কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

চিরশ্রী দেবনাথ

 

সমকালীন ছোটগল্প


প্রতিদ্বন্দ্বী


সামনে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা কাচের ফুলদানে রজনীগন্ধার স্টিকগুলো খুব সতেজ ও স্নিগ্ধ, জলের দানা লেগে আছে ফুলগুলোর পাপড়িতে, খুব সম্ভবত সকালেই জল স্প্রে করা হয়েছে তাদের ওপর, এখন ফুলেও প্রিজারভেটিভ দেওয়া হয়, যাতে তাদের রঙ, তাজা ভাব বেশ কিছুদিন থাকে। ঘরটির দেয়ালে বড় বড় ওয়েল পেইন্টিং, মেটফিনিশ ফ্রেমে বাঁধানো। সবকিছু অত্যন্ত সাজানোগোছানো, রুচিশীল। রিসেপশন কাউন্টারে সুন্দর দেখতে অল্প বয়সের দুটো ছেলে মেয়ে বসে আছে।

প্রয়াগ কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঘামছে এই এয়ারকন্ডিশন ঘরের আরামপদ আবহাওয়ায় বসেও। যদিও বাইরে থেকে , প্রয়াগের ভেতরে যে টেনশন চলছে তা এক বিন্দুও বোঝা যাচ্ছে না।

এবছর এটা তার চার নম্বর ইন্টারভিউ।

ছয়জন ক্যান্ডিডেট রয়েছে। এই সমস্ত জায়গায় একদিনে সবাইকে ডাকা হয় না। প্যানেল অনুযায়ী সিলেকশন চলতে থাকবে। প্রয়াগের অবজারভেশন এবং ক্যালকুলেশন হয়ে গেছে মনে মনে। ডানদিকের সোফায় বসা দুজনকে সে বাদ দিয়ে দিল আগেই। তাদের শার্ট, প্যান্ট ও টাই সামঞ্জস্যহীন। তার ওপর সামান্য ময়লা ও কোঁচকানো। মনে হয়, কয়েকবার পরা জামাকাপড় যেমনতেমনভাবে ইস্ত্রি করে পরে এসেছে। জুতোও অপরিস্কার। এতো বহিরঙ্গ। তাছাড়া যেভাবে টুকটাক কথা বলছে দুজনে, তাতে বোঝা যাচ্ছে তাদের এই ইন্টারভিউ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।

প্রয়াগের ঠিক পাশের চেয়ারে একটি মেয়ে বসে আছে। কুর্তি এবং জিনস পরে  এসেছে। গালে ব্রণের দাগ। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। চুলগুলো হর্সটেল  বাঁধা। একে দেখে ঠিক কর্পোরেট গ্রুপে জয়েন করার মতো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, কোন কিন্ডারগার্ডেনের আন্টি হলে মানাতো। সে কোন কথাই বলছে না। গম্ভীরমুখে বসে আছে। তবে একটু দূরের দিকের সোফায় আরো তিনজন বসেছে। একজন ছেলে, দুজন মেয়ে, তিনজনই খুব স্মার্ট। আর দুটো মেয়ে, পুরোপুরি যেন জয়েন করার জন্য রেডি হয়ে এসেছে। স্ট্রেট চুল, ঝকঝকে ত্বক, নিঁখুতভাবে চোখ ও ঠোঁটের মেকআপ করা। এই তিনজন পূর্বপরিচিত বোঝাই যাচ্ছে। মুখে ইংরেজি ও হিন্দির তুবড়ি ছুটছে। কথাবার্তায় যেসমস্ত টার্ম ছিটকে আসছে, তাতে তারা যে যথেষ্ট মেধাবী এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।  মেয়েগুলোর মধ্যে একটি মেয়ের নাম সোনিয়া, বাকি দুজন এই নামেই ডাকছে ওকে। তার দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে প্রয়াগের, কারণ মেয়েটি মিডি, টাইট টপ ও জ্যাকেট পরেছে। তার উদ্ধত বক্ষ এবং উন্মুক্ত দীর্ঘ ফর্সা পা যে প্রথমেই বসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ইন্টারভিউ তো পরে। এসব   জিনিস আজকাল প্রয়াগকে ভাবতে  হয়, এই পোশাকে মেয়েটির এখানে না এলেও চলত। কিন্তু মেয়েটি তা পরে এসেছে উদ্দেশ্যেমূলক ভাবে, যাতে সহজেই ইন্টারভিউ বোর্ডের পুরুষ মেম্বাররা তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে।  মনে মনে মেয়েটিকে ভীষণ বাজে একটি গালাগাল দিল প্রয়াগ। এদের জন্যই যোগ্য ছেলেদের চাকরি আজকাল আটকে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ফিগার সুন্দর রেখেছে, এটাও কর্পোরেট চাকরিতে একটি কোয়ালিফিকেশন হিসেবে মেয়েটি তুলে ধরতে চাইছে। দেখলে যতটা সফিস্টিকেটেড মনে হয়, আসলে খোঁজ নিলে দেখা যাবে খুবই সাধারণ পরিবারের মেয়ে, শুধু গ্রুমিং করেছে নিজেকে।

প্রয়াগ আপাতত চাকরি করছে অন্য একটি বেসরকারি ফার্মে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনীয়ার হিসেবে দুবছর ধরে তার ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে। যে বেতনে চাকরিতে ঢুকেছিল, আপাতত বেতন তার চাইতে কিছু কম করে দেওয়া হয়েছে পেনডেমিকের কারণে। তারা এখন চায় অফিসে গিয়ে কাজ করতে কিন্তু মালিকপক্ষ তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছে না। এভাবেই কাজ চলছে, তেমন কিছু তো অসুবিধে হচ্ছে না। দু তিনজনকে মাত্র অফিসে ডাকা হয়েছে যারা একটু সিনিয়র পোস্টের, তারাই অফিস থেকে  সব জরুরী ইনস্ট্রাকশন দেয়। এদিকে বাড়ির পরিবেশে কাজ করতে করতে প্রয়াগ হাঁফিয়ে উঠেছে। তার পরিবারে যথেষ্ট শান্তি নেই। দাদা, বৌদি,  তাদের দুই ছেলেমেয়ে, মা, বাবা এবং ছোটকাকা। দিদির বিয়ে হয়েছে, তবে প্রায়ই আসা যাওয়া আছে খুব স্বাভাবিকভাবেই। সামান্য পারিবারিক ঝগড়া প্রায়ই হয়।

আগে দুই ভাই মিলে একটি বড় ঘরে থাকত। এখন সেই ঘরের ডালপালা একটু বাড়িয়ে, এটাচড বাথরুম ইত্যাদি মিলিয়ে দাদা বৌদি ও তাদের ছেলেমেয়েরা থাকে। মাঝখানে কিচেন সংলগ্ন ডাইনিং স্পেশ এবং ড্রয়িং, একটিই হলঘর মোদ্দা কথা। একপাশে মা বাবার ঘর ও স্টোররুম, স্টোররুমেই এক পাশে সামান্য জায়গা রয়েছে, সেখানে ব্যাচেলর ছোটকাকার খাট, টেবিল, সামান্য বইপত্র ও জামাকাপড়। তারপর বাথরুম, ছোট বারান্দা। ছাদের সিঁড়ি। দেড় কাঠার মতো জায়গা কিনে শহরাঞ্চলে মোটামুটি এই বাড়ি বানাতে ও তাদের পড়াশোনা করাতে প্রয়াগের বাবার সব পুঁজি শেষ। বর্তমানে মা বাবার ঘরেই আরো একটি খাট ম্যানেজ করে প্রয়াগ ঘুমোয়। সকাল থেকে বাইরে কাজ করে, রাতে ঘরে এসে ল্যাদ খেলে তেমন কোন ব্যাপার না। কিন্তু এতো বড় ছেলের পক্ষে সারাদিন সেখানে বসে কাজ করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে উঠেছে।  মা বাবার সামনে ফোনে সব কথা বলা যায় না, বন্ধুদের সঙ্গে ইচ্ছেমতো খিস্তি ব্যবহার করে পেট হালকা করা যায় না। পঁয়ষট্টি বছরের বাবা এবং ষাটবছরের মাকে প্রবল ভালোবাসলেও প্রয়াগের খুবই অসুবিধে হচ্ছে।  যখন তখন ছাদে যেতে হয়। টাকা জমিয়ে ছাদে নিজের জন্য ঘর বানাতে হবে, তবে তত সহজ নয় সবকিছু।

