কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

সুবল দত্ত

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০২


লাক্ষাকুঠি  

    

ঊনিশ’শো আশিতে যাঁরা বিকেলে মায়া সরোবরে বিহার করেছেন, তাঁরা দেখতে  পেয়েছেন সন্ধে হব হব সময়ে জালানের গালা কুঠির খন্ডহর রূপ কী ভয়ানক। সর্বহারা লাক্ষাচাষী ও লেবারদের হায় নিঃশ্বাস সদ্য জর্জর বিশাল কুঠির কালো উঁচু গোল টাওয়ার দিয়ে পাক খেতে খেতে তপ্ত কালো লাভার মত হতদরিদ্র পথে নামে, এই উপলব্ধি সে সময়ের টুরিষ্টেরা দেখেছে। তবে ওই ভ্রমণকারীরা আমারই মত। কোনো সাংবাদিক বা সাহিত্যিক নয়। অধুনা পৃথিবীর আর্টিফিসিয়াল ইণ্টেলিজেন্স প্রায় দেড়লাখ হরর স্টোরি হজম করে নিয়েছে। আমার কথাটা ছাপলে সেটা টপ প্রায়রিটির হতো।

প্রমাণ চাই? প্রত্যক্ষদর্শী একজনই বেঁচে। কৃত্তিবাস বুড়ো। বয়েস বিরাশি। তবে তাকে কাছে পাওয়া মুশকিল। সে লোকালয়ে থাকে না। অনেক দূরে পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে একটা ভাঙা নীলকুঠিতে বাস করে। সেটা ছিল রমরমা সতেরো’শো সালে, এখন প্রেত দুর্গ, কটাশ হুড়ার আর শেয়ালের আড্ডা। কেউ যায়না সেখানে। দেদার বনমুরগী, খেজুরগাছের বারোমেসে তাড়ি, আদ্যিকালের একটা জলাভূমির পাড়ে প্রচুর ওলকচু। ওই সবই খেয়ে বাঁচে। কখনো সখনো সাঁঝবেরাতে লোকালয়ে আসে। রাতারাতি ফিরে যায় আবার। দুই হাত সবসময় দুটো ছোটো গামছা দিয়ে মোড়া থাকে। চোখে মোটা গ্লাসের ভাঙা নড়বড়ে চশমা, দড়ি দিয়ে মাথায় বাঁধা। চোখগুলো এতোবড় দেখায় যে কেউ সাহস করে দুবার তার দিকে তাকায় না। এই বয়েসে কীকরে অন্ধকারে ভয়ানক দুর্গম জঙ্গলের  মাঝ দিয়ে পথ চেনে, সেটাও অনেকের আলোচ্য বিষয়।

ওর সাথে সাক্ষাৎ হওয়াটা একরকম ভৌতিক ঘটনা। ওকে দেখেছি আর ওর ডেরাও দেখে এসেছি। তাই কারো এই অভিজ্ঞতা চাইলে আমি আছি। ঘটনাটা বলি তবে। একদিন বিকেলে শনি-পাহাড়ের চূড়ো থেকে দূরে পুরনো কেল্লার মত গালা কুঠি দেখে জেদ চাপলো, ওখানে যাবই। এক্ষুনি। ওই কুঠির রাস্তা দিয়েই  তো মায়া সরোবর। হাঁটতে শুরু করলাম। কাছে পৌঁছতেই হুড়মুড় করে আঁধার নেমে এল। কুঠির বিশাল উঁচু কালো টাওয়ার আলো বাতাস এমনকি পোকা মাকড়েরও শব্দ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। টের পেলাম ভূঁইছোঁয়া তপ্ত কালো ধোঁয়া পাক খেতে খেতে ছড়িয়ে পড়ছে। আতঙ্কে ফিরে যেতে মন চাইল, কিন্তু কিছুই দেখা যায় না যে! ভয়ে পিছোতেই কারো সাথে বেদম ধাক্কা খেয়ে পড়ে  গেলাম। উঠবো কী, ওর দিকে তাকাতেই আমার হাড় বরফ হয়ে গেল। দুজোড়া  গোল চাঁদের মত চকচকে কাঁচের ভিতর দিয়ে বিশ্বজোড়া চোখ আমাকে গিলতে আসছে যেন। দুহাতের কাপড় দিয়ে ধোঁয়া সরাতে সরাতে চিত্কার করতে লাগল কেউ, ‘ভয় নেই, আমি কৃত্তিবাস দাদু, ওঠো’। আমি ধাতস্থ হলাম। একজন বৃদ্ধ।

তিনিই আমাকে শোনালেন কুঠির ভিতরের অতীত কাহিনী। বহু আগে কুঠির ভিতর বঁধুয়া মজদুর বিশাল ভাটির গনগনে আগুনে লাক্ষা থেকে গালা তৈরির কাজ করত। রাতদিন। কালো ধুঁয়ো আলকাতরার মত ছড়িয়ে থাকতো। এখন সাঁঝবেলায় ভুখা লেবার প্রতিবাদ করতে ধুঁয়ো হয়ে পথে নামে। হাতে লোহার শিকল বাঁধা। এইরকম। বলে হাতদুটো তুলে দেখালো। দেখলাম দুটো কঙ্কাল হাত।              

 

      


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন