কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮

<<<< সম্পাদকীয় >>>>



কালিমাটি অনলাইন / ৫৮ 


গত সতেরো জুলাই ২০১৮ তারিখে ‘আনন্দবাজার’এ প্রকাশিত এই খবরটা সম্ভবত অনেকেই পড়েছেন। তবুও যাঁদের পড়া হয়নি, তাঁদের জন্য তা পুনঃপ্রকাশ করা একান্ত প্রয়োজন মনে করছি, কেননা, এটা এমন একটা খবর, যা আজকের এই ক্ষয়িষ্ণু ভালোবাসার পৃথিবীতে এক অন্য বার্তা বয়ে এনেছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, এই খবর বা ঘটনা যেন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে তথাকথিত ভালোবাসার পৃথিবীকে।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাড়ুইয়ের তরুণী নার্গিস। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র সতেরো। সদ্য বিবাহিতা। একদিন তাঁর স্বামীর সঙ্গে মোটরবাইকে কোথাও বেরিয়েছিলেন। কিন্তু সেই যাত্রা ছিল মারাত্মক। পথিমধ্যে তাঁরা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন। মৃত্যু হয় তাঁ স্বামীর। এবং নার্গিস গুরুতর আহত হন। তাঁকে ‘রেফার’ করা হয় কলকাতার হাসপাতালে। আঠারো দিন তিনি ছিলেন কোমায়। কলকাতায় ‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি’ এবং ‘এস এস কে এম হাসপাতাল’এ দীর্ঘ প্রায় তিন বছরের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে তিনি ঘরে ফিরে আসেন। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ তিনি হয়ে উঠতে পারেন নি। আজও তাঁর নিজে নিজে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। বসে বসেই তাঁকে চলাফেরা করতে হয়। ঘরের টুকিটাকি কাজও করতে হয়। তিনি নিজে সরাসরি বসে থাকতে পারেন না, পেছনে বালিশ দিয়ে বসতে হয়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয়। খুবই যন্ত্রণাদায়ক তাঁর নিত্যদিনের জীবনযাপন।

কিন্তু জীবন তো কখনই থেমে থাকে না! কখনও কখনও জীবনে বৈচিত্র্যের অভাবও ঘটে না। আর তাই নার্গিসের আশাতীত নিতান্ত কম বয়সের ট্র্যাজিক জীবনে আবির্ভাব ঘটল বীরভূমের কেন্দ্রডাঙাল গ্রামের তরুণ আব্দুলের। আব্দুল কুদ্দুস। আব্দুল ভালোবাসলেন নার্গিসকে। নার্গিস ভালোবাসলেন আব্দুলকে। এই ভালোবাসার মাঝে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ালো না নার্গিসের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। আব্দুল এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শুধু একটা মানুষের দৈহিক সৌন্দর্য  দেখে ভালোবাসা হয় না। নার্গিসের মনের জোর, জীবনে ফেরার তাগিদ আর লড়াইয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই লড়াইয়ে আমি ওর পাশে থাকতে চাই আজীবন’। হ্যাঁ, কথার অন্যথা করেন নি আব্দুল। সামাজিক ও পারিবারিক সব বাধা উপেক্ষা করে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ আব্দুল বিয়ে করেছেন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী নার্গিসকে। নার্গিস জানিয়েছেন, ‘আমার স্বামী বা বাড়ির লোক কখনও এমন আচরণ করেননি, যাতে মনে হয় যে, আমি তাঁদের বোঝা বা আমাকে নিয়ে ওঁরা লজ্জিত’। আর স্বামীর কথা জানিয়েছেন, ‘আব্দুল সব জায়গায় আমাকে কোলে করে নিয়ে যায়। কোলে করে চেয়ারে বসায়, গাড়িতে তোলে। ওর কোলে চড়েই একসঙ্গে কেনাকাটা করি, সিনেমা দেখি, আত্মীয়দের বাড়ি যাই। এমন কি, বাড়ির দোতলাতেও আমাকে কোলে করে তোলে’।

আপনাদের জেনে ভালো লাগবে, এ বছর তেসরা জুলাই নার্গিস ও আব্দুল জন্ম দিয়েছেন এক সুন্দর স্বাস্থ্যবান শিশুপুত্রের।

আপনাদের কি মনে পড়ছে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মণিরত্নমের ‘গুরু’ ছবিটির কথা। এই ছবির মুখ্য চরিত্রে ছিলেন ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী। আর ছিলেন বিদ্যা বালন ও মাধবন। ছবিতে বিদ্যা বালন অভিনীত চরিত্র মিনুও ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি চলাফেরা করতে পারতেন না, হুইল চেয়ারের আশ্রয় তাঁকে নিতে হয়েছিল। এমনকি প্রকৃতির ডাকেও তাঁকে অসহায়ভাবে সাড়া দিতে হতো সেই হুইলচেয়ারে বসেই। মিনু ভালোবাসতেন মাধবন অভিনীত চরিত্র শ্যাম সাক্সেনাকে। শ্যামও প্রচন্ড ভালোবাসতেন মিনুকে। প্রতিবন্ধী মিনুকে কোলে নিয়ে শ্যাম চলাফেরা করতেন। আর হ্যাঁ, শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবল শ্যাম ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মিনুকে।

নার্গিসের আরও একটি নাম আছে। সোমা।

সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। 


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :  
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com  

দূরভাষ যোগাযোগ :            
08789040217 / 09835544675 
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


ফারহানা রহমান



আধুনিক কবিতায় শার্ল বোদলেয়ার 




“আধুনিকতা হচ্ছে অস্থায়ী, দ্রুতগামী অপ্রত্যাশিত একটি ব্যাপার; এটা শিল্পের অর্ধেক এবং অন্যঅর্ধেক হচ্ছে শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়।” -শার্লবোদলেয়ার

ইউরোপের সাহিত্যজগতে যখন একদিকে রোমান্টিকতার জয়জয়াকার আর অন্যদিকে নাগরিক জীবনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে দুটি মহাযুদ্ধ, মহামারী প্লেগ। একদিকে যেমন বদলে যাচ্ছে নৈতিকতার সংজ্ঞা, সামাজিক বন্ধন, অন্যদিকে শুরু হয়ে গেছে মানুষের বোধের আর চেতনার অবক্ষয়। এ যেন এক নব্যপুঁজিপতিদের পেষণে দিশেহারা এক সমাজ । আর তাই বদলেয়ারের কবিতায় উঠে আসলো সেসময়ের প্রকৃত রূপ। মানবজীবন ও সমাজের অবক্ষয়, ঈশ্বরের নিন্দা ও প্রেমের প্রতি ঘৃণা ও প্রথাবিরোধিতা আর উন্নাসিকতাই হয়ে উঠলো তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ।

আধুনিক কবিতাজগতে যাদের কবিতাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়, ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক কবিতা  বলতে মূলত আমরা যা কিছু বুঝি, তা কোনো না কো্নোভাবে বোদলেয়ারের কবিতার চিত্তনির্যাস ও তারই সংক্রাম। ফরাসি কবিতায় যেমন রয়েছে  বোদলেয়ারের কবিতার অনুরণন, তেমনি পশ্চিমি কবিতার প্রায় প্রত্যেকটি স্তরেই আমরা বোদলেয়ারের কবিতার প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ প্রভাব দেখতে পাই। তিনি তাঁর কবিতায় রিয়েলিজম বা বাস্তবতাকে সেই সময়ের পরিপেক্ষিতে এতটাই স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন যা অন্যদের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আর তাঁর ছিল কবিতার শব্দচয়নে অসামান্য দক্ষতা যা তাঁকে অন্যসব কবিদের কাছ থেকে অনন্য করে তোলে। তাঁর সময়ের ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই তিনি বর্ণমালার চিত্রলিপি দিয়ে বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বোদলেয়ার মনে করতেন মানুষ হচ্ছে এমন এক দ্বৈতসত্ত্বার প্রাণী, যার চরিত্রের একদিকে রয়েছে ঈশ্বরের রূপ আর আরেকদিকে  রয়েছে শয়তানের রূপ। আর এই দুয়ের মিলনেই মানুষ হয়ে ওঠে প্রকৃত মানুষ। 

বোদলেয়ার গদ্য কবিতায় এমন একটি স্বতন্ত্রধারার সূচনা করেন যা পরবর্তী কবিদের উপর সমূহ প্রভাব বিস্তার করে। তিনি ছন্দবদ্ধ কবিতাকে পরিবর্তন করে কবিতার স্তবককে ভেঙে দেন। এই গদ্য কবিতাগুলোও ছিল সেসময়ের গদ্য কবিতার  সবচেয়ে সফল এবং প্রাথমিকভাবে গবেষণাধর্মী গদ্য কবিতা। আধুনিক কবিতার  সৃষ্টি ও সৃজনে শার্ল বোদলেয়ারের নান্দনিক অর্জন ও প্রভাব অনস্বীকার্য, কবিতায় তার মনন, ভাবনা ও ভাষা সত্যি অনন্য। 

বোলেয়ারের বাবা আত্মভোলা, সৎ ও শিল্পীমনের অধিকারী জোসেফ-ফ্রাঙ্কোজ বোদলেয়ারের পেশা ছিল শিক্ষকতা। তাঁর মার নাম ছিল ক্যারোলিন আর্চবিউৎ দুফেস। তাদের একমাত্র সন্তান বোদলেয়ার প্যারিসে ১৮২১ সালের ৯ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ  করেন। বোদলেয়ারের মাত্র ছয় বছর বয়সে তার বাবা মারা যান, যিনি  বোদলেয়ারের মা দুফেসের চেয়ে ৩৪ বছরের বড় ছিলেন। বোদলেয়ার চিরকাল তাঁর মাকে গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন ফলে বাবার মৃত্যুর পর মা দুফেস যখন মেজর অপিককে বিয়ে করলেন তখন সেই শিশু বয়সেই তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ফলে পরবর্তীতে মাতা ও বিপিতার  সমূহ ভালোবাসা, মনোযোগ পাওয়া সত্ত্বেও বালক বোদলেয়ার কিশোর বয়স থেকেই বিষাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং সারাজীবনভর সেই বিষাদ তাঁকে ঘিরে ছিল। 

১৮৩৩ সালে মেজর অপিক তাঁর পরিবার নিয়ে লায়ান্সে স্নানান্তরিত হন। এবং যেখানে বোদলেয়ারকে একটি মিলিটারি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করানো হয়। স্নাতক  হওয়ার কিছুদিন পরই তাঁকে আইন অবাধ্য করার অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। এর পরের দু’বছর তিনি প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারে একজন লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন এবং ভীষণভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মনে করা হয় যে এই সময়টিতেই তিনি তাঁর আজীবন ধরে অসুস্থতার পিছনের কারণ সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন। ছেলের উন্নত ভবিষ্যৎয়ের আশায় বোদলেয়ারের মা ও বিপিতা তাঁকে ভারত ভ্রমণের উদ্দেশে জাহাজে তুলে দিলেন, তাঁরা আশা করেছিলেন যে এই অভিজ্ঞতা বোদলেয়ারের বাউন্ডুলে জীবনকে বদলে  দেবে । ১৮৪১এর ৯ জুন তিনি বর্ডো থেকে ‘দক্ষিণ আকাশ’ নামক জাহাজে করে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হলেন। দুর্ভাগ্যবশত জাহাজটি উত্তমাশা অন্তরীপে এক  ভয়াবহ ঝড়ের মুখে পড়ে জখম হয়ে তিন সপ্তাহের জন্য মরিশাস দ্বীপে আটকে থাকে। এসময় বোদলেয়ার প্যারিসে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ফলে তিনি ভারত সমুদ্রের রেনুয়ার দ্বীপ থেকে অন্য জাহাজে করে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।

প্যারিসে ফিরে আসার পর তিনি উত্তরাধিকার সুত্রে অগাধ সম্পত্তি লাভ করেন যা দিয়ে তিনি পরবর্তী কয়েকবছর রাজার হালে জীবন কাটান। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ ‘তেওদর দ্যা বাভিলরে’ ১৮৪২ সালে প্রকাশ পায়। এসময় তিনি পোশাকআশাকের  পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে থাকেন এবং প্যারিসের আর্ট গ্যালারীগুলোতে এবং ক্যাফেগুলোতে দিন কাঁটাতে থাকেন। তিনি হ্যাশিশ ও আফিমের নেশায় ডুবে থাকেন এবং জান দ্যুভালের প্রেমে পড়ে ‘ল্য ফ্ল্যর দ্যু মল’ সৃষ্টি করেন। জান  দ্যুভালকে তিনি 'ব্ল্যাক ভেনাস' নামে ডাকতেন। পরবর্তী দু’বছরের মধ্যেই  বোদলেয়ার উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া অর্থের প্রায় অর্ধেক টাকা খরচ করে ফেললেন। ফলে মাদাম অপিক তাঁকে মাসে মাসে  শুধুমাত্র প্রয়োজনীয়  হাত খরচ পাওয়ার জন্য একজন আইনজীবী নিযুক্ত করেন এবং তিনি বাকি জীবন সেখান থেকেই সামান্য কিছু ‘ভাতা’ পেতে থাকেন।

প্রতিমাসের আয় কমে যাওয়াতে বোদলেয়ারকে নানা শিল্প সমালোচনা, প্রবন্ধ এবং বিভিন্ন পত্রিকার জন্য জার্নাল লেখা শুরু করতে হয়। তাঁর প্রথম দিকের সমালোচনাগুলো ছিল ইউজিন ড্যালাক্রয়েক্স এবং গুস্টাভ কোরব্যেট মতো  সমসাময়িক ফরাসী  চিত্রশিল্পীদের নিয়ে যা তাঁকে পক্ষপাতমূলক শিল্পসমালোচক  হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৮৪৭ সালে তার প্রথম ছোট উপন্যাস বা নভেলা ‘লা ফাঁফার্লো’ প্রকাশিত হলো। এবং পরের বছর পো-র গল্প ‘মেসমেরীয় উন্মীলন’এর অনুবাদ করেন। এসময় ফ্রান্সে দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য ফেব্রুয়ারির বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে এবং বোদলেয়ার নিজেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে বিপ্লবের নেশায় মেতে উঠলেন। 
 
বোদলেয়ার ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ বইটি প্রিন্টিংয়ের গুণগত মানের ব্যাপারে এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে তিনি বইয়ের উৎপাদনের সময় তত্ত্বাবধানে সাহায্য করার জন্য প্রেসের কাছাকাছি একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। নির্ঘুম নিরলসভাবে পাঁচমাসব্যাপী একনাগাড়ে  প্রুফ দেখার পর মোট একশটি বাছাইকৃত কবিতা নিয়ে ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ ১৮৫৭ সালে বই আকারে প্রকাশিত হলো। প্রথমেই ১০০০ কপি প্রকাশ করা হলো, যার দাম ধরা হলো দু’ ফ্র্যা করে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করলেন তেফোয়েল গোতিয়ে-কে। এর মধ্যেকার ছয়টি কবিতা যাতে সমকামী প্রেম এবং ভ্যাম্পায়ারের বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোকে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের পাবলিক সেফটি সেকশন কর্তৃক অশ্লীল হিসাবে নিন্দা করা হয়। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এই কবিতাগুলো ফ্রান্সের সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল। ১৮৬১ সালে বোদলেয়ারের ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ এর দ্বিতীয় সংগ্রহটিতে আরো পঁয়ত্রিশটি কবিতা যোগ করা হয়।
তেফোয়েল গোতিয়ে-কে উৎসর্গপত্রে লিখলেন,
‘ফরাসী সাহিত্যের পরম জাদুকর
আমার অতি প্রিয়, অতি শ্রদ্ধেয়
গুরু ও বন্ধু
তেফোয়েল গোতিয়েকে
গভীরতম বিনয়ের অনুভূতিসমেত
এই দূষিত পুষ্পগুচ্ছ
উৎসর্গ করলাম।’

তবে উৎসর্গপ্রাপক গোতিয়ে থেকে শুরু করে সম্পাদক দ্যু কা, অন্যসব প্রতিভাশালী বন্ধুরা এমনকি বোদলেয়ারের খুড়ো স্যাঁৎ ব্যভ পর্যন্ত একজন কেউও মুখ ফুটে বা লিখিত আকারে বইটি সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না বা লিখলেন  না।

যদিও ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’ ছিল ১৯ শতকের ইউরোপে প্রকাশিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  এবং প্রভাবশালী কবিতাগুচ্ছ যা বোদলেয়ারকে সাহিত্য জগতে অনন্য এক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। আর একইভাবে, ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ছোট গদ্য  কবিতাগুলোও ছিল সেসময়ের গদ্যের কবিতায় সবচেয়ে সফল এবং প্রাথমিকভাবে  গবেষণাধর্মী গদ্যকবিতা। বোদলেয়ারই প্রথম কবি যিনি ছন্দবদ্ধ কবিতাকে আমুল পরিবর্তন করে কবিতার স্তবককে ভেঙে দেন। গুস্তাভ, ফ্লাবার্ট এবং ভিক্টর হুগোর মতো বিখ্যাত সব লেখকরা এই কবিতাগুলোর প্রশংসা করেন। ফ্লবারট বোদলেয়ারকে লিখিতভাবে জানান যে, “আপনি রোম্যান্টিকটাকে একটি নতুন মাত্রায় খুঁজে পেতে অনুপ্রাণিত করেছেন। আপনি অন্যদের চেয়ে আলাদা (যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ)”। পূর্ববর্তী রোম্যান্টিকদের তুলনায় বোদলিয়ার প্যারিসের  শহুরে জীবনকেই রোম্যান্টিকটার প্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং দাবী করতেন যে সবচেয়ে অধোগামী ও অকাব্যিক অবস্থার ভিতর থেকেই শিল্পের সৌন্দর্য তৈরি করতে হবে।

‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল' এর বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট যৌন উদ্দীপক বিষয় এবং শহুরে সৌন্দর্যের  পাশাপাশি অবক্ষয়কে সম্বলিত করা লেখা হওয়া সত্ত্বেও সেসময় ইউরোপের সাহিত্য জগতে বোদলেয়ারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, যদিওবা সমসাময়িক কবিদের মধ্যে তিনি সমসময় ছিলেন একজন অগ্রহণযোগ্য এবং অনুল্লেখিত কবি। বোদলেয়ার প্রায়ই তাঁর বন্ধুদের মধ্যে এবং সমসাময়িক লেখকজগতে বিখ্যাত হওয়ার জন্যে নানা ধরনের ঔদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা এবং খামখেয়ালী ব্যবহার করতেন।  এরকমই এক পর্যায়ে কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ তিনি তাঁর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি আমার সাথে স্নান করতে রাজি হবে না ?” এই সব কারণে সাহিত্য জগতে বোদলেয়ার সম্পর্কে এত ধরনের গল্প চালু ছিল যে, কোনটা সত্য  ঘটনা আর কোনটা কল্পনা সেটা খুঁজে বের করা ছিল মুশকিলের ব্যাপার।

বোদলেয়ারের জীবনে এডগার এলান পো’র অবদান অনস্বীকার্য। নিজের সাহিত্যিক  অসাফল্যে তিনি যখন চরম হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছিলেন ঠিক তখনই পো’র রচনা  তাকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহী করে তোলে। সাহিত্যের মাধ্যমে সেসময় পো’র মধ্য দিয়ে তার নিজেকে প্রকাশ করার আবেগ ছিল অদম্য। তিনি নিজেকে  পো’র অনুবাদক হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করতেন। ৫৬ ও ৫৭ সালে  বোদলেয়ার ‘যমজ আত্মা’ নামে দু’খণ্ডে এডগার অ্যালান পো’র গল্প ও প্রবন্ধের  অনুবাদ প্রকাশ করেন। এরপর আরও তিনখন্ড বের হয় ১৮৫৮, ৬৩ ও ৬৫ তে। এই পাঁচখণ্ড অনুবাদই বোদলেয়ারের সাহিত্যিক জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি বলে মনে করা হয়। সেসময় অনুবাদগুলো ভীষণ প্রশংসিত হয়েছিল। তবে এতসব অনুবাদের মধ্যে পো’র মাত্র ৪টি কবিতার অনুবাদ তিনি করেছিলেন।

বোদলেয়ারের জীবনে আরো দুজন দার্শনিকের প্রভাব বিশেষভাবে পড়েছিল। তাঁরা হলেন জসেফ দ্য মেস্তর এবং সোয়েডেনবর্গ। দ্য মেস্তর ছিলেন দার্শনিক ও কূটনীতিজ্ঞ। বোদলেয়ার তাঁর অন্তরঙ্গ ডাইরিতে বলেছিলেন, জসেফ মেস্তর ও পো  আমাকে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। এদিকে এমানুয়েল সোয়েডেনবর্গ যিনি তাঁর  অর্ধেক জীবন বৈজ্ঞানিক হিসেবে কাটিয়ে পরবর্তীতে একটি নতুন ধর্মতত্ত্বের প্রবর্তন করেন, তাঁর সমূহ প্রভাব এসে পড়ে বোদলেয়ারের চিন্তা চেতনায়। এরমাঝে বালজাকারের মিস্টিক উপন্যাসত্রয়ের সাথে তাঁর পরিচয় হয় এবং একধরনের অলৌকিকতার দ্বারা প্রবাভিত হয়ে তিনি রচনা করেন তাঁর ‘প্রতিসাম্য’ ও ‘পুনর্জন্ম’ কবিতাগুলো।

১৮৬২ সাল থেকে তাঁর অনবরতভাবে স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে এবং দুঃস্বপ্নে ভুগতে থাকেন। ১৮৬৩ সালে প্যারিস ছেড়ে সাহিত্যের বক্তৃতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রাসেলে রওনা হন। কিন্তু বারবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ৬৬ তে ব্রাসেলসেই প্রকাশ করলেন ‘বেওয়ারিশ মাল’ কাব্যগ্রন্থটি। তিনি এবছর মার্চে প্যারিসে একেবারে ফিরে যাওয়ার মনস্থির করলেন কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাঁকে ব্রাসেলসেই থাকতে হলো। অবস্থার যখন চরম অবনতি হলো, মার কাছে তাঁকে চিঠি পাঠাতে হলো। সেসময় মাদাম অপিক তাঁর দেখভাল করার জন্য  প্রৌঢ় আইনজীবী আঁসেলকে পাঠালেন। আঁসেল বোদলেয়ারকে নার্সিংহোমে ভর্তি করলেন। সেখানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে মাদাম অপিক এসে ছেলেকে নিয়ে একটি আবাসিক হোটেলে উঠলেন। ১৮৬৬ সালের জুলাই মাসের দু’ তারিখে  আবারো প্যারিসে ফিরিয়ে আনলেন। এখানে একটি নার্সিংহোমের নীচতলায় তাঁকে স্থায়ীভাবে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। তাঁর প্রিয় বইগুলো দিয়ে ঘর সাজানো হলো, দেয়ালে টাঙানো হলো প্রিয় পেইন্টিংস। ঘরের সামনেই একটি ছোট বাগান। মাঝে মাঝে একমনে তিনি সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। বন্ধুরা এলে তাদের কথা শোনেন, কদাচিৎ হেঁটেও বেড়ান। চিকিৎসকরাও আশা করছেন তিনি আস্তে আস্তে সেরে উঠবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ৬৭ সালের মে মাসে তাঁর অবস্থার চরম  অবনতি হলো। জুনের প্রথম সপ্তাহে পুরোপুরি বিছানায় পড়ে গেলেন। এর পরের দু’মাস জ্ঞানহীন মুমূর্ষু অবস্থা কাটলো। ৩১ সে আগস্ট ১৮৬৭ সালের বেলা এগারোটায়, ছেচল্লিশ বছর চারমাস বয়সে তিনি তাঁর মায়ের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন।

যদিও সেসময় ডাক্তাররা নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি, তবুও মনে করা হয় যে,  সিফিলিসই বোদলেয়ারের মৃত্যুর প্রধান কারণ। মৃত্যুর সময়েই কবি হিসেবে বোদলিয়ারের খ্যাতি চারপাশে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। কবি মহলে তিনি তখন একজন প্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবে পরিচিত। বিখ্যাত কবি স্টেফান মালারমে, পল ভারলেন, আরতুর র‍্যাবোর মতো কবিরা তাঁকে নিজেদের পূর্বসূরি হিসেবে দাবি করেন।  বিংশ শতাব্দীতে এসে জ্য পল সাত্রে, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, রবার্ট লোয়েল এবং সিমাস হ্যানের মতো সব খ্যাতিমান লেখক ও দার্শনিকরা তাঁর লেখক ও শিল্পসত্তাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে শুরু করলেন।

‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’এর তৃতীয় সংস্করণটি বের হওয়ার আগেই বোদলেয়ারের মৃত্যু হয়। এটিতে ভুমিকা হিসেবে লিখেছিলেন,  ‘কোনো কোনো বিখ্যাত কবি, বহুকাল  ধরে কাব্যজগতের পুস্পল প্রদেশগুলোতে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। আমি  কিন্তু পাপ থেকেই নিংড়ে বের করেছি সৌন্দর্য – তাতে কৌতুক বেশী, আর দুঃসাধ্য বলেই তা অধিক প্রীতিকর। পরম নিষ্পাপ এই গ্রন্থ কোনো কাজে আসবে না কখনো। আমি এটি রচনা করেছিলাম আর কোনো উদ্দেশে নয়, শুধু নিজের  বিনোদন জোগাতে, আর দুরূহের প্রতি আমার তীব্র অভিরুচির তৃপ্তির জন্য’...

সারাজীবন ধরে অপমানীত ও অবহেলিত বোদলেয়ার মৃত্যুর পরেও খুব বেশী সম্মানিত হলেন না। গির্জায় তাঁর পারলৌকিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণ করার সময়ও  মাত্র একশ লোকও হলো না। দোসরা সেপ্টেম্বর তাঁর সৎকারে বক্তৃতা করার জন্যও কাউকে পাওয়া গেলো না। এমনকি প্যারিসের সাহিত্য পরিষদ সংবাদ করার জন্য একজন প্রতিনিধি পর্যন্ত পাঠালেন না। ১৮৬৭ সালের নভেম্বর মাসেই বোদলেয়ারের গ্রন্থসমূহ নিলামে ওঠানো হলো। মিশেল লেভি পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য মাত্র ১৭৫০ ফ্রাঁ দিয়ে সমগ্র রচনাবলী কিনে নিলেন।

আধুনিক নাগরিক জীবনের জটিলতাই ছিল ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের কবিতার প্রধান বিষয়। যা কিছু কবিতা নয়, তা থেকে তিনি কবিতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর কবিতাগুলোকে অবান্তরতা বর্জন করে কবিতাসর্বস্ব করে তোলেন। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙক্তি ও শব্দ, মিল ও অনুপ্রাস থেকেই পাঠক  রস খুঁজে পান। আবেগের নিবিড়তম মুহূর্তেও উচ্ছ্বাসের হাতে ধরা না দিয়ে কবিতার গভীরতাকে মূল্যায়ন করাই ছিল বোদলেয়ারের মূল উদ্দেশ্য।

তাই বোদলেয়ারের সমগ্র কাব্যে যে বাণী নিরন্তর ধ্বনিত হয়েছে তা হচ্ছে, ‘সকলে জানবে না, জানতে পারবে না বা চাইবে না; কিন্তু কবিরা জানুন’।

গ্রন্থসূত্র

১. শার্ল বোদলেয়ার তাঁর কবিতা - বুদ্ধদেব বসু
২. শার্ল বোদলেয়ার অনন্যদৃষ্টি – সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বোদল্যার, ও বোদল্যার - পলাশ দত্ত
৪. উইকিপিডিয়া










শিবাংশু দে



কুশারিবাগান ৫




নিভৃত  নীলপদ্ম লাগি


তিনি সতত নির্জনতা খুঁজতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথের পুত্র, ভোগসুখ বিষয়প্রবৃত্তির শীর্ষে থাকা মোকাম কলকাতার এক নম্বর পরিবারের ঐতিহ্যধারক, খুঁজে যেতেন ঈশ্বর নামের এক প্রহেলিকাকে। নির্জনতা তাঁর কাছে ঈশ্বরের আরেক নাম। রামমোহন তাঁকে ডাকতেন বেরাদর, পুত্র রমাপ্রসাদের বন্ধু ছিলেন তিনি। তিনি  কেশব সেন ছিলেন না, তাঁর ঈশ্বরচর্চা ছিলো অন্তর্মুখী। ঊনবিংশ শতকের বাঙালির হাজার ভালোমন্দ, শাদাকালোর পরিপ্রেক্ষিতে তিনিও ছিলেন পরিবর্তনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বভাবতই স্ববিরোধের একটি স্তম্ভ। বাড়িতে দুর্গোৎসব হতো, তিনি পৌত্তলিকতার বিরোধী বলে প্রতিবাদে পাহাড়ে চলে যেতেন। অনেকদিন লেগেছিলো তাঁর এই মূর্তিপূজা নিবারণ করতে। একদিকে সংসারে নির্লিপ্ত, অন্যদিকে অতি সংলিপ্ত। ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর জুড়ি সেকালের বঙ্গীয় নক্ষত্রসমাজে আর কেউ ছিলো না। কিন্তু যেমন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বলেছিলেন, "বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা", তিনি ছিলেন তাই। পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর স্মৃতিকথায় খুব সরলভাবে লিখেছিলেন, " মার শ্বশুরমশায় তো কলকাতায় থাকতেন না। তিনি হিমালয়ে ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াতেন।" কেন বেড়াতেন? কী প্রয়োজন ছিলো তাঁর, কোন আকুলতা? লোকজন রামায়ণের সংসারী ঋষি বিশ্বামিত্রের প্রতি প্রযুক্ত আখ্যাটি ধার করে তাঁকে বলতো 'মহর্ষি'। রাজা জনকের অনুকরণে 'রাজর্ষি' বলতো না। এটাও একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। তাঁর সংসারী সত্ত্বাটিকে অনেক বেশি ছেয়ে থাকতো তাঁর অতিসংসারী সত্ত্বা, সেটাই কি কারণ?

ভুবনডাঙ্গার মাঠে দেবেন্দ্রনাথের ছাতিমগাছ আবিষ্কার, বাংলার আবহমান সংস্কৃতি ইতিহাসে একটা অন্যযুগের বীজবপন বলা যায়। তিনি কীভাবে, কখন এই গাছটিকে ধ্যানের আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তা নিয়ে পন্ডিতজনের নানা মত রয়েছে। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা প্রমথনাথ বিশী, সবাই ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। তবে প্রশান্তকুমার পাল মশায় জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত। দেবেন্দ্রনাথ গুসকরায় এক নির্জন প্রান্তরে তাঁবু খাটিয়ে ধ্যান করতেন। সেখান থেকে একদিন তাঁর সুহৃদ রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহমশায়ের আমন্ত্রণে পাল্কিতে দিগন্তবিস্তৃত ভুবনডাঙ্গার মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর বাড়ি। পথে তাঁর চোখে পড়ে ঐ ছাতিমগাছটি। তিনি পাল্কি থামিয়ে কিছুক্ষণ ঐ গাছের ছায়ায় বসে ঈশ্বরচিন্তা করলেন। তাঁর মনে হলো এই স্থানটিই নির্জনে ঈশ্বরকে স্মরণ করার উপযুক্ত ঠিকানা। ফিরে গিয়ে ১৮৬৩ সালের পয়লা মার্চ সেখানকার জমিদার প্রতাপনারায়ণ সিংহের থেকে বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় মৌরসি পট্টা নিলেন ভুবনডাঙ্গা গ্রামে বাঁধপারের বিশ বিঘে জমি। উদ্দেশ্য ছিলো সেখানে ব্রাহ্ম উপাসনা ও চর্চার জন্য একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা।

এই প্রান্তরে ১৮৬৩ সালেই মহর্ষির নির্মিত প্রথম অট্টালিকাটির নাম ছিলো শান্তিনিকেতন গৃহ। তার নামেই সমগ্র ভূখন্ডটির নাম হলো 'শান্তিনিকেতন'। ১৮৯০ সালে উপাসনা গৃহ নির্মিত হবার আগে পর্যন্ত এখানেই ব্রহ্ম-উপাসনা হতো। ১৯০১ সালে কবি যখন পাঁচ জন ছাত্রকে নিয়ে ব্রহ্মচর্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তখন তিনি সস্ত্রীক এই ভবনটিতেই থাকতেন। গীতাঞ্জলির অধিকাংশ কবিতা এখানেই রচিত। পাশেই ছাতিমতলায় ধ্যানের বেদী। তাঁর প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি। শান্তিনিকেতন গৃহ একটি দোতলা সুরম্য ভবন। আইওনিক স্তম্ভ, ত্রিকোণ কর্নিশ আর সবুজ খড়খড়ি দেওয়া দীর্ঘ  জানালারা। বাড়িটির পিছন দিকের বিস্তারটি ক্রমশ কমে গেছে। কপালে লেখা "সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং"। এখানে এখন একটি জাদুঘর। শৈশব থেকে কবি এসে এখানেই থাকতেন। বাড়িটির ঠিক সামনেই প্রতিষ্ঠিত রামকিঙ্করের বিমূর্ত ভাস্কর্য 'অনির্বাণ শিখা'। একটু এগিয়েই ডানদিকে সেই বিখ্যাত বিপুল বটবৃক্ষটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। যার নীচে কোনকালে একটি ছোটো জলাশয় ছিলো।  আর ছিলো পাথর জমিয়ে তৈরি করা বালক রবীন্দ্রনাথের তিনটি ঢিবি, যেজন্য তার নাম তিন পাহাড়। রাস্তার ওপারেব উপাসনাগৃহ বা ব্রাহ্মমন্দির, যার ডাকনাম কাচঘর।

অনেক সুখে অনেক দুখে তোমার বাণী নিলেম বুকে
ফাগুনশেষে যাবার বেলা আমার বাণী যাবো বলে
আমি যাবো না গো অমনি চলে ...

আমার বাবা প্রথম শান্তিনিকেতনে যেতেন গত শতকে চল্লিশ দশকের শেষদিক থেকে। তখন তিনি কলকাতায় কলেজছাত্র। ততোদিনে সূর্য ডুবে গিয়েছে, কিন্তু গোধূলির কিছু লালিমা তখনও আকাশে বেঁচে ছিলো, যথেষ্ট উজ্জ্বল। শান্তিনিকেতনের পথেঘাটে খালিপায়ে, কখনও চটি পরে, টোকা বা ছাতা মাথায় বহু ডাকসাইটে মানুষেরা ঘোরাফেরা করতেন। দর্শনধারী কিস্যু ঠাহর হবে না, কিন্তু নামটাম শুনলেই চমকে যেতে হতো। বাবা বলতেন ওখানে রিকশাচালকদেরও একটা অন্যস্তরের জানাবোঝার জগৎ ছিলো। বাইরের লোকজন তো চিরকালই সেখানে আসেন নিয়মিতভাবে। শান্তিনিকেতনে তাঁদের জন্য পান্ডার ডিউটি করতেন ঐ রিকশাচালকেরা। আসলে শান্তিনিকেতনে পর্যটকের লিস্টিটি প্রথম তৈরি হয়েছিলো রিকশাচালকদের দৌলতেই।

নতুনবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলুম ছায়ায়। এক রিকশাসওয়ার দম্পতিকে চালক প্রশ্ন করছেন, বলুন তো রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর আসল নাম কী? তাঁরা এদিকওদিক ভেবে বললেন, মৃণালিনী না? এই তো, জানেন না তো, উনার নাম ছিলো ভবতারিণী। তাই...? হমম, তিনি হলেন যশোরের মেয়ে। এই বাড়িটায় থাকতেন, হুই যে ওদিকের ঘরটা, উনার রান্নাঘর (এই কথাটা যদিও সত্যি নয়, কারণ ঐ বাড়িতে তাঁর থাকার সুযোগ হয়নি)। পর্যটকেরা চমৎকৃত হয়ে শুনতে থাকেন। খানিক পরে সেই রিকশাচালককেই দেখি কলাভবনের সামনে দেওয়ালের অলংকরণ দেখিয়ে সেই দম্পতিকেই বলছেন, ঐ যে দেওয়ালের আঁকা, ওটা মানিদা'র করা। মানি'দা কে? সে কী, নাম শোনেননি? খুব বড়ো আটিস। তাঁরা মাথা নাড়েন। কে জি সুব্রামনিয়ান বেশ ভারি নাম, রিকশাচালকের সব সময় মনে থাকে না হয়তো।

কলকাতায় ছিলো 'বাবু' কালচার, শান্তিনিকেতনে শুরু থেকেই 'দাদা' কালচার। সম্ভবতঃ কবি নিজে, অবনীন্দ্রনাথ আর দু'য়েকজন 'কড়া' শিক্ষক (যেমন জগদানন্দ প্রমুখ) ছাড়া সবাই 'দাদা'গিরির অংশ ছিলেন।

শান্তিনিকেতনের গৌরব ছিলো না ইঁটকাঠ, ধুলোমাটি, কুবেরযক্ষের মেহরবানি। সেখানে ছিলো শুধু একদল মানুষ, যারা দায়িত্ব নিয়েছিলো সারা বিশ্বে বাংলাভাষায় বেঁচে থাকা মানুষদের জীবনে একটা নতুন ধরনের সেরিব্রাল মাত্রা যোগ করার। এই মাত্রাটির দৌলতেই বাংলাভাষীরা দীর্ঘদিন ধরে বোধবুদ্ধির জগতে অন্যান্য দেশবাসিদের থেকে নিজেদের উৎকৃষ্ট ভাবার অহংকার করে  এসেছে। প্রাথমিকভাবে উৎসটি ছিলো দ্বারকানাথের দুই পুত্রের দেহকোষে ওয়াটসন-ক্রিক সাহেবের নক্শায় আঁকা কিছু প্রোটিনের কারিকুরি। কালক্রমে সেই সব সংক্রামক প্রোটিনশৃঙ্খলের জাদু ছড়িয়ে পড়েছিলো যতসব মরা গাছের ডালে ডালে, আকাশে হাততোলা আগুনের মতো। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে, কোনও জাতির সমগ্র সাংস্কৃতিক চেতনায়, একটি মাত্র পরিবার থেকে স্ফূরিত এই জাতীয় বন্ধহীন প্রভাবী দিগদর্শনের নমুনা আর দেখা যায় না । সেই পরিবারটির বাইরে আরো যে সমস্ত মহৎ মননশীল অস্তিত্ত্বগুলি সেই ধারাটিকে শুধু ধরে রেখেছিলো তাই নয়, তাকে ক্রমাগত পরিবর্ধন, পরিমার্জনও করেছিলো, তাঁদের সিংহভাগ একসময় এই ছোট্টো ভূখন্ডটিতেই নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরাই ছিলেন শান্তিনিকেতনের আসল সম্পদ, বুনো রামনাথের ব্রাহ্মণীর হাতে লালসুতোর মতো গর্বিত অলঙ্কার। সেই আর্ষরীতির অনুগামী হয়তো এখন অনেক কমে এসেছে, তবু রয়ে গেছেন বেশ কিছু মনস্বী মানুষজন।

এমন একজন মানুষ, ড. অশোক কুমার দাস। বর্ষীয়ান শিল্প ইতিহাসবিদ, আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত জাদুঘর বিশারদ, মুঘল ও অন্য ভারতীয় লঘুচিত্র বিশেষজ্ঞ এবং কলাসমালোচক। অনেক পালকই আছে তাঁর মুকুটে। দীর্ঘদিন জয়পুর প্রাসাদ জাদুঘরের অধিকর্তা ছিলেন। তার পর বিদ্যাচর্চার সূত্রে সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করেন নিয়মিত। সারস্বত সাধনা জীবনচর্যার অংশ। প্রেসিডেন্সি থেকে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, ভারতীয় জাদুঘর থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ম, মেট্রোপলিটান থেকে খুদাবক্শ, সর্বত্র তাঁর ঘর বাঁধা আছে। বিশ্বভারতীর সত্যজিৎ রায় অধ্যাপক হিসেবে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তার পর থেকে গত  বাইশ বছর এখানেই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা।
বাগানপাড়াতেই তাঁর সুরম্য বাড়িটিতে বসে নানা আড্ডা। ইতিহাস থেকে হয়তো শুরু, তারপর সেখান থেকে উদ্যানচর্চা, ভোজনবিলাস বা সাহিত্যসহকার, কিছুই অস্পৃশ্য থাকে না। তাঁর সহধর্মিণী শ্রীমতী শ্যামলী দাসের গবেষণা ও বিশেষ চর্চা রয়েছে ঐতিহ্যজাত ভারতীয় বয়নশিল্প ও তার বিবর্তনধারার ক্ষেত্রে।
শান্তিনিকেতন এখনও 'শান্তিনিকেতন' হয়ে রয়েছে এই স্তরের আশ্রমিকদের বোধিব্রত ও জীবনচর্চার সুবাদে।
স্মৃতির সিন্দুক এভাবেই ক্রমে ভরে ওঠে।
এ পথে আমি যে গেছি বারবার...

ছোটবেলা থেকে বাবার থেকে জায়গাটার নানা গল্প শুনতুম। আমাদের তাপদগ্ধ, সবুজবন-পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে আকাশছোঁয়া চিমনি থেকে বৈকুণ্ঠের দিকে  উড়ে যাওয়া শাদা-কালো ধোঁয়ার মেঘ। পরিপাটি কালো রাস্তার  সীমারেখা পেরোলেই ঘাসজমিতে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দু’চার জন শাল্মলী  দেবতা। তাদের শিরপল্লবে আটকে যাওয়া আমাদের ছেঁড়া ঘুড়িগুলি। তোপমার কি চৌরঙ্গি, চাঁদমারিও হতে পারে। মহান্তিস্যারের কাছে শেখা পাটিগণিত আর পাত্রস্যারের কাছে ইংরিজি। ঐকিক নিয়ম কিংবা মেনসুরেশনের অঙ্ক ভুল হলেই হাত পেতে কঞ্চির সপাং। আমাদের লেখাপড়া এরকমই। ক্লাস নাইন স্পেশালে ওঠার পর ইংরিজি বই ফ্রি ইণ্ডিয়া রিডার। মাখনরঙের মলাটে হার্কিউলিসের গ্রিক দেওয়ালচিত্রের আদলে লাইন ড্রইং আঁকা। প্রথম লেখাটিই শান্তিনিকেতনের আমবাগানে বসে পাঠশালার গল্প। অবাঙালি বন্ধুরা সবাই ভাবতো শান্তিনিকেতন মানেই মাঠেঘাটে খাতাবই নিয়ে বসে পড়া। শিক্ষক আসেননি এক পিরিয়ড। সবাই পিছনের ঘাসমাঠে গাছতলায় বসে , "আজ হমলোগোঁ কে শান্তিনিকেতন হ্যাঁয়।" ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যবিদ্যালয় স্থাপনের পর সত্তর বছরের বেশি হয়ে গেছে ততদিনে। কবি যে বলেছিলেন উচ্চশিক্ষা মানে মাথার ভিতর শুধু তথ্য বোঝাই করা নয়। প্রকৃতির ভিতর নিজের আসল জায়গাটা চিনে নেওয়াটাই উচ্চশিক্ষা। ক'জন বুঝেছিল সেসময় তাঁর বক্তব্যটা জানা নেই। আচার্য যদুনাথ সরকারকে যখন কবি অনুরোধ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করার জন্য, যদুনাথ শিক্ষা বিষয়ে কবির ধারণাটিকে এক কথায় নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। তার কতদিন পরে আমাদের সময়েও দেখতুম 'রুচিশীল, সম্পন্ন' মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মায়েরা মেয়েদের শান্তিনিকেতন পড়তে পাঠাতেন। 'পড়তে' কি না বলা মুশকিল। আমার ধারণায় সাহেবদের অনুকরণে 'গ্রুমিং' করতে পাঠাতেন মেয়েদের। গান শিখবে, আঁকা শিখবে, সাজতে শিখবে, সূক্ষ্মভাবে কথা বলতে শিখবে। অর্থাৎ একজন ভাবী বড়োসাহেবের পত্নী হয়ে ওঠার গুণগুলি অর্জন করবে। সুইজারল্যান্ডের বদলে শান্তিনিকেতন। কিন্তু ছেলেরা কখনও যাবে না। তারা 'ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র' হবে। ওসব শান্তিনিকেতনি হ্যাংওভার তাদের জন্য নয়।

অন্য জায়গার কথা হয়তো বলতে পারবো না। তবে আমাদের শহরে সেরকমই হতো। সেখানে বাংলা ভাষাসাহিত্যের অধ্যাপকদের পুত্রকন্যা  'বাংলা' মাধ্যমে পড়তো না। সত্যি কথা বলতে কি কখনও বানান করে আনন্দবাজার পড়তে পারাই মস্তো সাফল্য ছিল তাদের। কিন্তু বাংলাভাষার 'দুরবস্থা' নিয়ে মিটিং মিছিলে তাঁরা সবার আগে বক্তব্য রাখতেন। এরকম একটি সভায় আমি যখন এই রূঢ় সত্যটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলুম, সভায় কর্ণবিদারী নীরবতা নেমে এসেছিল। সন্তানের 'দুধেভাতে' থাকার ব্যবস্থা না করে দিতে পারলে কীসের মাতৃভাষা? এমতাবস্থায় ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের তপোবন বা আদি পাঠভবন কেউই ধোপে টেকেনি। কিন্তু প্রথম যখন দেখেছিলুম আমগাছের ছায়ায় বেতের কি ঘাসের চাটাই পেতে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে, বেদনার মতো কিছু বেজেছিল কোথাও। 'ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়রে'র জীবন বড়ো কাছে থেকে, স্পর্শ করে চিনেছি আমরা। শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছোয় তা, তাও জানি। কিন্তু ঐ আমবনের ছায়ায় বসে রোদে হাওয়ায় নেওয়া পাঠ পরে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, তা জানতে পারিনি। হয়তো এটা জানার জন্যই আবার জন্মাতে হবে।

যখনই যাই ঐ চত্বরের গাছের ছায়ায় গোল ঘেরা ছেলেদের বেঞ্চি, রাখালরাজের সিংহাসনের মতো শিক্ষকের বেদি, ঝরা আমপাতার নরম রঙিন কালিন দেখলে তেলতেলে, ঘামেভেজা, খালিপা, দুই হাঁটুতে ক্ষতচিহ্ন আমাদের শৈশব নীরবে ভিতরে কড়া নাড়ে। হারায়নি তা হারায়নি...

(ক্রমশ)

রোখশানা রফিক



সুশীলতার প্রতিচ্ছায়ায় অপরাধপ্রবণতা  (Dis identification of self-crime) 

 




বর্তমান উপমহাদেশীয় সমাজব্যবস্থায় দিন দিন হু-হু করে বেড়ে চলেছে অপরাধপ্রবণতা। এর কারণ হতে পারে মূলতঃ দু’টি - সমাজে অপরাধীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়া অথবা সাধারণ মানুষের মূল্যবোধের অবনতি হয়ে তাদের দ্বারা ছোট-বড় নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত হওয়া।

বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে গেলে আমরা দেখতে পাই, বর্তমানে আইন-শৃঙ্খ্লা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগ ও ব্যক্তিবর্গের প্রশিক্ষণ  ও দক্ষতা আগের তুলনায় আধুনিকীকরনের কারণে, বাহ্যতঃ চিহ্নিত অপরাধীর সংখ্যা গাণিতিক অথবা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার বা  দমনের ক্ষেত্রে, তারা একেবারেই অসফল তা নির্দ্বিধায় বলতে পারার কোনো কারণ নেই। তাহলে কি প্রতিপাদ্য হয় যে, সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সাধারণ মানুষ তথা সামাজিকভাবে সুনাগরিক হিসাবে  চিহ্নিত মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়া?

এক্ষেত্রে সমাজে নতুনভাবে যে অভিনব মাত্রাটি যুক্ত হয়েছে সেটি হচ্ছে, বর্তমান উপমহাদেশীয় সমাজে সাধারণ নাগরিক তথা বাহ্যিকভাবে সুনাগরিক হিসাবে চিহ্নিত মানুষ, তার নিজস্ব নৈ্তিক মূল্যবোধের সীমা লঙ্ঘন করে চেতন অথবা অবচেতনভাবে আকস্মিক অথবা পরিকল্পিত উপায়ে নানা ছোট-বড় অপরাধ সংঘটিত করে, যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে সামাজিকতার ফিল্টারের নেতিবাচক দিক থেকে ভালোমানুষের রূপ ধরে পরিস্রবনের মাধ্যমে ইতিবাচক অবস্থায় নিজের স্থান পরিবর্তন করে নিচ্ছে। যেন এটি একটি লেইন-বাইলেইন চেন্জ করতে পারা টু ওয়ে হাইওয়ের মতোন চলমান প্রক্রিয়া। অপরাধীর বদলে সুনাগরিকের মুখোশটি তারা বসিয়ে নিচ্ছে নিজের সামাজিক প্রতিচ্ছবির মুখায়বয়বে।আধুনিক সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে এটি একটি চমকপ্রদ সংযোজন হতে পারে। আর এক্ষেত্রে একজন সুনাগরিকের দিকে অপরাধী হিসাবে অঙ্গুলী নির্দেশ করা দুরুহ হয়ে দাঁড়ায় সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীগনের পক্ষে। ফলে তার কৃত অপরাধসমূহ বিচারের মুখ না দেখে বরং ধামাচাপা পড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশী দেখা দেয়।

এ বিষয়ের অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের আশেপাশেই।  যেমন কোনো কোনো সুগৃহিনী-মাতা-ভগিনীই আধুনিককালে সকলের অগোচরে এসকর্ট বা দেহপসারিনীর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক কাঠামো ঠিক রেখেই। অথবা জড়িয়ে পড়ছে পরকীয়ার মতো অস্থিতিশীল অনৈতিক সম্পর্কে। ...বাহ্যত সৎ কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিটিই হয়তো কোনো পদোন্নতি বা আর্থিক  সুবিধা পেতে উৎকোচ বা অন্য কোনো উপঢৌকন দিচ্ছে তারই উর্ধ্বতন বস বা  সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে। কিংবা হয়তো ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের অধঃস্থনকে হেনস্থা করছে নানা উপায়ে বা নিজেই ঘুষ গ্রহণ করছে। আবার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই মানুষটিই ধর্মভীরু সৎ মানুষ হিসাবে যা যা আচরণ করা প্রয়োজন, তা পালন করে যাচ্ছে নিয়মিতভাবে। সে হয়তো পারিবারিক আবহে বা বন্ধু পরিমন্ডলে অত্যন্ত রুচিশীল দায়িত্ববান মানুষ হিসাবেই পরিচিত। এর ফলে তার কৃত অপরাধ সহসাই ধরা পড়ছে না কারো চোখেই। এমনকি অনেক সময় নিজের অবচেতন মনে সে স্বয়ং নিজের অভ্যন্তরীণ সত্ত্বার কাছেই অস্বীকার  করছে যে, এ ধরনের কোনো অন্যায় বা অপরাধ তার দ্বারা আদৌ সংঘটিত হতে  পারে। কিংবা নিজের কৃত অপরাধে অনুতপ্ত হয়ে বা অনুশোচনায় ভুগে, আরো বেশী করে সৎকর্মে বা ধর্মকর্মে নিয়োজিত করছে নিজেকে। এরকম পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি নিজেই যেখানে নিজেকে অপরাধী ভাবতে পারছে না, নিজেই নিজের চোখে ধুলো দিচ্ছে বা আই-ওয়াশ করে চলেছে, সেখানে পারিপার্শ্বিক মানুষজনের পক্ষে এই ব্যক্তিটির কোনো ধরনের নেতিবাচক কাজের সাথে জড়িত থাকার ক্ষীণতম সম্ভাবনার চিন্তাও কাজ করছে না। সামাজিক মনোস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে এই ধারণাটির নামকরণ করা যেতে পারে ‘Disidentification of self crime’.

কিন্তু কেন আজকাল মানুষ নিজের করা ছোট-বড় অপরাধগুলোকে ধর্তব্যের  মধ্যে আনছে না, সে বিষয়টিও বিবেচনায় এনে তার কারণসমূহ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। এ ধরনের সমস্যার প্রতিকারের উপায়গুলো অনুসন্ধান করতে গেলেও আমাদেরকে এসবের ভিত্তিমূল হিসাবে কাজ করে যে কারণগুলো, তাদেরেকে চিহ্নিত করে তবেই এগোতে হবে প্রতিকারের লক্ষ্যে।

Disidentification of self crime এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে বর্তমান সমাজে  উচ্চতর ডিগ্রীর সহজলভ্যতা। আজকাল নতুন নতুন সরকারী-বেসরকারী উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ার ফলে আগের চেয়ে অধিকসংখ্যক মানুষ উচ্চতর ডিগ্রীলাভের সুযোগপ্রাপ্ত হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভাব থেকে যাচ্ছে সুশিক্ষার। এর বিপরীতে একজন উচ্চ ডিগ্রীধারী ব্যক্তি হিসাবে নিজের স্থান উঁচুতে মনে করে, নিজের ইতিবাচক-নেতিবাচক সবধরনের কাজকেই ‘জায়েজ’ মনে করছেন একশ্রেণীর মানুষ। এক্ষেত্রে তাদের এমন মনোভাব কাজ  করে যে, “আমার মতোন একজন সুশিক্ষিত মানুষ কি এধরনের ভুল কিছু করতে পারে?” আর এই মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাকে ঠেলে দেয় ন্যায়-অন্যায়ের নৈতিক সীমালঙ্ঘন অতিক্রম করার প্রবণতার দিকে।

সেইসাথে কারো মালিকানায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদ থাকলে, সেও নিজেকে সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা ভেবে নিয়ে, অনেক সময় নিজের ও নিজের পরিবারের করা সব ধরনের কাজকেই ‘জায়েজ’ মনে করেন। নিজের অপরাধ  ঢেকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো নাক সিঁটকিয়ে আঙ্গুল তু্লে থাকেন অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণীর দিকে। যেন অপরাধী হওয়ার পূর্বশর্তই হলো দরিদ্র  হওয়া কিংবা বস্তির বাসিন্দা হওয়া। এক্ষেত্রে বাস্তবতা কিন্তু অন্য কথা বলে। আর বাস্তব সত্য হল, একজন অপরাধীর জন্ম পরিচয় হতে পারে সমাজের যে কোনো অর্থনৈতিক স্তরে। দরিদ্র হলেই কোনো মানুষ অপরাধী হবে, আর ধনবান হলেই কো্নো মানুষ অন্যায়ের ঊর্ধে অবস্থান করবে, সেটা নাও হতে পারে।

তৃতীয় কারণটি হচ্ছে, প্রকৃত ধর্মভীরুতার চেয়ে বাহ্যিকভাবে ধর্মের  আনুষ্ঠানিকতা চর্চার দিকে মানুষের মনোযোগ বেড়ে যাওয়া। ধর্মভীরুতা হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি সেই শ্রদ্ধাবোধ, যা মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তে যে কোনো ধরনের অন্যায় আচরণ থেকে বিরত রাখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। আর বাহ্যিক  ধর্মচর্চা হচ্ছে ধর্মীয় রীতিনীতি আচার-নিয়ম-নিষ্ঠা পালনের সেই প্র্যাকটিস যা মানুষকে সকলের চোখে ধার্মিক হিসাবে চিহ্নিত করে থাকে। এক্ষেত্রে কোনো  একজন মানুষ আন্তরিকভাবে ধর্মচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলে ছোট-বড় কোনো ধরনের অপরাধ করাই তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কোনো মানুষ যদি  মেকী বা ভন্ডামী বা লোকদেখানো ধর্মচর্চায় সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে সুযোগ মতোন সময়ে নৈতিকতার সীমালঙ্ঘন করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। এ ধরনের ব্যক্তি আসলে কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক অনুশাসনের ধার ধারে না। যে  কোনো ধরনের অপরাধ করা শেষে সে নির্দ্বিধায় প্রত্যাবর্তন করে নিজের  ধার্মিকতার লেবাসে। এই যে Disidentification বা নিজেকে চিহ্নিত হতে না দিয়ে নিজের কৃত অপরাধগুলো আড়াল করার প্রচেষ্টা , এটিই আমাদের আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়।

বহু হিজাবধারী মহিলা আজকাল নানা অতিআধুনিক বা অসামাজিক কাজ করে থাকে আড়ালে আবডালে। বাড়িতে অতিথি এলে যে সুগৃহিণী অত্যন্ত রুচিশীল  আবহে আদর-আপ্যায়ন করেন, তিনিই বহুক্ষেত্রে অতিথি চলে গেলে রান্নাঘরে গিয়ে কাজে ফাঁকি দেয়ার অভিযোগে অশালীন বাক্যপ্রয়োগ করেন গৃহপরিচারিকার দিকে। আবার যে গাড়িচালক মালিক এবং তার পরিবারের  সামনে বিনয়ের অবতার সেজে গাড়ির দরজা মেলে ধরে বা তাদের ব্যাগ বহন  করে, সেই চালকই আবার রাস্তায় অন্য ড্রাইভারকে অসতর্কতার অভিযোগে কুৎসিত ভাষায় গালি দিয়ে থাকে। হয়তো যে বালিকাটি বাবার কাছে অভিমান-আবদারে কে এফসি, পিজ্জাহাটে যাবার বায়না ধরছে ইনোসেন্ট ভাবে, সেইই আবার একাধিক বয়ফ্রেন্ডকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে দিনের পর দিন। যে শিক্ষক ক্লাসে নিয়মানুবর্তিতা ও সততার লেকচার দিয়ে ছাত্রদের মন্ত্রমুগ্ধ করছেন, তিনিই কোচিংএ মাসকাবারির টাকা থুথু দিয়ে গুনে পকেটে ভরছেন তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে। যে লেখক/শিল্পী গণমানুষের কাছে রূপ-গুণ-মেধা-রুচির  জন্য নন্দিত হচ্ছেন, তিনিই হয়তো রাতবিরেতে অভিসারে বেরিয়ে যাচ্ছেন প্রযোজক, পরিচালক বা বিত্তবানদের সাথে। যে আয়া বা গৃহপরিচারিকা কোনো শিশুর অভিভাবকের সামনে তাকে সোনা-ময়না-টিয়াপাখি বলে তুলুতুলু আদর দেখাচ্ছে, বাবা-মা কাজে বেরিয়ে গেলে সেই আয়াই হয়তো বাচ্চাকে মারধর বা নানা অবহেলা করছে। মাদার্স ডে/ ফাদার্স ডে’র দিনে যারা বাবা/মাকে জড়িয়ে  ধরে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমের মাঠ সরগরম করছেন, তাদের অনেকেই দিনের পর দিন বাড়ির এককোণায় অবহেলায় ফেলে রাখছেন বৃদ্ধ বাবা-মাকে,  অথবা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হচ্ছেন। প্রতিবেশীর উন্নতিতে যে মানুষটি সামনে পিঠ চাপড়ে বাহবা দিচ্ছেন, আড়ালে সেই ব্যক্তিই হয়তো তার চরম নিন্দুকের ভূমিকা পালন করছেন। কোনো তরুণীর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যে যুবক রুবাইয়াৎ বা শেরশায়েরী বা ভ্যালেন্টাইন সং আওড়াচ্ছে, সেইই আবার প্রত্যাখাত হয়ে চারিত্রিক অপবাদ দিতে ছাড়ছে না মেয়েটিকে। অফিস শেষে যে স্বামী ঘরের গৃহিণীর জন্য ফুলের তোড়া বা সোনার অলংকার হাতে ঘরে  ঢুকছেন, সেইই হয়তো বিকেলে পার্সোনাল সেক্রেটারী বা সহকর্মী মহিলার সাথে প্রেমালাপ লীলা খেলে এসেছেন।

এই যে দ্রুত এক ভূমিকা থেকে আরেক ভূমিকায় নিজেকে প্রতিস্থাপন, এর জন্য যে দক্ষতা ও কূটবুদ্ধি প্রয়োজন, তা মানুষের মধ্যে বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। সেজন্য অবশ্য মূল দায়ী হিসাবে আকাশ সংষ্কৃতির দিকে আঙ্গুল তোলা যায়। সাথে যুক্ত করা যেতে পারে সুস্থ বিনোদন না থাকা কিংবা সততার অভাবের মতো কারণগুলোকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রোড এক্সিডেন্টে মৃতপ্রায় মানুষের মুখে একফোঁটা পানি দেয়া বা তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার চেয়ে, আশেপাশের মানুষ আজকাল অনেক সময় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে আহত/নিহত মানুষটির সাথে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিতে। এই দুষ্কর্মগুলো যারা করছে, তারাও কিন্তু নিজ পরিবার বা সন্তান-সন্ততির কাছে ভালোমানুষ হিসাবেই চিহ্নিত অথবা ভালোমানুষ সেজে থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে নিঁখুতভাবে। কিংবা হয়তো তার পরিবারেরও ইন্ধন আছে এ কাজে, কিন্তু আশেপাশের মানুষের কাছে তারা সুশীল-ভদ্র-সভ্য-সজ্জন হিসাবেই পরিচিত।

আজকাল যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে, যেসব নিউক্লিয়ার পরিবার চালু হয়েছে, সেখানে বেড়ে ওঠা সন্তান-সন্ততি বঞ্চিত হচ্ছে মুরুব্বী শ্রেণীয় আত্মীয়দের কাছ থেকে শেখা পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শেখার ও চর্চা করার সুযোগ থেকে। এর ফলে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মিডিয়া তার সমুখে যেসব চটুল চারিত্রিক গুণাবলী ও মূল্যবোধ তুলে ধরছে, সেগুলোকেই সে মডেল  হিসাবে ধরে নিয়ে, সেগুলোর চর্চা করছে অতি উৎসাহে।

আজকাল আবার বহু পরিবারেই বাবা-মা উভয় অভিভাবকই কর্মজীবি। ফলে সন্তান-সন্ততির চারিত্রিক বিকাশে প্রয়োজনীয় গুণাবলী শিক্ষা দেয়ার জন্য যে  সময় ও শ্রম দেয়া প্রয়োজন, তা ইচ্ছা-অনিচ্ছা যেভাবেই হোক বের করা তাদের জন্য সম্ভবপর হচ্ছে না। ফলে তাদের সন্তানেরা জীবনধারনেরর জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বা আধুনিক উপকরণসমূহ সহজেই হাতের কাছে পাচ্ছে, কিন্তু জীবনযাপনের সঠিক মূল্যবোধ শেখার ক্ষেত্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আরেকটি বিষয় এখানে না উল্লেখ করলেই চলে না। তা হচ্ছে, আজকাল গ্লোবালাইজেশনের ফলে পুরো বিশ্বকে গণ্য করা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ হিসাবে।  বেড়ে গেছে একদেশ থেকে আরেক দেশে, এক উপমহাদেশ থেকে আরেক উপমহাদেশে মাইগ্রেশন বা দেশান্তর/স্থানান্তরের হার। ফলে এসব পরিবারের সন্তান-সন্ততি দুই বা ততোধিক সাংষ্কৃতিক মুল্যবোধ বা different cultural values এর মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। বাংলায় এরকম প্রবাদ আছে, “একদেশের বুলি, অন্যদেশের গালি”, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম হয়ে দাঁড়াচ্ছে এক্ষেত্রে। একটি বাড়ন্ত বয়সী শিশু বা কিশোর পরিবারের সাথে বিদেশে অবস্থানকালে বাড়িতে হয়তো একরকমের মূল্যবোধ শিখছে, আবার বাড়ির বাইরে বা  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ থেকে গ্রহণ করছে বা এডাপ্ট করছে অন্যরকমের  মূল্যবোধ বা cultural values. ফলে এসব মানবসন্তানের মধ্যে তৈরী হয় Conflict of values বা মূল্যবোধের দ্বান্দিক সংঘর্ষ। ফলে ন্যায়/অন্যায়, উচিত/অনুচিত বোধের ক্ষেত্রে তার মধ্যে ধোঁয়াশার মতো অস্পষ্ট ধা্রণা/মতামত বা vague ideas তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা বেশী দেখা দিচ্ছে। এ ধরনের দ্বন্দ্বের মধ্যে বেড়ে ওঠা কোনো মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে, কোন্  রীতিনীতি বা আচরণপন্থা আসলে সঠিক অথবা কোন আচরণটি নৈতিকতার মানদন্ডে ভালো/মন্দ কোন্ স্তরে পড়বে?

কিন্তু অবচেতনে নিজের কৃত অপরাধসমূহকে অস্বীকার করেই হোক বা নিজের ছোট-বড় অপরাধগুলোকে ধামাচাপা দিয়েই হোক, অপরাধ আসলে অপরাধই, আর যে ব্যক্তি অপরাধ সংঘটিত করে সে দোষী। একে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। কাজেই, দোষী ব্যক্তি বা অপরাধী যত দক্ষতার  সাথেই নিজের দোষ ঢেকে বা লুকিয়ে চলুক বা অপ্রত্যক্ষ রাখুক তথা Disidentification করার চেষ্টা করুক না কেন, তাতে তার পাপ লঘু হয়ে যায় না বিধায়, যথোপযুক্ত শাস্তিও তার পাওনা হয়ে যায়। সে শাস্তি হতে পারে বিধাতার তুলাদন্ডে ন্যায় বিচারে বা মানুষের গড়া আদালতে অথবা Natural justice এর মাধ্যমে।

সবশেষে বলা যায়, অপরাধী ধনী/দরিদ্র, বাহ্যত সজ্জন/দুষ্কৃতিকারী, ধার্মিক/বকধার্মিক যাই হোক না কেন, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। “বিচারের বাণী যেথা নিভৃতে কাঁদে” একথা বলেই আমরা যেন আমাদের দায় না সারি। অপরাধীকে চিহ্নিত করে তার উপযুক্ত শাস্তি প্রদানে নিশ্চেষ্ট না থাকি। এ ব্যাপারে দৃঢ়চিত্তে আমাদের সকলের ভূমিকা স্মরণে রেখে সামাজিক দায়িত্ত্ব পালন করলে তা হবে মানবকল্যাণের পথে আরেক ধাপ অগ্রগতি।

“অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন, তৃণ সম দহে” -  একথা মাথায় রেখে আমাদের প্রত্যেকেরই এব্যাপারে নিজ নিজ ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই সম্ভব হবে একটি প্রকৃত সুশীল সমাজ গঠন করা।









পারমিতা চক্রবর্ত্তী



কলকাতার ইতিকথা 




তিলোওমা কলকাতা নগরী, তাকে নিয়ে বাঙালীর উন্মাদনার শেষ নেই৷ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে গিয়ে বাঙালী পরিচয় দিলেই লোকের চোখ গোলগোল হয়ে যায়৷ কলকাতা নিয়ে আমাদের ভালোবাসার শেষ নেই ৷ মোহনবাগান ইষ্টবেঙ্গল কিংবা ঘটি বাঙালের বিবাদ এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে চলেই আসছে৷ ইলিশ, গলদার বিবাদ যেমন থাকবে; থাকবে ভিক্টোরিয়া, ময়দানের প্রতি আসক্তি৷

পুরনো কলকাতার ইতিহাস আমাকে আকৃষ্ট করেছে বারবার৷ কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড়ে (চব্বিশ পরগণা জেলায় এবং কলকাতা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরপূর্ব দিকে একদা ভাগীরথী নদীর অন্যতম প্রবাহ বিদ্যাধরী নদীর কূল ঘেঁষে এর অবস্থান) প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, এই অঞ্চলটি বিগত দু’হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে  জনবসতিপূর্ণ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলায় পর্তুগিজদের যাতায়াত শুরু হয়। সে যুগে টালির নালা (মারহাট্টা ডিচ) বা আদিগঙ্গা ছিল সমুদ্রে যাতায়াতের পথ। সমুদ্রগামী বড়ো বড়ো জাহাজগুলি এখন যেখানে গার্ডেনরিচ, সেই অঞ্চলে নোঙর ফেলত। কেবল মাত্র দেশি ছোটো নৌকাগুলিই হুগলি নদীর আরো উজানের দিকে চলাচল করত। সরস্বতী নদী ছিল এই সময়কার আরও একটি জলপথ। এই নদী ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুকিয়ে যেতে শুরু করে৷

কলকাতা নামকরণ কেন কলকাতা হয়েছে, মানে কলকাতা নামকরণের পিছনে  কারণ কী, তা আমরা অনেকেই জানি আবার অনেকেই জানি না৷ তবে সুষ্পষ্ট  ভাবে জানা যায়নি কলকাতার নামকরণের ইতিহাস। কলকাতা হল সব জাতির প্রাণকেন্দ্র, তা অতীত কিংবা বর্তমান উভয় সময়েই৷ সেই কারণেই অতীতেও  বারবার কলকাতায় আক্রমণ হয়েছে বৈদেশিক শক্রর। ভৌগলিক পরিস্থিতির অবস্থান কলকাতাকে কল্লোলিনী শিরোপা দিয়েছে৷

‘কলিকাতা’ বা ‘কলকাতা’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে নানা  মতান্তর রয়েছে।



সতেরশ শতাব্দীর শেষভাগে সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহরটি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ডিহি কলিকাতা নামটি থেকে কলকাতা নামটির উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন৷

অপর একটি মত হল, ‘কালীক্ষেত্র’ (হিন্দুদেবী কালীর ক্ষেত্র) নামটি থেকে ‘কলিকাতা’ বা ‘কলকাতা’ নামটির উৎপত্তি। মতান্তরে, বাংলা ‘কিলকিলা’ (অর্থাৎ ‘চ্যাপ্টা এলাকা’) কথাটি থেকে ‘কলিকাতা’ নামটির উৎপত্তি হয়। অন্য এক মতে বাংলা খাল ও কাটা শব্দ দু’টির বিকৃতির ফলে কলকাতা নামটির উৎপত্তি ঘটে।
অপর মতে, এই অঞ্চলটি কলিচুন ও কাতা (নারকেল ছোবড়ার আঁশ) উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। সেই থেকেই কলিকাতা নামটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়৷ ২০০১ সালে নামের বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে সমতা রেখে ইংরেজিতেও শহরের নাম কলকাতা (ইংরেজি: Kolkata) রাখা হয়৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতা শহর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শহরের দক্ষিণে যে অংশে ব্রিটিশরা বাস করতেন সেটিকে বলা হত হোয়াইট টাউন এবং উত্তরে যে অংশে ভারতীয়েরা বাস করত সেটিকে বলা হত ব্ল্যাক টাউন।

১৮৫০-এর দশক থেকে কলকাতা শহর বস্ত্রবয়ন ও পাটশিল্পে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার এখানে রেলপথ ও টেলিগ্রাফ প্রকল্পের মতো পরিকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে।

এরপর শুরু হয় কলকাতায় বাঙালি কালচার। ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে শহুরে বাঙালিদের মধ্যে এক নব্যবাবু শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। এই বাবুরা ছিলেন সাধারণত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংবাদপত্রের পাঠক। পেশাগতভাবে এঁরা ছিলেন জমিদার, সরকারি কর্মচারী বা শিক্ষক। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘বাংলার নবজাগরণ’ নামে পরিচিত যে যুগান্তকারী  সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার আন্দোলন বাঙালি সমাজের চিন্তাধারা ও রুচির আমূল  পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তার পটভূমিও ছিল এই কলকাতা শহর।

কলকাতার নগরায়ন শুরু হওয়ার পরও ‘পালকি’ সম্ভ্রান্ত ও অর্থবান বাঙ্গালিদের ও সাহেবদের কাছে ছিল খুব আদরের। তখনকার দিনের পালকি মর্যাদার চিহ্ন বহন করত৷ পালকির উল্লেখ আমরা অনেক বইয়ের মধ্যে পাই৷

এ ছিল আদি ‘নগর কলকাতা’র বাবু কালচারের অন্যতম প্রধান চিহ্ন। সওয়ারি হত দুজন, বইতো ৬জন বেহারা, মালপত্র বওয়ার জন্য কুলি আর রাতের পথে একজন মশালচি। সাহেবরা কলকাতা নগরীর পত্তন করলো মানে দ্রুত গতিতে সে এগিয়ে চললো, এমন নয় মোটেই। পত্তনের পর আরো একশ বছর  কলকাতার চেহারাটা প্রায় একই রকম ছিল। যাতায়াতের জন্য কয়েকটা সরু কাঁচা রাস্তায় গোরুর গাড়ি আর পালকি ভরসা। প্রথম বড় চওড়া খোয়া বাঁধানো রাস্তা সার্কুলার রোড তৈরী হয়েছিল ১৭৯৮/৯৯ নাগাদ৷ ফলে তখন থেকেই ছুটতে লাগল দ্রুত গতির ঘোড়ায় টানা গাড়ি । ঘোড়া মানেই গতি, দ্রুত গতির প্রতীক।

কলকাতার সবচেয়ে ‘নস্টালজিক হেরিটেজ’ হল ঘোড়াটানা গাড়ি। ব্রাউনলো নামে এক সাহেব বের করলেন ‘ব্রাউন বেরি’ নামে ঘোড়াগাড়ি। সাবেকি পালকিতেই চারটি চাকা বসিয়ে সামনে ঘোড়া জুতে দিয়ে বানিয়ে ফেললো এক ঘোড়ায় টানা ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি, ১৮২৭এ । ব্রাউন বেরির ভাড়া ছিল প্রথম একঘন্টায় চোদ্দ আনা, পরের প্রতি ঘন্টায় আট আনা আর সারা দিনের জন্য নিলে চার টাকা। নানান ধরনের ঘোড়ার গাড়ি ছিল সে সময়। সাহেবদের জন্য দামি গাড়ি, সাধারণ কর্মচারিদের জন্য আলাদা গাড়ি। নানান নামের এইসব ঘোড়ার গাড়ি। চেরট, ফিটন, ল্যান্ডো, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এইরকম। অনেক বড় বড় কোম্পানী হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি তৈরী করার জন্য সে সময়। এক্কা গাড়ি, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এসব নামগুলো প্রবাদের মত হয়ে গেছে। এককালে কলকাতার ‘বাবু’রা ফিটনে চেপে ময়দানে হাওয়া খেতেন। আর সেই ঐতিহ্যের পথ বেয়ে এই সেদিনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে সারি দেওয়া ফিটন গাড়ি দেখা যেত ময়দানে শখের হাওয়া-ভ্রমণের জন্য।



এরপর ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হল। মার্চ ১৮৭০ থেকে তোড়জোড় শুরু করে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বউবাজার, ডালহৌসি স্কোয়ার স্ট্রান্ড রোড হয়ে  আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত পাতা হল ট্রাম লাইন আর ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ থেকে ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়ি চলা শুরু করলো । দুটো বলিষ্ঠ ঘোড়া দিয়ে চালানো হত ট্রাম। এরপর অনেক রাস্তায় ট্রাম লাইন পাতা হল, কলকাতা ট্রামওয়েস কোম্পানী গড়ে উঠল। ঘোড়ায় টানা ট্রামই হয়ে উঠলো কলকাতার প্রথম গণপরিবহন ব্যবস্থা। ১৮৯০-৯১ সনে কলকাতায় ট্রাম টানবার জন্য ঘোড়ার সংখ্যা ছিল একহাজারl সবই শীতপ্রধান দেশ থেকে নিয়ে আসা বেশ বলবান ঘোড়া। প্রায় ত্রিশ বছর চালু ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রামের ব্যবস্থা। ঘোড়ায় টানা ট্রামের যুগ শেষ হল ১৯০২এ পৌছে। ২৭শে মার্চ ১৯০২এ প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চলতে শুরু করলো ধর্মতলা–খিদিরপুর পথে।

পথ ক্রমশ বাড়তে লাগল ... কলকাতা ধীরে ধীরে ব্যস্ত হল। তিলোত্তমা  কলকাতা ঘিরে মানুষ গতিশীল হয়ে উঠল। বনেদী গন্ধ, সাবেকী মানসিকতা কোথায় যেন ফিকে হয়ে গেল৷ তবু কলকাতা আজও ভালোবাসার শহর হয়েই থাকল৷

রোমেনা আফরোজ



ফিরোজা রঙের আকাশ...





ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ। দীর্ঘ তিনমাসের ছুটি। এই ফাঁকে বেড়াতে গিয়েছি  নানাবাড়ি। বাবার কয়েদখানা থেকে মুক্ত হয়ে বেশ ঝরঝরে লাগছে। এত ভালো লাগার কারণ মনের সাথে সাথে মানুষের শরীরও স্বাধীনতার অংশীদার হতে চায়। সেই স্বাধীনতার স্বাদ নিতে একবার খালাবাড়ি। আরেকবার বড়মামা। ছোটমামার বাড়ি তেমন একটা যাওয়া হয় না। তিনটি বাড়ি পাশাপাশি থাকাতে আমার পাখি হতে কোনো বাধা নেই। এমনকি মাঝে মাঝে খালার বাড়ি যাবার  নাম করে ছাদে যাই। বিড়াল পায়ে। কেউ কিচ্ছুটি টের পায় না। ওখানে মামাতো ভাই অপেক্ষা করে। তাকেও যে খুব একটা ধরা দেই তা নয়। মন বলে, শরীরকে অত প্রশ্রয় দিতে নেই।

একদিন লুকিয়ে নেমে যাই বিলের জলে।

সেই শীতল জলে রাঁজহাস হতে না পারলেও চলে জলকেলি। বার বার সীমাকে অনুরোধ করি, এসব কথা মামাকে বলিস না। কিন্তু গোপনীয়তা কেবল বৃক্ষদের পাঠশালায় শেখানো হয়। আজকাল মানুষকে চেনা বড্ড জটিলতার বিষয়। আমি চিনে রাখলাম, বসন্তদিনের ঝরাপাতা। নশ্বরতা। ওদের কুয়োর পাড়টা আমাকে টানে। একেবারে চুম্বকীয় টান। ইচ্ছে হয়, বালতি দিয়ে জল তুলে ধুয়ে দিই সব।  ভেতর বাহির। কুয়োর পাশের কাঠবাদাম গাছটা ভীষণ রকমের নিশ্চুপ। আমার মত চঞ্চল হরিণী নয়...

একদিন জুয়েল ভাইকে অনুরোধ করি, স্মৃতিসৌধে যাব। তিনিও বোধহয় লোভ সামলাতে পারলেন না। সম্ভবত মেয়ে বলে লালসার গনগনে আগুনে ঝাঁপ দেয় পুরুষ পানকৌড়ি। দু'দিন পর মধ্য দুপুরকে সাক্ষী রেখে আমরা তিনজন এগোতো থাকি। এই তিনজনের আরেকজন বড় মামাদের ভাড়াটিয়া। এখানে  আসার পর থেকে লক্ষ্য করেছি, ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে ওনাদের মাখামাখি একটু বেশিরকম। এসব স্নেহফল মন্দ নয়!

বাড়ির গণ্ডি পার হওয়ার পরেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।  সত্যি কি আমরা সাভারে যাচ্ছি! কেন যাচ্ছি? স্মৃতিসৌধ দেখতে? মহান মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন। সেই উদ্দেশ্য হয়তো বাহ্যিক, কিন্তু আমার ভেতরে গণ্ডি পার হওয়ার একটা আনন্দ টগবগ করে ফুটছে। যেন চৌকাঠ ডিঙোলেই আনন্দ। কী ফুরফুরে দিন! আমার ভেতরে আঙুর বাগান। পরনের ফিরোজা রঙের শাড়িটা বুঝি বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। একপ্রকার বড় বড় ভাব ঝাপটে ধরে আছে  আমার শাড়ির আঁচল।
ঐ যে একটা রিকশা।

আমরা তিনজন একই রিক্সায়। আমি একদিন আকাশের চেয়ে বড় হব। সেদিন মনের ধুকধুকানি নিশ্চিন্তে মেনে নেবে এসব মুক্তদিনের উজ্জ্বলতা। পরবশ্যতাকে ডিঙিয়ে আমরা স্বাধীনতা স্তম্ভের দিকে যাচ্ছি। রিক্সা থেকে নামতে ভীষণ রকম ব্যস্ত বাসস্টেশন। বাসে, আমার পাশে জুয়েলভাই। এটা কি ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত নদীস্রোত! আমি মাহমুদ ভাইকে আশা করছিলাম। কিন্তু কেন এই প্রত্যাশার বিচ্ছুরণ? জানা নেই। মুক্ত বাতাসে শরীর মন দু’ সত্ত্বাই ঝিমঝিম।  মনের এককোণ থেকে কে যেন আচ্ছন্ন ভাব তৈরি করছে। সবকিছু যেন বরফের মত গলতে চায়। অথচ আমি অখণ্ডতা আঁকড়ে বসে আছি। ওদিকে জুয়েলভাই তার সদ্য প্রেমিকার গল্প বলে ফেনা তুলছেন। আমার কি এসব প্রেম কাহিনী শোনার বয়স হয়েছে? নাকি বয়স এক অযাচিত ঠুনকো বিষয়। বয়স্কদের সমকক্ষ হওয়ার জন্য নিজেকেই তৈরি হতে হয়। এগিয়ে যেতে হয় রঙের কাছাকাছি।

আমরা পৌঁছলাম। আমাদের কারও হাতে ঘড়ি নেই। সূর্যঘড়ির আন্দাজে, তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। অনেকক্ষণ, সূর্য মধ্যকাশ থেকে নেমে খাদের সিঁড়ি ধরে তরতর করে নামছে। যেন পাহাড়িকন্যা। এখানে সেখানে ছায়াদের উচ্চতা। আমরা এলোমেলো হাঁটছি। আমাদের চারপাশে অনেক প্রেমিক প্রেমিকা। দূর থেকে ভেসে আসছে বাঁশির সুর।

মাহমুদভাই একঠোঙা বাদাম কিনে আনলেন। উনি কি জানেন, বাদামের খোসা ছাড়াতে আমার একদম ভালো লাগে না? এভাবেই শেষ বিকেলটাতে কৃষ্ণের বাঁশি বাজে। আগামীকাল কি এমনি রঙিন হবে? ইচ্ছে করছে প্রেম করার। কিন্তু মাহমুদ ভাইয়ের মত বোকাসোকা মার্কা লোকটি কি প্রেমের জন্য উপযুক্ত হবে? জুয়েলভাই মাগরিবের নামাজের জন্য চলে গেলেন। এখন আমরা পাশাপাশি। মন চাইলে, মাহমুদ ভাইয়ের হাত ধরা যায় কিংবা নিষিদ্ধ কথার ফিসফাস। এই যে শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর ভীষণ গোপন কথা বলে, সানাই বাজায়, এর  নামই কি ভালোবাসা? ক্রমশ অন্ধকার রাস্তা ধরে সবাই চলে যাচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করছি মামাতো ভাইয়ের জন্য। অপরিচিত অন্ধকার আমার ভেতর সৃষ্টি করছে ভয়। ঠিক তখনি, একদল পুলিশের আগমন। তারা একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। সম্ভবত আমার কাতান শাড়ি, সাজসজ্জা দেখে ভেবেছে, আমরা পালিয়েছি। ইস! যদি এমন হতো।
মাহমুদভাই পুলিশদের নিয়ে গাছপালার আড়ালে গেলেন। তাদের কথাবার্তা চলছে। দরকষাকষিও। একা হতেই অন্ধকার বিঁধে যায়। মর্মমূলে পাগলাঘণ্টি বাজে। সেই শঙ্কা অতিক্রম করার বয়স তখনো হয়নি।

আমার থেকে অনেকটা দূরে পুলিশের জিপগাড়ি। তাতে কয়েক জোড়া প্রেমিক প্রেমিকা। আমাদেরকেও কি হা করে গিলে খাবে এই গাড়ি? এতক্ষণে জুয়েল ভাইয়ের চলে আসার কথা। কিন্তু তার টিকিটি দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর মাহমুদভাই মলিনভাবে ফিরে এলেন। আমরা সবাই দলবেঁধে চললাম থানার দিকে। এতক্ষণ কোনোমতে নিজেকে সামলে রেখেছিলাম। এখন আর চোখের  জল বাঁধ মানছে না। গাড়ি ছুটছে। আমার পাশে মাহমুদভাই। তার কাঁধে মাথা রেখে আশ্বস্ত হওয়ার ইচ্ছেটাকে তাড়িয়ে দিই জোর করে। দাদি বলতেন, মেয়েরা  হল আগুন। আর পুরুষরা মোম। আগুনের স্পর্শ পেলে নাকি মোমের পাখিরা গলে যায় নিমেষে!

মোম, তুমি আগুন থেকে দূরেই থাক।

কিন্তু আমার পায়ের আঙুল ভয়ানক জ্বলছে। অবশ করা ব্যথা। কখন কোন ফাঁকে কেটে কেটে গেছে জানি না! রক্ত গড়াচ্ছে। এতক্ষণ পুলিশের ভয় এই ব্যথাকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। মাহমুদভাই, আমার খুব ভয় করছে! তিনি একবার ব্যথার  জায়গাটা স্পর্শ করলেন। সেই স্পর্শে জেগে উঠল বুনোমোষ। রাতের অন্ধকার ভেদ করে ঝুমঝুম বৃষ্টি। এখন আর ব্যথা নেই। ভয় নেই। শুধু হাইভোল্টেজ শক। হুহু বাতাসে ছুটে আসছে অন্ধপাখির দল। ছিঁড়ে খাচ্ছে উইঘুরদের মত আমার বাড়িঘর।

এই যে থানা–পুলিশ হলো, এরপর কোন মুখে বাড়ি ফিরবো? আজ রাতে যদি বাড়ি না ফিরি তবে তো সবাই চিন্তা করবে। হয়তো বাবাকেও জানাবে। সে ক্ষেত্রে পুনরায় জেলখানা। তখন হয়ত যাবজ্জীবন। হায়, এই অসামান্য ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে কীভাবে আমার জীবন কাটবে?

সাভার থানা। একটি চেয়ার দখল করে বসে আছি। আমার ডানদিকে আরও দু’টি মেয়ে। কাঁদছে। আমি অবশ্য সামলে নিয়েছি। একজন পুলিশ নানার নাম, ঠিকানা জানতে চাইলেন। কিন্তু বেহুলাবাতাস সব ভুলিয়ে দিয়ে গেছে, নাকি দুঃশ্চিন্তায়  বেড়ে গেছে আমার বয়স, কে জানে! এই শাড়িটাই যত অলক্ষ্মী। মাহমুদভাই  একবারও এদিকে তাকালেন না। উনি পুলিশদের নিয়ে মহাব্যস্ত। এদিকে আমার পেটে ইঁদুর নয়, একটা হাতি নাচানাচি করছে। সেই দুপুরে একমুঠো ভাত খেয়েছি। তারপর থেকে তো ননস্টপ সিনেমা চলছে।


আমরা থানা থেকে ছাড়া পেলাম ন’টার দিকে। মফস্বলের জন্য এটা অনেক রাত। থানার গাড়িটা আমাদের বাস স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে গেল। সেখানে দাঁড়াতেই ধামরাইয়ের শেষ বাস। মাহমুদভাই হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন বাসের দিকে। একেবারে বাসের শেষ প্রান্তে দু’টি সিট ছিল বলে যা রক্ষা। বাস ছুটছে। রাতের বাসের গতি একেবারে তুঙ্গে। বাইরে নিঝুম রাত। গাড়িতেও কোনো শব্দ নেই।  শুনসান নীরবতা। সবাই যেন ক্লান্ত। অবসন্ন। ইস! জুয়েল ভাইটা যে কোথায়? ওকে ফেলে আমরা বাড়ি যাবো কেমন করে? একবার মনে হল, কেউ জান্নাত  বলে ডাকছে। কিন্তু এই বাসে পরিচিত কারও থাকার কথা নয়। তবে কি জুয়েলভাই?

তখনি হাতের স্পর্শ। সেই অতিলৌকিক ছোঁয়ায় ঝনাৎ করে ফিরে তাকাই। বুঝতে পারি, মাহমুদ ভাই ডাকছিলেন। কিন্তু দুঃশ্চিন্তা এবং ক্ষুধায় খেয়াল করিনি সেই ডাক। সাথে সাথে মনে পড়ে, আজ সারাদিন আমার দিকে উনি ফিরে তাকাননি। একটা দুর্বোধ্য অভিমান উথলে উঠছে। - জান্নাত, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে...

সুবীর সরকার




উত্তরকথা




(৪৯)


ঘনঘোর বরিষণের দিনগুলির ভেতর দিয়ে কেমনধারা হেঁটে চলেছেন অন্তেশ্বরী বুড়ি।দশ কুড়ি গাঁগঞ্জে যিনি সকলের অন্তে আবো।তিনি টাড়িতে টাড়িতে ঘুরবেন,নদীর পাড়ে পাড়ে একা একাই বিড়বিড় করতে করতে হাঁটবেন।আকাশের হাড়িয়া মেঘের দিকে উদাসীন তাকিয়ে থাকবেন।আর দেখবেন কেমন হিড়িক হিড়িক শব্দে পাড় ভাঙছে তোরসা কালজানি রায়ডাক মুজনাই এমন সব নদীগুলি।অন্তে আবোর চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে কত কত পুরনো সব দিঙ্কাল।তখন রাজার আমল।চারপাশে সব বড় বড় জোতদারের ঘর।আর আষাঢ় শ্রাবণ জুড়ে একটানা কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টিগাঁ ঘরের গাভরু চেংরার ঘর ভরা নদীতে মাছ ধরতো আর তাদের গলায় কেবল গান আর গান।সমবেতভাবেই-

‘সাঁতাও আসিল রে
কালজানির ওরে কাছাড়ে
ঘর গেরস্থী মাইয়া ছাওয়া
ধরিয়া পলান রে’




(৫০)


সুরবালার সাথে যখন ভানমতির দেখা হল গদাধরের চর ভাসানো জলস্রোতের উপর,ব্যাপারীর নাওয়ে তখন কি বরষার বা বারিপতনের কোনো গান বাজছিলো কোথাও-

‘ও রে ঘাঁত ঘোঁত ঘাঁত ঘোঁত ট্যারট ট্যারট
আসিলো রে বরিষার কাল
ও হো বরিষাকাল আসিবে
জলে সুন্দি হোলা ভাসিবে’

এইভাবেই ইতিহাস-ভূগোলপরিধির ভাঁজে ভাঁজে খাঁজে খাঁজে বর্ষাকাল তার প্লাবন চেনাতে চেনাতে লোকমানুষের বাসভূমির দিকে ভয়াবহ ও সুন্দর এক বিশালাকার বন্য মহিষের মতোন ঢুকে পড়তে থাকে।বর্ষাকাল তখন অগণন স্রোত নিয়ে,লোককথার যাদুবিদ্যার মতোন মেঘনদীবাজনার গান শোনাতে থাকে-

‘আজি তোরসা নদীর উথালপাথাল
কার বা চলে নাও
সোনা বন্ধুর বাদে রে মোর
কেমন করে গাও’




(৫১)


যত কিছুই ঘটুক,ঘটে যেতে থাকুক, অন্তে বুড়ি বর্ষাকালের আন্ধারের রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করবার পরে আর কিছুই করবার থাকে না!তখন চারপাশে জিকিরের মতন ধ্বনিত হতে থাকে কেবল গান আর গান-

‘দোলার জল থই থই
আছে মাগুর সিঙ্গি কই’

বরিষণ মুখরিত বারিসের দিন ও রাত জুড়ে জুড়ে গঞ্জহাটের কোরাসে কেমনতর এক বৈচিত্র্য এসে পড়ে।এসে যায়।ভরা নদীতে তখন বাইচের নৌকোবাইচের গানে গানে জমে ওঠা বর্ষাকাল-

‘ও রে হাউসের মেলা জোড়া খেলা
কালজানির কাছাড়ে
ও হই,মিজান ভাইএর নৌকা ফাইনালে’

খুব খুব ঘুম জড়িয়ে বর্ষায় ভিজতে ভিজতে আদুরে হয়ে ওঠে চরাচর।ঝাপসা বারিপাতের ভেতর রহস্য জেগে থাকে!টিনের চালের ঘড়বাড়িতে বৃষ্টির শব্দ মেদুরতা জাগায়।আকাশের মেঘে মেঘে গানের সহজতায় বর্ষা তার নিজস্বী তুলে ফেললেও,কিছুতেই চূড়ান্ত প্রাপ্তির কথা ভাবা যায় না!আর,অন্তেশ্বরী বর্মণী তার সাড়ে চার কুড়ি বয়সের ভার নিয়েই ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসে আবার কিন্তু বর্ষার সিক্ত ও ব্যাঙদলের হাহাকারের এক মহাপ্রলয়েই গিয়ে ঢুকে পড়েন শেষাবধি।আর,এতকিছু মহাসত্যের ফোঁকরে ফোঁকরে অন্তে আবারও হেঁটে যাওয়ার
দৃশ্যের গায়ে আর কিছুই না,কেবলই লেপটে থাকে আস্ত এক বর্ষাকাল।আর নাচগুলি।আর গানগুলি।আর চাঁদের আলোর নিচে চিরকালীন সব গান বাজাতে থাকে বরিষণঘেরা এক মায়াভুবন-

‘বৈঠাতে জল ঘুঙ্গুরা বাজে রে
নাউ কেনে তোর টুলুং ভুলুং করে
ও বাইচার ভাইয়া’

এভাবেই শেষ না হতে চাওয়া গল্পগুলির হয়তো নতুন করে শুরু হয়!