কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

প্রণব চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


ধর্মের ষাঁড় এবং …


গল্পটা একটা ষাঁড়ের। বিদিশী ষাঁড়। খায় বেশি, হাগে বেশি, চেঁচায় ব্রহ্মতালু ফাটিয়ে এবং ষণ্ডকর্মে ব্যাপক তৎপর।  বেঁধে রাখা গরুর চোখে জল এসে যায়। এতকিছুর পরেও দেশি ষাঁড় থেকে বিদিশী ষাঁড়ের একটা বড় ব্যতিক্রম শিঙ  প্রায় নেয়ই, শিঙের শিখা দেখা গেলেও শিঙ উঁচিয়ে তেড়ে আসা কিংবা শিঙ তুলে আছাড় মারা কিংবা শিঙ ঢুকিয়ে  ফেড়ে দে য়া-- একেবারেই দেখানো যাবে না। তবে মাথা দিয়ে এক গুঁতো দিলে ছিটকে পড়তে হবে সাড়ে তিনহাত দূরে। দ্বিতীয়ত, বিদিশী ষাঁড়ের অণ্ডকোষ্টিও দেশী ষাঁড়ের তুলনায় ছোট।

তেমনই এক ষাঁড় নিয়ে এ গল্প, কারণ ষাঁড় দেশের হোক বা বিদেশের, তারা সবসময়েই ধর্মের ষাঁড় হয়। অর্থাৎ ধর্মের নামেই তাদের ছেড়ে রাখা হয় -- যা এবার চড়ে খা। অর্থাৎ ধর্ম এবং চড়ে খাওয়া এক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। যেমন মহাকাব্যের রামচন্দ্রের ভগবান হয়ে ওঠাই হত না যদি না তাদের ১৪ বছর বাড়ি থেকে নির্বাসিত হয়ে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে বা চড়ে বেড়াতে হত। কারণ এই নির্বাসন পর্ব ঘিরেই রামায়ণের যাবতীয় রোমহর্ষক সব ঘটনাপুঞ্জির বিস্তার। আর এই ঘটনাপুঞ্জির যাবতীয় ঘাত প্রতিঘাত বর্ণনার কৌশল প্রয়োগ করেই, কেন্দ্রীয় চরিত্র রামচন্দ্রকে সাধারণ রাজপুত্র থেকে ভগবানে উন্নীত যিনি করে দিলেন, সেই অসামান্য কাব্যপ্রতিভার অধিকারী, রাম-ভগবানের পূজারী ভক্তদের যেন আজ মাথাতেই নেই। যদি থাকত্‌ই, তবে রামচন্দ্রের আগে পূজিত হতেন তার স্রষ্টা, বল্মীক স্তূপ ভেদ কোরে বেরিয়ে আসা মহাত্মা বাল্মীকি। যিনি ভগবানকেও সৃষ্টি করবার ক্ষমতাধর এক কাব্যময় অরণ্যপুরুষ। শত সহস্র প্রণাম হে আদি কবি!     

কিংবা পাণ্ডবদের এপিসোডটাই ভাবুন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ বা কৃষ্ণ ভগবানের অনন্ত লীলার ক্ষমতাটা বোঝাই যেত না, যদি না পাণ্ডবদের চড়ে বেড়ানোর গল্প তার সঙ্গে যুক্ত হত। এই গীতা নামক গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াবার মত এক গ্রন্থ, মহাকাব্যের কবিকে লিখতেই হত না যদি না কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্লটটা ফাঁদা যেত। তাই বলছি ধর্ম এবং চড়ে বেড়ানো প্রায় ওতপ্রোত। এ ব্যাপারে কৃষ্ণ ভগবান একেবারে নিখুঁত চরিত্রায়ণ। নিজে উপস্থিত থেকে সিংহাসন নিষ্কন্টক করে দিয়েছেন, সবাই তাকে বারবার সিংহাসন অফার করেছে, বারবার বসাতে চেয়েছে রাজার মুকুট পরিয়ে আর প্রতিবার তিনি হেলায় সে সিংহাসন ফিরিয়ে দিয়ে ফন্দী করে কেটে পড়েছেন। যেহেতু আমি ভারতীয় তাই ভারতীয় মহাকাব্য থেকেই নমুনা নামালুম। এ কথাটা শুনে এক বন্ধু আমায় শুধরে দিতে বলেছিলো, দ্বারকার রাজা তো কৃষ্ণই ছিলেন! আমি কথা বাড়াইনি কারণ সে প্রসঙ্গ মহাকাব্য নয়, সেটি ভাগবৎ নামক অন্য এক সাহিত্যের উল্লেখ। অন্য এক কবির মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনা। প্রসঙ্গ যেহেতু ধর্মের ষাঁড় সুতরাং সে বিতর্কে পা গলাইনি। আমাদের ঘরের ছেলে নরেন্দ্রকেই দেখুন না। চড়ে বেড়াতে বেড়াতেই নরেন থেকে হয়ে উঠলো বিবেকানন্দ। আর তার গুরু রামকৃষ্ণদেব, দেখে মনে হবে তিনি তো ঘরেই আছেন! একেবারেই নয়। ঘরে থেকেও যে তিনি নেই, সেটা বোঝা যায় যখন অন্যেরা তাঁকে আবিষ্কার করে গভীর অন্ধকারে পঞ্চবটী বনের গাছতলায়। জামাকাপড়ই শুধু খুলে ফেলা নয় গলার পৈতেটাও খুলে টাঙিয়ে রেখেছেন গাছের ডালে। ঘর মাঠ বন উবু করে দিয়ে উলঙ্গ পৃথিবী দিয়ে তিনি তখন চড়ে বেড়াচ্ছেন জীবন মৃত্যুর সীমারেখা তছনছ করা কোনও আলোর তুফানে। যেখানে যেতে হয় তন্তুহীন হয়েই। ঘর তো কোন ছাড়, তথাকথিত ধর্মীয় চিহ্ন হিসেবে উপবীতকেও ফেলে যেতে হয় সেই অজ্ঞেয় জগতের অভ্যন্তরে। যাই হোক, ধর্ম যদি করতে হয় বাপু, তবে চড়ে বেড়াও। সেই জন্যেই ধর্মের ষাঁড় এত স্বেচ্ছাচারী, বিরাট শরীর নিয়ে নিরন্তর বাজার বাজার ঘুরে তোলাবাজী করে বেড়াবে, তুমি কিছু বলতে পারবে না। ঢিঁসিয়ে তোমার প্রাণবায়ু ফুস করে দিলেও, জয় বাবা ধর্মের ষাঁড়, যাকে ফক্কা করলো সে নিশ্চিত বৈকুণ্ঠলোক প্রাপ্ত হলো।

এবার গল্পের ষাঁড়ে আসি। তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ, এক মধ্যরাতে আড্ডাকর্ম শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে।  গাঁয়ের গলিপথ আটকে সেই বিশালদেহী শঙ্খের মত আওয়াজের বিশাল হুঙ্কার ধ্বনি ছাড়ছে তার উপস্থিতি জানাবার জন্য। বা ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে দিয়ে তার প্রয়োজনীয় পাল দেবার মতো এক গরু খুঁজে পাবার নিমিত্ত। মানে ধর্মের হোক আর যারই হোক, ষাঁড় বাবাজীর বেগ এসেছে, সোজা বাংলায় ইরেকটেড বা হাটুরে বাংলা্‌য়, চেগেছে। এমন না হলে এই মাঝরাতে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে কেউ হল্লা করে? মোদ্দা কথা তার একটা মেয়েছেলে দরকার। মানে পাল্লা   দেবার মতো একটা গরু। রাস্তায় রাস্তায় টহলদারী কোরেও বেওয়ারিশ কোনও মাল পায়নি। তাই এই গলিতে ছল্লি মারছে। বেচারা। এসব ক্ষেত্রে ওদের জন্য কোনও যৌনপল্লীও নেই যেখানে গিয়ে ঢুকে পড়ে গরম কমিয়ে আসবে। স্বাভাবিক ভাবেই আপাতত ধম্মের গুঁতোয় আমাদের শান্তিতে নিশিযাপন বিলা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ অত্যাচার নির্বিবাদে মানুষেরা সহ্য করবে কেন? সব মানুষই তো আর গরুর মালিক নয়, মানুষের ছানাপোনা বানিয়ে ঘরসংসারে বাস করে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে পেটের ভাত জোগাড় করতে মুখে ফেনা তুলে পরিশ্রম করে, তাই রাতে একটু নিশ্চিন্ত ঘুমের জন্য কাতর ও ক্লান্ত হয়ে থাকে। সেই কাঁচাঘুম এভাবে প্যালসা মেরে দেবে, সবাই সেটা সহ্য করবে কেন? যতই তুমি ধর্মের হও বা ফুচুক্ষ্যাপা হও, বাঁশের বাড়ি গায়ে পড়লে গুটিয়ে যাবে ক্ষ্যাপামো। হলও তাই। আমি না হয় মজা দেখছি চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কিন্তু এর মধ্যেই দরজা খুলে যে যেরকম পারছে -- যেমন কেউ একমগ জল নিয়ে গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে, কেউ ঘরের হুড়কো হাতে লুঙ্গি গুটিয়ে রোয়াব দেখাচ্ছে, আর কেউ বাঁশের দু-এক বারি সাঁটিয়ে তাকে তাড়াচ্ছে ইত্যাদি। তো এতকিছুর পর ষণ্ড বাবাজী অনুধাবন করতে পারলো এক্ষেত্রে ধর্মের নামে ক্যাওড়াবাজী কেউ সহ্য করবে না। বাধ্যতই রুট বদলে আবার গলি থেকে বেরোনোর পথেই হাঁটা দিলো, কিন্তু সে মাল এখনও বেশ চেতেই আছে, গলি ছাড়ার আগেও আরও একবার মহাশঙ্খধ্বনির মতো তার হাঁকবাজি চালিয়ে গেলো। আর তখনই আমি সিদ্ধান্তে এলাম, এ ষণ্ডটি আমাদের দেশীয় ষণ্ড নয়। কারণ, ১) আমাদের দেশীয় ষাঁড়েরা সারাদিন যা করবার করুক, পেগলে না গেলে রাতের দিকে তেমন ঝামেলা করে না। চুপচাপ একটু ফাঁকা জায়গা দেখে নিজেও কিছুটা মহাকাল সঙ্গ করবার নিমিত্ত জাবর কাটতে কাটতে থিতিয়ে যায়। ২) যেহেতু আমাদের ঘরসংসার, বাজারহাট, দোকানপসার, ধূমধামাকা তার পরিচিত হয়ে গেছে, তাই নির্বিবাদ ঘুরে বেড়ায় বাজার রাস্তা গলি রাজপথ সবখানে। মাঝে মাঝে একটু গলাখাঁকারি দিয়ে তার দাদাগিরির জানান দিয়েই বিশাল চেহারা নিয়ে হেঁটে চলে নিজের খেয়ালে। প্রচুর গরু দেখেছি এই দেশীয় ষাঁড়েদের ফ্যান। তাদের ইল্লিবিল্লী করবার সময়সুযোগ না হলেও, ষাঁড় দেখলেই কেমন পালাবার ভান কোরে ছুকছুক করে। কোন কোন গরুতো আবার বড়ই গা-ঘেঁষা, ষাঁড় বাবাজী বিশেষ পাত্তা না দিলেও সে গরু তার পিছু ছাড়তে চায় না। ৩) তৃতীয় বিশেষত্বটি অবশ্যই আকৃতি বিষয়ক। কুঁজ, শিং ইত্যাদি নিয়ে একেবারে গাঙ্গেয় বঙ্গ জনপদের আকাশ বন নদী মোরাম টিলা পাহাড়ের সঙ্গে ছয়টি ঋতুর মানানসই ব্যালেন্স রক্ষা কোরে, সৃষ্টির আদি চীফ ডিজাইনার স্যাম্পলটিকে বাজারে ল্যাণ্ড করিয়েছিলেন। ব্যাস, শিল্পী কবিরাও ক্যাচ কট কোরে সেই জন্তুটিকেই বাবা শিব বা ভোলানাথের সঙ্গে লটকে দিয়েছে। যেমন মালিক তেমন চ্যালা। এবার বোঝ। ভোলানাথের চ্যালা, তোলা না দিলে দোকান বাজার কোরে খাওয়া ঢিলে কোরে দেবো। সুতরাং জয় বাবা... ইত্যাদি।  

এই তিনটি ব্যতিক্রম অনুধাবন কোরে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে এটি বিদেশী মাল। প্রচুর খাই। গলার আওয়াজটাও যেন নিজের দেশে ফেলে আসা কোনও গুপ্ত প্রেমিকার দিকে ডুকরে ডুকরে উঠছে। দিন রাতের হিসেব ভুল কোরে ফেলেছে। মিলছে না। অগত্যা ধম্মের নামে, সে দেশি হোক বা বিদেশী, পালাবার রাস্তাটা ছেড়ে রেখে একটু দূরে গিয়েই দাঁড়ালাম। তিনি বাঁশ-টাশের দাগ-টাগ পিঠে বয়ে নিয়ে গরর গরর করতে করতে গলি ছেড়ে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছেই তেড়ে গলাবাজি করতে শুরু করলো। তাকে একাই হল্লা করতে ময়দান ছাড়বে কেন, একটু পরেই কানে এলো, আমাদের অত্যন্ত পরিচিত এপাড়া ওপাড়ার সেইসব বিনে পয়সার পাহারাদারেরা, যারা প্রাকৃতিক ভাবেই দায়িত্ব পেয়েছে আমাদের পাহারা দেবার, সেইসব নেড়ী কুকুরেরা একজোট হয়ে তুমুল পালটি দিয়ে যাচ্ছে সেই ধম্ম বাবাজীর একরোখা দাদাগিরীর বিরুদ্ধে। হল্লা কত করবি কর, আমরাই তোর মগজ ঢিলে কোরে দোবো, ভাবটা এইরকমের। অবশেষে রাস্তা ফাঁকা। সঠিক রোগের সঠিক ডোজ। গোটা দশ পনেরো নেড়ী কুকুরের মিলিত চিৎকারে বার দুয়েক হিসিটিসি, হাগুটাগু ঝড়িয়ে, বেগ কিছুটা কমে গেলে সেই বিদেশী ষাঁড়টি রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে কোথাও সটকে পড়লো। আমিও ধীরে ধীরে ঘরের দিকে চললাম। আর ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো এই ভেবে যে, অই রাজকীয় বিশাল চেহারার বিদিশী হাঁকবাজ ধর্মের ষাঁড়ের বিরুদ্ধে, আমাদের প্রতিবেশী অপুষ্ট ছোটছোট চেহারার নেড়ীগুলোর যে সম্মিলিত প্রতিরোধ, যে প্রতিরোধের মুখে ধর্মের নামে হল্লাবাজ হেগেমুতে ল্যাজ গুটিয়ে কেটে পড়ে, সেই ঐতিহাসিক সত্যটি আজকের রাত্রে আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেলো।

 

 

    

 

      


1 কমেন্টস্: