কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১১৩ / একাদশ বর্ষ : তৃতীয় সংখ্যা




গত ২৪শে বৈশাখ আমি সস্ত্রীক গেছিলাম বোলপুর-শান্তিনিকেতন। আমার সহযাত্রী ছিলেন সপরিবার কবি অনিরুদ্ধ সুব্রত। যাবার কথা ছিল সস্ত্রীক বিমান মৈত্ররও। কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি শেষপর্যন্ত যেতে পারেননি। আমরা সবাই আমন্ত্রিত ছিলাম শান্তিনিকেতনের মুদ্রিত ও অনলাইন ‘ভুবনডাঙা’ পত্রিকার ২৫শে বৈশাখ সংখ্যা প্রকাশ ও কবিতা পাঠ এবং আলোচনার জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে। আমাদের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন পত্রিকার পক্ষ থেকে আমিনুল ইসলাম এবং রুদ্র কিংশুক। আমরা খুবই উৎসাহিত ও উল্লসিত ছিলাম জীবনে এই প্রথম ২৫শে বৈশাখ শান্তিনিকেতনে একই দিনে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রজয়ন্তী ও ‘ভুবনডাঙা’ পত্রিকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য লাভ করে। আমি অবশ্য  ব্যক্তিগতভাবে নিতান্ত ছেলেবেলা থেকে শান্তিনিকেতনে যাবার ও থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার মায়ের এক মামা প্রয়াত যদুপতি বসু ছিলেন সেই রবীন্দ্রনাথের সময়কাল থেকে কলাভবনের শিল্পী ও শিক্ষক। বিখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেইজ সবাই ছিলেন আমার দাদুর বন্ধু ও সহকর্মী। আমার অস্পষ্ট মনে পড়ে, আমি ও মা দাদু-দিদার সঙ্গে সেই ছেলেবেলায় যেতাম ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসু, প্রবোধচন্দ্র সেন এবং আরও অনেকের শান্তিনিকেতনের বাসভবনে। বড় হয়েও বেশ কয়েকবার শান্তিনিকেতনে গেছিলাম বিভিন্ন সময়ে। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাসভবনেও গেছিলাম। ড. ভবতোষ দত্তর বাসভবনেও। কিন্তু এতবার শান্তিনিকেতনে যাওয়া আসা সত্ত্বেও কখনও ২৫শে বৈশাখ যাওয়া হয়ে ওঠেনি।  এমনকি কখনও পৌষমেলাতেও যাওয়া হয়নি, শুধু একবার ভাঙামেলার দিনগুলিতে শান্তিনিকেতনে ছিলাম। যাইহোক যে জন্য এই সম্পাদকীয় লিখতে বসেছি, তাতে একইসঙ্গে আশা ও হতাশার কথা উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি। শুধু হতাশাই নয়, নিরাশার কথাও। ২৪শে ও ২৫শে বৈশাখ বোলপুরে অবস্থান করেও বোলপুরে এবং  শান্তিনিকেতনে কোথাও রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী পালনের কোনো অনুষ্ঠানের সন্ধান পাইনি। কানে ভেসে আসেনি এককলিও রবীন্দ্রসঙ্গীত। এমনিতে বিশ্বভারতীর দরজা তো বিশ্বের আমাদের মতো মানুষজনদের জন্য প্রবেশ নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে যতবার শান্তিনিকেতনে এসেছি, বিশ্বভারতীর প্রতিটি কোণে কোণে ঘুরে বেড়িয়েছি। মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন আশ্রম রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে পরিণত হয়েছিল বিশাল মহীরুহে। বিশ্বের মানুষকে তিনি আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ কী আশ্চর্য! সেই বিশ্বভারতীর দ্বার আজ রুদ্ধ বিশ্বের মানুষের কাছে। এবং যেহেতু রুদ্ধ, তাই এবছর বিশ্বভারতীর অন্দরে রবীন্দ্রজয়ন্তী কীভাবে পালিত হলো, অথবা আদৌ পালিত হয়েছে কিনা, কিছুই জানা হলো না, দেখা হলো না। তাই খুব স্বাভাবিক ও সঙ্গত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগে, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ কি ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে  পড়েছেন? তাঁকে আর প্রয়োজন নেই বিশ্বভারতীর? বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম জানতে পারছি, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকদের কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখা নাকি শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠ্যসূচির সিলেবাসে থাকা আর জরুরি নয়! রবীন্দ্রভাবনা নাকি ক্রমশ তামাদি হয়ে গেছে! আমি খুবই সামান্য সাধারণ মানুষ, তাই এব্যাপারে আমার কোনো অভিমত প্রকাশ করা হয়তো সঙ্গত হবে না, কিন্তু মনের মধ্যে যে দুঃখ ও ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে, তা তো প্রকাশ করতেই পারি! বেশ কিছুদিন থেকেই শুনছি, শান্তিনিকেতনে আর শান্তি নেই। আর এবছর শান্তিনিকেতনে পৌঁছে আমার মনে হলো, শান্তিনিকেতনে আর রবীন্দ্রনাথও নেই।

তবে আমার মনের এই দুঃখ ও ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, সোনাঝুরিতে আয়োজিত ‘ভুবনডাঙা’ পত্রিকার ২৫শে বৈশাখ সংখ্যা প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে। সেই অনুষ্ঠানে আমি একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং কবিতা কেন্দ্রিক আলোচনায় ঋদ্ধ হয়েছি। অত্যন্ত আন্তরিক এই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রশান্ত গুহ মজুমদার, তানিয়া গুহ মজুমদার, কৃশানু গুহ মজুমদার, মুরারি সিংহ, যূথিকা চৌধুরী, সৌরভ বর্ধন, নীপবীথি ভৌমিক, প্রকাশ ঘোষাল, হরিত বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, স্বপন দত্ত, সোমা মুখোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র রায়, দেবব্রত রায়, নিয়াজুল হক, মৌমিতা মিত্র এবং আরও অনেকে। অনুষ্ঠানস্থল ছিল মনীষা মিশ্রর শ্রমণা আর্ট গ্যালারি। আমিনুল ইসলাম ও রুদ্র কিংশুকের প্রতি জানাই আমার শুভেচ্ছা এবং কৃতজ্ঞতা। আর খুব ভালো লেগেছে বিশ্বভারতীর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. উমাশঙ্কর মালিকের বাসভবনে গিয়ে। উমাশঙ্করবাবু, তাঁর স্ত্রী শিক্ষিকা পাপিয়া মালিক এবং কন্যা সাহিত্য গবেষণার ছাত্রী পৌলমী মালিকের সঙ্গে কয়েক ঘন্টা উপভোগ্য সময় কাটিয়েছিলাম।

সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩০




এই পর্বে আমরা ইউরোপের মাঝের কয়েকটা প্রতিবেশী দেশের সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব। দক্ষিণ দিক থেকে ক্লকওয়াইজ যদি ওপরে উঠি, তাহলে পরপর দেশগুলো দাঁড়ায়ঃ হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র এবং পোল্যান্ড।

এই লেখা আমি শুরু করব এক ছোট্ট ইতিহাস দিয়ে যা আমার পাঠক-পাঠিকারা আমার থেকেও নিশ্চয় বেশি জানেন। আসলে কেন এই চারটে দেশকে বেছে নিলাম, সেটা পরিষ্কার না করলে অনেকের ভুরু কুঁচকে থাকবে, তাই। ১৮৬৭ সালে অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি মিলে এক যৌথ মিলিটারি রাজত্ব শুরু করে যা অস্ট্রো-হাঙ্গেরি রাজত্ব বলে পরিচিত। এই যৌথ রাজত্ব ছিল ইউরোপের ইতিহাসে রাশিয়ার পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজত্ব এবং কেউ একে ঘাঁটাতে সাহস পেত না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই জোট জার্মানির পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু জার্মানির হার হচ্ছে দেখে এরা সেখান থেকে সমর্থন তুলে নিতে বাধ্য হয়। তারপর ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি আলাদা ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে আরো কয়েকটা দেশ তৈরি হয়, যার মধ্যে চেকোস্লোভাকিয়া (চেক ও স্লোভাক মিলে এই দেশ ছিল) ও পোল্যান্ড দুটো। কিন্তু এই চার দেশের এক সাদারন ইতিহাস আছে – এরা কোন না কোন সময় নাৎসিদের কাছে পদানত ছিল। নাৎসিদের অত্যাচার সহ্য করেছে। এরপর আরো কিছু ইতিহাস আছে, সেগুলো আমাদের তুলে আনার দরকার নেই, কিন্তু এটা ঠিক – আমাদের আজকের বাছাই এই চার দেশ সিনেমার ইতিহাসে অন্য বেশ কিছু দেশের থেকে অনেকটা এগিয়ে। 

হাঙ্গেরির সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি সেই বিশ শতকের শুরু থেকেই সক্রিয়। কিন্তু দুটো বিশ্বযুদ্ধ এই দেশের সিনেমায় প্রচুর প্রভাব ফেলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাইকেল কার্তিজ (কাসাব্লাঙ্কা ছবির পরিচালক) বা আলেকজান্ডার কর্দা (দ্য থার্ড ম্যান ছবির পরিচালক) হাঙ্গেরি ছেড়ে হলিউড বা গ্রেট ব্রিটেন চলে যান। হাঙ্গেরির একনায়ক নিকোলাস হর্তি যেহেতু নাৎসিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন, ওদেশে তাই ইহুদীদের কাজের ওপর কোপ পড়ে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন একে একে প্রাইভেট স্টুডিয়ো বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ১৯৪৬ সালে ওখানে কোন ছবি মুক্তি পায়নি। পঞ্চাশের দশক থেকে হাঙ্গেরির ছবি আবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে।

যে যে ছবি হাঙ্গেরির সিনেমার ইতিহাসে উজ্জ্বল, সেগুলোর কয়েকটা হল - দ্য বয়েজ অব পল স্ট্রীট (১৯৬৮), দ্য উইটনেস (১৯৬৯), লাভ (১৯৭০), ক্যাটস প্লে (১৯৭২), ফিফ্থ সিল (১৯৭৬), হাঙ্গেরিয়ানস্ (১৯৭৮), মেফিস্টো (১৯৮১), দ্য মিডাস টাচ (১৯৮৮), সাটানটাঙ্গো (১৯৯৪), সান অব সোল (২০১৫) ইত্যাদি। আজ আমরা এর মধ্যে মেফিস্টো নিয়ে আলোচনা করব।

গ্রীক দৈত্য মেফিস্টোফিলিসের গল্পটা মনে আছে? যার কাছে ফাউস্ট নিজের আত্মা বেচে দিয়েছিল? সাবো ইতভানের ১৪৪ মিনিটের ছবি ‘মেফিস্টো’ এক রাজনৈতিক ড্রামা, যা এক অপেরা অভিনেতা ক্লাউস মারিয়া ব্রান্দর-এর ফাউস্ট  নাটকে মেফিস্টোফিলিসের সফল অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে। এই সিনেমায় উনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের জার্মানির এক অপেরা অভিনেতা, নাৎসি নেতাদের কথামত যাকে স্টেজ অভিনয় করতে হয়। এবং মেফিস্টোফিলিসের অভিনয় করতে করতে যার নিজের সত্বা ঢাকা পড়ে গেছে। তার বন্ধুরা, তার স্ত্রী সবাই নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে একে একে চলে গেছে। সে তবুও অক্লান্তভাবে অভিনয় করে চলেছে যাতে নাৎসি নেতাদের থেকে সে এক সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পারে। তাহলে ছবির নাম মেফিস্টো কেন? কারণ ক্লাউস কিছু সামাজিক উন্নতির লোভে তার নিজের আত্মাকে নাৎসিদের কাছে বন্ধক রেখেছে।

এই ছবিকে আমি এগিয়ে রাখি মূলত এর চিত্রনাট্য আর অভিনয়ের জন্য। ভাবুন, নাৎসিদের এক জেনারেল (যাকে সত্যিই মেফিস্টো বলা যায়), ক্লাউসের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপাত্মকভাবে উচ্চারণ করছে ‘actor’! আর তার পাশেই ক্লাউসের ভাবলেশহীন মুখ, অপমান সহ্য করে চলা চোখ। পরিচালক এখানে সচেতনভাবে কস্টিউম ডিজাইনের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন যে ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে কিছু লোক আস্তে আস্তে পোশাকের মধ্যে দিয়ে কিভাবে নাৎসি হয়ে উঠেছে। এবং কেউ কেউ কিভাবে নাৎসিদের স্তাবক হয়ে উঠেছে। এই ছবির থিম আমাকে যদি বলতে বলা হয়, আমি এক কথায় বলব ‘transformation’। এর প্রকৃষ্ট উদাহরন, ক্লাউস যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে- my name is not my name because I’m an actor।   

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি আলাদা হয়ে আলাদা রাস্তায় চলতে শুরু করার পর অস্ট্রিয়া ১৯৩৮ সালে আবার নাৎসি জার্মানির অংশ হয়ে পড়ে। ছবি তৈরি ধাক্কা খায়। যেহেতু অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জার্মানির এক ক্লোজ টাই ছিল, বেশ কিছু অস্ট্রিয়ান পরিচালক এই দেশ ছেড়ে জার্মানি গিয়ে সেখান থেকে আবার পরে আমেরিকা পাড়ি দেন। যেমন ফ্রিজ ল্যাং (মেট্রোপোলিস) বা বিলি ওয়াইল্ডার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি এদেশে সিনেমা তৈরি আবার শুরু করায়। যদিও সরকার পাশে না দাঁড়ানোয় ১৯৬৮ সাল নাগাত এখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রায় ভেঙে পড়ে। আবার ১৯৮১ সালে সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপে এবং আর্থিক সহায়তায় এখানকার সিনেমা আবার মুখ তুলে দাঁড়ায়। তারপর আর এই দেশকে সিনেমা নিয়ে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

অস্ট্রিয়ান বিখ্যাত পরিচালকদের ছবির কথা উঠলে বলতে হয় রুজোউইজস্কি-র ‘দ্য কাউন্টারফেটার্স’ (২০০৭) আর হানেকা-র ‘আমোর’ (২০১২) অস্কার পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মনে রাখতে হবে এর প্রথমটা জার্মান ভাষায় আর দ্বিতীয়টা  ফ্রেঞ্চ, অস্ট্রিয়ান ভাষায় একটাও নয়। বরং অস্ট্রিয়ান ভাষায় উল্লেখযোগ্য - দ্য লাস্ট ব্রিজ (১৯৫৪), দ্য ইনহেরিটর্স (১৯৯৮), দ্য সেভেন্থ কন্টিনেন্ট (১৯৮৯), মাদার্স ডে (১৯৯৩), পিয়ানো টিচার (২০০১), দ্য এডুকেটরস্ (২০০৪), রিভেঞ্জ (২০০৮) ইত্যাদি। এর ভেতর আজ আমরা  দ্য এডুকেটরস্ নিয়ে কলম ধরব।

অদ্ভুত ছবি। The Edukators। কে শিক্ষা দেয়? কি শিক্ষা? কিভাবে? পুরোটাই এক সোশাল স্যাটায়ার। বার্লিনের তিনজন যুবক যুবতী – জুল, জান, পিটার। পুঁজিতন্ত্রের ঘোরতর বিরোধী। তারা মাঝে মাঝেই উচ্চবিত্তদের ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আসবাবপত্র নিজেদের মত করে ইন্সটলেশন আর্ট করে দেয়। এবং যাবার আগে লিখে রেখে যায় ‘you have too much money’। কিন্তু বাড়ির এক কণাও সংগে নিয়ে যায় না। নন-ভায়োলেন্ট। এর মাঝে আবার জুল, জান ও পিটারের  ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনিও আছে।

পরিচালক হান্স উইঙ্গার্টনারের ১২৭ মিনিটের এই সিনেমা কাল্ট স্যাটায়ার তো বটেই, সিনেমার পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেও এক ধাক্কা। হাতে ধরা ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে পুরো ছবি তোলা, খুব কম বাজেটে, ফলে সিনেমাটোগ্রাফি বেশি আশা না করাই ভাল। কিন্তু অভিনয় বেশ ভাল। এখনো মনে আছে ২০০৪ সালের এই সিনেমা আইআইটি-র চাকরি শুরু করার পর ২০০৪ সালেই দেখেছিলাম, পাইরেটেড ভার্সান। বেশ ভাল লেগেছিল। আইডিয়াটা মনে ধরেছিল। তখন বয়স কম, আমরাও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই ভাবতাম। এই ছবি দেখার পর বোকা মুচি ও ব্যবসায়ীর গল্প মনে পড়েছিল। বোকা মুচির কোন টাকা ছিল না, তাই তার বাড়িতে কোন দরজা জানলাও ছিল না। সেই গল্প মনে পড়ে? অনেক পরে ছবির পরিচালক উইঙ্গার্টনারের এক সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম কোথাও – ‘another theme of the movie is getting rid of one’s fear. It’s important to put an end to anxiety, to stop worrying about safety and security. Freedom is more strenuous than safety… I believe that human beings are nomadic… They need to be free’। বুঝেছিলাম, আমার ভাবনাটা একদম ঠিক।

আগেই লিখেছি চেক প্রজাতন্ত্র শুরু হয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়া হিসেবে। তারও আগে এর পরিচয় ছিল বোহেমিয়া হিসেবে। যাই হোক, ১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়ার মত চেক প্রজাতন্ত্র-ও নাৎসি জার্মানির অংশ হয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ফিরে আসে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে রাশিয়া আবার এই দেশের দখল নেয়। ১৯৮৯ সালে ভেলভেট আন্দোলন করে রাশিয়াকে হঠিয়ে চেকোস্লোভাকিয়া উদ্ধার করা হয়। অবশেষে ১৯৯২ সালে বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র (ও স্লোভাকিয়া) তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে চেক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়ায় পর থেকেই এদেশের সিনেমা আস্তে আস্তে উন্নত হতে থাকে। এমনকি নব্য বাস্তব ছবিও তৈরি হতে শুরু করে।

এখানকার যে যে ছবির কথা বলতে হয় - বাটারফ্লাইজ ডোন্ট লিভ হেয়ার (১৯৫৯), দ্য হোয়াইট ডাভ (১৯৬০), দ্য শপ অন মেইন স্ট্রীট (১৯৬৫), ডেইসিজ (১৯৬৬), দ্য ফায়ারমেনস বল (১৯৬৭), ক্লোজলি ওয়াচ্ড ট্রেনস (১৯৬৭), দ্য ক্রিমেটর (১৯৬৯), কোলজা (১৯৯৬), রিটার্ন অব দ্য ইডিয়ট (১৯৯৯), গ্রিডি গাটস (২০০০) ইত্যাদি। অবশ্য এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব ক্লোজলি ওয়াচ্ড ট্রেনস।

জিরি মেঞ্জেল। আমার প্রিয় পরিচালকদের একজন। ওনার ছবিতে চেকোস্লোভাকিয়ার নিউ ওয়েভ সিনেমা আন্দোলন দুর্দান্ত ফুটে উঠেছে। তার মধ্যে সেরা ছবি নির্দ্বিধায় ক্লোজলি ওয়াচ্ড ট্রেনস। এই সিনেমার মূল গল্প হলঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক তরুণ ট্রেনি মিলো জার্মানির দখল করে নেওয়া চেকোস্লোভাকিয়ায় চাকরি করছে। শান্ত স্টেশন, শুধু মাঝে মাঝে নাৎসিরা গেলে স্টেশনে হৈ হট্টগোল হয়। সে মাসা নামক এক তরুণীর প্রেমে পড়ে। তাদের দৈহিক সম্পর্ক শুরু হয়। এবং শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে এক কিশোর আস্তে আস্তে পুরুষ হয়ে ওঠে – ‘all it takes to make a man of a boy is a woman’। 

সাহসী থিম। তবে আমার এই সিনেমা ভাল লাগার এক কারণ হল, এই ছবি সাবলাইম, বেশি উচ্চারিত নয় এবং এক সময় বসে দেখতে দেখতে মনে হয়, এটা মাথায় ধাক্কা মেরে বলে যাচ্ছে, জীবন মানুষকে কিভাবে গড়ে তোলে। নাৎসিদের মাঝে বসেও কোন এক কিশোর যুদ্ধ ভুলে, আশেপাশের বাধা বিপত্তি ভুলে গুটিপোকার আবরন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, বড় হয়ে উঠতে চাইছে। এক শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সে কৌমার্য ভুলতে চায়। নিজেকে নতুন করে জানতে চায়। এর মধ্যে হতাশা এবং যৌনতা দুই মিশে আছে, তার ছোট্ট এক ঘরের মধ্যে অ্যাডভেঞ্চার লুকিয়ে আছে। মাত্র দেড় ঘন্টার ছবি, কিন্তু মেঞ্জেল এর মধ্যে অনেক কিছু ফুটিয়ে তুলেছেন। এই সিনেমাকে সঠিকভাবেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘masterpiece of human observation’। সহজভাবে জটিল কিছু বিষয়কে দেখানো। 

তুলনামূলক ভাবে পোল্যান্ডের ইতিহাস অনেক মসৃণ। এখানে প্রথম ছবি তৈরি হয় ১৮৯৯ সালে, এখানেই শুরুর দিকে ‘প্লিওগ্রাফ’ ক্যামেরা (অনেকটা প্রোজেক্টরের মত) বানানো হয়েছিল। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে নিনা নিওভিলা  নামক এক মহিলা পরিচালক এখানে ছবিও বানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানেই প্রথম প্রতিবাদ দেখিয়ে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে সিনেমা বানানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিবাদী আন্দোলন তৈরি করা, ছক ভেঙে আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ইন্ডাস্ট্রির নতুনভাবে বদলে যাওয়া – এসবের জন্য পোল্যান্ড অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে। 

পোল্যান্ড মানেই রোমান পোলানস্কির কথা মনে পড়বে। তবে আরো অনেক বিখ্যাত পরিচালক রয়েছেন, যাদের ছবিও মনে রাখার মত। মোটামুটি এই ক’টা ছবি এখন চোখের সামনে ভাসছে - নাইফ ইন দ্য ওয়াটার (১৯৬২), রিপালসন  (১৯৬৫), ম্যাথুজ ডেইজ (১৯৬৮), দ্য থার্ড পার্ট অব দ্য নাইট (১৯৭১), দ্য হাওয়ারগ্লাস স্যানাটোরিয়াম (১৯৭৩), দ্য সিক্রেট গার্ডেন (১৯৯৩), থ্রি কালারস (১৯৯৩-৯৪), দ্য পিয়ানিস্ট (২০০২), কার্নেজ (২০১১), ইডা (২০১৩) ইত্যাদি। আর আজ আমাদের আলোচনার সিনেমা হল ইডা।

পাওয়েল পাওলিকোস্কির অনবদ্য ছবি ইডা। এক সদ্য যুবতী ইডা সন্ন্যাসিনী হিসেবে শপথ নিতে চলেছে। যাবার আগে সে তার পুরোন গ্রামে ফিরে আসে, এক কাকিমা ওয়ান্ডা-র সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে সে জানতে পারে সেই পোল্যান্ডের সেই গ্রাম যখন জার্মানরা দখল করে রেখেছিল, কিভাবে তার বাবা-মা কে মেরে ফেলা হয়েছিল। সে আরো জানতে চায়। তখন তারা দুজন মিলে এক সফরে বের হয় তাদের অন্যান্য আত্মীয়দের দুর্দশা জানার জন্য।

৮২ মিনিটের এক টানটান মাস্টারপিস। কোথাও মনে হয়নি গতি ঝিমিয়ে পড়েছে বা এখানে একটু অন্যরকম হলে ভাল হত। সন্ন্যাসিনী হবার আগে মানুষের দুর্দশা ও যন্ত্রনা না দেখলে সে বুঝতে পারবে না দুঃখের উৎস কোথায়। তাই এই সফর। এ যেন অবধারিত। সাদা কালো এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি তারিফ করার মত। অভিনয় ঠিকঠাক। ১৯৪০ থেকে ৪৫-এর মধ্যে পোল্যান্ড তার প্রায় এক পঞ্চমাংশ জনসংখ্যা হারায়, যার মধ্যে প্রায় তিরিশ লাখ ইহুদি। নেপথ্যে সেই নাৎসি অত্যাচার। এ ছবি যেন সেই বর্বরতার চুপচাপ ও টানটান দলিল। ইডা ও ওয়ান্ডা – দুজনের অভিনয় যথযথ। কেউ কেউ আবার এই ছবির মধ্যে কার্ল ড্রেয়ারের ‘জোয়ান অব আর্ক (আগের পর্বে আলোচনা করেছি) আর ব্রেসোঁর ‘ডায়েরি অব আ কান্ট্রি প্রিস্ট’ –এর ছায়া খুঁজে পান।

সে যাইহোক, আজকের এই যে চারটে ছবির আলোচনা করলাম, ভেবে দেখুন, এর সাধারণ যোগসূত্র একটাই – নাৎসি অধ্যুষিত এলাকা এবং সেখানকার অত্যাচার। সেই কারনেই এই চার দেশকে এক মালায় গেঁথে ফেলার এক প্রয়াস। এবং এটাও উল্লেখযোগ্য, দেখুন, যে চারটে ছবি নিয়ে আলোচনা করেছি, তাদের মধ্যে কেউ হয় প্রোটাগনিস্ট, অথবা কারো মধ্যে প্রোটাগনিস্ট হয়ে ওঠার বীজ লুকিয়ে রয়েছে। নেপথ্যে সেই সামাজিক অসাম্য ও অত্যাচার।

এই লেখা লিখতে লিখতে প্রয়াত হলেন সমরেশ মজুমদার (৮ মে ২০২৩)। খুব মনে পড়ছিল তাঁর অনবদ্য চরিত্র অনিমেষ মিত্র-কে, নক্সাল প্রতিবাদী চরিত্র অনিমেষ মিত্র-কে, কালবেলার অনিমেষ মিত্র-কে। স্বাধীনতার পরে বাংলার রাজনীতিতে অনিমেষ-ও তো একজন প্রোটাগনিস্ট, তাই না?      

(ক্রমশ)

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল’ ৪র্থ পর্ব

 রূপবাণী-অরুণা-ভারতী

 



ভারতী

১৯৬৬ সালে অধুনালুপ্ত ‘ভারতী’তে দেখি ‘দোলগোবিন্দের কড়চা’, হাসির ছবি, নাম ভূমিকায় রবি ঘোষদেখতে  আমার সঙ্গে ছিলেন মা ও আমার এক কাকা। ছবিটি তাঁদের এত ভালো লেগেছিলো যে বাবাকে জানানো হয়, এবং তিনি একদিন আমাকে নিয়ে ‘ভারতী’তে আসেন নিজে আমাকে ও মাকে নিয়ে ছবিটি দেখবেন ব’লে। কেন  মনে নেই, ওই ছবির টিকিট না কেটে, শেষ অবধি কাটা হয় পাশে ‘বিজলী’তে রম-রম করে চলা ‘মণিহার’-এর টিকিট। (প্রসঙ্গত দুটি ছবিই একদিনে মুক্তি পায়ঃ ৪ঠা ফেব্রুয়ারী)। ‘দোলগোবিন্দের কড়চা’-য় চিত্রনাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য (মূল কাহিনী বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের) একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আর এই ছবির আগেই দেখানো হয়েছিল বাংলা ভাষায় ‘মেট্রো নিউজ’ আর তারপর টম আর জেরির একটি কার্টুন! এসব  সাধারণত দেখানো হতো ধর্মতলার অভিজাত ‘মেট্রো’ সিনেমাতেই! আর এই বছর দেখি, এবং খুব ভালো লাগে, আমার প্রথম তপন সিংহ পরিচালিত ছবিঃ ‘গল্প হলেও সত্যি’। পরিবারের সবাই ছবিটির প্রশংসা করেন। দেখা হয়েছিল ভারতীতে, ছবিটি মুক্তি পায় ১৩ই অক্টোবর। ছবি শুরুর আগেই কর্তৃপক্ষ পর্দায় ‘স্লাইড’ ফেলে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণযন্ত্র কাজ করছে না! বাংলা ছবি দেখানো প্রেক্ষাগৃহে দর্শক-স্বাচ্ছন্দ্যের ইতি খুব তাড়াতাড়ি শুরু হয়েছিল!

১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে মুক্তি পায় আমার – মুক্তির সময়ের নিরিখে – দ্বিতীয় সবচেয়ে প্রিয় বাংলা ছবি, তরুণ মজুমদারের ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’! এটিও মোট চারবার দেখি ভারতীতে! এ নিয়ে এর আগে যা লিখেছি, তাই এখানে দিলামঃ দশ বছর বয়েসে ‘ইন্দিরা’য় ‘বালিকা বধূ’ দেখা আর ষোল পেরিয়ে ভারতীতে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ দেখার অভিজ্ঞতা  যে সম্পূর্ণ পৃথক হ’বে, তা বলা বাহুল্য। ‘বালিকা বধূ’র একটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ সপরিবারে কোণারক বেড়াতে গিয়ে একটি আদিরসাত্মক মূর্তি দেখে রজনীর চমকে ওঠা! তখন, ১৯৬৭ সালে খুব একটা কিছু বুঝিনি, যদিও দৃশ্যটি অস্বস্তিকর লেগেছিল। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ অন্য স্তরের ছবি। দামাল ছেলে রসিক বিয়ের পরেও তার দস্যিপনা বজায় রাখে, এমনকি স্ত্রী অমলার সঙ্গে স্ত্রীর সখীর (সন্ধ্যা রায়) কথামতো ‘গায়ে গা ঠেকিয়ে’ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ পড়ার সময়েও! আর বহুবিবাহের বিরুদ্ধে কী দারুণ মজার প্রতিবাদ, যেখানে  রসিক নিজেই দুই মায়ের সন্তান! রসিক অমলাকে হরণ ক’রে নিয়ে আসবেই শ্বশুরবাড়ি থেকে, তার বাবা তাকে দ্বিতীয়বার ছাঁদনাতলায় দাঁড় করাবার যতই চেষ্টা করুন না কেন! হাজার হোক রসিক তো নিজেই অমলাকে শ্বশুরবাড়িতে ছেড়ে পালিয়ে এসেছে, ‘ম্যাজিস্টর সায়েবের শালার’ নাকে এক ঘুঁষো ঝেড়ে দেবার পর! পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে হরণ করেছিলেন, রসিক অমলাকে তার শ্বশুরের সাধের মোটরগাড়ি চুরি করে তাতেই চাপিয়ে তার বাবার কাছে এনে ফেলে! নইলে যে বাবা এই বিংশ শতাব্দীর পৃথ্বীরাজের দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে দেবেন রসিকের চিরশত্রু ‘আলেকজান্ডারে’র বোন ‘ভূতি’র সঙ্গে – সেই ভূতি যে রসিকের স্বপ্নদৃশ্যে হয়ে ওঠে অমলাকে প্রাণদণ্ডদাত্রী সংযুক্তা!

আমার চিরকালের সবচেয়ে প্রিয় তিনটি বাংলা ছবির মধ্যে প্রথম স্থানে একে অপরকে গোঁতাগুঁতি করছে তরুণবাবুর এই অনবদ্য প্রেমগাথাটি, তাঁরই ‘দাদার কীর্তি’র (১৯৮০) সঙ্গে! মুখ্য চরিত্রে অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় অবিস্মরণীয়। ‘বালিকা বধূ’তে রজনী/চিনি-রূপিনী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় বেশী নজর কেড়েছিলেন, অমলরূপী পার্থ মুখোপাধ্যায়ের তুলনায়। এখানে, সজ্ঞানে কিনা জানি না, তরুণবাবু পাশা উল্টে দিয়েছেনঅমলাবেশিনী মহুয়া রায়চৌধুরী মিষ্টি, কিন্তু ছবির ফাটাফাটি শেষ দৃশ্যের আগে অয়নের পাশে কিছুটা নিস্প্রভ। ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অমলাকে রসিক তার চিঠিতে যা নিবেদন করেছিল, তা ‘বালিকা বধূর’ অমলের রজনীকে ‘প্রিয়তমা’ সম্বোধনের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে! সলজ্জ অমলা শেষ দৃশ্যে স্বামীকে তার সেই দাবী নিজের কথামত মিটিয়ে দেয়! ছবিটি যে আমাকে পাগল করে ছেড়েছিল, তার কারণ অবশ্যই এই দৃশ্যটি! চারবার ভবানীপুরের অধুনালুপ্ত ‘ভারতী’তে দেখেছি, তার মধ্যে একবার আমার ইংরেজী-মাধ্যম স্কুলের দুই সহপাঠীকে বগলদাবা ক’রে (“ওরে দেখবি চল, একটা দারুণ বাংলা ছবি! ইংরেজী তো অনেক হ’লো!”)। অভিনয় নিয়ে কাকে ছেড়ে কার প্রশংসা করবো? রসিকের বাবার ভূমিকায় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিকের শ্বশুর পান্নালালের ভূমিকায় উৎপল দত্ত, রসিকের ঠাকুমা নিভাননী দেবী, আর ইতিহাসের মাস্টারমশাইয়ের ছোট্ট ভূমিকায় একমেবমদ্বিতীয়ম সন্তোষ দত্ত, যিনি ক্ষেপে গিয়ে রসিককে বেত মারতে থাকেন এই রাগে যে সে কোন আস্পর্ধায় পৃথ্বীরাজ সেজে আলেকজান্ডারের সঙ্গে টিফিনের সময় যুদ্ধ করছিল! এবং যাঁকে স্বপ্নে পৃথ্বীরাজরূপী রসিক নিজের রাজসভায় ড্রিল-স্যারের (মনু মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে শৃঙ্খলিত বন্দীরূপে দেখে! শুধু একটি জিনিসই এই ছবিতে নিতে পারিনি – আমার পরিবারের অনেকেই একই কথা বলেছিলেন। তৎকালীন এক সমালোচকের মতে ছবির ‘সবচেয়ে সু-গীত গান’, লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে’! সত্তরের দশকে ঐ গানটির স্বত্ব নিয়ে রেখেছিল যাঁর কণ্ঠ তাঁর কাছে কয়েক মাস পরেই আমি গান শেখবার সুযোগ পাবঃ শ্রীমতী সুমিত্রা সেন!

আমার নিজের এই ছবিতে সবচেয়ে প্রিয় গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়, ‘ওরে মন, তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো’! কর্মস্থল থেকে অবসর গ্রহণের মুহূর্তে এই গানটিই বারবার মনে পড়েছিল!

আর সত্তরের দশকে প্রাক-উত্তম যুগের একগুচ্ছ ছবি দেখেছি প্রধানত মা’র উৎসাহে। তিনি ছিলেন মূলত কানন দেবীর ভক্তএই মহিয়সী অভিনেত্রীর যে ছবিগুলি দেখেছি, সেগুলি বেশীর ভাগই মুক্তি পেত দু’টি নতুন বাংলা ছবির মাঝখানে, এক সপ্তাহের জন্যেঃ

·                     ‘যোগাযোগ’ (১৯৪৩, রবীন্দ্রনাথের নয়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাহিনি ও গীত রচনা, অভিনয়ে কানন দেবীর  সঙ্গে জহর গাঙ্গুলী, রবীন মজুমদার, অহীন্দ্র চৌধুরী, এবং খলনায়কের চরিত্রে বড় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রেক্ষাগৃহ ভারতী।)

·                     ‘মুক্তি’ (১৯৩৭, অভিনয়ে পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী, অমর মল্লিক, মেনকা দেবী, পঙ্কজ মল্লিক, গীত রচনা রবীন্দ্রনাথ, সজনীকান্ত দাস, অজয় ভট্টাচার্য। প্রেক্ষাগৃহ ‘ভারতী’। ব্যতিক্রমঃ এক সপ্তাহের  জন্যে নয়, বিপুল সমারোহের সঙ্গে অন্তত তিন সপ্তাহ চলেছিল।) ১৯৩৭ সালে তোলা আসামের জঙ্গলের বহির্দৃশ্য এককথায় চমকপ্রদ। তাছাড়া ছিল চারটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ, যার মধ্যে আমার সবচেয়ে আগ্রহ ছিল ছবির সুরকার পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত ও গীত ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’। একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম যখন দেখলাম যে পঙ্কজবাবু ‘সাঁঝের বেলা ভাঁটার স্রোতে’ স্তবকটি গাইলেন না। এই সাম্প্রতিক জেনেছি যে উক্ত পংক্তিগুলির সুর করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সেই সত্তর দশকের গোড়ায় তাঁর প্রযোজিত ও পরিচালিত ‘অনিন্দিতা’ ছবিতে! ‘মুক্তি’-তে পঙ্কজ-অভিনীত চরিত্রটিই গানটি গেয়েছে। ‘অনিন্দিতা’-য় গানটি আছে নেপথ্যে।

 

১৯৮০-র ২৮শে নভেম্বর মুক্তি পায়, তারিখ অনুযায়ী, তৃতীয়, কিন্তু গুণের বিচারে ৭৩-এর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর সঙ্গে আমার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা ছবি, তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’! বাবা-মা আর আমি দেখতে যাই লেক টাউনের ‘জয়া’য় প্রথমবার। দেখে মুগ্ধ, আপ্লুত হয়ে স্থির করি আমার মাতৃসমা মাসীমাকে – যাঁর উৎসাহে আমরা  সবাই প্রথম ‘বালিকা বধূ’ দেখি, এবং যিনি আমাদের সঙ্গে তারপর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ও ‘ফুলেশ্বরী’, দুটিই দেখেছেন, এবং অনেক আগে ‘একটুকু বাসা’ও – এ ছবি দেখাতেই হবে। মা আর আমি ছুটলাম দক্ষিণ কলকাতার ‘ভারতী’তে তাঁকে নিয়ে। এরপর দাদার পালাতিনি চাইলেন ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ দেখতে (এটি  ততদিনে দেখা হয়ে গেছে আমার, সে কথা আগের পর্বে বলেছি)। কিন্তু আমি জোর করলাম, এবং নিয়ে চললাম শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পাশে ‘অরুণা’য় তাঁকে নিয়ে। এবার মুখ খুললেন বাবা, যিনি ১৯৭০-এ ‘বিজলী’তে ‘এই করেছ ভাল’ দেখে চরম বিরক্তি-সহকারে তাঁর জন্যে বাংলা ছবির টিকিট আর না কাটার নিদান দিয়েছিলেন (প্রথম পর্ব  দ্রষ্টব্য)। “দিব্যি নিজেরা বারবার দেখছো তো ছবিটা! আমাকে তো আরেকবার নিয়ে যাওয়া যায়, নাকি?” সেই তাঁকে নিয়ে ‘অরুণা’য় চতুর্থবার ‘দাদার কীর্তি’! ততদিনে ১৯৮১ সাল পড়ে গেছে!

তরুণবাবুর ছবি দেখার মুখ্য আকর্ষণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর স্বর্ণজুটি। তাছাড়া কিশোর প্রেমের এমন রুচিসম্মত উপস্থাপন তাঁর মতো কেউ করতে পারেন না। ‘দাদার কীর্তি’তে এর ওপর কাহিনি ও চরিত্রবিন্যাসে গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার, অভূতপূর্ব। স্বয়ং হেমন্ত ‘চরণ ধরিতে’ দিয়ে তরুণবাবু যে অলৌকিক মাধুর্য্য সৃষ্টি করতে চলেছেন তা বোঝেননি। গানটির চিত্রায়নও ভাবুনঃ সঞ্চারীতে ‘তোমারই কাছেতে হারিয়া’ গাইছে সরলপ্রাণ কেদার (তাপস পাল), আর ক্যামেরা ঘুরে তাকাচ্ছে পিয়ানো-বাদনকারিনী সরস্বতীর (মহুয়া রায়চৌধুরী) দিকে। পূজা ও প্রেম যে এভাবে সমার্থক হয়ে যেতে পারে তা একনিষ্ঠ রবীন্দ্র-পূজারী ছাড়া এমন করে কে বোঝাবে? এই গান তো শুনে এসেছি রেকর্ডে আরও দ্রুত লয়ে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে, ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনের গান হিসেবেই! হেমন্ত বলেছেন যে গানটি ‘শ্যামা’ গীতিনাট্যের বিকল্প রূপ ‘পরিশোধে’ শ্যামার মুখে শোনা যেত! ছবির শেষে সরস্বতীর দিক থেকে এই একই গান তার পূজামিশ্রিত প্রেম নিয়ে  ফিরে আসবে কেদারের দিকে। কেদার তার নিজের অবচেতনে নিজেকে এই গানটির মাধ্যমে নিবেদন করেছিল সরস্বতীর কাছে। এবার সরস্বতী তার কেদারকে ভুল বোঝার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে নিজেকে নিবেদন করলো কেদারের কাছেঃ ‘নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিও হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে’! এখানে ‘ফুলেশ্বরী’র কথা মনে পড়েছিল, ঐ শেষ মুহূর্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার ফর্মুলা ব্যবহারের জন্য। কিন্তু কিভাবে ভুল বোঝাবুঝি মিটল সেটা গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলায় ‘ফুলেশ্বরী’র মতো গোঁজামিল মনে হয়নি। এর একটু আগে, ভোম্বল ভটচাযের (অনুপকুমার) চক্রান্তে সরস্বতীর বিরাগভাজন হবার পর কেদারের মুখে ‘এই করেছ ভালো, নিঠুর হে’ শুনে মা চমৎকৃত হয়ে বলে উঠেছিলেন, “কি শিল্পসম্মত প্রয়োগ!” তারও আগে চিত্রাঙ্গদার বেশে সরস্বতীর মুখে ‘বঁধু, কোন আলো লাগলো চোখে’র মধ্য দিয়ে পরিচালক পরিস্ফুট করলেন কেদারের মনে অব্যক্ত ভক্তি-মেশানো প্রেমের জাগরণ, আবার কেদারের মাধ্যমে আপাত-কঠোর সরস্বতীর অন্তরে যে ভালোবাসার আলো পড়তে চলেছে, তারও ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। ধন্য তরুণবাবু! এর অনেক পর ‘আলো’ (২০০৩)তে ‘শ্রাবণের ধারা মতো’ আর ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, আর সাম্প্রতিক ‘ভালোবাসার বাড়ি’ (২০১৮)তে ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’! আপনি স্বয়ং কবিগুরুর আশীর্বাদ-ধন্য।

অন্য গানগুলিই বা কম কিসে? আমি তো মুগ্ধ হয়েছিলাম ‘এসো প্রাণ-ভরণ দৈন্য-হরণ হে’ উপাসনাসঙ্গীতটি শুনে! আবার, বসন্ত-উৎসবে ‘কী রূপে যে কখন আসো ওগো বসন্ত’! মাঝে কাহিনিকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বরচিত ‘জনম অবধি’, যাতে কীর্তন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, ভাটিয়ালী,পশ্চিমী আধুনিক – সব মিশিয়েছেন সুররত্নাকর হেমন্ত, আর কণ্ঠে রেখেছেন মান্না দে’কে! আর হৃদয়েশ পাণ্ডের হিন্দি-বাংলা মেশানো হোলি-দোলযাত্রার গানে  বিহারী হিন্দিভাষীর কণ্ঠ যে হেমন্তর তা তো রেকর্ড কেনার আগে বুঝতেই পারিনি! এই ছবির জন্যে শুনেছি হেমন্ত পেয়েছিলেন ‘পঙ্কজ মল্লিক স্মৃতি পুরষ্কার’, যা তাঁর সুরসৃষ্টির প্রতি প্রাপ্য সম্মানই প্রদর্শন করেছিল।

এক কথায় নিস্পাপ সততা, সরলতার জয় আত্মম্ভরিতা আর অতি-চালাকির বিরুদ্ধে – ছবির কাহিনির অন্যতম বক্তব্য বোধহয় এই। কেদারের নম্রতা, নিজের সম্বন্ধে বেশ খানিকটা হীনমন্যতা, অন্যকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করা, কারুর দ্বারা নির্যাতিত এবং প্রতারিত হয়েও তার অমঙ্গল কামনা না করা, এবং ভালোবাসার মানুষ ভুল বুঝে কষ্ট দিলেও পূজা-মিশ্রিত প্রেমে তাকে অভিবাদন – লিখতে-লিখতেই চোখে জল এসে যাচ্ছে!

আর সরস্বতী আপামর যুবকের হৃদয়ে বাণ হেনেছিল, ব্যতিক্রম বোধহয় শুধু আমি! সরস্বতীর ছোট বোন বিনি (দেবশ্রী রায়) যখন জানলার মধ্যে দিয়ে চোখ তুলে তার হবু স্বামীর (অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়) দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন  করছে, “তোমার শরীর ভালো আছে?” তখন আমি পুরো কাৎ! দেবশ্রীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে-খেতে এর পর তাঁর দেখা পাব অপর্ণা সেনের 36 Chowringhee Lane ছবিতে! সেখানে তাঁর ক্রিয়াকলাপ দেখে তো আমি ভগ্নহৃদয়! শেষে তরুণবাবুই আমার কষ্টের ‘মেঘমুক্তি’ ঘটাবেন। সে কথা যথাস্থানে (১ম পর্বে) বলা হয়ে গেছে। শুধু একটা কথা মনে খটকা লাগায়! ১৯৮০তে ছবিটি মুক্তি পাবার সময় পোস্টারে দেখেছিলাম ‘জীবনে যখন প্রথম রামধনু ওঠে!’ কে এই কথা লিখেছিলেন এবং কেন, জানি না। এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে প্রশ্ন জাগে, এই উক্তির মধ্যে ভোম্বলের ক্রমাগত কেদারের পেছনে লাগা এবং শেষ অবধি কেদারের কাছে নতিস্বীকারের কোন কারণের প্রতি ইঙ্গিত আছে কিনা!

১৯৮২ সালে আমি অবশেষে যতীন দাস পার্ক-সংলগ্ন শ্যামাপ্রসাদ (সান্ধ্য) কলেজে অধ্যাপনায় রত হই। মোটামুটি এই সময়েই ‘ভারতী’তে পুনর্মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালের সুপারহিট হিন্দী ছবি ‘নাগিন’, যাতে সুরারোপ  করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ভারতজোড়া খ্যাতি লাভ করেন তাঁর ‘হেমন্তকুমার’ অভিধায়। তাঁর আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’ পড়েছিলাম কিভাবে ক্ল্যাভিওলাইন যন্ত্রের সঙ্গে হারমোনিয়ম মিশিয়ে এক অদ্ভুত উপায়ে সাপুড়েদের বীণ-এর ধ্বনি সৃষ্টি করেছিলেন হেমন্ত। আমি হেমন্ত-পূজারী, আর এই ছবি দেখার সুযোগ হারাব?

সত্যি কথা বলি? ছবির কাহিনি বহুশ্রুত, সাপুড়েদের দুই যুযুধান সম্প্রদায়ের সভ্য সনাতন (প্রদীপকুমার) আর মালা (বৈজয়ন্তীমালা)-র মধ্যে কণ্টকাকীর্ণ প্রেম, হরেদরে সেই রোমিও-জুলিয়েট, যদিও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মিলনান্তক, বিয়োগাত্মক নয়। গানগুলি সুখশ্রাব্য কিন্তু আমার অশিক্ষিত শ্রবণে ঐ ১৯৫৪-তেই একই প্রযোজনা-সংস্থা (ফিল্মিস্তান) থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত, এবং ১৯৬৯ সালে ইস্কুলে প্রদর্শিত ‘আনারকলি’ ছবির গান অনেক, অনেক বেশী হৃদয়গ্রাহী ছিল! সেগুলোও ছিল, একটি বাদে, লতা মঙ্গেশকর আর হেমন্তর কণ্ঠে। পরে সঙ্গীত-বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা শুনেছি যে কোন কোন প্রায়োগিক কারণে ‘নাগিন’-এর সঙ্গীতই তুলনায় যুগান্তকারী ছিল। আর হেমন্ত স্বয়ং তো বলেইছেন যে বর্তমানে সাপুড়েরা ‘নাগিন’-এর বীণের সুরই বাজায়! এও শুনেছি যে বৈজয়ন্তীমালা কোনো রেস্টুরেন্টে গেলে সেখানকার ব্যান্ড তৎক্ষণাৎ ‘মন ডোলে মেরা, তন ডোলে মেরা’-র সুর বাজাতো!



১৯৮৮-তে বিদেশ থেকে ফেরার পর শেষবারের মতো ‘ভারতী’তে গেছি অজয় কর পরিচালিত এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত-সমৃদ্ধ শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ দেখতে, নাম ভূমিকায় সুচিত্রা সেন। ছবিটি প্রথম ১৯৭৬-এ ‘শ্রী’ আর ‘ইন্দিরা’য় মুক্তি পেয়েছিল।


অরুণা

অবশেষে ১৯৮২ সালে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের প্রেমে পড়ি শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পাশে ‘অরুণা’য়  ১৯৫৭ সালের ‘হারানো সুর’ দেখে। আজও আমি তাঁর মুগ্ধ ভক্ত! এর আগে সত্তরের দশকে তাঁকে দেবী চৌধুরাণী-রূপে যে মনে ধরেনি তা প্রথম পর্বেই বলেছি। পরে ‘পূর্ণ’-তে ‘ঢুলী’ দেখে তাঁর রূপলাবণ্য এবং অভিনয়-ক্ষমতা উপলব্ধি  করেছিলাম; সে কথা পরে। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে ‘হারানো সুর’-এ উত্তমই অভিনয়ে মহানায়িকাকে টেক্কা দিয়েছেন, আমার তো মনে হয় উত্তম ইচ্ছে করেই, বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে, একটু চেপে অভিনয় করেছেন, সুচিত্রাকে আবেগ-প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ ছেড়ে দিয়ে, আর প্রথমার্ধে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। এটাই অভিনেতা-পরিচালকের মধ্যে ‘টিম ওয়ার্কের’ নিদর্শন। মূল কাহিনির (James Hilton-এর উপন্যাস ‘Random Harvestএবং সেটির ওপর আধারিত ১৯৪২ সালের Ronald Coleman Greer Garson অভিনীত ছবিটি) তুলনায় ‘হারানো সুর’-এর চিত্রনাট্যও দুর্বল লাগে আমার, যদিও ‘শাপমোচন’-এর মতো ততটা নয়। তবে অভিনয়, আবহ-সঙ্গীত এবং গান মিলে সব ত্রুটি ঢেকে দিয়েছে। ‘তুমি যে আমার’ গানটি ছবিটি দেখার আগে প্রথম শুনি উত্তমকুমারের প্রয়াণের পর HMV-র ‘মহানায়ক উত্তমকুমার’ নামক ডিস্কে। শুনে যেন কি-রকম অদ্ভুত লেগেছিল, মনে হয়েছিল গীতা দত্ত যেন যাকে বলে ‘এদরে-এদরে’ কথাগুলো উচ্চারণ করছেনঅনেক, অনেক পরে, তরুণ মজুমদার তাঁর ‘ভালোবাসার অনেক নাম’ (২০০৬) ছবিতে যে একাধিক পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দি গান নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে ‘তুমি যে আমার’ একটি।

অজয় করের স্মৃতিচারণায় পড়েছি যে ‘হারানো সুর’-এর আগে সুচিত্রা খ্যাতি লাভ করেছিলেন ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ (১৯৫৩) ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়া-রূপে, কিন্তু সে অভিনয় অজয়বাবুর মনে তেমন দাগ কাটেনি। তাঁর নিজের ‘গৃহপ্রবেশ’ (১৯৫৪) ছবিতে সুচিত্রার অভিনয় নিয়েও অজয়বাবু কিছু বলেননি। ‘তুমি যে আমার’-এর চিত্রায়নের আগে সুচিত্রা পরিচালককে নাকি প্রশ্ন করেন কিরকম অভিব্যক্তি দিতে হবে। উত্তরে অজয়বাবু বলেন যে একজন যুবতী সদ্য প্রেমে পড়ে যেমন করে সেইরকম একটা কিছু, আর কি! এরপর একটু ভেবে নিয়ে মহানায়িকা যা শট দেন, তাতে পরিচালক বাক্যহারা হয়ে পড়েন! ১৯৮২ সালে ছবিটি দেখে বুঝতে পারি কেন ঐ দৃশ্যটি এবং তার সঙ্গের গানটি অনেকের মতো আমার কাছেও মধুর, মার্জিত প্রেমের এক চিরকালীন দলিল এবং সংজ্ঞা! অথচ হেমন্ত যখন গানটি প্রথম উত্তমকুমার এবং অজয় করকে শোনান, দুজনেই নাকি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলেছিলেন, “বেশ!” তারপর হেমন্ত জানান যে গানের রেকর্ডিং হবে কলকাতায় নয়, বোম্বেতে, কারণ এই গানের জন্যে যে প্রযুক্তির প্রয়োজন তা কলকাতায় নেই, এবং সর্বোপরি, গাইবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নন, গীতা দত্ত, কারণ হেমন্তবাবুর মতে আর কারুর পক্ষে এই গানের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব নয়। হেমন্তবাবু চলে যাবার পর, প্রযোজক-পরিচালকদ্বয় উপস্থিত দোর্দ্যণ্ডপ্রতাপ চলচ্চিত্র-সম্পাদক অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে নাকি বলেন, “যাক গে, অসুবিধে হ’লে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে দেওয়া যাবে ’খন!” দ্বিতীয় গান হিসেবে নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীতই বাছা হয়েছিলঃ ‘আমার এ পথ, তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে’। পরে ঐ গানের অনুপ্রেরণাতেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লেখেন ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ ওগো দু’টি দিকে গেছে বেঁকে’। ছবির প্রোজেকশান চলাকালীন নাকি পরিচালক অজয় করের মনে হয় গানটি নিস্প্রয়োজন, আর ছবিকে অকারণ দীর্ঘায়িত করছে। তাঁর কথা অনুযায়ী সম্পাদক অর্ধেন্দুবাবু নাকি তাঁর কাঁচি নিয়ে প্রোজেকশান রুমে উঠতে উদ্যত হয়েছিলেন, অজয়বাবুর ভাষায় গানটি ‘কাইট্যা’ দিতে! কিন্তু ছবির নাম ‘হারানো সুর’ এবং সুরকার সুরের জহুরী হেমন্ত! পরলোক থেকে শেষ হাসি এখনো হাসেন আমার জীবনদেবতা!

‘অরুণা’তে এরপর ১৯৮১ সালে আরও দু’বার যাই, প্রথমবার দাদাকে ‘দাদার কীর্তি’ দেখাতে, এবং পরের বার  বাবাকে দ্বিতীয়বার এবং মা এবং নিজেকে চতুর্থবার উক্ত ছবিটি দেখাতে!

 

রূপবাণী

 


স্বয়ং কবিগুরুর দেওয়া নামের এই প্রেক্ষাগৃহে মোট দু’বার গেছি, ১৯৮৮-এ বিদেশ থেকে ফেরার পর। একবার আমার হবু-শাশুড়িকে নিয়ে সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত শরৎচন্দ্রের ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ (১৯৫৮) দেখতে।  ব্যক্তিগত মতঃ শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ থেকে বাংলায় যে চারটি ছবি হয়েছে - ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ (১৯৫৮), ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি’ (১৯৫৯), ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ (১৯৬৫), এবং ‘কমললতা’ (১৯৬৯) – তার মধ্যে  এই প্রথম ছবিটিই খানিকটা অতিদীর্ঘ লেগেছে, বাংলা ছবির সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর উপস্থিতি সত্বেও। এঁরাই আবার ‘কমললতা’-য় মুগ্ধ করবেন।





১৯৮৯-তে দেখা শেষ বাংলা ছবি, হাতিবাগানের ‘রূপবাণী’তে আমার হবু-শ্যালিকার সঙ্গে ‘শ্রীমতী হংসরাজ’।  ১৯৭৬-এর মূল ছবির – যা দেখেছিলাম কৃষ্ণনগরে ‘ছায়াবাণী’ নামের প্রেক্ষাগৃহে – ধারে-কাছে আসে না, কি গল্প, কি অভিনয়, কি গানে। একমাত্র টিয়ারূপিনী শতাব্দী রায়ের জন্যে শেষ অবধি বসে ছবিটা দেখতে পেরেছিলাম।

 


শাশ্বতী চট্টোপাধ্যায়

 

‘তরঙ্গ' এক আশ্চর্য উত্তরণের সিনেমা 




জীবন শিল্পের আধার। অগণিত শৈল্পিক মুহূর্তের অলিখিত সংশ্লেষ। তাকিয়ে দেখতে জানলে, ঐ যেন বাবুইয়ের বাসা, ঐ যেন অলৌকিক স্থাপত্যের কারুকাজে পড়ে থাকা একলা পাঁজরের খণ্ডহর, রোদজ্বলা পথের মরীচিকায় তিরতির লুকিয়ে থাকা মহার্ঘ্য ইন্দ্রধনু। ছায়াছবির কারিগর সেই অঘোষিত শিল্প ছেনে তোলেন, খড়কুটো মুড়িয়ে সেই অনাম্নী সূক্ষ্মতা কুড়িয়ে আনেন। বাস্তবের চাইতে বড় রূপকথা হয় না। আর পরিচালক যখন কবিতাকারও, তখন সেই কথা ও কাহিনী সময়ের নিক্তিতে আরো বেশি ক'রে উত্তীর্ণ হয়। কীটসের কথায়, কবিতা যদি গাছে পাতা গজানোর মতো স্বাভাবিকভাবে না আসে, তো সে না আসাই ভালো। পলাশ দে'র 'তরঙ্গ' সেই স্বাভাবিকভাবে ফুটে ওঠা আলোছায়ার কলমকারি, পাওয়া হারানোর স্বতঃপ্রবাহ।

'তরঙ্গ'। পলাশ দে'র ছবি। 'অসুখওয়ালা'র স্রষ্টা, 'ওস্তাদ'এর ঔপন্যাসিক এবার হাজির সমাজের বিপ্রতীপে অবস্থান করা বিচিত্র জীবন আর তাদের মুঠোয় বাঁধা লড়াইয়ের পটকথা নিয়ে। টিঁকে থাকার লড়াই আলোকপ্রাপ্ত সম্পন্ন শহুরে জীবনে একরকম, আবার শহর থেকে অনেক দূরে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের উঠোনের ধোঁয়ার ঝাপসায় অন্যরকম। প্রতিভা সেখানে দু'মুঠো ভাতের দরে হেলায় বিকোয়। পেটের দায়ে মুনাফালোভী আধুনিক মুখোশধারী মহাজনের কাছে মহার্ঘ্য শিল্প বাঁধা পড়ে। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মুহূর্তও আসে। বিপ্লব মাহাতোর মতো দক্ষ ছৌ মুখোশশিল্পী অসহায়তার চরমে দাঁড়িয়ে, মার খেয়েও শোষকের চোখে চোখ মেলায়, বৈধ পাওনা দাবি করে, সাহস যোগায় সোহাগ। সূত্রপাত হয় নিঃশব্দ বিদ্রোহ তথা বিপ্লবের। বিপ্লবদের মতো মুখোশশিল্পীদের প্রতি ঘটে চলা শোষণ, বঞ্চনার প্রতিবাদে সোহাগ রাজীবদের প্রোজেক্ট থেকে সরে আসে, আর্থিক নিরাপত্তার লোভে সে বিবেককে বিসর্জন দিতে পারে না। গল্প নিজের গতিতে এগিয়েছে। সারথির প্রকট বা প্রচ্ছন্ন দাদাগিরির ছাপ নেই কোথাও, শুধু ছোঁয়া আছে। চাপিয়ে দেওয়ার বিড়ম্বনা, ভাবনার অতিরেক, নির্মাণকে দাগা দিতে পারেনি। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত প্রকৃতি, রোজকার ওঠাবসার ঘরদোর, লাল ধুলো মাটির মানুষের 'দিবারাত্রির কাব্য' - সব মিলিয়ে ম্যাট ফিনিশ 'তরঙ্গ'।

একদিকে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র সোহাগের ব্যক্তিগত জীবনের ওঠাপড়া। তার স্বামী অভিজিতের শরীরে নিঃশব্দে ঘটে চলা মারণরোগের তাণ্ডব, ফলস্বরূপ সোহাগের বিপন্ন দাম্পত্য, সম্পর্কের নিরাপত্তাহীনতা, তাদের দুজনকে দিনে দিনে যেন অনিরাময়যোগ্য নিস্পৃহতায় আচ্ছন্ন করে। অন্যদিকে, শোষিত, বঞ্চিত মুখোশশিল্পীদের জীবনযন্ত্রণা - দুইয়ের সমান্তরাল অভিযাত্রায় মৌনমুখর 'তরঙ্গ'।

সোহাগ খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে চায়। কিন্তু, স্বামীর অস্তিত্বকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন ক'রে, সস্তা প্রলোভনে পা দিয়ে নয়; রাজীবের অত্যুৎসাহী প্রস্তাবকে মুহূর্তে প্রতিহত করে। কঠোর কণ্ঠের প্রত্যুত্তরে দর্শককে সে নিশ্চিন্ত করে, পাশের ঘরে এখনো আমার স্বামী ঘুমোচ্ছে। ফেলে আসা শখের সবুজ তাকে অক্সিজেন দেয়।  কাজ করতে এসে নতুন সত্যের মুখোমুখি হয়। খেটে খাওয়া শিল্পীদের সঙ্গে ঘটে চলা দুর্নীতি, প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে সরগরম হয় সে। কিন্তু, দাম্পত্যজীবনের শুষ্কতার অছিলায় সহজ শরীরী হাতছানির মোহে ভেসে যেতে চায় না। বরং মানুষের জন্যে, মানুষিক সৌকর্যে প্রাণের উদ্বৃত্তটুকু বিলিয়ে দিতে চায়। অপরদিকে  অভিনেতা রণোর ফেসিয়াল ফীচার্সের তীক্ষ্ণতাকে, রাজীব চরিত্রের ক্ষুরধার অ্যাপ্রোচকে নিখুঁত ফুটিয়ে তোলার কাজে পরিচালক বুদ্ধিদীপ্ততায় ব্যবহার করেছেন। রাজীব চরিত্রের শেডস্, তার আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, প্রবৃত্তিগত বাসনা, শঠতার খল উঁকিঝুঁকি দর্শক সংবেদে তীব্র দাগ রাখে। কেউ শিল্পের নামে বাণিজ্য বোঝে, আবার কেউ আতরের বাণিজ্যের নামে সুগন্ধী স্বপ্নকে খুঁজে পেতে চায়, জ্ঞাতসারেই জীবনের উপসংহারটুকু অজানার হাতে সঁপে নিরুদ্দেশ হতে চায়। স্বাস্থ্যে, আয়ুষ্কালের সম্ভাবনায় ক্ষীণ, অসহায় ও অনিশ্চিত হ'লেও সোহাগের স্বামী অভিজিত প্রাণশক্তিতে, স্বপ্ন দেখার নিবিড়ত্বে হীন নয়, রীতিমতো সমৃদ্ধ। আতর তৈরির স্বপ্ন তার আজও সমান সুবাসিত। চলে যাবার আগে বৃষ্টির মাঝে সুদৃশ্য শিশি থেকে আতর ছিটিয়ে দেবার দৃশ্য স্বয়ং এক দুর্নিবার কবিতা। এক কথায় অবিস্মরণীয়। বিচিত্র চরিত্রের স্বপ্ন, উদ্দেশ্য, উড়ান, অপসারী আলোকরশ্মির মত ছবি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

পাকা হাতের কাজ। সিরিয়াস ছবি। পলাশ দে-র ভাবনা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ঠাসবুনোটের নাতিদীর্ঘ 'তরঙ্গ'। মাটির গল্প, মানুষের গল্প, মানবিক সম্পর্ক ও মানসিক ওঠাপড়ার বাস্তব চলচ্চিত্রায়ণ। প্লটের প্রতিটি বাঁক, চরিত্রের শেডস্, আবহের ব্যবহার - সর্বত্র চরম পরিমিতিবোধের স্পষ্ট ছাপ। এতটুকু বাড়তি ভাবনা নেই। নেই পরিবেশনের অতিরেক। যেন শিল্পের প্রতি আজন্মের দায়বদ্ধতার ইস্তেহার তৈরি করেছেন পলাশ। সেইসঙ্গে মারণব্যাধি ও স্বভাবগত পার্থক্যের সুযোগ নিয়ে দাম্পত্য সম্পর্কের অনপনেয় আড়ষ্টতা, শীতলতা ও অসহায়তাকে দুরন্ত শৈলীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের বুকে ঐতিহ্যবাহী ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির কারিগরদের চরম বঞ্চনা, জীবনযুদ্ধ ও বিড়ম্বিত অস্তিত্বের দলিল 'তরঙ্গ'। কিন্তু শেষপর্যন্ত চলচ্চিত্রটির স্রষ্টা মানুষের শুভবোধ, চেতনা ও সচেতনতাকে জিতিয়ে দিয়েছেন। মানবিক মূল্যবোধের পরিসরে তুলে এনেছেন প্রেমের অন্তঃসলিলা কথকতা।

পুরুলিয়ার প্রকৃতিকে বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে ব্যবহার করা হয়েছে। মাটির মায়া, মেঘের ছায়া, বৃষ্টিধারায় আতরের খুশবু ছড়িয়ে গতি বাড়ায়, গতি কমায় 'তরঙ্গ'। বাদশা মৈত্র ও সোহিনী সরকারসহ প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীর দায়িত্বশীল ও পরিণত কাজ গভীর ছাপ ফেলে যায়। এত বাস্তবধর্মী নির্মাণ যে, দেখতে দেখতে এটি যে ফিচারফিল্ম, ডকুমেন্টারি নয়, প্রায় ভুলে যাচ্ছিলাম। 'বিপ্লব‌ মাহাতো' র চরিত্রাভিনেতার কাজ বিশেষ উল্লেখের দাবি করে। সীমিত পরিসরে এতখানি ডিটেইলিং নিঃসন্দেহে মুগ্ধতা আদায় করে নেয়। যখনই ভাবা গিয়েছে, দক্ষ মুখোশশিল্পীর চরিত্রাভিনেত্রীকে শুধু সংলাপের ইঙ্গিতে নয়, সরাসরি মুখোশ সংক্রান্ত কাজের মধ্যে কখন দেখতে পাওয়া যাবে, তখনই পরবর্তী দৃশ্যে পরিচালক সেই আকাঙ্ক্ষা  মিটিয়ে দিয়েছেন।

পলাশ দে সুচিকিৎসক; সময় ও মানুষের নাড়ীর গতি বুঝে কাজ করেন। সে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য হোক বা ছায়াছবি। সুরস্রষ্টা দেবজ্যোতি মিশ্র 'ভালো লাইগছে না' গানে কথা সুর ও গায়কীতে একাই জাদু দেখিয়ে গেলেন। দর্শক-শ্রোতার কানে ও কণ্ঠে নিভৃতে বেজে রইল।

'তরঙ্গ' উত্তরণের ছবি। 'ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত' বললে এক অর্থে ভুল হয় না। একজন আপাদমস্তক কবির দৃষ্টিকোণের আনুকূল্যপ্রাপ্ত ছবি। সুতরাং পরিমিতিবোধ, ইঙ্গিতময়তার সুযোগ সে ছাড়বে কেন? স্তবকে স্তবকে পাঠ ক'রে পাঠক তথা দর্শকই তার মোড়ক উন্মোচন করে নেন। পরিশিষ্টে 'তরঙ্গ' তাই কবিতার মতোই রিক্ত করে যায়, পূর্ণ করে যায়।


শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী ১৯৪৫


    


   

(৬)  

 ১৯৮০ ও তার পরবর্তী সময়ে নেতাজি - প্রসঙ্গ গুমনামি বাবা ওরফে ভগবানজী 

গুমনামী বাবা সম্পর্কে এখন আমরা সকলেই কম বেশি অবগত, চন্দ্রচূড় ঘোষ ও অনুজ ধরের লেখা বইটি না পড়লেও সৃজিত মুখার্জির কৃপায় আপামর বাঙালি এই নামটির সঙ্গে এখন পরিচিত। হঠাৎ ১৯৮৫ সাল থেকে একটি ঘটনা লোকমুখে প্রচার হতে শুরু করে যে এলাহাবাদের ফইজাবাদের রাম ভবনে নেতাজি সাধুর বেশে আছেন। শোনা যায় ষাটের দশকে এই ব্যাক্তি ইন্দো চিন যুদ্ধের সময় উত্তরপ্রদেশের নিমসারে আসেন এবং তারপর এক এক সময়ে এক এক বাসা বদল করে শেষ পর্যায়ে ওঠেন রাম ভবনে। শোনা যায় এই ব্যক্তি সর্বদা পর্দার আড়ালে থাকতেন এবং কাউকে মুখ দেখাতেন না, কেউ তার নাম জিজ্ঞাসা করলে নিজেকে বহুদিন আগে মৃত বলে দাবি করতেন। সাধারণ মানুষজন তাকে ভগবানজী এবং গুমনামি বাবা বলেই সম্বোধন করতেন।

এবার আসি, কেন এই ব্যক্তিকে নেতাজির সঙ্গে তুলনা করা হয় বা নেতাজি বলে মনে করা হয়। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো এই সাধুর থেকে এমন কিছু জিনিস, তার ব্যবহারিক সামগ্রী অথবা নথি পাওয়া যায় যা সাধারণ কোনো সাধুর কাছে থাকা সম্ভব নয়। শুধু প্রাপ্ত জিনিসের উপর ভিত্তি করে যে এই বিশ্বাস তাও নয় এমন অনেক ঘটনা, ব্যক্তি, সাক্ষ্য ও প্রমাণ এর সঙ্গে যুক্ত যে অনেক নেতাজি গবেষকই মনে করেন এই ব্যক্তিই আমাদের পরম পূজনীয় নেতাজি।

প্রথমত, গুমনামি বাবার মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় সরযূ নদীর তীরে যেখানে মাত্র তেরোজন উপস্থিত ছিলেন  যার মধ্যে ছিলেন ডক্টর প্রিয়ব্রত বন্দোপাধ্যায়, ডক্টর আর পি মিশ্র, সরস্বতী দেবী শুক্লা এবং রামকিশোর পান্ডা। চিতার আগুন যখন জ্বলছে হঠাৎ রামকিশোরজী ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন যার শেষকৃত্যে ১৩ লাখ লোক থাকার কথা সেখানে আজ মাত্র ১৩ জন। দিনটি ছিল ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ এবং ঠিক তার কিছুদিন পর ২৫শে অক্টোবরে নয়া লোগ নামে একটি সংবাদপত্রে হেডলাইন আসে - ফইজাবাদে অজ্ঞাতবাসে থাকা নেতাজি সুভষচন্দ্র বোস আর নেই? এই হেডলাইন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যশনাল মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দাবানলের মত খবরটি ছড়িয়ে পরে চারদিকে। দ্বিতীয়ত, গুমনামি বাবার মৃত্যুর পর তার ঘর থেকে ৪২টি ট্রাংক পাওয়া যায় যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় প্রচুর তথ্য, নথি এবং সামগ্রী যা এই জল্পনাকে আরও উস্কে দিয়েছিল। প্রাপ্ত জিনিসের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বসু পরিবারের প্রচুর ছবি, ভাইপো ভাইজির নিয়ে নেতাজির ছবি, পিতা ও মাতার একটি বাঁধাই করা ছবি, এছাড়াও সমগ্র বিশ্বের প্রচুর ম্যাপ, নেতাজীকে নিয়ে ভারত সরকারের দুটো কমিশনের পূর্ণ রিপোর্ট এবং আজাদ হিন্দ সরকারের প্রচুর নথি তথা নোট, স্ট্যাম্প ইত্যাদি। এছাড়াও পাওয়া যায় বিদেশি একটি দূরবীণ, জার্মান টাইপ রাইটার, ৫৫৫ সিগারেট  এবং বিদেশি পাত্র ও চা-কাপ। তিনটে ‘হাফ-বেন্ট ডাবলিন ধূমপানের পাইপ। জার্মানি ও ইতালির সিগার। গোল ফ্রেমের  চশমা, বাইনোকুলার, রোলেক্স অয়েস্টার পার্পেচ্যুয়াল ঘড়ি, স্পুল ক্যাসেট টেপ রেকর্ডার, পোর্টেবল বেলজিয়ান টাইপরাইটার, একটি রেডিও। এছাড়াও ছিলো ভারতীয় রাজনীতির ওপরে লেখা অজস্র বই। সুভাষচন্দ্রের জীবনীমূলক বই। আর ছিলো স্বাধীনতার আগের ও পরের বহু সংবাদপত্র  ও আনন্দবাজার পত্রিকার বিপুল সংগ্রহ। বাক্সগুলিতে পাওয়া গিয়েছিল, প্রচুর চিঠিপত্র ও নথি। নথির মধ্যে ছিলো, আজাদ হিন্দ ফৌজের পরিচিতদের তালিকা ও হাতে আঁকা সাইবেরিয়ার মানচিত্রও। এর মধ্যে বেশকিছু বই অজ্ঞাত কোনও ‘বোন-এর কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন গুমনামি বাবা। পাওয়া গেছিলো বেশ কয়েকটি টেলিগ্রাম। যেগুলো দুর্গাপুজো এবং ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে গুমনামি বাবাকে পাঠিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রবীণ সেনানায়করা। সবথেকে আকর্ষণীয় ঘটনা হলো ১৯৭২ সালে লেখা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রধান গোলওয়ালকরের লেখা চিঠি। এবার বিষয় হলো গুমনামী বাবা সাধারণ লোক হলে কেন তিনি কোনো সাধারণ সাধুকে চিঠি লিখবেন। চিঠিতে লেখা আছে "আপনার ২৫ শে আগস্ট থেকে ২রা সেপ্টেম্বর এর মধ্যে লেখা চিঠি আমি ৬ তারিখ পেয়েছি, আপনার কথা মত আমি তিনটি জায়গার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি তবে আপনি জায়গাগুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বললে খুব সুবিধা হতো"।

এছাড়াও ১৯৮২ সালে একজন বাঙালি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এই সাধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং রবীন্দ্র শুক্লা জানান যে তিনিই মোটর সাইকেল করে এই মন্ত্রীকে নিয়ে আসেন এবং পরবর্তী কালে টিভিতে দেখে বুঝতে পারেন যে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং সেই মন্ত্রী আর কেউই নন প্রণব মুখার্জি (নামটি এখনো কোথাও প্রকাশিত নয়, সহায় কমিশনের রিপোর্ট থেকে শুক্লার বক্তব্য থেকে প্রামাণ্য)।

সুতরাং, পাঠক মহোদয় এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছেন রামভবনের এই সাধু কোনো সাধারণ মানুষ নন এবং তাকে নেতাজি  ভাবার যথেষ্ট কারণও আছে। এই দ্বন্দ্বকে সামনে রেখেই ২০১৬ সালে অখিলেশ যাদবের সরকার সাড়ে ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ করে জাস্টিস বিষ্ণু সহায়ের নেতৃত্বে সহায় কমিশন গঠন করেন গুমনামী বাবা আসল নেতাজি কিনা সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করতে। কিন্তু সহায় কমিশন পরিষ্কার জানান যে নেতাজির সঙ্গে গুমনামী বাবার ডি এন এ রিপোর্টের কোনো মিল নেই এবং গুমনামী বাবার সঙ্গে নেতাজির পরিবারেরও ডি এন এ মিল পাওয়া যায়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর ইলেকট্রো ফ্যারোগ্রামের রিপোর্ট শেয়ার করে্ননি তাই অনেক নেতাজি গবেষক এই ডি এন এ রিপোর্টকে মানতে চাননি।

নানা রকম মতভেদ থাকলেও আমার ব্যক্তিগত গবেষণা অনুযায়ী বলতে পারি গুমনামী বাবা আসলে নেতাজি নন কিন্তু এই কথাও সত্য নেতাজি গুমনামী বাবা অর্থাৎ নেতাজি তার বৃহৎ কর্মযজ্ঞের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সাধুর ছদ্মবেশে তার পরিচিরদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং গুমনামী বাবা ওরফে ভগবানজীও ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। একটি ছোট উদাহরণ দিই, আপনারা গুমনামী বাবার স্মৃতি সৌধের কাছে গেলে দেখতে পাবেন তার মৃত্যুর সময় কালে ??? চিহ্ন  দেওয়া, কিন্তু গুমনামী বাবার মৃত্যুর সময় তারিখ সবই তার ভক্তরা জানতেন।

বলাই বাহুল্য এই সারদানন্দজী বা ভগবানজী নামের আড়ালে মূল যে ব্যক্তি বিদ্যমান তিনি আমাদের প্রিয় দেশনায়ক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে নেতাজীকে নিয়ে নানা গল্প ফেঁদেছে কারণ এখনো পর্যন্ত নেতাজির মত  রাজনৈতিক ইমোশান সারা ভারতে নেই, তাই কেউ ওনাকে প্লেন ক্রাশে মৃত বলে দাগিয়ে দিয়ে মিথ্যা স্ত্রী বা কন্যার গল্প সাজায় আর কেউ বা ভগবানজীর মাধ্যমে নেতাজির মৃত্যু ঘোষণা করতে চায়। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে আরও কিছু তথ্য আছে যেটা দেখলে অনুজ ধর বা চন্দ্রচুর ঘোষের এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণ রূপে বিশ্বাস আপনারা করতে পারবেন না। আবার বলছি আমি একবারও বলছি না ভগবানজী বা গুমনামী বাবা নেতাজি নন, কিন্তু গুমনামী বাবার  মৃত্যু কখনই এটা প্রমাণ করে না যে নেতাজি মৃত। নেতাজি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাধুর ছদ্মবেশ গ্রহণ করেছেন তাঁর কাজের খাতিরে, কিন্তু সেজন্য সেই সাধুর পরিচয়ই তাঁর একমাত্র পরিচয় এটা দাগিয়ে দেওয়া ভুল। আমার পরবর্তী  ধারাবাহিকে আমি আলোচনা করবো নেতাজির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সাধুদের সম্পর্কে এবং অবশ্যই গুমনামী বাবার মৃত্যুর পরেও নেতাজির জীবিত প্রামাণ্য দলিল নিয়ে।

(ক্রমশ)


মৌলিনাথ বিশ্বাস

 

আমাদের হয়ে তিনি এই ‘শতাব্দীর প্রায়শ্চিত্ত’টাও করে গেলেন




কখনও কখনও একটা ‘না’, একটা প্রত্যাখান একটা আগুনের জন্ম দেয়, যে আগুন ধ্বংসের বদলে আর একটা আরম্ভের সূচনা করে। জাতীয় গ্রন্থাগার লিটল ম্যাগাজিনের সংগ্রহ তথা যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে কোনও রকম সদর্থক আগ্রহ না দেখানোয়, এক তরুণের মধ্যে প্রতিস্পর্ধী জেদ জেগে ওঠে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও তিনি একই রকম উদাসীন ব্যবহার পান। তখন তিনি নিজেই নিজের বাড়িতে একক উদ্যোগে ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে এক বিশাল আয়োজন। ২৩ জুন ১৯৭৮ হল আনুষ্ঠানিক সূচনা। বাকিটা ইতিহাস।

সন্দীপ দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ কালে কালে হয়ে উঠেছে বাংলার অন্যতম সারস্বত প্রতিষ্ঠান। ‘প্রতিষ্ঠান’ কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতাহীন। যে কোনও প্রতিষ্ঠানই স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী কিছু উন্নাসিক অনমনীয় দাম্ভিক নিয়মের জন্ম দেয়। এটাই তার জন্ম বৈশিষ্ট্য। ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠান হয়েও সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল সমস্তরকম প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছে গবেষণা করছে যে ছাত্রছাত্রীরা, পড়াচ্ছেন যে অধ্যাপকরা, আমাদের মতো বেপাড়ার মানুষরাও পুরনো পত্রিকা, দুষ্প্রাপ্য কোনও লেখা – সবাই এই জাতীয় যে কোনও প্রয়োজনে হাজির হতাম টেমার লেনে।

শুধু সারা বাংলা নয়, সারা ভারত থেকে, এমনকি ভারতের বাইরে থেকেও মানুষ আসতেন তাঁর কাছে, তাঁর লাইব্রেরিতে। শুধু যে লেখার তথ্য বা বিষয় সন্ধানে তাই নয়, অন্য হাজার দরকারে। তাঁর ছিল অবারিত দ্বার, মুক্ত আহ্বান। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, বাঁকুড়া থেকে বোলপুর, বর্ধমান থেকে বনগাঁ দূর দূরান্তরে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন লিটল ম্যাগাজিনকে ভালোবেসে। তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল প্রশ্নাতীত।

লিটল ম্যাগাজিনের আদর্শকে তিনি একটা আন্দোলনের চেহারা দিয়েছিলেন। লড়াইটা নিজে সামনে থেকে লড়েছেন। তরুণ ছেলেমেয়েরা নতুন পত্রিকা করার আগে তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসত। আজ সারা বাংলা জুড়ে সারা বছর ধরে প্রচুর মেলা হয় লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে। সরকারি উদ্যোগে তো বটেই, ব্যক্তিগত ভাবেও। এর পিছনেও সন্দীপ দত্তের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ছোটো ছোটো মেলা করছে। সন্দীপ দত্তকে আমন্ত্রণ জানালে, শরীর সুস্থ থাকলে, তিনি পৌঁছে যেতেন। অভিভাবক হিসেবে তিনি উপদেশ দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন উৎসাহ দিয়েছেন কত পত্রিকাকে। ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ ছাপা কাগজে পুনর্মুদ্রণ করেছেন কত মুল্যবান লেখা। তাঁর ছিল জহুরির  চোখ। কোনও পত্রিকার কোন সংখ্যা ভবিষ্যতের গবেষকদের প্রয়োজন হতে পারে, বুঝে, নিজে কিনে নিতেন, আবার বলছি, নিজে কিনে নিতেন, লাইব্রেরির জন্য। এই কথাটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। লাইব্রেরির পক্ষ থেকে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের লেখকদের গবেষকদের সম্মানিত করতেন অনুষ্ঠান করে। উপস্থিত সবার জন্য থাকত পুঁটিরামের প্যাকেট।

নথিভূক্ত থাক ‘বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম’ প্রসঙ্গটাও। বাংলা আকাদেমি যখন তাঁদের আয়োজিত সরকারি মেলাটাকে সল্টলেকে রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে স্থানান্তরিত করেন, কিছু সমস্যা এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যখন কোনও সমাধান পাওয়া যায় না, দাবি ওঠে জরুরি ভিত্তিতে একটা বিকল্প মেলা আয়োজনের। গঠিত হয় ‘বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম’। যে ক’জন প্রবীণ-অগ্রজ আমাদের সঙ্গে থেকে আমাদের উৎসাহ দিয়েছিলেন, উপদেশ-পরামর্শ দিয়েছিলেন সন্দীপ দত্ত ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁরা সঙ্গে ছিলেন বলেই আমরা তিনবার সাফল্যের সঙ্গে মেলা আয়োজন করতে (প্রথমবার ভারত সভা হলে, পরের দু’বার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে) সক্ষম হই। তারপর এল করোনা। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ মেলা আবার নন্দন চত্বরে ফিরিয়ে আনলেন। আমাদের আনন্দ। সংঘ ভেঙে না গেলেও, বিচ্ছিন্নতা আমাদের আচ্ছন্ন করে।

জেনে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, ১৯ মার্চ ২০২২ শান্তিনিকেতন লিটল ম্যাগাজিন মেলা উপলক্ষে সন্দীপ দত্ত ও আমি কলকাতা থেকে একসঙ্গে যাই ও পরদিন ফিরে আসি। প্রায় কুড়ি বছরের সারস্বত যোগাযোগের বাইরে এই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা। গাড়িতে দীর্ঘ যাত্রাপথ, দু’দিন একসঙ্গে থাকা -  আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়। তিনি বারবার-ই তাঁর অবর্তমানে লাইব্রেরির কী অবস্থা হবে এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আমরা কিছু ব্যবস্থাজনিত কথা ভেবেও ছিলাম। তবে তিনি সরকারি ব্যবস্থার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন না। এর বাইরে সেই দু’দিনে আরও দু’একটা ব্যক্তিগত স্মৃতি ও ছবি, যা আমার ও আমাদের পারিবারিক সঞ্চয় হয়ে থাকবে। আমাদের পারিবারিক বইএর সংগ্রহের অগোছালো অবস্থা দেখে সামান্য বকুনিও দেন। পাঠক আপনার সানুগ্রহ অনুমতি নিয়ে দুটি প্রসঙ্গ এখানে অ্যানেকডোট হিসেবে নিবেদন করি। যাওয়ার সময় বর্ধমানে আমাদের বাড়িতে বিশ্রামের ও দুপুরের খাওয়ার জন্য আমরা থামি। কচি সজনে ডাঁটার ঝোল খেয়ে আমার বৌদির কাছে জানতে চান, এত টাটকা এখানের বাজারে পাওয়া যায়? আমি যখন ছাদে উঠে ওঁকে বাড়ির পিছনেই সেই গাছ  দেখাই, কী বিস্ময় ওঁর চোখে। পরদিন ফেরার পথে আবার যখন বাড়িতে থামি, বৌদি ওঁকে গাছ থেকে ডাঁটা পেড়ে উপহার দেন। উনি খুশি হয়েছিলেন। শক্তিগড়ে চা খাওয়ার অজুহাতে আমাকে ও আমাদের চালককে শিঙাড়া ও ল্যাংচা খেতে দেখে তিনিও শিঙাড়া ও চিনি ছাড়া চা খান। আমরা তিনজনেই বাড়ির জন্য ল্যাংচা ও মাখা সন্দেশ নিয়ে আসি। ওঁর বাড়িতে রাত্রে মালপত্র পৌঁছে দিতে চালক ছেলেটি ওঁর ঘরে যায়। পরে আমাকে নিখাদ বিস্ময়ে বলে যে, ওঁর এত বই! ছেলেটিকে ওঁর মৃত্যুর কথা জানালাম। বলল, “ও, যাঁর ঘরে সেই অত বই দেখেছিলাম!”

তাঁর ঐ অমূল্য ও বিপুল সংগ্রহ ঠিকমতো রক্ষা করা আমাদের সাংস্কৃতিক দায়। উপযুক্ত মানুষজন যাঁরা আছেন তাঁরা নিশ্চয়ই ভাববেন। কলকাতা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য আরও যে সব সারস্বত প্রতিষ্ঠান এই শহরে আছে,  তারাও ভেবে দেখতে পারেন। তবে অবশ্যই শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁর পরিবার।

‘নিবিড়’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “...হয়তো ভুল জায়গায়, ভুল দেশে লাইব্রেরীটা করেছি, কিন্তু আত্মমর্যাদা বজায় রেখে লড়াইটা তো চালিয়ে গিয়েছি। আমার শূন্য থেকে শুরু, জানি না এরপর কী হবে। আসলে আমাদের সমস্যা এটাই যে সাংস্কৃতিক হেরিটেজ বলতে আমরা মনীষীদের বাড়িটাই বুঝি, তাই ভীড় জমাই। লাইব্রেরীর চিরাচরিত ধারণার বাইরে গিয়েও আমি পেরেছি অন্যভাবে লাইব্রেরী গড়ে তুলতে, পাঠক কখনও বিভ্রান্ত হয়নি। তবে এই লাইব্রেরী থাকবে কিনা জানি না। তবে হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত এটুকুই বলতে পারি, লিটল ম্যাগাজিনের শতাব্দীপ্রাচীন যে ঐতিহ্য, তা ধরে রাখার প্রচেষ্টা করেছি এবং শতাব্দীর প্রায়শ্চিত্তটাও হয়তো করে যেতে পেরেছি।”

টেমার লেনের নাম সন্দীপ দত্তের বা তাঁর লাইব্রেরির নামে করার প্রস্তাব উঠেছে সামাজিক গণমাধ্যমে। হলে আমাদের কিছুটা প্রায়শিত্ত হবে।

(‘নিবিড়’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারাংশটা আমি পেয়েছি অন্যতর গ্রহণকারী দীপ মাইতির ফেবু ওয়াল থেকে।)