অনাথ মালচা মহল কথা
ঘন জঙ্গল ঘেরা মালচা মহল। সাতশো বছর আগে ফিরোজশাহ তুঘলক এই মহল বানিয়েছিলেন। তখন এই মহল তুঘলকদের ‘শিকারগাহ্’ ছিল। এখন দেয়ালের পাথর ঝরে পড়ছে। মহলের ছাদ ছেয়ে গেছে ঘন ঘাসের জঙ্গলে। অবধ-এর রাজঘরানার প্রিন্স রজা আলি এবং প্রিন্সেস সাকিনা মহল ১৯৮৫ সাল থেকে এখানেই থাকে। সঙ্গে মা বেগম বিলায়েত মহল। সকাল থেকে বিলায়েতের মন ভালো নেই। শিকারি কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করছে। এমন দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটবে, কে জানতো! চব্বিশটি আর্চ ছিল মহলে। বর্তমানে তিনটি আর্চ অক্ষত আছে। এই সেই মহল যেখানে না আছে কোনো দরজা, না আছে কোনো জানালা।
দিল্লির সর্দার প্যাটেল মার্গ থেকে মালচা মহল পৌঁছোনো কোনো সমস্যা নয়। দিনেরবেলা ঘন জঙ্গলে গাছে গাছে ঝুলতে থাকে অসংখ্য বাদুড়। সাপখোপেরও অভাব নেই। এরই মাঝে রঙবেরঙের পাখপাখালির কণ্ঠস্বর শোনা যায়। চারধারে বুনোফুল ফুটে থাকে। ফেটে যাওয়া ছাদ থেকে ঘরে জল পড়ে। এখন বর্ষার সময় সারারাত এইভাবেই কাটবে। মা বিলায়েত ভাবে। মা ও মেয়ের পরনে শতছিদ্র শালোয়ার কামিজ আর ছেলের পরনে বিবর্ণ পাঞ্জাবি চুড়িদার। বাতাসে ঝমঝম মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ।
ইলেকট্রিক কানেকশন নেই। জলের কোনো নিয়মিত ব্যবস্থা নেই। হ্যাঁ, একটি সাইকেল আছে, ট্রান্সপোর্টের এই একটি মাত্র পথ খোলা আছে! আধুনিক জীবনযাপন থেকে দূরে ঘন জঙ্গলে একজন প্রিন্স এবং একজন প্রিন্সেস থাকে। তারা সম্পর্কে ভাইবোন। মহলে আজ সকাল থেকে তাদের মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রেটডন আর জার্মান শেপর্ড বিদেশি জাতের কয়েকটি কুকুর এখনও কোনো মতে বেঁচে আছে। ওদের সঙ্গে নিয়ে ওরা মাকে জঙ্গলে খুঁজতে বেরোয়।
১৯৯৩ সালের এই ভোরে মা বিলায়েত আত্মহত্যা করেছে। এরপর দুই ভাইবোন এই শুনশান এলাকার সাক্ষী হতে থাকে। কোনো শোয়ার ব্যবস্থা নেই। পুরনো শতছিদ্র কার্পেটে দিনযাপন।
‘পুরানা গ্যাহনা লে যাইয়ে, ভাইজান। বেচ্ দিজিয়ে’- সাকিনার রুগ্ন চেহারায় স্পষ্ট আতংকের ছাপ।
সাইকেলটা বাইরে বের করে রজা আলি। হাতে পুরনো কাপড়ে বাঁধা পুরনো দিনের মূল্যবান ধাতুর গহনা।
‘আজ কুছ প্যায়সা তো মিলেগা, ব্যাহেন। কুত্তোঁ কে লিয়ে হাড্ডিয়াঁ লে আউঙ্গা। সাথ মেঁ হামারে লিয়ে রোটি’।
দেয়ালে আটকানো পুরনো ফটোগ্রাফগুলোই ছিটকে পড়ছে জল, বর্ষার জল। প্রিন্সেস সাকিনা পরম যত্নে ফটোগ্রাফগুলো স্পর্শ করতে থাকে।
টুরিস্ট ছেলেমেয়েদের দলটি হৈ চৈ করে এই জনশূন্য মালচা মহলের আনাচকানাচ পরিদর্শন করতে থাকে। আর বার-বার বলতে থাকে, গতকাল রাতেই তো প্রিন্স এবং প্রিন্সেসের সঙ্গে ডিনার করেছে তারা। এইভাবেই কী একটি উপকথার জন্ম হয়ে থাকে, বাতাসে উড়তে থাকে পাখির রঙিন পালক!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন