কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

কালিমাটি অনলাইন / ১৫

সম্পাদকীয়




গত ১১ই মে ২০১৪ রোববার সকালে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বারুইপুরে ‘মহাদিগন্ত বাগান’এ আয়োজিত হয়েছিল ‘মহাদিগন্তের কবিপ্রণাম ও মহাদিগন্ত পুরস্কার ২০১৪’ অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতাপাঠ ও আবৃত্তির পাশাপাশি ছিল স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। ‘মহাদিগন্ত পুরস্কার ২০১৪’ গ্রহণ করেন বাংলাদেশের কবি সৈয়দ শামসুল হক এবং ভারতের কবি শ্যামলকান্তি দাশ। গল্প ও প্রবন্ধের জন্য পুরস্কৃত হন যথাক্রমে কথা সাহিত্যিক রবীন্দ্র গুহ এবং বাংলাদেশের প্রাবন্ধিক মাহবুব সাদিক। এছাড়া বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে সামগ্রিক অবদানের জন্য ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক কাজল সেনকে পুরস্কৃত করা হয়। এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইতিপূর্বে ‘কালিমাটি’ পত্রিকা কানপুরের ‘দূরের খেয়া’ পুরস্কার (১৯৯৮), কলকাতার ‘তারাশঙ্কর পরিষদে’র ‘উমাশশী পুরস্কার’ (২০০১) এবং ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’র ‘লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার’এ (২০০৮) সম্মানিত হয়েছিল। কবি ও অধ্যাপক উত্তম দাশ সম্পাদিত ‘মহাদিগন্ত’ একটি বিশিষ্ট বাংলা লিটল ম্যাগাজিন। দীর্ঘদিন ধরে এই কবিতা-পত্রিকাটি নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। ‘মহাদিগন্ত প্রকাশনা’ থেকেও প্রকাশিত হয়েছে অনেকগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মননশীল গ্রন্থ। বিগত পনের বছর ধরে ‘মহাদিগন্ত পুরস্কার’এ সম্মানিত হয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি, গদ্যকার এবং পত্র-পত্রিকার সম্পাদক। ‘মহাদিগন্ত’র এই ধারাবাহিক সাহিত্য প্রয়াসকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং ‘মহাদিগন্ত পুরস্কার’এ সম্মানিত হয়ে শ্লাঘা বোধ করি।


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ১৪তম সংখ্যায় ‘কালিমাটির কথনবিশ্ব’ বিভাগে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শ্রীসন্দীপ দত্ত একটি নিবন্ধে লিখেছেন – ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে (দেশ, মে ১৯৫৩) বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘সবুজপত্র’ বাংলা ভাষার প্রথম ‘লিটল ম্যাগাজিন’। এই কথাকে যদি মান্যতা দিতে হয়, তবে এই বছর প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’র (প্রথম প্রকাশ ২৫শে বৈশাখ ১৩২১, ইংরেজি মে ১৯১৪) একশ বছর হলো এবং সেই হিসেবে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনেরও শতবর্ষ।


সঠিক কথাই উল্লেখ করেছেন সন্দীপ দত্ত। আমরা বুদ্ধদেব বসুর কথা মান্য করি এবং প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’কে বাংলা ভাষার প্রথম লিটল ম্যাগাজিনের মর্যাদা দিই। আর তাই ‘সবুজপত্র’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশের দিনটির শতবর্ষ পূর্তির কথা স্মরণে রেখে একদিকে যেমন ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১০০তম সংখ্যা প্রকাশের উন্মাদনা বোধ করি, অন্যদিকে তেমনি ‘মহাদিগন্ত পুরস্কার’এ সম্মানিত হয়ে আনন্দে আপ্লুত হই।


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ১৫তম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। আপনাদের সহযোগিতা ও ভালোবাসায় আমরা অনুপ্রাণিত। আপনাদের সবাইকে জানাই আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। প্রসঙ্গত জানাই, এই সংখ্যার ‘স্লাইড শো’তে যে পাঁচটি ছবির একটি সিরিজ প্রদর্শিত হয়েছে, তার শিল্পী শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়। সিরিজের নাম ‘মায়া – আ লাভার’স মনোলোগ’। শিল্পী এই সিরিজটি উৎসর্গ করেছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে। রচনাকাল : ২০১১-২০১৩। প্রকার : ডিজিটাল পেন্টিং। মাধ্যম : মিশ্রমাধ্যম। আমরা শিল্পীকে এই অসামান্য শিল্পকর্মের জন্য জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা।



আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kalimationline100@gmail.com
kajalsen1952@gmail.com

প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :
0657-2757506 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301,
Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002,
Jharkhand, India

<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


০১) রমিত দে

পথ ও পরিক্রমণ


আত্মঅতিক্রমণের পথ কি কবির আর্কিটাইপে বা আদিকল্পেই সংরক্ষিত থাকে! লোক-লৌকিকতা থেকে প্রসূতের মায়াবাঁশির থেকে কবি যখন হেঁটে যান পরম ভূমার দিকে, তখন কেবল একটা রসোত্তীর্ণ সাহিত্য নয় বরং অন্তেবাসী বিবেসাধনারও প্রয়োজন অনুভব করেন না কি কবি! আসলে কবির দেহের সাথে  দেহতন্ত্রের সাথে কোথাও কবিতা অমিয় শব্দরেণু দিয়ে জড়িত। আর দেহের সাথে জড়িত বলেই তাকে ছিন্ন করার, আগলে থাকা থেকে অনিরুক্ত হওয়ার প্রবণতাও প্রগাঢ়ভাবে মিশে আছে। বিশ্বব্রহ্মান্ড জড়িয়ে অনন্ত জীবন নিয়ে প্রভাতসংগীতে যে কবি একদা উচ্চারণ করেন তোরা ফুল, তোরা পাখি,  তোরা খোলা প্রাণ,/জগতের আনন্দ যে তোরা,/জগতের বিষাদ-পাসরা/পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী/তোরা তার একেকটি ঢেউ” সেই কবিই আবার ব্যক্ত পেরিয়ে অব্যক্তের সাধনায় মাতেন। তাঁর পুরবায়ুতে মেশে বাউলপনা-

     “যাত্রী আমি ওরে-
         বাহির হলেম না জানি কোন ভোরে
             …নিমেষহারা শুধু একটি আঁখি
                    জেগেছিল অন্ধকারের পরে”।   

এখন কি এই দৃষ্টি, কি এই দর্শ, পরম ঔৎসুকে রয়ে যাওয়া কি এই পৌঁছবার তাড়না! কোথায় বা পৌঁছতে চায় কবি! কোন অতিরিক্তের প্রাতঃভ্রমণের সাক্ষী হয়ে ওঠে তার হিমানী পংক্তিরা! কবি কি সত্যিই তবে দেহ থেকে বেরোতে  চায়, পেরোতে চায় এক থেকে অনন্তের ধারণায়, নাকি এ শুধু প্রত্যাখাত হতে হতে প্রত্যাশার আদিবন্ধ? আসলে কবি তো কাঁচা কাঠ, ঘু তাঁকে খেয়েছে অনেকদিন আগেই, জন্মক্ষণ থেকে মৃত্যুক্ষণ অবধি যে কবি বিশ্বপ্রকৃতিকে আর মানুষকে মন্থন করেছে সেই কবিই অস্থিরতা বোঝাতে স্মৃতি থেকে গড়িয়ে দিয়েছেন অবচেতনার ফ্র্যাগমেন্টস। শরীর থেকে, বৃদ্ধি ও জনন থেকে রতি ও বমন থেকে শব্দের এক ঘর সোজা আর এক ঘর উলটো নিয়ে কাকে খুঁজছেন কবি! “তং বেদ্যং পুরুষং বেদ মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ -উপনিষদ যেখানে   বলছে যাঁকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণ বেদনা”, তাকেই বাউল সম্প্রদায় খুঁজে চলেছে মনের মানুষের আদলে। এ কোন মানুষ!  মাচানতলা দিয়ে যিনি মহানির্বাণের পথে গেলেন, নাকি যিনি চুপ করে বসে   থাকলেন ‘মেঘের রেলিঙে মাথা দিয়ে’! বি ঠাকুর নাকি তাঁর জীবনব্যাপি   কবিতার অগ্নিতে অন্তরীক্ষে বায়ুতে দ্যুলোকে খুঁজে ফিরেছেন এমনই এক অপারের, অন্তর্যামীর বৃহদারণ্য; কেউ বলছেন বাউলেও মজেছে রবিহৃদয়, কিন্তু তার দেহতত্ত্ব ব্যতিরেকে দেহাতীত সহ্রসার সন্ধানে ছুটে গেছে তাঁর মন, তাঁর শর্তহীন প্রস্তাবহীন সমপর্ণ। “Who was it that imparted form to man, gave him majestry, movement, manifestation and character, inspired him with wisdom, music and dancing? When his body was raised upwards he found also the oblique sides and all other directions in him-he who is the Person, the citadel of the infinite being” -শরীরকে ছুঁতে অথবা শরীর থেকে সারপ্লাস অবধি পৌঁছতে রবির ছিল ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি অর্থাৎ দেহ আকাশের মতো কোনো এক সর্বব্যাপীতার খোঁজ। কিন্তু দেহের বাইরেই শুধু কেন? শরীরের মধ্যেও তো অনিকেত সাড়া রয়েছে, রয়েছে শূন্য ধানখেত। দেহের মধ্যেও তো দল উপদল নিয়ে বসে আছে শেকড়ের এতখানি বাঁক, পিন্ডদেহকে সূক্ষ্মদেহে পরিণত করতে শরীরের মধ্যেই   তো রয়েছে শরীরের এতখানি ফাঁক। ‘হারামনির’ বাউলেরা যখন বলে ওঠে   -“গোঁসাই আপনার ঘরে আপনি ঘুরি/গোঁসাই সদা করে রস চুরি/জীবের ঘরে ঘরে”, তখন কি বক্তাকে ব্যক্ত করতে করতে আদতে ব্রহ্মানন্দপল্লীতেই ঢুকে  পড়া নয়? আসলে থাকার কথার মাঝে একটা ফেরার ভাষা থেকেই থাকে। কখনও স্তব্ধ কখনও বা স্পষ্টতার তাপে জারিত। সে তুমি যেভাবেই দেখ পরবাসী হয়ে অথবা কুড়ানী হয়ে কেউ অতিবেগুনী হতে ছুটে যাছে নতুন ‘আমি’র দিকে, কেউ অতিবেগুনী হতে ফিরে আসছে নতুন ‘আমি’র দিকে। একটা পোড়া গন্ধ সবক্ষেত্রেই আছে। আমাদের নিসর্গের, প্রকৃতির কবিতাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে কবি চলেছেন ইপ্সিত চলমানতার দিকে। ডুবের অনেক ওপরে কাদা ঘুলিয়ে ভেসে উঠছে একক ভাসমানতা। আর এখানে দাঁড়িয়েই কবি বা কবিতার কোনো সম্প্রদায় খারিজ হয়ে যায়। সম্প্রদায় নির্বিশেষে পাখি গহীনেতে চড়ে। পাখি শূন্য ভরে। কাব্য নাটকের অন্তিম শ্লোকে কালিদাসের পুলকিতদেহ হংসযুবা যে তার সহচরীকে  নিয়ে আকাশে ওড়ে, সেখানে কবির উজ্জ্বল পালকই ডানা ঝাপটিয়ে বলে “প্রাপ্তসহচরীসঙ্গমঃ পুলকপ্রসাধিতাঙ্গেঃ /স্বেচ্ছাপ্রাপ্তবিমানো বিহরতি হংসযুবা”, আসলে  কবি সেখানে আনন্দের ভেতর দিয়ে খুঁজছেন আলোয় বাড়ি ফেরার পথ, নিজের কাছেই খুঁজছেন মানসচিত্রের মধুময় জবাবদিহি, আবার ঠিক তেমনি আশির কবি যখন ‘শ্মশান যাত্রায়’ লেখেন - “সংসারের ধারে কে একটা খাঁচা রেখে গেছে/রেখে গেছে বাকি পাঁচ ফুট উঁচু স্বপ্ন/যা এখনি হেলে দুলে রওনা দেবে/বা পড়ে থাকবে এমনি বিকেলবেলা”- কেউ ভাবে বিষাদবিলাপ, কেউ ভাবে অমর শোকগাথা কিন্তু না, এও তো এক দুঃখবিনির্মুক্ত পূর্ণমিলনেরই গল্প, অতিজাগরের গল্প। এ যেন ছুটির কবিতা, চিত্রের গহনে কতখানি বাঁক নিচ্ছে প্রকৃত ‘আমি’, তা দেখে নেওয়ার কবিতা। কবির অ্যানাটমিতে প্রথম থেকেই লেগে রয়েছে একটা উত্তরমেঘের কথা, উত্তরণের কথা, সব ফেলে সামনের দিকে পালিয়ে যাওয়ার কথা। যেদিন চার পেয়ে থেকে দুপেয়ে হয়েই অ্যানিমাল/লোকোমেশনকে আঘাত হেনেছে মানুষ, তার প্রাজ্ঞ আর পঞ্চানন নিয়ে অনন্তকে চিন্তা করতে শিখেছে মানুষ, সেদিন থেকেই সে আসলে বিশাল বড় একটা অপ্রমাণ। একটা ক্রমআবিষ্কার। কেউ পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবী থেকে পৃথক, কেউ আবার পৃথিবী দিয়েই বর্ণনা করে চলেছেন এত বেশি থাকার মাঝে এত বেশি না থাকা। কোনটা ঠিক! কোনটা আমন্ত্রণ! কোনটাই বা অনুরনণ! সে প্রশ্ন বাহ্যিক।
     

সব কবিরই কল্পলোকের এক চিত্র আছে, সব কবিতারই কালি থেকে বেরোবার এক চরিত্র। শব্দ উৎসবের আলো জ্বললেও কেউ দেখে না করোটিগহ্বর অবধি কখন ভরে যায় গমগমে আঁধারে। কবি বোঝে এবার ফিরতে হবে। কবির বোঝা উচিত অবিচ্ছেদ্য তন্ত্র থেকে এবার গা ঝাড়া দেওয়া উচিত। ‘উচিত’ কথাটা এইজন্যই ব্যবহার করলাম, কার কবি কোনো হরিতকী বাগানের হলুদ  বিকেল নন, নন কোনো স্থিতিমগ্ন হরিবাড়ি। তিনি আছেন এই বাড়িগুলিতেই এই রোগা রোগা বাসনাগুলিতেই। কেবল চুরি হওয়ার মতো হয়ে আছেন। আর ওই চুরিটুকুই সত্য, আঁকশি বাড়িয়ে তুলে নেওয়া জীবনের সর্বোত্তম সত্য। হিরন্ময়েণ পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম; তিনি কেবল হিরন্ময় পাত্রের সেই আধার যার ভেতর আবৃত রয়েছে সত্য, যা এক প্রকাশের আবরণ। আর এখান থেকেই শুরু হয় কবির স্বীকারোক্তি, এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখা। কবিকে খুঁজে নিতে হয় সরু গোপন একটা পথ। এ পথ দিয়ে যাওয়া তার নিজের, এ পথ নিয়ে যাওয়া তার নিজের। একাধিক লোকের পায়ের শব্দ এ পথে একাধিক পুরুষের সাহচর্য এ পথে। প্রকৃতির একাধিক ছড়িয়ে আছে অথচ মুখের একক খুঁজে ফিরছে কবি। এ পথ তাই তার নিজের। এ দেখা নিজেকে দেখা। মানুষ জীবজন্তু গাছপালার ফাঁকে যে দীর্ঘ আঁকাবাকা পড়ে রইল, ঘুম না আসা পাখনায় পড়ে রইল যে শিরশিরানি যে হিজিবিজি, সেই কুন্ডলী বেষ্টনী সীমা  আর বক্রতা থেকে বিশ্বপ্রবাহকে একা রেখে এক দৌড়, প্রতিপক্ষহীন দৌড়। ভাষার ভেতর দিয়ে এভাবেই খুলে যায় ভাষার সেলাই, কেউ যেন লেখার ওপর অন্ধকার করে দিয়ে বলে, নাও, এই নাও, আলোর বন্ধুতা। এই নাও প্রত্যাবর্তনের দিকের পথ। পথ রয়েছে কার তুমি পেরোবে, তুমি পেরোবে কার তোমার মাঝে প্রাণনা রয়েছে।

এখন প্রশ্ন মাটির দেহ নিয়ে যে কবি মনোভূমিকে বিস্তৃত করতে করতে মাটিকে ছাড়তে চাইলেন, সে কবি কি সত্যই অন্যরূপে পড়েন নাকি এ কেবল এক   বাতাসবিহার! ঘর থেকে বেরিয়ে ফিরে ফিরে আসা পাঁচিলের ভারে। কিছুতেই যেতে চায় না পা, ঝুল বারান্দা থেকে কিছুতেই পাড়তে চায় না সবশুদ্ধ একটা ‘আমি’ অথবা শবহীন একটা ‘আমি’কে। মনসুরউদ্দিন মহম্মদের সংকলিত সেই মুর্শিবাদের মেয়েলী গানটার প্রথম কয়েক ছত্র মনে পড়ছে।

“আম গাছ কাটিয়া ভায়া ডোলা সাজালেরে
ভায়া না যাব ডোলাতে
জাম গাছ কাটিয়া ভায়া ডোলা সাজালেরে
ভায়া না যাব ডোলাতে ।
সিথ্যার মানান সেন্দুর দিছি বহিন ডোলাতে চড়রে
ভায়া না যাব ডোলাতে

সরস ও কোমল প্রাণের বোনের বিবাহ প্রসঙ্গে ভাই পালকি সাজিয়েছে, কিন্তু বোন কিছুতেই যাবে না; আমগাছ কেটে ডোলা সাজিয়েছে জাম গাছ কেটে ডোলা সাজিয়েছে, প্রলোভন দেওয়া হয়েছে নানাবিধ অলংকারের, কিন্তু কিছুতেই সে যাবে না একটা থাকা থেকে, একটা বহুদিনের যত্নে রাখা আত্মীয়তা থেকে। কবিও ঠিক তেমন, কিছুতেই মাটি ছাড়তে চায় না,কিছুতেই ছাড়তে চায় না ফ্যানগালা রান্নাঘর, ছাই লালা আর লবণের থেকে কিছুতেই বেরোতে চায় না কবির ডুমো ডুমো যাপন। কবির মায়াবন্দর। একটা মানুষ আর তার ঘুম এই তো আছে আর এই মানডেন থেকেই পুটকে পুটকে মধু গ্রহরা এক অশ্রুত  মুক্তমালার খোঁজে। আসলে কবি তখন ঘুমোন। স্মৃতির সঙ্গে স্বপ্নের সঙ্গে। আর এই স্মৃতি এই স্বপ্নই তার জেগে ওঠার আর্কিটাইপ। মহানগর থেকে মহাজাগতিকে ফেরার পাশওয়ার্ড। ডোলাতে উঠতেই জড়তাকে হাত নাড়ান, শব্দের পেছনের দিকে জমি শব্দের পেছনের দিকের জরাকে অন্তিম অস্ত্রোপচার দিয়ে লিখে যান-“ আমরা কি এভাবেই যাবো, ওই ভাবে চলে যাবো/আমরা কি সেই আখ মাড়িয়ে স্রোতের দেখা পাবো/সমস্ত দেখার দেখা, শোনার সমস্ত কিছু শোনা/…মনে পড়ে দূরে যাবো -ড়ে থাকা ময়ূরের দিকে/থাকে যত ভালোবাসা দূরের মাপেরও কিছু দূরে”। এই ঘুম ভাঙা কিন্তু বেশ একটা আয়ামের। সেখানে খড়ির গন্ডি  নেই, সীমান্ত চৌহদ্দি নেই, কুলোনো বা এঁটে যাওয়া নেই, নেই দৌড় পাল্লা নাগাল আয়ত্তি।


আবু সাইদ আয়ুব যখন বলেন, কবিতা হলো মানবিক প্রাকৃতিক বা  সর্বজাগতিক বিশ্ববোধ। অর্থাৎ আভাসে ইঙ্গিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শেষ পর্যন্ত কবি প্রকাশ করতে চান তাঁর বিশিষ্ট হৃদয় অথবা সমগ্র ব্যক্তিস্বরূপ দিয়ে দেখা মানুষের রূপ, প্রকৃতির রূপ এবং মানু্য ও প্রকৃতিকে নিয়ে যে ভূমা তার রহস্যময় রূপরেখা। সে রহস্য মনের দরজায় সর্বদাই অত্যন্ত মৃদু করাঘাত করে কিন্তু দরজা খুললেই দেখা যায় - নেই, কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। অর্থাৎ কবিতার অমরত্ব সে কি গিলগামিশের পুনর্নবা ওষধি চুরি হয়ে যাওয়ার মতো  নয়? আছে অথচ নেই।

পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য গিলগামিশের কাহিনীতে গিলগামেশ চেয়েছিলেন চিরঅমরত্বের ঠিকানা।
তারই বহুপূর্বপুরুষ অমর উতনপিশতমের কাছে গিয়েছিলেন নিকষ কালো নারকীয় যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যন্ত্রণাহীন মৃত্যুহীন এক  জীবনের আর্জি নিয়ে; উতনপিশতমকে খুশি করে চিরঅমরতার ওষধিও পেয়েছিলেন গিলগামিশ। শর্ত ছিল ফেরার পথে পিছুডাকে সাড়া না দেওয়ার কিন্তু জীবিতের মধ্যে যে লেগে রয়েছে মায়াবাদ, লেগে রয়েছে অব্যক্ত  অবস্থাগুলোর আবরক, তাই তাকে সাড়া দিতেই হয়, দৌড়ের মধ্য দিয়েও  দেখতে হয় মাটির পিন্ডবস্থা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কে। প্রশ্ন থেকে যায়, তবে উতনপিশতম অমর রইলেন কীভাবে! কীভাবে স্বর্গীয় বাগানে তাঁবু ফেললেন এক মনুষ্য মন্দার! আসলে তার অস্তিত্বের মূর্ত আয়তন দেবতার দেওয়া জলোচ্ছাসে ডুবে যাওয়ার আগে কে যেন তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন - নৌকা বানাও, বিরাট এক নৌকা বানাও উতনপিশতম। মহাবন্যা আসবে, ডুবে যাবে সব, বাঁচতে চাও তো সব প্রাণীর একজোড়া নাও, সব  বীজের একজোড়া নাও। আর ভাসতে ভাসতে ক্রমশ সে বীজ ভাসিয়ে দিল, পাখি উড়িয়ে দিল। মহাপ্রলয় থেকে এই হলো উতনপিশতমের অমর মূর্ধায়  প্রস্থান।

কবির মূর্ধায় বা চৈত
ন্যপুরীতে ঠিক এমনই এক চৈতন্যরূপ হংসী সাঁতার  কাটছে। শেখাচ্ছে হৃদ্যসমুদ্রের গভীর স্বভাব। এ সাঁতার কোনো প্রতারণাময় সাঁতার নয়, ডানা ঝেড়ে গভীর স্বভাবে নয়, এখানে রূপ রস গন্ধের জগতে কোনো তাপ হয় না, কেবল ব্যাপ্তির বোধে বিশেষিত হয় ভেতরের  বিসর্গ। কবিতার শরীরের ভেতর আসলে কোনো আমন্ত্রণ নেই বরং কবির আছে মানবজমিন ছেড়ে এক অন্তহীন লাফ দেওয়ার খিদে। কবির আছে আত্মসমীক্ষণ। দৃশ্যমান থেকে প্রকৃত পরিদৃশ্যমানে যাওয়ার আকুতি। চৈতন্য দ্যুতির বাইরে অচৈতন্য কুঁড়ে ঘরে থাকার দৃশ্য; যিনি পারলেন তাকে উড়ুক ফুড়ুক বুলবুলিরা ডেকে গেল উতনপিশতম নামে; আর বাকিরা সেই সংশয়দীর্ণ গিলগামিশ, যাদের কাছে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে অমরতার বয়াটি, ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে যাচ্ছে- জল একটা আছে, ভেসে যাওয়া একটা আছে...

আমার কবিতা কোথা থেকে আসে? আমার স্মৃতি থেকে সম্ভোগ থেকে। নির্সগের আলোয় যে নীড়, সেখান থেকেই তো ধরা হচ্ছে খালি ভরা  হচ্ছে  খালি তোমার কবিতা কোথা থেকে আসে? তোমার সুষুন্মাশীর্ষ থেকে, শূন্যে ভাসা শ্লেট যেখানে জন্মশৃঙ্খলা ধরে রয়েছে, ধরে রয়েছে জীবন ও জগতের গাঢ় ও গ্রহতা। কিন্তু দেখ তবু সখ্যের, স্বরূপের খোঁজে ব্যথার পোড়োবাড়িতে কখন ঢুকে পড়ছে অনন্ত বৈতালিকের দল। মাঠেঘাটে নেচে গেয়ে বেড়ানো অমার্জিত বাউলের সবুজ শ্বাসযন্ত্রে উঠে পড়ছে মার্গের সহজ সুস্থতা। চিন্তার অলিতে গলিতেই চিন্তার অহেতুকতা, চিন্তার আচ্ছন্নতা খেয়ে রয়েছে আমাকে তোমাকে। আমিসত্ত্বার সাথে বন্ধুত্ব তবে কি নেই? নাকি আমিত্ত্বাকে মন প্রাণ বাক চক্ষু   ও শ্রোত্রের থেকে আরও এক অধিক সংকেতে ধরা! কবির চেতনা হচ্ছে কবির শরীরেরই পরিবর্তিত রূপ, যেখান থেকে সে শুধু শরীরের জন্য আর বাঁচতে চায় না, পায়ের তলায় সে আর টের পায় না ফেলে আসা পুরনো পথের ছবি বরং এক নতুন পিকচার গ্যালারী বন্ধু হয়ে দাঁড়ায় দ্বিতীয় আত্মা নিয়ে। না, একাকীত্বমোচন হয়তো না বরং একা হয়ে যাওয়ার খেলাই হয়ে ওঠে পথের তাড়না, একটি থাকার কৃপণতা থেকে একটি ফেরার কৌতুকী রঙের তাড়না। আসলে কবি যখন দীর্ঘপথ শব্দের সাইকেলে ঘোরেন, অক্ষরের ক্লেশ অগ্রাহ্য করে তার পেছন পেছন ঘোরে অতিদূর বলে কিছু, এক দূরহ পদার্থ, শীতের বাগান থেকে জ্যোৎস্নাময় প্রাকৃত জীবনপথ। এই অতিদূর কি সেই পথ, যেখানে লেগে  রয়েছে ‘পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষের’ মতো অন্ধ আকুতি! কে জানে! পা নামের দুজন প্রহরী ধরে কবি যে বারবার ফিরছেন মরুপারের অলীক মরীচিকা ধরতে, মার্গ থেকে মার্গান্তরের মার্কিং করতে সে কি তার প্রাণ! প্রাণদন্ড! নাকি নাইকুন্ডলে জড়িয়ে থাকা পারলৌকিক পিয়াস! কীভাবে   প্লাবিত হবে সে এই ক্ষরণ টরণ ছাড়া এক ফাঁকায়? উপনিষদের সেই ‘আবৃত্ত-চক্ষু’, যা আমাদের ঘুমের মাঝে ঘুমটুকু শুধু নয়, ঘুমের জাগ্রতটুকু ধরে থাকে, তা কেবল শুকিয়ে যাওয়া টবের সামনে বসে শূন্যের যোগস্থ দেখার মধ্যেই যে  সম্পূর্ণ হয়ে রয়েছে তা কিন্তু নয়, বরং একটি মফঃস্বলী বট কিংবা একটি  হিড়িকবাজ বদ্রিকার মাঝেও তা পাওয়া সম্ভব। পাওয়া সম্ভব নখ কাটতে কাটতে ভুলে যাওয়া, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ভুলে যাওয়া কোনো এক সূর্যাস্ত  কলোনিতে অথবা জারী শারী বারোমাসী এমনই সব সূক্ষ্ম পাতলা ও হালকা শব্দকলোরলে।

আসলে কবির অন্তর্ধারণালো হৃদ্যে, ভ্রুমধ্যে, মেরুদণ্ডে চিত্তকে ধার করার ধারণা, যা থেকে সূক্ষ্ম কথাটা তার বাহ্যিক শাস্ত্রকে তামাদি করে দিতে পারে। এই সূক্ষ্মতার কোনো আবহাওয়াতত্ত্ব নেই। তাত্ত্বিক নিরাপত্তার থেকেও বৌদ্ধিক নিশ্চিন্ততাই তাকে ইন্দ্রিয় থেকে ঐন্দ্রিকের দিকে, আকাশ থেকে চিদাকাশের দিকে, স্পিরিট থেকে স্পেসের দিকে টেনে নিতে পারে। প্রথম পর্বে ঈশ্বরে আকুল ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ, গীতাঞ্জলির স্তর থেকে তাঁর ঈশ্বরে ফিরে যাওয়ার প্রয়াস, যদিও উপনিষেদীয় নৈবেদ্যে আমূল সাজানো রবিরচনা। ‘ইদং সর্বং’এ ব্যাপিত হওয়াই ছিল তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু সত্যিই কি উত্তর সংকেতে যাওয়ার এই একমাত্র পথ? তবে কেন তিনি অবিশ্বাস্য শিশিরের দিকে উন্মুক্ত হলেও সংশয়   আর বিশ্বাসের দোলা থেকে গড়িয়ে যেতে পারেন না বিপক্ষহীন! কেন তাঁকে আলোর দিকে তাকিয়েও আঁকড়ে ধরতে হয় স্নেহ-মানবের হৃদয়, কেন তাঁকে   নিঠুর জড়স্রোতে ঠায় বসে থাকতে হয় মহাআশা নিয়ে! দূর ব্যবধানের মাঝেও নিকট কেন তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় -“অন্ধকারহীন হয়ে গেল অন্ধকার।/আমি’ বলে কেহ নাই, তবু যেন আছে”। আবার পাশাপাশি কোনো মনফকিরা, শরীয়ত মারফতের দ্বন্ধ পেরোনো কোনো দরবেশের কন্ঠে, কোনো অগোচরচোরা আউলিয়া বাউলিয়ার ডালছাড়া আদি বা আধাতে যখন ‘পান্থপাখির’ কথা ওঠে, ওঠে ‘পথক্লান্তির’ কথা, কবিও কি কবিতার আজব কারখানা ছেড়ে সাধের   বাড়ি সাধের ঘরকন্না ছেড়ে এক ছুট্টে বেরিয়ে আসেন না! পরে থাকে তাঁর বাক শ্রুতি আর সংরক্ষণের স্ফোটন। কবিতার কালো মাংস অথবা কবিতার গুশব্দ সব কিছুকেই পানাপুকুরের অধিকারে দিয়ে ওষধি বনস্পতি দিয়ে কবির বার্তা তখন কেবল একটি অভিসারের। একটি কেবল একটিই মাত্র অভিসারের। নিরভিমান অভিসারের। শব্দের সুখময় স্বরূপের সাথে সুখময় সত্ত্বগুণের সাথে   তিনি এবার স্বজাতীয়। গন্ধযুক্ত ঘ্রা এবং রূপযুক্ত চক্ষু থেকে বেরিয়ে এবার  তিনি বোধযুক্ত তৈজসে হাত রাখতে পারেন। এখান থেকে শুনতে পারেন কেবল একটি সুস্থ হৃদির শব্দ। শোনা যায় একটিই সাধননির্দেশ -

“আমার মন পাখি বিবাগী হয়ে ঘুরে মরো না
ভবে আসা যাওয়া যে যন্ত্রণা, জেনেও কি তা জান না।
দেহে আট কুঠরী, রিপু ছয় জনা,
মনে থেকো থেকো, হুসিয়ার থেকো, যেন মায়ায় ভুলো না।
কোন দিন হাওয়ারূপে প্রবেশিয়া লুটবেরে ষোল আনা”।



(কবিতা ঋণ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বদেশ সেন, বারীন ঘোষাল, লালনগীতি)