কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৬৩  
  
                               
ইংরেজি নতুন বছরের শুরুতে সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা। অনেক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে গড়িয়ে গেছে বিগত বছর। তার মধ্যে যেমন কিছু সুখস্মৃতি আছে, তেমনই আছে বেশ কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতিও। একে একে কত প্রিয়জন যে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন! আসলে প্রত্যেকটি মানুষের  জীবনের জার্নি বা যাত্রা তো এমনই হয়ে থাকে। জীবন-বাস্তবতাকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। অস্বীকার করলে তা জীবন-বিমুখতা হয়ে দাঁড়ায়।  

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নতুন বছরে  আমাদের নিবেদন সদ্য প্রকাশিত দুটি সম্পাদিত বই ‘কবিতা ডট কম’ ও ‘অবৈধগল্প’ এবং ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১০৫তম সংখ্যা; বিষয় – সৃষ্টি।

‘কবিতা ডট কম’ কবিতা সংকলনে মূলতকালিমাটি অনলাইনব্লগজিনে প্রকাশিত অসংখ্য কবির অগণিত কবিতার মধ্যে থেকে আপাতত বেছে নেওয়া হয়েছে বিরাশিজন কবির কবিতাঅধুনা প্রয়াত কয়েকজন কবির কবিতা অবশ্য ‘কালিমাটি’ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এবংকালিমাটিপত্রিকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এই সংকলনেও কয়েকজন বিশিষ্ট প্রবীণ কবির পাশাপাশি মূলত তরুণ ও তরুণতর প্রজন্মের কবিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করা হয়তো বাহুল্য হবে, এই বিরাশিজন কবির কবিতার নিবিড় পাঠে সমসময়ের বাংলা  কবিতার ধারাটিকে মোটামুটি ভাবে স্পর্শ করতে পারবেন প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা

এই সংকলনটি অবশ্য শুধুমাত্র ভারতে বসবাসকারী কবিদের বাংলা কবিতার সংকলন এই বিরাশিজন কবি ছাড়াও আরও অনেক কবিকালিমাটিকালিমাটি অনলাইনপত্রিকায় কবিতা লিখেছেন এবং শুধু ভারতে বসবাসকারী কবিরাই নন, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী, বিশেষত বাংলাদেশের কবিরাকালিমাটিকে তাঁদের কবিতায় সমৃদ্ধ করেছেন আগামী কবিতা সংকলনে আমরা সেইসব কবিদের কবিতা প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছি ‘কবিতা ডট কম’ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার ‘বৈভাষিক প্রকাশনী’ থেকে। 

‘অবৈধগল্প’ মোট কুড়িজন লেখকের কুড়িটি গল্পের সংকলন। যুগের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে মানবসভ্যতা যেমন যেমন অগ্রসর হয়, তেমনি তার সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রেখে বিবর্তিত হয় সমাজব্যবস্থা। এবং সেই ধারাবাহিকতায় ক্রম বিকশিত হয় সংস্কৃতি। একথা উল্লেখ করা নিতান্তই বাহুল্য যে, সমকালীন প্রচলিত সমাজব্যবস্থা সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবে পরিচালনার জন্যই অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কিছু নিয়ম-কানুন ও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। এবং সমাজে বসবাসকারী মানুষদের মঙ্গলের জন্যই তা করা হয়আর এই প্রাসঙ্গিকতায় অনিবার্য হয়ে পড়ে যে কোনো নিয়ম, প্রথা, চিন্তাভাবনা, আচার আচরণ ও ক্রিয়ার বৈধতা ও অবৈধতা বিচার বিশ্লেষণ কিন্তু খুবই দুঃখের ব্যাপার, এই কার্যকারণ সম্পর্কটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কার্যকরী হয় না বা হতে দেওয়া হয় না। আর এই না হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা, যেমন অধিকাংশ মানুষের বহুদিন ধরে লালিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার, অশিক্ষা, জীবন ও জগত সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মান্ধতা, বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, যুক্তিচর্চার অভাব, জীবনের অনিশ্চয়তা সম্পর্কিত ভীতি এবং সেইসঙ্গে অতি অবশ্যই শাসকশ্রেণী ও সমাজপতিদের সুবিধাবাদ এবং কায়েমিস্বার্থ। আর এরই ফলশ্রুতিতে বহমান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, মানুষ, সভ্যতার বিভিন্ন উপকরণ, প্রযুক্তি ক্রম পরিবর্তিত ও বিকশিত হলেও অধিকাংশ বিধি-নিষেধ অপরিবর্তিতই থেকে যায় যে নিয়ম, প্রথা, চিন্তাভাবনা, আচার আচরণ ও ক্রিয়া সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অচল হয়ে গেছে, অচলায়তনে পর্যবসিত হয়েছে, তা টিকিয়ে রাখার জন্য চলে নিরন্তর প্রয়াস। সামাজিকতা, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থাকে তারই অনুকূলে যথাযথ সাজিয়ে রাখা হয়। আর তাই  সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়  এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সৃষ্টি হয় জটিলতা, শুরু হয় বৈধ ও অবৈধর টানাপড়েন বিড়ম্বিত হয়  স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। কিন্তু প্রত্যেক ক্রিয়ারই যেমন প্রতিক্রিয়া থাকে, তেমনি তথাকথিত অবৈধতার বিপ্রতীপেও চলে অন্যায্য, অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিত বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে মানুষের সচেতন প্রয়াস ও লড়াই। সম্প্রতি মহামান্য ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত কিছু অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক বিধি-নিষেধকে বাতিল করা হয়েছে। আর ঠিক এই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের ‘অবৈধগল্প’ সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। মোট কুড়িজন গল্পকারের কুড়িটি গল্প সংকলিত হয়েছে। কলকাতার বিশিষ্ট প্রকাশনী সংস্থা ‘ধানসিড়ি’ এই ‘অবৈধগল্প’ সংকলনটির প্রকাশক।  

কালিমাটির ১০৫তম বিশেষ এই সংখ্যাটির বিষয়সৃষ্টি সৃষ্টির লীলা, মাহাত্ম্য এবং কুহেলিকা সম্পর্কিত আলাপ ও আলোচনা স্বভাবতই, ‘সৃষ্টিকীএমন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া স্বভাবিক বিজ্ঞানীদের ভাষায়, একটি অণু-মুহূর্তের শতকোটি ভগ্নাংশ সময়ে মহাবিস্ফোরণে এই ব্রক্ষ্মান্ডের জন্ম হয়েছিল সময়ের মাপনিতে তা আজ থেকে মোটামুটি ১৩৭০ কোটি বছর আগের ঘটনা আর সেই সময় থেকে সৃষ্টিসুখের উল্লাস চলছে বিবর্তনের পথ ধরে বস্তু, শক্তি, শূন্য, কণা, অপ্রাণ-প্রাণ হয়ে দীর্ঘ পথের শেষেমানুষ মানুষের সভ্যতা, চেতনা, আবেগসব কিছু জড়িয়ে আছে নানা সৃষ্টির পথ-সংগমে

সৃষ্টির গৌরবেই এসেছে ভাষা, ছন্দ, সুর, কাব্য এবং চেতনা ও অধিচেতনার সংযোগে বিচিত্র স্বপ্ন আমাদের বোধের স্তর লীলায়িত হয়ে সৃষ্টি করে চলেছে ভাবমন্ডলের বিচিত্র ভুবন সৃষ্টিকর্তা বলেই মানুষ ঈশ্বর প্রাণীজগত থেকে আলাদা সৃষ্টিশক্তির অনির্বাণ শিখায় মানুষ চেতনাকে নতুন মায়াজালে আলোকিত রেখেছেরবীন্দ্রনাথ প্রয়াণের আগে তাঁর শেষ কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন – “তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি / বিচিত্র ছলনাজালে / হে ছলনাময়ী সেইছলনাময়ীর স্বরূপ সন্ধানের জন্য আধুনিক সৃষ্টিকারদের কাছে আমরা এই সংখ্যায় তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রের গহন অনুভবটুকু প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছি কালিমাটির ১০৫তম সংখ্যা (সৃষ্টি সংখ্যা) প্রকাশিত হয়েছে বৈভাষিক প্রকাশনীথেকে

আশাকরি, ‘কালিমাটি অনলাইনব্লগজিনের উদ্যোগে সদ্য প্রকাশিত দুটি সংকলন কবিতা ডট কমঅবৈধগল্পএবং কালিমাটিপত্রিকা আপনারা সংগ্রহ করতে আগ্রহী হবেন


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :   
        
08789040217 / 09835544675  

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India


<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




ধিক্কৃত ও অ-ধিক্কৃত বিবিধ নরখাদকতা (১)




এই লেখাটা একটা সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক/অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে দ্বিবিধ নরখাদকতাকে নিয়ে। শুরু করছি বেচারি থর্স্টিন ভেবলেনকে (Thorstein Veblen) দিয়ে, যিনি দুটোর সম্পর্কেই লিখেছিলেন প্রথমটার সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে এবং পরেরটার সম্পর্কে অপ্রত্যক্ষভাবে! ভেবলেন ভবঘুরে নরওয়েজীয় কৃষকের ছেলেছেলেদের মানুষ করায় চাষী বাবার আগ্রহে ১৮৭৪ সালেমিনেসোটা প্রেইরিতে নিউ ইংল্যান্ডের  কনগ্রিগেশন্যাল চার্চের মিশনারি ভাবধারায় দীক্ষিত কার্ল্টন কলেজে ভর্তি হলেন, লুথেরান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কলেজের ক্লান্তিকর, শ্বাসরোধী আবহাওয়ায় অতিষ্ঠ ভেবলেন গ্র্যাজুয়েট হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে লেখ্য দুটি প্রবন্ধ লিখে কলেজের কর্তৃপক্ষের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলেনপ্রথমটা নরখাদকতার সপক্ষে, আর দ্বিতীয়টা কোনো মাতালের নেশাদাসত্বের সমর্থন (নাম্না, ‘Plea for Cannibalism’, এবং ‘Apology for a Toper’) এটাকে আমি আমার ছাত্রজীবনে ধরেছিলাম মূল্যবোধ নিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার উদাহরণ হিসেবে, যার আদিতম উদাহরণ আছে প্রাচীন গ্রিসের ডায়ালেকটিক্স-এর মধ্যে। 

আবার পরবর্তীকালে ভেবলেন বই লিখলেন এক অবসরভোগী শ্রেণিকে নিয়ে, যেটি এমনকি বন্য (savage) গোষ্ঠীর মধ্যে বা বন্যসংস্কৃতিতেও ছিল, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও এই বইটিও আমার মতে মুক্তচিন্তক ভেবলেনই লিখতে পারতেন। কারণ এক আয়েসি শ্রেণির সমাজতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ভেবলেন অনেক নিন্দাসূচক শব্দকে প্রশংসার্হনা করে’ দিলেও তাচ্ছিল্যার্থকতা এমনকি নিন্দাসূচকতা থেকে অব্যাহতিদিলেন, যেমন ‘অপচয়ী’ (‘wasteful’) শব্দটিকে। অবসরভোগী শ্রেণির তত্ত্ব বইতে এক জায়গায় ভেবলেন বললেন, ‘এক দিক থেকে অপচয় শব্দটির ব্যবহারই বেঠিক। প্রাত্যহিক জীবনের কথাবার্তায় যেমন, শব্দটা একটা অনুচ্চস্বর অননুমোদনের ভার বয়ে বেড়ায়। কিন্তু এটা এখানে লিখলাম এমন একটা  ভালোতর শব্দের অভাবে, যেটি একই ধরলার প্রেষণা ও ঘটনাক্রমের বর্ণনা দিলেও, তাকে এমন নিন্দার্থে নেবে না যে তা মানবিক উৎপাদন অথবা মানবিক জীবনের অবৈধ ব্যবহারের দ্যোতনা দেবে অর্থনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিতে এই আলোচ্য ব্যয়টি অন্য কোনো ব্যয়ের চেয়ে বেশি বৈধও নয়, কম বৈধও নয়’অন্যত্র বললেন, ‘এই ব্যয়কে এখানে (এই বইতে)অপচয় বলা হয়েছে, একারণে যে এই ব্যয় মানবজীবনের  অথবা সমগ্রভাবে মানবিক কল্যাণের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে না, এহেতু নয় যে, যে ব্যক্তিভোক্তা এটাকে বেছে নেয় তার দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অপচয় বা প্রয়াসের ভুলপথ গ্রহণ’ আরো এক জায়গায় লিখলেন, ‘এটা পণ্যের অপচয়মূলক ভোগ দুই অর্থে, ক) সম্পদের প্রত্যক্ষ ব্যাখ্যাতা হিসেবে, আর খ) শোভনতার মাপকাঠির উপাদান হিসেবে’আর ‘কোনো বিশেষ ব্যয় বাস্তবে যতই অপচয়মূলক হোক, তাকে আপাত-প্রতীয়মান, বাহ্য কোনো উদ্দেশ্যের আপাত-সঙ্গত অজুহাত সঙ্গে রাখতেই হবে’ভেবলেনের এই শেষ কথাটি দিয়ে ঔপনিবেশিক কলকাতার ভুঁইফোড় হঠাৎ বড়লোকদের ঘুড়ির সঙ্গে ভারি নোট জুড়ে ওড়ানো, পোষ্য প্রাণীর বা কন্যার পুতুলের বিয়েতে লাখ লাখ টাকা ওড়ানো, দুর্গা পূজার জৌলুষ ইত্যাদির কারণ বেশ ভালো ব্যাখ্যা করা যায়।

 তা, হঠাৎ ভেবলেনের নরখাদকতা নিয়ে লেখার সঙ্গে অবসরভোগী শ্রেণির অপচয় এবং জাহিরিপনার ভোগের কথা বলছি কেন? এই দুই বিষয়ের যোগ কী? সেই যোগ নিয়েই এই লেখা। নরখাদকতার মতো বিকৃতরুচি ও নৈতিক ভ্রষ্টাচারের সপক্ষতা কেন করছেন, কার্ল্টন শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের এই উদ্বিগ্ন প্রশ্নের উত্তরে তরুণ ভেবলেন দুঃসাহসী উত্তর দিয়েছিলেন যে তিনি কেবল বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষণে ব্যাপৃত আছেন এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ভেবলেন অবসরভোগী শ্রেণির অপচয়মূলক ব্যয় ও নেত্রাকর্ষক ভোগের পর্যালোচনা করেছিলেন, এবং যৌক্তিক অনুমানে অবসরভোগী শ্রেণির মধ্যে লুণ্ঠনপ্রবৃত্তির প্রাবল্যের কথা বলেছিলেননইলে ভেবলেন নরখাদকতা বা কোনো একটি শ্রেণির অত্যধিক আর্থিক সমৃদ্ধি কোনোটারই সমর্থক ছিলেন না, যদিও পুঁজিবাদ কথাটিই বা তার ইংরিজি রূপ এই বইতে নেই

আমরা, সভ্য মানুষরা নরখাদকতার সমর্থক তো নইই, তাকে ঘেন্না করি! আমরা, সভ্য মানুষরা সব্বাই না হলেও অনেকেই উদার বলেই হয়তো অর্থনৈতিক উদারনীতির সমর্থক। অর্থনৈতিক উদারনীতি পুঁজিবাদেরই শোভন, ভদ্র নাম। আমরা ছোটোবেলা থেকে শিহরিত হয়ে শুনেছি যে আফ্রিকায় এবং অন্যত্র কিছু উপজাতিদের মধ্যে নাকি নরখাদক ছিল। বড় হয়ে শিউরে উঠে জেনেছি যে আফ্রিকায়, ল্যাটিন আমেরিকায় এবং অন্যত্র নরখাদকতা নাকি আধুনিক যুগেও ছিল ও অত্যাধুনিক কালেও আছে
আমি উপায়ান্তর না পেয়ে প্রাণরক্ষার জন্য নরমাংস ভক্ষণের কথা বলছি না! ১৮৮৪ সালে একটি মামলায় জাহাজ ডুবি হওয়া ডাডলে এবং স্টিফেন্স রিচার্ড পার্কার নামের কোমায় থাকা কেবিন বয়কে খেয়ে ফেলে ইংলণ্ডের কোর্টে আত্মরক্ষার যুক্তিতে ছাড় পান। আগে অবশ্য তাঁরা লটারি করে’ হন্য/বধ্য  বাছার চেষ্টা করেছিলেনকিন্তু তাতে সফল হননি। পরে চূড়ান্ত ক্ষুধায় নিজেদের প্রস্রাব পান শুরু করার পর পার্কার কোমায় চলে যাওয়ায় গোল মিটে যায়।১৮৪৬-৪৭ সালে মিসৌরির ইণ্ডিপেন্ডেন্স থেকে ওয়াগন ট্রেনে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়া ৮৭ জনের মার্কিন পুরোধার (Pioneer) ডনার পার্টির ৪৮জন(Donner Party) তুষারে আটকে যাওয়া সিয়েরা নিভাডায় নিজেদের মধ্যে মরে’ যাওয়াদের খেয়েই বেঁচে ফেরেন। ১৯৭২ সালে উরুগুয়ের বিমান দুর্ঘটনায় যাত্রী ৪৫ জনের মধ্যে যে ২৮জন বেঁচে  অ্যান্ডিজের হিমশৈলে আটকে পড়েন, তাঁরা দুর্ঘটনার দশম দিনে রেডিওতে তাঁদের জন্যে অনুসন্ধান বাদ দেওয়া হয়েছে শুনে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁদের মধ্যে যাঁরা মরে যাবেন, বাকিরা তাদের খেয়ে বাঁচবেন আমি সেই নরখাদকতার কথা বলছি যেখানে বিকল্প খাদ্য হিসেবে, অথবা হিংসা চরিতার্থ করতে মানুষ নরমাংস খায়।


 এই ঐচ্ছিক অর্থে নরখাদকতা নাকি আধুনিক যুগে শুরু হয়ে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পেরিয়ে একেবারে হালে অবধি চলেছে। ক্যারিবিয়ান সাগরে লেসার অ্যাণ্টিলিসের আইল্যান্ড ক্যারিব জনজাতির উপকথা/কিংবদন্তী সপ্তদশ শতাব্দীতে নথিবদ্ধ করা শুরু হবার পর নরখাদক হিসেবে তাঁরা স্থায়ী (কু)খ্যাতি পান, অনেকটাই কলম্বাসের (অ)কল্যাণে, যদিও এই উপকথাগুলির যথার্থতা এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতা সম্বন্ধে প্রভূত বিতর্ক আছে। পর্যটক ও শখের নৃতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন যে  দূর অতীতে নিউ গিনিতে, সলোমন দ্বীপপুঞ্জের কোনো কোনো অংশে, ফিজিদ্বীপপুঞ্জে, সেখান থেকে আমাজন জলনিম্নভূমি হয়ে কঙ্গো থেকে নিউজিল্যাণ্ডের মাওরি জনজাতির মধ্যে, প্রাচীন ও রোম্যান ইজিপ্টে নরখাদকতা চালু ছিল মেলানেশিয়ার কোনো কোনো অংশে নাকি নরমাংসের  বাজার পর্যন্ত ছিল। সাম্প্রতিক কালে বহু যুদ্ধে নরখাদকতা নাকি অনুশীলিত এবং ফলে নিন্দিত হয়েছে; যেমন লাইবেরিয়ায় ১৮৮০-র দশকের প্রথম দিকে প্রথম ও দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধে, ও কঙ্গোর গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের যুদ্ধে। যুদ্ধের বাইরেও পাপুয়া নিউ গিনিতে ১৯১২ সালেও নরমাংস ভোজনের রিপোর্ট ছিল। বিভিন্ন আচারিক এবং অন্যান্য কারণে মেলানেশিয়ার বিভিন্ন উপজাতির মধ্যেও। আফ্রিকায় কিছু প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সম্বন্ধে নরখাদকতার গুজব আছে, যেমন ইকোয়েটোরিয়াল নিউ গিনির টিওডোরো এনগুয়েমার (Teodoro Nguema) নাকি বিশেষ পছন্দ ছিল শত্রুদের অণ্ডকোষ; সাজাপ্রাপ্ত প্রাক্তন লাইবেরীয় রাষ্ট্রপতি চার্লস টেলরের (Charles Taylor) কথিতভাবে পছন্দ ছিল শত্রুদের হৃদয়; সেণ্ট্রাল আফ্রিকান একনায়ক জাঁ বেদেল বোকাসা (Jean Bédel Bokasa) নাকি শত্রুদের ও প্রতিযোগীদের দেহাংশ খেতেন ও পশুদের খাওয়াতেন; উগাণ্ডার ইদি আমিন (Idi Amin) নাকি শত্রুদের ও প্রতিযোগীদের দেহাংশ খেয়ে আর পোষা কুমিরদের খাইয়ে মাথাগুলো ফ্রিজারে রাখতেন! আমার এসব কথা কখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হয় নিকিন্তু ইউটিউবে ছড়িয়ে আছে তাঁদের ছবি! আন্তর্জালে ছড়িয়ে আছে তাঁদের কথা। ওয়াশিংটন পোস্ট কাগজে এই ২০১৭-র ২৯শে আগস্ট খবর বেরিয়েছিল যে দক্ষিণ আফ্রিকায় এক নরখাদক চক্রের সদস্য পুলিশ থানায় গিয়ে তিনি মানুষের মাংস খেয়ে ক্লান্ত বলে জানানোয় ওই চক্রের পাঁচ সদস্য গ্রেপ্তার হয়! এরও লিঙ্ক দিয়ে দিলাম। চাইলে দেখতে পারেন১০


তো, ভেবলেনের মতো আমরাও নরখাদকতাকে ও নরখাদকদের ঘেন্না করি, যদিও বলা হয় যে বহু সমাজে নরখাদকতা এক সাংস্কৃতিক নীতিমান। ঘেন্না করি এই জন্যে যে যে সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ বহুত্ববাদের ভিত্তি, তাকে নরখাদকতা চূড়ান্ত পরীক্ষার সামনে ফেলে। কিন্তু এখবর রাখি তো, যে নরখাদকতার অভিযোগ অনেক সময়েই ‘মিথ’? মিথের কথা এজন্য বলছি যে ক্রিস্টোফার কলম্বাস, যিনি ‘ক্যানিবালিজ্‌ম’ শব্দটির স্রষ্টা, যখন ১৪৯২ সালে ক্যারিবিয়ানে প্রথম সমুদ্রযাত্রায় যান, তখন তিনি নেটিভ গাইডদের বলতে শুনেছিলেন, বা বলা ভালো ভেবেছিলেন যে বলতে শুনেছিলেন, যে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ‘ক্যানিবেল’ নামে এক ভয়াবহ নরখাদক উপজাতি আছে। কলম্বাস এদের দেখেনই নি! নেটিভ গাইডরা সম্ভবতঃ ‘ক্যারিবেস’ (‘Caribs’)-দের কথা বলেছিল। আর কলম্বাস দিব্যি তাঁর রিপোর্টে এদের কথা লিখে দিলেন। আরতার পর থেকেই ‘canibales’ শব্দটা ‘man-eating savage’-এর অর্থে ‘cannibalism’ হিসেবে ইউরোপীয় ভাষাগুলিতে তার দীর্ঘ যাত্রা শুরু করলো। শব্দটি কাজের। কোনো জনগোষ্ঠীকে ক্যানিবাল বলে দেওয়া গেলে তার সম্পর্কে যে কোনো আচরণের, নির্মূলীকরণ অবধি সভ্য সমাজের আর দায় থাকে না। Santiago Colás লিখেছেন, ‘শব্দটা পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে ইউরোপীয়দের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছিলো, আর নতুন পৃথিবীতে দেখা পাওয়া দেশি মানুষদের গণহত্যার স্তরে বিধ্বংসের বুলিসর্বস্ব সমর্থনের ক্ষেত্রে বড় স্থান পেয়েছিল। সব কিছুর পর, এই লোকগুলি যদি নরখাদক হয় তবে কী তারা সুরক্ষার অযোগ্য নয়? তাদের অব্যাহত অস্তিত্ব কি দুই আমেরিকায় ইউরোপের সভ্যকারী ব্রতের পক্ষে ভীতিকর নয়? সেই দিক থেকে Colás-এর মতে নরখাদকতা নতুন পৃথিবীতে ইউরোপীয়দের ভুল নামকরণ ও ইউরোপীয় সহিংসকতার দীর্ঘ বিষণ্ণ বিবাহের একটি উপাখ্যান বই ছাড়া আর কিছু না হয়ে থাকতে পারে১১
Abdul Said বর্ণিত প্রাচ্যবাদের বাঁধা নিয়মে এর পর থেকে শিল্পে, সাহিত্যে নরখাদকতার উপাখ্যান বর্ণিল হতে থাকে। থিওডর দ্য ব্রাই নিজের লেখায় যে ছবি দেন ১৫৫৭ সালে ব্রাজিলে হান্স স্টাডেনের বন্দিত্বের বইতে চিত্র হিসেবে,১২ বা চার্লস ই গর্ডন ফ্রেজার ১৮৮৫-৮৯-র মধ্যে ভানুআতু-র তান্নাতে যে নরখাদক ভোজের ছবি আঁকেন,১৩ সেগুলো প্রায় ফোটোগ্রাফির  মর্যাদায় ইউরোপীয়র মত বাজারে বিকোতে থাকে।

এতে করে’ চাপা পড়ে যায় নতুন পৃথিবীতে ইউরোপীয় এবং পরে আমেরিকার সভ্যতা বিস্তারের নামে প্রাধান্য কায়েমের অনেক বড় অনেক নরখাদকতার গল্প। এই নরখাদকতার ‘trope’ কীভাবে সেই গল্পগুলোকে চাপা রেখে এগোতে  দিয়েছে, সেই কথা পরের কিস্তিতে বলবোতবে শুরু করবো বদনামি আফ্রিকান রাষ্ট্রপতিদের বদনামের পিছনে কী ছিল তা দিয়ে।


গ্রন্থ/তথ্যসূত্র 


The Theory of the Leisure  Class: An Economic Study of American Institutions and a Social Critique of Conspicuous Consumption, 1880), অনলাইনে পিডিএফ হিসেবেও পাবেন।  http://moglen.law.columbia.edu/LCS/theoryleisureclass.pdf, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ প্রবিষ্ট।    

২। ‘The use of the term “waste” is in one  respect an unfortunate one. As used in the speech of everyday life the word carries an undertone of deprecation. It is here used for want of a better term that will adequately describe the same range of motives and of phenomena, and it is not to be taken in an odious sense, as implying an illegitimate expenditure of human products or of human life. In the view of economic theory the expenditure in question is no more and no less legitimate than any other expenditure’, তত্রত্য, পৃঃ ৪৬। 

৩।‘It is here called “waste” because this expenditure does not serve human life or  human well-being on the whole, not because it  is waste or misdirection of effort or expenditure as viewed from the standpoint of the individual consumer who chooses it’, তত্রত্য, পৃঃ ৪৬।

৪। ‘wasteful consumption of goods, both as a  direct exponent of wealth and as an element in the standard of decency’, তত্রত্য, পৃঃ ৪৩

৫।‘So that however wasteful a given expenditure may be in reality, it must at least have some colorable excuse in the way of an ostensible purpose’, তত্রত্য, পৃঃ ৪৪।

৬। ‘the leisure class of today is recruited from those who have been successful in a pecuniary way, and who, therefore, are presumably endowed with more than an even complement of the predatory traits’, তত্রত্য, পৃঃ ১০৮।

৭। A. W. Brian Simpson,Cannibalism and Common Law: A Victorian Yachting Tragedy, originally published by the University of Chicago Press, 1884 (London: The Hambledon Press, 1994/2003), passim

https://en.wikipedia.org/wiki/Human_cannibalism, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯ প্রবিষ্ট। 

৯। https://www.youtube.com/watch?v=TS_ZDKMAw4I, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯ প্রবিষ্ট।

১০। (https://www.washingtonpost.com/news/morning-mix/wp/2017/08/29/5-arrested-in-alleged-south-africa-cannibalism-ring-after-man-walks-into-police-station-saying-hes-tired-of-eating-human-flesh/?utm_term=.fc68fb61ec4c), ডিসেম্বর ৩০, ২০১৯ প্রবিষ্ট।

১১। ‘The word did hard work for Europeans in the centuries that followed, figuring prominently in the rhetorical justification for their genocidal annihilation of the native peoples they encountered in the New World. After all if these people were cannibals, humans who ate human beings, weren’t they beyond salvation? Did not their continued existence threaten Europe’s civilization mission in the Americas? Cannibalism might have been nothing more than an episode in the long and sad marriage between European misnaming and European violence in the New World’,Santiago Colás,‘From Caliban to Cronus: A Critique of Cannibalism in Cuban Revolutionary Culture’ Kristen Guest, Eating Their Words: Cannibalism as the Boundaries of Cultural Identity New York: SUNY Press, 2014), pp. 129-30.

১২। সূত্র Theodor de Bry - Own work, Photography by The Photographer, Public Domain, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=44893797, জানুয়ারি ১, ২০১৯ প্রবিষ্ট।

১৩।সূত্র Charles E. Gordon Frazer (1863-1899) - Bonhams, Public Domain, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=17330887), জানুয়ারি ১, ২০১৯ প্রবিষ্ট।


(ক্রমশ)



শিবাংশু দে




হরীতকী ফলের মতন   


        

(৩)

          
এরূপ বিরহ ভালো; কবিতার প্রথম পাঠের
পরবর্তীকাল যদি নিদ্রিতের মতো থাকা যায়,
স্বপ্নাচ্ছন্ন, কাল্পনিক; দীর্ঘকাল পরে পুনরায়
পাঠের সময়ে যদি শাশ্বত ফুলের মতো স্মিত,
রূপ, ঘ্রাণ ঝরে পড়ে তবে সার্থক সব ব্যথা,
সকল বিরহ, স্বপ্ন; মদিরা বুদ্বুদের মতো
মৃদুশব্দে সমাচ্ছন্ন, কবিতা, তোমার অপ্রণয়
হাসির মতন তুমি মিলিয়ে গিয়েছ সিন্ধুপারে...
      
অনেক ছোটো ছিলুম তখন বাবার বিশাল বইয়ের ভার গুছিয়ে রাখার দায় নিজেই নিয়েছিলুম জাস্ট বই ঘাঁটার আনন্দ পেতে পদ্যের বইগুলোর মধ্যেও তেষট্টি সালের ছাপা এই সংকলনটি  ছিলো প্রায় নেই হয়েই অনেকটা পাড়াগাঁর বাসর ঘরের সবচেয়ে গোধূলি মদির মেয়েটির মতো বারো তেরো বছর বয়েসে নিশ্চয় বিনয় মজুমদারকে ছুঁয়ে থাকার মতো এলেম আমার ছিলো না কিন্তু পদ্যগুলি ছিলো শুধু পড়ে যাওয়ার জন্য সব তন্তুজাল উড়িয়ে দিয়ে আটপৌরে বা তৎসম শব্দগুলিকে হৃদমাঝারে গড়িয়ে দেবার যে মসৃণ পাকদন্ডি বিনয় আবিষ্কার করেছিলেন, তার জাদু সেই বয়েসেই অনুভব করেছিলুম তোমার মোহন রূপেকে রয় ভুলে...? বাবাকে প্রশ্ন করেছিলুম এই কবিতাগুলি কবে বুঝতে পারবো? তিনি বলেছিলেন, বোঝার চেষ্টা কোরো না, কাছে যাওয়ার কথা ভেবো তার জন্য সময় দিতে হবে, নিজেকে দিতে হবে মগ্নতা বৈষ্ণবের কৃষ্ণপ্রাপ্তির মতো অনুভব হবে একদিন, সেটাই কবিতার কাছে আমাদের প্রার্থনা

তারপরেও সম্ভবত সিগনেট থেকে একটা তন্বী সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছিলো, সেটা আমরা আমাদের শহরে পাইনি


এটা নিয়ে একটা তুমুল তর্ক চলতো জীবনানন্দের আসল উত্তরাধিকারী কে? দাবিদার আমার প্রিয়তম দুই কবি, বিনয় ও শক্তি তখন কবিতাকে বা বলা ভালো বিভিন্ন 'রবীন্দ্রঅনুসারী' বা অন্যরকম মূঢ় তকমাও ছিলো খুব সুলভ একটু সরব হয়ে মানুষের দুঃখ সুখ নিয়ে চর্চা করতেন যেসব কবি তাঁরা ছিলেন 'সংগ্রামী', কেউ ছিলেন মাতাল, আর কেউ বা পদ্যবণিক বুদ্ধদেব বসুর 'মতো' যাঁরা, তাঁরা 'বৌদ্ধ' আর বিষ্ণু দের কাছাকাছি ছিলেন 'বৈষ্ণব'রা

জীবনানন্দ যে ধারাটায়, অর্থাৎ পদ্যের যে প্রতিমায় শেষপর্যন্ত স্থিত হয়েছিলেন তা কিন্তু একেবারেই 'ঘোর' সৃজনী পন্থা ছিলো না তাঁর জীবৎকালে তাঁর সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে, পরবর্তীকালে দেখি সবই সত্যের থেকে দূরে তাঁর কাছে শব্দ, শব্দবন্ধ, রূপক, প্রতীক, প্রত্নচিণ্হ সবই আসতো অনেক শ্রমের পর কিন্তু কবিতাটির অবয়ব স্থির হয়ে গেলে কোনও জীবনচিণ্হ খুঁজে পাওয়া যেতো না একজন প্রকৃত শিল্পীই পারেন এরকম একজন সফল মৃৎশিল্পীর প্রতিমায় পাওয়া যায় না খড়ের ভঙ্গুর নির্মাণ বা একজন সফল কণ্ঠশিল্পীর তানকারি পরিবেশনায় থাকে না অকারণ সরগমের চমক দেওয়া ভেল্কি

সমর সেনের সঙ্গে সুনীল গঙ্গো বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে অলোকরঞ্জন, এভাবে সমান্তরাল খোঁজার খেলা ছিলো পদ্য পাগলদের মধ্যে জীবনানন্দের সঙ্গে বিনয় বা শক্তির সমান্তরাল টানা ছিলো অত্যন্ত সুলভ ব্যসন এর কারণ কি যেহেতু জীবনানন্দ জীবৎকালে ছিলেন একজন দুরূহ কবি বা তদুপরি একজন নিজের মুদ্রাদোষে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া এক মানুষ, তাই কলকাতার মহানাগরিক মননের অংক তাঁকে নিজের সুবিধের জন্য একটা বিশেষ গোত্রে ফেলে দিলো। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, জীবনানন্দ একজন আদ্যন্ত কবি এবং কবিতা ছাড়া তিনি কিছু লেখেন না। অর্থাৎ,একজন সাবেক 'কবি'র  ছাঁচে ফেলা হলো তাঁকে, আলুলায়িত যুক্তিবোধও  বলগাহীন আবেগতাড়িত শব্দের বাজিকর হিসেবে, যেটা হয়তো কবিদের সম্বন্ধে 
সমাজের অধিকাংশ লোকেরই ধারণা। কবিও যে সর্ব অর্থে  একজন শ্রমিক, সেইবোধ বেশ বিরল। তাঁর ইতিহাসচেতনা, সামাজিক বোধির স্বরূপ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 
মাপের একজন ধীমান কবিও বুঝতে পারেননি। অন্য পরে কা কথা? তথাকথিত
 'বামপন্থী' বিশ্লেষণে অবক্ষয়ের সাবেক ছাপ দাগানো হয়েছিলো  তাঁর উপর। তাই 
জীবনানন্দের প্রকৃত উত্তরসূরি হয়ে আসেন একজন 'পাগল'  একজন 'মাতাল', দুই বরেণ্য উৎকেন্দ্রিক,  সরকারে দরকার নেই, তাই নিজের সুড়ঙ্গে  স্বচ্ছন্দ থাকাই তাঁদের  ভবিতব্য। তাঁদের স্ব আরোপিত ট্র্যান্সের মুগ্ধ অমরাপুরীতে স্বপ্ননির্বাসন দেওয়া হলো?

কবিতা পড়ার বা শোনার আগে এতো কচকচি কি অনিবার্য? এতো সব নিয়ে চর্চা না  করলে, ঘাম না ঝরালে কি কবিতা উপভোগ করার অধিকার জন্মায় না? কবিতা তো এভাবেই মানুষের থেকে দূরে চলে যায়।

পর্ণা আমাকে এই প্রশ্ন করেছিলো একদিন।কিছু সন্দিগ্ধ, কিছু নিরাশ। আমি ভাবি, 
সত্যিই তো, যাঁরা পদ্য আর লিটল ম্যাগ নিয়ে  সতত নানা নিরীক্ষায় ব্যস্ত তাঁরা ছাড়া কি কবিতায় আর কারো অধিকার নেই?  জনপ্রিয় না হলেই কি তা 'প্রকৃত' 
কবিতা হবে? অংকটা কি এতই সহজ?


()

কিন্তু কোথায় গেলো সে আজকে? নিশ্চিত  বলেছিলো আসবে, কিন্তু এতোক্ষণেও খুঁজে পেলুম না। হঠাৎ দেখি পরমা, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি এগিয়েযেতে নিজেই বলে উঠলো ,
সুরঞ্জন, অই খানে যেওনাকো তুমি,  বোলোনাকো কথা অই বালিকার সাথে...

 নিশ্চয় কিছু জানে...
কখন এসেছো?
তুমি কি আমাকে জিগ্যেস করছো?
না, তোমাকে নয়, নিস্তারিনী পিসিকে জিগ্যেস করছি...
তাহলে তাকেই জিগাও, আমি পালাই...
বললো, কিন্তু দাঁড়িয়েও থাকলো
আমি বলি, কী হলো, পালাও
না, আমি অপেক্ষা করছি সেই প্রশ্নের, যা তুমি এখনও করোনি...
আমার তো কোনও প্রশ্ন নেই...
তাই, বেশ... ঠিক আছে আমি ওখানে গান শুনছি, ইচ্ছে হলে এসো...
বেশ চলো, কিন্তু আমাকে দেখলে অসিতদা আবার গানের জন্য টানাটানি করবে...
অসিতদা তোমার নাগাল পাবেনা আজ...

একটু এগিয়ে দেখি ঘাসের উপর তিনি বসে আছেন যেন গজেন্দ্রগামিনী। গান শুনছেন। বড্ডো ভিড় তাই দূর থেকে দেখা  যাচ্ছিলো না।
পরমা বললো, বসবে না উঠবে?
বালিকে, গুরুজনদের সহিত পরিহাস! নরকগামিনী হইবে ...
তাতে আর কী? ওখানেও তো তোমায় পাওয়া যাবে...
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে...
বস করো, নয়তো আমার বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে যাবে...
দেখতে পেয়ে উঠে এলো সে। পরমাকে প্রশ্ন,
কীরে কখন ফিরবি?
সেটা তো তুই বলবি। আমি তো ভাবলাম ফেরার কোনও সিন নেই এখন...

সই'দের রহস্যালাপ। আমার তো কোনও ভূমিকা নেই এখানে, এখন অপেক্ষা করি, বালিকাকে বিদায় দেবার
বহুপরে পুনরায় দর্শনের অপেক্ষার মতো-
হয়তো সর্বস্ব তার ভরে গেছে চমকে চমকে।
অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহব্যথা ভালো।'
আমার দিকে ফিরে প্রশ্ন, তোমার কতোক্ষণের কাজ আছে এখন?
আমার তো কোনও কাজ নেই...
তবে?
তুমিই তো কাজ...
আমি...? বাত কুছ হজম নহি হুই...
আপকি মর্জি...
তবে চলি এখন...
'...বেশ, তবে চলে যাও, তবে যদি কোনোদিন কোনো
লৌকিক সাহায্যে লাগি, ডেকে নিও...'
তোমার হাতে কী?
ফিরে এসো চাকা...
চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মুখ, 'পেয়েছো শেষ পর্যন্ত! ওফ... দারুণ ব্যাপার'
গ্রহণ করহ,
করিলাম...
নামপাতাটি উল্টিয়েই 'উৎসর্গ গায়ত্রী চক্রবর্তী', নিচে লেখা, 'উৎসর্গ, পর্ণা'।
তুমি আমাকে 'উৎসর্গ' কী করে করলে? উপহার বলতে হতো... আচ্ছা গায়ত্রী চক্রবর্তী কে? কিছু জানো?
বোধ হয় সামান্য জানি। উনি বিনয়ের পর্ণা।
ধ্যাৎ...
'...একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো- এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল।...'



এই স্মিত দৃশ্য, এই আপক্ক রক্তিম দ্রাঘিমার ছবি দেখার জন্যই তো সারা সন্ধে অপেক্ষা করেছিলুম।

(ক্রমশ)