কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৯৬


সাধারণভাবে আমরা সবাই এই সত্য জানি যে, জীবনের তাৎপর্য হচ্ছে চলা, আর থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু। আবার এই সত্য শুধু প্রাণী জীবনের জন্যই নয়, বরং অনন্ত বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের জড় পদার্থের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, কোনো বস্তুই স্থিরভাবে অবস্থান করে না, বরং তা সর্বদা গতিশীল। তবে এটা হতেই পারে যে, তার গতিপথ একমাত্র বিকাশের পর্যায়েই থাকে না, বিনাশের পর্যায়েও থাকে। তাই কোনো কিছুই অপরিবর্তনীয় নয়, সব কিছুই পরিবর্তনশীল। এবং একথাও আমরা সবাই জানি যে, এভাবেই পৃথিবীর ইতিহাসে মানবসভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে এবং সমাজ গঠিত হয়েছে ও পরিবর্তিত হয়েছে। আর এই যে সমাজ তথা সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে, তার অনুষঙ্গে অনেক কারণ ও উপাদান থাকলেও, মূলত একটি উপাদান এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা সক্রিয় থেকেছে, তা হলো ভ্যালুজ বা মূল্যবোধ।

আমরা যদি সমাজ তথা সভ্যতার ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখি, লক্ষ্য করব, পরিবর্তনশীল সমাজ ও সভ্যতায় মূল্যবোধও কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায় তার নিজস্ব মূল্যবোধ থাকে। সমাজে বসবাসকারী মানুষেরা সেইসব মূল্যবোধকে স্বীকার করে তা পালন করে। ব্যক্তিগত ব্যবহারে ও আচরণে সেই মূল্যবোধের অবমাননা হলে সমাজ তাকে তিরষ্কার করে, শাস্তিও দিতে পারে। কিন্তু সেই সমাজব্যবস্থা যেহেতু সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়, তাই নতুনতর সমাজব্যবস্থায় মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। পুরনো মূল্যবোধ অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী সেইসব মানুষদের, যাদের জীবনকালেই এই পরিবর্তন সংঘটিত হয়, অর্থাৎ সমাজ পরিবর্তনের মধ্যবর্তী অবস্থানে যারা জীবিত থাকে। পুরনো সমাজব্যবস্থার সঙ্গে নতুন সমাজব্যবস্থার চিন্তা-ভাবনার দ্বন্দ্ব, ব্যবহার ও আচরণের দ্বন্দ্ব, জীবনশৈলীর দ্বন্দ্ব তাদের বিচলিত ও বিভ্রান্ত করে তোলে। তারা একইসঙ্গে নতুনকে আঁকড়ে ধরতে চায়, আবার পুরনোকেও ছাড়তে চায় না। বিশেষত  ভ্যালুজ বা মূল্যবোধের বদল তাদের দিশাহারা করে তোলে। আর এই দোলাচলের মধ্যে জীবনকাল অতিবাহিত করতে করতে কখনও বা হার মানতেও বাধ্য হয়। তবু চলাই যেহেতু জীবনের তাৎপর্য, তাই তাকে চলতেই হয়, কেননা থেমে যাওয়া মানেই যে মৃত্যু!   

হৈমন্তিক শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই সবাইকে। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব


চিত্তরঞ্জন হীরা

 

সিঁড়ি ভেঙে চলা যে জীবন : কবির জীবন


(চিত্র-ঋণ : আন্তর্জাল)
 

শূন্য ও অশূন্য। ঝুলে আছে জীবনমৃত্যুর মাঝ বরাবর। অশূন্যের গায়ে শীতের আলোয়ানের মতো এক নির্লিপ্ত আকাশ। সে জাগতিক আলোর বাইরে দাঁড়িয়ে যেন বিশ্বনাট্যের মহড়া দেখছে। মোহাবিষ্টের রাত্রিজগৎ। এতো যে লীলাভৈরব, সেখানে তার কি কোনও ভূমিকা থাকছে না! এদিকে শূন্যের একখানা সিঁড়ি, নেমে আসছে নিবিড় নৈর্ব্যক্তের দিকে। এই নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে চরাচরের আনন্দ মিশে এক স্বাধীন সম্পর্ক। যাঁরা এই নিবিড়ে একান্ত হয়ে উঠতে চান, তাঁদের ভেতরে নিজের অজান্তেই বিশেষের জন্ম হয়। বিশেষ হলো সত্তার এক রূপ, যে তাড়িত করে সমস্ত 'আমি'র ভিন্ন 'আমি'কে তাকে খুঁজে বের করতে মন ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে। এই খোঁজ হলো শূন্যের সেই প্রথমাংশ। অর্থাৎ বিস্ময়ের বোধ। অরূপের জিজ্ঞাসা। আত্মখননের পথ ধরে যার গভীরে নেমে যাওয়া। গভীর থেকে আরও গভীর। এক জীবনে যে খননের কোনও শেষ নেই। আবার এই খনন শুরু হলে থেমে থাকারও কোনও উপায় থাকে না। নিজের সঙ্গে নিজে, ভেতরের জিজ্ঞাসাগুলো যেন আন্তরিক হয়ে ওঠে।

তাহলে কবিতা কোথায় থাকে! বা কবিতার ভেতরবাড়ির আলো-অন্ধকার! ছায়া ছায়া নীরবতার গায়ে শিশির লাগছে। হিম বাতাস। কেউ দেখছে না বাতাসের গায়ে উলঙ্গ আঙুলের স্পর্শ রচনা করে চলেছে একটা সরুপথ। এই পথ কতদূর বিস্তৃত! তাকে কি আমাদের পক্ষে সহজে উদ্ধার করা সম্ভব! আমরা সেভাবে বলতেই পারি না। কারণ কেউ তো সেভাবে দেখছে না। এই দেখাটাই এক জিজ্ঞাসা। সম্ভব-অসম্ভবের একটা দোলায় দুলছে। তার মধ্যে আরও আরও বিস্ময় সন্ধ্যার আভাস নিয়ে জড়ো হয়। দূরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকার যেন পা মিলিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। বিস্ময় আর বিস্ময়। জিজ্ঞাসাকে সাজাতে বসেছে রাত্রি তার নিজের অলংকার দিয়ে। তার জন্যেও অস্থির হচ্ছে মন। না-পারার ঢেউ যতো আছড়ে পড়ছে  বুকের উপর, অস্থিরতাও ততো তীব্র হয়ে উঠছে। ব্যাকুলতার কি এবার যাত্রা শুরু হলো! সেকি এবার চলেছে অনির্দিষ্টের দিকে!

এভাবে বললে কি সবটুকু বোঝা যায়! আসলে বোঝার নয় বাজার। কতটা ভেতরে বাজলো! আমরা জানি না, এই যে জীবন, সে কতটা কবিতার ভেতরবাড়ির আলোবিন্দুকে কাছে পায়! কতটা অন্ধকারের রহস্যকে উদ্ধার করতে পারে! প্রতিটি শুরুর আগে একটা শুরু থাকে, একটা আরম্ভ। একটা পথ এগিয়ে চলেছে নানা বাঁক নিয়ে। জীবনের গভীরে যখন সত্তার নড়াচড়া শুরু হবে সেই হলো আরম্ভ। সত্তাকে সংসারের বাজারি হিসেব ছেড়ে উন্মুক্ত পথের বাঁকে এসে দাঁড়াতে হবে। কানের মধ্যে ঝুম ঝুম অপরিচিত শব্দ নিয়ে। এই অপরিচয়ও এমন এক উপাদান যা একসময় অপূর্ণ থেকে পূর্ণতার দিকে ঠেলে দেয়। এখন এক 'আত্ম'র জন্যে একাকিত্বের মহার্ঘ ধ্যান সেরে নেওয়া। যে চাইছে বীজের আশ্রয়। বীজ হলো পাখপাখালির অচেনা গুঞ্জন থেকে উঠে আসা আত্মার 'অক্ষর'। অন্তর্গত ধ্বনির অক্ষর। মূলে বিষাদের নৈর্ব্যক্তিক ঘোর। যখন সে এসে দানা বাঁধে, তখনই ঘনিয়ে আসা রাত্রির অন্ধকারে তার হয়ে ওঠার চাকাটা ঘুরতে শুরু করেসৃষ্টির উন্মাদনা শুর হয়

এই উন্মাদনার মধ্যে নতুন জন্মের আয়োজন সংঘটিত হচ্ছে। স্রষ্টা একবার নিজেকে ভাঙছেন একবার গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। যেটুকু ধরাছোঁয়ার অতীত, তাকে বর্তমানে টেনে আনার চেষ্টা। হয়তো পুরোটাই ব্যর্থ হলো। তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। ব্যর্থতাও সংসারের আরেক উপাদান, ধূপ-ধুনো-চন্দনের মতো। কবির নিঃসঙ্গের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। প্রতিটি ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নেমে যাওয়া। যেন আত্মহননের পথ তাঁকে ডেকে চলেছে বিযুক্তির দিকে। যা তাঁকে অন্য জীবনের সন্ধান দেয়। এই পথই তাঁর নিয়তি। শব্দের ঘর, শব্দের সংসারে তাঁর নাড়া বাঁধা। এই অকথিত ধ্বনিপুঞ্জ প্রতিমুহূর্তে কবিকে নির্দেশ পাঠাচ্ছে। কবি সেই নির্দেশ মেনে বরণ করে নিচ্ছেন সৃষ্টির অমোঘকে গূঢ় বেদনার মতো। হ্যাঁ, চূড়ান্ত বেদনা থেকে যে আনন্দ, তাই-ই অমোঘ। একবার সত্তা যদি জাগে, তাহলেই চক্রব্যূহে ঢুকে পড়া। ঢুকে পড়লে এর থেকে নিষ্কৃতি নেই। নিজেকে মুক্ত করার আর কোনও উপায় নেই। ধারণার বাইরেও একটা জগৎ থাকে।‌ সেই জগতে প্রবেশের জন্যে সবার আগে বেদনার গহ্বরটি খুঁজে বের করতে হবে। জীবনের সমস্ত সাধারণসামগ্রী সরিয়ে, সমস্ত আগাছা সরিয়ে, জঞ্জাল সরিয়ে হাতি ধরা ফাঁদের মতো সেই গহ্বরে ঢুকে পড়তে হবে শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে। সম্পর্কের দ্রাঘিমায় রেখাগুলো যতদূর বিস্তৃত তাকে ছাড়িয়ে, আরও দূর সীমানার বাইরে যেতে যেতে নিজেকে নিক্ষেপ করতে হবে

কবি বলছেন

দু-চোখে কাপড় বেঁধে

ক্রাচ ঠুকে ঠুকে এসেছি এতটা পথ

দেখেছি নৌকার কাঠে গূঢ় অন্ধকার!

মাঝি নেই, হাল নেই, স্রোতের স্তব্ধতা

(দেবজ্যোতি রায়)

তবু চলা কিন্তু থেমে নেই। নিরন্তরের এই যাত্রায় গন্তব্য অনির্দিষ্ট হলেও লক্ষ্য একটা রয়েছে। তা হলো যেতে যেতে স্ফূট আর অস্ফূটের মধ্যে যে শিহরণ, তাকে বীজের রূপে মাটিতে ধারণ করা। যা থেকে অঙ্কুরিত হবে নিজের আখরগুলো। এক আত্মকীয় অস্তিত্বের ছায়া যেন আকার পেতে থাকে। ডালপালা বিস্তারের বাসনা জাগায়। সাধ যেন সাধ্যের বাইরে না হয়। একে যদি আসক্তি বলা হয় তো আসক্তি, লোভ বললে লোভ। কিন্তু প্রকাশের জন্যে এটুকুই তাঁর নিজের। বাকি যা সব এই মহাবিশ্বের। নিঃসঙ্গের মধ্যে আসঙ্গ এই 'আমি'র আমিত্ব 'আমি'কে দেখাউন্মোচন করে দেখা। সত্তা এবং ব্যক্তিত্বের গভীরে নিহিত যে সত্য তাকে জাগিয়ে তোলা। এক্ষেত্রে সেই নিরাসক্তি নিয়ে একটা সংশয় জন্ম নিতে পারে। তাহলে আমরা বলবো এ হলো পরম আসক্তি। আত্মপীড়নের অরূপ থেকে যার জন্ম হয়। যাত্রা থাকে অপরূপের অভিমুখে। তখন চোখের মধ্যে আরেকটা চোখের জন্ম হয়। সেই চোখ সীমাহীন একাকিত্বময় সপ্রাণ জীবনকে দেখতে পায়।

তবে 'উন্মোচন' আর 'জাগরণ' কিন্তু এক নয়। নিজেকে খোঁজার যে তাগিদ বা আসক্তি তা হলো 'জাগরণ'। এই আত্মসন্ধানের পথ ধরে গভীরে যেতে যেতে তাকে পাওয়ার যে ধ্যান তা হলো 'উন্মোচন'। এ দুয়ের মিলে কবির সত্তায় শুরু হয় নক্ষত্রের আলোড়ন। সে ভাষা পেলে তবেই প্রকাশ। না পেলেও পাওয়ার ইচ্ছায় প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। ভাঙার মধ্যে গড়ে তোলার বাসনা, সেও এক কাম। সৃষ্টি এবং নির্মাণের শঙ্খলাগা মাধুর্য। এক অবাক করা ধ্বনির গুঞ্জন উঠছে। বীজের আভাস ঘটছে। কবির জীবন এই বীজের জীবন। স্বপ্ন দেখে মন আর চোখ দেখে নিসর্গের বাস্তবতা। যার নির্দিষ্ট কোনও আকার নেই। কবি যা কল্পনা করেন সেটা তার বাস্তব। কারণ যে বাস্তবকে কবি দেখেন তার স্বরূপ বাইরের প্রকৃতি থেকে পাওয়া নয়, ভেতরে ভেতরে গড়ে ওঠা বাস্তবতা।

এই তো শব্দপ্রবাহের সঙ্গে উছলে উঠছে নদী। সঙ্গে সময় চলেছে কম্পমান একটি রেখা বরাবর। আরেকটি রেখা চলেছে কবির অনুভবতরঙ্গ ধরে। সমান্তরাল এই চলনের মধ্যে ধরা থাকে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ-এর জাগতিক বোঝাপড়া। রাত্রি যখন ঘন তমসার বুকে নিজের আসন পেতে বসে তখন নৈঃশব্দ্যের আলো এসে তাদের বাসর সাজায়। কবি দেখছেন এই দৃশ্য। এইটুকু সম্বল করে তাঁর বাঁচা। বহতার মধ্যে একজীবনের দুটো খসড়া। এটাই কবির রচিত পৃথিবী। সৌন্দর্য এবং মাধুর্যের সমস্ত উপকরণ দিয়েই তাঁর রচনা –

এখানে এলেই স্নায়ুপথ পিছলে এক্কেবারে গহ্বরে। আর কেবলই পিছিয়ে যাই বিচলিত

আমি, পথ-পথালি নিয়ে। ঝোপ বুঝে রঙের পেছনে লুকাই এই নিরাপদ। দুকূল কীভাবে

সামলাব? এখানেই আমি মলম পরিয়ে দমকা হাতে পাই। ছাতার দূরত্ব মাপি।

(কল্যাণী লাহিড়ী)

কবি দেখলেন এবং এভাবেই আঁকলেন। এই তাঁর রূপাভাস। যা প্রত্যক্ষে হবে না। কেবলমাত্র অনুভবে। সময় এর মধ্যেই অবস্থান করছে। এটাই কবিতার বিশ্ব এবং কবির চরাচর। এই নিবেদন। এছাড়া আত্মের আর কোনও উৎসর্গ নেই। অনন্তের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কবি বহুবিচিত্র বাঁক নিয়ে সেই রেখার উপর হয়তো একটু দাঁড়ালেন, তারপর অবলীলায় পেরিয়ে গেলেন এক একটা বিপজ্জনক খাদ। নির্মিত হতে লাগলো অনির্ভর কান্নার দুরূহ। একটা ঝরঝর, প্রবাহিত হচ্ছে অদৃশ্য থেকে, তারপর উৎসারিত হলো। অজ্ঞাত বিষণ্ণকে পাশ কাটিয়ে অন্ধকারের মেধায় আশ্রিত  যে আলো তাকে ধরলেন, নৈঃশব্দ্যের গভীরে দুলতে থাকা ছায়াকে ধরলেন। কালের গর্ভে ঘুমিয়ে পড়া পরিত্রাণকে ডেকে তুললেন। তারপর তার হাত ধরে হেঁটে চললেন আরোগ্যভূমির দিকে।

কিন্তু এই আরোগ্যভূমিটি কোথায়! যেখানে কবি কল্পনায় বিচরণ করতে চান। সত্তা যেখানে নিরাময়ের সন্ধান দেয়। কবি যদি নিজের সঙ্গে কথা বলতে না পারেন তাহলে এই নিরাময়ের সন্ধান কোথায় মিলবে! যখনই ভেতর দরজাটি খুলে সামনে এসে দাঁড়াবেন, নিরাময় এসে হাত ধরবে। আমরা বলছিলাম স্ফূট আর অস্ফূটের কথা। যেখানে জ্যোৎস্না-আলোকিত নীরবতা খেলছে অন্ধকার নিয়ে। নিরাময় এসে দাঁড়ায় এদের মাঝখানে। শব্দের চলাচল শুরু হয়। অথচ যার কোনও শুরু নেই, শেষও থাকে না। শুধু প্রবাহিত নৈঃশব্দ্যের মধ্যে কথার ঝরনা।

কথা তো কত রকমেরই হয়। দুটি শব্দের মিলন আর মিলিত প্রাণের বাসনায় নিজেকে জাগিয়ে তোলা। জাগরণের ভোর নিয়ে বসা। ঘোরানো সিঁড়িটি অতলে নামছে আর কথা হচ্ছে দুজনের। যেন মহাকাব্যের আলো ফেলে ফেলে আজও চরিত্ররা কথা বলে। বলছে

যুযুৎসুর মায়ের নাম কি তুমি জানো?

এই মহাজগতে নিমিত্তমাত্র জীব। তার নামে কী এসে যায়!

তাহলে শিরোনামহীন রমণের মধ্যে তুমি তাকে কতটা পেলে!

প্রতিটি সৃষ্টির মূলেই রমণের অভীপ্সা। আচ্ছা, অনুভূতির কোনও নাম হয় নাকি!

এই যে অশ্রুপাত বা অপ্রকাশের প্রকাশ সেখানে নির্বাণ আছে কিন্তু মুক্তি নেই। রথের চাকা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে মাটিতে, ডুবে যাচ্ছে আলো "পিতার মাংসের আলো"। বেলা যায়। বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকে সূর্য। তার শরীর থেকে একটু একটু করে খসে পড়ে তেজ-আভা-দীপ্তি-অহংকার। শুধু পাঠ নয়, সেই রাত্রির অষ্টমীর চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে কেউ আমাদের অনুভব করতে শেখায় মহাবিশ্বের সমস্ত যুদ্ধই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আর সমস্ত কান্নার রঙ হলো 'উপলব্ধি'। আত্মপ্রশ্নে গড়ে তোলা একান্ত ব্যক্তিগত নির্জনে নিজের মুখোমুখি হওয়া।

এভাবেই কথারা আত্মজীবনের সংকেত পাঠায়। এভাবেই প্রতিটি আকষ্মিকতার মধ্যে নামহীন প্রয়োজনের বোধ। সমস্ত কবিরই ভেতরবাড়ির যন্ত্রণা এক, বিষাদ এক। সমস্ত মাতৃত্বের যেমন গর্ভযন্ত্রণা। প্রতিটি আমি বা আমির আমিত্ব যখন আমিহীনতার দিকে যাত্রা করে তখনই কবিতার মুহূর্তের জন্ম হয়। সে এক ক্ষরণ। ক্ষরণের তীব্র অভিঘাত বাজিয়ে চলেছে নৈঃশব্দ্যবীণার তার –

কাঠের ওপর জঙ্ঘা, বাকিটা নারীর; হাঁটলে সম্ভাবনা

উল্টে পড়ে, তখনই তরল হয়ে যায়

আগুন লাগিয়ে দেখিনি কতটা পোড়ে

কতটা সিল্যুট, কুঠার ঘামে না কখনো

আমরাই ক্লান্ত হই, হাতে ঘষে বিভূতি বানাই

(অনিন্দ্য রায়)

এভাবেই চোখের বাইরেই ভেতর দেখার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়। জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি এই অবর্ণনীয় দশার অন্য কোনও ব্যাখ্যা নেই, কারণ এর কোনও আকার নেই, বাস্তবতা নেই, অবস্থান নেই। তবু সেখানে দাঁড়িয়ে একজন কবি নিজেকে খুঁজছেন, কথা বলছেন শব্দের সঙ্গে। শব্দ তাঁকে অহমের অরূপবেদনা থেকে অপরূপের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। বলছে – ওঠো, জাগো, দেখো। এই অব্যক্ত বেদনাই অক্ষরের নির্যাস।

দেহ, দেহের মধ্যে তমসার ঘরগেরস্তি। যেখানে নির্জনতা এবং কোলাহল মেশামেশি। যেন দুধে জলে মেশা। এখন দুধ থেকে জলটুকু সরাতে হবে। দুধ ও জল – যে যেমন বুঝবেন। কোলাহল ও নীরবতা, তমসা ও আলো। এরই মধ্যে সৃষ্টির অন্ধকার এসে উৎসার ঘটায়। অক্ষরজন্মের প্রস্তুতি নেয় সাদাপাতা। কবির আশ্রয়। এই আশ্রয় হলো বীজসত্তা। সমস্ত বিভ্রম মুছে যাবে যখন বীজের মধ্যে মহাবিস্ফোরণের সম্ভাবনা জেগে উঠবে। দুলে উঠবে শ্রমের অধিবাস নিয়ে ক্ষেত্রভূমি। মিলনের উৎসব শুরু হবে। অর্থাৎ জাগরণ। অনেকটা সঙ্গমের মতো। প্রতিবার মিলনের আগে আত্মহত্যাঠোঁট চুমু খায় মৃত্যুকে।

এভাবেই রাত্রিময় নীরবতা সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে – কেন মিলনকালে একবারও মনে হয়নি এই অনামিকা নারীটির নাম জানতে চাওয়াও এক ধর্ম! অন্তত তার অস্তিত্বের সম্মান জানানোর জন্যে !

আপনি ভেবে দেখুন অনামিকাও একটি নাম হয়ে ওঠে।

আচ্ছা, প্রতিটি আকস্মিকতার মধ্যে কি সৃষ্টির রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে?

এ প্রশ্ন সেই রহস্যজন্মের শুরু থেকেই। মানুষ যেদিন আগুন জ্বালতে শিখলো। যে কোনও আত্মনিবেদনই হলো সঙ্গহীন আসঙ্গের নিভৃতলোক। কোনও জয় নেই, পরাজয় নেই শুধু খনন আর খনন। আত্মভ্রমণের পথ ধরে কবি খুঁড়ে চলেছেন আত্মভূমিকে। ভেতর বাহির নিয়ে দুই সত্তার প্রবল অভিঘাত। এই অভিঘাত আসলে কোনও দ্বন্দ্ব নয়, সংঘাত নয়। একটা চলা রয়েছে, যেখানে আমাদের যাত্রাধ্বনিটুকু বাজে আবহমান মিলনবাঁশির সুরে। তবে সুরটাকে ধরা যায় না সেভাবে। শুধু বেজে যাওয়ার ধ্বনিটুকু কানে এসে বাজে। আমরা শব্দের মধ্যে নৈঃশব্দ্যের কথা যেমন বারবার বলতে চেয়েছি। নীরবতার আশ্চর্য সরগম তোলা। কবিকেই সেসব উদ্ধার করতে হয়। এই উদ্ধার হলো এক যাত্রা। জীবন থেকে মহাজীবনের পথে পাড়ি দেওয়া। যেতে যেতে বহুমিশ্ররাগে, ছায়াচিত্রের আবহে ফিরে ফিরে দেখা – কে আমি! কেন আমি! কোথায় আমি!

রূপ অরূপের খেলাটা রূপসাগরে অতলডুবের মধ্যে নিহিত। এই জগতের সমস্ত রূপ সেই জলের ধারণায় অসীম। তার দিকে তাকিয়ে একটা জীবন চলতে চলতে জীবনের মধ্যে মৃত্যুকেও অনুভব করা যায়। যে পাখিটা এই মাত্র আকাশে ডানা মেলে দিলো তাকে যেমন কবি একটা রূপের মধ্যে দেখলেন তেমনি অরূপেও দেখতে পারেন। একটা বাইরের, একটা ভেতরের। আমরাও নিরন্তর ভেতর থেকে বাইরে, বাইরে থেকে ভেতরবাড়ির কোণে কোণে একটা বোবাসুর তুলে চলেছি। কিন্তু বুঝে উঠতে পারি না তার কোনও পায়ের ছাপ কি পড়লো! এও জানি না এই যে জীবন তাকে ঠিক জীবন বলা যায় কী না! একমাত্র কবিই জানেন এই আপাত পাগলপারা রহস্যজাল কতদূর বিস্তার করে আছে! যার কোনও নির্দিষ্ট অর্থ হয় না। শুধু এক নিহিতার্থের ঘাট। নিরালা আসন পেতে বসা। কবি হয়তো কিছুটা উদ্ধার করতে পারলেন। হয়তো এভাবে

তেপায়ার নীলে শুয়ে। সময় গড়াচ্ছে নীচে সান্ধ্যভাষায়

আর এক অদৃশ্য-পা আমার দোলনা। শূন্যে টাঙানো

দুলে দুলে দেখি দূর বজরা চলেছে

নদী বাঁকে-বাঁকে বনের জানালা। তীরের প্রবাহে ভেসে গহনশ্মশান

(সমীরণ ঘোষ)

এই নিহিতার্থের ঘাটটি কি দেখা যায়! কিন্তু তার অস্তিত্ব বর্তমান। তবে একে ঠিক গন্তব্য বলা যায় না। অগন্তব্যের অন্ধকার রাত্রির হাড় বাজিয়ে মহাভোজের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে। রণক্ষেত্র বেদনার্ত হচ্ছে। তারই মধ্যে আলো বয়ে ফিরছেন একমাত্র কবি। শ্মশানের গহন জুড়ে সেই মহাভোজের আরতি চলছে। এই মহাভোজ হলো নিস্তব্ধতার সমারোহ। শব্দের মধ্যে যেমন নৈঃশব্দ্যের আরোহণ, এ তারই এক অরূপমাধুরী। তিলমাত্র কথার ভেতর যেমন এক বিস্ফোরণের আবহ, তাকে অনুভবের শ্রম চিতার মতো জ্বলছে, অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। নিরাভরণ অগ্নি সেই সমারোহকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলছে তার নিরাকার অবিরোধ দিয়ে। এভাবেই শবযাত্রা থেকে শব্দযাত্রায় আমাদের পথ আলোকিত হয়। প্রকৃত বিস্ময় মেলে ধরে তার রূপের বৈভব।

এতো এতো অপ্রসঙ্গেই এসে পড়ে ছায়াপথের কথা, ছায়ার ঘূর্ণি। যেখানে শব্দ, বর্ণ আর ধ্বনি মিলে উৎসবের সাজ। হাহাকারের মধ্যে জীবিতের কঙ্কাল কথা বলে। শূন্যের মাঝখানে আরও শূন্য হয়ে দুলতে থাকে। কবি দেখছেন কুয়াশার ভেলাটা ভাসছে। জগৎ সম্পর্কে যাবতীয় মোহ, তাপ, অস্থিরতা কখনও ভেসে ভেসে, কখনও পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে। চরাচর জুড়ে মায়া। দুহাতে আগলে রাখা রাত্রির নীরবতা। যেন আমাদের সমগ্র মনোভূমি ও বস্তুভূমি জুড়ে এক শিশুর পদচারণা। হাঁটছে ঘুঙুর পরা পায়ে আর পৃথিবীটা দুলে দুলে উঠছে। রহস্যময় এই জগৎ, ব্যাখ্যাতীত অন্ধকারের মধ্যে সে আলোময়। আসলে শব্দের একটা নিজস্ব দর্শন আছে,  আলোর আত্মীয়তা নিয়ে এই বোধ সবসময় বিপরীতমুখে ছুটতে চায়। আমাদের নতুন নতুন উদঘাটনের দিকে ঠেলে দেয়। প্রকাশ করতে চায় অব্যবহৃত সম্পর্কগুলো ।

এই অনন্ত রহস্যের মধ্যে সমস্ত ভেদ-অভেদ একই সঙ্গে স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট। অনেক আলো অনেক অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে অনেক রাত্রি এবং দিন ফেরি হয়ে যাচ্ছে নিহিতার্থের ঘাট বেয়ে। দূর থেকে হাতছানি দিয়ে এক একটা ডাক কখনও নিবিড় হচ্ছে, কখনও ধোঁয়াশা। একান্ত পরিসরে নিভৃতের কোলে মাথা রেখে কবি দেখলেন আর কোনও প্রভেদ থাকছে না শূন্য এবং অশূন্যের।

কবির জীবন এমনই। যতটুকু বাঁচা তা শুধু নিজের। এই জীবনপ্রবাহ তো প্রলাপ মাত্র। প্রলাপের বাইরে এই আমি – নিরবয়ব আমির আর কোনও ঠাঁই নেই, আশ্রয় নেই। ঘর নেই, সংসার নেই। এক অপার নৈঃশব্দ্য লিখে চলেছে তাকে। আর তাকে যে পড়ছে সে-ই শুধু জানে এই নীরবতার মানে, বিষাদের মানে। একটা শরীর থেকে শেষ গন্তব্যের আলো মিলিয়ে গেলো। আত্মজিজ্ঞাসার ছেঁড়াপালে লাগছে তিরতিরে হাওয়া। ভাসছে আলো আলো ছায়া ছায়া অক্ষরের গান। ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছে। শূন্য নিয়ে। সিঁড়িটা নেমে যাচ্ছে আরও গভীর শূন্যের দিকে। মাঝে মাঝে প্রকাশিত হচ্ছে কৈশোরের মাঠ ঘাট, বাঁশবন, জোনাকির মিহিতান। সবই যেন অপ্রকাশের প্রকাশ হয়ে ওঠে। একে কি নৈর্ব্যক্ত বলা যায়! নাকি অব্যক্তের প্রবল ব্যক্ততা!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৪




 

ইতালির পর আজ ফ্রান্স। ইতালির পরেই যে দেশ বিদেশী সিনেমা বিভাগে বেশিবার অস্কার পুরষ্কার পেয়েছে – ১২ বার। কিন্তু ইতালি আর ফ্রান্সের সিনেমার যদি তুলনামূলক আলোচনা করতে হয়, তাহলে প্রথমেই যে কথাটা উঠে আসবে, তা হল, ইতালির সিনেমা সুন্দর, অনুভূতিপ্রবণ কিন্তু ফ্রান্সের ছবি বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল। যার প্রতি ভাঁজে কিছু নতুনত্ব আর মাথার খেলা থাকে। আমাকে যদি ফ্রেঞ্চ ছবির সঙ্গে হলিউড সিনেমার সূক্ষ্ম পার্থক্য জিজ্ঞেস করা হয়, প্রাথমিকভাবে যেটা আমার মাথায় আসবে, তা হল, ফ্রেঞ্চ সিনেমায় চরিত্র, মনস্তত্ব আর পারিপার্শ্ব নিয়ে বেশি গভীরতা থাকে, যা সিনেমার প্লট আরো জমাট করে তোলে। ফ্রান্সের ছবিতে এই জাক্সটাপোজিশন ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য ইতালির পরেই আমাদের আজকের আলোচ্য ফ্রান্সের সিনেমা। তবে আমি এখানে একটা ব্যক্তিগত কথা না বলে থাকতে পারছি না। আপনি যদি পৃথিবীর যে কোন সিনেমাপ্রেমী মানুষকে জিজ্ঞেস করেন, কোন্‌ দেশের ছবি তাকে বেশি টানে, দেখবেন ৭০% উত্তর হবে ফ্রান্স। এবং আমিও, আজ অব্ধি পৃথিবীর যে দেশের  সিনেমা সব থেকে বেশি দেখেছি, সেটা ফ্রান্স। 

যাইহোক, প্রাথমিকভাবে ফ্রান্সের কিছু সিনেমা বেছে নেওয়া যাক। ইতালির ঠিক উল্টো সংখ্যায় বাছি। ২১। ড্রেয়ারের ‘প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক’  (১৯২৭), ভিগোর ‘লা’তালান্তে’ (১৯৩৪), রেনোয়ার ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ (১৯৩৭) এবং ‘রুলস অব দ্য গেম’ (১৯৩৯), ককতোর ‘অর্ফিয়াস’ (১৯৫০), ক্লুজোর ‘দ্য ওয়েজেস অব ফিয়ার’ (১৯৫৩), ম্যাথু ক্যসোভিজের ‘লা হাইন’ (১৯৫৫), রেনের ‘হিরোশিমা মাই লাভ’ (১৯৫৯), ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ (১৯৫৯), গোদারের ‘ব্রেথলেস’ (১৯৬০) এবং ‘কনটেম্পট্‌’ (১৯৬৩), মার্কারের ‘লা জেটি’ (১৯৬২), জ্যাক ডেমির ‘দ্য আমব্রেলাজ অব চেরবার্গ’ (১৯৬৪), ব্রেসোঁর ‘ও হাসার বালথাজার’ (১৯৬৬), জ্যাক তাঁতির ‘মাই আঙ্কল’ (১৯৫৮) এবং ‘প্লে টাইম’ (১৯৬৫), ল্যাঞ্জম্যানের ‘শোয়া’ (১৯৮৫), জুনেটের ‘আমেলি’ (২০০১), দাহানের ‘লা ভাই এন রোজ’ (২০০৭), হেনেকের ‘আমোর’ (২০১২) এবং আব্দেল্লাতিফ কেচিচের ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’ (২০১৩)।

আজ কিন্তু উল্টো ইতিহাস দিয়ে শুরু করব। প্রথমেই ধরব একদম সাম্প্রতিক ছবি। আব্দেল্লাতিফ কেচিচের সাহসী ছবি ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’। নিখাদ এক লেসবিয়ান সম্পর্ক নিয়ে সিনেমা। দুই প্রাণোচ্ছল তরুণী ও কিশোরীর, লিয়া  ও আদেল, খোলামেলা যৌনজীবন নিয়ে সিনেমা। এর মাঝে কিশোরী আদেলের স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজ এবং চাকরী জীবন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের যৌন জীবনের পরিণতি।

১৫ বছরের স্কুল কিশোরী আদেল। একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সে ছোট নীল চুলের অধিকারী যুবতী লিয়াকে দেখে। এবং তার মনে লিয়ার প্রতি, লিয়ার নীল চুলের প্রতি আকর্ষণ জাগে। আকর্ষণ বেড়ে চলে। স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে সে  যৌনতা উপভোগ করতে পারে না। একদিন এক লেসবিয়ান ডান্স বারে গিয়ে লিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। লিয়া এই সিনেমায় আর্ট গ্র্যাজুয়েট। খোলামেলা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। দুজনের সম্পর্ক নিবিড় হয়। লিয়ার পরিবার তাদের সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি করে না, কিন্তু আদেলের পরিবার রক্ষণশীল। তাই আদেল নিজের  পরিবারের কাছে লিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক জানাতে পারে না। বলে, লিয়া তার ফিলসফি ক্লাসের টিউটর। এরপর সময় গড়ায়। আদেল ১৮ বছরের যুবতী হয়। ক্যামেরায় আমরা তখন লিয়াকে তার জীবনে আর দেখতে পাই না। আদেল স্কুল টিচারের চাকরি নেয়। এক আর্ট গ্যালারিতে আবার দুজনের দেখা হয়। আবার সম্পর্কের টানাপোড়েন। ইতিমধ্যে লিয়ার সঙ্গে আরেক মহিলার লেসবিয়ান সম্পর্ক শুরু হয়েছে। শেষদিকে আমরা দেখতে পাই আদেল তার একাকীত্ব লুকিয়ে লিয়ার জীবন থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

এই সিনেমায় ভরপুর সেক্সুয়ালিটি আছে, কিন্তু তার সাথে সমাজের শ্রেণীবিভাগ ব্যাপারটাও সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একইসঙ্গে দুজন মহিলা চরিত্রের  স্বাধীনতা ও ইচ্ছের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সামাজিক শ্রেণীবিভাগের অঙ্গ হিসেবে খাবার কীরকম হয়, কীভাবে আলাদা হয়, সেটাও যথাযথ। খাবার এখানে একটা সিম্বল। যেমন নীল চুল। পিকাসো বা ভ্যান গগ, এই রং সিম্বল হিসেবে তুলে ধরেছেন। সেই কলা এখানেও। নীল যেখানে মানসিক সম্পর্ক তৈরি করছে, ভালবাসা শেখাচ্ছে, আবার দূরত্বও তৈরি করছে। যথেষ্ট সাহসী ছবি।

কিন্তু এই সিনেমার আসল কাজ লুকিয়ে ক্যামেরায়। আর সেজন্য এটা আমার প্রিয় ছবি। কেচিচ ক্যামেরায় কখনোই নিজের বাহাদুরি দেখাতে চান নি, উল্টে চেয়েছেন যে দর্শক যেন ছবির চরিত্রগুলোয় মিশে যেতে পারে। ফলে ক্যামেরা বেশির ভাগ সময়েই মুখের খুব কাছাকাছি। মুখের শিরা উপশিরাগুলোও যাতে বোঝা যায়। ক্লোজ শট, ক্যামেরা ডায়নামিক, ভার্টিকাল, অবজেক্টকে আলাদা করে বোঝানো হচ্ছে। সেটা ভালবাসার সিন হোক বা আর্ট গ্যালারি বা বা ব্রেক-আপ। পেছনে মিউজিক আর আলোর ব্যবহার।

এই অব্ধি পড়ে আমার পাঠক-পাঠিকা যদি ভেবে থাকেন যে, এই রে, অভিজিৎ মিত্র দুজন সুন্দরী ভরন্ত ফ্রেঞ্চ যুবতীকে দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একটা সফট্‌ পর্ণ নিয়ে এত ভাল ভাল কথা বলে গেল, তাহলে ভুল করবেন। কমল চক্রবর্তীর প্রতিকবিতা ভুলবেন না – ‘আরও কালো পিস্তলের দৃঢ়তম নল স্তনে চেপে/ যুবতীরা সমুদ্রে নেমেছে’। এই সিনেমা ২০১৩ সালে কান ফিল্ম  ফেস্টিভালে ‘গোল্ডেন পাম’ পুরষ্কার পেয়েছিল। গোল্ডেন গ্লোব আর বাফটার জন্যও মনোনয়ন পেয়েছিল। বাঘা সমালোচকরা মন্তব্য করেছিলেন, এই সিনেমা ২০১৩-য় বানানো প্রথম দশ সিনেমার ভেতর একটা। একবার দেখতে পারেন, এই সাহসী ছবি কোনভাবে আপনাদের মাথায় ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ব দিয়ে ঘা দেয় কিনা।  

এরপর বেছে নেব দুটো খ্যাতনামা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমা – ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ এবং জাঁ-লুক গোদারের ‘ব্রেথলেস’। এই দুটোই পৃথিবীর প্রথম ২০ ক্লাসিক সিনেমার ভেতর সবসময় থাকবে।

ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ (১৯৫৯) আলোচনা করার আগে আমি পাঠককে এক বাংলা সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেব। এই সিরিজের ৮ নম্বর পর্বে তার উল্লেখ করেছিলাম মাত্র। ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৮)। আট বছরের এক ছেলে বাবার শাসনে ভয় পেয়ে গ্রাম থেকে কলকাতা পালিয়ে যায়। সেখানে অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে সে জীবন সম্বন্ধে নতুন করে অনুভব করে, বোঝে যে বাবার শাসন তার ভালর জন্যই। সে আবার বাড়ি ফিরে আসে। এই হল ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। উল্টোদিকে ‘দ্য 400 ব্লোজ’এর বেশ কয়েক ধাপ ওপরের মনস্তত্ত্ব  নিয়ে তৈরি। আটোয়ান এক ১৩ বছরের বখাটে ছোঁড়া। স্কুলে অনেক ধরনের বদমাশি করে বেড়ায়। রোজ তার বাড়িতে রিপোর্ট হয়। একদিন সে স্কুল থেকে পালায়। পালানোর আগে সে সঙ্গে তার সৎ-বাবার দামি টাইপরাইটারটা নিয়ে নেয়। কিন্তু কোথাও বেচতে পারে না। বাধ্য হয়ে সে যখন আবার তার সৎ-বাবাকে সেই টাইপরাইটার ফেরৎ দিতে আসে, তার সৎ-বাবা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আটোয়ান গোটা রাত পুলিশ হেফাজতে কাটায় আরো অনেক চোর, ডাকাত, বেশ্যার সঙ্গে। পরেরদিন কোর্টের নির্দেশে তাকে কারেকশনাল হোমে নিয়ে চলে যাওয়া হয়। এই নতুন আস্তানা সমুদ্রের একদম ধারে। সেখানে আটোয়ানের মতই আরো অনেকে আছে। একদিন খেলার সময় আটোয়ান সেই হোম ছেড়েও পালায়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় আটোয়ান সমুদ্রের ধারে নিজের ইচ্ছেমত চলাফেরা করছে।

দুটো ছবিতেই দুই বালক নিজের মত করে স্বাধীনতা খুঁজে নিতে চাইছে। কিন্তু ত্রুফোর ছবি অনেক গভীরে। তার ছবির কিশোর জেলে সময় কাটিয়ে সাবালক হয়ে উঠছে। হোমে গিয়েও নিজের মত পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। অনবদ্য থিম। ক্যামেরার কাজ বেশ ভাল। এখানে ক্যামেরায় বন্দী বয়ঃসন্ধীর এক কিশোরের মনস্তত্ব – যার জীবনের প্রতি দিন, প্রতি ঘটনা এক ট্র্যাজেডি। এই সিনেমা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমার এমন এক ছবি যেখানে ‘ক্যামেরা অ্যাজ পেন’ নীতিতে বিশ্বাস রাখা হত। এই ছবি যেন ছত্রে ছত্রে ত্রুফোর নিজের কৈশোরের কথা, একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। সিনেমার দৃষ্টিকোণ একটাই – আটোয়ানের চোখে চোখ রেখে ছবি এগোবে। সিনের আবহেও সেই স্কুলছুট ছেলেটিই ফ্রেম হয়ে ওঠে। ছেলেটিকে ফোকাস করে গল্প যখন সময়ের তালে তাল না রেখে আগে-পরে ঘোরে এবং কোন এক সিনের মনস্তত্ব বোঝাতে ত্রুফো জুম করে হঠাৎ ফ্রেম ফ্রিজ করে দেন (পরবর্তীতে এই টেকনিক খুব জনপ্রিয় হয়), সেখান থেকে এই ছবি সাধারণ হয়েও অসাধারণ হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, এই ছবির ঘরে এত প্রাইজ যে  সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা যাবে না।   

পরের ছবি গোদারের ‘ব্রেথলেস’ বা ‘আউট অব ব্রিদ’। ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ  সিনেমার আরেক গুরুত্বপূর্ণ ছবি। এক অপরাধী মাইকেলের ওপর এই সিনেমা।  মাইকেল একটা গাড়ি চুরি করতে গিয়ে একজন পুলিশকে গুলি করে মেরে ফেলে। পুলিশের তাড়া খেয়ে মাইকেল তার প্রেমিকা প্যাট্রিসিয়ার ফ্ল্যাটে এসে লুকিয়ে পড়ে। প্যাট্রিসিয়া এক হবু সাংবাদিক এবং সে প্যারিসের গলিতে গলিতে তার ম্যাগাজিন বিক্রি করে বেড়ায়। ফ্ল্যাটে দুজনের রোমান্সের সঙ্গে সঙ্গে মাইকেল প্যাট্রিসিয়াকে নিয়ে ইতালি পালিয়ে যাবার প্ল্যান করে। কিন্তু মেয়েটি তাতে সায় দেয় না কারণ সে গর্ভবতী। শেষে সে যখন মাইকেলের কুকীর্তির  ব্যাপারে জানতে পারে, সে মাইকেলকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। পুলিশ তাকে ধাওয়া করে রাস্তায় গুলি করে। শেষ দৃশ্যে মাইকেল ‘আউট অব ব্রিদ’ হয়ে তার প্রেমিকাকে গালমন্দ করতে করতে মারা যায়। অবশ্য এই সিন নিয়ে একটু ধন্ধ আছে।

কোন কোন দার্শনিক এই সিনেমার থিম নিৎসের ‘নিহিলিজ’-এর সঙ্গে মিলিয়েছেন। নিহিলিজম এক অসামঞ্জস্য, যেখানে আমরা কাকে বা কোন্‌ বিষয়কে গুরুত্ব দিই আর পৃথিবী সেই গুরুত্বের বাইরে কীভাবে নিজের মত বয়ে  চলে, সেই নিয়ে আমাদের ভেতরের টানাপোড়েন। এই সিনেমার অনুসরণে পরবর্তীতে অনেক ছবি বানানো হয়েছে। সিনেমার মূলে অপরাধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু ব্রেথলেস সবার থেকে আলাদা। এর ফ্রি স্টাইল, এক ঝলক নতুন হাওয়া, প্রতি ফ্রেমে স্পেস তৈরি করা, জীবনের গতি, এমনকি অপরাধের মাঝেও রোমান্টিক কমেডির উপাদান – সব মিলিয়ে গোদার এই ছবিতে নিজের এমন এক শৈলি তৈরি করেছেন যা অননুকরণীয়।   

এবং এই সিনেমায় দেখার মত ক্যামেরার কাজ হল জাম্প-কাট। সাহসী পদক্ষেপ। এই সিনেমাতেই প্রথম জাম্প-কাট এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল যে সেটা জনপ্রিয়তা লাভ করে। কী এই জাম্প-কাট? ধরুন একটা গোটা সিন,  বেশ বড়। সেটাকে আপনি কেটে তিন-চার টুকরো করলেন। এবার সিনে থেকে সিনে যাবার সময় খানিকটা অংশ ইচ্ছে করে বাদ দিলেন। কিন্তু ক্যামেরার জায়গা বিশেষ বদলালেন না। উদ্দেশ্য – এক, সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা, এবং  দুই, দর্শকের চিন্তাশক্তির ওপর খানিকটা ছেড়ে দেওয়া। এবার ব্রেথলেস-এ আসুন। সেই বিখ্যাত সিন। প্যারিসের রাস্তায় প্যাট্রিসিয়া ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন’ বিক্রি করছে। এক লং আনকাট শট। তারপর মাইকেল আর  প্যাট্রিসিয়ার গাড়িতে চড়ে ঘোরা। সেখানে পরপর জাম্প-কাট। এত কাছাকাছি যে আপনাকে ভাবতে হবে কোথা থেকে কী হল। এটাই তারুণ্যের প্রাণশক্তির প্রতীক গোদার এবং তার ‘ব্রেথলেস’।    

সবশেষে বাছব নিউ ওয়েভ সিনেমার অনেক আগের এক ক্লাসিক ছবি। জাঁ ভিগোর ‘লা’তালান্তে’। অদ্ভুত গল্প, অন্তত সেই সময়ের প্রেক্ষিতে। এক জাহাজের ক্যাপ্টেন জাঁ তার প্রেমিকা জুলিয়েটকে বিয়ে করে সোজা নিয়ে হাজির করে নিজের জাহাজে। জাহাজ বয়ে চলে প্যারিসের উদ্দেশ্যে। জাহাজের আরো দুজন কেবিন বয় মহিলাসঙ্গ কখনো পায় নি। ফলে তারা জুলিয়েটকে দেখে মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণ করে, কিন্তু সবকিছুর মাঝেও জাহাজ বয়ে চলে এবং জাঁ ও  জুলিয়েটের হানিমুন চলতে থাকে। অবশ্য জাঁ চরিত্রটা মোটেও সোজা নয়, সে খুব পোসেসিভ এবং রাগী গোঁয়ার। একদিন জুলিয়েটকে এক কেবিন বয়ের সঙ্গে  গল্প করতে দেখে রেগে সেই কেবিন বয়কে অনেক বেশি কাজ দিতে শুরু করে। এরপর প্যারিস এলে তারা প্যারিসের রাত্রিকালীন জীবন দেখার জন্য এক ডান্স হলে যায়। সেখানে এক পথচলতি যুবক জুলিয়েটের সঙ্গে নাচতে চায়। সেই নিয়ে জাঁ-র সঙ্গে সেই যুবকের হাতাহাতি হয়। জাঁ জুলিয়েটকে জোর করে জাহাজে নিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু প্যারিসের ঝলমলে রাত্তির দেখার জন্য জুলিয়েট জাহাজ থেকে পালিয়ে এসে দোকানের বাইরে উইন্ডো শপিং শুরু করে। এদিকে জাঁ যখন জানতে পারে যে জুলিয়েট জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে, সে রাগের বশে প্যারিস ছেড়ে জাহাজ নিয়ে চলে যায়। জুলিয়েট ফিরে এসে বন্দরে জাহাজ দেখতে না পেয়ে মনের দুঃখে এক চাকরি ধরে যাতে সে টাকা জমিয়ে জাহাজের পরের লক্ষ্য অব্ধি পৌঁছতে পারে। এদিকে জুলিয়েটকে ছেড়ে এসে জাঁ ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করে। অবশেষে সেই কেবিন বয় জুলিয়েটকে খুঁজে আনে এবং জাঁ-জুলিয়েট যুগলের আবার মিলন হয়।

হয়ত এরকম হ্যাপি এন্ডিং পুরো সিনেমার সাহসী প্লট খানিকটা হলেও নষ্ট করেছে, কিন্তু আজ থেকে ৮৭-৮৮ বছর আগে দর্শকরা হলে যেত নায়ক নায়িকার মিলন দেখতে, অন্য কোন রকম শেষ দেখতে নয়। সে কারণেই কম্প্রোমাইজ। সে যাইহোক, এই সিনেমা বাছার কয়েকটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।  প্রথমত, এই সিনেমা ভিগো বানিয়েছিলেন মাত্র ২৯ বছর বয়সে। এবং এটাই ছিল তাঁর শেষ ছবি। ছবি বানানোর সময় উনি টিউবারকিউলোসিসে ভুগছিলেন।  সেখান থেকে আর সেরে ওঠেন নি। উনি ১৯৩৪-এই মারা যান। দ্বিতীয়ত, এই সিনেমায় উনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন কাব্যিক বাস্তবতা, যা নব্য বাস্তব ফ্রেঞ্চ সিনেমাকে ৫০-৬০-এর দশকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তৃতীয়ত, এই সিনেমা কোন সাহিত্য থেকে নেওয়া হয় নি, ভিগো নিজে লিখেছিলেন। চতুর্থত, এই সিনেমা ১৯৩৪-এ রিলিজ হবার পর বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কিন্তু ৫০-এর নব্য বাস্তবতা শুরু হবার পর এই সিনেমা গোটা পৃথিবীর এক ক্লাসিকে পরিণত হয়। সবাই একে একে স্বীকার করেন যে সেই যুগের তুলনায় এরকম  প্লট অনেক এগিয়ে থাকা প্লট এবং অরিজিনাল।

লা’তালান্তে দেখে মনে হয়েছিল এক সহজ কিন্তু বিমূর্ত কবিতা দেখছি। যে সিনেমা দেখে কিশোর বয়সে ত্রুফো-ও এই সিনেমার প্রেমে পড়েছিলেন। এই সিনেমা দেখে মনে পড়ে জন কিট্‌সের কবিতা ‘To Autumn’ – ‘Where are the songs of Spring? Ay, where are they?/ Think not of them, thou hast thy music too –’। সত্যি, অসাধারণ সব ছবির ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমের এক  সহজ সাহসী প্লট, যার নিজস্ব সঙ্গীত কানে বাজতে বাধ্য। এবং আশ্চর্য, ভিগো আর কিট্‌স, দুজনেই মারা গেছিলেন টিউবারকিউলোসিসে, একজন ২৯, অন্যজন ২৫। যদি এরা দুজনেই আরো অন্তত ৩০ বছর বাঁচতেন, তাহলে সিনেমা আর সাহিত্যর ইতিহাস আরেকটু বদলাতো। 

তাহলে সোজা ইতিহাস কী বলছে? সেই ১৯৩৪ সালে যে সাহসী চিত্রনাট্যর বীজ  নিয়ে এসেছিল ভিগোর লা’তালান্তে, সেটা আস্তে আস্তে সৌন্দর্যের সঙ্গে ফুটে উঠেছে ৫৯-৬০-এ নিউ ওয়েভ সিনেমায়, আর সেই গাছ মহীরূহ হয়েছে ২০১৩-র ব্লু-তে। এবার বুঝলেন, কেন ফ্রেঞ্চ সিনেমাকে বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল বলা হয়?

শেষ করার আগে সিনেমাপ্রেমী পাঠকের জন্য আগের বারের মতই এক সবিনয় পরামর্শ। সময় করে গোদারের ‘হিস্ট্রি অব সিনেমা’ (১৯৮০-৯৮) সিরিজ দেখুন। মোট ৮ টা ভিডিও। ২৬৬ মিনিট। সিনেমার ধারণা ও তার বিবর্তন নিয়ে ভাবনা চিন্তার অনেক খোরাক পাবেন।