ইন্টারভিউ শুরু হয়েছে ঠিক সকাল দশটায়। সেন্ট্রাল এসি করা অফিসের বাইরে প্রবল রোদ। অসহ্য গরম। চারদিকে নতুন নতুন বিল্ডিংএর খাঁচা। শহর ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এখান থেকে যে বিশাল হোর্ডিংটা চোখে পড়ে তা গুঁড়োমশলার বিজ্ঞাপন। সুন্দরী গৃহিনী গুঁড়ো মশলার প্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁত বের করে হাসছেন। কিছু নাড়কেল সুপারি গাছের মাথা। চোখে পড়ার মতো আর কিছু নেই।

পর পর তিনজন বেরিয়ে এসেছে ইন্টারভিউ দিয়ে। বাকিরা তাদের ছেঁকে ধরেছে, প্রয়াগ এসবে নেই। বুকভরা নির্লিপ্তি নিয়ে বসে আছে। আগের চাকরি থেকে দশহাজার টাকার মতো বেশি বেতন অফার করা হয়েছে দেখে সে এসেছে। তবে এসব ক্ষেত্রে যা বলা হয়, তা প্রায়শই খুব একটা মানা হয় না। ভেতরে ভেতরে ফাঁকি থাকে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্যান্ডিডেট সোনিয়ার ঠিক আগে প্রয়াগের ডাক পড়ল।

রুমের ভেতর ঢুকে প্রয়াগ একটু অবাক হলো। যে তিনজন বসে আছেন, তারা  বেশ বয়স্ক, সাধারণত ইয়ং সফটওয়্যার ইঞ্জিনীয়াররা থাকে অন্য জায়গায়। প্রয়াগের  এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন, কোথায় কাজ  করছে সমস্ত ডকুমেন্ট আগেই জমা করা ছিল। তবুও এখন যে প্রজেক্টর ওপর প্রয়াগ কাজ করছে, তা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তারা অনেককিছু জিজ্ঞেস করলেন। প্রয়াগ নিজের সাবজেক্টের  ওপর প্রশ্ন করলে খুব আনন্দ পায়। তখন তার মুখে আত্মবিশ্বাস ঝলমল করে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য সে যেন ভুলে যায় ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। এখানেও তাই হলো, প্রোগ্রামিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার সমস্ত এডভান্স নলেজ প্রকাশ পেলো ভালোভাবেই। প্রায় আধঘণ্টা চলল ইন্টারভিউ। মনে হলো ওনারা বেশ প্লিজড।

বাইরে বেরিয়ে দেখল, সবাই চলে গেছে, শুধু সোনিয়া অপেক্ষা করছে তার পালা কখন আসবে। যেহেতু সবকিছুই মোবাইলে জানানো হবে, তাই হয়তো বাকিরা আর সময় নষ্ট করেনি। অফিসটির বাইরে বেরিয়ে, গেটের কাছে এসে প্রয়াগ দেখল একটি ক্যান্টিন রয়েছে। প্রয়াগের খুব ইচ্ছে সে সোনিয়া নামের    মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে। কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে সোনিয়াই তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। তাকে একটু যাচাই করতে মন চাইছে। ক্যান্টিনে চা আর স্যান্ডউইচ নিয়ে সে একটি টেবিলে বসল যেখান থেকে সোনিয়া বেরিয়ে এলেই দেখা যাবে। খাবার যথাসম্ভব আস্তে আস্তে খেয়েও শেষ হয়ে গেলো। এখনো সোনিয়া বেরিয়ে আসেনি। একটু উসখুশ করতে লাগল প্রয়াগ। খাবার শেষ হওয়ার পর বেশিক্ষণ বসে থাকা ভালো দেখায় না। এমনসময় দেখা গেলো সোনিয়া বেরিয়েছে। বাইরে এসেই দুপুরের পড়ন্ত রোদে  সানগ্লাশ পরল। প্রয়াগ এগিয়ে গেলো।

এক্সকিউজ মি।

সোনিয়া তাকাল। আপত্তি না থাকলে একটু পরিচয় করার ইচ্ছে ছিল।

বলুন।

কেমন হলো ইন্টারভিউ।

সোনিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, দারুণ। মনে হয় আশা আছে।

সামান্য দমে যাওয়া মন নিয়ে প্রয়াগ ভাবল, হবেই তো, যা ড্রেস পরে এসেছো! তার মন থেকে যেন সোডার মতো গালাগাল বেরিয়ে আসতে চাইছে।

আচমকা প্রয়াগ বলে উঠল, ইন্টারভিউ দিতে এলে কি এমন পোশাক পরে আসতে হবে? ক্লিভেজ না দেখালে বুঝি চাকরির সম্ভাবনা কম? না এটাও এখন কোয়ালিফিকেশন?

বলেই বুঝল এভাবে বলা ঠিক হয়নি। তার এখন চড় খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

কিন্তু প্রয়াগকে অবাক করে দিয়ে, সোনিয়া বলল, এজন্যই কি আপনার ব্রাইট চোখদুটো সারাদিন আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। আমি ভাবলাম প্রেমে পড়েছেন। এখন বুঝলাম আমার পোশাক পছন্দ হয়নি।

তারপর হাসতে হাসতে সোনিয়া বলল, শুনুন, আপনার কী কোয়ালিফিকেশন আমি জানি না। তবুও আমার ডিগ্রিও নিতান্ত কম নয়। কিন্তু আগেও বেশ কিছু ইন্টারভিউ দিয়েছি। দিতে দিতে পালক খসিয়েছি। এখনও চাকরি করছি একটি। হয়তো আপনিও করছেন। আমার পরিশ্রম কিন্তু কম নয়। তবে আরো ভালো পোস্ট দরকার। নাহলে পোষাচ্ছে না। আপনার যেমন পোষাচ্ছে না, তেমনি আমারো। তাই কিছুটা মোহময়ী করলাম নিজেকে। যদি বাড়তি সুবিধা মেলে। সোনিয়া খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে বোঝা গেলো। প্রয়াগের কথায় রাগ দেখাল না একটুও।

প্রয়াগ কিন্তু থামল না। মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের নীচে নামায়, বুঝলেন, হিসহিস করে বলল। আশ্চর্য সে তো কোনদিন এমন প্রতিক্রিয়াশীল ছিল না। আজ অপরিচিত একটি মেয়ের পোশাক যেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

সোনিয়া এবার গম্ভীর হয়ে বলল, আসি কেমন। চাকরি পেলে দেখা হবে। ওরা শুনেছি বেশ কিছু সফটওয়্যার ইঞ্জিনীয়ার নেবেন। কী জানি, হয়তো দুজনেই সিলেক্ট হবো। ছুটন্ত অটোকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করালো সোনিয়া, সামান্য হাসল, প্রয়াগকে টা টা দেখালো, তারপর উঠে গেলো অটোতে।

মেয়েটি চলে যাওয়ার পর, প্রয়াগের নিজের কাছে নিজেকে হঠাৎ খুব ছোট মনে হতে লাগল। দূর বিনাকারণে একটি অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে সে ভুল করেছে। কারো ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা তার উচিত নয়। হয়তো মেয়েটি অন্যদের সঙ্গে এবিষয়ে গল্প করবে, হয়তো ফেসবুকে নারী স্বাধীনতা নিয়ে স্ট্যাটাস লিখবে। সেখানে বর্ণনা থাকবে এক নাম না জানা হীন প্রবৃ্ত্তির যুবকের যে কিনা এযুগের ছেলে হয়ে এসব নিয়ে মাথা ঘামায়। সেই স্ট্যাটাসের নিচে পাঁচশ লাইক, কয়েকশো প্রতিবাদী কমেন্ট হবে। কী মনে করে প্রয়াগ আবার চারতলায় গেলো, রিসেপশনিস্ট মেয়েটির  কাছে সোনিয়ার ফোন নং  চাইল। মেয়েটি প্রথমে কিছুতেই দিতে রাজি হচ্ছিল না, তবে নানান কথা বলে প্রয়াগ ফোন নং  আদায় করল। ভাবল রাতে ফোন করে সরি বলবে।

কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখল, দিদি তার দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছে, মা বাবার ঘরে সবাই বসে আছে। অগত্যা প্রয়াগকেও বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে হলো, তারপর এক ফাঁকে ছাদের অসম্পুর্ণ চিলেকোঠায় উঠে গেল। যা বিশ্রি গরম, আজ খোলা ছাদেই ঘুমোবে প্রয়াগ। তার আগে সোনিয়া নামের মেয়েটিকে ফোন করা দরকার।

সাত-পাঁচ ভেবে ফোনটা করেই ফেলল প্রয়াগ। তারপর আগের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ  ভুলে বলল, একবার দেখা করতে চাই, যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

মেয়েটি এড্রেস বলে দিল। পরদিন বিকেলবেলা প্রয়াগ গিয়ে পৌঁছুলো মেয়েটির বাড়ি। তার সাতাশ বছরের জীবনে এই প্রথম সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মেয়ের বাড়ি এভাবে আসা। ছিমছাম দোতলা বাড়ি, মোটামুটি স্বচ্ছল অবস্থা বলা চলে বাড়ি দেখে, যদি বাড়িটি সোনিয়াদের নিজস্ব হয়। ডোরবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলল সোনিয়াই। চেক চেক ট্রাউজার আর টি শার্ট পরা। আসুন প্রয়াগ। কালকের মতোই স্বচ্ছন্দ, সপ্রতিভ। একটি করিডোর পেরিয়ে, সোনিয়া তাকে যেখানে নিয়ে এলো, মনে হলো এটা সোনিয়ার কাজের ঘর, সোফার ওপর ছড়ানো ছিটানো প্রচুর ম্যাগাজিন। দুটো  ল্যাপটপ, সাউন্ড সিস্টেম। একপাশে পরিপাটি করে ভাঁজ করা কিছু পোশাক, বড়ো বড়ো দুটো ফ্লাওয়ার ভাসে এরিকা পাম ঘরটিকে সজীবতা দিয়েছে।

প্রয়াগও বেশ ফ্রি অনুভব করছে। প্রথমে সোনিয়ার কাছে দুঃখপ্রকাশ করল। তার ওভাবে বলা উচিত হয়নি। তারপর ঘন্টাখানেক যে কোনদিকে দিয়ে গেলো গল্প করতে করতে, তা বোঝা গেল না।

সোনিয়ার মা বাবা পরিচয় করে গেলেন, কফি, চাউমিন হলো। প্রয়াগ বহুদিন পর যেন কোনো বন্ধুর সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলল। আবারও দ্রুত তাদের দেখা হবে, এটা বোঝা গেল সেই সন্ধ্যার প্রাণখোলা আড্ডার পর।

নাহ্ সেই চাকরিটা তাদের কারো হয়নি। চশমা পরা গম্ভীরবদনা মেয়েটি এবং যাদের পোশাক বেশি ধোপদুরস্ত ছিল না, তাদের মধ্য থেকেই একটি ছেলে পেয়েছে। সেই নিয়ে জলঘোলা করে কোন লাভ নেই, ভাগ্যে কার কখন কেন শিকে ছিঁড়বে কিছুই বলা যায় না। তার চেয়ে কাজের কথা হলো, নিজেদের খোঁজ

জারি রাখা। কোথায় ইন্টারভিউ আছে, কোন নতুন কোম্পানি তাদের ব্রাঞ্চ নিয়ে এই শহরে উপস্থিত হয়েছে।

সোনিয়া মেয়েটিকে প্রয়াগের হঠাৎ করে খুব ভালো লেগে গেছে, কী স্মার্ট মেয়েটি। সবচেয়ে মজা লাগে ওর দিকে ছুঁড়ে আসা তিরগুলোকেও সে হেসে হেসে উড়িয়ে দেয়। প্রয়াগ এতোদিন জানত ও যেভাবে প্রিপারেশন নেয় সেটাই ঠিক, সোনিয়ার কাছে এসে জানল তার অনেক খামতি।

সেদিন খুব মেঘলা দিন। এরকমই কাচের ঘর। টেনশন নিয়ে বসে থাকা কিছু চাকুরিপ্রার্থী। সোনিয়ার নিঁখুত সাজ, প্রয়াগ মিটিমিটি হেসে বলল, মনে হচ্ছে আজ আমাদের চাকরি হবে।

কেন?

আজ খুব বৃষ্টি হবে বিকেলে, বৃষ্টির দিনে আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো খবরগুলো আসে, যেমন পরীক্ষার রেজাল্ট, বসের প্রশংসা, নতুন প্রজেক্টের খবর ইত্যাদি।

সোনিয়া বলল, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা নয়। দেখাই যাক।

এবার সত্যিই চাকরির খবর এলো, তবে প্রয়াগ নয়। সোনিয়া পেলো। লিস্টে সোনিয়ার নাম দেখে প্রয়াগ খুশি হতে চেয়েও পারছিল না। কেমন যেন কিছুদিন আগের সেই বিদ্বেষটা ফিরে ফিরে আসছে।

ছাদের কোণে ভর সন্ধ্যাবেলা একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে প্রয়াগ, খুব অস্থির হয়ে আছে মনটা। সোনিয়ার সঙ্গে কি ও আর আগের মতো মিশতে পারবে, কোথায় যেন ফাটল তৈরি হলো।

নিচে খুব হইচই হচ্ছে, যেন কেউ এসেছে। প্রয়াগের ইচ্ছে হচ্ছিল না দেখতে, তবুও কৌতুহলী হলো। আরে মা’র সঙ্গে ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছে সোনিয়া!  অন্যরাও আছে। মিষ্টি নিয়ে এসেছে। প্রয়াগ দুঃখ পেলো। সোনিয়া যেন ওর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে এসেছে। প্রথমদিনের বিদ্রুপ মনে পুষে রেখেছে বোধহয়। আজ ফেরত দিচ্ছে সুদে আসলে।

তবে বাইরে কিছু বলল না। জোর করে প্রচুর খুশি হওয়ার ভান করে সোনিয়াকে অভিনন্দন জানাল।

সোনিয়া হেসে বলল, আমি চাকরি পেয়ে, সেটা জানাতে আসিনি প্রয়াগ। চাকরি না করে দিয়েছি। যে সমস্ত কন্ডিশন দিয়েছে তা আমার পোষাবে না। আমি এমনি এলাম।

প্রয়াগের মন থেকে ভার নেমে গেলো। বুঝতে পারল, সে অত্যন্ত পুরুষ ইগো নিয়ে চলা একজন হিংসুটে লোক। তবুও নিজেকে মাপও করে দিল, জমানাই এমন, সবার সঙ্গে সবার শুধু প্রতিযোগিতা। সোনিয়ার কথা বাড়ির সবাই অল্পবিস্তর শুনেছে, বাকিটা সোনিয়া নিজের উপস্থিতি দিয়েই পুষিয়ে দিয়েছে আজ।

চা পর্ব শেষ হলে প্রয়াগ সোনিয়াকে ছাদে নিয়ে এলো।

কেন করুণা করছো সোনিয়া?

করুণা নয় প্রয়াগ, আসলে বৃষ্টির দিনে ভালো খবর আসে এই ধারণাটা তোমার জীবনে সত্যি থাক, এটাই চাইছি আমি। জানি তোমার মনের এইসব সংকীর্ণতা, দ্বিধা, ইগো আসলে থাকা উচিত নয়। কিন্তু তবুও আছে, বিশেষ করে যদি প্রতিদ্বন্দ্বী তারই সমবয়সী কোন মেয়ে হয়। আমি যদি পুরুষ হতাম, তুমি কিন্তু ততটা আহত হতে না প্রয়াগ।

তবুও না হয় কোন একদিন একসঙ্গে দুই বন্ধুতে সেলিব্রেট করবো নতুন চাকরি, কী বলো?

একটি চাকরিই তো, না পেলে বা ছেড়ে দিলে যদি খুব নরম কোন বিশ্বাস বেঁচে থাকে একজন মানুষের মনে, তাকে দূর থেকে বাঁচিয়ে রাখি। সোনিয়ার দৃষ্টি অন্যদিকে, একটু দূরে, যেন আকাশ আর মেঘ দেখছে সে।

প্রয়াগ আর কিছু বলতে পারল না, পৃথিবীতে কোন কোন মানুষ আসলেই ভীষণ ভালো হয়...

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন