিয় দেশে আর্যদের মধ্যে বসবাস শুরু করলেন। ইতিমধ্যেই সিন্ধুর উত্তরাঞ্চলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি যখন পঞ্চনদীর দেশ ও রাজপুতানার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জৈন [‘D Jaine’] উপাসকেরা তাঁকে তাদের সঙ্গে থাকতে অনুরোধ করলেও তিনি ঐ বিপথগামী ভক্তদের ছেড়ে চলে যান ওড়িশা [orsis] প্রদেশের জগন্নাথধামে [‘Juggernaut’]।

সেখানে ব্রহ্ম বা ব্রহ্মার শ্বেত উপাসকেরা তাঁকে স্বাগত জানান। এই পুরোহিতেরাই তাঁকে বেদপাঠ ও শাস্ত্রব্যাখ্যা করতে শেখান। এদের কাছে ইশা আর যা যা শেখেন, তা হলো – প্রার্থনার মাধ্যমে রোগ সারানো, অশুভ আত্মার প্রভাব কাটিয়ে মানুষকে সুস্থ করে তোলা ইত্যাদি।

এরপর ছ’ বছর ধরে ইশা, জগন্নাথধাম, রাজগৃহ ও বারাণসীর পবিত্র নগরীতে বৈশ্য ও শূদ্রদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করেন। এরা তাঁকে ভালোবাসতো ও এদের কাছে তিনি পরস্বাপহরকদের নিন্দা ও সাম্য, শান্তি আর সৌভ্রাত্রের বাণী প্রচার করতেন। শূদ্রদের তিনি বলতেন, “গরীব ও দুর্বলের সহায় হও, অপরের ক্ষতি কোরো না, অন্যের সম্পত্তিতে লোভ কোরো না” ইত্যাদি। তাঁর এ-ধরনের উপদেশে ক্রুদ্ধ হয়ে জগন্নাথের সেই ‘শ্বেত পুরোহিতে’র দল ও যোদ্ধারা [warriors] ইশার প্রাণনাশের চেষ্টা করে, কিন্তু শূদ্রদের কাছে এই চক্রান্তের খবর পেয়ে তিনি রাতারাতি পুরীধাম থেকে পালিয়ে যান। অতঃপর তিনি আশ্রয় নেন বুদ্ধের জন্মস্থান গোতমীয় দেশে [Gothamide country] ও সেখানে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসকদের কাছে ছ’বছর থেকে বৌদ্ধশাস্ত্র ব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এই বিবরণ থেকে মনে হয় যে, এই তরুণ পরিব্রাজককে পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডারা ও রাজশক্তির বেতনভূক সৈনিকেরা মিলে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তিনি সম্ভবত এরপর নেপালে চলে যান।

যা-ই হোক, বইটির ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাওয়া যাচ্ছে, এরপর তরুণ ইশা নেপাল ও হিমালয় অঞ্চল ছেড়ে তাঁর শান্তির বাণী প্রচার করতে করতে রাজপুতানা হয়ে পশ্চিম দিকে চলতে থাকেন। তাঁর প্রচারে আতঙ্কিত হয়ে পারস্যের পুরোহিতেরা স্থানীয় লোকজনকে ইশার উপদেশ শুনতে নিষেধ করে। কিন্তু তবু গ্রামবাসীরা ইশাকে সমাদর করে সাগ্রহে তাঁর উপদেশ শুনছে দেখে পুরোহিতেরা তাঁকে বন্দী করে প্রধান পুরোহিতের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু এই বিচক্ষণ লোকটি ইশার কথা শুনে তাঁর কোনো ক্ষতি না করে ছেড়ে দেন। শেষ পর্যন্ত পুরোহিতেরা ইশাকে নগরপ্রাচীরের বাইরে রাজপথের ওপর ছেড়ে দেয় এই ভেবে যে, অচিরেই তিনি বন্যজন্তুর শিকার হবেন। কিন্তু প্রভুর আশীর্বাদে ইশা নির্বিঘ্নে ইজ্রায়েলের দেশে এসে পৌঁছান। এই কাহিনী অনুযায়ী তখন তাঁর বয়স উনত্রিশ বছর। এর পরে ঐ তিব্বতী পুঁথিতে এই পরিব্রাজকের পরবর্তী জীবনের যে-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তা অনেকাংশেই খ্রীস্টীয় গসপেলে বর্ণিত যিশুর জীবনকাহিনীর সঙ্গে মিলে যায়।

কনটোভিচের পরিবেশিত কাহিনীটির পর তার প্রকাশনা ও প্রতিক্রিয়ার কথা কিছুটা শোনাও জরুরী। তিব্বতী পুঁথিতে বর্ণিত কাহিনী যে যিশুরই তরুণ বয়সের অজ্ঞাত কাহিনী, এ-কথা বুঝতে পেরে তিনি ইয়োরোপের কয়েকজন ধর্মবেত্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু প্রাচ্যদেশীয় ধর্ম ও দর্শনের কাছে যিশু বা তাঁর প্রতিপাদিত ধর্মমতের কোনো রকম ঋণ ছিল, তা খ্রীস্টীয় সমাজের পক্ষে মেনে নেওয়া যথেষ্ট কঠিন ছিল। কিয়েভের স্বনামধন্য আর্কবিশপ মঁসেন্যুর প্লাতন, পারীর কার্ডিনাল রোটেলি প্রমুখ নটোভিচকে ঐ বইয়ের প্রকাশনা থেকে নানাভাবে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন। ইতালির এক উচ্চপদস্থ কার্ডিনাল নাকি বইটি প্রকাশ না করার ক্ষতিপূরণ হিসেবে নটোভিচকে অর্থও দিতে চান, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর তিনি চিঠি লেখেন জুলস সাইমনকে, জবাবে তিনি বইটি প্রকাশ করা বা না করা সম্পর্কে বিচার করে নটোভিচকেই সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। অতঃপর ফরাসি ভাষায় নটোভিচের বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন যে, তাঁকে সমালোচনা করার আগে বৈজ্ঞানিকসমাজ ওই বৌদ্ধ পুঁথিটি যেখানে আছে, সেখানে গিয়ে যেন এর ঐতিহাসিক মূল্য যাচাই করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য খ্রীস্টীয় সমাজের ও তার বাইরের কেউ কেউ হিমিস গুম্ফায় গিয়ে ওই চেষ্টা করেছেন। এঁদের মধ্যে ১৯২১ সালে হেনরিয়েটা মেরিক, ১৯২২ সালে বাঙালি সন্ন্যাসী স্বামী অভেদানন্দ ও ১৯২৫ সাল নাগাদ রুশ চিত্রকর নিকোলাস রোয়েরিখের হিমিস গুম্ফায় আগমন উল্লেখযোগ্য এবং তাঁরা ওই পুঁথিটি দেখেছেন বলে দাবি করে ইশা-কাহিনীর যে-বিবরণ দেন, তা মোটামুটি নটোভিচের কাহিনীর সঙ্গে মিলে যায়। এঁরা ছাড়াও শ্রী রামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ [কোন্‌ সালে জানা যাচ্ছে না], ১৯৩৯ সালে আলাদা ভাবে মিসেস গেস্ক আর ই. কাস্পারি, ১৯৭০ সালে এডোয়ার্ড নোওয়াক, ’৭৩ সালে ডঃ রেভিজ, ’৭৪ সালে ইউ এইক্সটাড প্রমুখ হিমিস গুম্ফায় আসেন। এঁরা সকলেই সেখানে ওই পুঁথিটি দেখেছেন অথবা সেটির কথা লামাদের কাছে শুনেছেন বলে দাবি করেছেন। তা সত্ত্বেও এঁদের কথায় বিশ্বাস করেননি, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। শোনা যায়, স্বনামধন্য প্রাচ্যবিদ ম্যাক্সমূলর এঁদের অন্যতম। এই অবিশ্বাসী খ্রীস্টানদের বক্তব্য প্রচারের জন্য বেশ কিছু ওয়েবসাইট চালু আছে, যার মূল বক্তব্য, নটোভিচ ধাপ্পাবাজ ছাড়া আর কিছু নন। ‘দি ফোর্থ আর’ নামে এক পত্রিকায় রবার্ট প্রাইস নামে এক লেখক ২০০১ সালে জানিয়েছিলেন, আগ্রার জনৈক অধ্যাপক ডগলাস নাকি নটোভিচের বই প্রকাশের সমকালে হিমিস গুম্ফায় গিয়ে লামাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বিগত পনেরো বছরে কোনো পর্যটকই ঐ গুম্ফায় আসেননি এবং নটোভিচ-কথিত কোনো পুঁথিও নাকি হিমিস মঠে নেই।



ক্রুশারোহণের পরে


রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেটের আদেশে যিশুকে ক্রুশে ঝোলানো হয়েছিল, এ-কথার উল্লেখ বাইবেল সাহিত্যগুলিতে পাওয়া যায়। কিন্তু তার পরে তাঁর মৃত্যু বা সৎকারের কথা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। সন্ত ল্যুকের বর্ণনায় আছে, ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে দেখে মন্দিরের পুরোহিত ও শাস্ত্রীরা, পথচারীরা, এমন কি, ক্রুশে ঝোলানো একটা চোরও নানা রকম ব্যঙ্গবিদ্রূপ করছিল। মার্ক লিখিত সমাচারেও আছে, যিশুর প্রাণদন্ডের পরে তাঁকে ক্রুশে চড়াবার আগে সৈন্যেরা তাঁকে উপহাস ও আঘাত করছিল আর তাঁর গায়ে থুথু দিচ্ছিল। এ-থেকে বোঝা যায় যে, গলগাথা নামক ওই বধ্যভূমিতে যিশুর প্রতি সহানুভূতিশীল একজনও ছিল না। পুরোহিতেরা স্থানীয় জনতাকে তাঁর বিরুদ্ধে ভালো ভাবেই খেপিয়ে তুলেছিল। বাইবেলের বিবরণ অনুযায়ী, সকাল ন’টা নাগাদ যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, দুপুর বারোটার পর চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। বেলা তিনটের সময় যিশু উচ্চকন্ঠে বলে উঠলেন, “ঈশ্বর আমার, কেন তুমি আমায় ত্যাগ করেছ?” তারপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। যিশুর মা মরিয়ম সহ তাঁর আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মানুষ দূর থেকে সব দেখছিলেন। সন্ধ্যা নাগাদ যোশেফ নামে এক প্রভাবশালী ইহুদি পন্টিয়াস পাইলেটের কাছে গিয়ে যিশুর মৃত্যুর কথা জানিয়ে তাঁর দেহটি কবর দেবার জন্য নিয়ে যাবার অনুমতি চাইলেন। মৃত্যুর খবরে পাইলেট বিস্মিত হলেন ও বধ্যভূমিতে প্রহরারত সেনানায়কের কাছে খবরটি যাচাই করে নিয়ে দেহটি নিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন। যোসেফ ক্রুশ থেকে দেহটি নামিয়ে একটি নতুন চাদরে জড়িয়ে সেটিকে পাহাড়ের একটি গুহার ভেতরে শুইয়ে দিলেন ও একটি পাথর দিয়ে সমাধির মুখ বন্ধ করে দিলেন। দূর থেকে যারা সব লক্ষ্য রাখছিলেন, সেই মাদ্গালা-নিবাসিনী মরিয়ম ও যিশু-জননী মেরী যিশুকে কোথায় রাখা হলো দেখে গেলেন।

বাইবেলীয় বিবরণের এ-টুকু অংশ থেকে কয়েকটি ব্যাপার ভেবে দেখার মতো মনে হয়। প্রথমত, ছ’ঘন্টা একজন ক্রুশবিদ্ধ মানুষের সজ্ঞান অবস্থায় থাকা ও কথা বলতে বলতে হঠাৎ মৃত্যু হওয়াটা খুব স্বাভাবিক মনে হয় না। মৃত্যুর সংবাদে রোমান শাসকের বিস্ময়ের কারণও সেটাই হতে পারে। দ্বিতীয়ত, গলগাথায় শত্রুভাবাপন্ন লোকেরা যিশুকে ঘিরে রাখলেও তাঁর শিষ্য-অনুরাগীরা তাঁর ওপর দূর থেকে নজর রাখছিলেন। অনেকে মনে করেন যে, এমনটা হওয়া সম্ভব যে, যিশু সাময়িকভাবে মূর্ছিত হয়েছিলেন ও তা মৃত্যু বলে ধরে নিয়েছিল সমবেত জনতা ও পাহারায় থাকা রোমান সেনানায়কটি। ফলে তাঁর দেহটি শিষ্য-অনুগামীরা ক্রুশ থেকে নামিয়ে আনার সুযোগ পান ও তার পরেই সম্ভবত তাঁরা বুঝতে পারেন যে, তিনি মারা যাননি। তাঁর দেহকে যে-ভাবে কবর দেওয়ার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, তা এতই অস্বাভাবিক যে, তাতে এই সন্দেহই দৃঢ় হয় যে, যিশু সে-সময় মারা যাননি।

বাইবেলের বিবরণে এর পরের কাহিনী অলৌকিক উপাদানে মেশানো। একদিন পার হবার পর দুই মেরী সমাধিগুহার সামনে গিয়ে দেখেন যে, গুহামুখের পাথরটি সেখান থেকে সরিয়ে তার ওপর এক দেবদূত বসে আছেন। তিনি মহিলাদের জানান যে, যিশু সেখানে নেই, তাঁর ‘পুনরুত্থান’ হয়েছে। কোথায় গেলে যিশুর দেখা পাওয়া যাবে, সেকথাও তিনি এঁদের বলে দিচ্ছেন। এরপর তাঁদের ফিরে যাবার পথে আবির্ভূত হচ্ছেন স্বয়ং যিশু ও এঁদের বলছেন শিষ্যবন্ধুসহ গালীল প্রদেশে যেতে, সেখানেই তিনি দর্শন দেবেন। খ্রীস্টীয় কাহিনীগুলিতে এরপরেও শিষ্যদের সামনে যিশুর আবির্ভাবের কথা আছে – কখনও তিনি বোঝাচ্ছেন যে, তাঁর ঐ পুনরুত্থানে অবিশ্বাস্য কিছু নেই, কখনও বা তিনিই যে জলজ্যান্ত যিশু, তা বোঝাতে নিজের ক্রুশক্ষত দেখাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত গালীল প্রদেশে শিষ্যভক্তদের সামনে এক পাহাড়ের ওপর থেকে তিনি সোজা আকাশে উঠে অদৃশ্য হয়ে যান। জন ও অন্যান্যদের লেখা সুসমাচারের এই অলৌকিক বিবরণেই যিশুর সর্বশেষ বর্ণনা পাওয়া যায়।

অবাস্তব বা অলৌকিক বর্ণনাকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে যাঁরা ঐ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, তাঁদের অনেকের মতে, ঐ ‘পুনরুত্থান’ খুব সম্ভব একটি পরিকল্পিত ব্যাপার। অচৈতন্য যিশুকে ক্ষত নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত ভেষজ আর ওষধির [বাইবেলেই এর বিবরণ আছে] সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলে শত্রুভাবাপন্ন পুরোহিত ও শাসককুলের নজর এড়িয়ে নিরাপদ স্থানে শিষ্যভক্তদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব‍্যবস্থা করার জন্যই ওই সব অলৌকিক কাহিনী ছড়ানো হয়েছিল। যিশুর অন্তর্হিত হবার সোজা অর্থ, তিনি গা ঢাকা দিয়েছিলেন ও সম্ভবত কোনো দূরদেশে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রভাবশালী শিষ্যেরা তাঁকে শত্রুরাজ্য থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দৃশ্য কেউ দেখেনি বলেই বাইবেলে তার বর্ণনা কোথাও নেই। তাঁর এই নিরুদ্দেশকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে মেঘের মধ্যে মিলিয়ে যাবার রূপক কাহিনীর মধ্য দিয়ে।

এতক্ষণ যা বলা হলো, তা সবই বাইবেলের অলৌকিক কাহিনীর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, যিশু সত্যিই যদি অন্য কোনো দেশে চলে গিয়ে থাকেন, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ বা সাক্ষ্য পাওয়া যায় কিনা! এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, যিশুর ক্রুশারোহণ-উত্তর পর্বের জীবন সম্পর্কে সত্যিই বিভিন্ন জনশ্রুতি ও কাহিনী আর তার সপক্ষে নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সাহিত্যিক ও নৃতাত্ত্বিক সাক্ষ্য নানা দেশে ছড়িয়ে আছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে যিশুর এই ‘অজ্ঞাত’ জীবনের কাহিনীগুলির বিভিন্ন শাখাগুলি এ-রকম। একটি শাখা অনুসারে যিশু তুরস্ক, পারস্য ও পশ্চিম ইয়োরোপ হয়ে পৌঁছন ইংলন্ড ও ফ্রান্স পর্যন্ত। আরেকটি শাখা পৌঁছেছে জেরুজালেমে। ওই অঞ্চলে ১৯৮০ সালে আবিষ্কৃত এক প্রাচীন সমাধিতে চিত্রলিপিতে খোদিত এমন কিছু নাম পাওয়া যায়, যা নাকি নিউ টেস্টামেন্টের বিভিন্ন চিত্রের সঙ্গে মিলে যায়। অনেকের মতে, এটি যিশু খ্রীস্টের পারিবারিক কবর – টোপেল নামে এক মার্কিন সাংবাদিক এ-বিষয়ে ‘দি লস্ট টোম অব জেসাস’ নামে এক তথ্যচিত্র তৈরি করেন, যা ২০০৭ সালে টি-ভি-তে প্রথম দেখানো হয়। আবার প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রাপ্ত এক প্রাচীন পুঁথিতে লেখা আছে, পুনরুত্থানের পর যিশু আবার তাঁর আদি কর্মভূমি হিমালয় অঞ্চলে ফিরে আসেন ‘শয়তানদের রাজ্য’ পরিত্যাগ করে এবং সেখানে শিষ্যদের নিয়ে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। যিশুজীবনের অজ্ঞাত পর্বের এই বিভিন্ন শাখাগুলির মধ্যে যেটি ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত, আপাতত সেটি নিয়েই আমরা এখানে আলোচনা করবো।

যিশুর ক্রুশ-উত্তর জীবনকাহিনীর ভারত-সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংক্ষেপে এ-রকম। নিজের মা মেরীকে নিয়ে যিশু প্রায় ষোলো বছর পশ্চিম এশিয়া ও ইয়োরোপের নানাদেশে ও সম্ভবত ইংল্যান্ডে সফর করেন ও শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে এসে উপস্থিত হন। সেখানেই মেরী মাতার মৃত্যু হয়। সেখানকার মানুষের কাছে বহু বছর ধর্মীয় উপদেশ প্রচার করেন তিনি, এরা তাঁকে একজন মহান পয়গম্বর, সন্ত ও সংস্কারক হিসেবে শ্রদ্ধা করতো। কাশ্মীরেই তাঁর মৃত্যু হয় ও সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। প্রাচীন ও আধুনিক নানা গ্রন্থেই এই কাহিনী পাওয়া যায়। ইরানের পন্ডিত এফ মহম্মদের ‘জোমি উৎ তুওয়ারিক’, ইমাম আবু জাফর মুহম্মদের ‘তফাসি-ইবন-ই-জামিরাৎ’ প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থ, ফিদা হাসনাইনের ‘Jesus from Apocryphal, Buddhist, Islamic & Sanskrit sources’, হলগার কের্স্তেনের ‘Jesus lived in India’ ইত্যাদি বইয়ের নাম এ-প্রসঙ্গে করা যায়। তুরস্ক ও পারস্য দু’দেশেরই প্রাচীন কাহিনীতে ইয়ুজ আসফ নামে এক সন্তের নাম পাওয়া যায়। পূর্বোক্ত লেখক কের্স্তেন লক্ষ্য করেছেন, এই ব্যক্তির অলৌকিক কাজকর্ম ও কথাবার্তা যেন যিশুর সঙ্গেই মিলে যায়। পূর্ব আনাতোলিয়ায় কুর্দ উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী ক্রুশারোহণের পর যিশু কিছুদিন পূর্ব তুরস্কে বসবাস করেছিলেন।

চার্চের ক্ষমতাসীন অধিকারীরা [থিওলজিকাল কম্যুনিটি] যিশু-জীবনের অনেক প্রচলিত কাহিনীকেই শোনা কথা বলে বর্জন করেন। এই সব অসমর্থিত বিবরণ বা ‘অ্যাপোক্রাইফা’-গুলির মধ্যেই যিশুর নিরুদ্দেশ-জীবনের অনেক সূত্র লুকিয়ে আছে বলে অনেকের বিশ্বাস। এ-রকম দু’টি বিবরণ হচ্ছে ‘দি অ্যাপোক্রাইফাল অ্যাক্ট অব জেসাস’ আর ‘দি গসপেল অব জেসাস’। দু’টিতেই পাওয়া যাচ্ছে, ক্রুশারোহণের পরে যিশুর সঙ্গে বেশ কয়েকবার সেন্ট টমাসের দেখা হয় ও তিনিই টমাসকে ভারতে প্রচারের উদ্দেশ্যে পাঠান। এই টমাসের গসপেলটি মূলত সিরিয়ান, খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতক বা তারও আগেকার। এটিতে টমাস আনাতোলিয়ার আন্দ্রোপলিসে রাজা আন্দ্রাপ্পার অতিথি হিসেবে যিশুর উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। প্রাচীন এক ইসলামি পুঁথিতে মেসোপটেমিয়ার নিসবিসে মাতা মেরী ও শিষ্যদের সঙ্গে যিশুর আগমন ও ধর্মপ্রচারে বাধা পাবার কথা আছে। ‘ফরহাং ই আসাফিয়া’ নামে একটি বইয়ে ইরানে যিশুর আগমন, অসুস্থদের রোগ নিরাময় ও তাদের সংঘবদ্ধ করার কথা আছে। ‘অ্যাক্টা থোমায়ে’ নামে একটি বইয়ে ভারতের তক্ষশিলায় এক রাজপরিবারের বিবাহ-অনুষ্ঠানে যিশুর উপস্থিতির কাহিনী রয়েছে। কোরআনের ‘সুরাত-উল-সুমিনাম’ অংশের একটি বইয়ে বলা হচ্ছে --“আমরা মেরীপুত্রকে ও তাঁর জননীকে আশ্রয় দিয়েছি সবুজ উপত্যকায় ও প্রবহমান ঝর্ণার সেই উচ্চভূমিতে।” এখানে কাশ্মীরের নামোল্লেখ না করা হলেও হজরত ইশার ইয়ুজ আসফ নাম নিয়ে কাশ্মীর উপত্যকায় বসবাস, নানা স্থানে ভ্রমণ ও মৃত্যুর পর সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করার কথা পাওয়া যায় মুল্লা নাদরির ‘তারিখ ই কাশ্মীরি’ [১৮২০ খ্রিঃ], ‘ওয়াজিস-উৎ-তাওয়ারিখ’ [১৮৫৭] আর তারিখ-ই-হাসান’, শেখ আল সৈদ-উস-সাদিকের ‘ইকমাল-উদ-দিন’, মীর শাদুল্লা শাহাবাদীর ‘বাগ-ই-সুলাইমান’ [১৭৮০] ইত্যাদি বহু প্রাচীন ও অর্বাচীন গ্রন্থে।

গোপানন্দ বা গোপদত্ত ৪৯ থেকে ১০৯ খ্রীঃ পর্যন্ত কাশ্মীরের শাসক ছিলেন। ‘তারিখ ই কাশ্মীরি’ জানাচ্ছে, সন্ত ইয়ুজ আসফ এই অঞ্চলের সব মানুষের কাছেই দিব্যপুরুষ হিসেবে শ্রদ্ধেয় ছিলেন, যদিও তাঁর নিজস্ব ধর্মপ্রচার সম্পর্কে হিন্দুদের কিছু আপত্তির কথা রাজা গোপদত্ত তাঁকে জানিয়েছিলেন। কাশ্মীরের রাজ্য অভিলেখাগারের প্রাক্তন ডিরেক্টর ডঃ ফিদা হাসনাইনের ‘এ সার্চ ফর হিসটোরিকাল জেসাস’ বইটিতে ‘ভবিষ্য মহাপুরাণ’ নামে একটি হিন্দু গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাতে শাক্য নরপতি শালিবাহনের হিমালয় অঞ্চলে ‘হুনরাজ্যে’ ভ্রমণের সময় এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে রাজা শ্বেতবস্ত্রপরিহিত এক দিব্যদর্শন ব্যক্তিকে পাহাড়ে উপবিষ্ট দেখতে পান, তাঁর গায়ের রং ফরসা। রাজা তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি কুমারীগর্ভসঞ্জাত ইশাপুত্র, সত্যব্রতপরায়ণ ও ম্লেচ্ছধর্মের প্রবক্তা।” তাঁর ধর্ম কী, রাজার এই প্রশ্নের উত্তরে ঐ ব্যক্তি বলেন, “মহারাজ, ম্লেচ্ছদেশে সত্য ক্ষয়প্রাপ্ত হলে আমি সেখানে মসীহা [অবতার] রূপে সমাগত হই।” [‘নির্মর্যাদে ম্লেচ্ছদেশে মসীহো২হং সমাগত’] ডঃ হাসনাইনের মতে, এই হুনদেশ এখনকার লাদাখ উপত্যকা, যা সে-সময় কুশান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।



‘হারানো ভেড়া’দের খোঁজে -- নৃতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্বের পাথুরে প্রমাণ


ম্যাথু লিখিত সুসমাচারে পাওয়া যায়, যিশু তাঁর বারোজন শিষ্যকে নির্দেশ দেন, ‘ইজ্রায়েল বংশের যে-সব হারানো ভেড়ারা’ রয়েছে, তাদের কাছেই যেন তাঁরা যান। যিশুর কাশ্মীর বা ভারতে যাবার তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের মতে ইহুদিদের মাত্র দু’টি বংশ ছাড়া আর সব বংশের লোকেরাই তাদের বাসভূমি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল নানা দেশে, হারানো ভেড়া বা ‘লস্ট শীপ’ বলতে যিশু তাদেরই বুঝিয়ে ছিলেন। সে-জন্যই যিশুর পুনরুত্থানের পর তাঁর শিষ্যেরা জেরুজালেমে মিলিত হয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়া ইহুদিদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তখন ভারতবর্ষ বলতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বর্তমান ভারত পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বোঝাতো। তাই অনেকের বিশ্বাস, যিশুর নির্দেশ মেনেই সেন্ট টমাস প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতে আসেন ও এ-দেশের প্রথম খ্রীস্টান সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় সাহিত্য ও লোককথায় এই বিশ্বাসের কিছু সমর্থনের কথা আমরা বলেছি। এখন দেখতে হবে যে, এ-সব শুধুই বিশ্বাস, না এর সপক্ষে কোনো ‘পাথুরে প্রমাণ’ অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক কোনো সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায়।

যিশুর ইংলন্ড সফরের সপক্ষে ব্রিটেনে ‘হ্যালেড ট্রি’ নামে এক প্রাচীন ওকগাছের উল্লেখ করা হয়, যা যিশু পুঁতেছিলেন বলে জনশ্রুতি। তবে যিশুর সঙ্গে জড়িত প্রাচীন স্মৃতিচিহ্নের সংখ্যা ইয়োরোপের চেয়ে এশিয়াতেই বেশি। যেমন স্বভূমি থেকে যিশুর ভারতে আসার কথিত পথের [প্রাচীন ‘রেশম পথ’] ওপর ছিল ‘হোম অব মেরী’ নামে এক বিশ্রামস্থল, পাকিস্তানের পিন্ডি পয়েন্ট নামক পাহাড়ে মুরি [অথবা ‘মারি’] শহরের কিনারায় ‘মাই মেরী কা আস্থান’ নামে একটি কবর ইত্যাদি সম্ভবত যিশু-জননীর স্মৃতির সঙ্গেই জড়িত। ঐ পিন্ডি পয়েন্ট, যে-পর্বতের অংশ, সেই ‘কুইন্স মাউন্টেন’ নামটিও মেরীর নামেই বলেই অনেকে মনে করেন, এমন কি, জায়গাটির ‘মারী’ নামটিও মেরী থেকেই এসেছে বলে অনেকের ধারণা। এই কবরটি মুসলিম এলাকার মধ্যে হলেও এটি ইহুদি প্রথা অনুযায়ী পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। আফগানিস্তানের হেরাত ও তার আশেপাশে বাস করে এক প্রাচীন মুসলিম উপজাতি, যারা নিজেদের মরিয়মপুত্র ইশার অনুগামী বলে পরিচয় দেয়, যা এক সময়ে যিশুর এ-অঞ্চলে ধর্মপ্রচারের ইঙ্গিত দেয়। কাবুলের কাছে ‘ইশা তালাও’ নামে এক জলাশয়ের কথাও শোনা যায়, যেখানে ভারতে যাবার পথে যিশু তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি।

এর পর যিশুর ‘স্মৃতিচিহ্নে’র সন্ধানে আসা যাক ভারতে। তাঁর ভারতে আসার কথিত পথটির সন্নিহিত অঞ্চলে নানা আফগান ও কাশ্মীরী জাতি ও উপজাতির মধ্যে এখনও এমন অনেক নাম পাওয়া যায়, যা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে রয়েছে। বস্তুত এত বেশি বাইবেলীয় নাম কাশ্মীর ও আফগানিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই দুই অঞ্চলের অনেক স্থানের নামও বাইবেলে পাওয়া যায়। এ-গুলি এই সব অঞ্চলের ঘরছাড়া ইহুদিবংশীয়দের কাছে যিশুর ধর্মপ্রচারের ইঙ্গিত দেয় বলে ‘দি টোম অব জেসাস’ নামক ওয়েবসাইটটি দাবি করে। শুধু কাশ্মীরেই রয়েছে যিশু খ্রীস্টের স্মৃতি বিজড়িত একাধিক স্থান। শ্রীনগরের ওপরেই দি থ্রোন অব সলোমান নামে প্রায় তিন হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন এক মন্দিরের গায়ে খোদিত আছে চারটি লিখন, যার একটির মর্মার্থ – “এই সময়ে, এই ৫৪ অব্দে ইয়ুজ আসফ ঘোষণা করেন তাঁর স্বর্গীয় আহ্বান”, এবং -- “তিনিই যিশু – ইজরায়েলের সন্তানদের দিব্যপুরুষ”। শ্রীনগরের দক্ষিণে রয়েছে এক তৃণভূমি, যার নাম ‘য়ুজি মার্গ’ আর এই শহরের দক্ষিণ পূর্বে রয়েছে এক পবিত্র ইমারত, যার নাম ‘আইশ মোকাম’। এই বাড়িটির মধ্যে আছে একটি পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন, যাকে কেউ বলেন ‘মোজেস রড’, কেউ বা বলেন ‘জেসাস রড’। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচিহ্নটি রয়েছে শ্রীনগরেই ‘রোজাবাল’ [শব্দটির অর্থ ‘পয়গম্বরের কবর’] নামে একটি বাড়িতে। এখানে সমাধি কুঠুরির ভেতরে সন্ত য়ুজ আসফ ও আর একজন মুসলিম সন্তের কবর রয়েছে। এর মধ্যে য়ুজ আসফের পাথরের কবরটি বসানো হয়েছে ইহুদি প্রথা মেনে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর এবং সমাধিপ্রস্তরে খোদাই করা রয়েছে দুটি পায়ের ছাপ। উল্লেখযোগ্য যে, দুটি পদচিহ্নের মাঝখানেই দেখা যায় একটি গোলাকার ক্ষতচিহ্ন। গবেষক অধ্যাপক হাসনাইনের মতে, হতে পারে এগুলি ক্রুশের পেরেক পোঁতারই দাগ। এই কবরের দেওয়াল থেকে একদা মৃগনাভির সুগন্ধ নির্গত হতো বলে শোনা যায়। এ-রকমও শোনা যায় যে, এক সময় স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ‘মলুন-ই-ইশা’ নামে এক মলম নাকি পাওয়া যেত, যা কাশ্মীরে আগত যিশুর ক্রুশক্ষত নিবারণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল বলে এদের বিশ্বাস।



বিবেকানন্দের আশ্চর্য স্বপ্ন


যিশু খ্রীস্টের জীবনের রহস্যাবৃত অধ্যায়গুলির সঙ্গে জড়িত ভারতীয় অনুষঙ্গগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও পুরাতাত্ত্বিক তথ্যাদি নিয়ে আমরা কিছু নাড়াচাড়া করেছি। এর পরিপূরক দিকটি, অর্থাৎ খ্রীস্টীয় ধর্মতত্ত্বে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক উপাদানের উপস্থিতি বা প্রভাব সম্পর্কে আলোচনার মধ্যে আপাতত আমরা না গিয়ে শুধু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের একটি অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ সব শেষে করতে চাই। ১৮৯৬ সালে স্বামীজি যখন জাহাজে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছেন, তখন এক রাতে নেপলস ও পোর্ট সৈয়দের মাঝামাঝি এক জায়গায় ভূমধ্যসাগরের বুকে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা এক ঋষিপ্রতিম বৃদ্ধ এসে তাঁকে বলছেন, “তুমি এখন যেখনে এসেছ, সেটা ক্রীট দ্বীপ, এখানেই খ্রীস্টধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল। আমি এখানকার প্রাচীন থেরাপুত্তিদের [বৌদ্ধদের একটি সম্প্রদায়] একজন। আমরা যে-সব তত্ত্ব প্রচার করতাম, খ্রীস্টানরা সে-গুলিই যীশুর উপদেশ বলে প্রচার করছে। আসলে যিশু খ্রীস্ট বলে কেউ কোনোদিন ছিলেন না। এই জায়গায় খনন করলে আমার কথার অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে।”

স্বামীজির তখনই ঘুম ভেঙে গেল ও তিনি জাহাজের ডেকে এসে এক কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন, তখন মধ্যরাত্রি ও জাহাজ রয়েছে সত্যিই ক্রীট দ্বীপ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে। তিনি পরে ইংল্যন্ডে তাঁর এক প্রত্নতাত্ত্বিক বন্ধুকে নাকি এই স্বপ্নবৃত্তান্তের কথা জানিয়ে এ-বিষয়ে খোঁজ নিতে অনুরোধ করেছিলেন। বিবেকানন্দের জীবনীকার স্বামী গম্ভীরানন্দ জানাচ্ছেন, স্বামীজির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গিয়েছিল যে, ক্রীট দ্বীপে খনন চালিয়ে এক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক নাকি এমন অনেক লিপি পেয়েছেন, যা থেকে খ্রীস্টধর্মের উৎপত্তি বিষয়ে অনেক আশ্চর্যজনক তথ্য জানা যায়। এখানে অবশ্য বলে রাখা উচিত, বিবেকানন্দ নিজে কোনোদিনই যিশু খ্রীস্টের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেননি। তবে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, আলেকজান্দ্রিয়া নগরে ভারতীয় ও মিশরীয় ভাবধারার যে মিশ্রণ হয়, তা-ই ছিল খ্রীস্টধর্ম গঠনের মুখ্য উপাদান। তিনি এমন কথাও বলেছেন :- “খ্রীস্টধর্ম... সোজা হিন্দুধর্ম থেকে উদ্ভুত।”

আমরা এতক্ষণ যে-সব কাহিনীর কথা বলেছি, সে সূত্রে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যিশুর উদ্দেশে লেখা একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র মনে পড়ে যায় -- “ওখানে ঠাঁই নাই প্রভু আর, এই এশিয়ায় দাঁড়াও সরে এসে / বুদ্ধ-জনক-কবীর-নানক-নিমাই-নিতাই-শুক-সনকের দেশে।।...” এখানে অবশ্য যদিও যিশুর শারীরিকভাবে ভারতে চলে আসার কথা বলা হয়নি, হিংসাদীর্ণ ইয়োরোপে যিশুর আদর্শের কোনো স্থান নেই, এ-কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে; তবু আমাদের বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে, যিশু সত্যিই তাঁর জীবনে এক বা একাধিকবার এশিয়ায় এসেছেন, এখানে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন ও এখানকার মানুষজনের কাছে নিজের বিশ্বাসের কথা প্রচার করেছেন। আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে, ভারতের মাটিতে এই মহান মানবপ্রেমিক ও ঐশী পুরুষ বসবাস করে গেছেন ও হিমালয়ের কোলে তিনি পেতেছিলেন তাঁর শেষ শয্যা।


তথ্যসুত্র :-

১। reluctant-messenger.com/issa.htm
২। Smithbrad.nventure.com/unknown JC.htm
৩। Jesus in Tibet : A modern Myth By Robert M. Price- The Fourth R, May-June,2001
৪। Tomb of Jesus.com
৫। en.wikiepedia.org
৬। যুগনায়ক বিবেকানন্দ / স্বামী গম্ভীরানন্দ, দ্বিতীয় খন্ড।

০২) রমিত দে

নিঃশব্দ নবীনে রয়েছে জেগে



“The Correct method of Philosophy would
Really be following: to say NOTHING”…      হিটগেনস্টাইন…


‘পূরবী’র কবিতাপর্বে রবীন্দ্রনাথের ডুডলস বা পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটিকে অনেকেই তাঁর নিজস্ব চিত্রভাষা খুঁজে পাওয়ার বা বইয়ের ঘর থেকে ছবির দরবারে পৌঁছে যাওয়ার প্রস্তুতি বলে অভিহিত করেন; সেক্ষেত্রে সান ইদ্রিসোর পরবাসে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মতো অনুগামিনী কেবল অনুঘটকের কাজ করেছিল একজন কবির শব্দতারিক্ত অনুকৃতির আধারটাকে চিনে নেওয়ার আর পুঁথিসাহিত্যের ফাঁকে ফাঁকে সেই দ্বিতীয় বিন্যাস, কথকের সেই picture poesis,
শব্দ থেকে ডিস্টরটেড আঁকিবুকি আবোল তাবোলই হয়ে উঠেছিল কবির ব্যক্তিগত ধ্যানের জগত, স্পেসের জগত, না ছুঁতে পারা এক বাড়তি দূরত্বের জগত। সে যেন এক না শব্দের জগত যে অবধি গিয়েও শব্দ তাকে বারবার সত্যাশ্রিত ঋতের ছন্দে ফিরিয়ে এনেছে আর সসীম শব্দ থেকে অসীম নির্মাণে যাওয়ার ছোট্ট একটা স্পেস বারবার ভীড়ের পথের মাঝে ভরাট শূন্যতা চেনাতে, শব্দের সাদা চেনাতে সেজেগুজে বসে আছে। হ্যাঁ, এ যেন শব্দের চামড়ার ওপর মহাযাত্রিকের আয়না বসানো একটা শূন্যবাদী নৈঃশব্দের জগত। শব্দের সীমাকে বিদীর্ণ করে শূন্যতা লিখে রাখার জন্য যেন এভাবেই রেখার সূক্ষ্মতা থেকে গড়িয়ে নামে স্রষ্টার ছবির গল্প বা গল্পের ছবি। তবে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর ললিতকলা এসব কিছুই এ পরিসরে আলোচ্য নয়, বরং স্পষ্টভাবে প্রবহমান উচ্চারণের বাইরে আবহমান অনুচ্চারণের প্রজনন গ্রন্থিটুকু খোঁজা, নির্লিপ্ত নিরপেক্ষ কিছুটা অতিরিক্ত খোঁজা, যেখানে দাঁড়িয়ে দ্রষ্টা যোজন যোজন অন্ধকার খোঁজেন, খোঁজেন নিঝুম অবধি পৌঁছে যাওয়ার ব্রহ্মগ্রন্থি। এখন প্রশ্ন, কবিকে কি ছবিতে পায়? আক্রান্ত হয় সরবতাকে নিশ্চুপ করার চক্রান্তে? নাকি একজন চিত্রকরের ন্যাচারাল সাইনেও লেগে থাকে শব্দের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়! সে শব্দের ইন্দ্রিয়জ উৎসব নেই, কিন্তু অপ্রাকৃত অবয়বেও সে যেন হাবুডুবু খাচ্ছে, চাইছে চৈতন্যকে গ্রাস করতে। যে শব্দ কোনো ভাষাকে চিহ্নিত করে না বরং ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় শব্দের আলোর শরীর, আর অন্ধকার ঘরে উঠে বসে নৈঃশব্দের প্রাণ ও প্রজ্ঞা। খুঁজে বের করে নিজেকে প্রশ্ন করার সেই জ্যামিতিক প্যার্টানটা, সেই ট্রান্সডেন্টাল পিপাসাটা, যেখানে কবি বা চিত্রকর সীমাবদ্ধতার বাইরে স্বস্তির নিঃশ্বাসের বাইরে কুড়িয়ে রাখছেন এক চিরস্থায়ী দূরত্ব, অদল বদলগুলোর মাঝে স্রষ্টা সেখানে এক অদ্ভুত আস্তাবল খুলে বসেছে অস্তিত্ব ও শূন্যতা বিষয়ক চোরাবালিগুলোকে বুঝে নিতে; সেখানে কবি ও শিল্পীর মাঝে লেগে আছে এক চিরন্তন মাইমেসিস, অনুধ্যানের কিছু লেট ডায়লগ; ইমপারশোনেট হতে হতে প্রতীকের বেড়াজাল পেরিয়ে অর্থের আন্দোলন পেরিয়ে রিলিজ অফ সোলে একীভূত হওয়া; ফর্ম নয় শিরোনাম নয়, কেবল প্রণালীর সৃজন, যা চিহ্ন ও চিত্রনের মগ্নচেতনা জারিত, যা কবিও পুঁতে চলেছেন তাঁর রঙহীন সাদা মাটিতে, আবার ছবিকারও অথবা ভাস্কর তাঁর বিরেখীয় টেক্সচারে লিপি থেকে তুলে আনতে চাইছেন শব্দের আর্বিটারি মোটিভসগুলো, অতলান্তের উঁচু নিচু জমিগুলো, যেখানে শব্দ ও দৃশ্যের মাঝে শিল্পের নিঃশব্দ তর্জনী উদ্ভাসিত হচ্ছে যোগাযোগ ছাড়াই।

একদিকে বোদল্যেয়ারের les phares কবিতা যেখানে দেলেক্রোয়া, লিওনার্দোর ছবির আলো নিয়েই নিভিয়ে দিচ্ছে শব্দের মধ্যেকার সবকটা অন্ধকার, তেমনি তুষার চৌধুরীর ‘গগ্যাঁর হলুদ যীশু’ও তো দালি, মাতিস বা গগ্যাঁর নির্বস্তুক জগতেরই ডেসক্রিপটিভ ভিস্যুয়াল; যেন ভাষা থেকে তার সেন্সেটিভ ইনস্ট্রুমেন্টকে গূঢ়সত্ত্বাকে চিহ্নিত করে একজন চিত্ররসিকের প্যারাফিনে তুলে দেওয়া, ইমোশনকে উস্কিত করে দেওয়া মোশনের আঙ্গিকে; আসলে কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দৃশ্যের সেই বধির অথচ অনবহিত চলা, ঠিক যেমন তেলরং-এর পরতে পরতে তন্ত্রের মতো লেগে রয়েছে বর্ণের অ্যানাটমি; ম্যাথু কোয়ান যাকে বলছেন -“painting is dumb poesy, and a poesy is a speaking painting; and the actions which the painters set out with visible colours and figures the poets reckon with words, as though they had indeed been performed”. যুক্তিগ্রাহ্য পারস্পর্যের মাঝে চলা আসলে একটা চালু আত্মা, যে কিনা গোপনচারী কবি বা শিল্পীকে রাতের জার্গন শোনাতে নিয়ে চলে পোশাকের বিরুদ্ধে পরিচর্চার বিরুদ্ধে। ভাস্কর আর মূর্তির মাঝে, কবি আর কবিতার মাঝে উঠে বসে এক স্বতঃস্ফূর্ত দূরত্ব, এক বিরাজিত সুপ্ত আর সেখানেই শিল্পী আর শিল্পের মাঝে শুরু হয় প্রাণ নয়, প্রজ্ঞানের সাধনা। মাত্রাস্পর্শের বিপরীতে দূরত্বের সংজ্ঞা তৈরি করা। ওই দূরত্বই তো অনন্য দৃষ্টি আর দৃষ্টির নাড়ীপথ ধরে দর্শনের হেঁটে যাওয়া। এক অনন্ত সম্ভাবনার দিকে হাহাকার করে ওঠে শিল্পী; সঙ্গের প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজতে প্রতিটি পদক্ষেপে বেজে ওঠে নৈঃসঙ্গের স্বচ্ছ উচ্চারণ। শিল্পী ও তাঁর শূন্যতার সাধনাদর্শনে যখন আলোক সরকার লেখেন --

“চলেছি যে
এটাই কোনোদিন টের পাইনি
আজ চলার কথা
সব কটা উঁচুনিচুই বলে।
………
আর সেই যাওয়া
তা আলো জ্বালায়নি,
আলো নিভিয়েও দেয়নি।
আলো জ্বালা না জ্বালার ভিতর
যে ছবি হয়
তা দৃশ্য নয়, রেখা-রং নয়।… (আলোক সরকার)

তখন আসলে তাঁর প্রতিটি পংক্তিকে ছেড়ে রাখেন এক দ্বিতীয় অতিরিক্তের দিকে, জীবন ও জগতের মাঝে বঁড়শি দিয়ে তুলে নেওয়া সেই ঊর্মিহীন বিমূর্ত সংবেদের মাঝে; লাইফ থ্রু এ লেন্সে দাঁড়িয়ে কবি যখন চলা শব্দটি উচ্চারণ করেন অথচ টের পান না কোনো প্রোথিত পদক্ষেপ, টের পান না পায়ের নিঃশ্বাসকুচি, তখন আসলে কবি তৈরি করেন এক চুম্বকীয় শূন্যতা, এক বিপজ্জনক স্পেস, যে স্পেস অস্তিত্বের কেন্দ্র থেকে অপরিজ্ঞাতের দিকে চলেছে। অবয়বহীন এক জগতের দিকে চলেছে। আর সেখানেই কি কবি খুঁজে পেলেন তাঁর চিত্রভাষা! লিপি থেকে লিপিকা! মাটি মুছে মুছে দীর্ঘ অঙ্গের সূক্ষ্মতা! কবিতার কারুঘরের প্রথম দরজা খুলে অন্তর্জীবনের পিছল রাস্তাগুলোর ঠিকানা খোঁজে এক ইর্টারনাল ভাইব্রেশন। কবি এখানে একে একে এঁকে চলেছেন ভার্বাল পিকচার, আঠাকাঁচি নিয়ে বসেছেন ভিভিড ওর্য়াড ইলাস্ট্রেশনের ফ্যাকসিমিলি খুঁজতে; স্তুপাকার শব্দের ভরা সংসার থেকে দৃশ্যমান জগতে নেমে পড়ছেন কবি আবার; আসলে সেই স্পেস সেই একটা সাদা ফাঁকা জায়গা যার দিকে ছিটকে যাওয়া যায়, যার দিকে ছিটকে যাওয়া যাচ্ছে না, আর অথৈ থেকে টইটম্বুর থেকে উদোমের দিকে সিগনিফাইং নাথিং-এর দিকে এক স্বয়ং বধিরের দিকে বেড়াতে চলেছেন কবি। পুঁথিসাহিত্যের তরজমাকে অস্বীকার করে তিনি এগিয়ে চলেছেন লিংগুইস্টিক আইসোলশনের দিকে; ঠিক এখান থেকেই শব্দ প্রতিনিধি হয়ে উঠছে সেন্সেশনের, ফ্রি ভার্সের; কাব্যিক ঘোষণাকে মুক্ত করে আলস্য ভেঙে দিয়ে কবি চলেছেন এক সচকিত দৃশ্যের সন্ধ্যামালতী খুঁজতে; কুড়িয়ে নিয়ে চলেছেন শব্দের মাঝের ক্যামোফ্লেজিং শ্বাসটাকে। মঞ্চমায়ায় অনেক দূরের এক জগত এঁকে দিলেন কবি; কেবল দৃশ্য নয়, দৃশ্য মধ্যবর্তী অদৃশ্যকেও মুক্ত করে গেলেন দৃশ্যের আপাত অমরতা থেকে; একে কি অনুকৃতির শিল্প বলা যেতে পারে বা প্রতিকৃতির ভাষা? তো এমনই শব্দের পরের শব্দ, শব্দের পরের নৈঃশব্দ পরখ হয়ে গেলে, দ্রষ্টার কাছে চলা বলতে কেবল কিছু বর্ণে বোঝাই বাসনা থাকে না, বোধিও উঠে আসে; ভাষার হিমানী মার্জিনে রিফু হয়ে যায় কাব্যিক চিত্রলিপিও; দ্রষ্টার হাতে দৃশ্য থেকে দৃশ্যাতীত এই সেই ম্যাক্রোকসমিক পিপাসা, সেই উজ্জ্বল শব্দ যাকে তুমি না-শব্দ বলছ, যার দিকে তৃষ্ণা ছুঁড়ে দিচ্ছি আমি আর তাই যেন কবিতার ছাইগাদায় জন্মেও অস্থিত মীমাংসাহীন এক সত্যের রেখা ও রঙের গজমোতিমালা বুনে চলেছে। চাক্ষুষ চেতনা পেরিয়ে এই পরমোহৎসবে জন্ম নেই মৃত্যু নেই শুরু নেই শেষ নেই, কেবল এক আবহমান টেনশন, পারপেচ্যুয়াল পিলগ্রিমেজ। হয়তো বা পোয়েট্রি হতে হতেই এই সেই আলোকিত পোর্ট্রেট। হয়তো এই সেই পথ যা কেবল পরিধি বা পরিক্রমণে সীমাবদ্ধ নয় বরং অতিক্রম করার শেষেও তার মাঝে রয়ে গেছে আরও এক উদ্ধারহীন অনুভূতির জগৎ…

এরই ঠিক পাশাপাশি এই মহার্ঘ চলাকে সুইস ভাস্কর অ্যালবের্তো জিয়াকোমেত্তির ‘ম্যান ওয়াকিং ইন দ্য রেইন’ ভাস্কর্যটিকে ফুটিয়ে তুললেন পাথরের গহনাতে। সে কি কেবলই পাথর? নাকি জড় ও চৈতন্যের তফাত শিখতে শিখতে বিষয়ের বাইরেও ব্যস্ত হয়ে রইল আরও কিছু সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ! প্রসঙ্গে আসা যাক, অবয়ব বা আকার নয় বরং আকারের নিয়মতন্তুগুলো পেরিয়ে যে অবিরহ এক ধীর পায়ের নির্মাণ, দেখা যাক নির্ধারিতকে অস্বীকার করে সেই অর্ধস্ফুট বা প্রায় অশ্রুত সজীব উপস্থিতিটুকুকে। কেবল একটি ন্যুড লাইনড অবয়ব হেঁটে চলেছে। সরু সরু হাত তদবধি শীর্ণকায় তার পা, মেরুদণ্ডের ছায়ায় ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে চলা লৌকিকের আদল; কেবল একটি মানুষ এবং তাকে ঘিরে অনুক্ত ইথার স্পেস! দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে, জিয়াকোমেত্তির এই ছবিতেই লক্ষ্য করেছেন, শব্দ ও দৃশ্যের আরোপিত যাপনের বাইরের সেই সূক্ষ্ম যোগাযোগ- “The line is the beginning of a negation, the passage from being to non being. Giacometti holds that reality is pure positivity, that there is being and then suddenly there no longer is any, but that there is no conceivable transition from being to nothingness. A vacuum is a distended plenum, a plenum an oriented vacuum”. মোটামুটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পরেই তৈরি এই ভাস্কর্য, আবহে অনিশ্চিয়তা আর নৈঃসঙ্গ আর পৌনঃপুনিকতা থেকে ক্লান্ত অবসন্ন মানুষের বারংবার আলোর সন্ধানে সূর্যকে অনুসরণ করা -- এই প্রেক্ষাপটে জিয়াকোমেত্তি কি শুধু মানুষ আঁকতে চাইলেন? আঁকতে চাইলেন কেবল একটি হেঁটে যাওয়া? ক্ষত থেকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে অনর্থক এক হেঁটে যাওয়াকে চিহ্নিত করতে চাইলেন? শূন্যতাকেই কি আঁকতে চাইলেন জিয়াকোমেত্তি! দৃশ্য উদ্ভুত কেবল শূন্য হওয়ার খেলা? যে শূন্যতা আলোক সরকার বললেন, নাকি সেই ভাঙাগড়ার জাগতিক পর্যটনটুকুকে দেখলেন ভাষাহারা-ভারে ন্যুব্জ মানুষটির ট্রাইঅ্যাঙ্গুলার প্রতিলিপিতে! তবে চলা একটা আছে এবং সে চলা কাঠকয়লা অস্থি থেকে এক অন্বেষণের দিকে চলা। যে চলা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে আলোক সরকারের আত্মবৃত্ত পদক্ষেপে, যে চলা আলো জ্বালিয়ে যায়নি, আলো নিভিয়েও যায়নি, সেই নীরব চলাই হয়তো আছে নির্মাণের ভাষ্যে। আসলে সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটিতে দুটি অসম দিকের এক অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ রয়ে গেছে; একদিকে মানুষটির ক্ষুদ্র পরিসর, তার সারা গায়ে লেগে থাকা বস্তুজগতের আঁধার, প্রতিটি ছায়াতে লিখে রাখা নো একজিট এবং বেঁচে থাকার প্রক্ষোভ, পিগমেন্টেশন ব্যক্ত করছে আবার সাথে সাথে তার চারপাশে শিল্পীর হাতে গড়ে দেওয়া দিগন্তব্যাপী পরিসর আদতে অনবহিত হারাবার কথাই বলছে, যেন কপাট খুলে পেরোতে হবে চেনা চিরদিনের, আবার যেন এই আত্মঅস্তিত্ব থেকে কোনোদিনই বেরোতে পারবে না লম্বা ঢ্যাঙা মানুষটা। পাথরকে আঁকড়ে মূর্তিকে আঁকড়ে মূঢ় জীব থেকে মূর্চ্ছনার মনোরমা দান করেছেন জিয়াকোমেত্তি। এ ছবিতে নিরাময় নেই, আবার বধির নিষ্ক্রমণও নেই। তবে কি পরিসরের প্রশ্রয়ে সে কেবল একটি মানুষের কথাই বলছে? নাকি একটি মানুষ এবং তাকে অনুসরণ করে চলেছে আদতে সামগ্রিক প্রজাতি! ওই যে মানুষটা হেঁটে চলেছে, তার ভেতর কিন্তু কেবল শূন্যতার ম্যানুস্ক্রিপ্ট নেই বরং দৃশ্যমান জগতের মাটিতেই গড়া হয়ে গেছে বিমূর্তায়নের ভিত; ইলাস্ট্রেশনে জানা হয়ে গেছে জন্মান্তরীন চক্রবাল মন্ত্রটি, পাথরের মাঝে শূন্যতার যে স্কুল খুলেছেন জিয়াকোমেত্তি সেখানে যেন চলছে কোনো এক উদ্বাস্তু বোধের আবিষ্কার। কবিভাষার লিপি আবিষ্কার। শূন্যতা মুছে মুছে অতিজীবিত প্রভাগুলি ঠিক এখানেই বেরিয়ে আসছে শব্দোত্তর সাধনায়। জিয়াকোমেত্তির মূর্তিও কি বলছে না – “চলেছি যে / এটাই কোনোদিনও টের পাইনি”…! আসলে এলাকাগুলো স্পষ্টতর হচ্ছে না কিছুতেই, গন্তব্যের আদি নেই অন্ত নেই তীর্থযাত্রীর মতো চমৎকারটি চিনতে চিনতে যাওয়া শুধু, অথচ নিশ্চিত ও অনিবার্য বলতে কোনো ভাষা তৈরিই হলো না; ভাষা থেকে পাথর থেকে তৈরি হলো নির্মাণের ফাঁক, তৈরি হলো ছোট্ট একটা অন্তরিন্দ্রিয়ের জগৎ। সংলাপের কবি তার সামনে ঘুমের মতো একা, পাথরের শিল্পী তার সামনে পরম শূন্য। এই দর্শনই হয়ে উঠছে দ্রষ্টার দ্বন্দতত্ত্ব। চিত্রকলা সেখানে কেবল চোখের নয়, রঙের খেয়ালে সেও স্বরান্তরের, দৃশ্যকে বোধে তুলে আনার যে ললিতকলা, তাই কি শিল্পের ছাঁচ তুলে নিল না? এই ব্যবধান অনেক যোজন অথচ এই ব্যবধানেই শিল্পীর নিকট সান্নিধ্য। বাক সেখানে নির্বাক প্রেমিককে বসিয়ে রেখেছে চিরসখা করে, পাথর ধরেছে পথের পিটুইটারি।

আসলে একটি ছবি এবং ছবি বলতে যা বোঝায় তা সারাক্ষণ পা বাড়িয়ে আছে সৃষ্টিশীল কেন্দ্রহীনতার দিকে; পথ তো ছিলই কেবল শিল্পী বা কবির কাছে রয়ে গেছে পরমানন্দ হওয়ার মন্ত্রটুকু; ভাষার বিমূর্তকরনের মধ্য দিয়েই যেভাবে একজন কবির বা লেখকের লেখনীর ভরা সংসারের মাপজোক নিয়ে পালাতে পারে যে কোনো রং, সেভাবেই মূর্তির মাঝে একজন ভাস্কর খুঁজে ফেরেন সেই মৌলিক দূরত্ব যা পাথরকেও দেবে যাপনের অলৌকিক এক ভাষা, যেখানে লেগে রয়েছে প্রতিটা ব্যর্থতা প্রতিটা ক্লান্তি প্রতিটা অস্পষ্ট আত্মচিন্তা। আসলে শব্দও তো শূন্য, আর্বিট্রারি, একাকী সঞ্চারমান। অভিজ্ঞতা থেকে স্মৃতি থেকে আশ্রয় নেয় নির্মাণে -- সম্ভাবনায়, আশ্রয় নিতে হয় রেখার বিভ্রান্তিতে, সচেতনভাবে গ্রহণ করতে হয় ছবির আলোকতরঙ্গক। সব পথই পথিকের হয়ে উঠতে পারে কেবল তার প্রাণবায়ুকে পঞ্চানন করে। যিনি লেখেন তিনি যেমন তাঁর বিশাল খড়িতে কোথাও এঁকে রাখেন এক স্বয়ম্ভু ও স্বেচ্ছাচারী ক্যানভাস, তেমনি যিনি আঁকেন, মূর্তি গড়েন তিনিও কোথাও শব্দের দেবদারু কলোনিতে এসে খুঁজে বেড়ান নির্সগবেদ্য যাপনটুকু।

৩১ জুলাই ১৯৩৯এ রানী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন -- “দেখ তো অন্ধের মতো বসে বসে এই ছবিখানি করলুম। শুধু লাইনেই রেখে দিলুম। এইতেই যখন ছবি একটা কথা বলছে তখন আর তাতে কিছু করা উচিত নয়; …আমার সব ছবি এইরকম। হাসিখুশি ভাব হয় না কেন, বলতে পারিস? অথচ আমি নিজে হাসতে ও হাসাতে ভালোবাসি, কিন্তু আমার সব ছবিরই ভাব কেমন যেন বিষাদমাখা। হয়তো ভিতরে আছে ওটা”। আসলে, একদিন ছবি হয়ে উঠবে এই আশা নিয়ে বাঁচে কবিতা, একদিন কবিতা হয়ে উঠবে এই সখ্যতা নিয়ে সংগীতময় হয়ে ওঠে পাথরের ঘাম। সবই রয়েছে এখানে অথচ প্রতিটি ক্ষণের সেই চিরন্তন দূরত্বকে খুঁজে চলেছে শিল্পী তারই স্ববিরোধিতায়; আর চিত্রকর? ভাস্কর? তার অবলোকনে তবে কি! --“ছবির জগতে সেথা কোনো ভাষা নেই / সেথায় তোমার স্থির দৃষ্টি / যে কাহিনী করিতেছে সৃষ্টি / ঘটনাবিহীন তার বোবা ইতিহাস”…!

০৩) বারীন ঘোষাল

অংকবিদের কথা



তোমাকেই বলা ... ... ...

অংক(গণিত)বিদের নাকি অং(অহংমার)কবিদের কথা বলতে নিয়েছি, আজ সেটা খানিক পরেই বোঝা যাবে। আপাতত বলি, সামান্য বিজ্ঞানিকা বা, বিজ্ঞান চেতনা প্রয়োজন আছে কবির, সেই কবির, যার খোঁজ আছে। যে চিরায়তের বাইরে, আবহমান পেরিয়ে খোঁজ করে মানুষের অস্তির সঙ্গে পৃথিবী আর জীবনের সম্পর্ক। বুদ্ধিমান সে। দেখাটাকে বুঝেও নেয়। তাহলে কি আমি সাধারণভাবে কবিদের ভাবনা-পন্থার বিরোধিতা করছি? করিই না হয় একটু ভিলেইনি।

There is nothing called truth, leave alone absolute truth. There is nothing called Absolute. কিন্তু শব্দগুলো এবং তত্ত্ব আর বিশ্বাস বাস করে মানুষের কল্পনায়, ধারণায়। তুমি আবার আমার কথার বিরোধিতা করার জন্য উন্মুখ, আমার কথা মানবে না। কারণ you are a believer having a closed mind. তোমার বিশ্বাস গণিত নিখুঁত ও কঠোর। কিন্তু আমি বলি it is always flexible. তাই তো কালে কালে বৈজ্ঞানিক থিয়োরিগুলো পরিবর্তিত হতে থাকে। এই change effective করে গণিত। আইনস্টাইনের গণিত প্ল্যাঙ্ক এসে বাতিল করে। নিউটন শেষে বাতিল হয়। স্টিফেন হকিং পেনরোজকে বলেন – আমি ভুল, তুমি ঠিক। Bang theory concede করে shadow of mind-এ। গণিত ফ্লেক্সিবল বলেই গাণিতিক দর্শন কালে কালে পালটায়। Statistical mode পালটায়। তুমি কি মনে কর – ISI প্রতিবছর একই গণিত পড়িয়ে যাচ্ছে? No, never. তোমার সুতোর বয়ন, বয়ান, তানাবানা, মাকুপাঠ, রং-গোত্র হামেশা পালটে গেছে গণিত দিয়েই। আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে পড়তো, সে maths নিয়ে MA করার সময় তার হস্টেলে গিয়ে দেখতাম, একটা ঢোল কিনেছে, বসে বাজাচ্ছে। সে কোনো বোল তুলছে। আমি গেলেই বলতো – এটা কোন্‌ ইকুয়েশন বলতো, কোন্‌ থিয়োরেম এটা? পারলে কবিরাজি। আমরা অবাক হয়ে সেই ঝালাপালা শুনতাম, কিন্তু বলতে না পেরে কবিরাজি মিস করতাম প্রতিবার। আর তুমি কবি, গণিতকে কঠোর বলছো! জানো না যে রাসেল, ফ্রয়েড তামাদি হয়ে গেছে?



চেতনা থেকে কবিতার জন্ম হয়। কবিতায় চেতনা থাকে না। যা তুমি কবিতা বলে লেখো, তা আসলে কবিতা নয়। কবিতার অনুরূপ অনুভবের প্রকাশ তা, তাই একই কবিতা যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয় নানা-কবির হাত দিয়ে। তাকে বলে কবিতালিপি। তা কবিতা নয়। কবিতা কোনো unit নয় যে এক জায়গা থেকে অন্যত্র transfer করা যাবে। প্রকাশ করার পরেও তা কবির মাথায় কখনো জাগ্রত কখনো সুপ্ত থেকে যায়। প্লেটোর সময় কেউ কবিতা লিখতো না, লিখতো verse, যা ছিল তখনকার একমাত্র প্রকাশ পন্থা, যা দিয়ে ইতিহাস ধর্ম দর্শন কাহিনী রাজনীতি সবই লেখা হতো। প্লেটো তাকেই আক্রমণ করেছিলেন, কবিতাকে নয়, কারণ কবিতা কী তিনি জানতেন না। ভারতীয় দর্শনেও সেই অবস্থা। নিজেরা verse-এ লিখে তাকেই condemn করেছেন। বাংলা ‘কবিতা’ শব্দটা সঠিক অর্থে, বর্তমানে প্রচলিত অর্থে প্রথম অনুভূত হয় বিংশ শতাব্দীতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে আমরা গদ্য লেখা শিখেছিলাম, thanks to the British. তারপরেই এলো ছাপাখানা। স্মৃতির পাট চুকলো। গদ্যসম্ভব সব কিছু verse থেকে সরে গেল। সেই থেকে পদ্য ধীরে ধীরে বদলে গেল কবিতায়। বিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথের হাতে প্রাথমিক কবিতা তৈরি হতে থাকে। বাংলার আর ইংল্যান্ডের মাটি আলাদা, রাসেল আর রবীন্দ্রনাথ আলাদা, এটা মেনে নেওয়া ভালো।

তোমার নিজের অটল বিশ্বাসের কথা কি মনে আছে এখনো? থাকলে এইবেলা ভাবো, তুমি ভেবেছিলে গণিতকে কঠোর হতে হবে। না হলে তা formless হয়ে পড়বে। এতে আমি এই বুঝলাম যে, আমি মরে, পুড়ে গেলাম, ছবিতে স্মৃতিতে থেকে গেলাম, তাই আমি formless হয়ে গেলাম। তখন আমার chaos in energy reserve নিয়ে কেউ ভাববে না। এছাড়া, ধরো বরফ বা লোহা গলে গেল, তাতে তো formless হলো না, form change হলো মাত্র। formless বলা যাবে কি film projection-কে, বা witchcraft-এ receptor-কে? না। এমনকি কাল্পনিক ঈশ্বরের মূর্তিরও form হয়। মানুষ কল্পনাতেও চেহারা দ্যাখে। নিরাকার কিছু ভাবতেই পারে না। তাই বেদবাদীরা উপনিষদবাদীদের দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিল ২০০ বছর আগেও। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রাহ্মরা জেগে উঠলেও অচিরে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনো সেই chaos-কে বিশাল space-এ রাখবে কি? ছোট স্পেস-এ কেঅস বোঝা যায়। বিশাল বিশ্ব-স্পেসে যে কেঅস চলছে, তা বুঝতে আমাদের লক্ষ বছর লাগল কেন? তাও মুষ্টিমেয় কিছু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছাড়া কেউ ভাবে না, বোঝে না তা। তাই বলে তা কি নেই? তোমাকে বলি, in space, even inside of an atomic nucleus 95% space is occupied by quarks, অন্ধকার। তুমি কি টের পাও, ধরো তর্কের খাতিরেও? দেখতে পাও অন্ধকারের আলো? ঐখানে কবিতার মাঠ।


বিজ্ঞানকে সীমাবদ্ধ, কবিতার বাইরে রাখার কথাটা ভ্রান্ত। বিজ্ঞান কোনো জিনিস না, কোনো তর্ক না। বিজ্ঞান একটা tool. সেই টুল ব্যবহারের পন্থা জানেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞান কোনো theory or achievement না। এই টুল দিয়ে আমরা খুঁজি। যে এই টুলটা জানে না বোঝে না, তার কোনো খোঁজ নেই। তার আছে বদ্ধ ধারণা বা বিশ্বাস। সীমাবদ্ধ হয় তা। সে লেখে অমোঘ শব্দ দিয়ে কংক্রিট কবিতা, যার ব্যাখ্যা করা শিখেছি আমরা ছোটবেলায়। ষাটের দশকে এ নিয়ে একটা আন্দোলনই হয়েছিল কংক্রিট কবিতা লেখার। আমাদের সম্পর্কগুলো নিয়ত পরিবর্তনশীল পুঁজিবাদের, ব্যবসার, বিশ্বায়নের চাপে, তা ঠিক। এতে কোনো যুদ্ধ নেই। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আছে প্রতিরোধের আর বুলডোজের। তার কার্যবিবরণী দিয়ে গণিতের metric কবিতা লেখা হতে পারে, আমেরিকায় language poetry-তে যা হয়েছে। এদেশে, বাংলায় কেউ কেউ লিখেছেন for a change. আমাদের কাব্যের অর্থ জগত পরম্পরাকে ব্যাখ্যা করা নয়। এই আমরা ‘আমি’ দিয়ে শুরু। সেটা দার্শনিকের কাজ। কবি সেই যুক্তি পেরিয়ে সম্পর্কগুলি আর তার সম্ভাবনাকে দ্যাখে। যা unique but not absolute. এবং সতত পরিবর্তনশীল। সামগ্রিক text বলে কিছু নেই। আসলে text কতগুলো ছাপা শব্দ-সমষ্টি। তাতে কবিতার সামগ্রিকতা বোঝায় না। আর, ঐ যে তুমি ভাবলে – সৃষ্টিকর্তার তেমন ইচ্ছা হয়তো ছিল না – এতে তুমি প্রমাণ করলে যে, you are a believer. এবং সমস্ত আবহমান-বিরোধী কথা blasphemous. অথচ জানলেই না যে, তুমি এই duality বা দ্বান্দ্বিকতা বহন করে কবিতা লিখে চলেছো।

জয় হো আজ শিকল-মুক্ত কবিতার। পরে কহ আর।

০৪) স্বপন রায়

রেলা-৪


এ এক ভোরের অযত্নে রাখা প্রাপ্তবয়স্ক শীতের চাউনি, ঠোঁটে ফুটি ফুটি ভাঙা শব্দের জিজ্ঞাসা, ‘উঠতে হবে, না?’ আমি যা করে থাকি, তাই করছিলাম, দন্তচর্যা শেষ করে কুয়াশা খোঁজা... পেয়েও গেলাম জানালার বাইরে, থাক থাক! বললাম, কুয়াশা শিউরে দিচ্ছে...

-ওমা তাই? বলেই এক চিরকালীন স্কার্ফে যেন লীনাই এলো, কুয়াশায়... এসে দাঁড়ালো আমার পাশে! আমরা আমাদের শরীরের এগিয়ে থাকা চেতনার প্রতীক নাকের ডগায় জানালার কাচ লাগিয়ে স্বোপার্জিত কুয়াশ্বাসের ধোঁয়ায় আবছা করে দিই কাচের প্রতিরোধ, ভালোবাসা স্তিম স্তিম শব্দ করে।

-স্তিম মানে কি? এতো আলগোছে বললো যে, আমি উত্তর দিলাম না! স্তিম মানে যে সেক্স নয়, এটা ও নিশ্চয়ই বুঝবে!

কাল যখন নিউজলপাইগুড়ি থেকে টয়ট্রেন ঝটকা দিয়ে ছাড়লো, আমি ওর কানের সংরক্ষণে মুখ রেখে বলেছিলাম, ‘ট্রেনটার সেক্সড্রাইভ দারুণ!’

এ ক্ষেত্রে মেয়েরা দুটো কথা বলে, ‘যা!’ আর ‘অসভ্য’। ও কিছু বললো না, মুচকি হাসি এনে ভরিয়ে দিলো সেই ভোরমোছানো সকালের রাঙা ইনকামিং, একটু স্লো কিন্তু বিস্তারময়! ট্রেন টয়িশলি যাচ্ছে শিলিগুড়ি টাউন আর জংশন পেরিয়ে সুকনার দিকে।

আমার এই দুনিয়াবুকিং, এই পাখিবার, এমন আকাশ ভর্তি হাল্কানীল রেনকোটের ভাব সম্প্রসারণ আর এই পুরো রচনার কারণ যে, সে তার মুখ জানালার কাচে রেখে অবাক হয়ে দেখছে এই পৃথিবীর জড় শব্দের সচল হয়ে ওঠা, দেখছে বাঁক এসে মানুষের হাসিতে কিছু রহস্য রেখে যাচ্ছে, আর সুকনার জঙ্গলে ঢুকতেই ঠাণ্ডা পাতায় মোড়া হাওয়া এসে যখন আমাদের কিছুটা নিষ্কলুষ করে দিলো, সে আমার দিকে তার বিস্ময় ছুঁড়ে দিয়ে বললো, ‘জঙ্গল!’ আরো কিছুক্ষণ পরে আরো একটু জোরে বললো, ‘পাহাড়!’ ট্রেন এখনো মানোবীণা, তখন তো গীটারও! মার্চের প্রথম সপ্তাহ এক নেপালি ছেলের গীটারে আসন্ন হয়ে উঠছিলো। খেলনা ট্রেনের পাশে ফুটে উঠছে কারো বারান্দা, কারো পশরা সাজানো দোকানের গায়ে টুকিটাকি, উড়ছে ট্রেনের হাওয়ায় চূর্ণকুন্তলে ঝরে পড়া স্প্রিং-ফেস্ট। আমি গীটারের টুং টাং জড়িয়ে নিয়ে ভাবছি, এই পৃথিবীতে একটিই মেয়ে আছে যার গালের ডানদিকে যেমন বাঁ দিকেও একটিই রং, চাঁপা!


আজ দার্জিলিঙের সকাল এসেছে কুয়াশাকাতার নিয়ে! আমি আমার পাশের দাহ্যতায় ছোট্ট ডুব দিয়ে বলি বলি করেও বলি না, প্লিজ হোল্ড ইয়োর টাংগ এন্ড লেট মি লাভ... সে ঠোঁটের ইমন মুছে দেয় হাসির কল্যাণ দিয়ে, বলে, কেভেন্টারস মনে আছে তো, ব্রেকফাস্ট তো ওখানেই? বাইরে ম্যালের একটা কোণায় রোদ এসে বেড়ালের পা পা করে এগোনো হয়ে গেলো, এই রোদ আর ওর কথার মাঝখানে কি কোনো অলস সম্পর্ক রয়েছে? কথা বলার শেষেই রোদের পা পড়লো যেভাবে, এই যাওয়া-আসা শিথিল কিন্তু অবশ্যসম্ভাবি হয়ে উঠছে যে ভাবে, সম্পর্ক ছাড়া হয়?

Gillanders Arbuthnot & co ১৮৮১ সালের এক সকালে ৩২৮ ফুটের শিলিগুড়িতে এই রেল লাইনের জন্য কোদাল বেলচার যৌথ অভিযান শুরু করে। ৭২১৮ ফুট অব্দি যেতে সেই তখনকার সময়ে যে এঞ্জিনিয়ারিং কর্মকুশলতার প্রয়োজন হয়েছিলো, এখন ভাবলে অবিশ্বাস্য মনে হয়! দুটো লুপ আর ছটা রিভার্সে মোড়া প্রায় ৮০ কিলোমিটারের এই রেল লাইনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পরিশ্রম, মেধা, ব্রিটিশ দুঃসাহস আর রোমান্স! ধীরে ধীরে উঠে যাওয়া বাঁক অবাঁক মুহূর্তগুলো চোখের ভেতরে ট্রান্সহিমালয়ান শীতলতার সঙ্গে মিশে যেতে থাকে, মনে হয় নিশ্বাস এক স্তব্ধ চুক্তি, যা আমার বিরাজমানায় অবিরাম, আর ওই নির্ভেজাল খুশিতে মোড়া আমার সহর্ষ প্রয়োগটি, টয়ট্রেন বিভাজ্য করেই যাচ্ছে তাকে, তার একেকটা বিস্ময় আরো উজাড় করে দিচ্ছে পাহাড়ের ‘বাঃ’গুলো!

ট্রেন, বিশেষত টয়ট্রেনের ওই দীর্ঘ যাত্রায় আমি গতকাল এক অমনোযোগী বিন্দি থেকে লুপ আর রিভার্সের এতোল বেতোল পেরিয়ে আনমনে রাখা তার হাসির শহরেই যেন অপেক্ষা করছিলাম! বিকেল এসে রাস্তার ওপরে টানা ফেলছিলো অপসরণের আলো, তার পা পড়লে যদি এক আসক্তি তৈরি হয়, যদি আলোর এই ফিকে সংসারে থেকে যায় মহক আর মেহনের সঙ্কর অভিধানটি! আর আজ ম্যাল থেকে দারজিলিং বাজারের দিকে নামার সময় ওকে আলতো করে বললাম, ‘টুং, সোনাদা, রাংবুল, জোড়পাহাড়ি, ঘুম এই ষ্টেশনগুলো অদ্ভুত না?’ ও তাকায়। পাইন সুশ্রী হয়। পাহাড় নিস্বঃ হতে থাকে। বলে, ‘কেন?’

-সব এখানেই আছে!

-মানে?

-বুঝতে পারছো না, আমার পাশে, ডানদিকে... ব’লে হাসতে থাকি। ও বুঝে যায়।

আমি গলা নামিয়ে বলি, জোড়পাহাড়ি হলো...

-মারবো!

-আর টুং, সোনাদা... ধরো জোড়পাহাড়ি থেকে টুং-এ নামলাম, ছোট্ট টুং-এ নিকোন আহ্বান, যেন বলছে, হাঁ ভি না ভি... একটু বসবো নাকি নেমে যাবো নিচের ওই সংরক্ষিত বনতান্ত্রিক বাহারশালায়... সোনাদায়... আর তুমি তো জানোই সোনাদায় আমি নামলেই মেঘের কেশরে বৃষ্টি নামে... আরোহণ নামে অবরোহণে...

-আচ্ছা পাজি তো তুমি... তোমায় হচ্ছে দাঁড়াও... যখন সে বলছিলো পুরো দারজিলিং-এর কোথাও কোনো অবিশ্বাস ছিলো না, বিকেলে লুকিয়ে ছিলো মীনে করা সহিম অস্তরা... নব্বই-এর দশটা বছর সবে তখন পাতা ওল্টাতে শুরু করেছে, বাজারের ব্যস্ত জ্যামিতিতে ঢুকে পড়ছে কুমার শানুর নাকি কিশোরসুলভ স্বরামিঃ ‘বাজিগর ম্যায় বাজিগর...’

-তোমায় ডাকছে মনে হয়!

আমি ওর কথানুযায়ি তাকাতেই দেখি পিটার, পিটার ইডেন!

-হাই, হাউ আর ইউ?

-এম ফাইন, এন্ড ইউ? হোয়ার ইস আনা?

-স্লিপিং

-এট দিস হাওয়ার?

-সর্ট অফ স্টমাক ডিসঅর্ডার... পিটার হাসে... আমি আর আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গীও হেসে ফেলে... হাসির কারণ গতকাল পুরো ট্রেনযাত্রার সাত ঘন্টায় পিটার আর আনা গোটা পঞ্চাশেক চুমু আর দু তিনটে কোক ছাড়া কিছুই খায়নি, ডিসঅর্ডারটা স্টমাকে হওয়ার তো কথা নয়... মুখে বললাম, টেক কেয়ার অফ হার... এন্ড এনজয় ইয়োর প্রিডিসারস হেভেন!



পিটারের পূর্বপুরুষ লর্ড এশলে ইডেন এই হেরিটেজ রেললাইনটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পিটার এসেছে সেই উত্তরাধিকারে বিস্ময় নিয়ে, সঙ্গে চেক বান্ধবী আনা। গতকাল যখন ও এসব হাসতে হাসতে বলছিলো, আমি ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছিলাম আর সেই সময়েই সন্ধ্যার ঘুম স্টেশনে টয়ট্রেনের জানালায় আটকে গেল কবেকার পা-বিদ্ধ চাঁদ আর আমার অপাপবিদ্ধটি সেই চাঁদকে হারিয়ে হেসে উঠলো, চন্দ্রাহত আর কি!

ভোর আসে, একশো ফার্নের দ্বিজত্ব নিয়ে, সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার উদয়ঘটিত কফি! কফি-মেয়েরা তো টাইগার হিলের অনেক আগে থেকেই উঠে বসে জীপের পিছনে, তাদের কলকল ভেঙে দেয় ড্রাইভারদের সতর্ক মনোনিবেশ। এ যেন এক বিশাল পরিবার, দিদি আর দাজুতে ভরা। এ সব আমায় মনস্ক করে তোলে, আমি ওকে দেখি, দেখি আমার ছোট্ট বাগানটিকে... ইস্পাতনগরীতে তখন অন্য সব জায়গার মতোই কম্পিউটার আসতে অনেক দেরি। মানুষের সঙ্গী ছিল সিনেমহল, নাটক আর আড্ডা...। আমার কবিতা লেখার ফাঁকে এ সব তো ছিলই আর ছিল এক অসহায় পরিক্রমা সাইকেলের। আমি কী ভাবে বলবো? ও কি রেগে যাবে? ভয় পাবে? আর আড্ডার মেজাজেও ওর শ্রীময়ী চোখের টানা বারান্দায় আমি ঘোরাফেরা করতে থাকি, চিঠি মেশানো বাদাম গাছে হেলান দিয়ে ভাবি, বনের রঙ তাকে বনের ভাবনা দিয়েছে, সে ফুল তোলে আর আমি দেখি স্কার্ট হয় পোশাকের নাম, মাদ্রাস-কেবিনের ধোসায় ঢুকে পড়ে রেশম-নিচু বারিষ আর নদী ভরা, জ্বরের দু’দিন ভরা দোপাট্টার রং... আমি ওকে বলেই ফেলি এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে... পৃথিবী তারপরেই অমনোযোগী ছাত্র হয়ে ওঠে... দোদুল্যমান আমার ভেতরে রয়ে যায় এক উত্তরের প্রতীক্ষা... কী বলবে ও? না করে দেবে? অপেক্ষা এত ভারী, জানতাম না! আর আজ জীপ বাঁক নিতেই ও ঢলে পড়ে আমার কাঁধে, এই তো পৃথিবী...

তবু গতকাল ঘুম স্টেশনে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল জাগতিক সবকিছু। আমি অসহায় হয়ে ঘন হিমের ওপারে খুঁজে যাচ্ছিলাম ওকে... ট্রেনের জানালায় চাঁদ দেখে নেমে যাওয়ার আগে বলে গেল, একটু বাইরে গিয়ে দেখি, অত ভাবার কিছু নেই, আমি হারিয়ে যাবো না... আমি ওকে দেখি আমার রচনা নিয়ে ও নেমে যাচ্ছে... পিটার আর আনা আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয় এরপর... ঘুম স্টেশনে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় টয়ট্রেন... আমরা গল্প করতে থাকি লন্ডনের রাজনীতি, সমাজ আর কেচ্ছাটেচ্ছা নিয়ে... পিটার হঠাৎ বলে, হে বাডি ট্রেন ওন্ট স্টপ হিয়ার ফর আওয়ারস... গো অ্যান্ড কল হার ব্যাক...

আমি স্টেশনে নেমে ঘুমের থিকথিকে কুয়াশায় হারিয়ে যাই... কোথায় কে... এ তো কমপ্লিট হোয়াইট আউট... কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না... ঘোষণা শুনতে পাই ট্রেন ছাড়ার... ওই ঠাণ্ডাতেও আমার রগের কাছে ঘাম জমতে থাকে... কোনো রকমে গার্ডের কামরায় পৌঁছে আমার সমস্যরা কথা বলি... উনি আমায় আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ডোন্ট ওরি... আমি দেখছি... পরে ওয়াকি টকিতে কিছু বলেন... ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে ওঁর অনুরোধে, আর ঘোষণা হতে থাকে এড্রেস সিস্টেমে, ‘দিস এনাউন্সমেন্ট ইজ ফর...’

আমি প্রায় টলতে টলতে কামরার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকি, কুয়াশাপাথার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা শরীরগুলোয় কি ফুটে উঠছে এক স্বভাবনতা নাতিদীর্ঘ দীঘল চোখের বাঙালি মেয়ের পরিচিতি? তার হাত ধরে আছে আমার সাড়ে তিন বছরের সন্তানকে... যে এতক্ষণের ট্রেন জার্নিতে একবারের জন্যও ক্লান্ত হয়নি, প্রায় সব বাঁক, সব কটি মানুষের অপসৃয়মানতায় হেসে উঠেছে, কথা বলে গেছে অনবরত, পাহাড়ের গায়ে আটকানো পাইনের সার সার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে প্রশ্ন করেছে, ‘বাবা এরা কি সব সোলজার, পাহার দিচ্ছে আমাদের?...’ আমি আমার সব কান্না বুকে লুকিয়ে রেখে এক আবৃত ফ্যাকাসে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকি...


-বাবা!

আমি চমকে তাকাই, পিছনে! ছেলে হাসছে, মা কাঁচুমাচু, সঙ্গে একজন রেলওয়ে-কর্মচারী, সে হেসে বললো, ‘দাদা ইয়ে লিজিয়ে আপকা আমানত!’

আমি কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম, প্রায় কাঁপতে কাঁপতে তাঁর হাত জড়িয়ে ধরে যা বলার বললাম!

তখন এ ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। ভদ্রলোক হাসছিলেন, হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আপকা বেটা ফগ মে খো গয়া থা,চলতে চলতে স্টেশন কা উস তরফ চলা গয়া... বচ্চা হ্যায়... ম্যাডাম ভি রো রহি থি... তো এনাউন্সমেন্ট সে হমলোগ বচ্চা কো দেখ পায়া... ঠিক হ্যায় সাব... ইয়ে দারজিলিং হ্যায়... ইহাঁ হর খোয়া হুয়া চিজ ওয়াপস মিল যাতা হ্যায়...

এতটা বলে সেই দেবদূত আবার মিলিয়ে গেল অসরল কুয়াশায়। পিটারের কোলে চেপে বসা ছেলে তখন তাকে টাটা করছে, করেই যাচ্ছে...

ট্রেন আবার আমায় জীবনদেখায় নিয়ে আসে, যাওয়া আর আসার মধ্যে আমাদের এই দোদুল্যমান ভয়টুকু বাতাসিয়া লুপে তখন হু হু... দূরের আলোয় মাখা দার্জিলিঙের দিকে তাকিয়ে আমি সেই মেয়েটিকে বলি, বাইরে দেখো খোয়া খোয়া চাঁদ... সে আলগোছে তাকায়... হাসি ফিরে আসে তার মাধবীমূলক মুখটিতে... পৃথিবী আর কবে এলাচ রঙের হবে, আজ ছাড়া?

আর আজ কুয়াশা কেবিনে দাঁড়িয়ে রয়েছি! সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা, ভোরাজের কাঞ্চন! সূর্য আড়মোরা ভেঙে উঠছে, প্রতিফলনের সিরসিরে রঙ রাঙা হওয়ার দিকে! আমি আমার কাঞ্চনসমাকে দেখি, দেখি আমার কাঞ্ছাটিকেও, সূর্য তার কাছে এক আজব পারফরমার, যত উঠছে, ছড়াচ্ছে, রক্তিম করছে শাদা

তুষারের বিস্তীর্ণ ক্যানভাস, তার চেয়ে বেশি হাততালি ছুঁড়ে দিচ্ছে ওই গ্রেট পারফরমারের দিকে, আমি জানি ওই হাতের উল্লাসে লেগে আছে অনাগত পাখিদের সঞ্চার, তাদের এক তিল রচনাবলীও!

সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে আমি দুজনের পাশে এসে দাঁড়াই, সে তাকায়, ছেলে হাসে, আমার আবারও মনে হয়, এই অপার সংক্রান্তিতে দাঁড়িয়ে বার বার মনে হয় যে, হাজার বছরের জমে ওঠা ঘৃণা মুছে দিতে পারে এক মুহূর্তের মৌন ভালোবাসা...

০৫) অর্ক চট্টোপাধ্যায়


এক... একা... অনেক... অন্য... অনন্য : সচিন
রমেশ তেন্ডুলকার আর ক্রিকেটের স্বপ্নপূরণ



ব্যাট হাতে নামার সময় একা। আগের জন আউট হয়ে ফিরে আসছে। সেও একা। প্যাভেলিয়নে ফেরার সময় তার কাঁধের পাশে কাঁধ রেখে মাঠে ঢুকছে নতুন ব্যাটসম্যান, আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, হয়তো সে সেঞ্চুরি করেছে, কিম্বা শূন্য, হয়তো কোনোটাই নয়, মাঝারি! নতুন ব্যাটসম্যান তাকে বাহবা দিচ্ছে অথবা সান্ত্বনা। একজন ব্যাটসম্যান আউট হয়ে ফেরার সময় তার মুখের এক্সপ্রেশন থেকে তার অবস্থা, দলের অবস্থা এবং ম্যাচের অবস্থারও একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। তীরে এসে তরী ডোবার হতাশা থেকে জয়ের হাতছানি কত কিছু বলে যাচ্ছে ঘাম, ধুলো, ভুরু, চোখ, নাক, মুখ জোড়া মাংসের অক্ষরবিন্যাস। মাঠে নামা আর মাঠ থেকে বেরোনোর সময় দুজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে ওই ক্ষণিক সমাপতনের মুহূর্ত, তখন ক্রিকেট একাও নয়, আবার অনেকও নয়, সে তখন দোকা, যেমন দোকা দুজন ফিল্ডারের কলিশনে কিম্বা বোলার আর উইকেটকিপারের পারস্পরিক অভিনন্দনে, কিম্বা ক্যাপ্টেন আর বোলারের পরামর্শে ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্রিকেটের 'একা', 'দোকা' এবং 'অনেক' নামক এই তিনটি মুহূর্ত, বোলিং ব্যাটিং আর ফিল্ডিং-এর আশেপাশে আর ভেতরে বাইরে। নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে পার্টনার থাকলেও তুমি যখন ব্যাট করছো, তুমি এক্কেবারে একা। যে বল করছে বা ফিল্ডিং করছে, তার মতোই। কিন্তু এই একারাই খেলার আঁকে বাঁকে দোকা তেকা এবং অনেকের মুহূর্ত তৈরি করছে যদিও খেলাটির তিনটি বেসিক টাস্ক: ব্যাটিং বোলিং এবং ফিল্ডিং আসলে কিন্তু সকলে প্রত্যেকে একা। ব্যাট হাতে নামার সময় একা। ব্যাট হাতে ফেরার সময় একা। ব্যাটসম্যানের হাতে বেধড়ক মার খাবার সময় একা। নিপুণ ইয়র্কারে তার মিডল স্ট্যাম্প ছিটকে দেবার সময় একা। ক্যাচ ধরা বা ফ্যালা বা ড্রাইভ দিয়ে বাউন্ডারি বাঁচাবার সময়ও একা। আর এই একা একা মুহূর্তগুলোই টিভিতে বা ইন্টারনেটে কত কত মানুষকে অনেকের সাথে জুড়ে দিচ্ছে। মাঠ জুড়ে দর্শকদের সমস্বরও তেমনি অনেকের এক হয়ে ওঠার মুহূর্ত। একদিকে এক দুই হয়ে অনেক আর অন্যদিকে অনেকের এক হয়ে ওঠা। কিন্তু অনেকের মধ্যে দিয়ে হয়ে ওঠা ওই একও কি একা? ব্যাটসম্যান আউট হতেই থিতিয়ে পড়া হইচইয়ের ভেতর তার মাথা খানিক নিচু করে হেলমেট খুলে হেলমেটের ভেতর গ্লাভসগুলো ফেলতে ফেলতে হেঁটে যাবার সময় দর্শকের ওই এককত্ব কি আবার একাকিত্বের দিকে ঘুরে যায়? কিন্তু নতুন ব্যাটসম্যান মানেই নতুন আশা, আবার নতুন করে এক হয়ে ওঠার শুরু। ক্রিকেট এভাবেই ভাঙতে থাকে গড়তে থাকে এক, দুই একা আর অনেকের মুহূর্তগুলোকে, সেলাই করতে থাকে সেলাই ছিঁড়ে যাওয়া অব্দি, তারপরে হয়তো আবার প্রথম থেকে ।


আজকাল আমাদের ম্যাচ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। মাঠে না গিয়ে টিভিতে দেখলে তো বটেই, মাঠে গিয়ে দেখলেও জায়েন্ট স্ক্রিন বিজ্ঞাপন ধরে আনে ব্যাটসম্যান আউট হতে না হতেই। টিভিতে আজকাল আর দেখাই যায় না একা-দোকার ওই মুহূর্তদের। ওভার শেষ হতে না হতেই বিজ্ঞাপন, ব্যাটসম্যান আউট হতে না হতেই বিজ্ঞাপন। ক্যাচ ধরতে না ধরতেই বিজ্ঞাপন। কেউ আউট হলে দলের অনেকের একসাথে উদযাপন, ওভার শেষে দুই ব্যাটসম্যানের পরামর্শ, ফিল্ডিং টিমের প্ল্যানিং কিম্বা বাউন্ডারির কাছাকাছি আউট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানের সাথে নতুন ব্যাটসম্যানের স্বল্প বিনিময়ের বাঙ্ময়তা -- এইসব মুহূর্তগুলো যেখানে ক্রিকেট একটা 'অনেক' হয়ে উঠতে থাকে সেগুলো আজকাল বিজ্ঞাপন এসে চুরি করে নিয়ে যায়। তাও থেকেই যায় কিছু কিছু ঝলক : দর্শকদের উল্লাস, বাউন্ডারির কাছে দুজন ফিল্ডারের চমৎকার রিলে ফিল্ডিং। বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যাবার আগে মুহূর্তের ওই ঝলকগুলোকে তো আর কেড়ে নিতে পারে না!

এই যে এইসব ছাইপাশ লিখে চলেছি আর আপনি বা আপনারাও পড়ে চলেছেন এও তো এক থেকে দুই আর দুই থেকে সম্ভাব্য অনেকের পাঠ-সম্ভাবনা! কিন্তু এইসব লেখার উদ্দেশ্য? পরিপ্রেক্ষিত?

আসলে এই লেখায় আমি যে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইছি, তারা সকলেই ছোটবেলায় যবে থেকে ক্রিকেট খেলা দেখতে শুরু করেছে, তবে থেকে সচিন রমেশ তেন্ডুলকারকেও দেখে চলেছে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে ২৪ বছর যাবৎ এক এবং অভিন্ন হয়ে ওঠা এই নামটা একজন ব্যক্তি-ক্রিকেটারের: একা একটা মানুষের একা নাম যাকে মেলে ধরলে তার ভেতর তার বাবার নামটাও মেলে। কিন্তু আমাদের ছোটবেলা থেকে গোটা নব্বই দশক জুড়ে এই একা লোকের দোকা নাম সচিন রমেশ জুটি শাসন করে এসেছে ভারতীয় ক্রিকেট নামক এই অনেকটিকে, টিমকে এবং দর্শকদের। ৯০এর দশক জুড়ে কত দর্শক মাঠ ছেড়েছেন সচিন আউট হতেই, আরো কতজন টিভি বন্ধ করে দিয়েছেন সেই মুহূর্তে! 'ওয়ান ম্যান টিম'এর এই অসম্মানজনক অভিধা বহন করেছে ভারতীয় দল, বহন করেছেন তেন্ডুলকারও। অনেক সময়ই একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে, তিনি কি নিজের জন্য খেলেন, না দলের জন্য? টাফ ম্যাচে আন্ডার প্রেশার কটা ম্যাচ জিতিয়েছেন? তিনি কি ওভার-রেটেড? আমিও কখনো কখনো এমন অভিযোগে গলা মিলিয়েছি। রাহুল দ্রাবিড় নামের অসামান্য এক ক্রিকেটার তাঁর গোটা কেরিয়ার জুড়ে আন্ডার-রেটেড থেকে গ্যাছেন বলে কখনো কখনো বোকার মতো রাগ করেছি সচিনের ওপর, কিন্তু সে রাগ ততটা সচিনের ওপর নয়, যতটা তাঁকে যা বানানো হয়েছে তার ওপর।

মনে আছে ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার ৩৬০ রানের পাহাড় তাড়া করতে নেমে সচিন যখন ফার্স্ট ওভারে ম্যাকগ্রার শিকার হয়েছেন, আমারও মনে হয়েছে, এই তো বিশ্বকাপের ফাইনালে বিশাল রান তাড়া করতে নেমে একা টিমকে জেতানোর সুযোগ হারালেন ভারতের সর্বকালের সেরা এবং হয়তো পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই খেলোয়াড়টি। মনে হয়েছে, যারা বলেন উনি কঠিন পরিস্থিতি থেকে একা ম্যাচ জেতাতে পারেন না, আবার তাদের উত্তর দেবার সুযোগ হাতছাড়া করলেন! স্বভাবসিদ্ধ ভারতীয় কায়দায় সচিন হয়ে উঠেছেন আমাদের 'ভগবান' আর তাঁর থেকে সম্ভব-অসম্ভব সব চেয়ে গিয়েছি আমরা, চাওয়ার শেষ হয়নি কখনো। আজ যখন এই লেখা লিখছি, তখন অবশেষে সেই চাওয়া শেষ হয়েছে সচিন রমেশ তেন্ডুলকারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের মধ্য দিয়ে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, 'all good things should come to an end', কিন্তু এখানেই তো সমস্যা, আমাদের প্রজন্মের কাছে তেন্ডুলকার এমন এক একা 'এক' যে টিম এবং দর্শকদের 'অনেক'টিকে ধারণ করেছিলেন ২৪ বছর ধরে, এতোটাই যে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যতদিন ক্রিকেট খেলা চলবে ততদিন সচিনও খেলে যাবেন যেন। অবাস্তব এই কষ্টকল্পনার অবসান যেন ঈশ্বরের মৃত্যুর মতোই, তাই সারা দেশ জুড়ে সাশ্রু নয়ন, হতাশা এবং অবসাদ। আর প্রবাসের পরবাসে সিডনিতে বসে ইউটিউবে তাঁর ফেয়ারওয়েল স্পিচ শুনে কিম্বা শেষ বার আউট হবার পর তিনি যখন প্যাভেলিয়নে ফিরছেন, সেই অমোঘ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার ২৮ বছরের জন্মদিনের প্রাক্কালে বড়ই বয়ঃবৃদ্ধ লাগছিলো নিজেকে। ভারতীয় ক্রিকেটের সাথে, আমাদের ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে গড়ে ওঠা ক্রিকেটিং মেমরির সাথে এই একা একটা নাম এতই ওতপ্রোত হয়ে উঠেছিল যে, একার এই নক্ষত্রপতন যেন অনেকের ছবিগুলোকে ম্লান করে অ-ক্রিকেটীয় হয়ে উঠছিল।

ইউটিউবে শেষবার যখন আউট হয়ে ফিরে যেতে দেখছিলাম তেন্ডুলকারকে, তখন মনে হচ্ছিল কতদিন পর ক্রিকেট খেলার একান্ত নিঃসঙ্গ এই মুহূর্তটা দেখছি। বিজ্ঞাপনের দাপটে তো আজকাল দেখাই হয় না এই মুহূর্তটা। শেষ টেস্ট ইনিংসে সচিন সেঞ্চুরি করতে পারলেন না বলে যারা দুঃখ পেলেন, স্যরি, আমি তাদের দলে নেই। সচিন তেন্ডুলকার 'ভগবান' নন, তিনি অসম্ভব প্রতিভাবান এবংপরিশ্রমী একজন মানুষ যিনি তাঁর জীবনের ৪০টা বছর ক্রিকেট অন্তপ্রাণ হয়ে কাটিয়েছেন। থাক না তাঁর ঐটুকু মনুষ্যত্ব, যেমন ছিলো ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের, যিনি ১০০ রানের অভ্যারেজে পৌঁছতে পারেননি শেষ ইনিংসে শূন্য রানে আউট হবার জন্য। ব্রায়ান চার্লস লারাকেও তো খেলতে হয়েছিল একটি তৃতীয় শ্রেণীর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান টিমে তাঁর কেরিয়ারের সিংহভাগ জুড়ে। ক্রিকেটের গ্রেটদের আশেপাশে এইসব আয়রনির হয়তো প্রয়োজন রয়েছে যাতে আমরা তাদের 'ভগবান' বানাতে না পারি! সচিনের একা আউট হয়ে ফেরার ওই মুহূর্ত কিম্বা ম্যাচ শেষে একার অনেককে করা ওই আবেগময় বিদায়ী সম্ভাষণ, সবই কিন্তু বড় মানবিক। যেন একটি মানুষ তাঁর নশ্বরতার দাবি রাখছেন চোখের জলে, যাকে আমরা এত বছর ধরে ভগবান বানিয়ে আসছি, প্রশ্ন করে আসছি কেন তিনি সব পারেন না? কেন পারলেন না শেষ ইনিংসে সেঞ্চুরি করতে? কেন পারেননি টেস্ট ট্রিপল সেঞ্চুরি করতে? কই শেহবাগ তো পেরেছেন? আরো কতজন! সমসময়ের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লারা তো টেস্টে ৪০০ রান করেছেন, তাহলে সচিন পারেননি কেন? আমি পরিসংখ্যানবিদ নই, ক্রিকেটগবেষকও নই, তাই সেই দিক থেকে আমি এই প্রশ্নগুলোকে দেখব না। আমার কাছে দেখার মতো ব্যাপার হলো, সচিনকে কেন্দ্র করে আমাদের এই অনন্ত দাবিদাওয়া যেখানে জনমননে তিনি ক্রিকেট নামক অনেকের খেলার সর্বেসর্বা 'এক' হয়ে উঠছেন আর সচিনের নিজের পারা-না-পারাগুলো যা বারবার তাকে মানুষ করে রাখছে, মানুষ, ভগবান নয়!

শেষ ইনিংসে আউট হয়ে যখন ফিরে যাচ্ছেন সচিন, আমার মনে পড়ছে পাকিস্তানের বিরূদ্ধে সেই ১৯৯৯এ সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। একা খেলে ম্যাচ জেতাচ্ছেন তিনি, উল্টোদিকে বিশেষ কোনো সাপোর্ট নেই, অনেকগুলো উইকেট পড়ে গেছে, উনি আউট হলেই ম্যাচ পাকিস্তানের, এমন অবস্থা। সচিনের পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, ব্যাট করতে পারছেন না আর! অল্প কিছু রান বাকি, ব্যথায় কাতর সচিন তাড়াতাড়ি মেরে খেলা শেষ করতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন সেদিন, যার পর বাকি উইকেটগুলো তাসের ঘরের মতো ছড়কুটে পড়ে এবং ভারত ম্যাচটা হেরে যায়। আমার আজও মনে আছে, পিঠের ব্যথায় কাতর সচিনের প্যাভেলিয়নে ফেরা, যেন ভগবান মানুষ হয়ে ফিরছেন ড্রেসিংরুমে। চোখে মুখে লেখা হচ্ছে নশ্বর শরীরের কষ্ট আর তার সাথে গিয়ে মিশেছে তীব্র মনোকষ্ট : ম্যাচটা জেতাতে পারলাম না। কান্নায় ভাঙতে থাকা ওই মুখমন্ডল আমার অবান্তর স্মৃতির মধ্যে ফিরে ফিরে আসে আজো! অসামান্য এক খেলোয়াড়ের ব্যতিক্রমী এক মনুষ্যত্ব একা ওই হেঁটে যাওয়ায়; যেখানে থেমে গেছে সচিন সচিন ওই কলরব, সেখানেই তিনি মানুষ হয়ে ঘরে ফিরছেন যেন, আমার ছোটবেলায় তখনও কিছুটা বিলম্বিত ছিল বিজ্ঞাপনের আক্রমণ, তাই স্মরণীয় ওই দৃশ্যটা মিস করিনি।

অবশেষে ঘটে গেছে অবিশ্বাস্য সেই ঘটনা! সচিন রমেশ তেন্ডুলকার এখন অতীত! গোটা দেশকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একত্রিত করার বিপ্লবী ক্ষমতা রাখতো যে এক-একা-অনেক লোকটা, সে আর কোনোদিন নামবে না ক্রিকেট মাঠে, হাতে তুলে নেবে না ক্রিকেট ব্যাট! সচিন নিজেও তার বিদায়ী সম্ভাষণে বলছিলেন এই অবিশ্বাস্যতার কথা। কিন্তু এখন যখন এই অবিশ্বাস্যতাকে বিশ্বাস করার সময় হয়েছে আমরা আরেকটু ফিরে দেখি এক একা এই লোকটার অনেকের কাছে যাবার পথের আরো কয়েকটা মাইলফলক।

১৯৯৮য়ের শারজায় ভারতকে যখন ফাইনালে উঠতে গেলে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৫০ ওভারের আগেই ম্যাচ জিততে হবে এবং আস্কিং রেট ক্রমশ অধরা হয়ে উঠছে; সচিনের সাথে ক্রিজে তখন অনভিজ্ঞ ভি ভি এস লক্ষ্মণ। আমরা ধরেই নিয়েছি ভারতের ফাইনালে যাওয়া দুষ্কর, তখন বালির ঝড় শুরু হয় স্টেডিয়ামে। খেলা থেমে যায় বেশ কিছুক্ষণের জন্য। দর্শকরা সবাই অপেক্ষা করছেন তাও, আমরাও টিভির সামনে। সচিন এখনো ব্যাট করছেন যে! এখনো সম্ভব ওই অসম্ভব যদি তিনি ঠিক করে খেলে দ্যান। বালির ঝড়ের আগে সচিনও সেদিন কিছুটা অস্বস্তিতে খেলছিলেন আশেপাশে অনেকগুলো উইকেট পড়ে যাওয়ায়, লক্ষ্মণ আউট হলেই টেইল বেরিয়ে পড়বে, শুরু হয়ে যাবে 'শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা'! এহেন অবস্থায় বালির ঝড় শেষ হবার পর সেদিন যখন খেলা শুরু হয়েছিল, তেন্ডুলকার আক্ষরিক ভাবেই ঝড় হয়ে ফিরে এসেছিলেন। শ্যেন ওয়ার্ন থেকে ডেমিয়েন ফ্লেমিং কেউ পার পাননি। একা ফাইনালে টেনে তুলেছিলেন টিম ইন্ডিয়াকে। তাঁর প্রতিভা এবং মেধা অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের নিয়ে স্টেডিয়ামের চতুর্দিকে ছেলেখেলা করেছিল সেদিন। বল থেকে শুধু বালি উড়েছিল তারপর। সেঞ্চুরি করেন সচিন। ফাইনালে ওঠার জন্য যত রান দরকার ছিল সেটা করে ফেলার পর ইন্ডিয়াকে ম্যাচটা জেতানোর চেষ্টা করেন যেটা এক ঘন্টা আগে থেকেই আমরা ভাবা ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারণ ফাইনালে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় টার্গেটই এত দূর অস্ত ছিল যে, ম্যাচ জেতা, মানে আরো ৪০-৫০ রান, সে তো অসম্ভব! কিন্তু সচিন যে আমাদের নাছোড়বান্দা 'ভগবান', তাই ফাইনালের কোয়ালিফাইং স্কোর করে ফেলার পরেই দর্শকরা সবাই এবার ম্যাচ জেতার স্বপ্নে ফিরে আসে, আর এই সময় আরো কয়েকটা রাজকীয় ড্রাইভের পর আউট হয়ে যান সচিন, ভারত তখন ফাইনালে কিন্তু ম্যাচ জেতার স্বপ্নে ওখানেই ইতি। তার পরের ম্যাচে অর্থাৎ ফাইনালে আবার সেঞ্চুরি করে আমাদের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতিয়েছিলেন তিনি কিন্তু সেই ইনিংসে যাচ্ছি না। আমার কাছে শারজার এই ভার্চুয়াল সেমিফাইনাল ‘ভগবান’ আর মানুষ সচিনের অপূর্ব এক সঙ্গমক্ষেত্র, যা এই দুই প্রতিস্বকে আলাদা করার জন্য জরুরি এক দৃষ্টান্ত। সেদিন একা হাতে বা যাকে বলা যায় একা ব্যাটে প্রায় ঐশ্বরিক কায়দায় সচিন ভারতকে ফাইনালে তোলেন, কিন্তু ফাইনালের কোয়ালিফাইং স্কোর অব্দি ইন্ডিয়াকে টেনে তোলার পর যখন আমরা তাঁর থেকে আরো বেশি চাইতে শুরু করি, তখন ম্যাচ জেতাতে ব্যর্থ হয়ে প্যাভেলিয়নের দিকে হাঁটা দ্যান তিনি আর ঠিক সেই সময় হাঁটতে হাঁটতেই তিনি আবার মানুষ বনে যান। সচিন রমেশ তেন্ডুলকার তখন ঘর্মাক্ত পরিশ্রমী প্রতিভার এক মানুষ-শরীর, যাঁর হাতে রয়েছে ততোধিক শ্রমে বানানো কাঠের ব্যাট, তাঁর যুদ্ধাস্ত্র।


১৯৯৯এর বিশ্বকাপ চলাকালীন নিজের বাবাকে হারান সচিন। তখন তিনি সচিন রমেশহীন তেন্ডুলকার। পিতার শেষকৃত্য করে ইংল্যান্ড ফেরেন ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে এবং প্রথম ম্যাচেই কেনিয়ার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেন। দেশ জুড়ে জল্পনা শুরু হয়, বাবার মৃত্যুর শোকের জবাব দিয়ে এবার ভারতকে বিশ্বকাপ এনে দেবেন সচিন। কিন্তু না, এমনটা হয়নি। কারণ সচিন ভগবান নন, তিনি আমাদের ইচ্ছাপূরণের যন্ত্র নন, তিনি স্বয়ম্ভর একজন মানুষ, একজন খেলোয়াড়। কিন্তু কেনিয়ার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির পর হয়তো কেরিয়ারে প্রথমবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যাট তোলেন সচিন, যেন মৃত পিতাকে সম্বোধন করছেন ব্যাট দিয়ে। এই মুহূর্তটির সঘন আবেগে আবার মানুষ হয়ে ওঠেন এক-একা-অনন্য এই খেলোয়াড়টি। বাবার মৃত্যুর পর থেকে শেষ দিন অব্দি সেঞ্চুরি করলেই আকাশের দিকে তাকাতেন তিনি। আবেগের সিগনেচার এই মুহূর্তগুলো আমার স্মৃতিতে মানুষ সচিনের কীর্তিময়তা হয়ে রয়ে যাবে সারা জীবন। যেমন ওয়ান-ডে তে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করলেন যেদিন, আমি খেলাটা দেখতে পারিনি, ট্রেনে ফিরতে ফিরতে সহযাত্রীদের মুখে সচিনের ২০০ রানের খবর শুনে চমকে যাই, ভাবি লোকটা কি 'ভগবান'? তখনকার সময়েও ওয়ান-ডে তে ২০০ রান প্রায় অসম্ভব, তখনও টি-টোয়েন্টি নামক প্রাণীটা জিরাফ হয়ে ওঠেনি! কিন্তু রাতে ফিরে হাইলাইটস দেখতে বসে বুঝতে পারি, না, আদ্যন্ত একটা মানুষ ব্যাট করছেন এখানে। তাঁর মুখ মানুষের মুখ, ভগবানের মুখ আমি দেখিনি, তিনি কি ব্যাট করতে পারেন? আমি অবিশ্বাসী লোক, জানি না ঠিক।

সবার মতোই আমিও চেয়েছিলাম ভারত ২০১১র বিশ্বকাপ জিতুক, কারণ ওটাই সম্ভবত সচিনের শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছিল এবং ভারত সত্যিই দেশের মাটিতে ওই ওয়ার্ল্ড কাপ জেতে। কিন্তু ততদিনে ৯০এর 'ওয়ান ম্যান টিম' থেকে সৌরভ গাঙ্গুলীর পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে 'টিম ইন্ডিয়া' নামক এক এককত্ব আর মহেন্দ্র সিং ধোনি সৌরভের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেই টিম স্পিরিটকে, তাই সচিন রমেশ তেন্ডুলকারকে একা জেতাতে হয়নি সেই বিশ্বকাপ। সকলের হাতে একসাথে উঠেছে সেই ট্রফি, ক্রিকেটের একা-দোকা-অনেক থেকে অনেকের একীভবনের প্রতীক হয়ে। ফাইনালের শেষে ভারত জিতে যাবার পর যখন গোটা টিম মাথায় তুলে স্টেডিয়ামে ঘুরিয়েছে সচিন রমেশ তেন্ডুলকারকে, সেই দৃশ্যে ক্রিকেটের 'অনেক' আবার ফিরে পেয়েছে তার ভেতরের 'একা' ওই এক-টিকে, নিজের ভেবে জড়িয়ে ধরেছে তাকে! সচিন আবার মানুষ হয়ে উঠেছেন, শুধু সচিনের টিম নয়, টিমেরও সচিন, এমনই বলে গেছে সেই মুহূর্ত!

সচিনের ফেয়ারওয়েল স্পিচ দিয়েই শেষ করি ফেয়ারওয়েল-সূচক এই লেখা। ২৪ বছরের এই কিংবদন্তি অমরত্ব এবং ঈশ্বরত্বপ্রাপ্তির পর বিদায়ের সন্ধ্যায় যখন হ্যাটের আড়ালে চোখের জল লুকোচ্ছেন মানুষের মতো, পাছে ভুলে না যান তাই কাগজে লিখে এনেছেন সবার নাম, যাদের এতদিনের সফরের জন্য ধন্যবাদ দিতে চান এবং সর্বোপরি স্বভাবসিদ্ধ বিনম্রতায় যখন বলছেন যে আর সবার মতো তিনিও একজন ক্রিকেটার, মহান এই খেলার এক রূপক-প্রতিনিধি মাত্র, তখন তিনি আবার মানুষ, ভগবান নন। বিদায়ী সম্ভাষণের একেবারে শেষে এসে তিনি যখন বলছেন তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দর্শকদের এই সচিন সচিন কলধ্বনি বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসবে তাঁর কানে, তখন সত্যিই জীবন-বিস্তীর্ণ এই শুশ্রুষা ভেসে বেড়াচ্ছে তাঁর মনুষ্যত্বে, পরম আদরে তাঁকে মানুষ করে রাখছে। ২৪ বছর ধরে নিজের ও কোটি কোটি মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছার পাথর নিয়ে একা সিসিফাসের মতো শ্রম করে গেছেন সচিন, অবশেষে এবার ক্রিকেটের বাইরে, যেখানে শুধু তাঁর ইচ্ছা আমাদের সকলের ইচ্ছা থেকে মুক্ত হয়ে অবসর গ্রহণ করছে, সেখানে নতুন খেলা শুরু করবেন তিনি। আমার বিশ্বাস সচিনের মতো ক্রিকেটারের কাছে ক্রিকেট জীবন এবং ইচ্ছার নামান্তর।

'খেলবে সচিন খেলবে সচিন মারবে সচিন চার / খেলবে সচিন খেলবে সচিন মারবে সচিন ছয়।'

আমি নিশ্চিত এমনটাই হবে যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন। এমনটাই হবে কিন্তু এখন থেকে তিনি একা। আমরা আর দেখব না সেই খেলা।

আমাদের সকলের মতো অবশেষে তিনিও আজ অনেকের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে এক থেকে একা হয়েছেন। চলুন এবার বরং আমরা তাঁকে তাঁর একার ক্রিকেট খেলতে দিই, যেখানে আর তাঁকে আমাদের সবার অসম্ভব স্বপ্নপূরণের বাহন হতে হবে না।

<<< চারানা আটানা >>>


০১) অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা



(৬)
শচীন, এবং




নস্ট্রাডামুস, পাগলাবাবা বেঙ্গলি, হনুমান মহারাজ, তন্ত্রসাধক শ্রীশ্রীক্ষ্যাপাবাবা, মাতাহারি দেবী প্রমুখ তাবড় তাবড় ভবিষ্যদ্‌দ্রষ্টার সমস্ত গণনাকে কাঁচকলা দেখিয়ে শচীন অবশেষে অবসর নিল। টেস্ট খেলার সংখ্যায় তার ডবল সেঞ্চুরি পূর্ণ করেই ডিক্লেয়ার করে দিল সে। উত্তমকুমার সাড়ে চুয়াত্তর দিয়ে মহানায়ক হওয়ার পথে ওপরের দিকে ওঠা শুরু করেছিল, শচীন মহানায়কের মতো চুয়াত্তর দিয়ে শেষ করল। কলকাতায় ট্রাফিক সিগন্যাল এক বেলার জন্যে পুরো ঘাসের মতো সবুজ করে রাখা যায় কিনা, সেই নিয়ে ভাবনাচিন্তা হতে লাগল দু-নম্বর মহাকরণে, কেননা শচীন যখন শুরু করেছিল, রাজ্যে সেটা ছিল বাম জমানা, অর্থাৎ ট্রাফিক লাইটে লালবাতি জ্বলতো। যতক্ষণ না এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, ততক্ষণ সমস্ত সিগন্যালে গাঁক গাঁক করে বাজতে লাগল দাদুর গান, তোমার হলো শুরু, আমার হল সারা।

নিন্দুকেরা অবশ্য কানাকানি করতে লাগল, শচীনের এই চব্বিশ বছর ধরে খেলা ওর নিজের ক্রেডিট নয়। যার মা-র নামের মধ্যে ‘রজনী’ আর কোচের নামের মধ্যে ‘কান্ত্‌’ আছে, তার কাছে চব্বিশ বছর তো নস্যি! অন্য আর এক দল বলল, ব্যাপারটা বুঝলি না! এমনি এমনি কী আর ছাড়লো, মুখের সামনে টোপ ধরলে ছাড়বে না তো কী! অন্যেরা জিজ্ঞেস করল, কিসের টোপ? নিন্দুকসম্রাট বলল, কিসের আবার, ভারতরত্ন! সলমন খানকে পরমবীর চক্র দে, দেখবি ও-ও সুড়সুড় করে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসবে।



রোহিত শর্মা হাঁফ ছেড়ে জগুবাবুর বাজারে বড় সাইজের রোহিত মৎস্যের অর্ডার প্লেস করল। ভারতীয় টীমে তার জায়গা নিয়ে এখন আর বিশেষ মাথাব্যথা নেই। সামনে সাউথ আফ্রিকায় সিরিজ, বাউন্সি পিচ, ওখানে একের পর এক ধেড়িয়ে এলেও টীমে জায়গা পাকা। অ্যাদ্দিন শচীন ছিল, ঝড়ঝাপ্টা ওর ওপর দিয়ে যেত; পাজী চলে গেল, এখন পাজির পা ঝাড়াগুলো নেত্য করবে যথাতথা।

শচীনের অবসর গ্রহণে ভারতবর্ষের বুকে নেমে এলো হাহাকার। ছাড়া পাওয়া গরুর মতো এক কৃত্রিম উপগ্রহ উঠে গেল ওপরের কক্ষপথে। খনা বলেছিল, মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা। কিন্তু দিন বদলে গেছে, এখন মঙ্গলেই পা রাখতে চায় মানুষ, বুধ উইল বি নেক্স্‌ট্‌। ‘শচীন, শচীন’ শুনে কেউ কেউ বলছিল, আরে চীনকে শো করার কিছু নেই, ওরাও স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, সেটাও অতদূরেই গেছিল, কিন্তু মঙ্গলে পা রাখতে পারে নি। শচীন অবসর নেওয়ার পর ইসরোর সায়েন্টিস্টরা কী সব ক্যালকুলেশন করে কলকাঠি নাড়তেই সেই উপগ্রহ পৃথিবীকে বাই বাই জানিয়ে অষ্টমঙ্গলার মতো মঙ্গলের দিকে চলা শুরু করল। কত লক্ষ কিলোমিটার নাকি চলে গেছে, মানে কনসীভ করে গেছে, আর ন’মাস গেলেই ডেলিভারি করার মতো সেটা মঙ্গলের ফাঁদে জড়িয়ে যাবে।

আলু-পেঁয়াজের দরও আপার অরবিটে উঠে আটকে গেছে, সেখান থেকে আর নামতে চাইছে না। ডলার আর তেলও। সাধারণ মানুষ ডলার দিয়ে ফলার করে না, কিন্তু তেল কিনতে ডলার লাগে। আর তেলের দাম বেড়ে গেলে সব কিছুর দাম বেড়ে যায়। তাই ছাপোষা গরীব মানুষদের আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়। যাদের পেটে ভাত জোটে না, তারা আনন্দ করবে কী করে? তখন তাদের এক আধ পিস শচীনের দরকার হয়।

তবে শচীন আর ব্যাট হাতে মাঠে নামবে না। পাকাপাকিভাবেই চলে গেল। যাওয়ার আগে বেশ লম্বা একটা বক্তৃতা দিয়ে গেল। হাটখোলার জগার সেজো পিসে বসে বসে খেলা দেখছিল টিভিতে। ভারত জিতল, শচীন মাইক হাতে লেকচার শুরু করেছে, সেই সময়েই তার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠতে গাড়ু নিয়ে নেত্যকালীর মাঠে ছুটতে হলো। ফিরে এসেও দেখে শচীনের বক্তৃতা তখনো চলছে। ক্রিজে যেমন টাইম কাটাতো, মনে হচ্ছে, এখন ক্রিজের বাইরেও সেই রকম পার্ফর্মেন্স দেবে।

হ্যাঁ, শচীনের এখন অনেক কাজ। একে তো সে অলরেডি রাজ্যসভার সদস্য। এখন জনস্বার্থে কেউ কেউ জানতে চাইবে, শচীন ভারতের জাতীয় খেলা হকির জন্য কী করেছে বা অ্যাট লীস্ট কী ভাবছে। এসব প্রশ্নের উত্তর তো সহজ নয়, এর চেয়ে ম্যাকগ্রার গুডলেন্থে কভার ড্রাইভ করা লেস রিস্কি। তবে শচীন ইজ শচীন। শোনা গেল শচীন অলরেডি কাজ শুরু করে দিয়েছে, যাতে এই রকম উল্টোপাল্টা কোশ্চেন করে কেউ তাকে না ঠকাতে পারে।


সেই কাজের প্রথম ধাপ হিসাবে ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ সিনেমাটা ও আর অঞ্জলি চোদ্দবার দেখে ফেলেছে। হকিতে ভারতের হৃত গৌরব ফিরে পেতে গেলে হৃতিক রোশনের কৃষ-টাইপের ম্যাজিক চাই, না শাহ্‌রুখ খানের ‘জিন্দেগিকা আখরি থার্টি মিনিট্‌স্‌’-বালা চাক দে, এই নিয়ে ওদের মধ্যে অনেক আলোচনা, দাম্পত্য কলহ মায় বেটাবিটি অর্থাৎ বেটিং পর্যন্ত হয়ে গেছে। শেষে ওদের বেটা আর বেটি দুজনেই বলেছে চাক দে! তাই শচীন ফোনে শাহরুখকে ধরেছে সঙ্গে সঙ্গে। শাহরুখ তখন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডারের কাজ করতে কলকাতায় এসে এক সরকারি অ্যাম্বাসাডার গাড়ির মধ্যে বসে বসে ঘামছিল, গাড়ির এসি চলছিল না বলে। ড্রাইভার এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু দিশি ব্র্যান্ডি অফার করতেই খচে মচে করণ জোহরের সিনেমার ডায়লগ দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় অটোগ্রাফ শিকারীরা ঘিরে ফেলে গাড়ি থেকে তাকে নামিয়ে নেয়। ওদিকে ঠিক সেই সময়েই এসেছে শচীনের ফোন। ফোনটা রাখা ছিল গাড়ির সীটে, ড্রাইভার ফোন তুলে শচীনের ফ্যাসফেসে গলা শুনে ভাবল, ম্যাডামের ফোন। চাক দে শুনে বুঝে নিল চাকদায় যেতে বলা হচ্ছে, ওখানে আজ কারো মৃত্যুঘন্টা বাজানোর আহ্বানে জনসভা আছে। ম্যাডামের হুকুম, গোল্লায় যাক এসি। শাহরুখকে গাড়িতে ঢুকিয়ে পড়িমড়ি করে চাকদায় নিয়ে গিয়ে তুলল। শচীনও ওদিকে শাহরুখের গলার আওয়াজ কী করে বদলে গেল, সেই নিয়ে অঞ্জলির সঙ্গে আবার বৈঠক করতে বসে গেল।

এদিকে শাহরুখকে বলা হয়েছিল, হাওড়ার নিউ মহাকরণে এসে করণ-অর্জুনের ডায়লগের কিছু মহা অংশ পেশ করে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এখনো যারা লাল আছে, তাদের নীল করে ফেলতে সাহায্য করতে। কিন্তু টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে, তার তো টিকিও দেখা যাচ্ছে না! দিদি আস্তে আস্তে বুঝে ফেলেছে, এই শাহরুখটা পুরো ফালতু, একে দিয়ে কোনো কাজ হবার নয়। যাই বলতে বলা হোক, ও সেই তু হ্যায় ম-ম-মের-রি ক-ক-ক-কিরণ-এ নিয়ে গিয়ে ফেলে। সেদিন দিদিকেও বোধ হয় কিরণ খেরের সাথে গুলিয়ে ফেলছিল। ঐ ছাতার ডায়লগ কদ্দিন চলে! এর চেয়ে বচ্চন মোদির ডেজার্টে অনেক বেশি ফুল ফোটাচ্ছে। মদনের সঙ্গে কনসাল্ট করতে হবে শচীনকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার করলে কেমন হয়। ও ব্যাট হাতে চব্বিশ বছর ক্রিজে কাটিয়েছে বোলারদের ঘোল খাইয়ে, ব্যালটবক্সে ভোটারদের ঘোল খাইয়ে অন্তত তত বছর মহাকরণে কাটানোর পক্ষে ওকে আইডল করাই আইডিয়াল। এর আগেও মাঝে মাঝে এ নিয়ে লাঞ্চ টেবিলে আলোচনা হয়েছে। লোকাল পোস্টার বয় সৌরভকে পাওয়া যাবে না, তার সব কিছুতেই দাদাগিরি, দিদিগিরি সহ্য করতে পারে না সে। বাকি ছিল পোসেনজিত আর সিলিন্ডার, থুড়ি লিয়েন্ডার। কিন্তু ব্র্যান্ড হিসেবে ওদের সে রকম ইয়ে, মানে এক্স ফ্যাক্টর নেই।

মদন-আরাবুল সবাই বলল, হ্যাঁ, শচীন ইজ বেটার। মানে শচীনের আর একটা কাজ বাড়ল। রাজ্যসভার জন্যে দিল্লী যেতে হবে, আবার কলকাতাতেও আসতে হবে পোস্‌চিমবঙ্গের ইমেজ ফেরানোর জন্যে। লাস্ট টেস্টের শেষে ঐ লেকচারটার মতো একটা গরম গরম কিছু নামিয়ে দিলে চাই কী গঙ্গার ধারে দু’কাঠা জমিও মঞ্জুর হয়ে যেতে পারে। প্যানেলিস্ট ডেরেক টাইম্‌স্‌ নাউয়ের নিউজ ইন্টারভিউতে অর্ণবের হাতে নাকানিচুবানি খাচ্ছিল, উপায় না পেয়ে কাঠে পেরেক ঠোকার মতো তুরুপের তাস ছেড়ে দিয়ে জানালো, হ্যাঁ, আমরা শচীনকে আনছি। ওয়েস্ট বেঙ্গলে এবার ফরেন ইনভেস্টমেন্টে জোয়ার আসবে। অলরেডি সিঙ্গুরে পৃথিবীর বৃহত্তম সিঙ্গাড়ার ফ্যাক্টরি খোলা হবে বলে একটা টেন্ডারের খসড়া রেডি করে ফেলেছেন বিত্তমন্ত্রী, সেখানে ইনভেস্ট করবে পৃথিবীর নাম্বার ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় পাঞ্জাবের লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটির মালিক। সুনীতা উইলিয়াম্‌স্‌ স্পেসে সামোসা নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই আইডিয়া তার মাথার মধ্যে ঘুরছে। শোনা যাচ্ছে, ম্যাকডোনাল্ড্‌স্‌ও ম্যাক-সিঙাড়া ছাড়ছে বাজারে, আর কে এফ সি ওদের আগের নাম চেঞ্জ করে কলকাতা ফাস্টফুড সেন্টার বানিয়ে ফেলবে কিনা ভাবছে। শচীনকে দিয়ে বলানো হবে, তার প্রত্যেকটি ইন্টারন্যাশনাল সেঞ্চুরির আগের দিন রাত্রে সে আধখানা করে সিঙাড়া খেয়েছিল, অন্যান্যবার মেনুতে সিঙাড়া ছিল না, তাই সেঞ্চুরিও ফস্কে গেছে।

খেলাধূলার উন্নতিকল্পে কোথায় কী করা যায়, এর জন্যে প্রখ্যাত ক্রীড়ামোদি লেখক মতি নন্দীকে মহাকরণে তুলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করায় তিনি নন্দীগ্রামে হাডুডু কোচিং সেন্টার খোলার কথা বলেন। এতে বিজেপি প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বিবৃতি দিয়েছে, শ্রীনরেন্দ্র মোদির পেটেন্টেড রীতি ফলো করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শ্রীমতি নন্দীকে নিযুক্ত করেছে। এদিকে শ্রীমতি নন্দী কে, সেই নিয়ে জনগণের মধ্যে মহা বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে। নন্দী পদবীর কোন্‌ মহিলার সাথে খেলাধূলার ব্যাপারে আলোচনা করা হচ্ছে?

এদিকে সাউথ আফ্রিকায় ভারত খেলতে আসছে, সেই টীমে শচীন খেলবে না, কেননা সে এখন ভারতরত্ন, এই শুনে সে দেশের ভারতরত্ন ভাবল, আর বেঁচে থেকে লাভ কী! সবই মায়া। তার দেহান্তের খবর পেয়ে তড়িঘড়ি প্রধানমন্ত্রী ছোটে গান্ধীকে ডেকে বললেন, রাহুলবাবা, একটা বিবৃতি লিখে আমার নামে পাঠিয়ে দাও বাবা। আমি যদি এখন মুখ খুলতে যাই, লোকে বলবে, শচীন অবসর নিয়েছে বলেই দেখাদেখি আমিও...

পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্টদের হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে শচীনকে ক্যাশ করার জন্যে। শচীন যে পার্মানেন্টলি মাঠ ছাড়ার আগে পিচে গিয়ে প্রণাম করে এলো, তাই দেখে বিড়লারা ট্র্যাডিশনাল হিন্দুমন্দিরের বদলে পিচমন্দির, আর রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাদার হীরানন্দনি গ্রুপ তাদের ডেভেলপ করা সমস্ত কমপ্লেক্সে শচীনবেদি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় কমার্স মিনিস্টার সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে অবসর নেওয়া কর্মচারিদের শচীনের মতো বিদায়ী ভাষণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করার মর্মে এক বিল আনতে চলেছে পার্লামেন্টের পরবর্তী অধিবেশনে।

প্রখ্যাত হাফ পঞ্জিকার জনক বেণীমাধব শীলের লাল মলাটের বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, দিনে যে চব্বিশটা ঘন্টা, সেটা শচীনের ক্রিকেট জীবনের এক একটা বছরের মতো স্মরণীয় করে রাখতে প্রত্যেক যুবক-যুবতীর শক্তিবর্ধক গোলি খাওয়া উচিত। এ ব্যাপারে মন্ত্রপূতঃ তাবিজ পাওয়া যাবে মাত্র ছশো টাকা থেকে। তেল, মাদুলি, কবচকুন্ডলি এটসেট্রা কমপ্লিমেন্টারি, তবে ভ্যাট অতিরিক্ত। বাংলা বছরেরও আর বেশি বাকি নেই, এ সময় জেনেরালি পাঁজি ফাঁজি বিশেষ বিক্রি হয় না, কিন্তু শচীনের জন্যেই এবার হাফ পঞ্জিকা এখন হঠাৎ হৈ হৈ করে বিক্রী হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ক্যালেন্ডারমন্ত্রী এ বছর থেকে শচীনাব্দ চালু করা যায় কিনা, এই নিয়ে ইন্ডিয়ান ইন্সট্যুট অফ অ্যাস্ট্রোনমির সায়েন্টিস্টদের সাথে আলোচনা করছেন।

কলকাতা শচীনজ্বরে ভুগছে। নজরুলের জন্মদিনে নজরুল মঞ্চে যেমন ইয়াং রবি ঠাকুরের ছবিতে মালা পরিয়ে সবাই আহা-উহু করেছিল, বোম্বে গিয়ে শচীনকে ধরে আনতে গিয়ে মদনের সাঙ্গোপাঙ্গরা বেঁধে নিয়ে এসেছে তার মতোই দেখতে এক মারাঠি ছেলেকে। সে হিন্দী ফিল্মে এক্সট্রা, মানে পঁচিশ পঞ্চাশ টাকা পেলে ভিড়ের মধ্যে ডান্স করে। হোটেলে মহাকরণ থেকে নির্দেশ গেছিল, শচীনের স্ত্রীর ওপর বিশেষ সম্মানার্থে সে হোটেলে নিজের রুমে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে যেন তার ঘরে ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’টি বাজতে থাকে। সেই রকমই হয়েছে, তবে নকল শচীন তা অ্যাপ্রিশিয়েট না করে মাঝপথেই সেটা বন্ধ করে দিয়ে লুঙ্গিডান্স চালিয়ে দিয়েছে। তাজ বেঙ্গলে মহা আরামে সে এক বিশাল স্যুট নিয়ে আছে আর দু’বেলা পাওভাজি বড়া- পাও সাঁটাচ্ছে। সৌরভ শচীনের আসার খবর পেয়ে ডোনাকে সঙ্গে নিয়ে তাজে দেখা করতে গেছিল, ব্যাপার স্যাপার দেখে সে তো মহা আনন্দ পেয়েছে। দাদাগিরিতে প্রত্যেক দিন এই ঘটনা নিয়ে নতুন নতুন গুগলি বানাতে আরম্ভ করে দিয়েছে সে। এম এল এ স্পেশাল শোতে এই গুগলি খাইয়ে টি-আর-পি নাকি আকাশে তুলে ফেলেছে।

তবে সৌরভকেও আজ আর সাধু বলার রিস্ক নিতে যাবেন না। বললে তার মানে হবে আপনি চোর। রবি ঠাকুরের দুই বিঘা জমি-র লাস্ট লাইনটা মনে নেই?

<<< অণুরঙ্গ >>>


০১) সুজিৎ মুখোপাধ্যায়

নিরর্থক


চরিত্র : প্রণবেন্দু (বয়স ৭০, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বর্তমানে নিজের আশ্রমে থাকেন, অকৃতদার), শ্যামল (প্রণবেন্দুর ভাগ্নে), অনিমা (শ্যামলের স্ত্রী), অম্লান (প্রণবেন্দুর সহযাত্রী), ছন্দা (অম্লানের স্ত্রী)।

(প্রথম দৃশ্য)


(দিল্লী-হাওড়াগামী এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর বাতানুকুল কুপে তিনজন ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন। ট্রেন ছাড়তে মিনিট দশেক বাকি। এমন সময় শ্যামল, প্রণবেন্দু ও অনিমার প্রবেশ, সঙ্গে একটি স্যুটকেশ ও একটি সাইডব্যাগ।)

শ্যামল – মামাবাবু!

প্রণবেন্দু – বল্‌!

শ্যামল – এত তাড়াহুড়ো করে তোমার সাধনের কাছে যাওয়ার কোনো দরকার ছিল না।

প্রণবেন্দু(হেসে) অনেকদিন আগেই ওর কাছে এই সময় যাব বলে ঠিক হয়ে আছে। অহেতুক যাওয়া পিছিয়ে দেব কেন?

অনিমা
– কয়েকটা দিন আপনার সঙ্গে কী ভালো যে কাটলো!

প্রণবেন্দু (ঘড়ি দেখে) ট্রেন ছাড়ার সময় হলো, এবার তোরা আয়!

(স্বামী-স্ত্রী দুজনে প্রণবেন্দুকে প্রণাম করলো)

শ্যামল – আমরা ঠিক করেছি, এপ্রিল নাগাদ ছেলেকে নিয়ে তোমার আশ্রমে গিয়ে কয়েকদিন থাকব।

অনিমা – তুমি আশীর্বাদ কোরো, ও যেন মানুষ হয়।

প্রণবেন্দু (হেসে) আজকাল সবার এই এক রোগ। ছেলেমেয়ে নিয়ে অকারণে ভেবে ভেবেই মরলো। তরুণ তো ভালো ছেলে, এত ভাবছিস কেন? বাড়ি যা। চিন্তা করিস না। এপ্রিল মাসে আসিস। দেখা হবে।

অনিমা – সাবধানে যাবে। পৌঁছে একটা ফোন করবে।

প্রণবেন্দু – তোরা শান্তিতে থাকিস। আনন্দে থাকিস।

(স্বামী-স্ত্রীর প্রস্থান)


(অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়লো। কম বয়সের তরুণটি বাঙ্কের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে মগ্ন। প্রণবেন্দু লক্ষ্য করলেন, ভদ্রমহিলা একটি পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন, আর তাঁকে মাঝে মাঝে লক্ষ্য করছেন। ভদ্রলোক একটি খবরের কাগজ পড়ছেন।)

ছন্দা(প্রণবেন্দুকে) নমস্কার!

প্রণবেন্দু
– নমস্কার!

অম্লান (খবরের কাগজ পাশে রেখে) আপনাকে নমস্কার জানাই।

প্রণবেন্দু – হ্যাঁ, আপনাকেও নমস্কার জানাই। তা আপনারা কোথায় থাকেন? দিল্লী?

ছন্দা – গত বছর পর্যন্ত দিল্লীতেই ছিলাম, এ বছর কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছি আমরা। ছেলে দেরাদুনে পড়ে, তার সঙ্গে দেখা করে ফিরছি।

প্রণবেন্দু – তাই নাকি! ছেলের বয়স কত?

ছন্দা – এই সবে বারো পেরিয়েছে।

অম্লান(বাধা দিয়ে) এই তিন মাস হলো তেরো পেরিয়েছে, এখন চোদ্দ চলছে।

ছন্দা – মোটেও না!

প্রণবেন্দু (হেসে) কোন্‌ ক্লাসে পড়ে?

ছন্দা – এ বছর ক্লাস নাইনে উঠলো।

প্রণবেন্দু – আপনাদের একটি মাত্র ছেলে, তাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হয়, তাই না?

(ছন্দা নিরুত্তর)

অম্লান – আসলে আমার বদলির চাকরি, এছড়া কোনো উপায়ও নেই। আর একসময় আমিও ঐ স্কুলে পড়েছি। আর তাই ঐ স্কুলটার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে।

ছন্দা – আপনি কি দিল্লীতেই থাকেন?

প্রণবেন্দু – দিল্লীতে আমার ভাগ্নে থাকে, একটু আগে যাকে দেখলেন। আমার বাড়ি হরিদ্বারে। আগে, চাকরিজীবনে দিল্লীতেই ছিলাম। এখন আমি বছরে প্রায় দশমাস হরিদ্বারে থাকি, বাকি মাস দুয়েক আমার কয়েকজন পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাই।

ছন্দা – তাঁরা আপনার শিষ্য বুঝি?

প্রণবেন্দু(হেসে) আপনি শিষ্য বলতে যা বোঝাতে চাইছেন, তা নয়। আমি কাউকে কোনো দীক্ষা দিই না। আমার সেই যোগ্যতাই বলুন বা বিশ্বাসই বলুন, কোনোটাই নেই। আসলে ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে, আমিও ওদের খুব ভালোবাসি। মাঝে মাঝে ওদের দেখতে খুব ইচ্ছে করে। তাই দেখা করতে যাই।

ছন্দা – আশ্রমে কি আপনি এবং আপনার শিষ্যরা থাকেন?

প্রণবেন্দু – দেখুন, আমি যেখানে থাকি, সেটাকে আশ্রম না বললেও চলে। আমি একা মানুষ। চাকরি থেকে অবসরের পর আজ বারো বছর হলো হরিদ্বারে জমি কিনে একটা বাড়ি বানিয়ে সেখানেই থাকি। এমনিতে আমরা ওখানে তিনজন থাকি। তবে কিছু পরিচিত মানুষজন আছেন, তাঁরা নিয়মিত আসেন।

অম্লান – আপনি দিল্লীতে কোথায় চাকরি করতেন?

প্রণবেন্দু – আমি (একটু থেমে) জে এন ইউ-তে দর্শনের অধ্যাপক ছিলাম। বারো বছর হলো অবসর গ্রহণ করেছি।

অম্লান (খুব খুশি হয়ে) যদি কিছু মনে না করেন, আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনার এ ব্যাপারে অভিমত জানতে চাইলে, কোনো আপত্তি নেই তো?

প্রণবেন্দু – দেখুন, আমি একজন খুবই সাধারণ মানুষ। বেশি লেখাপড়া জানি না। কঠিন কঠিন প্রশ্ন করলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাব।

ছন্দা – জানেন, আমার না এই রকম কোনো আশ্রম, একটা ছোট্ট মন্দির, যেখানে লোকজনের ভিড় নেই, নিরিবিলি, সেখানে চুপ করে সারাটা সন্ধ্যে বসে থাকতে খুব ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে।

প্রণবেন্দু – বাঃ বাঃ, খুব ভালো। তা আপনারা এসে দিন কয়েক আমার ওখানে ঘুরে যান না! কোনো অসুবিধে হবে না।

অম্লান
– আপনার যদি কোনো কার্ড থাকে, তাহলে আমাকে দেবেন?

প্রণবেন্দু – হ্যাঁ আছে। (ব্যাগ হাতড়ে একটা কার্ড বের করে অম্লানকে দিলেন)। হ্যাঁ, আপনার কী প্রশ্ন আছে বলছিলেন!

অম্লান – আচ্ছা, আমাদের জীবনের অর্থ বা উদ্দেশ্য কী?

প্রণবেন্দু (দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তাঁরা খুব উৎসুক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। হেসে বললেন) দেখুন, মানুষের জীবনের কাজকর্ম, গতিপ্রকৃতি, বিশেষত শেষ পরিণতির কথা ভাবলে, যে কোনো বোধসম্পন্ন মানুষের মনে হতে বাধ্য যে, এই জীবনের কোনো অর্থ হয় না বা এর কোনো দরকার ছিল না। যেমন ধরুন, অনেকটা সেই ছোটবেলায় করা ‘সরল করো’ অঙ্কের মতো আর কী! অনেক লম্বা অঙ্ক, করতে করতে শেষ পর্যন্ত উত্তর বের হলো ‘শূন্য’ কিংবা ‘এক’।

অম্লান – উপমাটা মন্দ দেন নি! জানেন, আমারও একই মত, জীবনের কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য নেই।

প্রণবেন্দু (একটু চুপ করে থেকে) না, তা নয়। জীবনের কোনো উদ্দেশ্যই নেই, সেটা অবশ্য আমি মানি না।

ছন্দা – (ফ্লাস্ক থেকে দু’কাপ চা দু’জনকে দিয়ে এবং নিজে এক কাপ নিয়ে) একটু ডিসটার্ব করছি আপনাদের। আগে চা খাওয়া যাক, তারপর আমারও একটা প্রশ্ন আছে আপনার কাছে।

প্রণবেন্দু – তাই নাকি! বলুন, বলুন! আগে আপনার প্রশ্ন শুনি।

ছন্দা – আচ্ছা, আপনি অনুমান করতে পারেন, বুদ্ধদেব সুদীর্ঘকাল তপস্যা করে শেষপর্যন্ত কী উপলব্ধি করেছিলেন?

প্রণবেন্দু
– ওরে ব্বাবা, এতো সাংঘাতিক প্রশ্ন! দেখুন, তিনি কী দেখেছিলেন সেটা তো বলে যাননি, তবে তাঁর উপদেশ আর কর্ম দেখে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।

ছন্দা – হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার অনুমানটাই শুনতে চাই।

প্রণবেন্দু – আমার মনে হয়, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া বা বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু জন্মের ওপর যেহেতু নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেই জন্যই তিনি নির্বাণ তত্ত্ব প্রবর্তন করেন।

ছন্দা – এই নির্বাণ তত্ত্বে বা হিন্দুদের মুক্তির তত্ত্বে যাঁদের আস্থা আছে তাঁদের কথা আলাদা, কিন্তু যাঁদের নেই তাঁদের কী করণীয়?

অম্লান (হেসে) তাহলে তো শেষ পর্যন্ত হাতে থাকলো ‘চার্বাক’!

প্রণবেন্দু – দেখুন আপনি হাসছেন বটে, কিন্তু চার্বাকের উক্তির শেষ অর্ধেকটা বাদ দিলে যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেই কথাটি খুব খাঁটি কথা। চার্বাকের যে উক্তিটি প্রচলিত আছে, “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ / ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ”, আমার তো মনে হয়, চার্বাককে লঘু করে দেখাবার জন্য তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা শেষ অংশটা নিজেরা জুড়ে দিয়েছিলেন।

অম্লান(হেসে) মনে হচ্ছে আপনি চার্বাকে বিশ্বাসী!

প্রণবেন্দু – ওই যে বললাম, চার্বাকের উক্তির প্রথম অংশটি সবারই কাম্য। আর আমি যদি চার্বাকে বিশ্বাসী হইও, তাহলেও কি কোনো সুবিধা হবে? সুখ কি হাতের মোয়া?

ছন্দা – তাহলে?

অম্লান – তাহলে আবার কী, আমরা আবার সেই সুকুমার রায়ের ‘ঠিকানা’র ‘আমড়া তলার মোড়ে’ এসে পৌঁছলাম!

প্রণবেন্দু(হাই তুলে) এবার কিছু খেয়ে শুয়ে পড়া যাক, কেমন! অনেক রাত হলো। কাল বরং আবার গল্প করা যাবে।

ছন্দা – ওমা, সত্যিই তো অনেক রাত হয়েছে। কথায় কথায় খেয়ালই নেই। আপনি বয়স্ক মানুষ, শুধু শুধু আপনার দেরি করিয়ে দিলাম।

প্রণবেন্দু – না না, তা কেন! আমার তো ভালোই লাগছিল।



(দ্বিতীয় দৃশ্য)

(প্রণবেন্দু ঘুম থেকে উঠে ট্রেনের জানালার দিকে চেয়ে বসে আছেন। অম্লান তখনও ঘুমোচ্ছেন। ছন্দা এইমাত্র উঠেছেন।)
প্রণবেন্দু – সুপ্রভাত!

ছন্দা
(হেসে) হ্যাঁ, সুপ্রভাত!

প্রণবেন্দু – রাতে ভালো ঘুম হয়েছে?

ছন্দা – আমার ট্রেনে খুব একটা ভালো ঘুম হয় না। ওনার আবার ট্রেনেই নাকি ভালো ঘুম হয়। আপনি ঘুমিয়েছিলেন?

প্রণবেন্দু
– না, আমার এমনিতেই কখনও ভালো ঘুম হয় না। খামোকা ট্রেনকে দোষ দিয়ে কী লাভ!

(ইতিমধ্যে অম্লানের ঘুম ভেঙেছে। ঘুম থেকে উঠে নমস্কার বিনিময়ের পর চা-ওয়ালাকে ডেকে তিন কাপ চায়ের অর্ডার দেওয়া হলো।)

ছন্দা – আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে আরও ঘন্টা কয়েক বোধহয় বাকি আছে। তার আগে আমাদের আলোচনাটা শেষ করলে ভালো হয়।

প্রণবেন্দু (হাসতে হাসতে) শেষ করতে হবে? এই আলোচনার কি শেষ আছে? আসলে নানা মুনির নানা মত। অনেক জটিল তত্ত্ব। অনেক মোটা মোটা বই। অনেক রকম ব্যাখ্যা।

অম্লান – তা হোক, আমরা আপনার অভিমত জানতে আগ্রহী।

প্রণবেন্দু – ঠিক আছে। তা কাল আমরা আলোচনাটা কোথায় যেন স্থগিত রেখেছিলাম?

অম্লান (হাসতে হাসতে) আমড়াতলায়।

প্রণবেন্দু (অবাক হয়ে) আমড়াতলায়! (তারপর মনে পড়তে) হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আমড়াতলায়।

ছন্দা – বলুন আপনি!

প্রণবেন্দু – দেখুন, আমাদের সবারই আসলে হাত পা বাঁধা। জন্ম গ্রহণে যেমন আমাদের কোনো হাত নেই, তেমনি মৃত্যুতেও কোনো হাত নেই। সুখ বলুন, শান্তি বলুন, কোনো কিছুতেই মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। (একটু থেমে জল খেলেন, তারপর জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন) তবু সামনে দুটো পথ আছে।

অম্লান ও ছন্দা
– কী পথ?

প্রণবেন্দু – প্রথম পথ হচ্ছে, “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় / আরও-এক বিপন্ন বিস্ময় / আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে / খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে; / ক্লান্ত, ক্লান্ত করে; লাশকাটা ঘরে / সেই ক্লান্তি নাই”।

(অম্লান ও ছন্দা একদৃষ্টিতে প্রণবেন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রণবেন্দু চোখ বুজে আছেন।)
অম্লান (ধীরে ধীরে) শেষ লাইনে কিন্তু আছে, “আমরা দু’জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার”।

প্রণবেন্দু – হ্যাঁ, জীবনের ভাঁড়ার যা আছে, সে সব যারা পছন্দ করে তারা তা নিয়ে সব কিছু ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা তো জীবনের মানে বা উদ্দেশ্য হতে পারে না! প্রশ্নটা হচ্ছে, আমাদের জন্মানোর কি কোনো প্রয়োজন ছিল?

ছন্দা
– শুনেছি সব ধর্মেরই সার কথা, জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বরলাভ বা ঈশ্বরত্বলাভ।

প্রণবেন্দু – তা মানলাম। কিন্তু এই ঈশ্বরলাভ বা ঈশ্বরত্বলাভ বলতে আপনি কী বোঝেন? আর সেটা কী করেই বা সম্ভব?

অম্লান – বিষয়টা নিঃসন্দেহে জটিল। যাইহোক আপনি আপনার আর একটি পথের কথা বলুন।

প্রণবেন্দু – ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য বা তাঁর কৃপা পাওয়ার জন্য পুজো-আচ্চা, ঘন্টানাড়া, চরণামৃত খাওয়া আমি নিরর্থক বলে মনে করি। কারণ কাজের কাজ না করে শুধুমাত্র স্তাবকতায় ঈশ্বর তো দূর, কোনো প্রকৃত সজ্জন মানুষেরও কৃপালাভ করা যায় না। আমি এসবকে নিছকই পন্ডশ্রম মনে করি।

ছন্দা – একটা প্রশ্ন করব? আপনি তো আপনার আশ্রমে মন্দির স্থাপন করেছেন। সেখানে পুজো-আচ্চা হয় না?

প্রণবেন্দু – না, সে সব কিছু হয় না। শুধু বছরে একদিন, আমার উপাস্য মহাপুরুষের জন্মদিনটি আমরা কয়েকজন মিলে ‘সেলিব্রেট’ করি।

ছন্দা – ব্যাস! সারাদিন মন্দিরে আর কিছু হয় না?

প্রণবেন্দু – মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা আমি মন্দিরে বসে থাকি। মনে মনে তাঁর সঙ্গে অনেক আলোচনা, তর্ক করি। কিন্তু কে আর কবে তাঁর সঙ্গে তর্কে এঁটে উঠেছে? শেষ পর্যন্ত তাঁর কথায় ‘কনভিন্সড’ হয়ে ফিরে আসি। এছাড়া আমার সঙ্গীদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা করি। আসল কথাটি কী জানেন, “রুদ্ধ দ্বারে দেবালয়ের কোণে / কেন আছিস ওরে / অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে / কাহারে তুই খুঁজিস সঙ্গোপনে / নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে / দেবতা নেই ঘরে”। আর তাই দ্বিতীয় বা একমাত্র অবশিষ্ট পথ হচ্ছে, এই জীবনকে উৎসর্গ করা।

অম্লান
– কিন্তু কী ভাবে?

প্রণবেন্দু – “ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির, / মূক সবে, ম্লান মুখে / লেখা শুধু শত শতাব্দীর / বেদনার করুণ কাহিনী...। এই সব মূঢ়, ম্লান, মূক মুখে দিতে হবে ভাষা...”।

অম্লান
– এবার শেষ প্রশ্ন আপনার কাছে, জীবনের এই যে জটিলতা, আপনি যাকে অঙ্কের সরলীকরণ বলেছেন, তার উত্তরটা কী? শূন্য, নাকি এক?

প্রণবেন্দু(প্রাণখোলা হাসি হেসে) না, না, কখনই শূন্য নয়, এক। সব এক। সবাই এক। এটাই শেষ কথা। এটা উপলব্ধি করাই বোধহয় জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।

অম্লান
– কিন্তু এই উপলব্ধিতে পৌঁছনো কি আদৌ সম্ভব?

প্রণবেন্দু – অসম্ভব বলব না, তবে প্রায় অসম্ভবও। বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, বিদ্যাসাগর এই ধরনের কিছু মানুষই এটা উপলব্ধি করতে পেরে নিজের মতো করে কাজ করে গেছেন। (একটু থেমে) এবার উঠুন। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। (একটা ফোন এলো) হ্যাঁ, ডাক্তার সেন, বলুন! আরে কী মুশকিল, আপনি আবার স্টেশনে আসতে গেলেন কেন? না না, আমার আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি।

ছন্দা – আমরা আগামী অক্টোবরে হরিদ্বার যাব। আপনার সঙ্গে আশ্রমে গিয়ে দেখা করব।

প্রণবেন্দু – স্বাগতম! আমি অপেক্ষায় থাকব। নমস্কার!