কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

অচিন্ত্য দাশ

 

মসীচিত্র

 

অস্থি-প্রান্তর




২০১২ সালে কাজের সূত্রে আফ্রিকার জিম্বাবাওয়ে নামক দেশে গিয়াছিলাম। রাজধানীর নাম হারারে। সে শহর হইতে দূরে একটি কয়লাখনি অঞ্চলে যাইতে হইয়াছিল। ফিরিতে সন্ধ্যা হইল, গাড়ির চালক রবার্ট বলিল, “অন্ধকারে গাড়ি চালানো বিপজ্জনক, এখানে কোথাও রাত্রি কাটাইয়া যাইতে হইবে”। আমি এবং আমার সঙ্গী নির্মল একে অপরের দিকে তাকাইলাম। অস্তসূর্যের আলোতে জনহীন প্রান্তর ও কিছু বিশালকায় বাওবাব বৃক্ষ ছাড়া আর কিছু দেখিতেছি না। চাঁদের পাহাড়ের শংকরের কথা মনে পড়িয়া গেল। অবশ্য শংকর অপেক্ষা আমাদের অবস্থা অনেক ভালো বলিতে হইবে – সরাইখানা না পাইলে এই  গাড়িতেই রাত্রি কাটানো যাইতে পারে। তাঁবু খাটাইতে হইবে না। রবার্ট বলিল, “আর কিছু দূরে হাওয়াঙ্গে সরকারী বনাঞ্চল। সেখানে দু-একটি থাকিবার জায়গা আছে, আপনারা যদি যাইতে রাজি থাকেন…”

রবার্ট এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। গত তিন-চার দিন আমাদের সারথির কাজ করিতেছে। ছেলেটি যথেষ্ঠ বিশ্বাসভাজন। আমরা সম্মতি জানাইতে সে গাড়ি ঘুরাইয়া অন্য রাস্তা ধরিল। রাস্তা অন্য হইলেও চারিপাশ একই প্রকার। এবং এইরূপ জনহীন আরণ্যক প্রান্তরে গোধূলি আলোকে তাহাদের প্রথম দেখিতে পাইলাম। প্রথম দর্শনে ঠিক চিনিতে পারি নাই। অনেক দূরে কটি কালো বিন্দু নড়িয়া চড়িয়া বেড়াইতেছিল। রবার্ট গাড়ি থামাইয়া কিছু ভাবিল এবং আবার গাড়ি চালাইতে লাগিল। সমস্বরে বলিলাম, “কী হইল?” রবার্ট কম কথা বলে – ওইদিকে আঙ্গুল দেখাইল। আমরা কহিলাম, “হ্যাঁ, কতগুলি মহিষ ঘাস খাইতেছে”। রবার্ট বলিল, “না, তাহা নহে। তোমরা কথা বলিও না, এবং জানালার কাচ খুলিও না। তাড়াতাড়ি পৌঁছিতে হইবে”।

ততক্ষণে উহারা আর একটু কাছে আসিয়া পড়িয়াছে। এ কী! ইহারা তো…  পিতা-পিতামহের নাম স্মরণ হইতে লাগিল আমাদের। ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া পড়িলাম। মহিষের তো শুণ্ড থাকে না। ইহারা একপাল হাতি! তা চল্লিশ-পঞ্চাশটি তো হইবেই। বুঝিতে পারিলাম আমরা রাস্তা ধরিয়া যে দিকে যাইতেছি, মাঠের উপর দিয়া হাতির পাল সে দিকই চলিতেছে। হাতির পালের সহিত গতিতে মোটরগাড়িই জিতিল, গন্তব্যে আমরা কয়েক মিনিট পূর্বে পৌঁছিলাম।

থাকিবার জায়গা হিসাবে মন্দ নহে। তিনটি বনকুটির রহিয়াছে। কাঠের তৈরি, পাতায় ছাওয়া ছাদ। আমরা সেই চত্বরে গাড়ি লইয়া প্রবেশ করিলাম। বনকুটির হইতে পঞ্চাশ-ষাট গজের ভিতর একটি ছোট পুকুর ছিল। আর কয়েক মিনিটের ভিতরেই দেখিতে দেখিতে হাতির দলটি সেখানে আসিয়া পড়িল। তিনভাগ হস্তী জনিত ভীতি ও বাকি একভাগ এই কুটিরে আসন্ন রাত্রিবাসের কথা ভাবিয়া অভূতপূর্ব  অনুভূতি –  সংক্ষেপে বলিতে গেলে আমার মনের অবস্থা এইরূপ এক অভিনব ককটেলের মতো হইয়াছিল।

পূর্বে পোষ-মানানো, বন্দী অথবা দু-একটি বনের হাতি দেখিয়াছি। কিন্তু এতগুলি বন্য হস্তী এত নিকটে এই প্রথম। তাহার উপর আফ্রিকার হাতিগুলি আকারে ভারতীয় হাতির তুলনায় প্রায় দেড়গুণ বৃহৎ। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। অনেকগুলির দীর্ঘ ও শুভ্র দন্ত রহিয়াছে। জলপান করিতে আসিয়াছে। কয়েকটি হাতির পেটের নিচে ছোট শাবক দেখিলাম। তাহারা মাতার চারিপায়ের থামওয়ালা নিরাপদ বেস্টনীতে রহিয়াছে। মা চলিলে তাহারাও চলে। মা কিছুক্ষণ না চলিলে, অধৈর্য শিশুহাতি মায়ের পেটে ঢুঁ মারিতে থাকে। তবে সবকিছু এত নিকটে এবং বনকুটিরের সম্মুখে কিছুমাত্র আড়াল অথবা প্রাচীর না থাকায় আমরা সাহস হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম। বনকুটিরে একটিই কর্মচারি। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম (এই দেশে ইংরাজির বেশ চল রহিয়াছে, কথাবার্তায় অসুবিধা হয় না) –“ ভাই, ইহারা কিছু করিবে না তো…”

সে অম্লান বদনে কহিল, “আপনারা বেশি কথা কহিবেন না এবং উহাদের চোখে চোখ রাখিবেন না”।

ব্যাস? এই বলশালি হস্তীযুথের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ! মনের ভয় সেইদিন মোটে দূর হয় নাই কিন্তু  যে হাতির দলটিকে এত নিকটে দেখিয়াছিলাম তাহা আমার মানস-পটে ফটোগ্রাফের মত আজও রহিয়া গিয়াছে।

হাতিগণ মনের সুখে জলক্রীড়া করিতেছে। সে দেশ তখন বর্ষা আসিবার অপেক্ষায় দিন গুনিতেছে। বেশির ভাগ অঞ্চলে শুষ্কতার ভাব। শুনিয়াছি এই জলকষ্টে নাকি অনেক বন্য প্রাণীর মৃত্যু হয়। তাহা ভাবিয়া হাতিদের এই উল্লাস আমার ভালো লাগিতেছিল না। কত জল ইহারা ছড়াইয়া ছিটাইয়া নষ্ট করিতেছে! এদিকে ওদিকে চোখে পড়িল কয়েকটি হরিণ ও বাঁদরও জল খাইতে আসিয়াছে, কিন্তু হাতিদের দৌরাত্মে তাহারা মাঝেমাঝে পলাইয়া যাইতেছে। বনকুটিরের লোকটিকে জিগাসা করিলাম, “ইহারা আর কতক্ষণ থাকিবে?”

সে বলিল, “তাহা বলিতে পারিব না। এক জায়গায় আসিলে হাতির দল বেশ কয়েক ঘন্টা রহিয়া যায়। সারা রাত্তিরও কাটাইতে পারে। কারণ…”

-“কারণ কী?”

-“কারণ ইহারাই বনের রাজা”।

ইহার পর আরও কিছু হইয়াছিল, তাহা নয় আর একদিন লিখিব। ফাস্ট ফরোয়ার্ড করিয়া এই উপাখ্যানের শেষের দিকটায় আসিয়া পড়া যাক।

কাজে কিঞ্চিৎ ফাঁকি দিয়া আমরা রবার্টকে লইয়া তাহার গাড়িতে কয়েক ঘন্টার জন্য জঙ্গলে ঢুকিয়াছিলাম। পূর্বে দেশে অরণ্য ভ্রমণ যে করি নাই তাহা নহে, কিন্তু এই অরণ্যের মতো এতো অসংখ্য পশুপাখির সহজ বিচরণ কোনো স্থানে দেখি নাই। বহু প্রজাতির হরিণ, বাঁদর, হায়না,, জিরাফ, জেব্রা যত্রতত্র দেখিলাম। একটি জলাশয়ে একটি সরলরেখা ভাসিতেছিল, রবার্টের কথায় ভালো করিয়া দেখিলাম উহা একটি কুমীর। ইহার দৈর্ঘ্য অন্তত পনেরো ফুট তো  হইবেই। সিংহ দেখিতে পাই নাই, তাহারা নাকি আর একটু গভীরে ছায়াছন্ন পরিবেশে বিশ্রাম করে।  বিশ্রাম না করিতে থাকা ক্ষুধার্ত সিংহের এক্ষণে দেখা না পাওয়াই  মঙ্গল। রবার্ট আগেই বলিয়াছিল বনে ঘুরিবার পক্ষে এই গাড়ি তেমন মজবুত নহে।

