কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

সুকান্ত দেবনাথ

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

           

দূরত্ব




 

(দশ)  

 

স্থূল, সব কিছুই কিন্তু বাস্তবে খুব স্থূল। কস্তূরীর কান থেকে খসে পড়া সোনার  বালির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল। আমি হাতে করে তাকে সযত্নে তুলে রাখতে গিয়ে চোখে পড়লো, সেও তো এভাবেই আলগোছে শুয়েছিল কাল সারারাত। তবে কি আমার জন্য সেও এভাবেই এক পাথরের মূর্তি রেখেছিল। এবং এও হতে পারে আমি শেষতম ভুল না করে মিথ্যে প্রমাণ করেছি নিয়তি।  তাহলে আমার জন্য যে মর্তবাস নির্দিষ্ট ছিল তার কী হবে! সে কি নিজেকে তুলে  রাখবে আমার পরবর্তী দুর্ভাগ্যের জন্য? নাকি আমার সে ভাগ্য বয়ে যেতে চাইবে  অন্য কারোর দিকে? যখন কোনো স্বামী এভাবেই নিজের হতাশাকে দেখে শুয়ে  আছে। আর সে চায় বয়ে যাক তার চির মলিন রূমাল। যেখানে একটি অনির্দিষ্ট সময় বসে আছে সব কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি এক দুই তিন এভাবে দশ পর্যন্ত গুনতে শুরু করি, যতক্ষণ না কস্তূরীর দেহে প্রাণ আসে। আমার মানস পটে কিন্তু তখনও সাথীর অবচেতন শরীর পড়ে আছে। সে যে কিছু আগেই আমার কাছে ছিল এবং আমি তার সে রূপ লিপিবদ্ধ করছিলাম আমার খাতাপত্রের মধ্যে। তাহলে যে সব নারী আজকাল শাঁখা পলার ধার ধারে না আর যাদের হাতে অভাবজনিত প্লাস্টিকের শাঁখা পলা আসে, তাদের মাঝে কোনও তফাৎ নেই। সাথী ঘুমিয়ে ছিল আমার জাগরণে, আর আমার কাগজপত্র ছিল আমার বুকের ওঠা নামার সাক্ষী। আমি আবার সাথীর সামনে যে খাটের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে এসেছি। সে শুয়ে আছে, আমার দিকে তার সবকিছু মেলে দিয়ে। আমি তার খাটের উপর উঠে বসলাম। হাত রাখলাম তার মাথার উপর। সে এবার ঘুরে তাকাল, আমি তাকে ছেড়ে এক পা পিছনে সরে এলাম।

কিন্তু কি দেখলাম আমি, তার চোখ কি পালটে গেছে, সে কি অন্য কারোর চোখ  নিয়ে তাকিয়েছে আমার দিকে? তার চোখে কি কস্তূরীর চাউনি? জানিনা, কিন্তু অদ্ভুত এক লজ্জাবোধ।

কস্তূরী ডাকল – চলে যাচ্ছ।

বললাম – না চলে যাচ্ছি না, তোমার কানেরটা পড়ে ছিল, তাই রাখতে এসেছিলাম।

কস্তূরী তড়াক করে উঠে বসে হাত দিল কানে। সত্যিই তো নেই একদিকের। বললাম – ভয় নেই পেয়েছি।

সে বলল – ওটা মায়ের ছিল।  

আমি বললাম – তাহলে তো তাতে শৈলেশের বউয়ের অধিকার আগে। তুমি নিয়ে নিয়েছ কেন?

মাঝে মাঝে মনে হয়, কথা না বলা স্বীকারোক্তির সমান, আমি তার মুখের উপর যে রং দেখতে পাচ্ছি সাথীর মুখেও কি সে একই রং লেগে আছে? কিন্তু এমন মানুষও তো আছে যে নিজেকে প্রথমে নারী বা পুরুষ বলার থেকে মানুষ বলে ভাবতে বেশি ভালোবাসে। এমনিতে দেখতে গেলে আমার জীবন একেবারে নারী চরিত্রবিহীন। ওই কস্তূরী যে একমাত্র আমার কাছে থাকে। কিন্তু তার বাইরেও কত যে মেয়ে আমাকে ঘিরে রয়েছে। সে খবর আমিও হয়তো জানি না। কস্তূরীর মাসীমা, যে প্রায় আমার সমবয়সী। বা আমার থেকে কয়েক মাসের কি বছরের ছোটও হতে পারে। যার কথা কস্তূরীর বাবা আমাকে বলেছিল। সে মহিলা ছিল তাঁর শ্যালিকা।

কস্তূরীর বাবা আমাকে বলেছিল – 

-তোমরা তো এমন অনেক কাজই করেছ, কিন্তু এমন কি কিছু করেছ যে কেউ শেষ নিঃশ্বাস ছারার সময় তোমার কোলে মাথা রাখতে চেয়েছিল। আমি জানি, করনি। করনি কারণ এই নয় যে কেউ এমন ছিল না, যে সেভাবে মাথা রাখতে চাইবে। বরং তোমরা তাকে সে সুযোগই দিতে চাওনি, যে সে কিছু চাইতে পারে। আমি জানি এমন একজনকে, যে প্রথমে নিজেকে নারী বলার থেকে মানুষ বলতে ভালোবাসে। সে যখন রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে তার সাথে সাথেও হাঁটতে থাকে কিছু পবিত্র আত্মা। তাদের হাতে অভয় মূর্তি। সে এগোতে থাকে, সে এগোতে থাকে ভয় থেকে দূরে সব প্রতিকূলতা থেকে দূরে। পিছন থেকে তার মা বলে, কিরে অনি তুই নাকি আজ রানী হয়েছিস? অনি বলে, আমি নই মা, ওই আমার কথা যে তোমাকে বলে যাচ্ছে, সেই তো হল আসল কালপ্রিট। 

তারপর বুঝলে অনির হেঁটে যাওয়া বলতে পার, এক মাত্রা থেকে বহু মাত্রার দিকে সরে আসে।

আমি বলি – সে কেমন। 

-সে যেন এক নতুন সন্ন্যাসী, চলে যাচ্ছে মহাপ্রস্থানের দিকে। আমি তার  অনুসরণকারী। আমার পায়ের তলা থেকে রাস্তা সরে যাচ্ছে নিজে থেকেই। দৃশ্য নিজেকে ঢেকে নিচ্ছে দৃশ্যের মাঝে। সবকিছু মিলে মিশে ফুটে উঠছে সেই সব দিনগুলি যখন তার কোলে মাথা রেখে, তার দিকে তাকিয়ে আছে তার শাশুড়ি। যেন বলতে চায় আমার মুখে শেষ জল একমাত্র তুই দিবি। আমি আর কারোর হাতের জল নিয়ে যেতে পারবো না। আর সেই শান্ত দুটি চোখ তাকিয়ে আছে তার শাশুড়ি মায়ের দিকে নয় যেন তার নিজের মেয়ের দিকে। সব কষ্ট থেকে সারিয়ে তুলবে বলে। তার মধ্যে আর কোনও গুণ নেই, সে মেয়ে তেমন সুন্দরী নয়, ওই কাজ চালানোর মত ছিল, পড়াশোনা করেছে তবে তা দিয়ে বিয়েটুকুই  সম্ভব, নাচ গান বা কালচার কিছুই সে জানে না। এতই সাধারণ তার জীবন। ঘরের কাজ জানে, যে কাজের কোনও দাম নেই। তবু সে সকলের যেন দুঃখনাশী। সেও তাকিয়ে ছিল তার শাশুড়ির দিকে, কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক দিন। গলায় ক্যানসার, অনেক ট্রিটমেন্ট হয়েছিল কিন্তু সে যখন চলেই  যাবে, তখন কে পারে আটকাতে। বয়স বেশি ছিল না, মধ্যবয়সী এক মহিলা, যার তখনও অনেক দুঃখ পাওনা ছিল। তবু সবাইকে হঠাৎ ফাঁকি দিয়ে সে চলে যাচ্ছে। পিছনে রেখে যাচ্ছে, তার উত্তরসূরি, যে বেঁধে রাখবে তার নিজের হাতে বোনা ঘর সংসার। আর অন্তিম জলটুকু তার হাত দিয়ে যখন মুখের মধ্যে আসবে মনে হবে অমৃত।

বললাম – সব মেয়েরা কিন্তু এই সুযোগটা পায় না।

উনি বললেন – সব মেয়ে কি বলছ, কেউই প্রায় পায় না, বা নিতে চায় না। তারপর জানো সেই সাধারণ মেয়েটি যাকে আমি প্রায় তার জন্মলগ্ন থেকে চিনি। জন্মলগ্ন বলতে আমি যখন বিয়ে করে ছিলাম সে খুব ছোট ছিল। আর কেউ ভাবেইনি যে সে কোনোদিন এতদূর যেতে পারবে। তিন ছেলে এক মেয়ে অথচ যেন কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও খেদ নেই তার নিজের বরের প্রতি। সে আরও  কিছু দিতে পারে। বা সে হয়তো আরও দিলে খুশি হবে। না পারার কষ্ট তাকে দুঃখ দেয়। কোনও রকম একটি এলোমেলো শাড়ি, এলোমেলো চুল সে হেঁটে  যেতে যেতে রাস্তা হারিয়ে ফেলে। আমাদের চেনা জানা রাস্তা থেকে সরে এসে চলে যায় অন্য দিকে। যে দিকের খবর আমাদের মতো আলট্রা মর্ডান মানুষদের কাছে নেই।  

তারপর সেই রাস্তা দেখতে দেখতে জানো, তাকে এক পাহাড়ের চুড়ায় নিয়ে যায়। আর আমরা নিচে থেকে তাকিয়ে থাকি আর দেখতে থাকি তাকে। সে তার কর্মের শিখরে উঠেছে। কোনও এক নিঃসন্তান দম্পতীর সাথে হয়তো, তার কোনও এক বাজারে বা দোকানে বা তাদের ফার্মাসিতে দেখা হয়েছিল। কথা হয়েছিল সামান্য, কিন্তু সেই সামান্য সম্পর্ক একটু একটু করে তার ভিতরে ঘর করতে শুরু করে। যাতায়াত শুরু করে সে তাদের বাড়ি। খুবই সাধারণ একটি পরিবার, রাজ্য সরকারের চাকরি করতো তার স্বামী। ভাঙা পুরনো একটি বাড়ি ছিল, দুই বা তিন জনের শরিকি। এটুকু ভর করেই চলেছিল সেই দম্পতির  সংসার। কিন্তু খুব আশ্চর্যজনক ভাবে তাদের জীবনে অনির প্রবেশ হয়। অনি তখন তার ঘরের একছত্র নেত্রী। তার শাশুড়ি মারা গিয়েছেন বছর দুয়েক হবে,  স্বামী পারিবারিক ওষুধের ব্যবসায় সারাটা দিন ব্যস্ত। বড় ছেলে থেকে অনির ছোট ছেলের বয়সের তফাৎ ছয় বছরের কিছু বেশি হবে। মাঝে আবার আরও দুটি আছে। বড়টা যখন আট কি নয় বছরের ছোটটি তখন আড়াই কি তিন হবে। পরিবার বলতে গেলে খুবই স্বচ্ছল। তারপর জানও কি হল অনির মধ্যে এক  অদ্ভুত পরিবর্তন এল। সে যেন এবার নিজেকে ছাপিয়ে গেল সব দিক থেকে। সেই নিঃসন্তান দম্পতির মধ্যে কি জানি কি দেখতে পেল সে। তাদের কথা দিয়ে  এল, একটি ছেলে সে তাদেরকে দান করবে মানুষ করার জন্য। এবং প্রায় কোর্ট কাছারির খবরও সে নিয়ে এসেছে। অথচ ঘরে কিছুই বলেনি। ভাবতে পার একজন মা যার ঘরের অবস্থা খুবই ভালো, সে তার একটি সন্তানকে দান করতে চাইছে এমনই একজন অনাত্মীয়া নারীকে যাকে সে কিছুদিন আগেও চিনত না। তার স্বামী জানতে পেরে তো ঘরে তুলকালাম বেঁধে গেল একবারে। এদিকে সে বেচারা ঘরে থাকে না খুব বেশি। যখন একটু ঘরে আসে দেখে ছেলে মেয়ে সব খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার সাথে বাচ্চাদের স্বাভাবিক একটা দূরত্ব রয়েছে। তার মাঝে ছোট ছেলে বাবা মায়ের খুবই ন্যাওটা হয়। সে আসে আর ছোটটিকে কোলে তুলে সামান্য কিছুক্ষণ খেলা করে। সেই প্রায় ঘরের প্রাণ প্রদীপ ছেলেটিকে, কেউ নিয়ে যেতে চাইছে তার কোল থেকে। বুঝতে পারছ?

বললাম – বুঝতে পারছি, কিন্তু তারপর কি হল, অনি মাসি কি দিয়ে দিল তার ছেলে?  

-না না অত সোজা নাকি। কিন্তু এই সব দৌড়াদৌড়ির মাঝে সেই দম্পতির এ বাড়িতে কিছুটা আসা যাওয়া শুরু হল। হ্যাঁ, কি যেন নাম ছিল তাদের সুপ্রসন্ন এবং তার স্ত্রী। একবার আমার সাথেও দেখা হয়েছিল। এই সব ঘটনার অনেকটা গড়িয়ে যাওয়ার পরে আমি জানতে পারি। অনি নাকি তার ছেলেকে দান করতে চলেছে। অত সুন্দর একটি ফুটফুটে বাচ্চা। কেউ কি পারে দিয়ে দিতে? এ কেমন মা! মা নাকি রাক্ষসী? নিজের বাচ্ছার বুক চিরে রক্ত খেতে চায় সে। পালতে  পারছে না তো আমাকে দিয়ে দিক। আমি মানুষ করবো, এত সুন্দর বাচ্চা, দেখলেই বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।  

বললাম – আপনার তো নিজেরই দুটি ছেলে মেয়ে ছিল। তাও আপনি নিজে নিতে চেয়েছিলেন?

-অবশ্যই নিয়ে নিতে চেয়েছিলাম, কেননা তুমি দেখনি, কি সুন্দর ছিল তার বাচ্চারা, যেন দেবশিশু। অনি বলতে গেলে তেমন সুন্দরী ছিল না, অবশ্য সাজলে তাকে ভালই লাগতো। চুল ছিল দুর্গা প্রতিমার মতো একঝাঁক, পিছনে ছেড়ে রাখতো সে। কপালে একটা বড় লাল সিঁদুরের টিপ। সে সময় পর্যন্ত এখনকার মতো টিপ আসেনি বাজারে। আর তার শরীর ছিল ঠিক যেন চাবুকের মতো। সে যখন আঁটসাঁট করে শাড়ি পড়ে দাঁড়াত চোখের দিকে তাকিয়ে, মনে হত নিজের অন্তর আত্মা পর্যন্ত তার হাতে সমর্পণ চায়। আমি অনির দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলেছিলাম কি করছো অনি, নিজের ছেলেকে দিয়ে দিতে চাইছো কেন? অনি দুহাত পিছনে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, দেবো বলেছি, কিছু তো ছিনিয়ে নিতে চাইনি। কথাগুলো খুবই ইঙ্গিতবহ ছিল, কেননা তখন পার্টির কাজে কোনো নীতি ছিল না। ছিল শুধু নিজের আখের গুছানো। আমাকে চুপ করে যেতে হয়। অনি আবার বলে, আর কিছুই নয় ওই যে মায়ের বাচ্চা হয় না তার সাথে কিছুটা সময় ভাগ করতে চেয়েছি, তাই বলে নিজেরটাকে পর করতে চাইনি। আর আমি বললেই যে হয়ে যাবে এমন কিছুতো নেই পৃথিবীতে। 

তারপর কস্তূরীর বাবা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে যায়, যেন অনি মাসীমার কথা নিজের মধ্যে অনুভব করছে। কোনো কিছুই কি আর আমি চাইলেই বদলে যেতে পারে? আমি শুধু আমার বিশ্বাসটাকে বদলাতে পারি আর কিছু নয়। আমি আমার বিশ্বাস আর তুমি তোমার বিশ্বাস। কিন্তু যখন আমি আমার বিশ্বাস বদলাতে চাই না বা ভাবতে থাকি আমারটাই, তখনই সংঘাত হয়। তখনই আমার চাহিদা হয়  তোমার মৃত্যু। তাহলে আর তোমার বিশ্বাস বেঁচে থাকবে না। কস্তূরী আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিল তা সাথীর না-ঘুমের মধ্যে নিজের ছেলেকে আমার দিকে  এগিয়ে দেওয়ার সামিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি প্রলুব্ধের মতো। নিজের ছেলেকেও কি এভাবে দেখেছি কোনোদিন। মনে হচ্ছে তার ছেলেকে যদি কোলে তুলে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করি তবেও হয়তো সে মা আমাকে যেতে দেবে।

-আবার না হয় কস্তূরীর বাবার কথায় ফিরি, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি যেন কোথা থেকে ফিরে এলেন। বললেন তারপর কি হল জানো, অনির মাঝের একটি ছেলে হঠাৎ একদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেল। চারিদিকে ঢিঢি পড়ে গেল, অনির ছেলে হারিয়ে গেছে। খেলতে গিয়েছিল বিকেলে আর ফিরে আসেনি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে এলো, সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত্রি। ছেলে আর ফেরে না। অনির বরের কাছেও খবর গেল, সেও ছুটল ছেলে খুঁজতে। সাথে সাথে এক গুজবও ছড়াল খুব। সেই বাঁজা জোড়া কোথায় গেল? তারা তো নিয়ে পালিয়ে যায়নি? খোঁজ শুরু হল এবার সেই সুপ্রসন্ন এবং তার স্ত্রীর। কোথায় গেল তারা এবং আশ্চর্যের তাদেরও খবর নেই। ঘরে তালা কোথায় গিয়েছে কাউকে বলে যায়নি। খোঁজ এবার ছেলের থেকে ফিরে ঘুরে গেল সেই সুপ্রসন্ন এবং তার স্ত্রীর দিকে। মানুষের মন বড় আস্থায়ী, সে শুধু কিছু একটা ইস্যু চায়। সব দোষ সব ত্রুটি, অনি আর সেই সুপ্রসন্নের উপর। তারা তো নেবেই, কেন অনি তাদেরকে ঘরে এনেছিল। অনির স্বামী, তার ছেলে, তার দিদি, তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। আর অনি যেন দিশেহারা, কোথায় যাবে কার কাছে বলবে সে এসব কিছুই চায়নি। আমি পাশে দাঁড়ালাম। কস্তূরীর মা-ই আমাকে বলল জানো অনির ছেলেকে মনে হয় সেই লোকটা নিয়ে পালিয়েছে। আমি বললাম কোন লোকটা? বলল সেই যে যাদের ছেলে নেই। আমার আর বুঝতে কিছুই বাকি ছিল না এই সময়ে অনির কি অবস্থা হচ্ছে। সে মুহূর্তেই ছুটলাম। দেখি অনি যেন ছেলে মরার খবর নিয়ে বসে আছে ঘরের মেঝেতে। তারপর খোঁজ চলল সারা রাত পুলিশ, পাড়া, লোকজন। যতটা সেই বাচ্চার খোঁজ তার থেকেও অনেক বেশি, সেই পালিয়ে যাওয়া সুপ্রসন্ন এবং তার স্ত্রী। লোকে তাদের পেলে প্রায় মেরেই ফেলবে এমন অবস্থা। যখন সারারাত এই সব উত্তাল হয়ে চলেছে, ভোরের দিকে দেখি একজন অপরিচিত লোক অনির ছেলেকে তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে নিয়ে আসছে। ঘটনা আর কিছুই না, এই লোকটির ছেলের সাথেই অনির ছেলে এক মাঠে খেলছিল। হঠাৎ খেলার শেষে সবাই যখন চলে গেছে এদের সামান্য ক্রিকেটে আউট হওয়া নিয়ে মারামারি শুরু হয়ে যায়। অনির ছেলেটি রাগের বসে ক্রিকেটের ব্যাট দিয়ে এক বাড়ি লাগায় সেই ছেলেটির মাথায়। ছেলেটি কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এই দেখে অনির ছেলে মার খাওয়ার ভয়ে  বল ব্যাট ফেলে দৌড় দেয়। তারপর ছেলেটি নিজে থেকে উঠেই বাড়ি গিয়ে বলতে তার বাবা নিজে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পরে, এক ঝোপের আড়াল থেকে তুলে আনে। বাড়ি কিছুতেই আসতে চাইছিল না। কোনও রকমে রাত কাটিয়ে নিয়ে এসেছে। 

আমি বললাম তারপর তাদের কি হল, সেই যে সুপ্রসন্ন। যাদের ছেলে মেয়ে ছিল না।

-উনি বললেন, তাদের খবর আর যেন কেউই নিতে চায়নি। চায়নি তারা আর ফিরে আসুক, এ ঘরে এ জীবনে। এমনকি অনিও চায়নি। তারা হয়তো কোথাও বদলি হয়ে চলে গেছিল। বা হয়তো তাদের দেশের বাড়ি। 

আমি বললাম গল্পটা কিন্তু শেষে এসে সেভাবে ঠিক জমল না। তাদের কি হল?

-উনি বললেন, সেই তো গল্প কিভাবে জমবে। জীবন যত কমপ্লিকেটেড হয় ততই না ভালো গল্প। তা তোমার নিরাশ হওয়ার দরকার নেই। তোমার জন্য এখনও অনেক কিছু আছে। তারা একটি বাচ্চা এডপ্ট করেছিল। নিয়েও এসেছিল তাকে অনিদের বাড়ি। বছর দেড়েকের বাচ্চা ছিল। রোগা কালো দেখতে খুবই অসুস্থ। দেখে খুব বেশি খুশি হওয়ার মতো কিছু ছিল না। তাও নিয়েছে যখন, একটু আদর করা কোলে নিয়ে। কিন্তু তাদের দেখে ভালো গেলেছিল, তারা খুশি ছিল সেই বাচ্চাটিকে নিয়ে। অথচ বিধি বড় বাম, বুঝলে, বাচ্চাটা বাঁচল না।  কি জানি কি অসুখ ছিল বাচ্চাটার, বাড় ছিল না। ছোট্ট হয়েই ছিল, এক বছর ছিল তাদের কাছে, বছর আড়াই বয়সেও দেখলে মনে হত বছর খানেকের।  অনেক ডাক্তার দেখিয়েছিল। কিন্তু তাও কি যেন এক অসুখ করলো মারা গেল বাচ্চাটা।  

 

(ক্রমশ)      

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন