কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ৯২

 

আমরা যারা আজ জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি, প্রচলিত অভিধায় প্রবীণ অথবা  বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হয়েছি, স্বচ্ছন্দে বলতে পারি, বিগত সত্তর-আশি বছরে সারা বিশ্ব জুড়ে যে বিশাল পট পরিবর্তন ঘটেছে, তার আমরা সাক্ষী থেকেছি। সেই পরিবর্তন ঘটেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন এলাকায়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেমন, ঠিক তেমনই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও। বস্তুত শিল্প ও প্রযুক্তিতে যে অবিশ্বাস্য উন্নতি ঘটেছে এবং ঘটেই চলেছে, তার অভিঘাতে পরিবর্তিত হয়েছে গোটা বিশ্বের যাবতীয় কর্মকান্ড ও ধ্যান-ধারণা। আর তাই সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনবোধও পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের অভ্যেস বদলে গেছে, আচরণ বদলে গেছে, শিষ্টাচার বদলে গেছে, লক্ষ্য বদলে গেছে, দিশা বদলে গেছে, সম্ভাষণ বদলে গেছে, বিনোদন বদলে গেছে, ব্যবহারিকতা বদলে গেছে, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বদলে গেছে, আত্মীয়তা বদলে গেছে, এমনকী মূল্যবোধও বদলে গেছে। কতটা কী বদলে গেছে, তা আমরা যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করতে পারি, যদি আমরা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গীতে সবকিছু পর্যালোচনা করতে পারি। আসলে আমাদের জীবন ও জগতের এই যে সার্বিক পরিবর্তন, তা আগের মতো দীর্ঘ সময় বা কাল ধরে সংঘটিত হয়নি, বরং তা ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুতলয়ে, নিতান্ত তৎপরতার সঙ্গে। আমাদের প্রজন্ম যে ভাবনা চিন্তা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে শৈশব থেকে ক্রমশ উত্তীর্ণ হয়ে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধ্যকের জীবনকাল অতিবাহিত করত, আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকেই তা ক্রমশ অন্য খাতে বইতে শুরু করে। এবং আজ তৃতীয় প্রজন্ম পুরোপুরি ভাবেই সেই অন্যখাতকে আরও পুষ্ট ও বেগবান করে তুলেছে। বস্তুত আজ আমরা এমন এক বিশ্বের অধিবাসী হয়ে পড়েছি, যেখানে আমরা লক্ষ্য করছি, একটা শিশু জন্মগ্রহণের পর শৈশবের আবহাওয়াটাই উপভোগ করতে পারছে না। তাকে খুব দ্রুত বড় হয়ে উঠতে হচ্ছে বা বড় হয়ে উঠতে বাধ্য করা হচ্ছে। শৈশবকাল যাচ্ছে হারিয়ে। এবং শুধুমাত্র শৈশবকালই নয়, হারিয়ে যাচ্ছে তার কৈশোরকালও। নিতান্তই কম বয়সে তারা শৈশবকাল এবং কৈশোরকাল কোনোক্রমে অতিবাহিত করে উপনীত হচ্ছে যৌবনকালে। এবং এই যে বাচ্চাবয়সে তারা শারীরিকভাবে বড় এবং পরিণত না হলেও ব্যবহারে, আচরণে, মননে পরিণত হয়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছে, তা কখনই স্বাভাবিক নয়, নিতান্তই অস্বাভাবিক। আমাদের তৃতীয় প্রজন্মের যে কোনো সন্তানের সঙ্গে কথা বললে, মেলামেশা করলে তা অনুভব করা যায়। আমাদের প্রজন্মের কোনো কিছুর সঙ্গেই এই তৃতীয় প্রজন্মের ঠিক যেন মেলে না। হ্যাঁ, তথাকথিত জেনারেশন গ্যাপের প্রচলিত ফর্মুলাকে অস্বীকার না করেও একথা বলছি। আমাদের বিগত ছেলেবেলা আর আজকের প্রজন্মের ছেলেবেলা সত্যিই মেলে না। আসলে জীবন তো একটাই। সেই জীবন যদি জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম না মেনে অস্বাভাবিক ধারায় প্রবাহিত হয়, তবে তো জীবনের আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়! আর তাই আনন্দ-বঞ্চিত বর্তমান প্রজন্মের কথা ভেবে সত্যিই কষ্ট হয়।

 

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের লেখক-পাঠক-শুভানুধ্যায়ী সবাইকে জানাই বর্ষার শুভেচ্ছা।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

 

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

 

সাত সাতটা বড় কলকাতা

 


বেড়াতে গিয়েছেন। দি-পু-দা-তে বা আশেপাশে। শহরের যত বন্ধু ছ’মাসে ন’মাসে দেখা হয় না এখানে ছাড়া, তাদের বাদ দিয়ে যার সঙ্গেই দেখা হবে, একই হোটেলে, ভাজা মাছের কাউন্টারে, কটকি-কাজু-নকল-কিউরিওর দোকানে,  তাকেই জিগোবেন ‘আপনি কোত্থেকে’, সে বলবে কলকাতা। আর একটু জেরা করলে কলকাতা দাঁড়াবে খড়দা, ব্যারাকপুর, নিউব্যারাকপুর, টিটাগড়, নৈহাটি, কল্যাণী, শুঁটে বারাসত — আর গোরাবাজারের আতা মহম্মদ লেন, স্বাধীনতোত্তর দুর্গাবাড়ি লেনের কি নোয়াপাড়ার কি আমতলা পৈলানের কলকাত্তাই। আপনি  ‘ওঃ তাই’ বলে মনে মনে একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে নেবেন। আমরা সবাই কি জানি কলকাতা আসলে কী, খায় না পেতে শোয়, বা কটা?

আমি গ্রামের ছেলে। আমার এতে কী যায় আসে? কলকাতার নামের সঙ্গে সংযোগ একটাই ছিল। আমাদের বাবা-কাকার কেনা বাড়ি হাওড়া জেলার  আমতা শহরে। তার অদূরে ছিল ‘কলকাতা’ নামের একটা গ্রাম। আমতা এক  নম্বর ব্লকের রসপুর গ্রামের সংলগ্ন বলে যার নাম ছিল ‘রসপুর-কলিকাতা’। বড় কলকাতার থেকে তার এই ‘namesake’-কে আলাদা করতে একে ‘ছোটো কলকাতা’-ও বলতেন অধিবাসীরা। সেখানকার দোকান-টোকানে এই নাম  এখনও জ্বলজ্বলিং। আর অধিবাসীদের মনে একটু গুমোরও ছিল। কেউ বিস্ময়ে নামের রহস্য জানতে চাইলে কেউ বলতেন, ব্রিটিশ আমল থেকে এই নাম চলছে, কেউ আবার কোম্পানির আমলেও চলে যেতেন। কিন্তু টালাব্রিজের পাশে বাপের বাড়ি হওয়ায় বৌ ছিল, মানে নিজেকে ভাবতো, খাস কলকাতার মেয়ে। সেও ধাক্কা খেল।       

কারে পড়ে দমদম ক্যাণ্টনমেন্ট-এ বাসা নিয়ে ফেলে স্ত্রীর মনোকষ্ট দূর করতে বাড়ি খুঁজে ফিরে শ্বশুরের সূত্রে দীনেন্দ্র স্ট্রিটে গেছি। বাড়ির দুই হরিহরআত্মা বিপত্নীক ডিভোর্সি মালিক ভাই খাস কলকাত্তাই, আমরা দমদম ক্যাণ্ট-এ থাকি শুনে, সেখান থেকে এখানে বাড়ি দেখতে এসেছি, আর কল্যাণী ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র ঠ্যাঙাতে যাই শুনে, আঁতকে উঠলেন। স্ত্রী পরিস্থিতি সামলাতে তাদের বাড়ি টালা ব্রিজের পাশে বলেও সুবিধে হলো না। আমাদের ভাস্কো ডা গামা না হোক ফার্দিন্যান্দ ম্যাগেলানের মর্যাদা দিয়ে তখনই ঘর খুলে দেন আর কি! সবুজ পঙ্খের কাজ করা মেঝের বড় বড় ঘরের বাড়ির তিনটি ঘর তো পাবোই, ভাড়াও বেশি নয়। কেবল দু’ভাইকে মাঝে মাঝে একটু শুক্তো, ঘণ্ট রেঁধে খাওয়াতে হবে।  মধ্যচল্লিশের ডিভোর্সি চলে আসার আগে মৃদুকণ্ঠে অত দূরে কল্যাণী যাওয়াটা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতেও ভুললেন না!  

 বেরিয়ে, স্ত্রীর বিস্ময়-উষ্মা-ভস্মদৃষ্টির উত্তরে একটা কথাই বললাম,

 — এঁদের দোষ ধরো না। এঁরা খাস কলকত্তাই। অন্য কলকাতা বোঝেন না! বুঝবেনই বা কী ক’রে? কলকাতা ক’টা জানো? সাতটা।

 — বলছো কি, কলকাতা সাতটা?

 — হ্যাঁ।  

 — কেন?   

— মানে, এই সপ্তস্তর এককেন্দ্রিক বৃত্তসম কলকাতা নামক polymuclear বহুবিস্তারের কেন্দ্রে যে শাঁস আছে, মানে খাস কলকাতা, বা কলকাতা মিউনিসিপ্যাল এরিয়া বা ক্যালকাটা মেট্রোকোর, যার প্রশাসন চালায় কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন। এটা ১৯২৪-এর পয়লা এপ্রিল প্রাক্-স্বাধীনতা শেষ প্রসারণের পরে ৪৯.০৮ বর্গকিমি দাঁড়ায়। এর অধিবাসীরা পায়ের তলায় সর্ষে  থাকা লোক বলতে বুঝতেন টালা-টু-টালিগঞ্জ করা পাবলিক! ১৯৫৩-র পয়লা এপ্রিল টালিগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি এর মধ্যে মিশে যাওয়ার পরে জায়গাটা দাঁড়ায় প্রায় ৫৯.৪২ বর্গকিমি। আস্তে আস্তে আরো অনেক শহরতলির মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্ভুক্তি ও সংযুক্তি জায়গাটাকে বাড়াতে বাড়াতে ১৯৮১-র  লোকগণনা অবধি ১০৪ বর্গকিমিতে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে দমদম পুরসভা ঢুকে আসায় টালা থেকে টালিগঞ্জ যাওয়া লোকদের পায়ের তলার সর্ষে  তেল হয়ে যায়।  

   ঠিকাছে। আমরা না হয় পরেই কলকাতা হয়েছি, তাও আম-কলকাতা, খাস-কলকাতা নই। কিন্তু ওই যে গতবার দার্জিলিং-এ গিয়ে দেখলাম খড়দার লোকও কলকাতা বলছে। তাদের সমান তো নই!

   সমান অসমানের কথা আসছে কোথা থেকে! ওঁরাও কলকাতার লোক, তবে গ্রেটার ক্যালকাটার।  

   সেটা কী বস্তু?

   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শহরের খাদ্যসঙ্কটের দিনে বিধিবদ্ধ রেশনিং-এর আওতায় কারা আসবেন  সেটা ঠিক করতে বৃহত্তর কলকাতার ধারণা আনে ব্রিটিশ সরকার। হুগলী নদীর উভয় পারে চল্লিশ কিমি ধরে দক্ষিণে বজবজ আর উত্তরে হালিশহরের মধ্যে সবকটি মিউনিসিপ্যালিটি এর মধ্যে আসে, আর কলকাতার আয়তনকে ঠেলে নিয়ে যায় ৪৩৪.৫২ কিমি অবধি। ফলে খড়দা কেন, ব্যারাকপুর টিটাগড়-এর লোকও তো কলকাতায় থাকে।

   বাপরে!  এটাই শেষ তো! তিরিশের ডি-তে উঠবে, নাকি দমদম গিয়ে বনগাঁ লাইন ধরবে? দমদম ক্যান্ট-এই বা নামার কী দরকার? তার পরেও তো কলকাতা আছে।   

   সে তো ধরবো! এসব কথা শুনে ওই ডিভোর্সি না হোক বিপত্নীক মূর্ছা যাবেন। কিন্তু এটাও শেষ নয়! ১৯৫১-র সেন্সাসে সরকারের কাজকর্মের প্রাসঙ্গিক একক হিসেবে ধরেছিল ক্যালকাটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিজিয়ন নামে একটি এলাকাকে যার আয়তনে ২৬৩.৯৮ বর্গকিমি এলাকার মধ্যে ছত্রিশটি মিউনিসিপ্যালিটি ছিল।

   তাহলে তো সাইজে কমলো!

   কমা-বাড়া নির্ভর করে কলকাতা সম্পর্কে পারসেপশন-এর উপর! ১৯৬৪-র  পর ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান প্ল্যানিং অরগানিজেশন খাস কলকাতার চারধারে গজিয়ে ওঠা একটা এলাকাগত নিরবচ্ছিণ্ন ইঁটচুণসুরকির ঐক্য যাকে সিএমপিও ক্যালকাটা কোনার্বেশন (conurbation) নাম দেয়। হুগলী নদীর উভয় তীরে দানাবাঁধা কোঠাবাড়ির ঐক্য, কলকাতা, বালী আর নৈহাটির তিনটি রিভার ক্রসিং-এর দ্বারা সংযুক্ত, যার আয়তন আনুমানিক ৩৪৫.৭৫ বর্গকিমি।

 

তিরিশের ডি আসছে না। রোদ চড়ছে। বেলা বাড়ছে। গিয়ে রান্না চড়িয়ে খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। পায়ে পায়ে দীনেন্দ্র স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে আপার সার্কুলার থুড়ি এপিসি রোড বেরিয়ে আমরা ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত খাস কলকাতার গোলবাড়িতে ঢুকি। রুটি মাটনকষা অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে হবে। করবী বলে — ততক্ষণ নয় আর ক’টা কলকাতা আছে জেনে  নিই! আমি বলি আর বেশি নেই! ওই সিএমপিও একটা সম্পূর্ণ ট্রাফিক-ট্রান্সপোর্টেশন প্ল্যানের জন্যে যে এলাকার ছবি আঁকে, যার রূপায়ন করবে ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা সিএমডিএ নামে একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা, তারা যে ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট ডিস্ট্রিক্ট-এর  কথা বলে, তার এলাকা ৮৫৭.৫৭ বর্গকিমি, যার মধ্যে ৩টি মিউনিসিপ্যাল  কর্পোরেশন, ৩১টি মিউনিসিপ্যালিটি, একটা ক্যান্টনমেন্ট, আর ৫০৭টি গ্রামীণ মৌজা পড়ে। সন ১৯৬৬তে এটা আরো বেড়ে ১২৫৫ বর্গকিমি দাঁড়ায়, আর ১৯৭১-এ ১৩৩৩ বর্গকিমি।

 

   ব্যাস! স্টক শেষ! খাবার কিন্তু এখনও আসেনি। সিএমডির মধ্যে দমদম ক্যান্টনমেন্টতো এসে গেল!

    এসে তো গেলই। তোমার হৃদয়পুর ইস্কুল, গোবরডাঙা, শুঁটে বারাসত সব এসে গেল। পরে কলকাতা একটু ছোটো হয়ে গেলেও এসে গেল।  

    ছোটো হয়ে গেল মানে?

   মানে ইয়ে, ১৯৭১-এর লোকগণনায় আরেকটা ধারণা আনা হলো, দিল্লী, কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ এইসব মহানগরের জন্য, তার নাম ‘urban agglomeration’। তাতে ক্যালকাটা আর্বান অ্যাগ্লোমারেশন-এর এলাকা হলো ৩৫৬ বর্গকিমি। সেটা বেড়ে ১৯৮১-র লোকগণনায় ৮৫২.২৩ বর্গকিমি দাঁড়ালো!

  ফিনিশ?

  না, একটা আরো আছে। ক্যালকাটা ইনফ্লুয়েন্স রিজিয়ন।

  সেটা কী?

  এই ডালহৌসি স্কোয়ারে লালদিঘিতে যদি একটা বাঁশের খুঁটি বসিয়ে তাতে একটা দড়ি বেঁধে ১০০ কিমি ব্যাসে ঘোরাও তবে ছটি দক্ষিণবঙ্গের জেলায় যে যে জায়গা পড়বে, যেখান থেকে আমাদের রোজ সকালে টাটকা আনাজপাতি, মাছমাংস আসে ট্রেনের ভেন্ডর কামরায়, বাসে, লরিতে। সেখানকার লোকরা ক্যালকাটা ইনফ্লুয়েন্স রিজিয়ন-এর বাসিন্দে!

   তারাও বলবে আমরা ক্যালকাটান?

   সবাই নয়! হাটুরে, সব্জিওয়ালা, মেছো, ফেরিওয়ালা, এরা এই নিয়ে বোধহয় চিন্তিত নয়। কিন্তু জামাপ্যান্ট পরা চাকরি করতে আসা বাবুরা কী বলবে তা জানি না।

 

খাবার এসে গেছে। খিদেও লেগেছে খুব। দুজনেই খেয়ে নিই। করবী, মানে  আমার বৌ কীসব ভাবতে ভাবতে খায়। তারপর পয়সা মিটিয়ে মুখে মৌরি  দিয়ে উদ্ভাসিত মুখে বলে, চলো ওই দীনেন্দ্র স্ট্রিটে একবার যাই। গিয়ে বলে আসি ওদের বাড়ি নেবো না। আর এই সাত কলকাতার গল্প শুনিয়ে আসি।  আমি বলি, দূর! ওঁদের এসব শুনিয়ে কী হবে? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরবাসের ইতিকথা’ পড়েছো তো! তাতে নেই শহর তার, যে তাকে অর্জন  করে, যে জন্মায় সে কেবল নয়! কলকাতা আমাদেরও। আমরা কলকাতার! বাস এসে গেছে। উঠে পড়ি তাতে।   

               

 

         

 

 

    


পায়েল মণ্ডল

 

সিলভিয়া প্লাথ (পর্ব - ২)




 

(৮)

 

প্লাথের কবিতা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প নয় বরং তিনি সাধারণ মানুষ, সমাজ, গোত্র এবং জাতিসত্তার ক্রাইসিসকেও হলোকাস্ট ইমেজ দিয়ে আঁকেন। তাঁর কবিতায় উঠে আসে ইহুদীদের উপর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নাজী বাহিনীর অত্যাচারের চিত্র। তারা যেন জীবনমৃত। প্লাথ এই ইমেজকে দ্বৈত অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি সেই সময়ে মানুষের উপর অকথ্য নির্যাতনের কথা বলেছেন আর সেটা যেন রূপক হয়ে তাঁর জীবনের ঘটমান অত্যাচারের কথারই ইঙ্গিত দেয় পাঠকদের।

প্লাথের বেঁচে থাকাটা যেন নাজী কনসেনন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে আসা মানুষদের মত। যেন আতঙ্কজনক কল্পনায় বেঁচে থাকাএকটা ভয়াবহ ট্রমার মাঝে বেঁচে থাকা। সেই বেঁচে থাকার জগৎ হলো ডার্ক। বেঁচে থাকাটা প্লাথের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আর আত্মহনন হলো ইচ্ছের পক্ষে। আর সেই কারণে তাঁর স্বেচ্ছামৃত্য একটা মহান অর্থ বহন করে।

কবিতায় তিনি বলেন-

‘A sort of walking miracle, my skin

Bright as a Nazi lampshade!’

-Lady Lazarus

প্লাথের একের পর এক আত্মহননের চেষ্টা আসলে কোন আত্মহত্যা প্রবণতা থেকে আসেনি বরং এটা তাঁর সচেতন সত্তার চরম চাওয়া। তাই যারা তাঁকে বাঁচানোর সাথে জড়িত ছিলেন তাদেরকে প্লাথ ঘৃণা করছেন। কবিতায় তাঁর ইমেজগুলো দেখলেই বোঝা যায় তিনি কতখানি বিরক্ত ছিলেন ওই সব মানুষদের প্রতি। প্লাথ তাঁর এই শত্রুদের চিত্রিত করতে ব্যবহার করেন ‘Herr Doktor’ , ‘Herr Enemy’ এমন সব ইমেজ দিয়ে। প্লাথ কবিতায় প্রকাশ করছেন যে তিনি কতখানি হতাশ এবং বিব্রত হয়েছেন তাঁকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। তিনি আইরনি ব্যাবহার করে কবিতায় বলেন হাসিখুশি মহিলারা কখনো আত্মহত্যার কথা ভাববে না কিন্তু তিনি তেমন নন। তিনি হলেন নয় বার বেঁচে যাওয়ায় একজন অভিশপ্ত মানুষ।

‘And I a smiling woman

I only thirty

And like the Cat I have nine times to die!’

-Lady Lazarus

“A Birthday Present” – কবিতাটি প্লাথ লেখেন ১৯৬২তে। তাঁর আত্মহত্যার প্রায় ছয় মাস আগে। আমরা ধরে নিতে পারি যে কবিতাটা তিনি লিখেছিলেন আত্মহত্যার করার ব্যাপারে একেবারে মনস্থির করার পরেই। জন্মদিনের উপহার শিরোনাম কবিতাটিতেও তিনি কোন ভাবেই আশাবাদী নন। বরং প্লাথ ব্যক্ত করছেন যে কতখানি পার্থিব জীবনের প্রতি তিনি চরম ভাবে নিরাসক্ত। প্লাথ নিজেকেই বিদ্রূপ করছেন একজন সফল মা এবং স্ত্রী হবার তাঁর চেষ্টার প্রতি। প্লাথের এই চেষ্টা যেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় হাস্যকর ব্যাপার।

তিনি বলেন-

‘When I am quiet at my coocking I feel it looking I feel thinking

‘Is this the one I am to appear for,

Is this the elect one, the one with black eye-pits and a scare?

Measuring the flour, cutting off the surplus,

Adhering to rules, rules, rule.

Is this the one for the annunciation?

My god, what a laugh!’

-A Birthday Present

প্লাথ চেষ্টা করছেন একজন সফল মা ও স্ত্রী হতে। কিন্তু তাঁর মনোজগৎ তাঁকে উল্টো দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্লাথ চেষ্টা করেও যে তা হতে পারবেন না তা তিনি জেনে গেছেন। এই ব্যর্থতা তাঁকে আবারো ভাবায় মৃত্যুর কথাআত্মহত্যার মাঝ দিয়ে তিনি পারিবারিক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হতে চান। সেটা বোঝাতে তাঁর কবিতায় চলে আসে এই ইমেজ – ‘to rules, rules, rule।‘ প্লাথের এই মৃত্যুআসক্তি আসে তাঁর পরম একাকিত্ব থেকে তাঁর পাশে এমন কেউ নেই যে তাঁর কথা শুনবে। কথা বলবে। এমন কেউ নেই যে তাঁকে মানসিক ও শারীরিক সঙ্গ দেবে, তাঁকে দেখাশোনা করবে। প্লাথের জগৎ একেবারে সঙ্গীহীন। একা। প্লাথ মৃত্যুকে চান আর মৃত্যুও প্লাথকে।

তিনি উচ্চারণ করেন-

‘My god, what a laugh!'

But it shimmers, it does not stop, and I think it wants me.’

-A Birthday Present

প্লাথ পরিস্কার ভাবে বলে দেন তিনি তাঁর জীবনের উপর চরম ভাবে হতাশ এবং বেঁচে আছেন ঘটনাক্রমে –‘only by accident!’ A Birthday Present কবিতায় এমন ভাবেই নিজের বেঁচে থাকার অর্থ প্রকাশ করেন প্লাথ।  প্রশ্ন উঠতে পারে যে দুই সন্তানের মা প্লাথ তাঁর সন্তানদের জন্যেও তো বেঁচে থাকতে পারেন। উত্তর এমনটাই হতে পারে যে প্লাথ জানতেন তিনি কখনোই একজন ভালো মা হতে পারবেন না কারণ তিনি একজন সফল কন্যা বা স্ত্রী হতে পারেননি। এই ধারণাটা প্লাথের মনে জোঁকের মত বসে ছিলো যেটা থেকে শেষদিন পর্যন্ত মুক্ত হতে পারেননি। তাই তিনি ভেবেছিলেন তাঁর কন্যা মা ছাড়াই যেন বেড়ে ওঠে। তিনি চাননি তাঁর সন্তানরা একজন ব্যর্থ মায়ের ছায়ায় বেড়ে উঠুক। একজন ব্যর্থ মা হিসাবে নিজেকে দেখতে পেয়ে আবারো তাঁর মৃত্যুইচ্ছা তীব্রতর হয়ে ওঠে। 'এ্যা বার্থডে প্রেজেণ্ট’ কবিতায় প্লাথ এই কথাটাই বলেন এভাবে-

‘I do not want much of present, anyway this year.

After all I am alive by accident.

I would have killed myself gladly that time any possible way.’

বিশ্বসাহিত্যে জন্মদিন নিয়ে এমন মৃত্যুময় কবিতার নজির নেই যে কবিতায় কবি তাঁর মৃত্যুর স্বপক্ষে একের পর এক যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন এক অনবদ্য কাব্যময়তায়। মৃত্যুই যেন প্লাথের জন্মদিনের উপহার। প্লাথের কাছে জন্মদিনের উপহারের কোন অর্থ রাখে না। যা তাঁকে দেয়া হবে তাই তিনি নীরবে গ্রহণ করবেন। এই জগতে তাঁর আর কোন কিছুর চাওয়া পাওয়া নেই। প্লাথের এই ইচ্ছে কবিতায় প্রকাশ করেন এভাবে-

‘I will take it and go aside quietly.

You will not even hear me opening it, no paper crackle

No falling ribbons, no scream at the end.’

-A Birthday Present

জন্মদিনে প্লাথের পাশে কেউ নেই তাঁর কথা শোনার জন্য। কথা বলার জন্য। তাঁর কোন কথা শব্দ হয়ে বের হয় না কারন তাঁর আশেপাশে কোন শ্রোতা নেই। আর তাই তিনি কবিতায় বলেন তার সব কষ্ট, অভিমান, একাকিত্বের যন্ত্রণা। প্লাথের কাছে জন্মদিন আর জন্মদিন থাকেনা বরং তাঁর মতে সেটা মৃত্যুদিন হয়ে যায়। আর মৃত্যুই তাঁর জন্মদিনের উপহার।

তিনি মৃত্যুর কোরাস লেখেন-

‘Only let down the veil, the veil, the veil

If it were death

I would admire the deep gravity of it, its timeless eyes.

I would know you were serious.

There would be a nobility then, there would be a birthday.

And the knife not carve, but center

Pure and clean as the cry of a baby,

And the universe slide from my side!’

-A Birthday Present




 

(৯)

 

প্লাথের কাব্যে রঙ এর প্যালেট ও তাদের অর্থ অন্য কবিদের থেকে একেবারে আলাদা। ঠিক যেন ভ্যান গগের পছন্দের রঙ এর মত। তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে আসে সাদা, নীল, লাল, কালো রঙ। এই সব রঙ দিয়ে তিনি তৈরী করেন তাঁর ইমেজারি যার অর্থ ওই সব রঙের সাধারণ অর্থের সমার্থক নয়। বরং তা প্লাথের চিন্তা আর মনের অবস্থার একটা ক্যানভাস। শুধু ‘ম্যাডেলিয়ন’ কবিতায় ব্যবহার করেন একেবারে ভিন্ন রঙ যা অন্য কোন কবিতায় তিনি ব্যবহার করেননি। এই কবিতায় তিনি ব্যাবহার করেন ব্রোঞ্জ, গোলাপি, কমলা ও মেহেদী রঙ।

লাল রঙ প্লাথের অনেক কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে। প্লাথের কাছে লাল হলো জীবনীশক্তি। লালকে তিনি ব্যবহার করেন প্রাণকে বোঝাতে। নীল প্লাথের কাছে বিষণ্ণতার রঙ নয় । তাঁর কাছে নীল হলো মাতৃত্বের রঙ। মাতা মেরীর পোশাক ছিলো নীল। তিনি চিরায়ত মাতৃত্ববোধকে আঁকতে নীলের ছোঁয়া দিয়েছেন তাঁর কাব্যে। ‘Kindness’ কবিতায় আমরা প্লাথের এমন পাগল করা রঙের ব্যবহার দেখি।

‘Kindness glides about my house

Dame Kindness, she is so nice!

The Blue and Red jewels of her ring smoke

In the windows, the mirrors

Are falling with smiles!’

-Kindness

কবিতাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র- ‘ডেম কাইন্ডনেস’ একজন মেয়ে যাকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় সে হাসিখুশি অথচ তার মনোজগৎ একেবারে ভিন্ন। মেয়েটি প্রতি মুহূর্ত যুদ্ধ করছে তার বাহ্যিক ও অর্ন্তজীবনের সাথে। এই দ্বৈত যুদ্ধ করতে যেয়ে মেয়েটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তার বাঁচার ইচ্ছে টুকুও অবশিষ্ট নেই। সে তার মাতৃত্বকে অস্বীকার করছে। মাতৃত্বকে প্লাথ নীল রঙে এঁকেছেন। প্লাথ বলেন – ‘The Blue and Red jewels of her ring smoke!’

