কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৮৯   


গত ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় এবিপি বাংলা চ্যানেলে সুমন দে সঞ্চালিত ‘মুখোমুখি’ অনুষ্ঠান দেখতে বসেছিলাম। আলোচ্য বিষয় ছিল, সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা রাজ্যে যে অশান্তি অরাজকতা ও সন্ত্রাস ক্রমশই ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে শান্তিস্থাপন করা যায় এবং কারা কারা সেই দায়িত্ব নিতে পারেন, তারই বহুমুখী আলাপ আলোচনা। এদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা এবং কয়েকজন সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সবাই তাঁদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের প্রেক্ষিতে বক্তব্য উপস্থাপিত করেন। আমাদের এই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে সেই বিতর্ক ও আলোচনা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন এখান লিখতে বসিনি। শুধুমাত্র একজন বক্তার কিছু বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতায় আমার সম্পাদকীয় অভিমত ব্যক্ত করছি।

সেদিনের আলোচনা সভায় অন্যতম আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন কথা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তিনি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডের উল্লেখ করে কীভাবে সাধারণ মানুষের মনে ক্রমশ ভীতির মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলেন। বস্তুতপক্ষে বর্তমানে এইসব সন্ত্রাসের আবহাওয়া যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিই তাদের দলের হীন স্বার্থে ও ব্যক্তিগত কায়েমী স্বার্থে সংঘটিত করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই ভয় ও সন্ত্রাসের ফলে একদিকে সাধারণ মানুষ যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে যারা সৃজনশিল্পী তাঁরাও তাঁদের সৃষ্টিতে অনেকটাই গুটিয়ে থাকছেন। প্রসঙ্গক্রমে  সমরেশ মজুমদার উল্লেখ করলেন, যেসময় তিনি ‘উত্তরাধিকার’ ও ‘কালবেলা’ উপন্যাস লিখেছিলেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট। সমরেশ তাঁর ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসে উত্তরবঙ্গের পটভূমিকায় সেই সময়ের কম্যুনিস্ট পার্টির উত্থান ও তার বিস্তারের একটা সুন্দর আলেখ্য পরিবেশন করেছেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় ‘কালবেলা’ উপন্যাসে তিনি ব্যক্ত করেছেন সত্তর দশকের আন্দোলন বা নকশালবাড়ি আন্দোলনের একটা অনবদ্য কাহিনী। বলা বাহুল্য, ‘কালবেলা’ উপন্যাসে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের যে রূপরেখা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে, তা তৎকালীন রাজ্যের শাসকশ্রেণী বামফ্রন্টের পক্ষে হজম করা অস্বস্তিকর ছিল। তাদের মতাদর্শের বিরোধী মতাদর্শ ছিল। কিন্তু সমরেশ মজুমদার তাঁর বক্তব্যে খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করলেন, এই লেখার জন্য সেই সময়ের বাম সরকারের রক্তচক্ষু তাঁকে দেখতে হয়নি। অর্থাৎ মতবাদ বা মতাদর্শ ভিন্ন হলেও সহনশীলতা ছিল। যে সহনশীলতা আজকের সময়ে এবং আজকের রাজনীতিতে একেবারেই নেই। আর তাই বর্তমান প্রজন্মের সাহিত্যিকরা সাহস পাচ্ছে্ন না, আজকের এই অরাজকতা ও সন্ত্রাসকে তাঁদের সৃষ্টিতে মেলে ধরতে।  এবং তাই এখন কোনো রাজনৈটিক উপন্যাসও লেখা হচ্ছে না, যা একসময় তিনি লিখেছেন। শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার সঠিক কথাই উচ্চারণ করেছেন। বর্তমানের অসহনশীলতার আবহাওয়ায় শাসকশ্রণীর বিরুদ্ধে কেউ কোনো বক্তব্য রাখলে অথবা অন্য কোনো মতবাদ বা অভিমত প্রকাশ করলেই তাকে একদিকে যেমন অভিযুক্ত করা হচ্ছে মাওবাদী অভিধায়, অন্যদিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে দেশদ্রোহী রূপে। আর বলা বাহুল্য, এই বিষম পরিস্থিতিতে, ভয় ও সন্ত্রাসের পরিবেশে সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্টিতে সমসময়কে তুলে ধরতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন, আশঙ্কিত হচ্ছেন, সন্ত্রস্ত হচ্ছেন। অথচ তা লেখা অত্যন্ত জরুরি, একান্ত কর্তব্যও, কেননা এইসব লেখাই সময়ের দলিল হয়ে থাকবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।

বাংলা নতুন বছর শুরু হলো। এখনও আমরা করোনামুক্ত হইনি। উপযুক্ত সাবধানতা ও সতর্কতা বজায় রেখেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে। সবাইকে জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। সবাই ভালো থাকুন। সবাই সুস্থ থাকুন।   

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

অন্তর্লোকের মহাকাশ খোঁড়া চিহ্নসমূহ  



আমার তামস যাপনের গর্ভগৃহে আত্মমগ্ন অন্ধকারফিকে নয়। গাঢ় অন্ধকার। ঈষৎ হলুদ গাঢ় মাতৃত্ব যেমন। এই রৌদ্রময় অনুপস্থিতির অন্তরমহল খুঁড়তে গিয়ে আলোক সরকারের অন্তর্লোক-এর সঙ্গে সম্পর্ক। যে সম্পর্কে বসত করে আলোবাসা। তার দরজা তার জানলা খোলা থাকে চিরকাল। সেখানে খোয়া যাওয়ার ভয় নেই। আগমনেরও। শুধু এক নিশ্চিন্ত সাদা আলোর সম্ভাবনাযেখানে হাত পাতলেই সব রং। সম্ভাবনা যত গাঢ় হয় রঙের ঘনত্ব বাড়ে। সম্ভাবনার ভেতর দানা বাঁধে অসম্ভবের রাশি নক্ষত্র। আমি অন্তর্লোকের এক মাঠ দশ মাঠ খুঁড়তে থাকি। হাতের পাতায় উঠে আসে অজস্র শস্যকণা। কণা ঠিকরে তির্যক আলো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমি কণাদের সরণ দেখি। লিখে রাখি সরণের চিহ্নসমূহ।

 

চিহ্ন-১ : অনুভবের আঙুলে আলোকমণ্ডলবার্তানিবিড় আহ্বানআলগোছ রোপণে রাখা প্রতীক রহস্যের বুনোট খুলছে চলমান অন্তর্লিপির তামস গুহায়

 

চিহ্ন-২ : অস্পর্শ আলোর পিঠে তামসের মুখমুখের অন্তরবাহির দ্বন্দ্বদোটানার শেকড়ে দোলআলো নাআলো

 

চিহ্ন-৩ : বৃত্তময় অফুরান উড়ানউড়ে যায় আগামী পথের নিশানসংকেতে থাকে শিল্পনদীর ক্রন্দনবিচ্ছুরণের নির্জন রেখাপাঠ

 

চিহ্ন-৪ : ধারাবাহিক স্নানরৌদ্রলীন অনুপস্থিতির ভেতরনাহওয়া সর্বস্বতার ভেতরনির্ভার উচ্চারণনিস্তব্ধ আবাহন

 

চিহ্ন-৫ : সৃষ্টির সর্বনামে বসছে কর্মের অর্থশৃঙ্খলভাঙা পরোয়ানানতুন গড়ার অধিকারধ্যানমগ্ন চলনে পূর্ণতার প্রত্যাশা

 

চিহ্ন-৬ : গৃহের ভেতর অগৃহের চিহ্নসকলবিভঙ্গ দিচ্ছে অপ্রয়াসের চলনযাওয়া থেকে নাযাওয়ায়ফেরা থেকে নাফেরায়জায়মান অস্বীকারে

 

চিহ্ন-৭ : আলোর ক্যানভাসঅনুপস্থিত আলোঅপ্রশ্নেবিস্ময়েস্তব্ধতায়

 

চিহ্ন-৮ : আলোর আলেয়া খুলে তামস ভ্রমণঅসংলগ্ন পায়ে ফুটছে দ্বিতীয় ভুবনছন্দ নেইশৃঙ্খলা নেইনিয়মাবলিও

 

(১)

 

উত্তরের একটু এদিক নিরুত্তরের একটু ওদিক, ঝুলে আছে সত্য তার রূপ কেমন? নাকি অরূপেই বাস? রূপারূপের এলিজি লিখছে অনুভবের একান্ত পাঠশালা দুরূহ প্রশ্নপত্র। লেখা থাকে বোধ উধাও বিষয়। এলোমেলো অনির্বাচিতের আহরণসেখানে কেবল হতে চাওয়া আছে হওয়া নেই। প্রচন্ড বেহিসেব

আমার যুক্তির নামতাসকল

হাতড়ে বেড়ায় শৃঙ্খলাসূত্র

গা-লাগা অবস্থান

অথচ কী ভীষণ তাৎপর্যহীন

বিশ্লেষণের বহুমুখী সীবনপ্রণালী

নিশ্চিত আবহ খুঁজছে

নিয়মমাফিক

ব্যাখ্যা চাইতে গিয়ে পা পড়ে যায়

অভিজ্ঞতার আউলানো চৌকাঠে

হাতের পাতায় জড়ো হয়

অভিজ্ঞানপত্র

 

আবার ঢুকে পড়ি ওই পাঠশালায় শুরু হয়ে যায় অবিরাম নির্বাচন অবিরাম পরিবর্জন। তারই ভেতর সমগ্র চলেছে হওয়ার দিকে। আর পিছন থেকে তাকে শাসন করছে নাহওয়া। নিরন্তর। আমি হাতড়ে বেড়াই হওয়া আর নাহওয়ার মধ্যবর্তী বিন্দুটি। সমগ্র হেসে ওঠে খিলখিল – সত্যিকার হওয়া খুঁজছ?

গ্রহণ বর্জনের অনন্ত চক্রে

কে কবে চিরন্তন বলো

সত্য কোথাও নেই

সত্যকে পিছনে ফেলে এইমাত্র জন্ম নিল

আরো সত্য

ক্রমজায়মান

যার গায়ে এখনো লেগে আছে

অপ্রাপ্তির লিপিসকল

পাওয়ার প্রয়াসে বাজে

অন্তর্লীন বিষাদের স্বরলিপি

 

আঙুলে জড়ানো বিষণ্ণ পৃথিবীর সন্ধ্যাপত্র পত্রাবলির প্রচ্ছদে এক অন্তহীন সিঁড়ি পেতেছে অভিজ্ঞতার সর্বনাম যাপন প্রণালীর অনায়াস সারল্য দ্বিধা বুনছেপেরোতে হবে সরলে দাগানো সমস্ত উচ্চারণ। পৃথিবীর অবাক স্টেশনে ভ্রমণচিহ্ন খোদাই করছি। অভিজ্ঞানের অমোঘ সোপানে পা ফেলে ফেলে যেতে হবে সেই অন্তর্লীন পথে। সেই তামসময় শূন্যতার পথে।

 

()

 

আলোর ক্যানভাসে ঝুলে আছে মুখফেরানো নাআলো। অবস্থান সম্পর্কিত টান টান মেরুকরণ। কেন্দ্রমুখী অক্ষ বরাবর আমাদের দর্শনের পূর্বশর্ত। চোখ সংক্রান্ত ছায়াবাজির প্রেক্ষাপট। প্রতিফলনের সূত্রে অবস্থানের জমাখরচ। অথচ প্রতিফলন একটা সূত্র মাত্র। কোনো দায় নেই। স্থিতি নেই। অস্থিতিও। অবস্থান নিয়ে আমি দোটানায় পড়ে যাই

 

আলোর পিছনে

ঈষৎ অন্ধকার

কী তুমুল হয়ে উঠছে সংকেত

কী প্রবল হয়ে উঠছে অস্তিত্ব

যতটা দাগ লাগে চলাচলে

যতটা চিহ্ন পড়ে এই বাটে

সব নিঃশর্ত সমর্পণ

অন্ধকারের কাছে আলোর

তোমার কাছে আমার

এই এক একান্ত ইশারা

এত যে স্বত্ব ত্যাগ

তবু আলোবাসা

ভালোবাসা

কী যোজনফারাক

দোটানার শেকড় নড়ে ওঠে

 

অন্ধকারের শ্রবণবিমুখ সত্ত্বা ডিঙিয়ে যায় আমাদের ইন্দ্রিয়হীন গণ্ডি। দৃষ্টিগ্রাহ্য স্পর্শতায় ক্রমশ গ্রাস করতে থাকেক্রমশ। ক্রমশ পূর্ণগ্রাস। তখনও আমি হাত বাড়িয়ে অস্পর্শ আলো দেখি। নামছে ললিত তরঙ্গে লালিত প্রকাশে

আলোর চলনপথে পেতে রাখি

অন্ধকার হাতের পাতা

মুহূর্তে ছলাৎছল

অনিশ্চিত আঙুলে একটা দুটো মুদ্রা

নিত্য হলো না নৃত্যানন্দে

শুধু অন্ধকারের আঙুলে

জমা হতে থাকে

আলোর মুখ

বহির্মুখ

মুখের রেখাচিত্রে বেজে ওঠা নেই

না বেজে ওঠার বিষাদও নেই

আলোর ওইপারে

নাআলো

কী তীব্র প্রকাশ

কেবলই বেজে উঠছে

উচ্চারণরিক্ত নৈঃশব্দ্য

আমার দোটানার শেকড় উপড়ে যায়

 

বুকের ভেতর ক্রমশ জেগে উঠতে থাকে আত্মমগ্ন অন্ধকার। ফিকে নয়। গাঢ় অন্ধকার। যাকে তুমি তামস বলেছিলে। অস্তিত্বের যন্ত্রণায় থর থর কেঁপে ওঠে তার সমস্ত নির্মাণ। শূন্যের জিরোগ্র্যাফিক মুখ নয়রূপ আছে। অবয়ব আছে। আর সেই সত্ত্বার রং লাগে যাবতীয় রঙে। ফলত, সকলই তার নিজের বর্ণ। কখনো স্বর কখনো ব্যঞ্জন। যারা কেবলই হতে চায়। চাওয়ার পথে পড়ে থাকে ব্যর্থতার গন্ধমুকুল। মুকুলের যেখানে অপ্রকাশ সেখানেই বেজে ওঠে অন্তর্লোকের অলখ বর্ণসকল

 

(৩)

 

শিল্পমহলের জানলায় পূর্ণতা নামে এক অলখ পাখি ধরা দেবোকিদেবোনা প্রশ্ন ছড়াতে ছড়াতে উত্তর গোটাতে গোটাতে একটা গোটা বৃত্তনিটোল পূর্ণ আর অপূর্ণের মধ্যমায় রেখাপাঠের পাঠশালায় বসে আমি কম্পাস ঘোরাতে থাকি। এক বিন্দু থেকে পরবর্তী বিন্দুতেঘোর লাগা উঠোনে যাওয়ারা ফিরে আসে ফেরার পূর্ববর্তী বিন্দুতে

শুধু যাওয়া

শুধু ফিরে ফিরে আসা

ছুটির ঘন্টা বেজে যায়

পৌঁছনো হয় না

শুধু নূপুরিমা ঘুরে যায়

আবর্তনে

অপরিসীম বৃত্তধর্মে

 

অথচ তার কেন্দ্রে স্তব্ধ সম্পূর্ণতা। বীজ রোপণের মন্ত্র বোঝা যায় না। ছুটখোলা পায়ে হওয়ার দিকে যাত্রা ধরা যায় না। শুধু তার ক্ষরণের রেণু রেণু বোধ। শুধু তার অবোধের আলোনাআলো গুঞ্জন

 

সহসার চোখ ফুটছে

নিমগ্ন শূন্যমিথে

জেগে উঠছে তামস অধ্যয়ন

আঁধার রেখাপাঠের প্রয়াস

প্রতীতি জন্ম নেয়

অর্থে

অনর্থে

প্রতিদ্বন্দ্ব থেকে খুলে খুলে যায় দ্বন্দ্ব

শিল্পেরা হেঁটে যায় নিহিত চক্রমায়

যেমন এই চরাচর

এই আবহমান

বৃত্তসংকেতে

 

বারংবার যাওয়া অথচ কোথাও এগোচ্ছে না। বারংবার ফেরা অথচ কোথাও ফিরছে না। দোদুলের দোল লাগছে স্পর্শক বরাবরসিদ্ধি ছিটকে যাচ্ছে অসিদ্ধির খেয়ালেবৃত্তছুট সমস্ত সিদ্ধান্তই দৌড় খুলে রাখছে শিল্পালয়ের বারান্দায়। অবৈধ পায়ের জলছাপে বোধ লিখছে অবোধের দুরন্ত উল্লাস। 

     

(৪)

 

সিঁড়িভাঙা যাপন জুড়ে নির্দেশনামা। মূর্ত উপস্থিতি। পালক খসানো পাখি বসে থাকে প্রতিটা ধাপে। ওড়া নেই। ওড়ার আকাঙ্ক্ষাও নেই। সময়ের ভারে ন্যুব্জ হয়ে আসে যাপনের চিহ্নসমূহ তখন হঠাৎই বেজে ওঠে তোমার নির্দেশহীন আহ্বান

 

এই এক অমূর্ত অনুপস্থিতি

তবু শুনতে পাওয়া যায়

অনন্তের ডাক

ডাকের ভেতর স্মৃতিহীন আহ্বান

অনায়াস

সময়রিক্ত চলন

লেগে থাকে তোমার পায়ে

অবোধ্য শূন্যের ভেতর

ধ্বনিহীন উচ্চারণ

 

এমন নিঃশব্দ এইসব সংকেত, শ্রবণবিমুখ পাখির পালকও নড়ে ওঠে ওড়ার আকাঙ্ক্ষায়। জমাট নিঃসঙ্গতার ভেতর খুব অশ্রুত সুরে তোমার বোধন বেজেছে বোধের দরজা খুলে পৌঁছতে চাই সেই বাজনাতলায় তোমার স্বাভাবিক রং ভেঙে কবে থেকে যেন সহস্র রঙের পলেস্তারাচোখে তাই অতিরিক্ত বর্ণছটা। গায়ে অমিত প্রসাধনসমস্ত আরোপিত চিহ্ন মুছে আজ পৌঁছতে চাই তোমার বিশুদ্ধ আদিমতায়

সেই আবহমান আদিম

স্থবিরতাভাঙা ভঙ্গিতে নাচে

অনন্ত রোমাঞ্চ

ঝরনামুখর ধ্বনিতে বাজে

অনন্ত বিস্ময়

প্রতি মুহূর্ত

শাশ্বত মুহূর্ত

শিকড়রিক্ত থাকা

সম্ভাবনারিক্ত নাথাকা

 

থাকানাথাকার পথ হাঁটছে। প্রবহমান তরঙ্গেহেঁটে চলেছে অভিমানহীন রিক্ত নিঃস্ব চরাচরে। স্বয়ং-এর ডাক উঠেছে সম্পূর্ণের ঘরেবাইরেনামতে হবে সমস্ত নির্মোক খসিয়েশাশ্বত দিগন্তের গায়ে লেগেছে অনন্তের ডাক নামতে হবে পলেস্তারার সমস্ত দাগ মুছে প্রথমের দিকে নেমে যাওয়া আঙুলেরা লিখে রাখছে এককতার ধারাবাহিক স্নান

 

(৫)

 

ইতিহাসের ভাঁজে ভূগোলের গোল, কৃষ্ণাভ রায় – কর্মে অধিকার ফলে নয়। অথচ শিল্পানুবাদে থৈথৈ মানুষটি বিপরীত আঙুলে নির্মাণ ফুটছে। কর্মের সচেতন প্রয়াস। দলছুট ইশারা আকাঙ্ক্ষায় বসছে সম্ভাব্য পূর্ণতা। অথচ পূর্ণতা এক অলীক ধারণামাত্রপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় শুরু হয় আমাদের আঁধার আর ব্যক্তিগত অনুচ্ছেদএই কুরুশকাঁটার চলন বাজছে তারই আঙুলে, বেঁধানাবেঁধা একান্তই তার

 

জন্মাবধি নিজের অধীনে রেখেছ

তাবৎ বিশ্ব

সর্বময়ের ভূমিকা গড়ছ

জীবনভোর

অভিনয়ের ফাঁসিকাঠে

কাকতাড়ুয়া

তাড়নের হরফে লেখা কর্ম

অধিকার রাখোনি

ভূ কিংবা

ভূশণ্ডিতে

 

তবু তাবতের বাইরে দেখো ওই শিল্পী, জাগ্রত চেতনায়নে তোমার অস্তিত্ব রাখেনিতোমার রীতি কিংবা নীতি কোনটাই মানতে পারেনা সেসমস্ত শৃঙ্খলেই জন্মরাগ। কেবলই ভাঙছে। আর ভাঙছে। টুকরো টুকরো ভাঙা টুকরো টুকরো গড়া। তাকে ডাক দিয়েছে অনন্তের মুক্তিমণ্ডল যোজনহীন ধ্যানে। বৃত্তমগ্ন যাত্রায়অনায়াস

এই এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা

জীবনভোর

তুমি পূর্বে লেখো নির্ধারণ

শিল্পীর আঙুলে বিপরীত বায়োডেটা

অনিশ্চিতের পায়রা

পালক থেকে সম্প্রসারণ

ফোঁটায়

ফোঁটায়

প্রতিটা বিন্দুতে তার অধিকার

একমাত্র তারই

 

অবস্থান নিয়ে তুমি বরাবর ভেবেছ। কেবল ভাবেনি সেই শিল্পখেলার শরণার্থী অঙ্কবিহীন অস্থির গুহায় হাত পা মেলা অবস্থান তার হওয়ানাহওয়ার তোলপাড় কুয়াশায়আলোর লাগাম খুলে অন্ধকারে নেমে আসছে মহীনের ঘোড়াগুলো। চলন না-মানা পায়ে তার রীতি তার নীতি। সে আদিও জানে না অন্তও জানে নাশুধু ভাঙা আর গড়াশুধু গড়া আর ভাঙা। সম্প্রসারিত চেতনায় কোনো ধর্ম নেই কোনো সত্য নেই সমস্তই ঝরাপালকের গান। বিস্ময় থেকে সংশয়ে যেতে যেতে বিষয়হীন করে তুলছে তোমার অক্ষরের সীমানা। তোমাকে অস্বীকারের উজানে নিশ্চিন্তে বেয়ে চলেছে নির্মাণের তরীখানি

 

(৬)

 

ফিরে যেতে হবে তোমার দরজা নাথাকা গৃহে। যাওয়ার পথে যাদের সাজিয়ে রেখেছ তারা শুধু নিশ্চিতের কথা বলে। সেখানে অনিবার্য দিগ্‌নির্ণয়। সেখানে পূর্বনির্দিষ্টতার উচ্চরোল। এই জায়মানহীন রোল ও বোল আমার পা কে গেঁথে ফেলে প্রত্যাশার সঙ্গে। আমার আর যাওয়া হয়না

 

যেতে হবে তোমার অগৃহে

পথের ভেতর পথ খুঁজছি

পরিকল্পনাহীন

ইস্তাহারহীন

অতিজাগর যাত্রা

অপ্রয়াসের ভেতর

সহজের ভেতর

শুরুও নেই

শেষও নেই

শুধু বিস্মৃতির ভেতর

অলখ অপেক্ষা

 

অপেক্ষা তো আবহমান নয়। তাই সে সত্যও নয়। অপেক্ষা ক্ষণিকও নয়। তাই কোনো ব্যাকরণেই সে অসত্য নয়। তবে কোন সংজ্ঞায় বাঁধব তাকে? সংজ্ঞাবদ্ধ না হলে সে যে বিশ্বনিয়মের অস্বীকার। অস্বীকার আমরা মানতে পারিনা। শুধু যাওয়া শুধু ফিরে ফিরে আসা। এক অলখ উপস্থিতি। আমরা মানতে পারিনা। অনুপস্থিত আকুতির ভেতর যে চলন, সেখানে বাজিয়ে দিই ভয়ডঙ্কানির্নিমেষ এককতার ভেতর যে চলন, সেখানে দাগিয়ে দিই বিপদসংকেত তবু ওইখানে বাজছে তোমার অনাহূত শিল্প নূপুরের বিভঙ্গ। ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে তোমার ওই অগৃহে।

 

(৭)

 

দেখার পার্সপেকটিভে ঝুলে আছে থাকানাথাকাআলোর হারমোনিকে রাখা হয়েছে দেখাঅন্ধকারের সাপেক্ষে দেখা জেগে উঠছে আলোর মরশুমে আমি দেখা, সাপেক্ষ এবং আলো এদের মুছে দিতে চাইলাম হাতে রইল পেনসিল বনাম নিরবয়ব। নাম দিলাম তুমি এবং তুমিকেননা সকলেরই কিছু রকমফের থাকে ফিকে ঢং, আসমানি অবলম্বন, ধু ধু কায়া ইত্যাদি প্রভৃতি হরেকরকম্বাকেবল নিরালম্ব তুমি কোনো মাত্রা রাখোনি কোনোদিন

 

নিমাত্রিক ল্যান্ডস্কেপে উদাসী আঁচড়

এমন নিঃশব্দ

এমন প্রয়াসহীন

যেন দেখার সমস্ত পার্সপেক্টিভ

ঝরে ঝরে যায়

দেখার তসবিরি আঙুলে

বোধের অবৈধ স্বরলিপিতে

 

আলো নিশ্চিতভাবেই একটা সীমাকে স্পষ্ট করেএকটা উপস্থিতিকে প্রকাশ করে। কিন্তু তোমার পরিমিতি অসীম চিনেছে চিরদিন। শাসনের সমস্ত ব্যাকরণ গড়িয়ে গেছে দু আঙুলের ফাঁকেযাযাবরী দক্ষিণায়নে যেমন পথের এলিজি ফোটেনি, মুসাফিরি উত্তরায়ণেও লটকে থাকেনি বেলোয়ারি আশা

যার থাকা এমন নিরুচ্চার বিরাম

মৃত্যু তাকে কোথায় স্পর্শ করবে বলো

যার যাওয়া এমন প্রশ্নহীন

ধারাবাহিক খুলে রাখা

কেবলই অপ্রশ্ন

মৃত্যু তাকে কীভাবে গ্রাস করবে

যার চলা এমন নিস্পন্দ

এমন কোলাহলহীন

প্রবাহ অপ্রবাহ

একাকার

মৃত্যু কোথায় চিহ্ন রাখবে বলো

নিশ্চিত দরজা পেরিয়ে

সমস্ত চলা চলেছে

নাচলার দিকে

মৃত্যু কোথায় থামাবে বলো

 

যা কিছু দায়বদ্ধ তাই তো মৃত্যুনিশ্চিত। যা কিছু পরিকল্পিত, যা কিছু অবয়বমুখর তাই তো মৃত্যুচিহ্নিত। কুঁড়ির দায়বদ্ধ চলন ফুলের দিকে। ফুলের দায় পলের অভিমুখেনিঃশব্দে ঝরে যাচ্ছে হলুদ পাতারা। অথচ এই সমগ্র আবহমান ভেতরবাড়িতে সম্মিলন ডাকছে – জীবন আর মৃত্যু, আছে আর নেই হওয়ার ভেতর জেগে উঠছে নাহওয়ার অঙ্গীকার নাবয়বে অলখ ঘুঙুর জলছল পায়ে খুলে রাখছে মৃত্যুর পরোয়ানা    

 

()

 

তোমার অবস্থান সম্পর্কিত প্রশ্নে পূর্বাশ্রমের অনুবাদ। নিয়মাবলির আখ্যান লেগে থাকে বর্তমানের আঙুলে। ক্রিয়ার কোরাসে লেখা প্রতিক্রিয়া চলমান ইতিহাস। ধারাবাহিক বুনে দিচ্ছে আলসে অনুক্রম। আবির্ভাবও নেই। আবিষ্কারও নেই। কোলাহলহীন বৃত্তশিল্পী এলকেন্দ্র ভেঙে ব্যতিক্রম বসালো ব্যক্তিমানস

আত্মপ্রত্যয়ের ভ্রূণ ফুটছে

এই সেই দ্বিতীয়তা

প্রথমও নেই

ইতিহাসও

সত্যের স্বরলিপি ভাঙা

দ্বিতীয় সত্য

গভীর বুনোটে বিশৃঙ্খল জাল

আন্তর্জালে আঙুল রাখলে ভেঙে পড়ে

কার্যকারণ সম্পর্ক

ভাঙা সম্পর্কের অলিতেগলিতে

পিতৃগৃহের অস্বীকার

উদ্দেশ্যও নেই

উদ্দেশ্যহীনতাও

 

সৃষ্টি প্রয়াসের গর্ভে কেবল এক নিরবয়ব বীজ। বীজপত্রের গায়ে কোনো সম্পূর্ণতার ছবি নেইবীজমন্ত্রে প্রতিশ্রুতির ধ্বনি নেই। বীজতলা বুনে দেওয়ার দায়ও নেই। কেবলই তামসযাত্রা। স্বীকারেও নেই। অস্বীকারেওতোমার প্রথম পায়ের ছাপ পড়েছিল আদিম অণুকণায়। চারপাশে আরো আরো কণা জুড়ে এই বস্তুজগৎ। বস্তুর ভেতর পালক হারানো গল্প কেবলই গড়িয়ে যায়। গড়ানো নামতায় তোমারই কোলাজ শৃঙ্খলামগ্ন শ্লোগানে তার রং ঢংছবিতে ফোটে না কোনো অসংলগ্ন পা। স্থিরচিত্র এই অনন্তে দিগন্ত ফুটিয়ে শুরু হয় ব্যক্তিমানস যাত্রা

 

অনুপস্থিতির দিকে

অসংলগ্ন যাওয়া আর

ফিরে ফিরে আসা

লগ্নভ্রষ্ট আঙুল নামিয়ে রাখে বস্তুর ভার

ভরের কেন্দ্রে অতিক্রমণ মন্ত্র

নিঃশ্বাসের ভেতর

অনিঃশ্বাসের মন্ত্রণা

অসংলগ্ন পা গড়তে থাকে না-এর জগৎ

যত কেন্দ্রাতিগ

তত অগ্নিময়

যত বন্ধনহীন

তত বিদ্যুৎকোলাহল

------------- 

যে কবির “অন্তরলোক” খুঁড়ে আমার এই কবিতাযাত্রা সেই কবির সংক্ষিপ্ত পরিচয় :

আলোক সরকার (১৯৩১-২০১৬)

জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক কবি আলোক সরকার পঞ্চাশের দশকের বিকল্প সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ধারক ও বাহক। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ উতল নির্জন প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় কড়িটি: সূর্যাবর্ত, স্তব্ধলোক, বিশুদ্ধ অরণ্য, আলোকিত সমন্বয়, অন্ধকার উৎসব ইত্যাদি। লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি নাটক, উপন্যাস এবং ছোট গল্প। ২০১০ সালে তাঁর কবিতা সমগ্র প্রকাশিত হয় কলকাতার দিয়া প্রকাশনী থেকে। ২০১২ সালে কৌরব প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর গদ্য সংকলন অন্তরলোক। তাঁর ঙ্কাব্যগ্রন্থ শোনো জবাফুল রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করে ২০১৫ সালে।