কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৫৩ 
   

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ৫৩ তম সংখ্যার জন্য সম্পাদকীয় লিখতে বসেছি আজ দোলের দিনেআমি যেখানে থাকি অর্থাৎ ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের শিল্পশহর জামশেদপুর, সেখানে অবশ্য আজ দোল খেলা হচ্ছে না; যদিও জানি, সারা বাংলা জুড়ে আজ পালিত হচ্ছে দোল উৎসব। আগে অবশ্য হতো। তখন জামশেদপুরের বাংলাভাষীরা দোলের দিনেই দোল খেলতেন। এখন তাঁরা দোলের  পরের দিন খেলেন হোলিআসলে একদা এই শহর মূলত বাংলাভাষী অধ্যুষিত থাকলেও, আজ অন্যান্য ভাষাভাষীদের সংখ্যাধিক্যের ফলে বাংলা সংস্কৃতির কিছু কিছু অনুষ্ঠান মিলেমিশে গেছে অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে। আর তাই একসময় বাংলাভাষীরা যথারীতি দোল উৎসবে সামিল হলেও, ইদানীং তাঁরা সামিল হচ্ছেন হোলি উৎসবে। এবং তাই  স্বাভাবিক কারণেই আগেকার দু’দিনের রঙিন উৎসব এখন সঙ্কুচিত হয়ে ‘ওয়ান ডে ক্রিকেটের’ মতো একদিনই পালিত হচ্ছে। তা হোক, তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। এখন মানুষের হাতে অবসর সময় খুব কম। ধৈর্য আরও কম। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে কাজের প্রচন্ড চাপ। রঙ  নিয়ে তাই দু’দিনের মাতামাতি, সত্যি সত্যিই একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়।  কিন্তু  তার থেকেও দুশ্চিন্তা ও ভাবনার কথা, যেভাবে রঙের উৎসব সর্বত্র কিছু কিছু মানুষের উৎশৃঙ্খলা, অশ্লীলতা, নোংরামির জন্য ক্রমশ তার রঙ হারাতে হারাতে একটা উদ্ভট উন্মত্ততার দিকে গড়িয়ে চলেছে, তাতে প্রশ্ন জাগে, রঙের এত সম্ভারকে কি একটু একটু করে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র কালো রঙে? আলো মুছে  দিয়ে নামিয়ে আনা হচ্ছে শুধুই আঁধার? আমরা কি ক্রমাগত নেমে যেতে বাধ্য হচ্ছি সভ্যতার বিবর্ণ গহ্বরে? তাছাড়া এখন প্রতিদিনই সকালে চোখ মেলে অসহায়ের  মতো আমরা দেখি, পড়ি, শুনি – গতকাল কোথায় কোথায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি হয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত ও বিশদ বিবরণ। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ সংবাদ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অত্যাচার ও শোষণ। অনাহারের মিছিল, মৃত্যুর মিছিল, ধ্বংসের মিছিল। এই চরম দুর্যোগের দিনে তাহলে রঙ কোথায়? বিশেষত যাদের জীবন থেকে সব রঙ মুছে গেছে, রঙিন হবার স্বপ্ন মুছে গেছে, তাদের কথা ভেবে কি আমাদেরও চোখের সব রঙ ঘোলাটে  হয়ে যায় না? সব বর্ণ কি মুখ লুকোয় না বিবর্ণতায়?  


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিন যখন আমরা শুরু করেছিলাম, তখন আমাদের লেখক-পরিধি এবং পাঠক-পরিধি খুবই ছোট ছিল। ক্রমশ দুই পরিধিই বিস্তৃতি লাভ করেছে। সেইসঙ্গে অতিক্রান্ত পাঁচটি বছর। এই সংখ্যাটি সূচনা করল ছয় বছরের। আর তাই ব্লগজিনের নতুন বছরের আজ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিনটিতে আপনাদের সবাইকে জানাই আমাদের শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আমরা নিশ্চিত আপনারা আগামী দিনগুলিতেও ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনকে একইভাবে সাদরে গ্রহণ করবেন এবং সহযোগিতা করবেন। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, এই কামনা করি।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675
                                                        
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India




<<<< কথনবিশ্ব >>>>


সুনীতি দেবনাথ




দুরন্ত এক ঝড়ের নাম রবীন সেনগুপ্ত




আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ত্রিপুরা রাজ্যের বিশিষ্ট ‘যুদ্ধচিত্র সাংবাদিক’ রবীন সেনগুপ্ত চলে গেলেন। ভারতের নানা জাতীয় স্তরের পত্রিকায় সংবাদ শিরোনামে গর্বের সঙ্গে তাঁর যাবার সংবাদ উল্লেখ করা হল আন্তর্জাতিক সংবাদে। The Hindu পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম “Veteran war photo journalist Rabin Sengupta dies সাংবাদিক সৈয়দ সাজ্জিদ আলি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে  12.37 মিনিটে সংবাদ The Hindu - এর নিউজ রুমে প্রেরণ করলেন। ভারতের স্বল্প সংখ্যক 'ওয়ার' সাংবাদিকের অন্যতম রবীন সেনগুপ্ত, যিনি 1971 সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর সুবিস্তৃতভাবে  পরিবেশন করেছেন তাঁর চিত্র সাংবাদিকতায়। সে সংবাদ প্রেরণ করা হয় 7 ফেব্রুয়ারি, 2017 তারিখে। তাতে বলা হল রবীন সেনগুপ্ত আগরতলায় 87 বৎসর বয়সে পরলোকগত হয়েছেন।

রবীন সেনগুপ্ত মঙ্গলবার সকালে আগরতলার জি.বি.পন্থ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ডেইলী দেশের কথা পত্রিকায় বলা হয়েছে তাঁকে আগরতলার আই  এল এস হাসপাতালে আগের দিন ভর্তি করা হয় এবং পরদিন অর্থাৎ সাত ফেব্রুয়ারি সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি বার্ধক্যতাজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ চিত্র সাংবাদিকের মৃত্যুসংবাদ উত্তর পূর্বাঞ্চলের মিডিয়া সার্কেলে গভীর শোক ও বেদনার সৃষ্টি করেছে বলে অনুমান করা হয়। সর্বভারতীয় অন্যান্য পত্রিকা যেমন দি টাইমস অফ ইণ্ডিয়া, টেলিগ্রাফ প্রভৃতিতেও যেমন, তেমনি ত্রিপুরার নানা স্থানীয় পত্রিকায়ও বিশদভাবে রবীন সেনগুপ্তের প্রয়াণের সংবাদ শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে।

রবীন সেনগুপ্ত 1930 সালে আগরতলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন ত্রিপুরা একটি রাজন্যশাসিত স্বাধীন রাজ্য এবং তাঁর জন্মের বহু পরে 1949 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ত্রিপুরা স্বাধীন ভারতের সঙ্গে যোগদান করে। রবীন সেনগুপ্তের পূর্বপুরুষেরা ঢাকার বৈদ্যবংশীয় ছিলেন। পাহাড় লুঙ্গা অরণ্যানী আর ছোট ছোট নদী ছড়া নিয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যটি মনোরম। এই ত্রিপুরা রাজ্যে 1840 খ্রিস্টাব্দে রবীন সেনগুপ্তের পূর্বপুরুষ সূর্যমণি সেনগুপ্ত ঢাকার বিক্রমপুর থেকে তখনকার ত্রিপুরার রাজার আমন্ত্রণে এই রাজ্যে বসবাস করতে আসেন। তিনি ছিলেন একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক তথা বৈদ্য। তখন ত্রিপুরার রাজা ছিলেন কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য। ত্রিপুরায় নানারকম ভেষজ লতাপাতা, জড়িবুটির প্রাচুর্য দেখে সূর্যমণি মুগ্ধ হয়ে এখানে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের বংশধরগণও ত্রিপুরাকে মানিয়ে নিয়ে ভালবেসে ফেলেন। পূর্বজ সূর্যমণির সুবাদে রাজপরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশ করার অধিকার পরবর্তীতে তাঁরা পান এবং সেখানকার জাঁকজমক জৌলুস আর সুন্দরী রাণী রাজকন্যাদের দেখে অল্পবয়েসী রবীন সেনগুপ্তের চোখ যেন ঝলসে যায়। রবীন সেনগুপ্তের পিতা প্রফুল্লচন্দ্র সেনগুপ্ত  পি.সি.সেন নামে অধিক খ্যাত ছিলেন। তিনি সু্দক্ষ ফটোগ্রাফার ছিলেন। ফটোগ্রাফি বিদ্যায় তাঁর পারদর্শিতা ছিলো। পিতার কাছেই এই বিদ্যায় রবীন সেন শিক্ষা পেলেন। পি.সি.সেন মহাশয় আধুনিক জাদুবিদ্যায় শখের জাদুকর ছিলেন। তাঁকে ত্রিপুরার আধুনিক জাদুর আদি পুরুষ বলা হয়। যাইহোক ফটোগ্রাফিতে তাঁর দক্ষতা প্রবাদতুল্য ছিলো। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা রমেশকে নিয়ে 1910 সালে 'সেন এণ্ড সেন' নামে স্টুডিও স্থাপন করেন। এদিকে রমেশের ফটোগ্রাফিতে গভীর ঔৎসুক্য ছিলো আর তাঁর উৎসাহ রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের পুত্র সম্বরণচন্দ্র দেববর্মার অনুপ্রেরণায় দিনদিন বাড়তে লাগলো। মহরাজ বীরচন্দ্র দক্ষ চিত্রশিল্পী ছিলেন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ সর্বজন বিদিত।

পড়াশশোনা শেষ করে রবীন সেন স্টুডিও পরিচালনার দায়িত্ব নেন। স্টুডিওটির  তখন তিনটি শাখা। কিন্তু এতে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাঁর অন্তরাত্মা কী চায় তা  তাঁর অজানা ছিলো না। তাই তাঁর প্রিয় রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে যেতেন এবং ছবির পর ছবি তুলতেন। 1952 সাল থেকে তাঁর ফটোগ্রাফ আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার, যুগান্তর, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড এসব পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগলো। স্মৃতি থেকে রবীন সেনগুপ্ত জানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম প্রকাশিত ফটোগ্রাফটি ছিলো ভূট্টা খেতে কর্মরতা এক আদিবাসী বালিকার। ছবিটিতে মানব চরিত্রের মাহাত্ম্য ও শ্রমের মর্যাদার যৌথ বন্ধন সূচিত হয়েছে। তিনি জীবন জোড়া কঠোরতর সত্যের মুখোমুখি রুখে দাঁড়িয়ে গেছেন। 1971 সালে সমগ্র বাংলাদশে ব্যাপকভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শত্রুপক্ষের ভয়ঙ্কর পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা ও নিষ্পেষণের মধ্যে একটা জাতি প্রাণপণে সংগ্রাম করে কীভাবে গড়ে উঠছিল তা তিনি দেখেছেন। তিনি আরো দেখেছেন কি দুর্গতির চরমে মুক্তিবাহিনীকে যেতে  হয়েছে, সহায়ক ভারতীয় বাহিনী কতখানি বিপর্যস্ত হয়েছে। অবশেষে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হলো, রক্তে রাঙা সূর্যের মত উদিত হলো একটা দেশ বাংলাদেশ! একটি অরণ্য অঞ্চলে  বিশালাকার ও ফ্রেমে আবদ্ধ একটি বক্তব্যরত প্রতিকৃতিকে ট্রেণিং ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর ক্যাডাররা স্যালুট জানাচ্ছে, এমন একটি ফটোগ্রাফ রবীন  সেনগুপ্ত তুলেছিলেন। যুব সেনানীদের মুখমণ্ডল ইস্পাতদৃঢ় ও ভাবাবেগরহিত, এ যেন যুবশক্তির ক্ষতবিক্ষত মুখাবয়বের প্রতীকী রূপায়ন যাতে সহজ সারল্যের লেশমাত্র নেই।

রবীন সেনগুপ্ত রাতদিন এক করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে চরকির মত ঘুরে বেড়িয়েছেন, তথ্যপূর্ণ ফটোগ্রাফ তুলেছেন। বর্তমানে যে 'embedded photojournalism' অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে চিত্র সাংবাদিককে পাঠানো আর তাদের কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে ছবি তোলার রীতি প্রচলিত হয়েছে, সেনগুপ্ত তার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর মতে এতে চিত্র সাংবাদিককে প্রকৃত সত্য থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপরে তাঁর লেখা বই 'চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযোদ্ধা' বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন এবং পুরস্কৃত করেন। এছাড়াও তাঁর অন্য একটি বই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।

ফটোগ্রাফি সেনগুপ্তকে বহু স্থানে নিয়ে গেছে। সেসব স্থানের প্রকৃতি, বৃক্ষলতা, অরণ্যানীর আর মানুষ অকপটে তাঁর ক্যামেরাবন্দি হয়েছেমানুষের ভালবাসা তাঁকে ধন্য করেছে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রাজিলে গেছেন তিনি। 1959 সালে ব্রাজিলের একটি ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় তিনি স্টিল ফটোগ্রাফিতে প্রথম স্থান পেয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি ও স্বীকৃতি আদায় করে নিলেন। মস্কো থেকে এই প্রতিযোগিতার পুরস্কার নেন তিনি। সারাদেশের পত্রিকায় সেদিন কী উল্লাস, কী আনন্দ! তিন বছর পর গ্রেট ব্রিটেনের 'রয়্যাল ফটোগ্রাফি সোসাইটি'- এর সদস্যপদ লাভ করেন।

একজন সমর্পিতপ্রাণ মার্কসবাদী হলেও জওহরলাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি ও হৃদ্যতা ছিলো। জ্যোতি বসু এবং ই এম এস  নাম্বুদ্রিপাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিলো। চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এতো ঘনিষ্ঠতা ছিলো যে তাঁর অনেক ছবি তাঁর আর্কাইভে ছিলো।

রবীন সেনগুপ্তকে একটা পরিচিতির ফ্রেমে এভাবে বাঁধা যায়' যুদ্ধচিত্র সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বিশেষ করে ডকুমেন্টারী ফিল্ম নির্মাতা, সুলেখক, প্রাবন্ধিক, সংবাদপত্রে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ধারাবাহিক লেখক, চিত্র সংগ্রাহক, বামপন্থী রাজনীতি বিশেষজ্ঞ, দরদী বার্তালাপকারী এবং সর্বোপরি মানবদরদী ও অগাধ মানবপ্রীতি সম্পন্ন মানুষ তিনি। রাজ্যের উমাকান্ত একাডেমি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনি। মৃত্যুকালে স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা রেখে গেছেন তিনি। 1949 সালের 27 জানুয়ারি সরকারের খাদ্যনীতির বিরুদ্ধে ছাত্ররা যে ভুখা মিছিল করে, তাতে পুলিশ নির্দয়ভাবে লাঠিচার্জ ও গুলি চালায়। একমাত্র সেনগুপ্তের দেহে দুটি গুলি লাগে। নির্ভীক মানুষ ছিলেন তিনি। 1956 সাল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। আদিবাসীদের নিয়ে তাঁর রঙীন ছবি 'দি টেলস অব ট্রাইবেল লাইফ অব ত্রিপুরা' দেশবিদেশে প্রশংসা পায়। তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী, গ্রিমসেস অব ত্রিপুরা ছবিগুলিও করেন। তাঁর বহু বিচিত্র জীবন কথা সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রকাশ অসম্ভব। এই 'গ্রেট' মানুটির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে শেষ কথা বলবো, তাঁর ফটোগ্রাফ, ফিল্ম, ডকুমেন্টারী সহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী সরকারি উদ্যোগে আগরতলা মিউজিয়ামে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অনেক কিছু নাকি এখনই নষ্ট হয়ে গেছে। 







তুষ্টি ভট্টাচার্য




নাইজেল  



পাথরকে কেউ ভালবাসে? মানুষ কেন কোনো প্রাণীই সম্ভবত পাথরকে ভালবাসতে  পারবে না। অথচ সেই নাইজেল নামের গ্যানেট পাখিটি তো নিউজিল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত দ্বীপে (মানা আইল্যান্ড) তার পাথরের সঙ্গিনীর পাশে কাটিয়ে দিল তার সারাটি জীবন। তার পাথুরে প্রেমিকাও গলা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল নিঃশব্দে। এখনো সেভাবেই রয়েছে সঙ্গী হারিয়ে। তাদেরই প্রজাতির অন্য কিছু পাখি  এসে ওখানে বাসা বাঁধলেও সেই প্রেমিকটি কিন্তু শরীরের টানে বেছে নেয় নি কোনো সঙ্গিনীকে। পাথরকে ভালবেসে সে নিশ্চই অনুভব করেছে তার হৃদয়ের স্পন্দন। নইলে সারাটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারত না। মানুষও তো পাখি হতে চেয়েছে আজীবন। উড়তে চেয়েছে, আবার বাসা বাঁধতেও চেয়েছে। ওড়া আর স্থিতি তার দুই বিপরীত স্বভাবের মধ্যে রেখেছে নিজেকে। আমিও তেমনি চেয়েছি। সেও, তুমিও। তবে পাথর হয়ে অনড় হয়ে থাকতে চায় নি কেউ। তবুও তো মানুষ পাথর হয়েছে। অনিচ্ছায়, ঘাতে-প্রতিঘাতে। চেয়ে থেকেছে অপলক ওই আকাশের দিকে। ওড়ার ইচ্ছেটি তার ঘুমিয়ে পড়ে নি, ঘুম পাড়ানো হয়েছে। তার হলুদ গলার মধ্যে ওঠানামা করতে চেয়েছে হিম মেশানো ভারি জলের মত কিছু পাথরওঠানামা করতে পারে নি তার কন্ঠার হাড়, গলার বাষ্প স্থির হয়ে থেকে যেতে যেতে শুকিয়ে পড়েছে। সেই মানুষটিকে আমরা তো পাথরই বলব। যদিও তার শ্বাস পড়ছে, নড়াচড়া করছে তার শরীর। মন তো আর দেখা যায় না, বায়বীয় পদার্থ এক, নাকি নিছকই অস্তিত্বহীন কল্পনা মাত্র! আমরা অত জানি না, জেনেছি ওই পাথর সঙ্গিনীর পাশে মরে পড়ে থাকা নাইজেলের গল্পটি। সত্যি গল্প এক, যাকে নিয়ে আলোচনা করছে মিডিয়া, সাধারণ মানুষ। এই আশ্চর্যকে আমরা ছুঁতে পারি নি বলে, আমাদের ধারণার বাইরে এমন পাথর সঙ্গিনী বেছে মৃত্যু বরণের ঘটনা। আমরা কেউ পাথর হতে চাই নি, চাইব না কোনোদিন। আমাদের সঙ্গী বদল হবে, হাসিকান্নার কারণ  বদলে যাবে, আমাদের প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, বেদনা বদলে যাবে। তবুও আমরা নাইজেল হব না, তবুও আমরা পাথর হতে চাইব না, পাথরকে ভালবাসতেও পারব না। পাথর আসলে এক জমাট হয়ে যাওয়া মাটির গল্প, মাটি আসলে এক ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের গল্প।



ন্যাশনাল অডেবন সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিফেন ক্রেস নাইজেলের সম্বন্ধে বলেন, “নাইজেল এক পথপ্রদর্শক আত্মা। তার মত সাহসী প্রাণ খুব কমই দেখা যায়, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে একা কাটিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়” ক্রেস আসলে  জানতেন পথপ্রদর্শক হওয়ার সঠিক সংজ্ঞাটি। ১৯৭০সালে তিনি এই দ্বীপে এসেছিলেন কিছু করে দেখাবেন বলে। এই রকম পাথরের মূর্তি আর পাখির ডাক রেকর্ড করে তিনি অন্য সামুদ্রিক পাখিদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন প্রথমবার। মেইন আইল্যান্ডের বেশ কিছু দ্বীপে শিকারিদের বদান্যতায় এই সময়ে পাখিদের অস্তিত্ব প্রায় বিলোপ পেতে বসেছিলসেই সময়ে ইস্টার্ন এগ রক-এ আটলান্টিক পাফিনদের কোলোনি তৈরি করবেন বলে স্থির করেন। এ জন্য প্রথমে তিনি পাখির বাচ্চা নিয়ে এসে ওই দ্বীপে ছেড়ে দেন, আর আশায় থাকেন যে, ওরা একদিন বাসা বাঁধবে ওখানে। কিন্তু তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।  


                                                                            
তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে এই ধরনের পাখিরা কোলোনি ছাড়া কখনই বাসা  বাঁধে না। আর তারপরেই মূর্তি আর রেকর্ডেড সাউন্ডের আইডিয়াটি কার্যকর করেন। এছাড়াও তিনি বোঝেন যে মূর্তি নড়াচড়া না করলে পাখিদের স্বাভাবিক ভাবেই উৎসাহ কমে যাবে। পাখিদের বোকা বানানো অত সহজও নয়। তাই ওখানে তিনি বেশ কিছু আয়না রেখে দেনপাখিরা নিজেরদের প্রতিফলন দেখে খুশি হত নিশ্চই! কারণ তার ফল পাওয়া যায় কিছুদিনের মধ্যেই। বর্তমানে ইস্টার্ন এগ রক-এ ১৭২ জোড়া পাফিন রয়েছে। ক্রেসের এই পদ্ধতি, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সোসাল অ্যাট্রাকশন’, সারা পৃথিবীতে বর্তমানে জনপ্রিয় হয়েছে। 





শিবাংশু দে




সজনেফুল




আমার ঠাকুরদা ছিলেন জামশেদপুরের একটা কোম্পানির মোটামুটি বড় সাহেবদের একজন। থাকার জন্য যে বাড়িটা তিনি পেয়েছিলেন সেটা ছিলো বেশ প্রশস্ত। হতেই হবে। বাবা'রা দশ ভাইবোন। বেশ কিছু কাজের লোক। নিয়মিত অতিথিদের আসা যাওয়া। ওয়ার্ধা রোডের সেই বাড়িতেই আমার জন্ম। ছিলুম বছর চারেক বয়স পর্যন্ত। স্মৃতি বলতে কিছু ছবির কোলাজ। তবে সরগরম সেই বাড়িটা আমাদের পরিবার, যার নাম ছিলো 'দেবায়তন', তার বিপুল বৃত্তের সব সদস্যদের চৈতন্যে আলোছায়ার মতো এখনও আসা যাওয়া করে। 

সেসব দিনে সামনের সদর দরজা দিয়ে আসতেন পুরুষেরাপ্রতিবেশী, আগন্তুক বা অতিথি, যেই হোন। পিছনের দরজা, যার নাম ছিলো খিড়কি দুয়ার, সেখান থেকে বাড়িতে আসতেন মহিলারা বা ফিরিওয়ালা অথবা কাজের লোকজন। সেই পিছদুয়ারের দুদিকে ছিলো দুটো সজনে গাছ। ফলন্ত। ফুল, ডাঁটা, শুঁয়োপোকা, সব কিছু নিয়েই দ্বারপালের মতো তাদের সবুজপাতাগুলি হাওয়ায় ওড়াউড়ি করতো। উঠোনের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা  রাজসিক কাঁঠাল গাছটির মতো গরিমা তাদের ছিলো না ঠিকই। কিন্তু তাদের গর্ব ছিলো শীতের শেষে রুখু হাওয়ায় ভরে যাওয়া শাদাফুলের গয়নাগাঁটি।

পাশের বাড়ি থাকতেন ঘোষবাবু। দাদুর সহকর্মী। পদ্মাপারের মানুষ। স্বদেশচ্যুত হয়েছিলেন অল্পদিন আগেই। তাঁর মা কিছুতেই ভুলতে পারতেন না দ্যাশবাড়িতে ফেলে আসা ফলন্ত সজনেগাছগুলিকে। তাঁর নাতিদের নাম ছিলো বীরেন, নরেন। তাঁরা ডাকতেন বিরেইন্যা, নরেইন্যা। আমাদের চোদ্দোপুরুষের নৈকষ্য, মার্জিত ঘটি জিভে অমন ঘাতপ্রবল উচ্চারণ ধরার ধক ছিলো না। বাবা-কাকাদের সহপাঠী সেই সব বন্ধুদের তাঁরা ডাকতেন বিরেনিয়া, নরেনিয়া বলে। শুনেছি বাঙালবাড়ির মেয়ে আমার মা বিয়ে হয়ে আসার পর অমন 'উশ্চারণ' শুনে হেসেই খুন। তা সে ঘোষবাবুর মা, প্রায় আশি ছুঁইছুঁই মানুষটা মাঝেমাঝেই আসতেন সজনেগাছে কত ফুল ধরেছে দেখতে। আমাদের গোবর্ধনঠাকুরকে জিগ্যেস করবেন একটাই প্রশ্ন।  "অ ঠাকুর, তোমাদের এই গাছটা সজনা না নাজনা গো?" মেজাজ ভালো থাকলে বাঁকুড়া জেলার শ্যামসুন্দরপুর গ্রাম থেকে আসা আমাদের সাবেক গোবর্ধনঠাকুর কিছু ফুল পেড়ে দিতেন সেই বৃদ্ধার জন্য। নয়তো বাঁকুড়ার ভাষায় অসন্তোষ প্রকাশ করতেন নিত্যদিন একই প্রশ্ন করার জন্যে। তখনও জামশেদপুরের সবজিবাজারে সজনে ফুল বিক্রি হতো না। যদিও সিংভূমের মাটিতে চিরকাল সজনে সাম্রাজ্যের রমরমা।

বাবার সঙ্গে যখনই আমাদের 'বাড়ি' যেতুম ছোটোবেলায় খড়্গপুর থেকে ঝিকঝিক ইস্টিম গাড়ি, গোমো প্যাসেঞ্জার। জানালা থেকে কয়লার গুঁড়ো চোখে, মুখে, চুলে, জামায়। টেলিগ্র্যাফের অনন্ত টানা তার। ফিঙে দুলছে। গ্রাম এলে ঘুঘু-শালিক-চড়াই। আর যতদূর চোখ যায় রাঢ়বাংলার হলুদ-ধূসর প্রান্তর জুড়ে বেঁটে বেঁটে খেজুরগাছ আর সজনেগাছের ভাসাভাসি। বাড়ি পৌঁছোলে দিদা কাজের মেয়েকে ডেকে বলবেন, "ও দেবীর মা। কাল সজনেফুল পেড়ে এনো। ঘন্ট হবে।" তিনি জানতেন তাঁর মেজোছেলে সজনেফুলের পাগল। দেবায়তনে কেউ মাছ ভালোবাসে না। কিন্তু শাকসবজি মাশাল্লাহ। আর পোস্ত। যতভাবে হতে পারে। সজনেফুল মানে রাজভোগ।

বাল্যকালে আমাদের এগ্রিকো কলোনির বাড়ির উঠোনে ছিলো ফলন্ত একটা সজনে গাছ। তার প্রতিবেশী ছিলো ফলহীন একটি কলাগাছ মাঝে মাঝে তার পাতা কেটে গরমভাতে ঘি দিয়ে খেতুম আমরা। কিন্তু চৌষট্টি সালের দুর্ভিক্ষে আট আনা সেরের চাল হয়ে গেলো চার টাকা। ভাত আর কোথায়? মানুষ আটা, মাইলো, বাজরা খেতে শিখলো। শিখলো কর্ডনিং, চালপাচার, দেশি পুলিশের বেটনবাজি। শিখলো কী আর? তিন বছর পরেই তো নকশাললবাড়ি। সজনেগাছে বসন্তের শুঁয়োপোকা ডিঙি মেরে ওঠানামা করে।

প্রথম যখন জাদুগোড়ায় থাকতে যাই, ইউসিল কলোনির প্রতিটা বাড়িতে দেখি চার-পাঁচটা সজনে গাছ। কিন্তু দু’চারটে গাছ ছাড়া ফুল আর দেখা যায় না। বৃষ্টির মতো শুঁয়োপোকা। মানুষ সজনের ডালপালা কেটে দিয়ে গোবর লেপে দেয়। নয়তো পোকা এসে ঘরে ঢুকে যাবে। বুধবারের সবজিহাটে কখনও সখনও চাণ্ডিল-সুইসা থেকে কোনও রসিক পাইকার সজনেফুল নিয়ে আসে। পড়তে পায় না। পলকে শেষ হয়ে যায়। আমার প্রথম সংসার করতে আসা নতুন বৌ ছ’মাসের শিশুকে সামলে হাসিমুখে সজনেফুলের ঘন্ট বানায়।  

অনেকদিন পর যখন পাটনায় যাই আবার সজনের অরণ্য দেখি গঙ্গার ঈর্ষণীয় পলিমাটির টানা খেতখামারে। মাঝেমাঝে মিঠাপুরের গুমটিবাজারে কেউ কেউ নিয়ে বসে সজনেফুল। ইয়ারপুর-গরদানিবাগের বঙ্গালি দাদারা সজনেফুল পেলে লুটে নিয়ে যায়। বিহারিরা সজনেফুল খায় না। তাই দাম কখনও আকাশ ছোঁয় না। পাড়াতেই তো অনেক গাছ। ফুলের ভারে নুয়ে থাকে। কিন্তু সে কী আর 'চুরি' করা যায়? কিন্তু একদিন দেখি বাড়িতে প্রায় একটা পুরো সজনেগাছ। ফুলে ফুলে ভরা। শুনি মেয়েকে ইশকুল থেকে আনতে গিয়ে দেখা গেলো কেউ একটা গাছ কেটে পথে ফেলে দিয়েছে। আমার ডানপিটে ছ'বছরের ছোট মেয়ে আর তার মা টানতে টানতে সব ফুলন্ত ডালগুলোকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। তবে একটু ভয়ে ভয়ে আছে। হয়তো গাঁইয়াপনা দেখে আমি বকবো। কী আর বলি?

আমার অগ্রজ সহকর্মী তখন রিজিওন্যাল ম্যানেজার। মাসে কয়েকবার ব্রাঞ্চ ভিজিটে যেতে হয়। কখ্নও বিক্রম, কখনও পালি, কখনও বা মসৌড়ি হয়ে গয়ার পথে। জাহানাবাদ বা নবিনগরও তো রয়েছেগঙ্গা থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া পুনপুন নদীর অববাহিকায় এই সব বদনাম বস্তি। যে সব জায়গায় বিকেল পাঁচটার পর রাস্তায় কুকুরও বেরোতে ভয় পায়। কিন্তু ব্রাঞ্চ ম্যানেজারেরা জানে 'সাহব দিল কা সচ্চা হ্যাঁয়।' বকুনিটকুনি খাবার পর শুধু বলতে হবে “সর, ডিকিমেঁ রখ দিয়ে” “ক্যা রখ দিয়া ভই? ওহি সর, সহজন কা ফুল...

অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, মরাঠাওয়াড়া, তামিলনাড়ু'র পথে পথে গাড়ি নিয়ে ঘুরেছি অন্তহীন। প্রান্তরময় ভরে আছে বসন্তের সজনেফুলে, ঝিলমিল নীলদিগন্ত। ব্রাহ্মণী শুধু বলেন, "ইশ, এতো ফুল, এত্তো ফুল!! এক্কেবারে ফ্রেশ। একটু দাঁড়াও না। নিয়ে আসি।" কে বোঝাবে কোথায় তাঁর রান্নাঘর, কোথায় এই পলাশির প্রান্তর। যুক্তিই যদি মানবে তবে আর ভালোবাসা কোথায় রইলো?

আমি আর আমার বস মিটিং করতে গিয়েছি পারাদ্বীপ। আমরা তো সক্কাল সক্কাল  দেশোদ্ধার করতে বেরিয়ে গিয়েছি। আমাদের ব্রাহ্মণীদ্বয় বেরিয়েছেন দেশ দেখতে। চোখে পড়ে গেছে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ফুলের ভারে রাশি রাশি সজনেগাছ ঝুঁকে পড়েছে। দুজনেই পুলকিত। বেশ কিছুদিনের রসদ জোগাড় হয়ে গেছে। ড্রাইভারকে বলেন, যাও খোঁজ নাও। কত দাম? ড্রাইভার অনেক ঘুরেফিরে এসে জানায় সব গাছ জমা দেওয়া আছে। সজনেডাঁটার পাইকারদের কাছে। ফুল দিতে চাইছে নাতাঁরা রণে ভঙ্গ দেন। ভাগ্যিস আমাদের বলেননি, ব্রাঞ্চ ম্যানেজারদের বলে একটা ব্যবস্থা করে দাও।

এই তো সেদিন ব্রাহ্মণীর এক বাল্যবান্ধবী এলেন। দীর্ঘদিন ধরে বম্বের তেলেজলে ডুবে আছেন। আসার আগেই ফরমান, সজনেফুল খাওয়াতে হবে। কিন্তু তখনও সরস্বতীপুজো হয়নি অনেক খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেলো না। আমি তাঁকে শুধো'ই মহারাষ্ট্রের সর্বত্র এত সজনেগাছ দেখেছি। কেন বম্বেতে ফুল পাওয়া যায় না? তিনি বললেন এটা একটা রিসার্চের বিষয় হতে পারে। কিন্তু ঘটনা এরকমই। যেমন সারা উত্তর অন্ধ্রে কাঁঠালের অরণ্য মাইলের পর মাইল। কিন্তু ওখানে কোথাও এঁচড় পাওয়া যায় না। শুধু পাকা কাঁঠালের দৌরাত্ম্য। সব এঁচড় রফতানি হয়ে যায় কলকাতায়, ভুবনেশ্বরে।

রাঁচি গিয়েছিলুম একটা বিয়েবাড়িতে। ঘোর বসন্তকাল। কিন্তু রাঁচিতে এইসময় শীতের রেশ কাটে না। রোদ মিঠে, হাওয়া রুখু, লোকের গায়ে গরমজামা। কিন্তু ফাগুন মাস। দুপুরের ট্রেনে ফিরবো ভুবনেশ্বর। সক্কালবেলা চলে যাই টেগোরহিল। ফেরার পথে আপারবাজার থেকে হাটিয়া স্টেশন যাবো। পথে কাছারি আর আমাদের জোনাল অফিস। একসময় ঐ অফিসে আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বসতেন। ভয়ে ভয়ে ঢুকতুম ঐসব থমথমে অফিসঘরে। যখন থেকে নিজেই সেই সব ঘরে বসতে শুরু করেছি, একটা পরাবাস্তব অনুভূতি হয়। এইসব টেবিলের উল্টোদিকে দুরুদুরু বুকে বসে হুজুরদের মুড বুঝতে কত মুহূর্ত চলে গেছে। কিন্তু নিজেই যে কখন হেড'অফিসের বড়বাবু হয়ে গেছি, মনেও থাকে না।  অনুভূতিটা তবু  ঘুমিয়ে আছে কোথাও।

তা সেই অফিসের সামনে বেলা একটায় সারা রাঁচির ট্র্যাফিক দৌড়োদৌড়ি করছে। অটো করে যেতে যেতে দেখি রাস্তার ধারে বস্তা পেতে বিক্রি হচ্ছে, হ্যাঁ সজনেফুল। ভাবতে ভাবতে অটো ছুটে এগিয়ে গেছে অনেকটা। কিন্তু তাকে থামাই। দৌড়ে যাই ফুলের কাছে। কিন্তু তাজা নয়। একটু শুকনো লাগছে তাদের। হয়তো কালকের তোলা। ডালপালাও বেশি। পরিষ্কার করেনি ভালো করে। তবু নিয়েই নিই সেরখানেক। অনেকটাই তো ফেলা যাবে। বাড়ি ফিরে খেতে খেতে আরো অন্তত দু'দিন। কিন্তু ছাড়া গেলো না।



কয়েকদিন হলো বাজারে সজনেফুল উঠেছে। কলকাতায় দেখি একশো গ্রাম-দুশো গ্রামের হিসেবে সব কিছুই পাওয়া যায়। পাটনায় আন্টাঘাট সবজিবাজার আমার দেখা বৃহত্তম তরিতরকারির বাজারের মধ্যে একটা। সেখানে কোনও সবজি এক পসেরি'র কমে পাওয়া যায় না। পসেরি মানে পাঁচসেরি। দয়াপরবশ হয়ে কেউ কেউ আধা'পসেরি, অর্থাৎ আড়াইসের পর্যন্ত দিতে রাজি হয়। তার কমে নয়। তাই সই। গঙ্গার নদীদ্বীপ, যার নাম দিয়ারা, মাটি নয়তো পুরো সোনা। সেসব সব্জি,কী চেহারা, কী স্বাদ! আধা পসেরি হি সহি। হায়দরাবাদে  গুড়িমালকাপুরের বিশাল সবজিআড়তে কখনও কখনও কাঁচালংকা বিশ টাকা সের। তার অবশ্য 'লংকাত্ব' বিশেষ নেই। লোকে মির্চি কা সালন বানাতে কিনে নিয়ে যায়। আমাদের পাড়ায় একশো-দুশো গ্রামের হিসেবেও সব্জি উপলব্ধ হ্যাঁয়। সজনেফুল ছিলো পঁচিশ টংকা শ'গ্রাম। কমে পনেরো হয়েছে। 

ব্রাহ্মণী বেড়ে দেন। আর কী নেবে? বলি, দাঁড়াও এটা শেষ করি আগে। এখানকার সজনেফুলের গন্ধ চমৎকার। তিনি উদাস হয়ে বলেন, ভাবো বাবা পেলে কত খুশি হতেন!
বলি, কেন? মা'ও তো শুধু সজনেফুল দিয়েই ভাত শেষ করে দিতেন। তোমরা দেখোনি সেসব দিন। আমাদের রোজ মাছ খাবার সঙ্গতি ছিলো না। ডিমও দু'ভাগ, চারভাগ... কিন্তু আমাদের খুশি তো কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি। কত আনন্দের বীজ শিমুলতুলোর মতো আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াতো। ধরতে পারলেই হলো...

মনে পড়ে তোমার?  সজনেফুল?

পারমিতা চক্রবর্ত্তী




সমকামিতার চতুষ্কোণ



দেশ কালভেদে সমকামিতার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন স্তর পরিলক্ষিত হয়েছে সমকামী সম্পর্ককে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক বলে মনে করা, এর প্রতি সামাজিক উদাসীনতা, সাধারণ সহনশীলতা বা তীব্র অসহনশীলতা, একে একপ্রকার লঘু পাপ হিসেবে গণ্য করা থেকে শুরু করে আইন প্রণয়ন বিচারব্যবস্থার সাহায্যে এর অবদমন এবং মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজ সমকামিতাকে গ্রহণ বা বর্জন করেছে

প্রাক্‌-শিল্পায়ন সংস্কৃতিসমূহের ঐতিহাসিক জাতিতত্ত্বগত নমুনার একটি সুপরিকল্পিত সংকলনে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী সমীক্ষাধীন ৪২টি সংস্কৃতির ৪১ শতাংশে সমকামিতার প্রবল বিরোধিতার নমুনা পাওয়া গেছে; ২১%এর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, আর ১২% জানিয়েছে, তারা এমন কোনো ধারণার সঙ্গে  পরিচিত নয় সমীক্ষাধীন ৭০টি জাতির মধ্যে ৫৯% জানিয়েছে, সমকামিতা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত বা বিরল এবং অবশিষ্ট ৪১%এর মতে তা উপস্থিত বা 'বিরল নয়' সমকামিতা শব্দটিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় অনেকেই স্বীকার করতে চান না আমার ধারণা, এই যে শতাংশ মানুষ সমকামিতার বিপক্ষে কিংবা তারা আদৌ  পরিচিত নন, এটার একটি কারণ সমাজতত্ত্ব মনোসত্ত্ব  

চীনে সমকামিতাকে ‘কাটা পীচের প্রণয়’ এবং আরও বিভিন্ন উপমার মধ্য দিয়ে  কমবেশি খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকেই ইতিহাসে স্থান দেওয়া হয়েছে চীনা সাহিত্যের বহু বিখ্যাত কাজকর্মে সমকামিতার উল্লেখ পাওয়া যায় বর্তমান পর্যালোচকদের কাছে ধ্রুপদী উপন্যাস ‘লাল ঘরের স্বপ্ন’-তে বর্ণিত সমসাময়িক  সমকামী বিপরীতকামী প্রেমের বর্ণনা সমান স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয় কনফুসীয় ধর্ম মূলত একটি সামাজিক রাজনৈতিক দর্শন হওয়ার ফলে এতে সম বা বিপরীত কোনো রকম কাম সংক্রান্ত বিস্তৃত বিধিনিষেধ নেই বিয়ান এর চাই  প্রভৃতি মিং সাহিত্যকীর্তিতে সমকামী প্রণয়কে বিপরীতকামী প্রণয় অপেক্ষা অধিক উপভোগ্য অধিক ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে লিউ সুং রাজবংশের আমলের লেখক ওয়াং শুনু দাবি করেছেন যে, তৃতীয় শতাব্দীর শেষভাগে  সমকামিতা বিপরীতকামিতার মতই বহুপ্রচলিত ছিল

মধ্যযুগে তাং বংশের শাসনকালে চীনে সমকামিতার প্রতি বিরূপতার সূচনা হয় এর মূলে ছিল খ্রিস্টধর্ম ইসলামের আবির্ভাব তবে এই বিরূপতা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পায় মাঞ্চু আমলে পাশ্চাত্যকরণ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে
সাম্প্রতিক কালে নবলব্ধ সামাজিক সহনশীলতা এবং টোকিও, ওসাকা প্রভৃতি মহানগরে বিকল্প যৌনতার মানুষদের তথাকথিত ‘মুক্তাঞ্চল’ জাপানে বাস্তবায়িত  হয়েছে কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও জাপানে সমকামীরা প্রায়ই তাঁদের যৌন পরিচয় গোপন রাখতেন; অনেকে বিপরীত লিঙ্গের সাথে বিবাহবন্ধনে সম্মতি দিতেন সমলৈঙ্গিক বিবাহ জাপানে আইনসম্মত নয় জাপান টাইম্স-এর  প্রতিবেদন অনুযায়ী এই বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিতর্কও হয় না

সমকামিতা এমন এক বিষয় যার ব্যাখা প্রাচীনকাল থেকে এখনও অবধি খোঁজার চেষ্টা চলে আসছে নারী, পুরুষ সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সমকামিতা বর্তমান  তবুও নিয়ে বিচার, বিশ্নেষণ আলোচনা চলে আসবে পরিসংখ্যান দিয়ে ঢাকা হবে, কিন্তু নির্মূল হবে না