প্লাথ জীবনীশক্তিকে – ‘Red jewels’ এর ইমেজ দিয়ে আঁকেন।

‘Kindness’  কবিতাটি প্লাথের জীবনের শেষ লেখা কবিতা। প্লাথ তাঁর জীবনের সব মায়া ত্যাগ করেছেন। সন্তানের প্রতি মায়াও নেই। প্লাথ বলেন-

‘What is so real as the cry of a child?

A rabbit's cry may be wilder

But it has no soul.’

The Fearful কবিতায় প্লাথের রঙ সিলভার। এই রঙের মাধ্যমে প্লাথ কনফিউশনকে বঝাতে চান। এই কবিতাটিতে দুইজন মানুষ টেলিফোনে কথা বলছে। একজন নারী ও আর একজন পুরুষ। তারা দুজনেই মুখোশ পরে আছে। দুজনের মুখোশ ফুটো হয়ে চোখ, নাক, কান আর মুখের জানালা তৈরি করে। তাই মুখোশ পরা অবস্থায়ও তারা কথা বলতে পারে, শুনতে পারে। ফোনে মেয়েটি শুনতে পায় যে তার অপর প্রান্তের পুরুষটির মুখোশ খেয়ে ফেলার মচমচে শব্দ। মেয়ে ও পুরুষ উভয়ে উভয়কে বলেন তারা বাচ্চা চান না। মেয়েটি গর্ভবতি হতে চায় না কারণ সে পুরুষে রূপান্তরিত হতে চায়। এটাই তার পরম চাওয়া। এটা একটা সত্য-সত্তা থেকে মিথ্যা-সত্তার দিকে যাওয়া। মেয়েটি ইলিউশনের মাঝে আছে। আছে ভয়ঙ্কর আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের মাঝে। প্লাথ তাঁর কালার প্যালেট থেকে একটা রঙ বেছে নেন এই ছবিটা আঁকতে আর তা মায়াবস্তব ইমেজ হয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। প্লাথ সিলভার কালার দিয়ে এভাবে আঁকেন সেই ক্রাইসিসকে-

‘Hearing the fierce mask magnify

The silver limbo of each eye

Where the child can never swim

Where there is only him and him.’

রুপালী রঙ চোখকে অর্থাৎ মনের চোখকে দেখতে দেয় না। প্লাথ বোঝাতে চেয়েছেন যে এই রঙ ট্রান্সপারেন্ট যাতে আলো প্রতিফলিত হয়ে বস্তুর কোন ইমেজ তৈরি হয় না। চোখ একটা ভ্রমের মাঝে থাকে। দৃস্টিভ্রম।

 

(১০)

 

প্লাথের মনোজগতের রঙ সাধারণ মানুষের রঙের জগৎ থেকে একেবারে আলাদা। প্লাথ রঙিন ইমেজারি ব্যবহার করে কবিতাতে তাঁর মনোজগতের ছবি আঁকেন। এটা প্লাথিয় মনোজগতের একটা কালার ম্যাট্রিক্স। প্লাথ অনায়াসে পাঠকদের নিয়ে যেতে পারেন তাঁর সেই ম্যাট্রিক্সের কেন্দ্রে। পাঠকরা বিস্ময়ে দেখেন এই মৃত্যকামী কবির রঙের কোলাজ যেখানে তিনি রঙকে কাব্যময় রুপকের মাধ্যমে শব্দচিত্রে পরিণত করেন।

Medallion- প্লাথের এমনি একটি অনবদ্য রঙবাহারি কবিতা। কবিতাটিতে তিনি তাঁর প্রচলিত রঙগুলোর ব্যবহার করা থেকে বের হয়ে আসেন। প্লাথ জীবন আর মৃত্যুর মাঝের সময়কে চিত্রিত করেন অসামান্য চিত্রময়তায়।

Medallion শুরু হয় এমন ভাবে-

‘By the gate with star and moon

Worked into the peeled orange wood

The bronze snake lay in the sun..’

প্লাথ কবিতাটি শুরু করছেন একটা মৃত সাপের ইমেজারি দিয়ে যে সাপের গায়ের রঙ ব্রোঞ্জ। সাপটি সূর্যের আলোয় পড়ে আছেসূর্য জীবনকে বোঝায় আর চাঁদ জীবনের স্পন্দন। প্লাথ সাপটিকে এমন ভাবে রাঙিয়ে দেন। মৃত সাপটির শরীর ব্রোঞ্জ, জিব গোলাপি, চোখ সিঁদুর রঙের। কবিতার বর্ণনায় পাঠকরা সাপটিকে সাপ হিসাবে দেখতে পান না বরং তারা যেন দেখেন বহু মূল্যবান রত্ন খচিত কোন একটি মূর্তি। যে মূর্তিটা তার আত্মার প্রস্থানে প্রতীকীভাবে অবিনশ্বরতা লাভ করছে সূর্যের আলোয়। অর্থাৎ সাপটি অনন্তলোকে আবার পুনর্জন্ম লাভ করছে আর তার সেই লোকাতীত সৌন্দর্যকে প্লাথ এঁকেছেন রঙময় শব্দের ইমেজারি দিয়ে নশ্বর জগতে থাকা সাপের শবকে। প্লাথ পাঠকের চোখকে যেন একটা হ্যালুশিনেসনের মাঝে নিয়ে যান তাঁর রঙ্গিন ইমেজারি ছোঁয়ায়। প্লাথ মৃত্যুকে পাঠকদের সামনে উপস্থিত করেন  রঙময়তায় মৃত সাপের রঙ্গিন শবদেহের ইমেজারিতে। আবারো প্লাথ মৃত্যুকে পুনর্জন্মের পথ হিসাবেই দেখছেন। তাই তিনি বলেন – ‘By the gate with star and moon.’

 

(১১)

 

প্লাথের জীবনের শেষ কবিতা এজ। কবিতাটিতে রঙের ব্যাবহার যেন ফিকে হয়ে এসেছে। আত্মহত্যার মাত্র ছয় দিন আগে লেখা এই কবিতাটিতে তিনি যেন মথোজীবি হয়ে উঠেছেন। তিনি এক গ্রীক মিথকে ব্যবহার করেন তার মনের অবস্থাকে আঁকতে। মুক্তছন্দে লেখা কবিতাটি তার মৃত্যুর আগের মানসিক শব্দছাপ। এই কবিতাটির পরে প্লাথের কলম থেকে আর কোন লেখা বের হয়নি আর তাই কবিতাটি বিশেষভাবে অর্থবহ প্লাথের মৃত্যু পূর্ববর্তী মানসিক অবস্থা জানার জন্য।

কবিতাটিতে একজন মহিলার কথা বলা হচ্ছে যিনি মৃত্যুর মাধ্যমে তার জীবনের পূর্ণতা পায়। মৃত্যুটি স্বাভাবিক নয়। সে আত্মহত্যা করেছে। মৃত মহিলার শরীরে হাসির মুদ্রা জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ সে যে মৃত্যুকে বরণ করেছে তা নিছক দুর্ঘটনা নয় বরং সেটা ছিল একেবারে পরিকল্পিত। সে প্রশান্তিময় মৃত্যুবরণ করেছে। প্লাথ এই দৃশ্যকে আঁকেন এমন ভাবে-

‘Body wears the smile of accomplishment,

The illusion of a Greek necessity’

প্লাথ সোপেন হাওয়ারকে নাকচ করে দেন। সোপেন হাওয়ার আত্মহত্যাকে নাকচ করেছেন। তিনি মনে করেন যে আত্মহত্যা হলো একটা নৈতিক আপরাধ। প্লাথ হয়তো টমাস স্যাজের মতামতকেই আত্মস্থ করেছিলেন। স্যাজ মনে করেন যে আত্মহত্যা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। মানুষ তাদের নিজের জীবন যেমন ভাবে ইচ্ছে যাপন করবে এমনকি সে তাঁর নিজের জীবন নিজেও ধ্বংস করার অধিকার রাখে।

গ্রীক মিথকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করে প্লাথ তাঁর অবচেতন মনের ছবি আঁকেন কবিতাটিতে। মিথের গল্পটি এমন। এক জন মহিলা যিনি আত্মহত্যা করেছেন। তার পা দুটি নগ্ন। শবদেহ তখনো ‘টগো’ (গ্রীসিয়ান পরিধেয়) দিয়ে আবৃত। তার পাশে দুজন শিশু দ হয়ে শুয়ে আছে। তারাও মৃত। এই মৃত শিশুরা মহিলাটিরই সন্তান। মহিলাটি তার দুই শিশু সন্তানকে নিয়েই অনন্তলোকে যাত্রা করেন স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে। প্লাথেরও দুইটি শিশু সন্তান ছিল ঠিক কবিতাটির গল্পের মত। প্লাথের অবেচেতন মন চাইছিলেন তার সন্তান সহ আত্মহত্যা করতে।

শিশু দুটিকে প্লাথ সাদা সাপের ইমেজারিতে বর্ননা করেন। সাদা হলো প্লাথের মৃত্যুর রঙ। তাদের পাশে রাখা শূন্য দুধের পাত্রের ইমেজারি দিয়ে প্লাথ চিত্রায়ন করেন শিশু দুজনের মৃত্যুর পরে তাদের মায়ের জঠর কেমন ভাবে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

প্লাথ ভয়াবহ নেতিবাচক মৃত্যকে এক অনবদ্য শব্দচিত্রে রূপায়ন করেন এভাবে-

‘Each dead child coiled, a white serpent,

One at each little

Pitcher of milk, now empty

She has folded‘

প্রশ্ন উঠতে পারে যে একজন মা কী তার সন্তানদের হত্যা করতে পারে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে প্লাথের সেই সময়ের মনের অবস্থায়। প্লাথ চরমভাবে একাকিত্বে ভুগছিলেন, তার সাথে একিউট স্কেটযোফ্রেনিয়া। প্লাথের মন ছেয়ে ছিল নিরাপত্তাহীনতায়। প্লাথের অবচেতন মন ভাবছিলো তাঁর মৃত্যুর পরে হয়তো তাঁর দুই শিশু কখনই এই মরণশীল বাস্তবতায় নিরাপদ নয়। আর তাই তাদেরকে নিয়েই প্লাথ অনন্তলোকে যাত্রা করতে চান। কি এক অসম্ভব একাকীত্বের মাঝে এই প্রতিভাবান কবিকে সময় পার করতে হয়েছে যেখানে কেউ কোথাও নেই তাঁকে এবং তাঁর সন্তানদের পাশে দাঁড়াবার।

কবিতাটিকে শুধু মাত্র একটা সুইসাইড নোট বা অবজেক্টিভ কবিতা মনে করলে মনে হয়ে ভুল ভাবা হবে। কবিতিটি কাব্যময়তায় ভরপুর। প্লাথ এই কবিতাকে কয়েক বার কাটাছেঁড়া করেন। প্লাথ অনবদ্য ইমেজারি ব্যবহার করে তাঁর ভাবনাকে আঁকেন চিত্রময়তায়। এমনকি শিশুদের মৃত্যু দৃশ্য তাঁর কল্পনায় এমন-

‘Them back into her body as petals

Of a rose close when the garden

Stiffens and odors bleed

From the sweet, deep throats of the night flower.’

তাদের মৃতদেহের চিত্র ক্রমদৃশ্যমান হয় গোলাপের পাপড়ির ঝরে যাবার দৃশ্যের মত। অন্য কবিরা ফুল আর বাগানের ইমেজারি ভালোবাসা আর যৌন আবেদনকে চিত্রায়িত করার জন্য ব্যবহার করলেও প্লাথ ব্যবহার করছেন সম্পূর্ন ভিন্ন অর্থে। প্লাথের এই কবিতায় ফুল আর বাগানের ইমেজারি চিত্রায়ন করে একটা বহুবর্নময় মৃত্যু দৃশ্যের। উল্লেখ্য এমন ফ্লোরাল ইমেজারি দিয়ে মৃত্যু দৃশ্য আর এক জন কবি এঁকেছিলেন; সে হলেন জন কিটস তাঁর কবিতা –“La Belle Dame Sans Merci” তে। কিটস ও প্লাথের মাঝে পার্থক্য এই যে কিটস মৃত্যকামী কবি ছিলেন না আর প্লাথ ছিলেন মৃত্যকামী কবি যার কবিতায় তাঁর নিজের মৃত্যুর কল্পচিত্র বারবার ফিরে এসেছে।




 

(১২)


দ্যা বেলজার!’ সিলভিয়া প্লাথের লেখা একমাত্র উপন্যাস। উপন্যাসটি এক অর্থে তাঁর নিজের জীবন কাহিনিও বলা চলে। প্লাথের ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেসনের সময় তাঁর মনোজগৎ আর সেই সময় তাঁর দেখা চারপাশের মানুষ, সমাজ, আর তাদের ক্রাইসিসকে নিয়েই গড়ে উঠেছে দ্যা বেলজারের কাহিনি। উপন্যাসটি শুধু কোন গল্পের বর্ণনা নয় বরং এটা প্লাথের একটা মানসিক যাত্রার অনবদ্য স্বীকারোক্তি।

প্লাথের মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় লন্ডনে তাঁর ছদ্মনামভিক্টোরিয়া লুকাস’ এর নামে। উপন্যাসের নায়িকা বা কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো এস্থার গ্রীনউড। পটভূমি ১৯৫৩ সালের এক গ্রীষ্মে যখন গ্রীনউড নিউইয়র্ক এর এক নামজাদা পত্রিকায় ইনটার্নশিপ শেষ করে বোস্টনে ফিরে আসে আর সেখানে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। উপন্যাসটির শুরুতেই আমরা দেখি নিউইয়র্কের চাকচিক্যময় এবং সদাব্যাস্ত পরিবেশে থেকেও একা বোধ করে। সেখানকার মানুষের সাথে তিনি একাত্ব হতে পারে না। অর্থাৎ গ্রীনউড বা প্লাথ একজন এলিয়েনেটেড অস্তিত্ব।

উপন্যাসের ঘটনার সময়টা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধউত্তর সময়। স্থান আমেরিকা। এই যুদ্ধের পরে আমেরিকা বিশ্বব্যাপি একটা পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দেশ বিশ্বব্যাপি নিওকলোনিয়াল সম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে যার ফলে ঐ দেশের সমাজ, মানুষের জীবনযাত্রা ও মনোজগত ব্যাপক ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল। ভোগবাদী সমাজের প্রথম ধাপে পা রাখছিল আমেরিকা। ঠিক এমন এক সময় বেলজারের ঘটনা ঘটছে। আর বেলজারের প্রটাগনিস্ট গ্রীনউড এমনই সময়ের মানুষ।

বেলজারের কাহিনি উপন্যাসটির নায়িকার মনোজগতের। সে যা দেখে, যা ভাবে, অনুভব করে, তার ভয়, তার দ্বন্দ্ব, তার প্রেম, শারীরিক সম্পর্ক এবং এসবের উপর তার ভাবনা উপন্যাসের গল্প। এ ধরনের গল্প বলার ঢঙ হয়তো পাঠকদের এটা ভাবায় যে উপন্যাসটা একেবারে সাব্জেক্টিভ। প্লাথ এই সীমাবদ্ধতা থেকে কাটিয়ে উঠেছেন। তিনি তাঁর কবিতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন অসাধারণ ভাবে। আর তাই তিনি দ্যা বেলজারে মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর ব্যাক্তিগত উপলব্ধিজাত অনুভূতির সাথে তাঁর চার পাশের মানুষদের মনোজগতও। আর এখানেই প্লাথ হয়ে উঠেন একজন মাস্টার নভেলিস্ট

 

(১৩)


বেলজারের কাহিনী গড়ে উঠেছে প্লাথের আত্মজীবনীর ছায়ায় । বেলজারের কেন্দ্রীয় চরিত্র এস্থার গ্রীনউড প্লাথ স্বয়ং। ইমেজিজম এর ধাঁচে লেখা উপন্যাসটির কাহিনি এমন ভাবে গড়ায়। ম্যাসাচুসেটস থেকে নিউইয়র্কে আসে তরুণী এস্থার গ্রীনউড একটা নাম করা পত্রিকা অপিসে একমাসের ইনটার্নশিপ করার জন্য । সে একটা লেডিস হোস্টেলে ওঠে। সেখানে সে পরিচিত হয় ওখানে বসবাসকারী দুজন তরুণীর সাথে। অচিরেই তারা বন্ধু হয়ে যায়। গ্রীনউড যদিও তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি নির্লিপ্ত কিন্তু তরুণী দুজনের আব্দারে একটা পার্টিতে যোগ দেন। পার্টি থেকে ফিরে এসে গ্রীনউড ফুড পয়জনিং এ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সময় তার ভাবনার জগতে এটা নাড়া দিয়ে যায় যে সে এখনো কুমারীই থেকে গেছেন। তার কাছে জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে । সে ভাবে। কিন্তু কোন উত্তর পায় না যে কেন সে এখনো কুমারী থেকে গেছে। সে মনস্থির করে যে এক জন পুরুষের সাথে অতিসত্বর যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা উচিৎ। এরই ধারাবাহিকতার মাঝে সে এক জন ইউ এন ইন্টারপ্রেটারের সাথে মিলিত হতে চায় । কিন্তু ছেলেটি যৌনতার বিষয়ে শীতলতা প্রকাশ করলে গ্রীনউডের চেষ্টা ভেস্তে যায়।

ছেলেটির শারীরিক সম্পর্কে শীতলতা গ্রীনউডকে হীনমন্যতায় ফেলে দেয়। সে ভাবতে থাকে যে নিঃশ্চয় নারী হিসাবে তার এমন কোন অপূর্ণতা আছে যার জন্য হয়তো ছেলেটি তার প্রতি আকর্ষিত হয়নি। এই অনুভূতি তাকে তাড়িত করে অন্য এক পুরুষ সঙ্গী খোঁজায়। নব্য পরিচিত পুরুষ মার্কোর সাথে একটা ব্লাইন্ড ডেটে যায় গ্রীনউড। উদ্দেশ্য হলো শারীরিক মিলনের। কিন্তু মার্কোর শারীরিক ভাষা গ্রীনউডের কাছে মনে হয় ধর্ষণের মূদ্রা। আর তাই তার সাথে সে মিলিত হতে পারে না।  মার্কোর সাথে তিক্ত অভিজ্ঞতার পরে গ্রীনউড ভাবতে থাকে একটা সংসার জীবনে থিতু হলে কেমন হয়। এই সময় সে তার কলেজ জীবনের বন্ধু বাডি উইলিয়ামের সাথে দেখা হয়ে যায়। বাডি যক্ষ্মা রোগে ভুগছিল। একটা স্যানেটরিয়ামে তার চিকিৎসা চলছিল। বাডি কথা দেয় সুস্থ হয়ে উঠলে সে গ্রীনউড কে বিয়ে করবে।

আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বাডি আর গ্রীনউডের জুড়িটা ছিলো দারুণ মানানসই। বাডি দেখতে সুন্দর, তার ব্যবহার অমায়িক, সে ভদ্র এবং জীবনে উন্নতি করতে চায়। গ্রীনউডের জন্য এমন এক জীবন সঙ্গী নিঃসন্দেহে সোনায় সোহাগাপাত্র হিসাবে বাডির সব আছে শুধু একটা গুণ ছাড়া যা গ্রীনউডকে ধাক্কা দিয়ে যায়। বাডি কবিতা বোঝে না। হয়তো সেটাকে গ্রীনউড মেনে নিতো কিন্তু সে যখন জানতে পারলো যে বাডি তার আগে অন্য মেয়ের সাথে শারিরীক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে, সে তার সাথে আর এগোতে পারেনি। বাডিকে তার মনে হয় একটা চরম স্বার্থপর মানুষ। গ্রীনউডের কুমারীত্ব ভাঙার স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। গ্রীনউডের অবচেতন মন আসলে চাইছিলো যে যেহেতু সে এক জন কুমারী তাই এক জন কুমার পুরুষের সাথেই যেন তার প্রথম দৈহিক মিলন ঘটে। গ্রীনউড অর্থাৎ প্লাথ যৌনতার ক্ষেত্রে এমনি রক্ষণশীল।

গ্রীনউড বোস্টনে ফিরে যায়। সে আবার রাইটিং ক্লাসে যোগ দিতে চায় কিন্তু তাকে ক্লাসে নেয়া হয় না। রাইটিং ক্লাসে তাকে না নেয়াটা গ্রীনউডের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে। এতে করে সে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়ে বিক্ষিপ্ত চিন্তা তার মনকে গ্রাস করে। সে নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে ফেলে।  এমনকি তার মায়ের সাথেও কথাবার্তা প্রায় বন্ধের পর্যায়ে পৌঁছে মনস্থির করে যে সে উপন্যাস লেখা শুরু করবে এর সাথে শর্টহ্যান্ড লেখার ট্রেনিং নেবে আর তার অসম্পূর্ণ থিসিসটা শেষ করবে।

 

(১৪)


গ্রীনউডের অবস্থা ক্রমঅবনতি হয়। সে তার চারপাশের মানুষজনদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় না বরং পড়া, লেখা, ঘুম এমনকি স্নান করা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। এমন অবস্থায় তার মা তাকে মানসিক চকিৎসক ড. গর্ডনের কাছে নিয়ে যান। ড. গর্ডন গ্রীনউডকে ইলেকট্রিক শক থেরাপি দেবার জন্য প্রেসক্রাইব করেন।

ড. গর্ডনের জঘন্য শক থেরাপিতে গ্রীনউডের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার আরো অবনতি হয়। গ্রীনউড মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে থাকেন নিজেকে নেরে ফেলার। এরই ফলশ্রুতিতে সে নিজের হাতের রগ কেটে ফেলেন। কিন্তু সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যায় দ্রুত চিকিৎসা দেয়ার জন্য।

গ্রীনউডের আত্মহত্যার প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। গলায় ফাঁস দিয়ে মরার পরিকল্পনা করতে থাকে সে। কিন্তু তাদের বাড়ির সিলিং নীচু হওয়ার ফ্যানের সাথে ফাঁস দিয়ে মরার চেষ্টা করা সম্ভব হয়না।

সাগরে সাঁতার কাটতে যেয়ে ডুবে মরার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তার বন্ধু সে যাত্রায় তাকে উদ্ধার করে। গ্রীনউডের ডুবে মরা হয়না। কিন্তু আত্মহত্যার প্রচেষ্টা সে পুরো মাত্রায় চলাতে থাকে। আর তাই একদিন বাড়ির বেসমেন্টের নীচে যেয়ে এক গাদা ঘুমের অষুধ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন। তিনদিন পরে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় ও তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তার মরার এই প্রচেষ্টাও বিফলে যায়।

গ্রীনউড এই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় কোন শারীরিক ক্ষতি ছাড়াই। একটু সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে সিটি হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগে পাঠানো হয়। কিন্তু সে যেন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে যে কিছুতেই চিকিৎসা নেবে না। অর্থাৎ তার বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও অবশিষ্ট নেই।

ঘটনাক্রমে বিখ্যাত উপন্যাসিক ফিলোমিনা গুনিয়া এস্থার গ্রীনউডের স্কলারশীপের ব্যবস্থা করেন এবং তাকে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। প্রাইভেট হাসপাতালে এসে সেখানকার সেবা ব্যবস্থা এবং নার্স, ডাক্তারদের আন্তরিকতা দেখে গ্রীনউড মনবল ফিরে পায়। ড. নোলান নামের একজন মহিলা সাইকিয়ার্টিস্ট গ্রীনউডের চিকিৎসা শুরু করেন। গ্রীনউড ক্রমান্বয়ে সুস্থ হতে থাকেন। ড. নোলান তাকে টক থেরাপী, ইন্সুলিন ইনজেকশন, এবং নিয়ন্ত্রিত ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় জোয়ান নামের এক তরুণীর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। জোয়ান গ্রীনউডের মতই মানসিক রোগে ভুগছিলো। গ্রীনউডের সাথে তার বন্ধুত্ব বেশীদিন স্থায়ী হয় না। কারণ জোয়ান ছিল একজন লেসবিয়ান এবং সে গ্রীনউডের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছিলো।

এর মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে সময় সময় হাসপাতালের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এমনই এক বাইরে সময় কাটানোর দিনে গ্রীনউড তার বহুল আকাঙ্ক্ষিত কুমারিত্ব হারান ম্যাথ প্রফেসর আয়ারউইনের সাথে মধুর মিলনের মাধ্যমে। মিলন সমাপ্ত হতেই গ্রীনউডের শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হতে থাকে। তাকে হাসপাতালে এমারজেন্সিতে ভর্তি করা হয় এবং দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়।

এর কয়দিন পরে বাডি আসে গ্রীনউডের সাথে দেখা করার জন্য। তারা উভয়ই বুঝতে পারে যে তাদের সম্পর্ক এখন আর অটুট নেই। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে গ্রীনউডকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাড়ী ফিরে সে উইন্টার সেমিস্টারে ভর্তি হবার জন্য তৈরী হতে থাকে। এসময় এস্থার গ্রীনউড নিজেকে অনেক সুস্থ মনে করতে থাকেন । কিন্তু তার মনের কোণে একটা আশংকা থেকেই যায় যে যেকোন মুহুর্তে বিষণ্ণতার ‘বেলজারের’  (ফ্লানেল আকৃতির কাঁচের জার)  মাঝে সে আবার আটকা পড়তে পারে।

খুব সংক্ষেপে দ্যা বেলজারের কাহিনী এমন।





 

(১৫)


দ্যা বেলজার প্রকাশের সালে অর্থাৎ ১৯৬৩তে এই বিস্ময়কর মেধাবী কবি তাঁর জীবনের ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটান। তারিখটা ফেব্রুয়ারী ১১। প্লাথের আত্মহত্যার পদ্ধতিটা ছিলো বর্নাঢ্যময়। তখন তাঁর বয়স মাত্র তিরিশ।  আগের মাসে অর্থাৎ জানুয়ারীতে প্লাথ তাঁর ব্যাক্তিগত চিকিৎসক ড. হোভার্ডের সাথে কথা বলেন। তিনি জানান কিভাবে গত ছয় সাত মাস ধরে ডিপ্রেশন তাকে জেঁকে ধরেছে। তিনি আরো ব্যক্ত করেন কিভাবে আত্মহত্যা প্রবণতা তাঁকে ক্রমাগত গ্রাস করছে। তিনি ঐসব ডার্ক ভাবনা থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারছেন না। এ্যাকিউট ডিপ্রেশনের কারণে প্লাথ প্রাত্যহিক কাজগুলিও গুছিয়ে করতে পারছিলেন না। আর ডিপ্রেশনের সাথে যোগ হয়েছিল অনিদ্রা। গাদা গাদা ঘুমের ওষুধ খেয়েও তাঁর ঘুম ঠিক মত হচ্ছিলো না। মাঝরাতে প্লাথের ঘুম ভেঙ্গে যেত। বাকীরাত ঘুমহীন কাটতো। শেষ রাতের নির্জনতা তাঁর কাছে অসহ্য মনে হতো। আর এই মানসিক যন্ত্রণার মাঝে প্লাথ দ্রুত ওজন হারাতে থাকেন। এক মাসে তাঁর ওজন কুড়ি পাউন্ড কমে যায়। প্লাথের ব্যাক্তিগত চিকিৎসক তাঁকে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগস প্রেসক্রাইব করেন। কিন্তু কোন ওষুধই তখন আর কাজ করছিলো না। বরং তাঁর ডিপ্রেশন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। 

হাড়হিম এক শীত সকাল। ফেরুয়ারী ১১, ১৯৬৩। দুই বাচ্চাকে দেখাশোনা করতে নার্সের আসার কথা ছিলো সকাল নয়টায়। যথা সময় নার্স আসে কিন্তু প্লাথের ফ্লাটে সে প্রবেশ করতে পারেনা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। মাংস পোড়ার বিদঘুটে গন্ধে শ্বাস নেয়া ভার। নার্সের চিৎকারে আশে পাশের লোকজন ভীড় করে প্লাথের ফ্লাটের দরজায়। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা প্লাথের আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মৃত শরীর আবিস্কার করে। কোলাহলে বাচ্চা দুটো ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। তারা জানে না যে তাদের মা আর এই জগতে নেই। মেয়ের বয়স দুই আর ছেলের এক।

ঐ দিন অন্য রাতের মতই প্লাথের মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি তাঁর চিকিৎসকের কাছে একটা নোট লেখেন। এর পরে রান্না ঘরে চলে যান একটা ভেজা তোয়ালে নিয়ে। মেঝে আর দরজার মাঝের ফাঁকটুকু ভেজা তোয়ালেটি দিয়ে সিল করে দেন। পাশের ঘরে তাঁর দু সন্তান তখন গভীর ঘুমে। প্লাথ স্টোভে মুখ দিয়ে গ্যাস ছেড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেন। নিমেষে আগুন প্লানেট আর্থের এক প্রতিভাধর কবিকে নিয়ে যায় তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত সময়হীনতার জগতে যেখানে তাঁর ‘ড্যাডি’ অপেক্ষা করছে অভিমানী কন্যাকে বরণ করতে।