আর দেখিলাম হাতি। কখনো একটি দুটি, কখনো গোটা সাত আট – দলছুট হইয়া এদিকে ওদিকে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরিতেছে। গাছ তো অনেক, তবে মনে হইল ইহারা ভোজন-রসিক। পছন্দ মতো না হইলে খায় না। আগেই তো শুনিয়াছিলাম গল্প-গাঁথায় যাহা বলা হউক, জঙ্গলের আসল রাজা হইল হাতি। অন্ততপক্ষে আফ্রিকার এই অরণ্যে তো বটেই।  ইহাদের সহিত পাল্লা দিবার মতো কেহ নাই। সিংহ মহাশয়ও নাকি হাতিকে আক্রমণ করে না। তবে একটি কথা মনে হইয়াছিল – এ হেন পশুকে ঈশ্বর বোধহয় জানিয়া-শুনিয়াই নিরামিষাশি করিয়াছেন। ইহারা যদি প্রাণী সংহার করিত তাহা হইলে অরণ্য এতদিনে পশুশূন্য হইয়া পড়িত।

জিরাফ, জেব্রা, হরিণ ইত্যাদি পশুগণ গাড়ির শব্দে যেমন ভীত হইয়া পলাইতেছে, হাতি কিন্তু তেমন করিতেছে না। তাহারা নিজের মনে রহিয়াছে। দু-চারিটি মনুষ্য সন্তান চারচাকা বাহনে কোথা হইতে আসিয়াছে তাহাতে ইহাদের কিছু যায় আসে না। এই তুচ্ছ প্রাণীদের দিকে মনোযোগ দিবার কোনো প্রয়োজন রাজাদিগের নাই। তাহাদের মেজাজ রাজকীয়, তাহাদের কোনো অভাব নাই, তাহারা আর কোনো বন্যপশুর তোয়াক্কা করে না। এই অরণ্যমহলে তাহারা রাজাই বটে, বনকুটিরের লোকটি সঠিক কহিয়াছিল।



এই অরণ্যে গাড়ি চলিবার মতো কিছু কাঁচা রাস্তা রহিয়াছে। চলিতে চলিতে একজায়গায় দেখিলাম আর পথ নাই, সামনে অপেক্ষাকৃত হালকা অরণ্যানী। কতগুলি বাবলা ধরনের গাছ আর মেঠো উঁচুনিচু জমি। এইখানে যাহা  দেখিয়াছিলাম তাহা ভুলি নাই, কোনদিন ভুলিবও না। ভূমিতে ইতস্তত ছড়াইয়া রহিয়াছে অজস্র অস্থি। কিছু খণ্ডিত, কিছু অখণ্ডিত। জীববিদ্যায় কিছুমাত্র জ্ঞান না থাকিলেও এই অস্থিসকলের আকার হইতে সহজেই বুঝিতে পারা যায়, হাতি ছাড়া আর কোনো পশুর এত বৃহৎ হাড়গোড় হইতে পারে না। কী করিয়া  বা কেন শুধু একটি স্থানে এইরূপ হইয়াছে তাহার উত্তর পাই নাই। তবে নিশ্চিত ভাবে এই প্রান্তর হাতিদের শশ্মান-ভূমি বিশেষ।

এক স্থলে হাতির মস্তকের কঙ্কাল বা অস্থি-অবশেষ দেখিয়া একটু যেন শিহরিয়া উঠিলাম। মনে হইতেছিল এই হাতিটি জীবিত অবস্থায় কত বনপথ অতিক্রম  করিয়াছে। কত গভীর অরণ্যের অভ্যন্তরে, কত জলাশয়ের তীরে জ্যোৎস্না নিশীথে আপন মনে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে রাজার মেজাজ লইয়া। দোসরের সহিত ভালবাসার খেলা খেলিয়াছে প্রাণ ভরিয়া। কত পত্রপল্লব, কত সুমিষ্ট ফলমূল, কত কচি বৃক্ষের কাণ্ড আনন্দে ভক্ষণ করিয়াছে। হয়তো বা মহুয়ার মতো কিছু খাইয়া নেশায় মাতাল হইয়াছে। সে নেশা শুধু অরণ্যের নেশা নহে, তাহা বাঁচিয়া থাকিবার নেশাও বটে। পরাজিত হওয়া বলিয়া কিছু যে থাকিতে পারে, তাহা সে কোনোদিন শিখে নাই, জানেও নাই। তবু একদিন সে হারিল। সব রাজাকেই যাহার কাছে হারিতে হয়, সেই কালদেবের কাছে সেও হারিল। সময় কাহাকেও ছাড়িয়া দেয় না।  রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র – সময়ের দরবারে কোনরূপ পক্ষপাত নাই।

সেই অস্থি-প্রান্তরে দাঁড়াইয়া সহসা মনে হইয়াছিল স্বয়ং ঈশ্বর যেন রবার্টের উপর ভর হইয়া আমাদিগকে এই স্থানটিতে আনিয়াছেন। এই মহা-মূল্যবান শিক্ষাটি পাছে আমরা অহঙ্কারের বশে ভুলিয়া যাই, ঘটনাছলে তাহাই স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যেন!

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন