কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

পৃথা কুণ্ডু

 

সমকালীন ছোটগল্প


সেতু

 

বর্ণিল ফোনটা রেখে বসে রইল অনেকক্ষণ শ্রেয়া এভাবে বলতে পারল তাকে! এমনিতেই প্রচণ্ড সমস্যার মধ্যে আছে সে - ফ্রান্সে এসে আটকে গেছে, স্কলারশিপের টাকা এখনো ঢোকেনি লকডাউনের জেরে সব কাজকর্ম বন্ধ। শরীরটাও ভাল নেই, ক’দিন ধরে জ্বর জ্বর ভাব একজন ডাক্তারকে দেখিয়েছিল, তিনি বলেছেনএমনি ইনফ্লুয়েঞ্জা কিন্তু তাঁর দেওয়া অ্যানটিবায়োটিক খেয়েও জ্বরটা কমছে না সেটা শুনেও শ্রেয়া একটা শুকনো মেসেজ পাঠাল‘করোনা তো নয় ওষুধ খাও, ঠিক হয়ে যাবেখুব কষ্ট হয়েছিল দেখে অথচ দেশে থাকতে থাকতে শ্রেয়ার জন্য কী না করেছে সে! ওর ভাইয়ের অপারেশনের সময় রক্ত  দিয়েছে

যেদিন জ্বরটা খুব বেশি উঠল, বর্ণিল বাধ্য হল ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরকে জানাতে তিনি হসপিটালে কথাবার্তা বললেন, ওরা এসে স্যাম্পল নেবে যদি অ্যাডমিট করতে হয়, খরচ আপাতত ইউনিভার্সিটি দেবে।

আর কিছুক্ষণ পরেই হসপিটাল থেকে লোক আসবে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল বর্ণিল, যদি ভর্তি হতে হয়ফোনটা হয়ত কাছে থাকবে না মা-বাবা খুব চিন্তা করবেন, তাঁদের খবর দেবে কী করে? কোন বন্ধুর মাধ্যমে যদিকিন্তু কাকে বলবে?

ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে পূরবীর নাম্বারটায় এসে বর্ণিলের মনে হয়, একে একবার বলে দেখলে হয় না? দেশেও তো এখন লকডাউন শুরু হয়ে গেছে, নিশ্চয় বাড়িতেই থাকবে

***

 

বর্ণিলের সাথে একটা ট্রান্সলেশন ওয়ার্কশপে আলাপ পূরবীর পূরবী বয়সে একটু ছোট, তবে স্কুলে চাকরি পেয়েছিল তখনই। মোটামুটি যোগাযোগ ছিল তাদের, বর্ণিল ফ্রান্সে চলে যাবার পরেও। ওখানে জ্বর বাধিয়েছে শুনে পূরবী বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই বলেছিল, ‘ডাক্তার দেখিয়ে নিন। ইগনোর করবেন না।’ তারপর আজ এই মেসেজ - ‘আমাকে বোধহয় হসপিটালাইজড করবেএকটা উপকার করবেন?’ পূরবী লেখে, ‘বলুন কী করতে পারি?’

-   ‘আমার কাছে হয়ত ফোন রাখতে দেবে না। আপনি তো ফ্রেঞ্চ জানেন এখানে আমার যে প্রফেসর হেল্প করছেন, তাঁর ইমেইল আইডি যদি আপনাকে দিই, দিনে একবার তাঁর কাছে খবর নিয়ে আমার মা-বাবাকে জানাতে পারবেন প্লিজ? ওঁদের নাম্বারও দেব’

-   ‘কাকু-কাকিমা আর প্রফেসরের কাছে আমার পরিচয় দিয়ে রাখবেন, অবশ্যই জানিয়ে দেব।’

-   ‘খুব উপকার হয় তাহলে। ...নিতান্ত হেল্পলেস হয়ে আপনাকে এভাবে ট্রাবল দিচ্ছি

-   ‘এটুকু করা কোন ব্যাপার নাকি? ... আর হসপিটালে ভর্তি হলে একদিক দিয়ে ভালই। প্রপার মেডিক্যাল কেয়ারটা পাবেন। ভয়ের কিছু নেই

পরদিন সকালে দেখে, বর্ণিল অনলাইন আছে। অর্থাৎ ফোনটা এখনও ওর কাছেই। পূরবী জানতে চায়, ‘কেমন আছেন, রিপোর্ট কী?

উত্তর আসে, ‘আমার করোনা।’

আশঙ্কাটাই সত্যি হল তাহলে! কিন্তু বর্ণিলকে এখন একটু সাহস দেওয়াই উচিত। তাই সে লেখে – ‘ডায়াগনোসিস হয়েছে যখন ট্রিটমেন্টও এবার ঠিক পথে হবে। অত টেনশন নেবেন না।’

তারপর এতগুলো দিন সাংঘাতিক কেটেছে বর্ণিলের। সে যেটুকু ফ্রেঞ্চ জানে, তা দিয়ে সুবিধে-অসুবিধের কথা বলা খুব মুশকিল। তার কী খাবার সহ্য হয় - না হয়, বোঝাতে পারে না। ফোনটা রাখতে দিয়েছে তাই সে অন্তত বাড়িতে কথা বলতে পারছিল। পূরবীর মাধ্যমে যোগাযোগের দরকার পড়েনি, তবে সে প্রায়ই খোঁজ নিচ্ছিল। বর্ণিল ওর পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবার কথাই বলেছে ওকে এ কদিনে। এক এক সময় রীতিমত ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে সে, নিজের জীবন, চাওয়া-পাওয়া এসব নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলছে – পূরবী কখনও মজা করে, কখনও বুঝিয়ে  সামলানোর চেষ্টা করেছে। দূর থেকে একটা মানুষকে কষ্ট পেতে দেখলে এইটুকু তো করাই যায়।

***

হসপিটালে শুয়ে শুয়ে সেদিন কেঁদে ফেলেছিল বর্ণিল।

শ্রেয়া মিডিয়া লাইনে চাকরির চেষ্টা করছে শুনে, দেশে থাকতে থাকতেই বর্ণিল ওর পরিচিত একজনকে বলেছিল তার ব্যাপারে। ওদের অফিসেও সিভি দেওয়া ছিল। অবশ্য সেখানে ওর চেনা কেউ আছে, শ্রেয়াকে সেটা জানায় নি। যদি না হয়, ওর আশাভঙ্গ হতে পারে, সেই ভেবে। গত সপ্তাহে অফিস থেকে ফোন করেছিল ওকে। তখনই শ্রেয়া জানতে পারে ব্যাপারটাওর নাকি খুব খারাপ লেগেছে। কারও পরিচয়ে ও কিছু পেতে চায় না, তাই যা তা শুনিয়েছে বর্ণিলকে। সে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, ‘তুমি কাজটা পেলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দিওরেকমেণ্ড করা মানে কি অপমান করা?’

শ্রেয়া লেখে, ‘যে ফোন করেছিল, তার কথাবার্তা আমার মোটেই ভাল লাগেনি। যেভাবে বলেছে সেটা অপমানই দাঁড়ায়। এ লাইনের কিছু বোঝ না জানো না, কে একজন চেনা আছে – তাকে বলে ক্রেডিট নিচ্ছ!’

-   ‘যাকে বলেছিলাম সে মোটেও খারাপ নয়– সে যা হোক, তোমার কাজ পছন্দ না হলে কোর না। কিন্তু যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই- সেটাকে ছোট কোর না এভাবে।’

-   আমি কারও দয়ায় চাকরি করব না আর তোমার বা তোমার চেনা কারও দয়ায় তো নয়ই’ বিদেশে রিসার্চের সুযোগ পেয়েছ বলে নিজেকে বিরাট কিছু মনে করছ? তুমি আমার কেরিয়ার গড়ে দেবে, আর সেই নিয়ে সারাজীবন খোঁটা দেবে!

-‘এসব কী বলছ? তুমিও জানো আমি তোমার মতই সাধারণ বাড়ির ছেলে। ভাগ্যক্রমে চান্স পেয়েছি তাই এসেছি। তার জন্য তো আমার কোন ইগো নেই! আর প্রিয়জনের জন্য কিছু করার চেষ্টা তো সবাই করে, এতে আমার দোষ? প্লিজ এভাবে কথা বোল না।’

-‘তুমিই বাধ্য করছ বলতে।’

-‘প্লিজ ভুল বুঝো না এভাবে। আমি আর নিতে পারছি না। অসুস্থ অবস্থায় বিদেশে পড়ে আছি, হয়ত আর কোনদিন ফিরব না...’

-   ‘যত আজেবাজে কথামরে তো যাও নি, আর এত সহজে কিছু হয় না। এই জন্যই আজকাল  কথা বলতে ভাল লাগে না। বড্ড ন্যাগিং।... আর আন্টিকে দয়া করে এসব লাগিও না। ফোন করে আমাকে আরও পাঁচটা কথা বলবেন, আর অশান্তি ভাল লাগে না।’

বর্ণিল আর নিতে পারছিল না। আজ তাকে বিরক্তিকর লাগছে শ্রেয়ার! এভাবে বদলে গেল মেয়েটা? ওর জীবনে কি অন্য কেউ এসেছে? বর্ণিলের মাও তো শ্রেয়াকে মেয়ের মত দেখেন, তাদের বাড়িও এসেছে...

মাকে এখন বলা যাবে না। তিক্ততা আরও বাড়বে। কিন্তু এত যন্ত্রণা কি একা সওয়া যায়- এই অসুস্থ শরীরে - চিন্তায়, ভয়ে পাগল-পাগল অবস্থায়? বর্ণিল খানিক দোনামনা করে পুরো কথাবার্তার স্ক্রিনশট নিয়ে পাঠিয়ে দেয় পূরবীকেই। কাজটা ঠিক হল কিনা কে জানে!

***

পূরবী লেখে, ‘ওকে তো আমি পার্সোনালি চিনি না। কেন, কী পরিস্থিতিতে এরকম বলল – না জেনে মন্তব্য করব না। হয়ত কাজের অফারটা ভাল লাগেনি, তার কিছু কারণ হয়ত আছে। তবে আপনাকে এ অবস্থায় ওইভাবে বলাটা ঠিক হয়নি, এটুকু বলতে পারি

- ‘আজ সব শেষ হয়ে গেল, জানেন!’

- ‘অত সহজে কিছু শেষ হয় না। কোনভাবে হয়ত আপনি ওকে বোঝাতে পারেননি যে আপনি ওকে কতটা ভালবাসেন, বা ও-ই বুঝতে পারেনি। যাই হোক, তাতে তো আপনার ভালবাসা মিথ্যে হয়ে যায় না। এখন এসব নিয়ে স্ট্রেস নেবেন না, আগে নিজেকে সুস্থ করুন।’

-‘আপনি কিছু মনে করলেন না তো?’

-‘মনে করলে কি আর এত জ্ঞান দিতাম? বাদ দিন ওসব কথা, এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন বরং। সন্ধ্যেয় আবার কথা হবে।’ ব্যাপারটা একটু হাল্কা করার চেষ্টায় বলে পূরবী

 

***

গতকাল বর্ণিলকে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু আরও দুসপ্তাহ কোয়ারানটিনে থাকতে হবে। এখনও তো শরীর দুর্বল – একা সামলাবে কি করে? এইসব ভাবতে ভাবতেই ফোন করে পূরবী

-   ‘ঠিক আছেন এখন?’

-   ‘আর পারছি না’ ওপ্রান্তে বর্ণিলের গলা।

-   ‘আবার কী কষ্ট হচ্ছে?’

-   ‘হাতে ভীষণ ব্যথা। ফুলেছে। কি জানি, টেনে চ্যানেল খোলার সময়...’

-   ‘ও ঠিক হয়ে যাবে, আমারও অপারেশনের পর হয়েছিল। ... একটু জেল জাতীয় কিছু নেই?’

-   ‘না। মা বলল ঠাণ্ডা-গরম জল নিতে, এদিকে ঠাণ্ডা নিতে ভয় পাচ্ছি। গরম জলে ডোবালাম তাতেও কিছু হচ্ছে না।’

বেচারা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। খারাপ লাগছে, কিন্তু পূরবী-ই বা কী বলবে দূর থেকে? তবু বলে -

-   ‘গরম লাগালে তো ভালই। আলতো ম্যাসাজ করা যায়, তবে ঘষবেন নাআস্তে আস্তে কমবে, দেখুন।’

-   ‘তাও করেছি, কমছে না... ভেতরে কিছু হল কিনা কে জানে।’

-   ‘আপনি একটু বেশি ভয় পাচ্ছেন। এত বড় বিপদটা কাটিয়ে এলেন, আর এটা সহ্য করা এমন কী! মনটা সরিয়ে নিন ব্যথার জায়গা থেকে। অন্য কিছু ভাবুন... গান শুনুন।’

-   ‘পারছি না। গান শুনতে তো এমনি খুব ভালবাসি, চেষ্টা করছিলাম ইউটিউবে শোনার। কিন্তু শুনতে গিয়ে দেখলাম মিউজিকের আওয়াজ সহ্য করতে পারছি না, মাথা ধরে যাচ্ছে। খালি গলায় যদি কেউ শোনাত... সে আর কে শোনাবে?’

নিজের জীবনে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে পূরবীরবর্ণিলের মতই একা ছিল সে। বাড়ির লোকেরা আসত ভিজিটিং-এর সময়, কিন্তু তার সবটাই ধোঁয়া ধোঁয়া লাগত। ভুলভাল চিকিৎসা হয়েছিল, তারপর বাড়াবাড়ি রকমের ইনফেকশন। এদিকে যতদিন হসপিটালে থাকা, তত খরচ বেশি। বোন তখনও ছোট, ওর ম্যানেজমেণ্ট পড়ার খরচ অনেক... যেটুকু সময় জ্ঞান থাকত – সে ভাবত, তার জন্য এত খরচ হবার চেয়ে বরং...

পূরবী বলে বর্ণিলকে – ‘যদি আপনার একটু রিলিভড্ লাগে, চেষ্টা করে দেখতে পারি।’

-   ‘শোনাবেন? বড় ভাল হয়।’

- ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু হে প্রিয়...’ পূরবী শুরু করে।

এই গানটাই সে শুনেছিল এক রাতে, হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে... কেউ যেন এসে হাত রেখেছিল তার মাথায়, গানের সুরেই বলেছিল – একা কোথায়? আমি তো আছি। ‘হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো দাও গো আমার হাতে’... না ছুঁয়ে, না স্পর্শ করেও তো হাত ধরা যায়...

মনের ভুল? কে জানেতবে আজও তো পূরবী বেঁচে আছে, কথা বলছে, গান গাইছে...

গানটা শেষ হলে দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। তারপর বর্ণিল বলে, ‘আর একটা রিকোয়েস্ট করব?’

-   ‘কি, আরও একটা?’

-   ‘সে এরপর থেকে দাবি করেই নেব। অন্য কথা বলছি।’

-   ‘বলুন?’

-   ‘আপনি বলাটা এবার বাদ দেওয়া যায় না? ...এই ক’দিনে আপনি যা করেছেন... আপনজনের মত... দেশ থেকে একমাত্র মা-বাবা ছাড়া আর কেউ এভাবে রোজ খবর নেয়নি, মেণ্টাল সাপোর্ট দেয়নি... নিজের বোন থাকলে হয়ত এভাবেই ...’

কারও বিপদের সময় একটু ভরসা দিতে পেরেছে ভেবে ভাল লাগে পূরবীর তার এক দাদা ছিল, চলে গিয়েছিল অল্প বয়সেই। ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো’ গানটা বড় প্রিয় ছিল তারও... চোখের কোণে আসা জলটা মুছে নেয় পূরবী। বর্ণিলের সঙ্গে আলাপ মাত্র কয়েক মাসের, তবু তার আন্তরিকতা সে ঠেলে দিতে পারে নাজবাব দেয় -

- ‘সত্যি আপনজন বলে ভাবলে ‘তুই’ বলতে হবে কিন্তু আমি কিন্তু দু বছরের ছোট ....ব্যথা কি কমেছে?’

-   ‘আবার মনে করাচ্ছে - করাচ্ছিস! অনেকটা ভুলে ছিলাম।’

-   ‘একটু কাজ হয়েছে তাহলে।’

-   ‘তুই জানিস না, আমার জন্য তুই কী করেছিস!’

-   ‘আমি কিচ্ছু করিনি বর্ণিলদাহয়ে গেছে।’

-   ‘কে করল তবে?’

-   ‘কি জানি... ও ঠিক বোঝানো যায় না।’

পূরবী নিজেও কয়েকবছর আগের সেই আশ্চর্য রাতে বোঝেনি, কে অমন করে সেতু বেঁধে দিয়েছিল আলো আর আঁধারের মধ্যে। আজ বোধহয় বুঝতে পারছে।

 


1 কমেন্টস্: