যেতে যেতে গান গাইব তাই...
I WILL arise and go now, and go to Innisfree,
And a small cabin build there, of clay and wattles made:
Nine bean-rows will I have there, a hive for the honeybee,
And live alone in the bee-loud glade.
W.B.Yeats
(মঞ্চের পর্দাটি ধীরে
ধীরে উপরে উঠে যেতেই দেখা গেল তিনজন নারী-পুরুষ উপবিষ্ট। আবলুস কাঠের চেয়ারে
হেলান দিয়ে নিমগ্ন হয়ে কথা বলছে। চারদিকে পিনপতন
নিস্তব্ধতা, খুব নরম একটা আলো শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদেরকে
ঘিরে। আর শোনা যাচ্ছে তাদের গলার তীক্ষ আওয়াজ। দুজন পুরুষের মধ্যে
একজনের বয়স মধ্য তিরিশ পেরিয়ে গেছে, অন্যজন প্রৌঢ় আর
শ্যামাঙ্গী তরুণীটির চোখে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি ছড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে দীর্ঘদিন
ধরে একটা তর্ক চলছে। দিন যত গড়িয়ে যাচ্ছে, তর্কটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আমাদের মানে
দর্শকদের উপায় নেই সেই তর্কে সামিল না হয়ে। দু-কান তুলো দিয়ে ভর্তি
করেও এই তর্কের শব্দাবলী হতে খুব বেশি দূরে যেতে পারা যায় না, চোখ দুটোকে পর্দা
দিয়ে ঢেকে রেখেও দুঃস্বপ্ন দেখে আর্তনাদ করে জেগে উঠতে হয় রাতের পর রাত। একাকী ঘরে বা জনবহুল
রাস্তায় সর্বত্র তাদের গুঞ্জনধ্বনি কানে এসে আছড়ে পড়ছে। কফিশপের ঠাণ্ডাঘরে
ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ে কামড় বসানোর সময়েও কানে এসে দোলা দিচ্ছে তাদের বাক্যালাপ। মঞ্চের পর্দাটা একটু
একটু করে দুলে উঠছে, আলো জ্বলছে, নিভছে। সামনে এসে দাঁড়াল
চরিত্রত্রয়।)
যুবক – তোমাদের কাছে জানতে
পারি কি, আমাদের মধ্যে আর কতদিন এরকম তর্কটা চলবে? ঠিক কতদিন?
প্রৌঢ় – সেটা নির্ভর করছে
তোমাদের দুজনের উপরে অর্থাৎ তোমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া-না চাওয়ার উপর। তোমরা যদি মনে কর, শকেট চড়ে চলে যাবে
এই অঞ্চলের শেষ
প্রান্তে, যেখানে নাফ নদীর
স্বচ্ছ জল পা ধুইয়ে দেবে, তখনও হয়তো তর্ক চলবে। নিয়ম মতো মঞ্চের
পর্দা উঠবে, নামবে, কিন্তু সেইখানে দৃশ্য যাবে
বদলে। হয়তো কোনো রোহিঙ্গা নারীর চুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসবে নাকে। আর আমিও সেখানে থাকব না।
নারী – আমার সেরকম মনে হয় না। দুনিয়ার যে
প্রান্তেই আমরা আস্তানা গাড়ি না কেন, তোমার শ্যেনদৃষ্টি হতে রক্ষা
পাব না। তুমি অদৃষ্টের মতো। অদৃষ্টকে হারালে যেমন দু’চোখে অন্ধকার নেমে
আসে, তেমন নিকষ অন্ধকারের ভয়ে তোমাকে ছেড়ে আমরা যেতে পারি না, যেমন যেতে পারি না হাওয়াকে
ছেড়ে।
যুবক – তুমি মাঝে মাঝে এতো দার্শনিকের মতো কথা বলো যে
পুরোপুরি বিশ্বাস হয়ে যায়, কিন্তু আমি জানি যে
প্রত্যেক দার্শনিকের কথাই শুনতে এরকম খাঁটি মনে হয়। আসলে আমাদের যেমন হাওয়াকে দরকার, তারও তো আমাদেরকে
প্রয়োজন আধার করে বেঁচে
থাকার জন্য। কিন্তু সে বাতাস যদি সীসায় পূর্ণ হয়ে জীবন হরণকারী রূপে দেখা
দেয়, তাকে বদলে দেওয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় থাকে না!
প্রৌঢ় – নতুন যে হাওয়ার কথা
বলছ, তারও কি সম্ভাবনা থাকে না দূষিত হওয়ার? আর আকাশের সর্বত্রটাই কি আমরা বিষাক্ত হাওয়া
দিয়ে পূর্ণ করে তুলিনি?
যুবক – আকাশের সর্বত্র? তা বলতে কী বোঝাতে চাইছেন? আকাশের ছাদ কি আপনার মাথায়
এসে ঠেকেছে?
প্রৌঢ় – বাস্তবিক তা হয়তো
ঠেকেনি, কিন্তু আমরা তো হাজার হাজার বছর ধরে আকাশটাকে আমাদের ছাদ
ভেবে এসেছি। ছাদের ভাবনা তো নীল আচ্ছাদন হতেই এলো। শূন্য যে দৃশ্যপট, তাকেও তো আমরা একটা
আকার রূপে দেখছি।
নারী – এই চেনাজানা আকাশের নিচে আমার দম বন্ধ হয়ে
আসে। মনে হয় নীল কাচের ঘের দেওয়া আচ্ছাদনটাকে ভেঙে
ফেলি হাতের আঘাতে।
যুবক – তোমার মনে যে এই
ইচ্ছা জেগেছে,
এতেই তো ভেঙে গেছে
কাচের ত্রিশিরা। তার কি আর কোনো অস্তিত্ব আছে?
নারী – কিন্তু এই
আচ্ছাদনহীন, বর্মহীন চিত্রটা মনে কেমন
শঙ্কা জাগায়। বহুশত বছরের তাঁতে বোনা পোশাকটি
পাল্টে আজ কোন্ কাপড় দিয়ে নিজেকে আবৃত করব? সবই যে চকচক করছে, জহুরির মতো তীক্ষ্ণ চোখ তো আমার নেই!
যুবক – জহুরির চোখের তীক্ষ্ণতা তোমার না থাকুক
মনের মধ্যে ঘূর্ণি হাওয়া তো রয়েছে! সেই উদ্বেলিত হাওয়াই
তো তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তোমার কি ইচ্ছে করে না, পা থেকে শেকল খুলে
ফেলতে?
নারী – আমার তো সর্বক্ষণ
ইচ্ছে করে সাইরেনের ভোঁ শব্দ মাথা থেকে তাড়িয়ে নিয়ে নিবিড় কোনো ধ্বনি শুনতে।
প্রৌঢ় – তুমি কি পারবে মাথা
থেকে স্মৃতি খুলে ফেলতে?
নারী – কী জানি! আমি শুধু জানি যে, ক্রমাগত সুঁইয়ে সুতো
পড়াতে পড়াতে একদিন আমার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে, খসে পড়বে আঙুলের নরম চামড়া। কারখানার চিমনির
ধোঁয়াতে শ্বাস নিতে নিতে আমার ফুসফুস অকেজো হয়ে গেছে। আহ্! চিরদিনের মতো কোনো
দূর শহরে যদি চলে যেতে পারতাম!
প্রৌঢ় – ধোঁয়াহীন কোন্ শহরে তুমি যেতে চাও? ধোঁয়াহীন শহর, তার অস্তিত্ব, তার খোঁজ জানা আছে তোমার?
নারী – যত যত শহরের কথা আমি
জানি, সেখানে সর্বত্রই তো ধোঁয়ার গন্ধ। কোথাও কার্বনের পোড়া
গন্ধ, কোথাও মড়কলাগা দুর্গন্ধ।
যুবক – এ তো তোমার অজ্ঞতা। ধোঁয়ায় পূর্ণ ফুসফুস
নিয়ে তুমি তো রুগ্ন হয়ে পড়েছ। এইসব পচা জঞ্জালময় দুনিয়ার ঐপারে সিন্ধুঘোটকের
যে দেশ রয়েছে, তার কথা তো তোমার জানা নেই।
নারী – যা জানি না, যে শহরের নাম কখনো শুনিনি, যে দেশের অস্তিত্ব পৃথিবীর
মানচিত্রে নেই, তার অস্তিত্ব কল্পনা করব কীভাবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, দেওয়াল ঘেরা এই ধূসর শহরটি আমাকে যত বঞ্চনাই করুক, দেওয়ালের ঐপারে হয়তো
আরও বিষাক্ত কোনো
ধোঁয়ার কুণ্ডুলি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তখন তো এই কথাটি বলবার অবকাশটুকুও পাব না।
প্রৌঢ় – তুমি খুব খাঁটি কথা
বলেছ। আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনে যত যুদ্ধ ঘটেছে, তার ফলে রক্তক্ষয়ই
বেশি হয়েছে। তাদের বিজয় স্তম্ভের নিচে শুয়ে আছে
অগণিত সেনেকা। সকলে স্বচ্ছ জলটুকুই পান করতে চায়, কিন্তু তার সন্ধান না
জানলে পরিত্যক্ত কুয়ার জলে
মুখ না ডুবিয়ে তো কোনো উপায় নেই। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জলের খোঁজে পাহাড় থেকে পা
হড়কে পড়ার মতো বোকামি আর নেই। এটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরঞ্চ ভেবে দেখ, কীভাবে এই দূষিত
জলকে পেয় করে তোলা যায়?
যুবক – এসব কথা সব কালেই
শোনা যায়। এখন আর নতুন কী? বিষ ছেঁকে তাকে পরিশ্রুত
করে যে পানীয় এতদিন খেয়ে এসেছ, তারই গুণাগুণ প্রকাশ
পাচ্ছে তোমাদের কথায়। নুন খেয়ে তার
গুণটুকু তোমরা গাইতে ভোলনি, কিন্তু এমন অর্বাচীনের মতো দেওয়াল ঘেরা ঘরে
বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফুসফুসকে ভর্তি করে বিষপানের জন্য অপেক্ষা করার চাইতে তো খাদের নিচে তলিয়ে যাওয়াও ভালো। সেই বীরগাথা শুনে নবীন কোনো যুবক হয়তো সাহস করে পৌঁছে যাবে
নীল জলের দেশে বা অন্তত অন্য কোনো বিষে আক্রান্ত হয়ে তার
মৃত্যু হোক, তাও ভালো।
নারী – তোমার মনে কী কোনো
শঙ্কা নেই?
যুবক – কেন থাকবে না? সেজন্যই তো এই জাল কেটে বের
হয়ে যেতে চাই। মীন জাতকের মতো সাঁতরে চলে যেতে চাই
সিন্ধুঘোটকের দেশে।
প্রৌঢ় – আমার মন বলছে
তোমাদের তারুণ্য, তোমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, পরিবর্তন স্পৃহা হয়তো শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে জলে ডুবিয়ে মারবে। খরস্রোতা পাহাড়ি
নদীতে হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। এখানে টিকে থাকতে হলে শুধুমাত্র বাতিল করতে
জানলেই চলে না, বরঞ্চ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সময় কীভাবে বয়ে চলেছে
সে খোঁজও রাখতে হয়।
যুবক – আপনাদের মধ্যে
অনেকেই বা অনেকে কেন, প্রত্যেকেই হয়তো ভাবছেন হাজার বছরের পুরনো নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে
ধ্বংস হয়ে যাওয়া। কিন্তু একথা কি আপনাদের জানা নেই যে, বহু লক্ষ
দ্বন্দ্বের ফলেই তৈরি হয়েছে মৃত্তিকা, তার সংস্কৃতি এবং আমরা টিকে আছি? আজ যাকে ভাবছেন
বেঁচে থাকার সূত্র, সেখানেই যে বুমেরাং হয়ে
আছে ধ্বংসের বীজ!
নারী – মানুষ কি এই বিপুল
সময় ধরে তার মৃত্যু ফাঁদই তৈরি করেছে শুধু?
যুবক – সে যেমন মৃত্যু ফাঁদ
তৈরি করেছে, তেমনি জীবনের ইঙ্গিতও দেখিয়েছে। এখন আমাদেরকে পথ বেছে নিতে হবে। সে সিদ্ধান্ত
সম্পূর্ণ আমাদের।
প্রৌঢ় – এত সোজাসাপ্টা নিয়মে
এই জটিল অঙ্ক করা যাবে না। তাহলে দেখবে ফলাফল ভগ্নাংশে চলে এসেছে।
যুবক – আমরা সেই নতুন ফলাফলের জন্য অপেক্ষমাণ। আর নিয়মের কথা বলছেন? এই নিয়মও নতুন নয়। আদি মানুষের মনের
মধ্যেও তা দেখতে পাওয়া যায়। গুহাচিত্র সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নারী – সবার জন্য কি এক
নিয়ম খাটে? আমরা সবাই তো একরকম
খাবার খেতে পছন্দ করি না।
প্রৌঢ় – সবার মুখে এক খাবার
তুলে দেবার কথা ভাবা অবান্তর, আর তা অসম্ভব। এটা নির্বোধের
মস্তিষ্ক হতে সৃষ্ট।
যুবক – সবার মুখে এক খাবার
তুলে দেবার প্রশ্ন আসে না। সেরকম কথা আমরা ভাবিনি। এরকমটা ভেবেছিল
আমাদের পূর্বপুরুষগণ। তাদের চিন্তার খেসারত তারা দিয়েছে। আমরা তেমন ভাবিনি, ঢালাও কোনো পরিবর্তনের
চিন্তা আমরা করিনি, আর শুধুমাত্র স্বাদ বদলের তাড়নাও এখানে মুখ্য নয়, বরঞ্চ চিমনির
ধোঁয়ায় যখন আমাদের ফুসফুস দূষিত
হয়ে পড়েছে এবং তখনও আমাদেরকে খেতে হয়েছে রেশনের পোকা ধরা চালের সাথে পোড়া আলু, শতচ্ছিন্ন পোশাকটি রঙিন
কাগজ দিয়ে মুড়ে রাখতে হয়েছে তোরঙ্গে আর সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে ঘুমোতে হয়েছে মাইনপোঁতা বিছানাতে। আর এই হচ্ছে যখন অবস্থা, বহু হাজার বছর ধরে
লড়াইয়ের পর এমনতরো নিরুপদ্রব
জীবন যখন আমরা পেয়েছি, তখন আর কীই বা করার আছে? ঐসব গালভরা কথার পেছনে দৌড়ে
আমাদের আর কী উপকার হবে? আজ আমাদের চোখগুলি কি সত্যিই ধোঁয়ায় অন্ধ হয়ে গেছে, আর যন্ত্রের
প্রচণ্ড শব্দে কান হয়ে গেছে বধির? জিহ্বার স্বাদ নেবার
ক্ষমতাও কি আমরা হারিয়েছি, আর হাত দুটোকে ব্যবহার করতে, তাও কি ভুলে গেছি? আর যদি ভুলে গিয়েও থাকি, সেটাও তোমাদের
নিষ্পেষণে জেনো। তোমাদের লোভের খেসারত দিতে গিয়ে এতকাল শুধু ক্ষতিগ্রস্থই হয়েছি। আর এখন শুধু একটাই
গান মনে আসে -
সোনালি রোদ্দুরে হেঁটে বেড়ানোর গান
আমাদের পায়ের নিচে মরা শ্যাওলার দল, গলায় সুরেলা গান
মঞ্চের পর্দাটা একটু একটু দুলছে
উঠছে
নামছে
সোনালি রোদ্দুরে হেঁটে বেড়াবার শব্দ শোনা যাচ্ছে
খুটখুট শব্দ বেজে চলেছে, অন্তহীন
ভোরগুলো নতুন নতুন শব্দ নিয়ে হাজির হয়েছে
চোখেরা হাসছে, আলো ঝলমল করছে
মঞ্চের পর্দাটা একটু একটু দুলছে।
নামছে।
উঠছে।
নামছে...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন