আমাদের হয়ে তিনি এই ‘শতাব্দীর
প্রায়শ্চিত্ত’টাও করে গেলেন
কখনও কখনও একটা ‘না’, একটা প্রত্যাখান একটা আগুনের জন্ম দেয়, যে আগুন ধ্বংসের বদলে আর একটা আরম্ভের সূচনা করে। জাতীয় গ্রন্থাগার লিটল ম্যাগাজিনের সংগ্রহ তথা যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে কোনও রকম সদর্থক আগ্রহ না দেখানোয়, এক তরুণের মধ্যে প্রতিস্পর্ধী জেদ জেগে ওঠে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও তিনি একই রকম উদাসীন ব্যবহার পান। তখন তিনি নিজেই নিজের বাড়িতে একক উদ্যোগে ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে এক বিশাল আয়োজন। ২৩ জুন ১৯৭৮ হল আনুষ্ঠানিক সূচনা। বাকিটা ইতিহাস।
সন্দীপ দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ কালে কালে হয়ে উঠেছে বাংলার অন্যতম সারস্বত প্রতিষ্ঠান। ‘প্রতিষ্ঠান’ কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতাহীন। যে কোনও প্রতিষ্ঠানই স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী কিছু উন্নাসিক অনমনীয় দাম্ভিক নিয়মের জন্ম দেয়। এটাই তার জন্ম বৈশিষ্ট্য। ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠান হয়েও সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল সমস্তরকম প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছে গবেষণা করছে যে ছাত্রছাত্রীরা, পড়াচ্ছেন যে অধ্যাপকরা, আমাদের মতো বেপাড়ার মানুষরাও পুরনো পত্রিকা, দুষ্প্রাপ্য কোনও লেখা – সবাই এই জাতীয় যে কোনও প্রয়োজনে হাজির হতাম টেমার লেনে।
শুধু সারা বাংলা নয়, সারা ভারত থেকে, এমনকি ভারতের বাইরে থেকেও মানুষ আসতেন তাঁর কাছে, তাঁর লাইব্রেরিতে। শুধু যে লেখার তথ্য বা বিষয় সন্ধানে তাই নয়, অন্য হাজার দরকারে। তাঁর ছিল অবারিত দ্বার, মুক্ত আহ্বান। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, বাঁকুড়া থেকে বোলপুর, বর্ধমান থেকে বনগাঁ দূর দূরান্তরে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন লিটল ম্যাগাজিনকে ভালোবেসে। তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল প্রশ্নাতীত।
লিটল ম্যাগাজিনের আদর্শকে তিনি একটা আন্দোলনের চেহারা দিয়েছিলেন। লড়াইটা নিজে সামনে থেকে লড়েছেন। তরুণ ছেলেমেয়েরা নতুন পত্রিকা করার আগে তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসত। আজ সারা বাংলা জুড়ে সারা বছর ধরে প্রচুর মেলা হয় লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে। সরকারি উদ্যোগে তো বটেই, ব্যক্তিগত ভাবেও। এর পিছনেও সন্দীপ দত্তের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ছোটো ছোটো মেলা করছে। সন্দীপ দত্তকে আমন্ত্রণ জানালে, শরীর সুস্থ থাকলে, তিনি পৌঁছে যেতেন। অভিভাবক হিসেবে তিনি উপদেশ দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন উৎসাহ দিয়েছেন কত পত্রিকাকে। ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ ছাপা কাগজে পুনর্মুদ্রণ করেছেন কত মুল্যবান লেখা। তাঁর ছিল জহুরির চোখ। কোনও পত্রিকার কোন সংখ্যা ভবিষ্যতের গবেষকদের প্রয়োজন হতে পারে, বুঝে, নিজে কিনে নিতেন, আবার বলছি, নিজে কিনে নিতেন, লাইব্রেরির জন্য। এই কথাটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। লাইব্রেরির পক্ষ থেকে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের লেখকদের গবেষকদের সম্মানিত করতেন অনুষ্ঠান করে। উপস্থিত সবার জন্য থাকত পুঁটিরামের প্যাকেট।
নথিভূক্ত থাক ‘বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম’ প্রসঙ্গটাও। বাংলা আকাদেমি যখন তাঁদের আয়োজিত সরকারি মেলাটাকে সল্টলেকে রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে স্থানান্তরিত করেন, কিছু সমস্যা এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যখন কোনও সমাধান পাওয়া যায় না, দাবি ওঠে জরুরি ভিত্তিতে একটা বিকল্প মেলা আয়োজনের। গঠিত হয় ‘বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম’। যে ক’জন প্রবীণ-অগ্রজ আমাদের সঙ্গে থেকে আমাদের উৎসাহ দিয়েছিলেন, উপদেশ-পরামর্শ দিয়েছিলেন সন্দীপ দত্ত ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁরা সঙ্গে ছিলেন বলেই আমরা তিনবার সাফল্যের সঙ্গে মেলা আয়োজন করতে (প্রথমবার ভারত সভা হলে, পরের দু’বার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে) সক্ষম হই। তারপর এল করোনা। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ মেলা আবার নন্দন চত্বরে ফিরিয়ে আনলেন। আমাদের আনন্দ। সংঘ ভেঙে না গেলেও, বিচ্ছিন্নতা আমাদের আচ্ছন্ন করে।
জেনে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, ১৯ মার্চ ২০২২ শান্তিনিকেতন লিটল ম্যাগাজিন মেলা উপলক্ষে সন্দীপ দত্ত ও আমি কলকাতা থেকে একসঙ্গে যাই ও পরদিন ফিরে আসি। প্রায় কুড়ি বছরের সারস্বত যোগাযোগের বাইরে এই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা। গাড়িতে দীর্ঘ যাত্রাপথ, দু’দিন একসঙ্গে থাকা - আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়। তিনি বারবার-ই তাঁর অবর্তমানে লাইব্রেরির কী অবস্থা হবে এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আমরা কিছু ব্যবস্থাজনিত কথা ভেবেও ছিলাম। তবে তিনি সরকারি ব্যবস্থার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন না। এর বাইরে সেই দু’দিনে আরও দু’একটা ব্যক্তিগত স্মৃতি ও ছবি, যা আমার ও আমাদের পারিবারিক সঞ্চয় হয়ে থাকবে। আমাদের পারিবারিক বইএর সংগ্রহের অগোছালো অবস্থা দেখে সামান্য বকুনিও দেন। পাঠক আপনার সানুগ্রহ অনুমতি নিয়ে দুটি প্রসঙ্গ এখানে অ্যানেকডোট হিসেবে নিবেদন করি। যাওয়ার সময় বর্ধমানে আমাদের বাড়িতে বিশ্রামের ও দুপুরের খাওয়ার জন্য আমরা থামি। কচি সজনে ডাঁটার ঝোল খেয়ে আমার বৌদির কাছে জানতে চান, এত টাটকা এখানের বাজারে পাওয়া যায়? আমি যখন ছাদে উঠে ওঁকে বাড়ির পিছনেই সেই গাছ দেখাই, কী বিস্ময় ওঁর চোখে। পরদিন ফেরার পথে আবার যখন বাড়িতে থামি, বৌদি ওঁকে গাছ থেকে ডাঁটা পেড়ে উপহার দেন। উনি খুশি হয়েছিলেন। শক্তিগড়ে চা খাওয়ার অজুহাতে আমাকে ও আমাদের চালককে শিঙাড়া ও ল্যাংচা খেতে দেখে তিনিও শিঙাড়া ও চিনি ছাড়া চা খান। আমরা তিনজনেই বাড়ির জন্য ল্যাংচা ও মাখা সন্দেশ নিয়ে আসি। ওঁর বাড়িতে রাত্রে মালপত্র পৌঁছে দিতে চালক ছেলেটি ওঁর ঘরে যায়। পরে আমাকে নিখাদ বিস্ময়ে বলে যে, ওঁর এত বই! ছেলেটিকে ওঁর মৃত্যুর কথা জানালাম। বলল, “ও, যাঁর ঘরে সেই অত বই দেখেছিলাম!”
তাঁর ঐ অমূল্য ও বিপুল সংগ্রহ ঠিকমতো রক্ষা করা আমাদের সাংস্কৃতিক দায়। উপযুক্ত মানুষজন যাঁরা আছেন তাঁরা নিশ্চয়ই ভাববেন। কলকাতা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য আরও যে সব সারস্বত প্রতিষ্ঠান এই শহরে আছে, তারাও ভেবে দেখতে পারেন। তবে অবশ্যই শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁর পরিবার।
‘নিবিড়’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “...হয়তো ভুল জায়গায়, ভুল দেশে লাইব্রেরীটা করেছি, কিন্তু আত্মমর্যাদা বজায় রেখে লড়াইটা তো চালিয়ে গিয়েছি। আমার শূন্য থেকে শুরু, জানি না এরপর কী হবে। আসলে আমাদের সমস্যা এটাই যে সাংস্কৃতিক হেরিটেজ বলতে আমরা মনীষীদের বাড়িটাই বুঝি, তাই ভীড় জমাই। লাইব্রেরীর চিরাচরিত ধারণার বাইরে গিয়েও আমি পেরেছি অন্যভাবে লাইব্রেরী গড়ে তুলতে, পাঠক কখনও বিভ্রান্ত হয়নি। তবে এই লাইব্রেরী থাকবে কিনা জানি না। তবে হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত এটুকুই বলতে পারি, লিটল ম্যাগাজিনের শতাব্দীপ্রাচীন যে ঐতিহ্য, তা ধরে রাখার প্রচেষ্টা করেছি এবং শতাব্দীর প্রায়শ্চিত্তটাও হয়তো করে যেতে পেরেছি।”
টেমার লেনের নাম সন্দীপ দত্তের বা তাঁর লাইব্রেরির নামে করার প্রস্তাব উঠেছে সামাজিক গণমাধ্যমে। হলে আমাদের কিছুটা প্রায়শিত্ত হবে।
(‘নিবিড়’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারাংশটা আমি পেয়েছি অন্যতর গ্রহণকারী দীপ মাইতির ফেবু ওয়াল থেকে।)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন