কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ৯৫


 

পাশাপাশি দুই বাংলায়, ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে, দুটি ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে, বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি প্রবাহে যে ঢল নামে, তাকে আমরা বিশেষিত করতে পারি বাংলাসাহিত্য উৎসব নামেও। বস্তুতপক্ষে হিন্দু বাঙালি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপুজো এবং মুসলমান বাঙালি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব ঈদকে উপলক্ষ্য করে বাঙালি জনমানসে,  ধর্মীয় যাবতীয় রীতি-নীতি, প্রথা-বিশ্বাস ও সংস্কার তথা ঐতিহ্যকে যথাযথ বজায় রেখেও, এক স্বতন্ত্র চিন্তা-ভাবনা এবং সম্প্রীতির চেতনার সম্প্রসারণ ঘটে, যা সবাইকে বৃহত্তর মনুষ্যত্বের আলোকে উজ্জ্বল করে তোলে। আর মানুষ যখন  তার ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ পরিধিকে অতিক্রম করতে পারে, তখনই তার সৃজনশীলতাও এক ভিন্ন রূপ ও মাত্রা অর্জন করে। মানুষ স্বভাবতই সংস্কৃতি ও শিল্পপ্রেমী। জীবন সৃষ্ট হওয়ার পর যখন থেকে সভ্যতার আলো প্রবেশ করেছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে তার সংস্কৃতিচর্চা ও শিল্পচর্চা। মানুষের সেই আদিম জীবনের সেইসব চর্চার অনেক নমুনাই আমরা আবিষ্কার করেছি ইতিমধ্যেই। তারপর ভাব বিনিময়ের সুবিধার জন্য যখন তারা ভাষা ব্যবহার শুরু করেছে, তখন থেকে সাহিত্য রচনার সূত্রপাত ঘটেছে। এবং এভাবেই ক্রমশ বিকশিত হয়েছে বিশ্বে বসবাসকারী মানুষের ব্যবহৃত অগণিত ভাষায় রচিত সাহিত্যসম্ভার। বাংলা সাহিত্যও তার ভাষা সৃষ্টির সময় থেকে ক্রম বিকশিত হয়ে আজ বিশ্বের দরবারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে।

অবশ্য ইদানীং বাংলাসাহিত্য উৎসব যে শুধুমাত্র এই দুটি ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, তা নয়। বরং ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে যে বিশাল বইমেলা আয়োজিত হয় প্রতি বছর, তাও বাংলাসাহিত্যের আরও বড় এক উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় যে আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন হয়, তাতে স্বাভাবিক কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সম্মিলিত হলেও মূলত বাংলাসাহিত্যই প্রাধান্য পায়। আবার মহান ভাষাশহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারীকে স্মরণ করে বাংলাদেশে ঢাকায় যে একমাসব্যপী বইমেলার আয়োজন করা হয়, তা বাংলাভাষা সাহিত্যেরই মেলা বা উৎসব।

কোনো কিছু একটা উপলক্ষ্য করে মেলায় মানুষ মিলিত হয়। উৎসবে মানুষ সম্মিলিত হয়। প্রতিদিনের সাংসারিক, পারিবারিক, সামাজিক সব রকমের একঘেয়েমি, ক্লান্তি, হতাশা, ক্ষুদ্রতা, নীচতা, অসহায়তাকে দূরে সরিয়ে রেখে তাদের এই মিলন। এবং এই মিলনের ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন বিনিময় হয় মনের ভাবনা, অন্যদিকে তেমনি বিনিময় ঘটে শিল্প ও সংস্কৃতির।

বিগত দু’বছর ধরে মহামারীর কারণে আমরা অবশ্য বঞ্চিত হয়েছি এই মিলনমেলায় অংশগ্রহণ করতে। কোনো উৎসবেই আগের মতো সমবেত হতে পারিনি। কিন্তু শারীরিকভাবে সম্ভব না হলেও আমরা মানসিকভাবে সবাই সেইসব উৎসবে সমবেত হয়েছি। যে মেলা বা উৎসব আয়োজন করা সম্ভব হয়নি পরিস্থিতির কারণে, আমরা স্মৃতিচারণায় সেই স্বাদও আস্বাদন করেছি।

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের উৎসব সংখ্যা প্রকাশিত হলো শারদ উৎসবের দিনগুলি অতিক্রম করে। যদিও উৎসবের রেশ থেকেই যায় সবার মনে। আর শারদ শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা তো জানানোই যেতে পারে শরৎকালের অব্যবহিত পরেও।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৩




 

আজ আমরা ফিরে দেখব ইতালির সিনেমা। যে দেশে সবথেকে বেশিবারের জন্য বিদেশী সিনেমা বিভাগে অস্কার পুরষ্কার গেছে। মোট ১৪ বার। স্বাভাবিকভাবেই, ইতালির সিনেমা নিয়ে মানুষের আগ্রহ খুব বেশি। আমি এই দেশের যা যা ছবি দেখেছি, আজ তার ভেতর আমার মত করে কিছু সিনেমা প্রথমে বেছে নেব।

রোসেলিনির ‘রোম, ওপেন সিটি’ (১৯৪৫) ও ‘জার্নি টু ইতালি’ (১৯৫৪), ডি-সিকার ‘শু-শাইন’ (১৯৪৬) এবং ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ (১৯৪৯), ফেলিনির ‘লা ডোলচে ভিটা’ (১৯৬০) ও ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ (১৯৬৩), অ্যান্তনিয়নির ‘রেড ডেসার্ট’ (১৯৬৪) এবং ‘লা ভেঞ্চুরা’ (১৯৬৫), বার্তোলুচির ‘দ্য কনফর্মিস্ট’  (১৯৭০), র‍্যাডফোর্ডের ‘ইল পোস্টিনো’ (১৯৯৪), বেনিনির ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ (১৯৯৭) এবং সোরেন্টিনোর ‘দ্য গ্রেট বিউটি’ (২০১৩)। আমার মনে  হয় এগুলো দেখলে ইতালির সিনেমা নিয়ে বেশ খানিকটা ধারণা মাথায় ঢুকে যাবে।

এই ১২টা একদিনে আলোচনা করা যাবে না। তাছাড়া আমি এর ভেতর একটা ইতিমধ্যেই আলোচনা করে ফেলেছি, ভবিষ্যতেও আরো কয়েকটা করব। অতএব আজ মাত্র চারখানা ছবির কথা বিশদে বলব - রোম ওপেন সিটি, লা ডোলচে ভিটা, রেড ডেসার্ট ও দ্য কনফর্মিস্ট। আশাকরি আমার পাঠকরা, যারা আমার এই লেখা থেকে উৎসাহ পেয়ে বিভিন্ন দেশের সিনেমা দেখতে শুরু করেছেন, বুঝতে পারবেন আমার এই চারখানা সিনেমা বেছে নেবার কারণ কী হতে পারে।

ইতালির সিনেমায় স্বর্ণযুগ বললেই নব্য-বাস্তবতার কথা উঠতে বাধ্য। এবং লক্ষ্য করুন, আমার বাছাই করা শুরুর দিকের ছবিগুলোও সেই সময় ধরেই উঠে এসেছে। এই নব্য-বাস্তবতা (যা এর আগে ফ্রেঞ্চ সিনেমা ‘হিরোশিমা মাই লাভ’  নিয়ে বলতে গিয়ে খানিক আলোচনা করেছি) ইউরোপে এসেছিল ইতালির হাত ধরেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালিতে মুসোলিনির পরাজয় সমাজে অনেক পরিবর্তন আনে, যার প্রধান ছিল শিল্প ও সংস্কৃতিতে কাব্যিক বাস্তবতা, মার্ক্সিস্ট প্রভাব এবং খেটে খাওয়া মানুষের আদর্শ ও জীবনকথা প্রকট হয়ে ওঠা। ইতালির সিনেমা সেই দিক তুলে ধরতে শুরু করার পর ইউরোপের অন্যান্য দেশেও তা ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে অন্যান্য মহাদেশেও। আর এখানেই আমি ইতালির সিনেমাকে ফুল মার্কস দেব। কারণ একটা আন্দোলন যে সিনেমার মাধ্যমে  এভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা ইতালি দেখিয়েছিল। সেজন্য আজ আমার প্রথম বাছাই ‘রোম, ওপেন সিটি’।  

মুসোলিনির ফাঁসি হয়েছিল ১৯৪৫-এ। আর রবার্তো রোসেলিনির ‘রোম, ওপেন সিটি’ সেই বছরেই রিলিজ হয়ে প্রচলিত ধারণায় এমনভাবে নব্য-বাস্তবতার ধাক্কা মেরেছিল যে ১৯৪৬-এ এই সিনেমাকে কান ফিল্ম ফেস্টিভালের মাধ্যমে পৃথিবী জোড়া স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অস্কার-এর জন্যও এই ছবিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। মূলত এই সিনেমাই গোটা পৃথিবীতে নব্য-বাস্তবতার ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছিল।

১৯৪৩ সালের ১৪ অগস্ট রোম ‘মুক্ত শহর’ হিসেবে ঘোষিত হয়। যে কারণে  বিদ্রুপবশত এই সিনেমার নাম ‘রোম ওপেন সিটি’। গল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  পটভূমিকায়। ১৯৪৪ সাল। মুক্ত শহর হলেও রোম যখন ফ্যাসিজম আর জার্মানির নাজি দিয়ে অবরুদ্ধ। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে এই সিনেমা। যার পুরোভাগে এক ইঞ্জিনীয়ার এবং এক ক্যাথলিক ধর্মযাজক। মাঝে কিছু টুকরো রোমান্টিক চরিত্রায়ন। এক সাধারণ গল্প।  মুক্তিযুদ্ধের চোয়াল চাপা সাহস। এবং সেই থেকে এই ছবির লিজেন্ড হয়ে ওঠা।

পৌনে দু’ঘন্টার এই সিনেমা থেকে প্রাপ্তি বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ছবির  পরিচালনা ও দৃশ্যায়নের কথা। তারপর সিটে বসিয়ে রাখার মত কিছু অভিনয়, যার প্রথম নাম অবশ্যই সেই ক্যাথলিক ধর্মযাজক হিসেবে আল্ডো ফ্যাব্রিজি এবং নিজের মৃত্যুর দিকে অকুতোভয় দৌড়ে যাওয়া আনা ম্যাগনানি। ওপেন সিটি খুব কম বাজেটের ছবি যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্রায় নেই। ছবির ন্যারেটিভ অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব ঘটনা থেকে নেওয়া, এবং পেশাদার অভিনেতা ওপরের দুজন ছাড়া প্রায় নেই। অথচ এতকিছু খামতি থাকার পরেও এই সিনেমা শুধুমাত্র নব্য-বাস্তব নাটকীয়তার জন্য ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চূড়ান্ত সফল।

কীভাবে ওপেন সিটি লিজেন্ড হয়ে উঠল? প্রধান কারণ অপেশাদার চরিত্রায়ন,  যারা মাটি থেকে উঠে এসে ছবি জুড়ে মাটির গন্ধ আর সাহস বয়ে বেড়িয়েছে। এবং এই সিনেমা মেলোড্রামা নয়, যুদ্ধের নৃশংসতার এক উপাখ্যান হয়ে উঠেছে। যে দৃশ্যের জন্য এই সিনেমা বিখ্যাত, তা হল গর্ভবতী পিনার ভূমিকায় আনা ম্যাগনানির দৌড়। ক্যামেরা রাখা হয়েছে চলন্ত ট্রাকে, এবং ফোকাস করা হয়েছে পেছনে দৌড়ে আসা কালো পোষাকের পিনার দিকে। তাকে গুলি করে মারার পর সে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে, সাদা পোশাক পরে তার বাচ্চা এসে তার লাশ জড়িয়ে ধরছে, আর ধর্মযাজক পিনার লাশ নিজের দিকে তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করছেন সে বেঁচে আছে কিনা। যুদ্ধের পাশবিকতা হয়ত এর থেকে ভাল আর বোঝানো যেত না। সাদা ও কালো পোষাকের কম্বিনেশন অনবদ্য। তবে হ্যাঁ, ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার একটু আপত্তি আছে ঐ চটজলদি কাটসিনগুলোয়। পিনা গুলি খেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ার পর ক্যামেরার উচিৎ ছিল আরো অন্তত দু’সেকেন্ড  সেই চলন্ত ট্রাক থেকে পিনার দিকে ফোকাস করে রাখা। আরেকটা সিন, যেখানে বাচ্চারা রোম শহরকে আবহে রেখে হেঁটে চলে যাচ্ছে, সেটাও লক্ষ্য করার মত। দেখবেন, থমাস হার্ডির কবিতা মনে পড়ে যাবে – ‘war’s annals will fade into night/ ere their story die’। হ্যাঁ, যে কথাটা না বললে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে, তা হল, এই সিনেমার স্ক্রিন-প্লে লিখেছিলেন ফেদেরিকো ফেলিনি।

ফেদেরিকো ফেলিনির ‘লা ডোলচে ভিটা’ বা ‘দ্য সুইট লাইফ’ ইতালির নব্য-বাস্তবতার পরবর্তী উদাহরণ। ওপেন সিটির পরেই একে বেছে নিলাম এক বিশেষ  কারণে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে দারিদ্র আর ধ্বংসস্তুপের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা ইতালির  মধ্যে এক বিশেষ শ্রেণী ধীরে ধীরে যে চকচকে সমাজ নিজেদের আশেপাশে গড়ে  নিচ্ছিল, এই ছবি সেই সমাজের প্রতিচ্ছবি। এক গসিপ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক মার্সেলো সাতদিন ধরে রোমের আপাত উচ্চশ্রেণীর মধ্যে সুখ আর ভালবাসা  খুঁজে চলেছে। সেই বৃথা খুঁজে বেড়ানোর ছবি ‘দ্য সুইট লাইফ’। এই ছবির প্রধান  সাত টুকরো হল রোমের রাস্তায় মার্সেলোর সাতদিন ও রাত। এবং তার আগে রোম নতুন করে বানানোর এক ভূমিকা ও সবশেষে এক উপসংহার। পুরোটাই মার্সেলোর বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে ফ্লার্ট ও যৌনতা, উচ্চশ্রেণীর মানসিক অনিশ্চয়তা  ও দায়িত্বজ্ঞানহীন দ্রুত জীবনযাত্রার প্রতি আসক্তি, এই নিয়ে। নিজের প্রেমিকার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, বাবা বুকে ব্যথা অনুভব করা সত্বেও ছেলের কাছে যেতে গররাজী, মার্সেলোর এক বিখ্যাত ফিল্ম-স্টার সিলভিয়াকে নিয়ে ট্রেভি ফাউন্টেনে রাত কাটানো – এই সমস্ত ঘটনা যুদ্ধ পরবর্তী ইতালির ভঙ্গুর সমাজের নিদর্শন, যা চাকচিক্যের পেছনে দৌড়ে চলে। এই সিনেমা ট্রাডিশনাল প্লট ভেঙে দিয়ে আলাদা টুকরোয় জোড়া মালা গেঁথে এক দৈনন্দিন বৈষম্য গড়ে তুলেছে, যে কারণে একে বিশ্বের অন্যতম সেরা ড্রামা ছবি হিসেবে ধরা হয়।   

সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন সিনেমার কাজ হল সেলুলয়েডে জীবন ফুটিয়ে তোলা। সেই থিয়োরি মেনে নিলে ‘লা ডোলচে ভিটা’ দশে দশ পাবে, কারণ এই সিনেমা  এমন একজনের জীবনকে ছুঁয়ে ঘুরে চলেছে যার না আছে দিশা, না আছে কেন্দ্র। সে বিক্ষিপ্ত গ্রহাণুর মত ঘুরে চলেছে, জানে না কোথায় সুখ পাবে। অথচ তার  জীবনের পালটে যাওয়া রোজনামচা আছে। প্রায় তিন ঘন্টার এই সিনেমা দেখে আমি বুঝেছিলাম, এই ছবি আসলে দিন ও রাতের একাকীত্বের ছবি, চড়াই ও উৎরাইয়ের ছবি, এক জায়গা থেকে শুরু করে সেখানে আর ফিরে না আসার ছবি। মোদ্দা কথায় এই ছবি বর্ণনা করতে গেলে ক্যাওস থিয়োরি জানতে হবে। শুরুর সিনটার কথাই ধরা যাক। যুদ্ধবিধ্বস্ত রোমে যিশুখ্রীষ্টের নতুন এক মূর্তি আনা হচ্ছে। হেলিকপ্টার উড়ছে, আর জেলেদের জালে এক বিশাল ক্যাটফিশ লাফাচ্ছে। একজন প্রাণহীন, আরেকজন প্রাণের প্রতিভূ। এই অক্সিমোরন চলেছে সিন থেকে সিনে। এবং বয়ে গেছে অফুরন্ত প্রা্ণশক্তি। সেই শক্তির অনুঘটক  হিসেবে কাজ করেছে ফিল্ম-স্টার সিলভিয়ার ভূমিকায় অনিতা একবার্গ ও ট্রেভি ফাউন্টেনে তার শিহরণ তোলা ভিজে চলার দৃশ্য।

এই সিনেমা মনোযোগ দিয়ে দেখার পর আমার মনে হয়েছে, আসলে সুইট লাইফ বলে কিছু হয় না। পুরোটাই এক মরীচিকা বা প্রহেলিকা। কিন্তু নিজেকে নিজের মত করে সেই সুইট লাইফ খুঁজে নিতে হয়। আর সেখানেই এই সিনেমা আর মার্সেলোর অমরত্ব। নব্য-বাস্তব ফেলিনির পরিচালনার অমরত্ব। 

মাইকেলেঞ্জেলো অ্যান্তনিয়নির ‘রেড ডেসার্ট’ ইতালির নব্য-বাস্তব ধারণার পরের উদাহরণ। যুদ্ধবিধ্বস্ত রোমে একে একে তৈরি হচ্ছে কারখানা। কারখানার শব্দ,  ধূলো-ধোঁয়া, দূষণ আর নোংরা হয়ে যাওয়া নদীগর্ভ – সেখান থেকে উঠে আসছে  নব্য-আস্তবতার আরেক সংজ্ঞা। অ্যান্তনিয়নির ‘লা ভেঞ্চুরা’ র থেকে আমি ‘রেড ডেসার্ট’-কে বেশ খানিকটা এগিয়ে রাখব শুধুমাত্র থিম আর রংয়ের ব্যবহারের  জন্য।

এ ছবির গল্প ফেলিনির ভিটা-য় উচ্চশ্রেণীর মানসিক অনিশ্চয়তার পরের ধাপ।  এক কারখানা মালিকের স্ত্রী, যে মানসিকভাবে অস্থির এবং নিজের জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না, তাকে নিয়ে। সেই কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে তার রোমান্স নিয়ে। আর অবশ্যই এর পাশাপাশি নিম্নবিত্ত শ্রমিকদের জীবনযাত্রার দুর্দশা নিয়ে। যেখান থেকে ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ শ্রমিকদের চাকরির হাহাকার  দিয়ে শুরু করছে, ‘রেড ডেসার্ট’ সেখানে থেকে কয়েক পা এগিয়ে কারখানার  জন্য শ্রমিক আর প্রকৃতির দূষিত হয়ে যাওয়া ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছে।

আমি কিন্তু এই সিনেমাকে শিল্পায়ন বা দূষণ দেখানোর জন্য বাছিনি। আমার  চোখে এই সিনেমা সেলুলয়েডে এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে প্রতি পাতায় কাব্যিক বাস্তবতা। নব্য-বাস্তব সিনেমার অন্যতম প্রধান চিহ্ন। শিল্পায়ন কীভাবে প্রকৃতিকে নষ্ট করছে, তা দেখানোর জন্য অ্যান্তনিয়নি এই সিনেমা বানাননি। উনি কল কারখানার ভেতর দিয়ে গদ্যময় পৃথিবী কীভাবে দর্শকের চোখে পদ্যময় করে তোলা যায়, সেই চেষ্টা করেছেন। উনি বলেছেন ‘my intention was to  translate the poetry of the world, in which even factories can be beautiful. The line and curves of factories and their chimneys can be more beautiful than the outline of trees, which we are already too accustomed to seeing’। অদ্ভুত, তাই না! আরো বলেছেন যে উনি এই সিনেমায় রং ও ক্যানভাসের সম্পর্ক আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, সেইমত প্রতি সিন উঠে এসেছে। অর্থাৎ মোটিফ রইল কারখানার দূষণ ও শ্রমিকদের  অপরিচ্ছন্ন জীবন, কিন্তু আসলে ফুটে উঠল পেইন্টিং-এর এক গোটা ক্যানভাস – এক কবিতা। সিনেমার শেষ সিন ভালভাবে লক্ষ্য করুন। মা আর ছেলের কথোপকথন। হু হু করে বিষাক্ত হলুদ ধোঁয়া বেরচ্ছে। ছেলে জিজ্ঞেস করছে, এই ধোঁয়ায় পাখিরা কি মারা যাবে? মা বলছে, না, পাখিরা জানে কোথা দিয়ে উড়তে নেই। কবিতা আর জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। হয়ত আমার কথায় বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু আমার মতে এই সিনেমা অ্যান্তনিয়নির সেরা ছবি।   

অ্যালবার্তো মোরাভিয়ার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য কনফর্মিস্ট’ (১৯৫১)। সেই নিয়ে  বার্নার্ডো বার্তোলুচি ১৯৭০ সালে বানালেন ‘দ্য কনফর্মিস্ট’। ছবির পটভূমি ৩০-এর দশকের ফ্যাসিস্ট ইতালি। মার্সেলো নামক এক ফ্যাসিস্ট সমর্থক স্ত্রীকে নিয়ে প্যারিস যাচ্ছে তার বহু আগের পরিচিত একজন প্রফেসরকে মারতে, যিনি আর ফ্যাসিজমের সমর্থক নন এবং ইতালি ছেড়ে প্যারিস গিয়ে জীবনযাপন করছেন। সেখানে গিয়ে মার্সেলো প্রফেসরের তরুণী স্ত্রীর প্রেমে পড়ে। এবং  মার্সেলোর স্ত্রীর সঙ্গে প্রফেসরের তরুণী স্ত্রীর লেসবিয়ান সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছবি  শেষ হচ্ছে ১৯৪৩-এর পটভূমিকায়, যখন মুসোলিনি সরে যাচ্ছে আর মুক্তিযুদ্ধের হাওয়া এসে গোটা দেশ ঘিরে ধরছে। মার্সেলো তখন এক সচ্ছল জীবন যাপন করছে, স্ত্রী পুত্র নিয়ে।

এই ছবি প্রাথমিকভাবে মনস্তত্ব নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। কনফর্মিস্ট বলতে কী বোঝায়? এরা কারা? ইতালিতে ফ্যাসিজম চলাকালিন এক শ্রেণীর লোক সেই শ্রেণীর ভেতর সমান বন্টন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করত। সমাজে স্বাভাবিকতা  চাইত। তারা মনে করত কোন এক বিশেষ শ্রেণীর প্রত্যেকের হাতে সমান সম্পদ  ও ক্ষমতা থাকা দরকার। এরাই কনফর্মিস্ট। মার্সেলো সেই শ্রেণীর। সে আমলা,  উচ্চবর্গের, বুদ্ধিজীবী কিন্তু শৈশবের যৌন অত্যাচার ও বৈষম্যের কারণে যে ভাবেই হোক সমাজে এক বড় গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে চায়। সেই ধারণা তার মধ্যে এঁটে বসে গেছে (কনফর্ম)। আর এই স্বাভাবিক বাস্তবে  ফেরার জন্য মার্সেলো সমস্ত অস্বাভাবিক কাজ করতেও রাজি। যে কারণে সে তার প্রফেসর ও তার স্ত্রীকে হত্যা করতে পিছপা হয়নি। এই মনস্তত্ব ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে, আমার মনে হয়েছে, বার্তোলুচি সাহায্য নিয়েছেন জার্মান এক্সপ্রেসনিজমের। তাঁর সিনেমায় ৩০-এর দশকের এলিট ক্লাসের এমন কিছু  ঘরবাড়ি আসবাব জীবনযাপনের ব্যবহার রয়েছে যা ৩০-৪০এর জার্মান সিনেমার সঙ্গে মিলে যায়।

এই ১১০ মিনিটের সিনেমা তৈরি করার সময় বার্তোলুচির বয়স ছিল মাত্র ৩০। বেশ কিছু ভুল ছিল এই ছবিতে। যেমন সিন থেকে সিনে কিছু মিসিং লিঙ্ক রয়ে গেছিল। কিন্তু তার পরেও এই সিনেমা অনবদ্য, বিশেষ করে ৩০-এর দশকের ইতালি ও ফ্রান্স ফুটিয়ে তোলা, যা নব্য-বাস্তবতার আগের দলিল হিসেবে কাজ করেছে। এবং যা না বললে এই সিনেমার প্রতি অবিচার করা হবে, তা হল ক্যামেরার কাজ। খুব কম ছবিতেই আলো-ছায়ার এত ভাল কাজ দেখা গেছে। বড় বড় হলঘর ব্যবহার করে তার আলো-ছায়ার স্পেস থেকে ফ্রেমে ভেঙে সিন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, বিভিন্ন আর্কিটেকচার ব্যবহার করে সিনের ভেতরেই একাধিক সিন বানানো হয়েছে। এবং ক্যামেরা রাখা হয়েছে এমন কিছু অ্যাঙ্গলে যা কখনোই সাধারণভাবে ব্যবহার হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্যামেরা বাঁকা,  ফলে ভার্টিকাল ফ্রেম তৈরি হয় না। আমাদের চোখও সেট হয় না। যেমন রাস্তা দিয়ে গাড়ির চলে যাওয়া বা কোন একজনকে গাড়ির পিছু ধাওয়া করা। দেখলে বুঝবেন। এর সাথে আছে ডিপ কালার কনট্রাস্ট। সব মিলিয়ে বার্তোলুচির ক্যামেরা যেন হয়ে উঠেছে জেলখানা। এবং এই পুরো কাজটা করতে গিয়ে দক্ষ হাতে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ফ্যাসিস্ট ইতালির ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই ছবি দেখার পর দর্শকের একটা ঘোর লেগে থাকতে বাধ্য। 

শেষ করার আগে এই প্রসঙ্গে আরেকটা ছবির কথা বলতে চাই। পাসোলিনির ‘সালো, অর 120 ডেজ অব সোডোম’ (১৯৭৫)। তবে সিনেমার ভেতরে ঢোকার  খুব তীব্র প্যাশন না থাকলে এটা দেখবেন না, কারণ এটা দেখলে আপনার ঘেন্না পাবে, গা ঘিনঘিন করবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ফ্যাসিস্ট ইতালিতে বাচ্চাদের ওপর কী রকম শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন হত, তার দলিল এই সিনেমা।

(ক্রমশ)


শিবাংশু দে

 

ঋত্বিকের নিজস্ব মুদ্রাগুলি - ১




--------------------------------------------    

"...Film is not made, film is built. আমি চিত্রপরিচালক নই, আমি চিত্রস্রষ্টা। চিত্র সৃষ্টি করেন একজন - সত্যজিৎ রায়। মৃণাল সেন চিত্র সৃষ্টি করেন, তাঁরা (নিছক) চিত্রপরিচালক নন।" (ঋত্বিক ঘটক)

তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন ব্যক্তি ঋত্বিক বিতর্কের কেন্দ্রে থাকলেও স্রষ্টা ঋত্বিক সেভাবে আগ্রহীদের উপযুক্ত মনস্কতা আকর্ষণ করেননি। ঋত্বিককে কেন্দ্র করে মনস্তত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, চিত্রনির্মাণ ইত্যাদি নানা বিষয়ের উদ্দীপক চর্চা শুরু হয়েছে একটু ধীরে। কিন্তু অনিবার্য অভিঘাতগুলি দিনে দিনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে মানুষের মনে। একজন প্রকৃত শিল্পী যথাসময়ে মানুষের মনোজগতের গভীরে পৌঁছে যান, এটাই শিল্পের নিয়ম। সময়ের মাত্রা শিল্পের সার্থকতার একটা প্রধান শর্ত। ঋত্বিক আবার তা সপ্রমাণ করলেন।

------------------------------

সেকালে বিশাখদত্ত একটি অঙ্গুরীয় মুদ্রার প্রতীককে কেন্দ্রে রেখে তাঁর চিরায়ত নাটকটির মাধ্যমে আমাদের নাট্যশাস্ত্রের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছিলেন। মুদ্রাই মন্ত্রী না মন্ত্রীর মুদ্রা, রাক্ষস শেষ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্পবিচারে মুদ্রার ছাপ থেকেই আমরা শিল্পীকে চেনার প্রয়াস পাই। ঋত্বিক ঘটকও কোনও ব্যতিক্রম ন'ন। তাঁরও কিছু প্রকট মুদ্রালক্ষণ রয়েছে। এটা সর্বজানিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাঁকে সেদেশের সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য। উড়োজাহাজে যাবার সময় তিনি আকাশ থেকে পদ্মানদী দেখে ভাববিহ্বল হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। সহযাত্রী সত্যজিৎ তাঁকে সম্বৃত করেন। কিন্তু সেদেশে পৌঁছে সেখানের তৎকালীন ভূমিগত বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে তিনি অচিরেই প্রথমে নিরাশ ও পরে মোহমুক্ত হবার প্রয়াস করেন। কিন্তু কখনও হতে পারেননি। তাঁর তক্ষশীলা ও মগধ পরস্পর ঘেঁটে গিয়েছিলো। চিরকালের মতো। তিনি কার মুদ্রা বহন করেন, শেষ পর্যন্ত ঠাহর করে উঠতে পারেননি। আমাদের জন্য সেটাই প্রাপ্তি। ট্রিলজি'র ছবিগুলি সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, "যোগসূত্র এই তিনটার মধ্যে একই মাত্র। সেটা হচ্ছে দুই বাংলার মিলন। দুইডা বাংলারে আমি মিলাইতে চাইছি। দুইডারে আমি ভালোবাসি হেইডা কমু গিয়া মিঞা, এবং আমি আজীবন কইয়া যামু, যখন মৃত্যু পর্যন্ত আমি কইয়া যামু। আমি পরোয়াই (করি না), আমার পয়সার পরোয়াই (নাই)। I can fight that out. ঋত্বিক ঘটক can do that out here and in Dhaka. আমারে কে মারব লাথি, মারুক গা যাক। বইয়া গ্যাছে গিয়া।"

এই ছবিগুলি তাঁর কীর্তির মাইলফলক, তারা কোনও না কোনও ভাবে ছিন্নমূল, মাতৃবিযুক্ত সন্তানের বিষাদবেদনায় ধূসর। যে দেশ তিনি ছেড়ে এসেছিলেন তাকে কখনই মৃণ্ময় ভেবে সান্ত্বনা পাননি, তা চিরকাল অত্যন্ত প্রকটভাবে তাঁর কাছে  চিন্ময় হয়ে থেকে গেছে। তাঁর 'দেশ'মাতৃকার সঙ্গে তাঁর নাড়ি সম্ভবত পঞ্চাশ বছর ধরেই কেউ ছিন্ন করতে পারেনি। তিনি যতদূরে যেতে চেয়েছেন তত বেশি নাড়িতে টান লেগেছে এবং তিনি ব্যথাকাতর হয়ে পড়েছেন। তাঁর ব্যক্তিজীবন, শিল্পীজীবন, রাজনীতি, উৎকেন্দ্রিকতা, কেউই তাঁকে এই বেদনা থেকে মুক্ত করার উপযুক্ত শুশ্রূষা দিতে পারেনি।

----------------------------------------

আবার অন্যদিকও আছে। এই তিনটি ছবি নিয়ে নিছক আবেগের ঊর্ধে গিয়ে তাঁর বিশ্লেষণটিও প্রণিধানে রাখা প্রয়োজন।  

"'মেঘে ঢাকা তারা' was complete my.... in my subconcious affair. 'কোমল গান্ধার' was a very concious affair. আমার এই মহিলার সঙ্গে বিবাহ ব্যাপারটা তার সঙ্গে প্রচণ্ড ভাবে জড়িত। আর 'সুবর্ণরেখা' is a very serious work. ওখানে খাটতে হয়েছে, হ্যাঁ, মানসিকভাবে... a work behind. দৈহিকভাবে খাটার ব্যাপার নয়, মানসিকভাবে প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে এবং এটাকে আমাকে দাঁড় করাতে হয়েছে। কদ্দূর দাঁড়িয়েছে সে আমি জানি না, কিন্তু মিঞা কথা হইত্যাছে, যে খাটছি আমি।" অথচ এ কথাও বারবার বলছেন, "...বাংলার ভাগটাকে আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে পারিনি। আজও পারি না। আর ঐ তিনটে ছবিতে (মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা) আমি ও-কথাই বলতে চেয়েছি। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও হয়ে গেলো একটা 'trilogy'.

এই মুদ্রাদোষটি থেকে তিনি সচেতন বা অবচেতনে কখনও রেহাই পেতে চাননি। তাই আমৃত্যু সেটি তাঁর হৃদয়লগ্ন হয়ে থেকে গিয়েছিলো। একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে একে 'সীমাবদ্ধতা'র চিহ্ন হিসেবে গণ্য করা যায়। যদিও ঋত্বিক আজীবন দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে সৃজনশীলতার ক্যাথার্সিস খুঁজেছেন। সেটি সত্যজিৎও  স্বীকার করেছিলেন।  

--------------------------------------------

“...Film is not made, film is built”। ঋত্বিক এই উক্তিটি ধার করেছিলেন  আইজেনস্টাইনের থেকে। তিনি যে সত্যজিতের মতো হলিউডি মডেলে বিশ্বাস করেন না এবং তাঁর রচনার সঙ্গে রুশ ক্ল্যাসিক ছবিগুলি মেলে তা স্বয়ং সত্যজিৎই বলে গেছেন, তাই তা জজেও মানে। তাঁর ছবি করার উৎস এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে ঋত্বিক বলেছিলেন, "...আইজেনস্টাইন না-থাকলে আমরা কাজ-কম্মর 'ক'ও শিখতাম না। উনি আমাদের বাবা। আমাদের পিতা। তাঁর লেখা, তাঁর thesis এবং তাঁর ছবি - এগুলো ছোটবেলায় আমাদেরকে পাগল করেছিল। এবং তখন ওগুলো আসত না। বহু কষ্টে লুকিয়ে-লুকিয়ে নিয়ে আসা হত। এই আইজেনস্টাইন... সত্যজিৎ রায়কেও আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, he will admit, that, he is the father of us." এর পরে তিনি নাম নিয়েছিলেন পুডোভকিন, কোজিনেৎসভ বা তারকোভস্কির। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ভিতরের অ্যানার্কিস্ট মুগ্ধ হয়েছিলো আরেকজনের প্রভাবে। অবাক হবার মতো কিছু নেই যদি তাঁর কাছে বুনুয়েল  শ্রেষ্ঠতার শিরোপা দখল করে নেন। যে স্ফুর্তির সঙ্গে তিনি বুনুয়েলের শিল্পকে বরণ করে নিয়েছিলেন, তাঁর থেকে এর জুড়ি আমরা আর পাইনি।

“আমার মতে বর্তমান চিত্র-পরিচালকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন লুইস বুনুয়েল। তাঁর চার-পাঁচটি ছবি আমি দেখেছি। ছবিগুলি আমাকে একেবারে পাগল করে দিয়েছে। বুনুয়েল-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশৃঙ্খলা এবং তার মধ্যে দিয়ে আমাদের একটা ছন্দে পৌঁছে দেওয়া। তিনি আমাদের মতো সাধারণ পরিচালকদের ভঙ্গিতে গুছিয়ে শট তোলেন না বা গুছিয়ে গল্প সাজান না। মনে হবে যেন তিনি পরম অবহেলায় ছবি তুলেছেন অথচ প্রায়শ এক-একটি মারাত্মক মুহূর্তে তিনি আমাদের নিয়ে যান যা রীতিমতো স্তম্ভিত করে দেয়।

...ওঁর থেকে বড় ছবির শিল্পী আমার মতে কেউ নেই বর্তমানে”।

--------------------------------------

স্ববিরোধের অন্য নাম ঋত্বিক। হয়তো সেটা বিরোধিতাই নয়। দ্বান্দ্বিকতা ও ভারতীয় ঐতিহ্যমুখী ব্যক্তিমানসের বিবর্তনে ইতিহাস, ঐতিহ্য বা মিথস্ক্রিয়ার ভূমিকা, ব্যক্তি তথা সমষ্টির সৃজনশীলতার প্রক্রিয়ায় তার প্রতিফলন এবং এ প্রসঙ্গে ইয়ুং সাহেবের তত্ত্ব অনায়াসে মিলেমিশে গেছে। তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছেন, "...ইয়ুং-এর সঙ্গে মার্ক্স-এর কোন বিরোধ নেই, দু'জনে দুই জগৎ নিয়ে কারবার করেছেন। দুটো প্রচণ্ডভাবে পরিপূরক। আমার ছবিতে ইয়ুং-এর যে-ব্যাপারটা প্রচণ্ডভাবে আসে, সেটা হলো ঐ mother complex. আমাকে আমার এক বন্ধু বলেছিলো, তোকে মা’য়ে খেয়েছে। আমার সব ছবিতে ঐ মা এসে পড়ে - তা মায়ে খেয়েছে কেন? এই 'যুক্তি তক্কো' ছবির entire ছৌ নাচটার raison d'etre হচ্ছে মা - mother complex. এখানে ঐ মেয়েটাকে, শাঁওলিকে তার সঙ্গে equate করো, জ্ঞানেশ বলছে নাচো, তোমরা নাচো, তোমরা না নাচলে কিছু হবে না। এটা সম্পূর্ণ Jungian, 'তিতাস'-এ ছেলেটা স্বপ্ন দেখে মা-কে ভগবতী রূপে, এই mother complex একটা basic point."  উত্তর আধুনিক পরিপ্রেক্ষিত ও ভারতীয় শিল্পবোধের নিরিখে এই উক্তির ব্যাখ্যা আজকের গুণগ্রাহীর বিচারে অনেক সহজবোধ্য হয়ে গেছে। তিনি বহুবার ওয়াজেদ আলি সাহেবের 'ট্র্যাডিশন' বিষয়ক অতি পরিচিত পরিভাষাটি উল্লেখ করেছেন তাঁর আলাপচারিতায়। বছর পঞ্চাশেক আগে যা নিশ্চিতভাবেই স্ববিরোধের সূচক ছিলো, কিন্তু আজ স্বপ্রতিষ্ঠ।

-------------------------------------

আইজেনস্টাইন বা বুনুয়েল, অনুপ্রেরণা হিসেবে তিনি যাকেই গ্রহণ করুন না কেন, 'আবেগপ্রবণতা'র 'পিছুটান' তাঁকে সতত আচ্ছন্ন করে রাখতো। বস্তুত তাঁর রচনার বিরুদ্ধে আমাদের যে প্রধান অভিযোগ, সেটাও তো তাই। আবেগের বশে মেলোড্রামার আধিক্য। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজে কী বলেন একবার দেখে নেওয়া যাক।

“...আসলে ছবি করার সময় অন্য কোন শক্তি ঢোকে। তার প্রথমে থাকে আবেগ,  আবেগই চালিত করে। সমস্ত ব্যাপারটা আবেগ থেকে আসে। যার আছে, তার আছে, যার নেই, তার নেই। এ হল ভেতর থেকে উৎসারিত। যে কোন শিল্পকর্ম সম্পর্কে এ কথা খাটে। লোকে গ্রহণ করুক অথবা না করুক। যে-দিন থেকে দর্শকরা screen ছিঁড়ে দিল, সেদিন থেকে চুল পাকতে শুরু হল”।   

অতএব ঋত্বিক সচেতনভাবেই আবেগকে চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছেন। আমরা যারা সিনেমার মূল্যায়নে য়ুরোপীয় নন্দনতত্ত্বের ধ্যানধারণার প্রতি  অধিক বিশ্বস্ত, তাদের মন্ত্র, আবেগ ভৃত্য হিসেবে উত্তম হলেও প্রভু হিসেবে তার ভূমিকা নৈব নৈব চ। আবেগের বন্ধহীন প্রকাশ মানে মেলোড্রামার 'স্থূলতা'। পরিভাষা হিসেবে 'মেলোড্রামা' শব্দটির মূল ঊনিশ শতকের ফরাসি গীতিনাট্য, মূলত অপেরার পরিবেশনার সঙ্গে জড়িত। যেহেতু প্রসেনিয়াম থিয়েটার বা ছায়াছবি দুইই আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, তাই এই শব্দটিকে আমরা 'অতি'নাটকের আখ্যা দিতে ব্যবহার করি। এই 'অতি' নাটকের উপাদান কী কী হতে পারে?

 ১. সমাপতনের ঘনঘটার প্রতি অধিক নির্ভরতা।

২. যে কোন মানুষী সংবেদ প্রকাশ করার সময় মন্দ্রসপ্তকের প্রতি ভরসা না রেখে তারসপ্তকের প্রতি অধিক বিশ্বস্ত হয়ে পড়া।

 ৩.  নীতিকথা প্রতিষ্ঠা করার অদম্য উৎসাহে পরিবেশনার সূক্ষ্মতর দিকগুলির প্রতি উদাসীন থাকা।

 এই লক্ষণগুলি পরিহার করার প্রতি অতিরিক্ত মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তা আমরা পশ্চিম থেকে শিখেছি। যেহেতু সিনেমা একটি সম্পূর্ণ পশ্চিমী মাধ্যম, তাই দীর্ঘদিন আমরা বিশ্বাস করেছি যে পশ্চিমের তৈরি করা (বিশেষত হলিউডের) 'ভালো সিনেমা'র মডেলটিই আমাদের অনুসরণ করা উচিৎ। ঋত্বিক এই মডেলটির প্রামাণ্যতা অনেকাংশেই স্বীকার করেননি, তাই মারি সিটনকে তিনি প্রভাবিত করতে পারেন না। বাংলা ছবিতে ঋত্বিক চিরকাল নিজস্ব মুদ্রা আবিষ্কার করার তাড়নায় অস্থির থেকেছেন।

(ক্রমশ) 

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

 

প্রসঙ্গঃ তরুণ মজুমদার (২)




 

শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩)

দশ বছর বয়েসে ‘বালিকা বধূ’ দেখা আর ষোল পেরিয়ে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ দেখার অভিজ্ঞতা যে সম্পূর্ণ পৃথক হ’বে, তা বলা বাহুল্য। ‘বালিকা বধূ’র একটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ সপরিবারে কোণারক বেড়াতে গিয়ে একটি আদিরসাত্মক মূর্তি দেখে রজনীর চমকে ওঠা! তখন, ১৯৬৭ সালে খুব একটা কিছু বুঝিনি, যদিও দৃশ্যটি অস্বস্তিকর লেগেছিল। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ অন্য স্তরের ছবি। দামাল ছেলে রসিক বিয়ের পরেও তার দস্যিপনা বজায় রাখে, এমনকি স্ত্রী অমলার সঙ্গে স্ত্রীর সখীর কথামতো ‘গায়ে গা ঠেকিয়ে’ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ পড়ার সময়েও! আর বহুবিবাহের বিরুদ্ধে কী দারুণ মজার প্রতিবাদ, যেখানে রসিক নিজেই দুই মায়ের  সন্তান! রসিক অমলাকে হরণ ক’রে নিয়ে আসবেই শ্বশুরবাড়ি থেকে, তার বাবা তাকে দ্বিতীয়বার ছাঁদনাতলায় দাঁড় করাবার যতই চেষ্টা করুন না কেন! হাজার হোক রসিক তো নিজেই অমলাকে শ্বশুরবাড়িতে ছেড়ে পালিয়ে এসেছে, ‘ম্যাজিস্টর সায়েবের শালার’ নাকে এক ঘুঁষো ঝেড়ে দেবার পর! পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে হরণ করেছিলেন, রসিক অমলাকে তার শ্বশুরের সাধের মোটরগাড়ি চুরি করে তাতেই চাপিয়ে তার বাবার কাছে এনে ফেলে! নইলে যে বাবা এই বিংশ শতাব্দীর পৃথ্বীরাজের দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে দেবেন রসিকের চিরশত্রু ‘আলেকজান্ডারে’র বোন ‘ভূতি’র সঙ্গে – সেই ভূতি যে রসিকের স্বপ্নদৃশ্যে হয়ে ওঠে অমলাকে প্রাণদণ্ডদাত্রী সংযুক্তা!



আমার চিরকালের সবচেয়ে প্রিয় তিনটি বাংলা ছবির মধ্যে প্রথম স্থানে একে অপরকে গোঁতাগুঁতি করছে তরুণবাবুর এই অনবদ্য প্রেমগাথাটি, তাঁরই ‘দাদার কীর্তি’র সঙ্গে! মুখ্য চরিত্রে অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় অবিস্মরণীয়। ‘বালিকা বধূ’তে রজনী/চিনি-রূপিনী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় বেশী নজর কেড়েছিলেন, অমলরূপী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের তুলনায়। এখানে, সজ্ঞানে কিনা জানি না, তরুণবাবু পাশা উল্টে দিয়েছেন। অমলাবেশিনী মহুয়া রায়চৌধুরী মিষ্টি, কিন্তু ছবির ফাটাফাটি শেষ দৃশ্যের আগে অয়নের পাশে কিছুটা নিস্প্রভ। ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অমলাকে রসিক তার চিঠিতে যা নিবেদন করেছিল, তা ‘বালিকা বধূর’ অমলের রজনীকে ‘প্রিয়তমা’ সম্বোধনের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে! সলজ্জ অমলা শেষ দৃশ্যে স্বামীকে তার সেই দাবী নিজের কথামত মিটিয়ে দেয়! ছবিটি যে আমাকে পাগল করে ছেড়েছিল, তার কারণ অবশ্যই এই দৃশ্যটি! চারবার ভবানীপুরের অধুনালুপ্ত ‘ভারতী’তে দেখেছি, তার মধ্যে একবার আমার ইংরেজী-মাধ্যম স্কুলের দুই সহপাঠীকে বগলদাবা ক’রে (“ওরে দেখবি চল, একটা দারুণ বাংলা ছবি! ইংরেজী তো অনেক হ’লো!”)

অভিনয় নিয়ে কার প্রশংসা করবো? রসিকের বাবার ভূমিকায় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিকের শ্বশুর পান্নালালের ভূমিকায় উৎপল দত্ত, রসিকের ঠাকুমা নিভাননী দেবী, আর ইতিহাসের মাস্টারমশাইয়ের ছোট্ট ভূমিকায় একমেবমদ্বিতীয়ম সন্তোষ দত্ত, যিনি ক্ষেপে গিয়ে রসিককে বেত মারতে থাকেন এই রাগে যে সে কোন আস্পর্ধায় পৃথ্বীরাজ সেজে আলেকজান্ডারের সঙ্গে টিফিনের সময় যুদ্ধ করছিল! এবং যাঁকে স্বপ্নে পৃথ্বীরাজরূপী রসিক নিজের রাজসভায় ড্রিল-স্যারের সঙ্গে শৃঙ্খলিত বন্দীরূপে দেখে!

শুধু একটি জিনিসই এই ছবিতে নিতে পারি নি – আমার পরিবারের অনেকেই একই কথা বলেছিলেন। তৎকালীন এক সমালোচকের মতে ছবির ‘সবচেয়ে সু-গীত গান’, লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে’! সত্তরের দশকে ঐ গানটির স্বত্ব নিয়ে রেখেছিল যাঁর কণ্ঠ তাঁর কাছে কয়েক মাস পরেই আমি গান শেখবার সুযোগ পাবঃ শ্রীমতী সুমিত্রা সেন!

আমার নিজের এই ছবিতে সবচেয়ে প্রিয় গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়, ‘ওরে মন, তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো’! অবসর গ্রহণের মুহূর্তে এই গানটিই গাইতে চাই!

 

কুহেলি (১৯৭৩/৭৪)

 


সবাই ভাবছেন, “এ আবার কী? ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজে’র পর ‘কুহেলি’ কী করে? সে তো  সেই ১৯৭১-এ ‘কুহেলি’ মুক্তি পেয়েছিল, এবং দেখতে হলে আমার সে ছবি দেখার কথা ছিল ভবানীপুরের ‘পূর্ণ’ প্রেক্ষাগৃহে (এখন বন্ধ পড়ে আছে, ভারতীর মতো  অদৃশ্য হয়ে যাবার অপেক্ষায়!)” না, তা হয়নি! এটি একমাত্র তরুণ মজুমদারের ছবি যেটি কলকাতায় দেখিনি! ৭৩-এর ডিসেম্বর বা ৭৪-এর জানুয়ারীতে, দাদা তখন চন্দননগরে এস ডি ও পদে আসীন। প্রথম কাউন্সিলের পরীক্ষা অক্টোবরেই শেষ হয়ে গেছে, আর আমিও গেছি দাদার কাছে ছুটি কাটাতে। তখন ওখানে ফরাসী নাট্যকার মলিয়েরের বিভিন্ন নাটকের বাংলা রূপান্তর করা অভিনয় চলছে। একদিন দেখলাম পাহাড়ী সান্যাল এসেছেন দেখতে!

এরই মধ্যে দেখি শহরের দেওয়ালে পোস্টার পড়েছে ‘কুহেলিঃ এক রুদ্ধশ্বাস রহস্য চিত্র!’ মনে পড়ল যে ছবিতে হেমন্তবাবুর গলায় আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘তুমি রবে নীরবে’, বাড়িতে যার রেকর্ড ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে। ততদিনে আমি গোঁড়া  হেমন্তভক্ত। অতএব দাদার কাছে আর্জি জানালাম। মঞ্জুর হলো, দাদা জীপে চেপে রাতের শোতে নিয়ে গেলেন ‘স্বপ্না’ নামের হলে (এখন আর আছে কি?)। দারুণ জমাটি ছবি, শিরদাঁড়ায় বেশ শিহরণ জাগানো! কিন্তু বহু রহস্যকাহিনী পড়া আমার কাছে খুব তাড়াতাড়ি পরিষ্কার হয়ে গেল অপরাধী কে! তাও বেশ ভয় করছিল,  কারণ ধরতে পারছিলাম না সে কী করে আপাত-ভৌতিক ঘটনাগুলি ঘটাচ্ছে।  রবীন্দ্রসঙ্গীতে হেমন্ত আশাতীত ভাবে ভালো, দাদাও সে কথা স্বীকার করলেন!

টি প্রশ্নঃ ‘তরুণ মজুমদারের নিবেদন’ কিন্তু পরিচালক হিসেবে ‘অভিমন্যু’র নাম  কেন? এতো সেই ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির টাইটেল কার্ডে পরিচালকের নাম ‘নায়ক’ রাখার মতো! ডিটেকটিভ/রহস্য কাহিনীর চিত্রায়নে সরাসরি নিজের নাম দিতে কিছু পরিচালকের কি সেই সময়ে কোন ছুৎমার্গ কাজ করতো? দুইঃ বিশ্বজিৎ হিন্দী এবং বাংলায় একাধিক এই জাতীয় রহস্য ছবিতে অভিনয় করেছেন, তবে সন্ধ্যা রায় আর কোন ছবিতে (আপাত বা আসল) ভূত সেজেছেন কি?

 

ফুলেশ্বরী (১৯৭৪)

 

সেই ১৯৬২/৩ সাল থেকে, যখন তরুণবাবু ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীতে ছিলেন, তখন থেকেই তিনি তাঁর ছবিতে তাঁর নিজের সঙ্গে আরেকজনকে নিয়ে এক মণিকাঞ্চন যোগ ঘটান, যা বিরাজ করেছে সেই ১৯৮৮ অবধি, ব্যতিক্রম একমাত্র হিন্দী ‘বালিকা বধূ’ (১৯৭৬)। তরুণবাবু যদি হন সেই মণি, তাহলে কাঞ্চন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৭২ সালে ভারতের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী মিশে যায় ঋষি অরবিন্দের জন্মশতবার্ষিকীর সঙ্গে। তখনই শেক্সপিয়র সরণীর শ্রীঅরবিন্দ ভবনে একদিন চাক্ষুষ করি হেমন্তকে, গেয়েছিলেন ৮টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও দুটি সময়োপযোগী অন্য গান। দেখে ভক্ত হয়েছিলাম, ১৯৮৯তে তিনি চলে যাবার পর এখন আমি পূজারী।

এত কথা বললাম এই জন্যে যে তরুণ মজুমদারের ছবির অন্যতম আকর্ষণ আমার কাছে, সেই ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ থেকেই হেমন্তবাবুর গান। অতএব ‘বিজলী’তে ‘ফুলেশ্বরী’ছবিটি এবং তার গান অসাধারণ জনপ্রিয় হয়, বিশেষ করে, ‘যেও না দাঁড়াও বন্ধু’। হেমন্ত নিজে ‘ফুলেশ্বরী, ফুলেশ্বরী’ গাইতে ভালবাসতেন বলেছেন, আর আমার সবচেয়ে ভাল লাগে ‘আমি দেখতে ভালোবাসি’। কিন্তু ছবির শেষটা, ঐ হঠাৎ করে ‘সব সমস্যা একে একে হলো সমাধান’ দেখে খুব বিরূপতা জেগেছিলঃ মনে হয়েছিল, এত করে crisisএর বেলুন ফোলালেন, তারপর ফুস করে এইরকম গোঁজামিল? দূর, মানতে পারলাম না! কিন্তু ৬ বছর পরে তো প্রায় একই উপায়ে ‘দাদার কীর্তি’তে মধুরেণ সমাপয়েৎ ঘটাবেন তরুণবাবু, তখন? সে কথা না হয় যখন ‘দাদার কীর্তি’ নিয়ে বলব, তখনকার জন্যেই তোলা থাক!

(ক্রমশ)


অম্লান বোস

 

ব্যাকরণবাবু - দ্বিজেনস্যার




 

গীতবিতানের নামকরা ছাত্রী নীলাঞ্জনাই কথাটা তুলেছিল। “ভীড়ের পেছন থেকে,  অনেক দূরে বসে বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে, আলোছায়া মঞ্চে আপনি গাইছেন, না হেমন্তবাবু - বুঝতেই পারা যায় না। সেই সাদা ধুতি, সাদা শার্ট, গলাটাও কাছাকাছি”।

আমাদের অতি সুদর্শনা দিদিমা ছিলেন সভা আলো করে। গোলাপী রং, ছোট করে কাটা শ্বেতশুভ্র রেশমী চুলের শোভা, দুধসাদা ধুতি পরিহিতা, সাজানো দোক্তারাঙা দাঁতে হাস্যমুখী পরিপাটি দিদিমার চোখে সবসময়েই কৌতুকের জোনাকী। উনি ছিলেন আমাদের বসুভবনের পঞ্চভ্রাতার ‘দ্রৌপদী’। আমরা সবে ঐ দীর্ঘাঙ্গ ভদ্রলোকের সঙ্গে চলনসই কথাবার্তা আরম্ভ করার চেষ্টা করছি, দিদিমা বলে বসলেন - “দ্বিজেনভাই (উনি সকলকেই ভাই বলে সম্বোধন করতেন), তোমার এত সুন্দর গলা, এত পরিষ্কার উচ্চারণ, গীতবিতানের কমা ফুলস্টপ মেনে গান গাও শুনেছি  - তবু, তোমাকে সবাই ‘হেমন্তের মতো’ বলে। তোমার নিজস্বতার কথা বলে না কেন ভাই? আমার কিন্তু ভীষণ রাগ হয়”।

আকাশকাকু বলে উঠলেন - “আরে, এটাই তো মুস্কিল দিদিমাভাই। এত সুন্দর ভরাট গলা, অথচ আপনার কথা উঠলে উনার কথা এসে যাবেই। কেন, আপনার কি নিজস্বতা নেই?”

নীলাঞ্জনার সাড়া আবার পাওয়া গেল – “নেই মানে? ওনার মত বিশুদ্ধ উচ্চারণ, ত্রুটিহীন ব্যাকরণ খুব কম গায়কেরই আছে। আমরা তো সবাই আপনাকে -  প্লিজ্ কিছু মনে করবেন না, ব্যাকরণবাবু বলি। সত্যি কথা বলি? বান্ধবীদের ইচ্ছা থাকলেও ভয়ে লজ্জায় আপনার ক্লাস নিতে পারে না”। ভদ্রলোক চোখে কৌতুক  নিয়ে কিছু বলবার আগেই সুমতিমাসী বলে উঠলেন - “তবু কেন সবাই তোমাকে হেমন্তের মতো গলা বলবে? আমি সবসময়েই প্রার্থনা করি ঐ মহান গায়ক হেমন্তবাবুর ছায়া থেকে তুমি বাবা, খুব শিগ্গিরই বেরিয়ে এসো”।

এতক্ষণে উনি সহজকণ্ঠেই বলে উঠলেন - “ওটা কিন্তু কিছু করার নেই মাসীমা!  কোন শিল্পীরই ওনাকে ছাড়িয়ে যাবার সাধ্য নেই। অনেকে আমাকেই জিজ্ঞেস করেন আমাদের কোন সম্পর্ক আছে কি না - আমি মাঝে মাঝে বলে দিই, আমি ওনার ভাইপো তো, তাই গলাটা উনি ব্যবহার করতে দিয়েছেন”। হাসির ঢেউ দুলিয়ে একেবারে হাল্কা করে দিলেন তুলনামূলক অস্বস্তিকর আলোচনাটা। ইনি - স্বর্ণযুগের অন্যতম সারথি, শ্রীদ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।

বোধহয় সেটা তাঁর দ্বিতীয়বার বসুভবনে পদার্পণ এবং দুদিনের জন্যে থাকা। সেবার সাকচির বেঙ্গল ক্লাব আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তীতে এসেছিলেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের এই পরম পাওয়া।

আমার সংস্কৃতিমনা, সর্বগুণসম্পন্না, সর্বস্তরে সমাদৃতা, অতি জনপ্রিয় এবং সঙ্গীত অনুরাগী মাতাঠাকুরাণীর স্নেহময় আতিথেয়তা এবং পেরুমামার সাদর আমন্ত্রণে গায়ক, লেখক, কবি, সাংবাদিক এবং নানান গুণীজনের আগমনে আমাদের বসুভবন সর্বদাই মুখরিত থাকত - যাদুসম্রাট পি সি সরকার, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, মণিশংকর মুখোপাধ্যায়, এমন কি পরমপূজ্যা আনন্দময়ী মা’য়ের পবিত্র পাদস্পর্শেও বসুভবন ধন্য হয়েছিল। এক সূতোয় বাঁধা সংস্কৃতিপ্রিয় পাড়া পড়শীদের প্রাণেও স্বভাবতই শিহরণ জাগাতো এইসব গুণীজনদের নিকট সান্নিধ্য।

সেদিনও ব্যতিক্রম নেই। যথারীতি দোতালার বসার ঘরে সঙ্গীতানুরাগীদের অস্হির আবেগ ঐ দীর্ঘাঙ্গ ঋজু মানুষটির জন্যে ফুটন্ত ছটফট করছিল সুমিতা - সুরঙ্গমার ছাত্রী, গায়কের একনিষ্ঠ ভক্ত। বলে উঠলো - “তবে আপনার কথা উঠলেই কিন্তু মহালয়ার ঐ দুর্ধর্ষ জাগো দূর্গা গমগম করে ওঠে। উফ্ ফ্ - কী গেয়েছেন! আচ্ছা দ্বিজেনদা, তখন তো লাইভ হত, ঐ ভোরসকালে। নার্ভাস লাগতো না? তখন বোধহয় আপনার গানের জগতে প্রথম দিকে - তাই না?”

“তা প্রথম দিকে একটু… মহালয়া আরম্ভ তো হয়েছিল ছেষট্টি সালে। এত বড় টিম, এত সমন্বয়, একটার পর একটা বর্ণনা, পাঠ, গান, বীরেনবাবুর ইমোশনাল স্তোত্রপাঠ! তাছাড়া, ঐ গানটা তো হেমন্তবাবুর গাইবার কথা ছিল - কিন্তু উনি তখন বোম্বেতে খুবই ব্যস্ত। মহালয়ার আগে এসে মহড়া দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। খুব সম্ভবত বাণীকুমারের সায় ছিল না এতে - তাই উনি আমাকেই গানটা  গাইতে বললেন। তখন কিন্তু একটু… মানে, হাজার হলেও হেমন্তবাবুর গান!”

ব্যস, মামা ধরে বসলেন - “দ্বিজেন, তাহলে আজকের আসর ঐ গানটা দিয়েই শুরু হোক্!”

মা’ও বললেন - “হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, গানটা শুনলে মনে কেমন শুদ্ধ শক্তি জেগে ওঠে”। বলেই গলায় আঁচল দিয়ে একটা প্রণাম, দশপ্রহারিণীর উদ্দেশ্যেই। খুবই ভক্তিমতী ছিলেন।

আমাদের সাবেকী হারমোনিয়ামটা নামানোই ছিল, ওটার দিকে আড়চোখে একটু তাকাতেই মামা বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমারটা থাক্ না দ্বিজেন। এটা আমার ফুলবৌমা রীতার, গীতবিতানের ছাত্রী। এটা ওর মামার হাতেও সুর তুলেছে - শ্রদ্ধেয় শৈলজারঞ্জন মজুমদন, রীতার মামা। উনি শ্যামবাজারের বাড়িতে ওঁর বোনের বাড়ি যখন তখন যেতেন, এটা বাজিয়ে রীতার গান শুনতে চাইতেন। শৈলজাবাবুই পরে ওকে সুরঙ্গমাতে ভর্তি করিয়েছিলেন”।

গায়কের মুখের ভাব বিশ্লেষণের সাধ্য আমার নেই, তবে রীতার দিকে অবাক বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে, হাতজোড় করে ঐ মানুষটির উদ্দেশ্যে মাথা নীচু করার ভঙ্গীটা আজও আমার মনে কেটে বসে আছে। পরম শ্রদ্ধাভরে, খুব সাবধানে ঐ হারমোনিয়মটা সরিয়ে আর একবার গুরুজীকে নমস্কার জানিয়ে, বোধহয় মাফ চেয়ে, নিজেরটাকেই টেনে নিলেন। বসুভবনে বড়, মেজো, রাঙ্গা ভাইয়ের পরে আমি নকুল, ফুল ছেলে, সেই সুবাদে রীতা বাড়ির ফুলবৌমা। সে অবশ্য গায়কের ঐ ভক্তির প্রকাশটা দেখতে পায়নি - লজ্জাবতী তখন শৈলজামামুর সঙ্গে তার নিজের নাম, তাও স্বয়ং দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সামনে, এক নি:শ্বাসে শুনতে পাবার লজ্জায় আর কিছু না পেরে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে রাঙাদিদির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকতে ব্যস্ত।

তা উনি গাইলেন গানটি - শেষও হলো। কিন্তু শিহরণ তোলা শেষের সেই বুক কাঁপানো ‘তুমি জাগো’র টানা বিলম্বিত সুরের স্বর্গীয় আশীর্বাদ যেন এক পাখি ডাকা শরতভোরের পবিত্র ধূপের ধোঁয়ায় সমস্ত বসুভবনের আনাচ কানাচ সুরভিত করে তুললো। প্রায় এক দেড় মিনিট আমরা সবাই স্তব্ধক, পাথর প্রতিমা।

এবার কল্যাণীমাসীমাই নিস্তব্ধ ভাবসমাধিটা ভাঙ্গতে তৎপর হলেন।

উফ্ ফ্ - কী গাইলে দ্বিজেন! আচ্ছা বলো তো, তুমি কার কাছে তালিম নিয়েছ বাবা, আর কত গান গেয়েছ?

হ্যাঁ সত্যিই, এরকম নির্ভুল গায়কী বিশুদ্ধ তালিম না হলে হয়?” ছন্দা ফুট কাটলো।

বেলোতে ক্লিপ লাগিয়ে দ্বিজেনবাবু বললেন, “সে তো বহু পুরনো কথা মাসীমা। ভিতটা গড়ে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় শ্রীশান্তিদেব ঘোষ, পঙ্কজ মল্লিক, সন্তোষ সেনগুপ্ত , অনাদি ঘোষ দস্তিদার, নীহারবিন্দু সেন মশাইরা - বিভিন্ন সময়ে। নমস্য শান্তিদেব তো একটুও ত্রুটি বিচ্যূতি সহ্য করতেন না। অসম্ভব কড়া ছিলেন। আর গান, তার কোন হিসেব করিনি মাসিমা। এই ষাট বছরে বেশ কয়েক শো গান তো গাওয়া হয়েছে, আর তার মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রায় আটশো মতো হবে হয়তো”।

অশোকদা বললেন, “আকাশবাণীতে কবে থেকে শুরু করলেন? সেই সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশে ঘোষকের গলায় - এখন রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনাচ্ছেন দ্বিজেন মুখাপাধ্যায়, সরি সরি – শ্রীদ্বিজেন…”

অমায়িক হাসি দিয়ে ওখানেই থামিয়ে দিলেন অশোকদাকে।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে - অভ্যেস আছে এসব শোনার। সত্যি বলতে ভালই লাগে। শ্যামল, তরুণ, হেমন্ত, সন্ধ্যা, মান্না - এগুলি নিজের মত করে, ভালবেসেই তো বলেন আপনারা, হতচ্ছেদ্দা করে তো নয়। আমরা অন্তত সেটাই

ভাবি”।

অশোকদার অপ্রস্তুত মুখের বাইরে প্রায় তিন ইঞ্চি বেরিয়ে থাকা জিভটাকে  দুহাতে চোখ মুখ ঢেকেও কিন্তু সেদিন আড়াল করতে পারেনি। দ্বিজেনবাবু স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ফিরে গেলেন আবার অশোকদার আগের প্রশ্নটাতেই -

“ও - আকাশবাণীতে? প্রথম ডাক পাই স্বধীনতার আগে, ঐ ছেচল্লিশে”।

“আর ওরা বলছিল তুমি নাকি বম্বেতেও গেছো গান গাইতে?” করবীমামী।

“হ্যাঁ , বম্বেতে সলিলবাবুই নিয়ে গিয়েছিলেন আমায়, সেটা বোধহয় ষাট সাল। ‘মধুমতী’ ছবিতে গান রেকর্ডিং-এর জন্যে - তবে সেগুলো মনে হয় ছবিতে  অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। তা না হলেও, উনি কিন্তু লতাজীর সঙ্গেও কয়েকটি ছবিতে আমাকে ডুয়েটের সুযোগ দিয়েছিলেন, আর ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’, ‘একদিন ফিরে যাবো’ গানগুলি হিন্দীতে গাইয়েছিলেন”।

সজল অনেকক্ষণ ধরে উসখুশ করছিল, এবার বলল, “দ্বিজেনদা, আপনি তো বাইরেও অনেক দেশে গেছেন। বিদেশে স্হানীয় মানুষেরা কীভাবে আমাদের দেশের, আমাদের ভাষার গানের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন - ঐ সব অভিজ্ঞতা  যদি বলেন!”

“হ্যাঁ, সত্যিই সেটা মনে রাখার মতই”। একটু নড়ে বসলেন শিল্পী। “সেবারে সোভিয়েট ইউনিয়ন,পোল্যান্ড, রোমানিয়া, য়ুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া এসব জায়গায় গিয়েছিলাম। ওরা কতটা কী বুঝত জানতাম না। তবে রবিঠাকুরের নামেই নিশ্চয়ই অডিটোরিয়াম কিন্তু খুব একটা খালি দেখিনি কোথাও। রাশিয়ার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। বোধহয় ‘পল্লবী গো তুমি সঞ্চারিণী’ গানটা গেয়েছিলাম, শেষ করতেই দর্শকমহলে প্রচন্ড গোলমাল শুরু হয়ে গন। দেখি - সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সামনের সিটটা চাপডাচ্ছে, দু’হাত তুলে নিজেদের ভাষায় কিছু বলছে, অনেকে আবার দু’হাতের বুড়ো আঙুল তুলে উত্তেজিত। আমার তো নাজেহাল অবস্হা, ওদের ভাল লাগছে না বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি কী করব তখন? উঠে পড়ব? হতাশভাবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি।  হারমোনিয়মের বেলোটা দু:খের সঙ্গে বন্ধ করে উঠেই পড়লাম। আমাদের দেশের রীতি অনুযায়ী দর্শকদের অভিশাপ স্বীকার করে, মাথা নীচু করে নমস্কার করলাম। মঞ্চ ছাড়তে সত্যিই খুব কষ্ট লাগছন, অপমান লাগছিল। কলকাতার কাগজে কাগজে এই লজ্জাজনক বর্ণনার ভাষা চোখে সটান ভেসে উঠল চোখের সামনে।

হঠাৎ উইংয়ের পাশ থেকে কোঅর্ডিনেটর মলোটভ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। ইংরেজীতে বললেন, “মি: মুখার্জি, আপনাকে যেভাবে ওরা সম্বর্ধনা জানাচ্ছে, রাজ সাহেবের (রাজকাপুর)পর এমনটা আমি দেখিনি”।

“কী বলছেন? ঐ যে বুড়ো আঙুল…!”

“সে কি, জানেন না আপনি? প্রশংসা, প্রশংসা - থামস্ আপ! আর আপনি যে একেবারে উঠে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে দর্শকদের সম্মান জানালেন - তাতে ওরা অভিভূত”। মাইকে কিছু বললেন - সমস্ত হল আবার ফেটে পড়ল, এবারে ওদের মুখের উচ্ছসিত ভাষা পড়তে আমার ভুল হল না। তীব্র আলোগুলো তখন তো হলঘরের শ্রোতাদের ওপরেই ফোকাস ছিল”।

সুমিতা বললো - “ওরে বাবা, দারুণ এক্সপিরিয়েন্স তো? ভাবতেই পারছি না!”

“হ্যাঁ, অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ওরা বোধহয় সুর আর ছন্দতেই আকৃষ্ট হয়েছিল। আর বাদ্যন্ত্রীদেরও অবশ্যই যথেষ্ট অবদান ছিল”।

আমার মামা, সবসময়েই আমাদের মধ্যেকার গাইয়েদের প্রোমোট করার চেষ্টা করতেন নামকরাদের সামনে - যদি ওরা নামী কারুর চোখে পড়ে যায়, যদি আকাশবাণীতে তালিকাভুক্ত হতে পার। তাই করলেন মামা, দু’তিন জনের পর মহুল গানটা আরম্ভই করল মাঝখান থেকেই -

“তুমি নও তো সূর্য নও তো চন্দ্র

তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ

তুমি আপন জীবন পূর্ণ করে আপন আলো জ্বেলেছো”।

গানটা সুন্দর ভাবেই শেষ হল। দ্বিজেনবাবু কিছু বলার আগেই কেতকীমাসী বলে উঠলেন – “বাবা দ্বিজেন, এ গানটা কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে একেবারে প্রযোজ্য - তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও তো ঋণী কারো কাছে, তোমার অন্তরে যা শক্তি আছে তারই আবেশ ঢেলেছ। তুমি তুমিই, আর হেমন্ত - হেমন্ত। তুলনা করার তো কিছু নেই - নিজের পথে নিজের সাধনা”।

দ্বিজেনবাবু কোন কথা বললেন না, অত উঁচু মাথাটা বুকের কাছে নামিয়ে চোখ বন্ধ করে মাসীমার দিকে তাকিয়ে দু’হাত জোড় করে প্রণাম করলেন। অবশ্য

মাসীমার জন্যে না কবিগুরুর উদ্দেশ্যে - বোঝা গেল না।

নিজের হারমোনিয়মটা টেনে নিয়ে এবার সুর দিলেন, পরমেশদার তবলায় পড়ল চাঁটি, পরের দুটো ঘন্টা তরঙ্গে তরঙ্গে পাল তুলে বসুভবনের উঠোনে, অলিন্দ, ঘরের কোণায় কোণায় সুরের মায়াজাল বিছিয়ে দিয়ে গেলো।

তার মাঝে মাঝে কিন্তু আলাপচারিতাও সমান তেজে চলেছে।

“রবীন্দ্রসঙ্গীতের তো কোন কথাই নেই, তবে ছায়াছবি, আধুনিক এসবে আপনার কখনো অসুবিধা হত না?”

“না, তেমন না, প্রায় শ’পাঁচেক গাওয়া হয়েছে তো। তবে, সলিলবাবুর সুরগুলি ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং”।

“মানে? অসুবিধা হত?”

“না, সেরকম নয়। ওনার সঙ্গে আমার জানাশোনা তো সেই আই পি টি এর সময় থেকে। আমি সবসময়েই বলি ওনার সুর আগামী কয়েকটা প্রজন্মকেও সন্মোহিত করবে। একদিন ফিরে যাবো চলে, সজল সজল মেঘ করেছে, পল্লবী গো সঞ্চারিণী। তারপর মাইকেল মধুসূদন ছবির গান? বোম্বেতে ওনার বাড়িতে গেছি, উনি দোতলায় সুর করছিলেন। নেমে এসে বললেন - ভাল হয়েছে, দেখি এই গানটা তোল তো চট করে! ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ বাজিয়ে শোনালেন, গাইতে বললেন। আচ্ছা, আপনারা বলুন তো ‘চিরস্হির কবে নীর হায় রে জীবন নদে’ - এইরকম একটা কঠিন বাক্যস্রোতকে আর কেউ কি ঐরকম অসাধারণ  সুরে গলিয়ে দিতে পারেন? সোজা কাজ? সত্যিই উনি ক্ষণজন্মা!”

হঠাৎ পল্লব বলে বসল - “আচ্ছা, এখনকার বাংলাব্যান্ড আর আধুনিক গান সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা দ্বিজেনবাবু? আপনাকে কিন্তু এখনকার লেখা কারুর গান গাইতে শুনিনি!”

“সে তো এক এক যুগের সৃষ্টি একেক রকম হবেই। আমার গলায় ঐসব নাও আসতে পার। তবে খারাপ লাগে যখন আমাকে কেউ কেউ বলেন আপনি আজকালকার জীবনমুখী কোন গান করেন না কেন? আমি দু’তিনজন অতি উৎসাহীকে বলতে বাধ্য হয়েছি - কেন মশাই, আমি কি এতদিন মরণমুখী গান গেয়ে এসেছি?” বলার ধরনে সবাই হেসে উঠল বটে, তবে প্রচ্ছন্ন বেদনার চাবুকটা একটা সূক্ষ্ম আঁচড় দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল বুকের গ্রন্থিগুলি।

রাত গড়াচ্ছে জামসেদপুরের আকাশে, পূবের দিকটা গোলাপী হয়ে উঠেছে ব্লাস্ট ফার্ণেসের লোহাগলানো আগুনের আঁচে। খাবার টেবিলের বিবরণটা আর দিলাম না, ওটা মাতাঠাকুরাণীর নিজস্ব লীলাক্ষেত্র। আইটেম, স্বাদ আর নিজস্বতায় কত যে স্টার মার্ক পেয়েছেন, সেটা গণনার মধ্যে আনতেই চান না উনি।

কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, স্মৃতির আকাশ থেকে ঝরছে ফুলঝুরি - অবিরাম। স্মৃতিচারণটা যথেষ্ট লম্বা হয়ে যাচ্ছে - পাঠক পাঠিকাদের ধৈর্য বা প্রশ্রয়ের সীমারেখা পরীক্ষা করা আর উচিত হবে না, ভবিষ্যতে ব্রাত্য বলে পরিচিত হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। তাই দু’একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে ইতি টানছি।

খাওয়ার টেবলে খোশগল্পের পর দ্বিজেনবাবুকে নীচের ঘরে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ে বাড়ির পেছনের পেয়ারা, আম, কাঁঠাল, শিউলী গাছের ছায়াছায়া অন্ধকারের দিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “আচ্ছ কানুবাবুশ, নীচে আর কেউ থাকবে না - মানে একা, অন্ধকার ফাঁকা উঠোন, ইয়ে –

আমি অভয় দিলাম, “দ্বিজেনদা, আমাদের পাড়া সাউথ পার্ক খুবই সেফ্, চোর-ডাকাত, বাজে লোকেরা আসতেই পারে না কোনদিন। তাছাড়া কোলাপ্সিবল গেট”।

“না না, মানুষ টানুষ নয়, মানে ঐ… মানুষদের তো তবু দেখা যায়, আসলে যাদের দেখা টেখা যায় না, তাদের নিয়ে একটু ভয়ের ব্যাপার থাকে না? অন্ধকার তো!”

দুটো রাত্তির, আমার ডাক্তার দাদার নীচে পাশের ঘরে শোবার ডিউটি পড়ে গিয়েছিল।

শেষ দেখা হয়েছিল যেদিন, সেদিন কিন্তু উনি মায়ের হাতের চিংড়ি মালাইকারীর কথা তুলেছিলেন। সেটা ছিল তাজ বেঙ্গলের ব্যাংকোয়েটে, সালটা মনে নেই। কেমন করে জানি না, একটা ইনভিটেশান পেয়েছিলাম, যেখানে বাঙলার তখনকার সময়ের অনেক গুণীমানুষজনকে সম্মানিত করা হয়েছিল। গান গেয়েছিলেন বাংলাদেশের বন্যা। রীতাকে নিয়ে ঢুকতেই একজন কর্মকর্তা এসে চুপিচুপি বললেন “ স্যার, মি: চ্যাটার্জি এসেছেন”। বুঝলাম সৌমিত্রদার কথা জানালেন উনি। আশেপাশের প্রতীক্ষারত কর্মকর্তা আর স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে সৌজন্যবিনিময়ের পরে বললাম-

“কোথায় উনি?”

“আসুন স্যার”।

দীপ্যমান হয়ে বসেছিলেন সৌমিত্রদা, হলের মাঝামাঝি - কখনই দেখিনি নিজের প্রাধান্য বা উপস্হিতি জাহির করতে। সাধারণ কথাবার্তার পর বললেন, “অম্লান,  দ্বিজেনবাবুর সঙ্গে দেখা হল? উনি এসেছেন তো!”

“না না, জানি না তো! কোথায়?” সামনের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

গেলাম অনিশ্চিত দৃষ্টি মেলে - অনেক বছর তো কেটে গেছে। চিনতে পারবেন না জেনেও বলতে হল-

“চিনতে পারছন না তো দ্বিজেনদা?” ওনাকে অপ্রস্তুত হবার সময় না দিয়েই  বলে উঠলাম-

“জামশেদপুর বসুভবন, নীহারমাসিমা, পেরুমামা…”

আস্তে করে স্মৃতির ছায়া সরে যেতে দেখলাম, চওড়া মুখটা একটু উজ্জল হল মনে হল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওরে বাবা! তা তুমি দ্রৌপদীর কোনজন?”

আশ্চর্য হবো না? আমাদের মনে না থাকলেও দ্রৌপদী দিদিমাকে ঠিক মনে ধরেছে?

“নীহারদি কেমন আছেন, উফ্ - সেই মালাইকারী, মোচার চপ্! ঢাকাই পরোটা আর কষামাংস ভুলব কী করে?” কিছুক্ষণ নতুন পুরনো আলাপচারিতা হল।  আলাপ করিয়ে দিলেন - সুনীল, শঙ্খ ঘোষ, পার্থ ও গৌরী, শুভাপ্রসন্ন, রুদ্রপ্রসাদ, নবনীতা আরও কয়েকজনের সঙ্গে।

নবনীতা নিজস্ব স্টাইলে বললেন - “নিশ্চয়ই অভিনয় জগতে আছেন, দেখেছি মনে হচ্ছে!” মুখ দেখে তামাশা করছেন কী না বোঝা গেল না।

পার্থ ঘোষ গলার নিজস্ব গভীরতায় জিজ্ঞেস করলেন - “আপনি কি বাচিক শিল্পী? আকাশবাণী বা দূরদর্শনের সঙ্গে যুক্ত আছেন? গলাটা শুনে মনে হচ্ছে”।

কে বলছেন? পার্থ ঘোষ। কাকে বলছেন গলার কথা? আমাকে!

কোথায় লুকাই অপদার্থ মুখটা?

রুদ্রপ্রসাদ স্মিতমুখে অপেক্ষা করছিলেন।

এত গুণী মানী শিল্পীদের সব ধারণাই যে অসার, একেবারে ভিত্তিহীন, সেটা বলতেও লজ্জা, তবু বলতে বাধ্য হলাম। আমার মত এক ধূলিকণার, ঐ সংস্কৃতিবানদের প্রতিভার ঢেউয়ে নিজের মাটি আঁকডে থাকার চেষ্টা খুই দুস্কর এবং লজ্জাজনক। বিব্রত মুখে মাথাটা একটু নাড়িয়ে পটপরিবর্তনে সচেষ্ট হয়ে তাড়াতাড়ি আবার দ্বিজেনদার দীর্ঘ ছায়ার তলায় আশ্রয় নিলাম।

“দ্বিজেনদা, এখনও গান গাইছেন তো?”

“হ্যাঁ, মানুষেরা যতদিন শুনতে চাইবেন আর কি। এই তো সামনের সপ্তাহেই দিল্লী যাচ্ছি - আকাশবাণীতে একটা পরিবেশন করার আছে।

ঠিক তখনই মধুবন্তীর সুরেলা গলা নিজস্ব একতারায় ঝিমঝিম করে উঠলো - রেজওয়ানা চৌধুরী মিষ্টি চেহারায় মঞ্চ আলোকিত করে এসে বসলেন।  যন্ত্রশিল্পীরা পাশাপাশি নানা বাদ্যযন্ত্রের হাল্কা ঝংকার তুলছেন, সঙ্গত করার জন্যে সসম্মানে তৈরী। অডিটোরিয়ম স্তব্ধ প্রতীক্ষায় উন্মুখ।

সবাইকে হাত নাড়িয়ে আর দ্বিজেনদার দু হাতে শ্রদ্ধা আর অগাধ শুভেচ্ছার চাপ দিয়েই নিজের জায়গায় ফিরে এলাম।

সেই শেষ। এর কয়েকবছরের মধ্যেই দেশে এসেছিলাম, ২০১৮র শীতকালে। সেই বছরে বড়দিনের আগেই উনি চলে গেলেন। ঐরকম মাপের শিল্পী বড়দিনের জন্যে অপেক্ষা করলেন না, তার আগের দিনই চলে গেলেন। রেখে গেলেন চিরবহমান সুর আর সাধনার অবিস্মরণীয় অনুরণন, অসংখ্য অনুরাগীর সীমাহীন শ্রদ্ধা আর অগাধ ভালবাসার শেষপারাণীর কড়ি সঙ্গে নিয়ে। দেশে বিদেশে যখনই মহালয়ার শিউলিঝরা ভোরের ফুটি ফুটি আলোতে প্রাণে যান্ত্রিক মাধ্যমে হিল্লোল তোলা সেই গভীর স্বর “জাগো দূর্গা, জাগো মা” আমাদের প্রতিটি রোমকে আগমনী সুরে উত্তাল উদ্বেল করে তোলে, তখন মুহূর্তের জন্য হলেও, ওনার অনুপস্হিতিটা কাঁটা হয়ে বিঁধতে থাকে। তখনই দ্বিজেনদার গলায় বসুভবনের প্রতিটি কড়ি বরগায়, প্রতিটি কোণায়, সিঁড়ির ধাপে ধাপে মূর্চ্ছনায়  কবিগুরুর অবিস্মরণীয় বার্তা হাহাকার করে গুমরে ওঠে (মাপ করবেন, একটু পরিবর্তিত প্রকাশে) -

কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।

সকল খেলায় -

মহালয়ায় থাকব তখন এই আমি,

আ - হা, কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি!