কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩

কালিমাটি অনলাইন / ০২

সম্পাদকীয়



‘কালিমাটি অনলাইন’ দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘কবিতার কালিমাটি’, ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ ও ‘ছবিঘর’ –- এই তিনটি বিভাগের পাশাপাশি প্রকাশ করা হলো প্রয়াত শিল্পী গণেশ পাইনের ওপর একটি ছোট্ট ক্রোড়প্ত্র। গণেশ পাইনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিল্পীর স্মৃতিচারণা, কয়েকটি স্কেচ এবং প্রয়াত শিল্পীর কিছু ছবি। খুবই সামান্য আয়োজন। তাঁর শিল্পচর্চা ও ব্যক্তিজীবন পর্যায়ে আরও কিছু লেখা আমরা এই সংখ্যায় প্রকাশ করব, মনস্থ করেছিলাম। কিন্তু যথাসময়ে লেখাগুলি সম্পাদকীয় দপ্তরে না আসায় পরবর্তী কোনো সংখ্যায় সেগুলি প্রকাশের জন্য রেখে দেওয়া হলো। আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও বিনম্র প্রণাম জানাই এই অসামান্য শিল্পীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন কবি রতন দাশ। ষাট বছর অতিক্রম করার বছর পাঁচেক আগেই তিনি অবসর গ্রহণ করলেন জীবন থেকে। এবং কবিতা থেকেও। তাঁর কবিজীবন মূলত শুরু হয়েছিল ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ পত্রিকা থেকে। পরবর্তী সময়ে তিনি কোনো বিশেষ পত্রিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়তো ছিলেন না, কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। সাধারণ কবিতাচর্চায় তিনি আদৌ উৎসাহী ছিলেন না, বরং তিনি গভীর মনোনিবেশ করেছিলেন প্রতি-কবিতার প্রতি। আর মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন তাঁর পরিচিতজনদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। বাংলা কবিতায় প্রয়াত কবি রতন দাশের অবদান আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে ভবিষ্যতেও স্মরণ করব। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে জানাই আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা।

প্রসঙ্গত আপনাদের কাছে আবার বিনীত অনুরোধ, প্রকাশিত লেখা ও ছবিগুলি সম্পর্কে আপনাদের অভিমত ‘কমেন্ট বক্স’-এ অবশ্যই জানাবেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক ও মননশীল কবিতা, ঝুরোগল্প ও ছবি পাঠিয়ে ‘কালিমাটি অনলাইন’কে আরও সমৃদ্ধ করবেন।

শুরু হলো নতুন বাংলা বছর ১২০। আপনাদের সবাইকে জানাই নতুন বছরের প্রীতি শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সবাই ভালো থাকুন। আনন্দে থাকুন।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : kalimationline100@gmail.com

প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :

0657-2757506 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Parvati Condominium, Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India




ভূদেব ভকত

গণেশ পাইন



দেবব্রত চক্রবর্তী

আড্ডা টেবিলের গণেশদা
দেবব্রত চক্রবর্তী


আমাদের আর্ট কলেজ জীবনের প্রারম্ভেই শিল্পী গণেশ পাইন আমাদের মধ্যে তাঁর শিল্পদ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি চাক্ষুষ পরিচয় আর সত্তর দশক থেকে প্রায় দু’দশক জুড়ে গণেশদার আড্ডা টেবিলের একজন মন্ত্রমুগ্ধ আড্ডাধারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। খুব কাছ থেকে মানুষটিকে জানার ও বোঝার সুযোগ ঘটেছিল। গণেশদার আড্ডার ঠেক কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ৬০ দশক থেকে ৯০ দশক জুড়ে। ধর্মতলার সোডা ফাউন্টেন রেস্টুরেন্ট বা কাফে ডি মণিকোতে আমার সেরকম ভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি, তবে কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনের আড্ডার টেবিলে একটু জায়গা পেয়েছিলাম। প্রথম আলাপ উত্তর কলকাতার শ্রীমানী মার্কেটের দোতলার পলেস্তারা খসা মন্দার মল্লিকের স্টুডিওতে। ওখানে উনি বিনা পারিশ্রমিকে অ্যানিমেশন ড্রইং করতেন। আমার অ-শিল্পী বন্ধু গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘গণেশদা, আমার এই বন্ধু আর্ট কলেজে পড়ে। আপনার ভক্ত’। গণেশদা ছবি আঁকতে আঁকতে চশমার ফাঁকের উজ্জ্বল দুটি চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে গোপালকে বলেছিলেন, ‘আমার আবার ভক্তও আছে নাকি?’ মধ্য কলকাতায় গণেশদার পৈতৃক বাড়ি ছিল কবিরাজ রো-তে। সেখানে কর্মরত ঐ শিল্পীকে দেখেছি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর ফুটপাথ ধরে ধুতির কোঁচা সামলে গেরুয়া পাঞ্জাবী পরিহিত গণেশ পাইনের সঙ্গে পথে হেঁটেছি। বিস্মিত হয়েছি ওঁর শিল্প সাহিত্যের পড়াশোনায়। ছবির নির্মাণ, কম্পোজিশনের যথার্থতা আর গণেশ ঘরাণার টেম্পারা সমৃদ্ধতা আমাদের বিস্মিত ও শ্রদ্ধানত করেছিল, যা আজও অটুট। ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর কার্টুনিস্টের চাকরি হওয়ার পরে আমার কার্টুন নিয়ে আগ্রহভরে নানা প্রশ্ন করতেন। ‘আমারও প্রিয় বিষয় কার্টুন’ –- একথাও বলতেন। সমাজের বিভিন্ন দিক কার্টুনিস্ট তুলে ধরেন, সেই কথাটা বলে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত ‘পাঞ্চ’ ম্যাগাজিনের কার্টুনিস্ট ডেভিড ল্যাংডনের গল্প শুনিয়েছিলেন। একটা বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে চলে যেতেন। এখন তো চলে গেলেন অন্যলোকে।

ভারতবর্ষের প্রথম সারির এই শিল্পীর ২০১৩-র ১২ মার্চ প্রয়াণের খবর দেশে ও বিদেশে আলোড়ন তুলেছিল।

হিরণ মিত্র

গণেশ পাইনের সীমাবদ্ধতা (সিমা?)
হিরণ মিত্র



উপরের এই নামকরণে আমার দ্বিধা আছে। নিজের মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত। তবুও সমস্ত তথাকথিত শিল্পীকুলের মনের ভেতরে উদ্বেগ-জারিত এই শব্দবন্ধ আমাকে প্ররোচিত করলো এমন বাক্যে। দুঃখিত এজন্য। ক্ষমাপ্রার্থী। তবুও। খুঁজে দেখা যাক আজকের শিল্পীর, শিল্পের অবস্থানের কানাগলি। কথিত আছে, চিত্র-আবেগ, দৃশ্য-আবেগ, শিল্পীর মনের মধ্যে উদিত হয়। তা ভোরের আকাশ হতে পারে, সন্ধ্যার বিদায়লগ্ন হতে পারে। ঘন কালো রাত্রির বিষাদগ্রস্ত, রাতজাগা, কর্কশ, নিঃশব্দ, চোখ থেমে যাওয়া, প্রাচীরের মতোও হতে পারে। তখন কী হয়, কে জানে? তবুও জানা নির্দেশিত হতে পারে। অলক্ষ্যে কেউ কোথা হতে ফিস ফিস করে উঁকি মেরে যেতে পারে। তার নাম ‘বাজার’। এই সম্বন্ধে যত কম বলা যায়, যত কম সেঁধানো যায়, ততই আশ্বস্ত বোধ করি। এড়িয়ে চলতে চাই। এই নয়, ‘বাজার’ আমাকে আতঙ্কিত করে রেখেছে, এই জন্য যে আমার প্রিয় শব্দ বাক্য –- ‘আঙুরফল টক’। যে আঙুরফল গাছের উপর ঝুলছে, তাকে আমাদের মতো শেয়ালরা ‘টক’ বলতেই অভ্যস্ত। তাতে কিছুক্ষণের শান্তি। শান্তি চিত্রে, শান্তি লিখে, শান্তি ভাবনায়। যদি সত্যিই কারও ভাগ্যে ওই আঙুরফল পেকে, মুখে এসে পড়ে, তখন তার পরিণতি কী হতে পারে, ভেবে আমি আতঙ্কিত হই।

মহাভারত নিয়ে গণেশ পাইনের বিখ্যাত এক সর্বশেষ চিত্র প্রদশর্নী, নামকরা বা একমাত্র শিখপীঠ বা তীর্থস্থানে হয়েছিল। ডায়েরির পাতায় দেখলাম লেখা আছে, ‘গণেশ পাইন তাঁর শবদেহ পাহারায় আছেন’। পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অনেক বছর আগের দেখা। কেন শবদেহ, কেন পাহারা দেওয়া! যে বিবরণ, যে নতুন ব্যাখ্যা, যে নতুন মহাভারত, কারণ এখানে বালী এসেছেন, একটা বিস্তৃত মৃত্যুভূমি, প্রান্তর জুড়ে পোড়া মৃতদেহের গন্ধ; রঙের তেমন পরত নেই, রেখা অন্যমনস্ক, যে অন্যমনস্কতাকে কুর্নিশ করে এসেছি, মনস্কতার সাথে, যে অন্যমনস্কতায়, আত্ম আবিষ্কারের মিথ বা গাথা রচিত হয়, অজান্তে, অজানা, অকথিত, ভিন্ন কল্পকাহিনী মাটি ফুঁড়ে, কাগজ ফুঁড়ে জেগে ওঠে, তার মনস্ক প্রয়োগ দেখলাম। আর এখানেই হয়তো সীমাবদ্ধতা বা ‘সিমাবদ্ধতা’! একটা বাধ্য বাধকতার ছাপ। সময়ের বাধ্য বাধকতা, ভাবনার বাধ্য বাধকতা, বিষয়ের বাধ্য বাধকতা। একজন গুহা আবিষ্কারে আছেন। হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ, পথ চেনার জন্য। হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় নিভে গেল তা। অন্ধকার পথ, অজানা। কবিতার, চিত্রের জন্ম হলো তখনই। বাকি পথ এমনই আঁধারে ভরা। এই অনিশ্চিত জীবনে ‘বাজার’ আনলো নিশ্চিন্তি ও মৃত্যু, শিল্পীর ও শিল্পের। হায়! সত্যিই আঙুরফল টক কখনো কখনো! আবারও আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

“সাফল্য এলো, ততই একা হয়ে গেলেন গণেশ”। (বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত)

মৃদুল বন্দ্যোপাধ্যায়

সুখস্মৃতি বয়ে চলেছি
মৃদুল বন্দ্যোপাধ্যায়



১৯৫৫, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। প্রথম দু’বছর সব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী, একসঙ্গে ক্লাস। নতুন এক ছাত্র এলো। শুনলাম খুব ভালো ড্রইং করে বলে মাস্টারমশাইরা সরাসরি সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি করেছেন। পরিচয় হলো। --‘কোন্‌ ডিপার্টমেন্ট? আমার কমার্শিয়াল আর্ট, তোমার?’ –-‘আমি তো ফাইন আর্টসে’। ক’দিনের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতা হলো।

মাস তিনেক পরেই একদিন ছুটির পর বলল –-‘চল একটু ঘুরে আসি’। নিউইয়র্ক সোডা ফাউন্টেনের গলি দিয়ে স্টেটস্‌ম্যান অফিস হয়ে ওদিকের ফুটে এগিয়ে চলেছি। পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবী কালোপাড় ধুতি কোঁচা হাতে ধীর পায়ে গণেশের নিজস্ব ভঙ্গিতে হাঁটা। ওই ফুটেই ওরিয়েন্ট লঙম্যানের অফিস। দোতলায় চিত্রপ্রদর্শনী। একটা ছবির সামনে এগিয়ে বলল, ‘দেখ কেমন লাগছে! বুদ্ধ ও সুজাতা। টেম্পারা মাধ্যম। অবনীন্দ্র ছাপ বসানো। ছবিটি পুরষ্কৃত হয়েছে’।

পুজোর ছুটি –- ঠিকানা বিনিময়। কবিরাজ রো-এর সঙ্গে বেলঘরিয়ার কে. পি. ঘোষাল রোড। ক’দিনের মধ্যেই তুমি থেকে তুই হয়েছি। পোস্টকার্ডে প্রথম দিকে যে কোনো একটা স্কেচ। নিচে ও অপরদিকে দু’চার কথা। এবং সেই আদি ও অমলিন স্বাক্ষর –- গণেশ পাইন। অফিসে বা সরকারী কাজ ছাড়া ইংরেজিতে সই করতে দেখিনি। দু’চারটে চিঠি দেওয়া নেওয়ার পর কী মনে হলো, দু’লাইন কবিতা লিখে ফেললাম। ব্যস, শুরু হলো গণেশ পাইনের কবিতায় উত্তর। সে কথায় পরে আসছি।

সৌভাগ্যবশত পাশ করেই ফুলিয়া পলিটেকনিকে শিক্ষকতা। সেখানেই থাকতে হয়, কোনো কোনো শনিবার বাড়ি আসি। সোডা ফাউন্টেন বা বসন্ত কেবিনের আড্ডায় যাবার আর অবসর হয় না। পাঁচ বছর পর নিজের কলেজেই শিক্ষকতার সুযোগ পেলাম। অধ্যক্ষ হিসাবে চিন্তামণি কর, সুশীল সেন ও শেষে সত্যেন ঘোষাল –- সকলেই আমার মাস্টারমশাই। বিশেষ করে টিচার্স কাউন্সিলের সম্পাদক ও কলেজের গভর্নিং বডির টি. আর ছিলাম বলে প্রয়োজনে ডাক পড়ত।

ইন্ডিয়ান পেন্টিং বিভাগের প্রধান ইন্দুভূষণ রক্ষিত অবসর নিলেন। মাস্টারমশাই সত্যেন ঘোষাল আমায় ডেকে বললেন –-‘গণেশ তো তোমার খুব বন্ধু, ওকে বলো না, ঐ বিভাগে জয়েন করতে!’ গণেশকে সব কথা বললাম। শুনে বলল -–‘ভেবে দেখি’। নিজেরই কলেজ, তায় বিভাগও ভারতীয় শিল্প ঘরানা। বেশ কিছুদিন পর মাস্টারমশাই আবার জানতে চাইলেন, কী হলো! গণেশকে বলায় ওর উত্তর -–‘শোন্‌ আমি কি পারব মাস্টারী করতে! ও আমার ধাতে সইবে না। আর একটা কথা, ছাত্র-ছাত্রীদের ছবির কথা ভাবলে, আমার ছবির কথা ভাববো কখন? ও আমার দ্বারা হবে না!’

আবার গণেশের চিঠির কথায় আসি। ফুলিয়া থাকাকালীন যে-সব চিঠি -– সঙ্গে অন্যান্য সহপাঠী বিশেষ করে প্রাণের বন্ধু লালুপ্রসাদ, ঈশা মহম্মদ, সুরজিত দাশ, দেবীপ্রসাদ, শুক্লা, অঞ্জনা, মাস্টারমশাই ধীরেন ব্রক্ষ্ম, রথীন মিত্র ও আরও অনেকের চিঠি ছিল। অনেক পুরনো কথা, কাঠের আলমারীর মাথায় পিচবোর্ডের বাক্সে –- সব উইয়ের দখলে। ভাবলেই বুকটা টনটন করে।

গণেশের কবিতার কথা! কবিরাজ রো-এর প্রায়ান্ধকার ঘরের এদিক ওদিক থেকে মায়াবী আলো এসে ঘরটাতে একটা অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করত। তার ছবির সম্পদ। King of the dark chamber-এ ওকে সম্মানিত করল। তার সব ছবি অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ। রামায়ণ মহাভারত থেকে ভিন্নধর্মী অনেক কাজ সে করেছিল –- কিন্তু তার পরিচিতি যে সব ছবি এঁকে, তা ওই অন্ধকার ভেদ করে বিভিন্ন স্তরের আলোর আনন্দানুভূতির প্রকাশ।

একটা কবিতার শেষ লাইন, যতদূর মনে পড়ে, ওর বাড়ির উলটো দিকের ছাদে শুকোতে দেওয়া শাড়ির কোণায় একটুকরো রোদ পড়েছে, গণেশ লিখেছে –-“একফালি পড়ন্ত রোদের আনন্দে শাড়িটার আঁচল একবার এপিঠ একবার ওপিঠ দেখাচ্ছে”।

লালু, আমি গণেশ –- আমরা সমবয়সী। গণেশ চলে যাওয়ায়, স্মৃতিভারে পড়ে আছি না বলে বলব, সুখস্মৃতি বয়ে চলেছি, যা আমার জীবনের সম্পদ –- পাথেয়।

নাসের হোসেন

অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী গণেশ পাইন
নাসের হোসেন



পৃথিবীজোড়া নাম যে ছোট্টখাট্ট মানুষটির, তাঁর নাম গণেশ পাইন। স্বনামধন্য শিল্পী তো বটেই, কিন্তু বিশাল নামের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো অহংকার তাঁর ছিল না। স্বভাবলাজুক তো ছিলেনই, সেইসঙ্গে ছিলেন স্বভাব-মিতভাষী। তাই বলে কী কথা তিনি একেবারেই কম বলতেন! না, সেটাও ঠিক নয়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় কত যে কথা তাঁর মুখে শোনা গেছে! কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে দীর্ঘদিন আড্ডা দিতে দেখেছি তাঁকে। আড্ডা দিতেন সমসাময়িক আর্টিস্ট ও অন্যান্য গ্রুপের শিল্পীদের সঙ্গেও। তবে মূলত তিনি ছিলেন তাঁর ছবির জগৎ নিয়ে একা, একক অণ্বেষক। তাঁর বেশির ভাগ কাজই ছোট ও মাঝারি মাপের। খুব বড় আকৃতির ছবির সংখ্যা অত্যন্ত কম। কাজের সাইজ ছোট হলে কী হবে, ছবিগুলোর প্রতিটি বিন্দুতে এমন কিছু সংবেদ যুক্ত করে দিতেন যে, সেগুলো কী বিশাল আবহ নিয়ে ঘিরে ফেলতে সক্ষম তার দর্শকদের, তার পাঠকদের। বই যেরকম এক ধরনের পাঠ, ছবি ও ভাস্কর্যও তেমনি পাঠ। অর্থাৎ ছবি ও ভাস্কর্য দেখাটাও এক ধরনের পাঠ। গণেশ পাইনের ছবির যে পাঠ, সে-পাঠে তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবির বিভিন্ন পাঠ আমরা দেখতে পাই। বিভিন্ন পাঠ থাকলেও, একটা মূল সুর। গণেশ পাইনের ছবির মূল সুর কিন্তু ভিতর-আবহের মতো তাঁর সব ছবির মধ্যেই বিরাজমান। কালিকলম, টেম্পারা, জলরঙ সবেতেই সেই ভিতর-আবহ আমাদের স্পর্শ করে থাকে। টেম্পারার কাজই বেশি করেছেন। বেশ কিছু কাজ মিশ্র মাধ্যমে। এই যে আমাদের জীবন, এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের মৃত্যু। একে আমরা জীবনের আবহ যেমন বলতে পারি, তেমনি একে আমরা মৃত্যুর আবহও বলতে পারি। এবং তার যে দৃশ্যায়ন, সে যে কী সংবেদনশীল! তার যে রেখায়ন, সেও যে কী সংবেদনশীল! একটা পেইন্টিং-এর চারদিকে নির্দিষ্ট সীমা বিদ্যমান, কিন্তু ওই সীমার থেকেও বড় কথা চিত্রটির কম্পোজিশন, তার রঙ, তার রেখা, এবং সব মিলিয়ে অপূর্ব এক সংক্রমণ। গণেশ পাইনের ছবিতে এই ব্যাপারটা চূড়ান্ত জায়গায় অবস্থান করছে বলে মনে হয়। তাঁর যোদ্ধা, তাঁর কৃষ্ণ, তাঁর মৃত্যুর নৌ্কা প্রভৃতি অসংখ্য পেন্টিং-এর নিহিত পর্যটন আমাদের মৃত্যুময় আধো-অন্ধকার পরিমন্ডলে জীবনের স্পন্দন শোনায়। জীবনের সাহস শোনায়। গণেশ পাইনের ছবিগুলোকে কখনো কখনো মনে হতে পারে অন্য ধরনের রূপকথা। সেখানে অন্ধকারে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কোটরগত চোখ জ্বলতে থাকে, কেউ পাঁজর থেকে মশাল বের করে সেটা উঁচু করে ধরে হাঁটতে থাকে, একলা চলো রে গান শোনা যেতে থাকে। সেখানে কোথাও হাড়ের পাহাড়, কোথাও মণিমাণিক্যের পাহাড়, কোনো সরু একটা নদী, আর সেই নদীর উপরে পুরনো দিনের নৌকা, নৌকার উপর যাত্রীরা –- সব সময়ের –- আঘাত-তাড়িত, একইসঙ্গে যেন-বা নিয়তি-তাড়িত। তাঁর ছবিতে কোথাও হয়তো বুদ্ধ-ভূতুম বা রাক্ষস-খোক্ষসের দ্বান্দ্বিক প্রতিভাস জায়গা করে নিতে থাকে। কিন্তু সরাসরি এইসব নামে হয়। কিছু কিছু বইয়ের, বিশেষত ছোটদের, প্রচ্ছদ ও ভিতরের অলঙ্করণ, সচিত্রকরণ করেছেন। সেগুলিও যে কী নিষ্ঠা সহকারে করেছেন, ভাবলেই অবাক লাগে। তবে ওইসব সচিত্রকরণের মধ্যেও গণেশ পাইনকে গণেশ পাইনের মতো করেই পাই। পাই তাঁর মকশো-ছবি বা ডুড্‌লগুলোতেও। বা, জটিংস। মকশো ছবির ব্যাপারে মনে পড়ছে, তিনি বড় সাইজের ডায়েরির রুলটানা পাতাগুলিকে কী চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কিছু প্রদর্শনী দেখেছি। ফলে বড় ওরিজিন্যাল কাজ দেখার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে বলে আমি গর্বিত। যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কুশল বিনিময় হয়েছে।

আশি দশকের শেষের দিকে আমাদের ‘রৌরব বারো বছর’ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল গণেশ পাইনের প্রচ্ছদ সহ। সেই প্রচ্ছদের ছবি আমি আনতে গেছিলাম কবিরাজ রো-এর অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িতে। গণেশ পাইন নিজে তাঁর সেই ছবি তুলে দিয়েছিলেন আমার আবেগ-বিহ্বল হাতে। সেটা ১৯৮৭ সাল। কালি ও জলরঙ-এর এই কাজটির নামও রেখেছিলেন ‘রৌরব’। তাঁর একটি পেন্টিং-এর মধ্যে আমাদের টগবগে যৌবনের ‘রৌরব’ পত্রিকা বেঁচে রইলো চিরদিনের জন্য, এটা আমাদের কাছে কত যে গৌরবের, একই সঙ্গে আনন্দের, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের কাজ হয়ে গেলে ছবিটি তাঁর হাতে পুনরায় অর্পণ করা হয়েছিল। পরে বিশাল আয়তনের বই আকারে ‘রৌরব বারো বছর’ বের হলে তাঁকে দিয়ে এসেছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন।

পরবর্তী সময়ে বহুবার দেখা হয়েছে। সে-সব গল্প অন্য সময় বলা যাবে।

ভূমেন্দ্র গুহ

ন্যায়
ভূমেন্দ্র গুহ


ন্যায় জিনিসটা যদি কোথাও থেকে থাকে, তা, তাহলে
এখুনি এসে সামনে দাঁড়াক। দেখি, কেমন তার চেহারাটা।
আর যদি এমন হয় যে, আকাশের তলা থেকে আমার শেষ
চিহ্নটুকুও মুছে যাওয়ার পরে সে এসে দেখা দিল, তাতে
আমার কী? তার সিংহাসনটা ইট-পাটকেল ছুঁড়ে চিরতরে
ধ্বংস ক’রে দেওয়া হোক! আর, তুমি, হে উদ্ধত, স্পর্ধিত
ন্যায়, তুমি তোমার নিজের হিংস্রতা সম্বল ক’রে এগোও,
রক্তপাত ও রক্তস্নান নিয়ে মেতে থাকো, আবার সেই
রক্তের ক্ষার দিয়েই ধুয়ে ফ্যালো তোমার পোশাক-আশাক।

আবার সেই লোকটাকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি
যে-লোকটা বলে প্রতিশোধ নাও অর্থাৎ বদলা নাও! না,
বদলা নেওয়া নয়, বদলা নেওয়ার মানে তো একটা কোলের
শিশুর রক্ত অথবা একজন অশীতিপর বৃদ্ধের রক্ত –-
শয়তানের হুকুম তামিল করা ছাড়া এ-সব আর কী?
যাক, রক্ত চুইয়ে যাক রসাতলের গভীর অতলে; যাক,
রক্ত ভিজিয়ে দিক অন্ধকারের অনিশ্চয় ও স্বরাট রাজ্যের
তন্তুকোষ; এবং সে-সব ক’রে ফেলতে গিয়ে ইঁদুরের
মতো কুটকুট ক’রে চিবিয়ে খাক –- অন্ধকারে –- এই
পৃথিবীর ঘুণে-ধরা সব তত্ত্ব-ঠেকনো ও তত্ত্ব-ভিত্তি।

(আলবেয়া কামু’র জন্মশতবর্ষ, খ্রি. ২০১৩)






সমীর রায়চৌধুরী

আল্পনা
সমীর রায়চৌধুরী



কবিতায় গৃহীত হওয়া মাত্র
                     শব্দ নিষিক্ত
                           জৈব সত্ত্বায়
আর সব বাস্তবের মতো
                     কবিতার বাস্তব
সমীর মানুষিক
                     আক্ষরিক
আমার আমি থেকে ভিন্ন
                     প্রতিচ্ছবি
লিখিত হওয়া মাত্র
                     সেও আমি
শেফালি আল্পনা 


বারীন ঘোষাল

ধুঁয়াধার
বারীন ঘোষাল


স্বপ্নের মধ্যে মিনার ঢুকছে ধীরে
ফিলিং ছেঁড়া ফুল ফোটার ক্রমে –- শরীর কী জয়
অনেক বোম ব্যোমের স্টিলে
লুকিয়ে ডাকুগণ
                    শুনছে সোলো সুফিগান
আর মিনারের গায়ে লাগা স্বপ্নে ফরেনসিক আদর

হেহোলীন ভাষায় বর্ণপরিচয় নেই তো
জলের প্রথা
                    পুকার ভিগি ভিগি
শুধু মনশেডিং-এর অংকধারা বুঝলে না
সমুদ্রের সিঁড়ি
মিনারের মাপে মিনা
                   বাণী বিনা
                   বাণী বিনার ফিলিং

ধুঁয়াধারে এক বধির দেখছে শব্দগুলিদের

শংকর লাহিড়ী

সেই বাড়িটার রঙ
শংকর লাহিড়ী

( উৎস : গদারের চলচ্চিত্র - ‘টু অর থ্রি থিংগ্‌স আই নো অ্যাবাউট হার’ )

সেই স্বপ্নটা আমি অনেকদিন দেখি না যেন ষোলোতলার
খোলা জানালা দিয়ে পড়ে যাচ্ছি গাছে গাছে
এত অজস্র স্যালাড-পাতা
সবুজ হলুদ মভ্‌ শিরাকাটা রক্তাক্ত খয়েরী

আর তুমুল আছড়ে পড়তেই ঝনঝনিয়ে ফুটপাথ টুকরোগুলো
সারা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে শববাহীরা আমি একা
কুড়িয়ে তুলছি ফটোফ্রেম বোন-চায়না
আমি নিশ্চিত জানি এখানে এইঘরেই কোথাও একটু নীল
রয়ে গেছে ওয়ার্ডরোবে স্বপ্নহীন
কন্ডোম লিপস্টিক

টীশার্টগুলোর অন্ধকার ভাঁজে ভাঁজে আমারই নামের
আদ্য অক্ষর আর তোমার শেষটা যদি
এমন হয় নীল রঙকে আসলে ওরা
সবুজ বলে, কোনও দিন খুঁজে পাবো না
চিনতেও পারবো না তোমার আঘাতগুলো

কেননা শব্দই আমাদের ধারণ করেছে সেই
প্রবাহিত শব্দমালা
অর্থ যতি আর্তি ব্যাঞ্জনা, ঝুলে আছে মহাশূন্যে

আমাদের একক আশ্রয় সেই বাড়িটার স্পর্শ ঘুম রঙ
হিমায়িত শবদেহ বিজ্ঞাপিত ধাতু ও বুরুশ
শ্বাসরোধকারী এক রন্ধনপ্রণালী।

মেঘ অদিতি

দুটি কবিতা
মেঘ অদিতি


মোহ অন্ধকার


ওই ফুল
এই স্যাংচুয়ারি
নৈঃশব্দ্য মাড়িয়ে ফিরে যাচ্ছে ঘুমবাড়ি
লীলাময় ভূগোল রাজ্যে রুদ্ধবাক মুখ
শ্বাসভঙ্গীতে রহস্যদাগ ভেঙেচুরে যায়
রঙের এপারে থাকে সরল আশ্বাস
ঘুম ঘুম মিথে থাকে মোহ অন্ধকার
যায় ফিরে মোমগড়ানে পুড়িয়ে নীল শাড়ি
এই দূরত্ব বাড়ানো ফুল
আর দূরের স্যাংচুয়ারি


বুকের পালক

জেগেছে উজানে ফের সহজাত ক্রোধ
বুকের পালক ফুঁড়ে বৃত্তের গানে
দুর্গত মন চায় নরম গোধূলি
এদিকে সমুহ আঁচড়
জেগে আছে তীব্র খরচোখ
বিহনে কার অনাঘ্রাত ফুল পড়ে ঝরে

প্রাত্যহিক প্রেম থেকে চোখের ঘূর্ণি
কোলাহল ছিঁড়ে ঘনিয়ে উঠেছে রাত

পেরিয়ে নিরুচ্চার কথা
পেরিয়ে লক্ষণরেখা
কে যে এখন ফেরাবে আর কারে


অমিতাভ মৈত্র

দুটি কবিতা
অমিতাভ মৈত্র


গ্রন্থ

রাত্রির পবিত্র গ্রন্থ তোমার শরীর।
সন্তর্পণে মেলে ধ’রে যে কোনো পৃষ্ঠা থেকে শুরু করা যায়।
কিছুক্ষণ পরে মাথা ঘুম ও ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ে।
তোমার পবিত্র গ্রন্থ রাত্রির পাপ নিয়ে জানালায় দাঁড়ায়।

ক্লোকরুম এবং ঈর্ষা

কুড়ি বছর ধ’রে জানতে চেয়েছি ক্লোকরুমে তুমি কতক্ষণ ছিলে, কী করছিলে
অসুখ হয়ে জানতে চেয়েছি আমার ওষুধ তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ কেন

কুড়ি বছর ধ’রে অপেক্ষা করছি পুনর্জন্মের, কোনোদিকে একবারও না তাকিয়ে
সন্দেহ আর ভয় নিয়ে –- কোনোদিকে একবারও না তাকিয়ে

সব ছেড়েছুড়ে দিচ্ছি আজ
শুধু বলো, জোনাথন তোমার কে?
এই সাদা বেডশিট তোমার কে?

(শাশ্বতীর জন্য)

স্বপন রায়

সিনেমা সিনেমা-২৬
স্বপন রায়

ঘ্রাণ শিস দিচ্ছে রেখে দিলাম কাল এটা খুলবো

কাল মানে আজ, খুললাম

কিছু দোকান, ওষুধ আছে আবার মাংসও, শিস এ সবে আটকালো না
তার রঙ নেই
কিন্তু বয়ে যাওয়া কান থেকে কানে, আহা!

বনরোঁয়া দুল শেষপর্যন্ত শিস গ’ড়ে নিয়েছে
যার দুল, তার হাতে একটা বই, পাতা খোলা, সেখানে আলোর দল ছায়াঘোর দিতে দিতে
                                                                                                      চিরন্তন
হয় নাকি? ছায়া যাবে রোদ যাবে, শিস যাবে পুল পেরিয়ে
                                                              আমোদপুর
তাহলে?

খুললে এ সব হয় চিরন্তন, পুরোন একটা বাড়ি আর একফালি রোদের টুকরো

মেয়েটা শুয়ে আছে, এত পুলিশ

ঘ্রাণ নেই

তরঙ্গ নেই দেখে শিস এক পাখির গলায় দলা পাকিয়ে থাকলো
                                                                     কাল যা হওয়ার হবে...



অনুপম মুখোপাধ্যায়

টুসকি আমার মেয়ে
অনুপম মুখোপাধ্যায়


(১)
আমি আমার মেয়ের দস্তানা
মেঝে থেকে আলনায় তুলতে ভুলি না

আকাশের সামনে দাঁড়িয়েও কি
নিজেকে এত বিশাল মনে হয়

শোন্‌ রে টুসকি
তোর উপন্যাসে
আমি নিছক একটা স্টেশন নই বুঝলি

অতখানি নেশাতুর নই

(২)
কুকুরের কানা শুনে রাতে
ভয় পাচ্ছে খুউউব

ও খিলের খবর রাখে না
দরজার মাপ জানে না

শুধু জানে আমার বুকের ছাতি
তেপান্তরের মাঠের চেয়ে চওড়া

ও আমাকে জড়িয়ে শুয়েছে

চৌত্রিশ বছরের একঘেয়েমির ছোঁয়া
এখন আমার হাতের চেটোয় নেই

(৩)
কর্নিয়ার উপরে তোর চোখের পাতা
ঘনঘন নড়াচড়া করছে

টুসকি, এত দ্রুত পলক ফেলিস্‌ না

তুই আমার মেয়ে
রসক্ষরণের মেশিন নোস্‌ তুই

এত সহজে অবাক হওয়া মানাচ্ছে না তোকে

কার্টুনের চেয়েও বড়ো রাক্ষস আছে
রসে

(৪)
তোর এই যে বকবকানি
এ-ও একদিন মিষ্টি একটা স্মৃতি হয়ে যাবে

ভাবতে পারিস্‌...

না হলে বাবা আর মেয়ের ছবি কোথাও থাকবে না

জানিস্‌ তুই কী করে
মনে রাখতে হয়?

কোনোদিন ভুলেও কিন্তু
ফ্রয়েড পড়িস না

সুমিতরঞ্জন দাস

দুটি কবিতা
সুমিতরঞ্জন দাস



লিখন
শৈশব ফিরে দাও, আর দাও
এক আঁজলা শিউলি ভালোবাসা

সহস্র বছর গদ্যময় পৃথিবীতে আছি
পঞ্চকোষী প্রেমের জোৎস্নায় স্নাত হয়ে প্রতিদিন
কেবল সরলরেখার শেষে মৃত্যুর হাতছানি ভুলতে চেয়ে;
একটা গর্বিত জীবন, গুটিকয়েক মেডেল আর কয়েকশো হাততালি
ন্যাংটা শিশুর হাত-পা ছোঁড়া আস্ফালন হয়ে আছে

ভুলেই গেছি --
এসব ঘটনায় তিরোধানদিবস কখনো বদলে যায় না।



ভাটার টানে

নদীঘাটেই আসতে হবে একদিন
মালসা ভরা ধোঁয়ায় ভরাবুকে এলিয়ে দিতে হবে গা
তারপর সব ছেড়ে ভেসে যেতে হবে ভাটার টানে ।

শাসন করেছো অনেককাল, জলকুমারী
এবার তুমিও ভাসাবে কণিনীকা
ভিনদেশী রাজকুমার আর ভোলাবে না তোমায়
রাতের সাইরেন বাজবে বুকে
গুমরে ওঠা তামাটে স্মৃতি আর কোনোদিনও
খেয়া বাঁধবে না এই ঘাটে

শুধু বাতাসে বাজবে সেই গান --
"এ নদী কেমন নদী! জল চাই একটু যদি..."

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

আলম্ব
রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়


আজ বৃষ্টি উড়েছে খুব
ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে
ঘুমের ছায়াও

যদিও পূর্বাভাস ছিল আমি বর্ষাতির কথা ভাবিনি কখনো
ঘুমের ভবিষ্য নিয়েও

জমাট জলের ভেতর বিপজ্জনক হয়ে উঠছে কোষের দেওয়াল

ভেঙে পড়ার আগে
ধ্বংসস্তূপের উপমাগুলো
গ্রন্থির চিহ্নগুলো
এমন ব্যবহৃত হয়ে গেছে
ভাষার আনুগত্যে
যেন জলীয় হয়ে উঠবে অনিবার্য প্রশ্নসকল

অতঃপর
সেতু পারাপারকথা
শব্দের পিঠে নিপুণ রোদকথা
এমন আকস্মিক
এমন ব্যক্তিগত রঙ
যেন দুর্বার ভেঙে পড়বে সমস্ত দেওয়াল
প্রকাশের গা থেকে
ভঙ্গিমার গ্রীবা থেকে

ইদানীং রঙের প্রতি অনীহা
ভায়োলেট হোক
নীল বিষ
কেন যে নিরালম্ব লাগে

আমি এক আলম্ব নদীর কথা ভাবি
জলরঙ
পারাপারহীন
জাস্ট ফর আ চেঞ্জ
মাত্রা ঊহ্য রেখে দেখো
ভাবনার খোলা পিঠে আভূমি নদীর ঝোঁক
গাঢ় ঘুম
মৃদু স্বপ্ন

শুধু জড়তার পাশে জেগে থাকে আমার ঘুমের সমস্যা

কাজল সেন

এই মহাজীবন
কাজল সেন


কাঁটা চামচে আর একটু চেখে দেখা এই মহাজীবন
কপিকলে নেমে যাচ্ছে জল সীমানার জল
এরপর শুরু হবে একটানা রোদের সরলরেখা
আর এফ এম রেডিও থেকে ভেসে আসবে
নতুন বর্ষাতির বিজ্ঞাপন

এভাবেই একটা সমানুপাতিক রাত ও দিন
একটা অনেকদিনের বাঁচিয়ে রাখা অভ্যাস
কুয়াশা ভেঙে ইহলৌকিক ক্রিয়াকলাপ
আমি এভাবে যতবারই আলগোছে পেরিয়েছি রাস্তা
ডিজিট্যাল ক্যামেরায় উঠে এসেছে অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান

তোমার জন্য কাচের ফ্রেমে সযত্নে রাখা আছে তোমার শরীর
নাভির শূন্যতায় বহুগামী মেঘ
ছেড়ে আসা উঠোন
ছেড়ে আসা জলচৌকি
কোনো এক অরণ্য থেকে কোনো এক বাইপাসে পায়চারি
এখন এই বারবেলায় সাজানো হচ্ছে আরামের চেয়ার
বিদায় সম্বর্ধনায় দেওয়া হবে একটা ব্রিফকেস ও ছাতা

একটা জলপোকা জল থেকে উঠেই শোনে এফ এম রেডিও
কেননা একটু পরেই ভেসে আসবে
নতুন সেলফোনের বিজ্ঞাপন


সাম্য ভট্টাচার্য

ময়
সাম্য ভট্টাচার্য



চোরাবালি জানালা

স্বপ্ন এক স্বপ্ন দুই রক্ততাস

চাকার দাগ

আইলাইনারের ক্ষতশিল্প


?


ঘুমচষা জমি                   হারাকিরি আলো


সূর্যাস্তের পখিপিস্তল      ওড়ো প্রাণের ভ্রমর


ঝিনুক-কম্পাস

শহরনাবিকের মোহনাজামা মৃত নক্ষত্রে


পোয়ানো আঙুর... সম্রাট...

পোয়াতি বেড়ালের সংশয়


নৌকাসিঁড়ি দিয়ে নামা জলহাত


বারুদকিশোরী বিধুর

আকাশের বিদূষক... মতো


আয়নার নাসারন্ধ্রে স্মৃতিচুল


ময়-এর সময়... একাকার চোখের জল আর স্থল


নবেন্দুবিকাশ রায়

তিনটি কবিতা
নবেন্দুবিকাশ রায়



ল্যান্ডস্কেপ

লোকটা প্রাণপণ সাইকেল চালাচ্ছে...
৩০º চড়াই, শেষ হচ্ছে পাখিময় একটা গাছে
একটাও পাখি শব্দ করছে না...


শুধু জন্মদিন কাছে এলে
মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।

 

একটি স্টুপিড সন্ধ্যায়

“বেদনার গন্ধ বোরোলিনের মতো”


এই বলে একজন চুপ করে গেল।


বাকিরাও।



ফেব্রুয়ারির তিন তারিখে দেয়াল যেরকম থাকে

একটা দেওয়ালের প্রতিফলন আরেকটা দেওয়াল 
এই সত্য পুনরাবিষ্কারের পর
আমি তোমার, তোমাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করি... সম্ভবত শ্যাওলা নিয়ে কিছু বলছিলে
সম্ভবত গুপ্ত প্রেম ও বাজেট


কোথাও এক ফিলিপ্স রঙের দেওয়ালে সূক্ষ্ম চিড় ধরেছিলো
 

রমিত দে

অনুসরণ
রমিত দে

ব্রম্ভ আনন্দ স্বরূপ
জগৎ তাঁহারই ঐশ্বর্য

এ পর্যন্ত জেনেই লাফিয়ে ধানক্ষেতে নামলাম
এখন আমরা দেখব কেঁচোর দেহে মাটি কেমন ঘুমোয়
আর ভেতরে বড়ি দিতে দিতে
কালো পিঁপড়েদের সাথে দু’তিনটে মেয়ে উধাও হয়ে যায়...

মাটি যতই নরম হোক, ভাতের আশায়
ভেতরে রেখেছে একবুক জল
বয়স্ক মেঘ ফেলে পালিয়েছে উৎসাহী জাগরণ

আর আমরা ক’জনা বারবার গাছ নাড়াচ্ছি
ফলের আদলে ঝরছে প্রসববেদনা
কোথায় ভাসমানতা?
ক্ষত পেলেই গানের খাতা লুকোতে আসে সুবর্ণ কাঠের খোপ

তার নিচে অন্ধকার শুধু অন্ধকার আর কোনো প্রেক্ষাগৃহ নেই
বোঁটাতে থরে থরে সাজানো ঝুলে থাকার বিশ্বাস



রত্নদীপা দে ঘোষ

বিছিন্ন
রত্নদীপা দে ঘোষ



বৃষ্টিপাতের গভীরে গড়ে উঠছে শস্যের মতো আকাশ
বাতাসদিনের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ছে বই কমছে না...
বসে আছো ওষধির খোঁজে
অবাক বোতাম খুলে বেরিয়ে আসে নক্ষত্র
ক্যামেরার বুকে শ্লিভলেস দুপুর
পালকের আড়াল খুলে কম্পোজ পায়রাদের চুমুবাক্স
কুয়াশার বয়াম অটুট রেখেছে পাখিজেলার রোদগাছ...
যে কোনো গোলার্ধই হাতের তালুতে বড্ডো ছোট
বিষুবরেখায় ওঠানামা থার্মোমিটারের ফিলে
সাপলুডোর পারদকুমারী জানে না জ্বর কত প্রকার...




অভিষেক রায়

মাতাল
অভিষেক রায়


ঘুমভাঙা চোখে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি যে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি
যদিও সম্ভাবনা ছিল

হৃদয়জুড়ে আশা ছিল যে কাল সবকিছু শেষ করে দেওয়া যাবে
এমন পরিণতি কাল রাতের আঁঠালো প্রতিটি মুহূর্তে নিহিত ছিল

রসদ ছিল পর্যাপ্ত
হাতে ছিল অঢেল সময় অবলীলায় এ-সব কিছু শেষ করে দেওয়ার মতো

কাল রাতের প্রতিটি মুহূর্ত তার বুকের অগণিত সুড়ঙ্গের দরজা খুলে
ডেকেছিল আঁধারের আড়াল থেকে

কাল রাতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে
অনেকক্ষণ পাশাপাশি আমি
আর মৃণালিনী ঘোষালের শব

নিশ্চুপ ভেসেছি মুহূর্তের ভিতরের অজানা অন্ধকারে

কাল রাতে সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারত
হয়নি কারণ কেউ ডেকেছিল
'অভিষেক, অভিষেক' বলে 


কিরীটি সেনগুপ্ত

ধুলো ঝড় হলে যে কী হতো...
কিরীটি সেনগুপ্ত


শেষ আলো কবে দেখেছিল মনে পড়ে না
ভারী হয়ে আছে কাল্-কুঠুরির বাতাসটাও
শ্বাস নেবে কী…
দমবন্ধ; রুদ্ধশ্বাস হলে বোধ হয়
এমনটাই…

মরচে ধরা তালা খোলা মাত্র
হৈ-হৈ; দে-ছুট
নিমেষে তরতাজা দিগন্ত বিস্তৃতি
ভোরের আলোয় স্নান –-
আহ্…

নিষিদ্ধ আপেলে নয়
সৃষ্টির তাগিদ; কামনা
কিছুটা শরীর জুড়ে
অবিন্যস্ত…

অপুষ্টির মধ্যেও তীব্র
চাওয়া-পাওয়ার তোয়াক্কা কোথায়?
অপ্রত্যাশিত গতিবেগ
টুপ্-টুপ্ ফোঁটায় জমে গেল…


তন্ময় ভট্টাচার্য

বিপন্ন সভ্যতা
তন্ময় ভট্টাচার্য


ওই যে সেই সভ্যতার বার্তা, মনে পড়ল?
তার শেষকৃত্য সেরে এলাম সবে।
বিউগল বাজিয়ে তাকে দিলাম
গার্ড অব অনার।
যখন তুমি থাকতে ওখানে, আর
আমি এখানে, সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়,
সেই বিংশ শতাব্দীর বর্ষাতি, সেই
সভ্যতার ছাউনির তলায় হয়েছিল
আমাদের প্রথম সহবাস।

আমাদের প্রতিটি চুম্বনের তৃপ্তি
মুছে যেতে বসেছিল, যেদিন
চলে গেল তুমি একলা পথে...

সভ্যতা কিন্তু হাল ছাড়েনি,
আমিও না, তুমি হলে জীবাশ্ম,
আর স্বর্গের একটা ফোটোফ্রেম
এখনও এম্পটি।
ফিরিয়ে নিলাম মুখ...

সুবীর সরকার

বাঁশি
সুবীর সরকার



(১)

এই মেঘ বৃষ্টির মেঘ নয়
সব দৃশ্যই এক একটা ছবি
কাগজের ওপর পাখি ও ঝর্ণা
সোনামুখে ঘাম, বাজনাসমেত
সিরিয়াল বিরতিতে আকাশ বাতাস
                                      নদী

(২)

হেসে চলে যায় বুড়ো সর্দার
তীর ছোঁড়ে। কানে হেডফোন লাগিয়ে
                                     শুয়ে পড়ে।
কাশবনে জল ঢুকছে
জঙ্গল পথে মাইল মাইল
ঘোড়াকে দেখাশোনা করার জন্য
                                     লোক দরকার
মাঠ দেখলে ছুটতে ইচ্ছে করে
হারানো বাশিঁ খুজঁতে কুরুয়া
                                     পাখি
কপালে ভ্রু উঠছে,
সড়কের মাথায় মেঘ, সমার্থক
                                     শব্দ

ইন্দ্রাণী সরকার

উড়োজাহাজ
ইন্দ্রাণী সরকার


হাতের মুঠোয় সব ভাবনার ছাইগুলো
আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলাম।
দিগন্তের সুর্যডোবা আকাশটা তখন লালে লাল।
আকাশের বুক চিরে উড়ে গেল একটা উড়োজাহাজ।
একঝাঁক পাখি ডানা ঝাপটিয়ে আকাশের ক্যানভাসে
কালো রঙের আঁকিবুঁকি দিয়ে উড়ে চলে যায়।
বৃষ্টি জমেছিল বুকে বহুদিন, বাতাসের আলতো ছোঁয়ায়
ঝরে পড়ল কচুরিপানার পাতায় পাতায় ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোর মতো।
চোখের কাজল জলে ধুয়ে একাকার হয়ে গেল,
বাতাসের ঝাপটায় মেঘের ওড়না সরে গিয়ে গোধুলির
আকাশ ভেজা বাতাসের গন্ধ মেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
উড়োজাহাজ ধীরে ধীরে মেঘের বুক চিরে সুদূর আকাশে
যেন এক অজানার দেশে পাড়ি দিয়ে হারিয়ে গেল।
জানো কী, আমার বন্ধু ওই বিশাল পাখিটায় ভর করে
চলে গেছে দূর, বহুদূর...


অথির শেরপা

কিশোরীফুল
অথির শেরপা


কিশোরীফুল, শোনো, তরল আগুন খেয়ে আমি আমার নামটারও
সম্পূর্ণ অধিকার ফলাতে পারিনি। তবে আমার সজল চোখ আর
বেকার হৃদয়ের কী হবে?

কিশোরীফুল তুমি কি শীতকাল আসার আগাম ঘ্রাণ হয়ে ছড়িয়ে
যাচ্ছ চারদিকে –- রটিয়ে যাচ্ছ কুয়াশাবিস্তার –- ভাব ও ভাষা

এই অপ্রতিরোধ্য শীতে কোনো অদৃশ্য কলিংবেল বেজে বেজে ওঠে
সাধ আর সাধ্যের মাঝখানে পোড়ামাংসের মতো জেগে আছি আমি!

মধুসূদন রায়

নির্জনতা
মধুসূদন রায়

এভাবে সব নির্জনতা কি ভেঙে
দেওয়া যায়? ফেরিঘাটের পথে পথে 

চলাফেরা সকাল সন্ধ্যে –-

সফেদ ঘূর্ণির পথে ফিরতে থাকা 

গৃহহীন পরিযায়ীরাও চোখ
ঝলসে দেওয়া বিবর্তনের পথে

ঝাড়বাতির ধুলোয় থাকা সাম্রাজ্যবাদী
গন্ধ আর নির্যাতন –-
একটু একটু করে ব্যাকডেটেড

আমি এবং আমার পাঠক।

অভিষেক গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতার বাসায়
অভিষেক গঙ্গোপাধ্যায়


আমার চেতনার গভীরে কিছু
অলৌকিক ভোর হাতছানি দেয়
সবার অলক্ষ্যে কাটে সময়।

ঝরে পড়া পাতার মতো
নিরহংকারী থাকি।
আমার মনের গোপন কুঠুরিতে
বাস করে কিছু সবুজ কবিতা।

লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল

নিবেদন
লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল

একটা আত্ম-নিবেদনএর কাছে কবিতার লাইন
এক উলঙ্গ মানুষের ছটফটানি দেখে
কেউ বলে বিকলাঙ্গ
কেউ বলে পাগল
মাটি শুধু নিজেকে চুরমার করে
ধুলো মাখায় তার গায়ে

তারপর সাদাপাতায় কবিতা শারীর পাতে
উপুড় হওয়া পিয়াসী আত্মায়


বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়

মরুঝড়
বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়


বিছানার চাদরে ভাঁজ পড়ে আছে,
হাড়ে হাড়ে যন্ত্রণার ছাপ।
কুঁকড়ে যাওয়া চোখে, হাতড়াই
দু’একটা লম্বাচুল!
আর কোনো চিহ্ন নেই,
বইছে আবার বিষাক্ত রক্তের স্রোত
শরীরের শিকড়ে শিকড়ে।
হাঁপিয়ে যাওয়া হাওয়া
হারিয়ে যাচ্ছে
শেষ রাতের মরুঝড়ে।

সরোজ রায়

ফসিল
সরোজ রায়


নিজেই ভেঙে ফেলেছো নিজের স্থাপত্য-কারুকাজ
তুমি আর কখনোই নিজেকে ফিরে পাবে না...

তোমার তর্জনী থেকে ছিটকে পড়ে অপরাহ্ন বেলা
অনিবার্য করে তোলে নির্নিমেষ অন্ধকার
আর কিছু নেই তোমার পুষ্পিত প্রহরের স্বরলিপি
কিংবা সালোক সংশ্লেষের নিজস্ব যাপন

জীবনের সব জলোচ্ছ্বাস অস্তমিত এখন
তোমাকে আর কোনো উদ্দীপনা উজ্জীবিত করে না
নিথর পেন্ডুলামের খন্ডহর হয়ে বসে আছো
পলিপাথরের অকাট্য ফসিল...



দিশারী মুখোপাধ্যায়

বাংলার ডেডবডি
দিশারী মুখোপাধ্যায়



ঠিক যে দিক থেকে ওটা ভেসে এলো সে দিকে কাউকে দেখা
যায়নি, একটা আকার বিহীন ছায়া খুব মুখরিত ভাবে মৌন
ছিল, কিন্তু কেউ তাকে সনাক্ত করতে পারেনি বা তেমন কোনো
প্রয়োজনও অনুভব করেনি কেউ। আর একটা মরা নদী,যেটা
ওখান দিয়ে প্রবাহিত হতো এককালে, -- যেরকম স্বপ্ন আছে বলেই
এখনো দুর্গন্ধ না বললে বা একটা বিকট মুখভঙ্গি না করলে
গন্ধ বলতে সবাই ভালোগন্ধকেই বোঝায় বা অন্তত(সব সম্ভাবনার
কথা মাথায় রেখেই বলা যায়)খারাপগন্ধের কথা কেউ ভাবে না ,
নদীটা গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল আর লক্ষ্য করছিল আমাদের
নিরপেক্ষ বিহীনতা।

কেউ মরে গেলেই তো আর সে সম্পূর্ণভাবে মারা যায় না,
একটু আধটু বেঁচে থাকতে পারে কিম্বা একথা কে না জানে
কেউ কেউ মরে গিয়ে বেশি করে বেঁচে ওঠে, যেমন একটা ঘটনা
ঘটেছে এই নদীটার ক্ষেত্রে, সে বেঁচে আছে আর মরে যাওয়ার পর
বেঁচে থাকাকে অনুভব করতে করতে বুঝতে পারছে, কী ভীষণ রকম
ভাবে দিন দিন মরে যাচ্ছি আমরা, আমাদের শঙ্খ, আমাদের হাওয়া,
আমাদের সরস্বতী -- সব মারা গেছে, মারা যাচ্ছে, মরে যাওয়ার
পরেও মারা যাচ্ছে বারবার।

আমাদের দিন রাত একাকার বাংলার ডেডবডি নিয়ে...


















সমীর রায়চৌধুরী

প্রস্রবণ
সমীর রায়চৌধুরী



চাইবাসায় ফিরে যাব। দু’দিন হয়ে গেল। শক্তি আর আমার ভালো লাগছে না। সোনুয়া থেকে রওয়ানা হবার সময় ফরেস্টার কুতুদাকে পেয়ে গেলাম। তিনি জঙ্গলের ভেতরের পথঘাট ভালো ভাবে চেনেন। লালমাটির রাস্তা। তবে পাকারাস্তা দিয়ে ফেরার চেয়ে অনেক কম সময় লাগে। জঙ্গল আর জঙ্গলের জীবনকে আরও কাছ থেকে জানা যায়। আমাদের জিপে তিনি উঠে গেলেন। তাঁর সাইকেলটিও গাড়িতে তুলে নেওয়া হলো। ড্রাইভার ছাড়া খালাসীও রয়েছে।

আমাদের রুটে যেসব গ্রাম পড়বে তার নামগুলো কুতুদা পরপর লিখে দিলেন। শক্তি জেনে নিল কোথায় ভালো মহুয়া বা রসম্‌ পাওয়া যায়। গাড়ি রওয়ানা দিল। আমার স্বভাবমতো আমি কিছু লজেন্স সঙ্গে নিয়েছি। ওয়াটার বটলে জল আছে। পথে একুশটা গ্রাম। গ্রামগুলোতে মানুষ ঘনিষ্ঠ হয়ে পাশাপাশি ঘর বানিয়ে থাকে। কেননা, জল যেখানে পাওয়া যায়, সেখানেই মানুষ ভিড় করে। ফরেস্টার বললেন, এই অঞ্চলে প্রচুর প্রস্রবণ রয়েছে। বনবিভাগ সেগুলো দেখাশোনা করে। বেশিরভাগ প্রস্রবণ অর্জুন গাছের শিকড়ের জায়গা থেকে বেরিয়েছে। সকালের দিকেই প্রচুর জল পাওয়া যায়। তারপর বেলা যত বাড়ে, জল কমে যায়। অনেকটা কর্পোরেশনের টাইম কলের মতো।

পাঁচ ছ’টা গ্রাম পেরোনোর পর কুতুদা নেমে গেলেন। ড্রাইভার এবং আমাকে পরিষ্কার করে রুটচার্ট বুঝিয়ে দিলেন। ড্রাইভার অবশ্য বলল, ‘পুরানা সাহেবকো লেকর হম ইস রাস্তা সে লৌটে’। শক্তি আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাদের গায়ে প্রচুর লালধুলো জমেছে। তোয়ালেটা দিয়ে ভালো করে ঝেড়ে দে’। আমাদের দুজনের চোখেই চশমা, এই একটা সুবিধে।

এই রুটের শেষ গ্রামটা আমার আর শক্তির চেনা। সেখানকার অনেক লোকজন আমাদের চেনে। কাছাকাছি ওরা সরকারী স্কিমে মাটি কাটার কাজ করে। শক্তি ইতিমধ্যে তার মহুয়া পেয়ে গেছে। গ্রামগুলো দেখতে দেখতে যেতে আমাদের ভালো লাগছে। প্রত্যেক গ্রামে একটা বা দুটো প্রস্রবণ। প্রস্রবণের জায়গাটা ছায়ায় ঘেরা। জলও তাই ঠান্ডা থাকে।

শেষ গ্রামটার নাম তোন্তো। তার খুব কাছাকাছি পাকারাস্তা। পথে আমরা বেশ খানিকটা মাছ কিনলাম। প্রথমে আমরা গেলাম চাইবাসার মধুটোলার বাড়িতে। ওরা কিছুটা মাছ আমাদের ভেজে দিলেন। কথা বলার সময় শক্তি খুব দূরত্ব রাখছে। কেননা, ইতিমধ্যে খানিকটা মহুয়া তার পেটে গেছে। শক্তি এখন নিজেই এক অন্তঃপ্রস্রবণ। ওর কথাগুলোও এখন কবিতার ভাষায়। জল দিয়ে ভালো করে চোখমুখ ধুয়ে নিল।

নিমডি যাওয়ার পথে আমরা একটা বড় পাউরুটি কিনলাম। আমি শক্তিকে বললাম, ‘সময়টা দেখতে দেখতে কেটে গেল। আমরা নিমডির বাড়িতেও ফিরে এলাম’। শক্তি বলল, ‘সেদিন সেই যে লিখলাম না –- ‘দিন চলে যায় কালের পাতায়’ –- কিন্তু আজ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসার সময় মনে হলো –- ‘দিন চলে যায় শালের পাতায়’...

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

আয়না
রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়


লক্ষ্যহীন। বহুদিন। উদ্দেশ্য বিধেয়রা হারিয়ে গেছে, নয়ত শহীদ। কলিংবেল।

--আরে, মিঃ এন্ড মিসেস সান্যাল, আপনারা দুজনেই আজ আমাদের গরিবখানায়! কী ভাগ্য আমাদের!

--আরে, না না, কী যে বলেন মিসেস রায়! আপনার মতো ঘরণী যেখানে, সে ঘর কি আর গরিবখানা হতে পারে!

নিখুঁত সলজ্জ হাসির আভাস ফুটিয়ে তুলি মুখে। কাটগ্লাসের সুদৃশ্য গ্লাসে চিল্‌ড লেমন্‌ ওয়াটার সার্ভ করি। গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু জলের নির্লজ্জ চাহনি।

--জানেন মিসেস রায়, রিপাপ্লিক ডে-তে মিঃ রায়, শর্মা, আরো কয়েকজন আমার বাড়িতে দু’পাত্তর নিয়ে বসেছিলাম। মিঃ রায় তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

মিসেস সান্যাল একটু আদুরে গলায় –- আমার কিন্তু ভাই বেশ একটু হিংসে হচ্ছিল।

মিঃ সান্যাল আবার -- স্বামী পুত্র নিয়ে এই যে সুখের সংসার গড়ে তুলেছেন, দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। নিউ জেনারেশানে আজকাল তো প্রায়ই দেখি আজ প্রেম, কাল বিয়ে তো পরশুই ডিভোর্স।

দেখানো গর্বের আঁচে আমার গালদুটো আরো একটু লাল হয়ে ওঠে।

রাতের মেঘেরা এমন বিষণ্ণ কেন? আলো আলো করে কাঁদে, নাকি আমারই ছায়া নিয়ে ভাসে!

শান্ত্বনুর আদুরে আঙুল আমার পিঠময় ঘুরে বেড়ায় –- এই, এদিকে ফেরো না

--না, আমার ইচ্ছে নেই আজ

আদুরে আঙুলগুলো মুঠি পাকিয়ে যায়। পিঠ থেকে ক্রমশ বুকের কাছে।

--এসো বলছি

--প্লিজ শান্ত্বনু, আমার আজ সত্যি ইচ্ছে করছে না

স্বর আর মুঠির কঠিন টানে বুকের কাছ থেকে ছিঁড়ে যায় পাতলা নাইটি।

স্খলিত শান্ত্বনু পাশ ফিরে শোয়। আমি ছেঁড়া নাইটি বুকের কাছে জড়ো করে উঠে যাই এটাচ্‌ড বাথরুমে। নাইটিটা টুকরো টুকরো করে প্রবল ঘৃণায় ফেলে দিই টয়লেট ডাস্টবিনে। সারা গায়ে লিকুইড ডাভ উপুড় করে ঘষতে থাকি। ঘষতেই থাকি--

--সব দাগ মুছে ফেলতে হবে। সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করতে হবে। না হলে তাতাইকে কোলে নেবো কী করে?

বাথটাব থেকে উঠে বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়াই, নগ্ন আমি। খিল খিল হেসে ওঠে আয়না।

--সব দাগ মোছা যায় না রে পাগলী মেয়ে!

আমার ম্যানিকিয়র্‌ড নেলপলিশ্‌ড নখ আঁচড়াতে থাকে সারা শরীর। আমার জিভ, ঠোঁট, স্তনবৃন্তে রক্তের আভাস। আয়নাটা হঠাৎ দুলে ওঠে। দুলতে দুলতে ক্রমশ ছোট হতে থাকে। চেনা হাত পা মুখের আদল ফুটে উঠতে থাকে। তাতাই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আমার কোলে। ওর কোমল স্পর্শে একটা একটা করে মুছে যেতে থাকে সব ধর্ষণচিহ্ন।

আমি আর একটা ধোওয়া নাইটি পড়ে আবার ফিরে যাই আমাদের বেডরুমে।


মলয় রায়চৌধুরী

জবাবদিহি
মলয় রায়চৌধুরী



ছবি : যে সময়ে পলায়ন করিতাম  সেই সময়কার ফোটো
স্কুলের পর্ব শেষ হইবার পর আমি স্বগৃহ হইতে কয়েকবার পলায়ন করিয়াছিলাম। কলেজে প্রবেশ করিয়াও পলাইয়াছি বারকয়েক। একা নয়, আমার পলায়নের সঙ্গী হইত সহপাঠী তরুণ শূর। তরুণ আমার নিকটতম বন্ধু ছিল। তাহার প্রধান কারণ আমরা দুইজনই একাকীত্ব ভালোবাসিতাম এবং একত্র হইলেও পরস্পরের সহিত কথাবার্তা বিশেষ বলিতাম না। পাশাপাশি হাঁটিতাম, ট্রাকে অথবা ট্রেনে চাপিয়া দূরদেশে যাইতাম, ধাবায় বসিয়া দ্বিপ্রহরের তড়কারুটি বা ভাত-মাংস খাইতাম। একান্ত প্রয়োজনীয় কথাবার্তা ছাড়া বিশেষ বাক্যালাপ হইত না।


গৃহ হইতে পলায়ন করিতে হইলে বাবা-মাকে অগ্রিম সংবাদটি জানাইয়া তো আর যাওয়া যায় না। হঠাৎই একদিন একবস্ত্রে দুইজনে পলাইতাম। তরুণ ছিল সচ্ছল পরিবারের। টাকাকড়ি সে-ই খরচ করিত।

গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর বাবা বা মা কেহই কোনো প্রশ্ন তুলিতেন না। কখনও তোলেন নাই। এমন ব্যবহার করিতেন যেন ব্যাপারটি স্বাভাবিক।

একবার পরপর বেশ কয়েকদিন তরুণ আমাদের গৃহে আসিল না। উহার পিতার সহিত যোগাযোগ করিতে উনি জানাইলেন যে, তরুণের লিউকেমিয়া হইয়াছে, চিকিৎসার জন্য পাটনা হইতে কলিকাতা লইয়া যাইতেছেন।

গৃহ হইতে পলায়নের পর্বে ছেদ পড়িল। স্নাতকোত্তরের পর আমি চাকুরিতে প্রবেশ করিলাম। চাকুরিতে প্রবেশের কয়েক বৎসর পর বিবাহ করিলাম। আমার একটি কন্যা সন্তান হইল। অফিস হইতে ফিরিয়া কন্যার সহিত খেলিতাম।

একদিন অফিসেই এক সহকর্মীর মুখে শুনিলাম যে তরুণের মৃত্যু হইয়াছে।

মৃত্যুসংবাদটি শুনিয়া, গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া সোফায় হেলান দিয়া চুপচাপ বসিয়াছিলাম।

সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল।

আমার চার বৎসরের কন্যা ঘরে ঢুকিয়া আমার সন্মুখে দাঁড়াইল, তাহার ছোটো-ছোটো দুটি হাত পিছনে। তিরস্কারের সুরে কহিল, "তুমি দাদু-ঠাকুমাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে?"


শ্রাবণী দাশগুপ্ত

লিপস্টিক
শ্রাবণী দাশগুপ্ত



গোলাপী লিপস্টিকটা তুলে নিয়ে আয়নার সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল শ্বেতা। লাগালো না। নাক কুঁচকে ঠোঁটদুটো ফাঁক করে দাঁত দেখলো নিজের। ঝকঝকে পরিপাটি, সুস্থ গোলাপি মাড়ি। মুখের একমাত্র সুন্দর অংশ। বেজারমুখে লিপস্টিকটা আঙুলে ঘোরাতে লাগলো। লাগাতে হবে? লাগাতেই হবে? ডিম্বাকার ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা মস্ত মুখ। গোলগোল চোখ, কাজল না পরলে মরা মাছের মতো। বড়ি নাকের ঠিক নিচে ছোট্ট একটা সরলরেখা। কবে যেন গানের ক্লাসে গোমড়া বসেছিল। পূর্বিতা ফিকফিক, “ঠোঁট বন্ধ রাখলে তোকে না একটু হনুমান-টাইপ...।” সে দুঃখীচোখে তাকাতে পূর্বিতা বলেছিল, “প্লিজ কিছু মনে করিস না রে, জাস্ট মজা!” পরের ক্লাসে একটা সরু বাদামী পেন্সিল মতোন দিয়েছিল, “এই নে। আগে এই লাইনার দিয়ে প্রমিনেন্ট করে এঁকে নিবি, তারপর ডীপ লিপস্টিক।” শ্বেতা বেশ একটু খুশি হয়েছিল, “ধ্যাত, ওসব পারব না।” দিনদুই পরে তুহিন রেস্টুরেন্টের ঘুমন্ত আলোয় একদৃষ্টিতে তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়েছিল। উত্তেজনায় তার গা শিরশির করছিল। নিশ্চয়ই আগের দিনের মতো বলবে না, “ধুর, তোকে চুমু খাওয়া যায় না... ঠোঁটই নেই।” সেদিন শ্বেতার অভিমান হয়েছিল। একটু ঝগড়া করেছিল,“কেন রে? সব্বাই তো বলে পাতলা ঠোঁটই সুন্দর!” তুহিন বলেছিল, “তা বলে এরকম? আমি কি এঞ্জেলিনা জোলি চেয়েছি?” আজ শ্বেতা ভরপুর আত্মবিশ্বাসী। তুহিন চশমাপরা চোখ বিস্ফারিত করে বলল, “এই! ঐরকম গোঁফ এঁকেছিস কেন? জঘন্য দেখাচ্ছে!” অপমানে চোখ ডবডবে। ভারি তো ছ’মাসের বয়ফ্রেন্ড! এঞ্জেলিনা জোলি, ঐশ্বর্‍য রাই, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া; দিম্মার যুগের সুপ্রিয়া দেবী, কিম্বা টিভির নিউজ রিডার, মডেল, সবার ঠোঁট পদ্মের পাপড়ির মতোন? সেক্সি? নিঁখুত? আকর্ষক? তারই শুধু বিতিকিচ্ছিরি? শ্যেনদৃষ্টিতে আজকাল সে পথেঘাটে ঠোঁট দেখে। কতরকম! পোড়াটে কালো, ফাটাফাটা, ঝোলা, ওলটানো, ছ্যাতড়ানো, পুলটিসের মতোন মোটা, কোণে থুতু-জমে থাকা, নকল আঁকা, নরম গোলাপী। পঁচিশ বছরের শ্বেতা নিজের আবিষ্কারে মশগুল। লোকে যা খুশি ভাবুকগে!

পাত্রের ফোটো দেখেনি। দেখতেই চায়নি। বৌদি চোখ টিপেছিল, “জানিস্‌ শ্বেতা, ঠোঁটদুটো বেশ...!” মা বন্ধ দরজায় চাপা ধাক্কা, “এ্যাই শ্বেতা, হলো তোর? শিগগীর বেরো। ছেলের বাবা তাড়া দিচ্ছেন।” সে আর কয়েক মুহূর্ত ভাবল। লিপলাইনারটা দিয়ে স্পষ্ট মোটা ঠোঁটজোড়া আঁকল আয়নার কাচে। লিপস্টিকটা দিয়ে রঙ ভরলো ঘষে ঘষে। তারপর দুটোকেই ছুঁড়ে দিল জানালার বাইরে এবং গর্বিতভাবে দরজা খুলে দিল।

বারীন ঘোষাল

যাহার নাম সুমনা
বারীন ঘোষাল



কিছুতেই পেরে উঠছি না। কাজে এমন জড়িয়ে আছি যে, কিছুতেই। যেন কাজ নয়। কাজ নেই যেয়ে। চিঠি। ফোন। সুমনা বাসস্ট্যান্ডে দুপুর গড়িয়ে। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরবে। বাস থেকে নামলাম হাসতে হাসতে। কাঁধের ঝোলাটা স্কুল ব্যাগের মতো। তা হোক। আমার কদ, আমার পোশাক, মায় গজদন্তিল হাসিটি তার মেয়ের মতো নয়। তবু সুমনা আমার প্রেমিকা। হাত ধরে জিজ্ঞেস করে

--আজ দেরি হয়নি তো!

--না।

--আরও আগে আসতে পারতে?

--পারতাম হয়তো।

--তাহলে আসবে। আমি পারি না। এই অপেক্ষা। দিদিমণি বকবে না হয়।

--ম্যানেজার বকবে না। তোমার কথা বললে।

--বোলো তা’লে।

--তোমাকে একটু ছোঁব। ছুঁয়ে দেখব।

--ছুঁয়েছ তো!

টেলিফোন নামিয়ে রাখি। চিঠি ছিঁড়ে ফেলি। প্রেমিকার কবিতা, প্রেমিকের গল্প আজ লেখা হয় না। প্রেম করা হয়ে ওঠে না। যেখানেই যাই, সাহিত্য আড্ডায়, ক্লাবে পানাসরে, ইউনিয়ন অফিসে, রেশনের লাইনে, সুমনার কাছে –- সুমনা আমার সূঁচসুতো নামিয়ে সরিয়ে রাখবে। ফেরার সময় সঙ্গে দিয়ে দেবে। রিপুকারের ভূমিকা –- ভূমিরই বা প্রয়োজন কী? সূঁচ ফেলে দিলাম।

ছোঁয়া থেকে ধরা, ধরা থেকে পীড়ন, স্বেদ, কাদা, কর্দম, শ্বেত কর্দম, সমসঙ্গতে উত্থান শ্বাস, সমস্তই চাই। সুমনা আদর করে, মুখ লুকায়, মুখ তোলে শুয়ে।

--চুমু খাবো?

--খেয়েছো তো!

--করব?

--করেছো তো!

--উপড়ে নিয়ে যাব?

--ছিঁড়েছো তো! নাও!

চিঠি ছিঁড়ে ফেলি। বুঝতে পারি না, সুমনার স্বামী কেন লুকোয়! অথবা আমিই লুকিয়ে চলি। পালিয়ে বেড়াই। আজ পর্যন্ত দেখা হয়নি। কিংবা সে দেখা নয়। একসাথে বসা। বোতল, সিনেমা, খেলাধুলো, পরনিন্দা। সে দেখা নয়। যে আমি এবং সুমনা এবং এই বিচরণ।

ওঃ সুমনা

সে জানে না কিংবা জেনেও –- অর্থাৎ জানে না।

ওঃ সুমনা

ম্যানেজার জানে কিংবা জেনেও -- অর্থাৎ জানে না।

ওঃ সুমনা

বন্ধুরা জানে না কিংবা জেনেও -- অর্থাৎ জানে না।

--চলে আসবে?

--কীভাবে?

--সব ছেড়ে। লোকলজ্জা। আইন আদালত।

--কীভাবে?

--দরজা খুলে, দরজা খুলে, দরজা খুলে।

ঘেমে উঠি। ঘুম ভাঙে, ভয় লাগে। হারাবো কি? ব্যাগ গোছাই। জল খাই। ব্যাগ আগোছাই। বসে ভাবি। সুমনা? কীভাবে? সুমনা! যাবার কথা আসার কথা শুধু কথা কী হবে আমাদের, কিছুতেই পেরে উঠছি না।


সাঁঝবাতি

প্যালিনড্রোম
সাঁঝবাতি


(১)

কদিন ধরে নিজের ছায়াটাও ফেড আপ হয়ে যাচ্ছিল। নিজের অনুভূতির প্রতি আর রাশ থাকছে না। বুড়ো বাবা মা, পাগল প্রেমিকা এবং টিভির মোটা লোকটাও পর্যন্ত জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে, কখন কীভাবে থাকলে নিজের অনুভূতি বশে রাখা যায়। ছ’টা রিপু কীভাবে দাঁত নখ বের করে প্রেমিকার গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে খাবারের থালা ছুঁড়ে ফেলে প্রমাণ করে দিতে চাইছে শিশ্নের জোর।

ছোটবেলা থেকে আমার একটা লুকানোর জায়গা ছিল। বাথরুমে ঢুকে খুব জোরে কল চালিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চার্লি চ্যাপলিন সাজতাম। সাদাকালো হয়ে আসতো চারদিকটা, আমি ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে দুনিয়াকে ওইটা দেখাতাম। আর আয়নাও ওপাশ থেকে আমায় ওইটা। একমাত্র এই জায়গাতেই আমি খাপ খুলতে পারিনি, রাগতে পারিনি।

সেদিন বাবাকে উত্তমমধ্যম দেওয়ার পর কান্নাকাটি, চেঁচামেচি পেরিয়ে কোনোমতে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। উদোম মাস্টারবেট করতে করতে আয়নার সামনে নিজেকে খুব বাবার মতো লাগছিল কি? মুছে দিলাম কাচটা। একবার, দু’বার, তিনবার। বারবার হাতটা পিছলে যাচ্ছিল। এত বাষ্প জমে কেন? আয়নাটা আজ পরিষ্কার হচ্ছে না। নিজের মুখের ওপর তিন চার বার হাত বোলালাম। কিছুদিনের বাসি দাড়ি, হাল্কা হয়ে আসা সাদাকালো চুল, ঢোকা চোখ, একটুও না ভালোবাসা পাওয়া মুখ-- আমার তো নয়! বন্ধুরা বলতো, আমি নাকি চিরঞ্জিতের মতো দেখতে। কী যে আলফাল দেখছি! হাতটা আবার পিছলে ঢুকে গেল। আয়নার গায়ে যেন কালো রঙের গর্ত তৈরি হচ্ছে! হাত দিতেই টেনে নিল, ব্ল্যাক হোলের মতো। খুব ভয় পেয়ে হাত সরিয়ে নিলাম। আরেকবার কৌতূহল দেখাতে যেতেই ব্ল্যাক হোলটা আমায় ভিতর দিকে টেনে নিতে শুরু করল। ছটফট করছি, যেতে চাইছি না, তাও প্রাণপণে আমাকে অল্পক্ষণেই আরেকটা বাথরুমে এনে ফেললো। একই রকম দেখতে, শুধু সব কিছু উলটো। একটা ছেলে আমার পাশেই ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অনেকটা চিরঞ্জিতের মতো দেখতে। ভীষণ চেনা! চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম -- কী হচ্ছে এসব! আমি কোথায়? গলা থেকে আওয়াজ বেরোলো না। ছেলেটা মিষ্টি হেসে আমার মতোই আয়না ভেদ করে অন্য দিকে চলে গেল। ভয়ে চেঁচাচ্ছি আমি, ধাক্কা দিচ্ছি। দেখতে পেলাম আমারই ছায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবার হাসল। আমি ক্রমাগত কাঁদছি, রাগছি, আঁচড়াচ্ছি...



(২)

পাড়ার সকলে বলে, বাবাইয়ের মতো ছেলে হয় না। মা বাবাকে এই তো ফরেন ট্যুরে পাঠালো। কী যত্নআত্তি করে! মুখে হাসি ছাড়া কথাই নেই! সত্যি ছেলেটা পালটে গেছে একদম!

কেবল বাথরুমে ঢুকলে এখনও দেরি হয়ে যায় আমার। আমি নগ্ন হয়ে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে হাসতে শুরু করতাম। হাসতে হাসতে এভাবেই একদিন আয়নাটা ভেঙে ফেললাম। কয়েকটা চার্লি চ্যাপলিনের সাদাকালো টুকরো হাসতে হাসতে কীভাবে যে আবর্জনায় মিশে গেল, আর কেউ জানতেও পারলো না!



কাজল সেন

দখল
কাজল সেন



আমি এতটা ভাবিনি। ভাবতে পারিনি। কিন্তু দু’আঙুলের ফাঁক দিয়ে যখন ঝরে গেল অনেকটা ঝুরোবালি, তখন ভাবতেই হলো চারিদিকের দিগন্তবিস্তৃত এই বালিয়াড়ির কথা। এখন কথা হচ্ছে, এই বালিয়াড়ির দখল নেবে কে? কার আছে সত্যি সত্যিই এতটা বুকের দাপট! চোয়ালের চওড়া একরোখা ঋজুতা! না, আমার হয়তো ছিল না কোনোদিনই। কিন্তু সমরেশ, তোরও কি ছিল কোনোদিন? শ্রীতমার জন্য তুই কতদূর ছুটিয়েছিস তোর ঘোড়া? উত্তপ্ত বালি খুঁড়ে কতটা তুলে সাজিয়ে রেখেছিস জল? অথচ সেই ঘোড়ার পিঠেই তো সওয়ার হতে চেয়েছিল শ্রীতমা! সেই নিবিড় পাতালের জলেই তো শান্ত করতে চেয়েছিল শ্রীতমা তার গভীর স্তনের উষ্ণতা!

রাতের সেই বালিয়াড়িতে কেটে গেছে আমাদের কত রাতজাগা সময়। দিনের ফুটন্ত বালি তখন ঘুমিয়ে থাকতো স্নিগ্ধ শান্ত হয়ে। আমরা খেলা করতাম সেই স্নিগ্ধতায়। আমি, শ্রীতমা আর সমরেশ। কত রাতে আমরা তিনজন গড়াতে গড়াতে চলে যেতাম সেই ডিঙি নৌকোটার কাছে। কেউ কোথাও নেই। শুনশান চারিদিক। আমরা ডিঙি নৌকোটা ভাসাতে চেষ্টা করতাম অকূলের উদ্দেশ্যে।

শ্রীতমা গান ভালোবাসতো। সে গান গাইতো। অনেক অনেক গান। সমরেশ খুব ভালোবাসতো কবিতা। সে একটার পর একটা কবিতা গভীর আবেগে উচ্চারণ করে যেত। আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। আমার খোলা চোখের ক্যানভাসে সেই নিটোল নিকষ অন্ধকারে একটু একটু করে ফুটে উঠতো দিগন্তবিস্তৃত নগ্ন অসংলগ্ন বালিয়াড়ির অভূতপূর্ব রূপ ও সৌন্দর্য। আর সেইসঙ্গে ফুটে উঠতো আমার, শ্রীতমার ও সমরেশের উদার উন্মুক্ত শরীরের প্রতিটি জ্যামিতিক বাঁক এবং ভাঁজ। উদ্বেলিত যৌবনের মায়াময় উচ্ছ্বাস।

না, তবুও আমি বা সমরেশ, কেউই সম্পূর্ণ দখল নিতে পারিনি সেই দিগন্তবিস্তৃত বালিয়াড়ির। আমরা কেউ নিরঙ্কুশ দখল নিতে পারিনি শ্রীতমারও। আসলে আমরা কি আদৌ ছুঁতে পেরেছিলাম শ্রীতমার শরীরের ভেতরের শরীরকে, মনের ভেতরের মনকে? হয়তো শ্রীতমাও চায়নি কেউ ছুঁইয়ে ফেলে তার ভেতরের সবকিছু! নিজেকে কোথাও আড়াল করেছিল সে। আমরা ছিলাম সেই আড়ালের বাইরে।

আর আমিও তো সেভাবে বালি খুঁড়ে সঞ্চয় করতে পারিনি পর্যাপ্ত জল। শ্রীতমার জন্য ঘোড়া ছুটিয়েও কোনোদিন অতিক্রম করতে পারিনি ডিঙিনৌকোটার

শ্রীতমা খুব গান ভালোবাসতো। শ্রীতমা গান গাইতো –- ‘জীবনের পরম লগন, কোরো না হেলা, কোরো না হেলা...’। না, আমরা তিনজনই তো জীবনকে কখনো অবহেলা করিনি। তবুও সেই পরম লগন আর এলো কই!


সোনালি বেগম

ট্রাপিজের খেলা
সোনালি বেগম


‘তোমার ঘরে বাস করে ক’জন ও মন জান না / তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জান না...’

সঙ্গে কয়েকটি বাউল গানের ক্যাসেট এনেছে মন্দিরা । ‘সহজ সরলভাবে জীবনযাপন করতেই তো চেয়েছিলাম,’ আক্ষেপ করে মন্দিরা।

মায়াবি প্রকৃতির বৈভবে মাখামাখি সকালের রোদ্দুর । থাইল্যান্ডের ফুকেত দ্বীপ। ‘ফুকেত’ একটি মালয় শব্দ ‘বুকিত’ থেকে এসেছে। ‘বুকিত’ মানে পাহাড়। ‘ফুকেত’-কে দূর থেকে দেখলে পাহাড় বলে মনে হয়।

জাভেদ তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ফুকেত-এর পাতং বিচ-এ একটি হোটেলে এসে উঠেছে ওরা দুজন।

‘সকালে বুবাই ফোন করেছিল,’ ফোঁপাতে থাকে মন্দিরা

‘হঠাৎ এই পরিবর্তন?’ জাভেদের চোখেমুখে বিস্ময়

‘আফটার অল, আমি একজন মা’

‘এখন তোমার মনে পড়ল?’

‘সত্যিই আমি অনুতপ্ত’

‘এই মেয়েগুলোকে আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না’

‘এইভাবে মেয়েদের অপমান করবে না’

‘এই যে, সংসারে অসহ্য হয়ে উঠেছিলে...’

‘বুবাই খাওয়াদাওয়া ছেড়েছে আমার জন্য’

‘আর তোমার হাসব্যান্ড?’

‘ওর কথা কীভাবে জানবো?’

‘কেন, বুবাই বলেনি?’

‘মা’কে ছেড়ে ঐটুকু বাচ্চা...’

ডুকরে উঠলো মন্দিরা

‘এই যে ম্যাডাম, কলেজ তো আর দিন তিনেকের মধ্যে খুলছে, কলকাতা ফেরার সময় হয়ে এলো’

জাভেদের কথা শুনে মাথা নাড়লো মন্দিরা। ‘কোথায় ফিরবে? আমার ওয়ানরুম সেটে, নাকি...?’ জাভেদ কাছে সরে এলো। ‘ভাবতে পারছি না, কিছুতেই’
‘ভ্রমণের মজাটা আর একটু জমিয়ে করো না, ইয়ার। এইসব কান্নাকাটির কোনো মানে হয়?’

‘প্যালেস অফ এলিফ্যান্টস’ থিয়েটার হলে তখন ফ্যান্টাসি-শো শুরু হয়ে গেছে। অসংখ্য হাতি আর ঝলমল থাইপোশাক পরিহিত মেয়েরা স্টেজ পারফরম্যান্স করছে। থাই লোককথা পরিবেশনে জাদু, সঙ্গীত ও নাচের অসাধারণ এরিয়াল ব্যালে, ট্রাপিজের খেলা।

রূপকথার দেবদূত-পরীদের সঙ্গে আকাশে উড়ে যেতে থাকল সুইমিং-স্যুট পরিহিত মহিলা ও পুরুষ, চমৎকার সাদা বালির সমুদ্র সৈকতে।

পিনাকী সেন

পনিটেইল
পিনাকী সেন



ঝাড়া চল্লিশ মিনিট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাকব্রাশ। রাউন্ড চিরুনি, ক্রু-জেল... হেয়ার-ব্যান্ডটা লাগাতেই অবশেষে হাতের মুঠোয় কাঙ্ক্ষিত নরম লোমশ দুলুনি। কতদিনের সখ। ছ’মাসের ওপর লাগল প্রায়। তাড়িয়ে তাড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে নিজেকে দেখছিল স্যমন্তক... ঘোড়ার পিছন। একটু ফিনিসিং ট্রিম করতে হবে খালি। আজই। ছোট্ট একটু নুর রাখবে। ভাগ্যিস মৌবনীকে নিয়ে বেটটা ধরেছিল! গীটার নিয়ে ক্যান্টিনে গলা মেলালেই ঠিক প’টে যাবে। ‘যখন নীরবে দূরে...’

- কী রে দাদা? এতক্ষণ ধরে কী করছিস মেয়েদের মতো? এ বাবা পনিটেইল! দেখি দেখি

- হাত দিবি না, একদম হাত দিবি না বলছি, মার খাবি

সাইকেলের টায়ার আজই লিক হতে হলো! সারাতে দোকানে দিয়ে অগত্যা হাঁটাপথ। মোড়ের পার্লারটাই সব থেকে ভালো। মেইন রোড দিয়ে হাঁটলে এই একটা সুবিধা, বাস আসলে হাত দেখাও, স্লো হলে রানিং-এ উঠে যাও। বাস আসছিল। হাতও দেখিয়েছিল। কিন্তু হাত বাড়িয়ে যখন রডটা ধরেছে, তখনই টের পে্‌ গাড়ি স্লো হয়নি। প্রথম লাফটা ফসকালো। জুতোটা স্কিড করল ফুট-বোর্ডে। হড়কে অনেকটাই পিছলে গেল। আপ্রাণ দ্বিতীয় লাফটাও। খানিকটা ছেঁচড়ে যাওয়ার পর হাল যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, শক্তিশালী কারোর একটা হাত বাসের ভেতর টেনে তুললো। সারা শরীর কাঁপছিল। দাঁড়াতে পারছিল না ভালো করে। মাথার ভেতরটা ঝাঁ ঝাঁ। তারই মধ্যে তাকে জ্ঞানদানের প্রতিযোগিতা চলছে যেন! ‘বয়সের দোষ, হিরোইজ্‌ম, জীবনটা সিনেমা নয়, স্টপেজ থেকে বাস ধরতে কী হয়!’ রাগে গা গোলাচ্ছিল, কোনো রকমে স্টেডি হওয়ার চেষ্টা করতে করতে স্টপ এসে গেল। ‘এই যে দাদারা, দিদিরা, দাদুরা, where there is life, there is risk’ -- শ্লেষটা ছুঁড়ে দিয়েই তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়ল স্টপেজে। ট্র্যাক-সুটটা অনেকটাই ফেঁসে গেছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে পার্লারের সিটে এসে বসে বড় করে একটা হাফ ছাড়ল। আয়নার দিকে তাকাতেই চোখ ফেটে জল এসে গিয়েছিল। সামনের দিকে অনেকখানি চুল খাবলা মেরে উঠে গেছে। ‘কী করে কী হলো?’ –- পার্লারের এক চেনা কর্মীভদ্রলোকের কৌতূহলী প্রশ্ন। ‘এখন কথা বলতে পারছি না, একদম ছোট করে ট্রিম করে দিন তো!’

মৌবনীর সংগে কাট হয়ে গেছে। স্যমন্তকের নিউ ক্রু-কাট হেয়ার স্টাইল নিয়ে বন্ধুমহলে ভিন্ন ভিন্ন ভোট অবশ্যই আছে। ইউনিভারসিটির লনে বসে একা একাই গুনগুন করছিল স্যমন্তক। ‘না জানে কোই...’। -- ‘হাই আমি আরাত্রিকা, ইউ রিয়েলি সাং ওয়েল।’ স্যমন্তক হাঁ হয়ে তাকিয়ে দেখল। ফার্স্ট-ইয়ার ইংলিশের সেই ডাঁটিয়াল বিউটিকুইন!

লিপিকা ঘোষ

সুবর্ণমৃগী
লিপিকা ঘোষ



নতুন প্ল্যাটফর্ম। টিকিট-ঘর আর সংলগ্ন লাইন দাঁড়ানোর জায়গাটির মাথা থেকে টিনের ছাউনি উপড়ে নতুন ঢালাই-ছাদ। স্টেশনটার হাল ফিরল এতদিনে। সুবর্ণমৃগী... স্টেশনের নাম সুবর্ণমৃগী। মেয়েটির নাম যেন কী ? সুবর্ণমৃগী হল্ট থেকে স্টেশন হয়ে উঠল ক্রমে। প্রায় সব ট্রেনই এখন এখানে জিরোয়।

হুইসলের সঙ্গে আঁচল ওড়া একলা বিকেলগুলো মনে পড়ছে ওর। এখানে মোবাইলে এক দাগও টাওয়ার থাকে না।

দূর থেকে একটা কলরব যেন শুনতে পেত ‘সুবর্ণমৃগীই-ই-ই-ই তোমাকে খুঁজছি আমরা’। ও কি সোনার হরিণী? ব্যাধেরা হন্যে হয়ে খুঁজছে?

শহর থেকে অনেকটা দূর-গ্রাম।পঞ্চায়েত অফিসে সদ্য চাকরি। তখন প্ল্যাটফর্ম ছিল না। এই হল্টেই ওঠা নামা। খুব অসুবিধে হতো। পা হড়কে যেত। সবজি-ওয়ালি চাচী-নানীদের হাত ধরে ওঠে নামে।

একদিন ফিরতি বিকেল। হঠাৎ কালবৈশাখী। দৌড়ে টিকিট ঘরে আশ্রয়। জনা কয়েক। ঝড়... ঝড়... তুমুল। পুরো স্টেশনটা-ই না উড়ে যায়! না, এ স্টেশন উড়ে গেলে চলবে না। এখানে সুবর্ণমৃগীর খোঁজ মেলে। তারপর হঠাৎ, পোকা। কালো কালো বিদঘুটে পোকা আর পোকা। টিনের চালার ফুটোগুলো বেয়ে নেমে আসছে। বাইরে ঝড় আর টিকিট-ঘরে শুধু পোকা। গা বেয়ে মাথা বেয়ে শাড়ি বেয়ে ছেয়ে যাচ্ছে। ছুটে বেরোয় ঘর থেকে। সুবর্ণমৃগী আতঙ্কে দিশাহারা। ঝড় ওর মেরুন পাড় ওর আঁচলের সাদা উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। বৃষ্টি নামল। অঝোরে ভিজতে থাকা মেয়েটাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসায় এক সবজি-ওয়ালি চাচী। ‘অই গো, ভয় পেইয়েছে গো সুনার বাছাডা। ও পুকাগুলোন কিছুডি বুইলবে না, হুই যে গাছখান, ওখেনে বাস উয়াদের। বাতাস উঠলিই উড়ে আসে টিকিট-ঘরে’।

হুইসল এলো। ভিজে শাড়ি জড়িয়ে গেছে পায়ের গোছে। এক সবজি-ওয়ালি নানীর হাত ধরে কোনো রকমে ট্রেনে উঠল।

প্রায় বছর পাঁচেক পর এই স্টেশনে আজ আবার এসে দাঁড়িয়েছে ও । মাঝে আর একদিনও আসেনি। ঘুর পথে অফিস যেত। এখন বদলি নিয়ে পদ্মাপাড়ের অন্য এক গ্রামে। সেথায় পদ্মার পানি, সেথায় পদ্মার ভাঙ্গন। সে গ্রামের নাম রূপনগর, পাশেই বুঝি পড়শীর বাস।

আজ ও এসেছে সেই সুবর্ণমৃগীর খোঁজে।

সেই সব সবজি-ওয়ালি চাচী-নানীরা ধারে কাছে কেউ নেই। এখন ট্রেনে উঠতে আর অসুবিধে নেই যদিও। উঁচু প্ল্যাটফর্ম।

দূর থেকে হুইসল আসছে। এক্ষুনি স্টেশনটা ছেড়ে যাবে ও। কোথায় সুবর্ণমৃগী, কোথায়? হারিয়ে গেছে! ট্রেনে চেপে বসল ও। দিশেহারা। কই সোনার হরিণী, কই! গতি নিচ্ছে ট্রেন। হঠাৎ একটা পোকা, সেই কালো বিদঘুটে পোকা। উড়ে এসে বসল ওর গলার ঠিক নিচে বড় কালো তিলের ওপর...




তপনকর ভট্টাচার্য

অন্য কথা
তপনকর ভট্টাচার্য


কী বলবো বলো, যে কথা বলা যাবে না, সেই কথা না বলে, অন্য কথা — অন্য কথা।

সে আমি, হ্যাঁ, সে আমি বলতেই পারি। যেমন, তুমি ফাটাফাটি। তোমার ফিগার, আর কোমর, খুব ইন্টারেস্টিং। ওই জায়গাটা, তুমি তো জানো, কোমর নিয়ে আমার অবসেশন—

যখন কথা বলো, দাঁত ঝকঝক। হাসলে আরো বেশি। চোখ বুজে, নাকে কাঁপা কাঁপা তিরতির, ছোট ছোট দোলা, ছোট গোছা চুল চকিতে সরে যায়। একথাও বলতে পারি। কিন্তু যে কথা বলবো ভাবছি অথবা বলতে চাইছি — তোমাকে আর... ভালোবাসা ক্রমশ... দিন দুঃসহ... আর নয়... সেই কথা বলা যাবে না, তাই অন্য কথা — অথচ তুমিও খুশি, যদি বলে দিই, সে কথাই তুমি শুনতে চাও, কিন্তু আমি বলবো না, তাই অন্য কথা—

শরীর, শুধু শরীর, আমাদের, দুজনের শরীর দুজনার কাছে, যেন আর কিছু নেই। শারীরিক চরম আমরা প্রতিদিন প্রায়। অসফল সঙ্গমের কোনো চিহ্ন আমাদের মধ্যে নেই। অথচ বালি সরে যাচ্ছে, ঢেউ ঢাকা বালি, চোখে না পরা বালি, আস্তে আস্তে—

--আজ শাক ভাজা।

--আজ শুক্তো?

--আজ পাবদা।

--আজ মাংস?

--আজ অম্বল।

--আজ চাটনি?

বলো বলো, এ ছাড়া কী আছে আমাদের? শরীর, সংসার, সঙ্গম, রান্না-খাওয়া ছাড়া! তুমিও চাও কথাগুলো বলতে। বলতে পারো না তাই অন্য কথা —

শীৎকার। কী বিপুল ভঙ্গি! সবটুকু আদায়, দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেওয়া, কামড়ে খামচে রক্তাক্ত, আর কথা বললেই অন্য কথা!

এসো, আমরা যা বলতে চাই, যে ভাবে শরীর খুলি, নগ্ন হই, সেইভাবে অন্তত কথা বলি।

--দাঁত মাজা শেষ?

--খবরের কাগজটা দাও।

--মাছ আনবে?

--না, মাংস।

--কাঁচা লঙ্কা, ঢ্যাঁড়স, পটল। আর দই।

--টক?

--না, মিষ্টি।

--অফিস যাবে না?

--না...

--আজ দুপুরে...

--হুম!

--আজ আমাদের...

--হুম!

অলোকপর্ণা

আপেক্ষিকতা সূত্র
অলোকপর্ণা



ক্রমশ ভারী হয়ে ওঠা বাবার বায়প্সি রিপোর্ট বুকে আগলে জীবন প্রাণপণ ঝুলে পড়ে ট্রেনের দরজার খেই ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে কর্কটের সাথে সে মুহূর্তেই যেন লড়াই শুরু হয় তার। দু’হাতে উপরের বাড়তি কিছু হাতল চেপে ধরে সে ভিড়ের কাঁকড়াটাকে বুক দিয়ে ধাক্কা মারতে মারতে একসময় কামরার মাঝখানে পৌঁছে যায়। গোটা কামরা পুরনো ক্ষয়াটে তাসের মতো গন্ধে আচ্ছন্ন। জীবনের কান্না পায়।

দমদম চলে আসলে তার গোটা লড়াইকে অর্থহীন বানিয়ে কামরা ফাঁকা হতে থাকে। জীবন শূন্য দৃষ্টিতে সেই রিক্ততা মেখে নেয়। চোখে জল আসতে ভুল হয়ে যায়। মুসামরি, সেফটিপিন, জেন্টস রুমালের বেওয়ারিশ কোলাজ কানে ঢুকে আসায় ঘোর কাটে তার। ফাঁকা ট্রেনের গড়পড়তা সীটে সে গা এলিয়ে দেয়। বাইরের হাওয়ার দমক অবশেষে আরামদায়ক বিলি কেটে যায় জীবনের কপালের বলিরেখায়। আরামের প্রতিটা বিন্দু পান করতে করতে তার চোখ পড়ে কলেজপড়ুয়ার দলের ওপর। এলেবেলে হাসিঠাট্টায় ওদেরই রাজার মতোন লাগে। জীবনের হিংসা হয় বাবার তৃতীয় দশায় ক্লান্ত হওয়ার অবসর নেই বলে। কুকুরের মতো ধুঁকতে থাকা কামরার বাকি মানুষগুলোর ক্লান্তিও তাই জীবনকে ভয়ানক ঈর্ষা দেয়।

এই সময়েই দরজার পাশ থেকে ‘ওর’ স্বর শোনা যেতে ক্লান্ত লোকগুলো কুন্ডলী খুলে একপাক দিয়ে ওঠে। কারো কারো চোখে মস্করা ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে উঠল। মানুষটার গায়ের উগ্র গন্ধ কামরার মন ভুলিয়ে দিচ্ছে। সচকিত হাততালি দিতে দিতে প্রত্যেকের কাছে গিয়ে মানুষটা বলতে শুরু করে, “দে উর্চিবাবু, দশটা টাকা দে। বাহামণির মতোন বউ পাবি! ভালো মানুষ হবি!” কলেজপড়ুয়াদের দলে শোরগোল বেড়ে কেউ একজন বলে -- “তুইই তো আমাদের বাহামণি!”, তবু সে শাড়ির বেয়াড়া আঁচল সম্বল করে অবিচল বলে চলে, “দে উর্চিবাবু...”।

জীবন দেখে, ‘ভালো মানুষ হবি!’র নালিশ বা অভিশাপ দিয়ে সবার প্রতি ঈর্ষান্বিত মানুষটা নেমে যাচ্ছে ট্রেন থেকে। তার ফেলে যাওয়া উগ্র গন্ধ হিংসা করছে বাকিদের ক্লান্তি, মস্করা, গলার স্বর, পেলব ত্বক আর প্রবলভাবে -- যৌনাঙ্গকে। এমনকি মানুষটার হিংসা জীবনের বলিরেখা আর হাল্কা হতে শুরু করা বায়প্সি রিপোর্টকেও ছাড়ছে না; কামরার তাসের গন্ধে হিংসুটে জোকারের মতো বাড়তি হয়ে বিলিয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত জীবন নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে।


অর্ক চট্টোপাধ্যায়

শয়নযান : একটি নীতিমূলক গল্প
অর্ক চট্টোপাধ্যায়



অসিত একমাত্র শুয়ে শুয়ে ভাবতে পারতো। না শুলে তার মাথা কাজ করতো না। এ জন্য জীবনে কম ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাকে! কোনোদিন পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করতে পারেনি। শেষে হেড মাস্টারকে বলে কয়ে একটা ঘরে শুয়ে শুয়ে, মানে বেঞ্চের ওপর উপুড় হয়ে, পরীক্ষা দিত। পরে যখন ইস্কুল মাস্টারি শুরু করলো, তখন তো ঝামেলাটা চরমে উঠলো। কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে চাইতো না; ভাবতো, ফাঁকিবাজি আর কী! ক্লাস না নেবার অজুহাত! কিন্তু ক্রমশ যখন বোঝা যেতে লাগলো যে অসিতের সত্যিই একটা সমস্যা আছে, তখন ইস্কুলের হেডমাস্টার বললেন, "আচ্ছা, ঠিক আছে, একবার না হয় অসিতবাবুকে একটা সুযোগ দেওয়া হোক"। চেয়ার টেবিলের জায়গায় একটা খাটিয়া পাতা হলো আর অসিত তার ওপর শুয়ে শুয়ে সামনে বেঞ্চে বসা ছেলেদের দিব্যি পড়িয়ে দিলো। এই বন্দোবস্তে প্রথম প্রথম ছেলেরা বেজায় হাসাহাসি করতো, কিন্তু ক্রমশ অসিতের উচ্চাঙ্গের পড়ানো তাদের মন কাড়লো! যে অসিতকে সবাই ক্লাসে দাঁড়িয়ে কিম্বা বসে খাবি খেতে দেখেছে, সে কিনা শুয়ে শুয়ে অমন সুন্দর কাটা কাটা যুক্তি দিয়ে কথা বলে গেল টানা!

কিন্তু সব থেকে বড় সমস্যাটা অসিতের জীবনে নয়, বরং তার মরণে হলো! যে পুণ্য তিথিতে ভর দুপুরবেলা রিটায়ারমেন্টের দেদার ভাতঘুমের ভেতর ঝুপ করে থেমে গেল তার হৃৎপিণ্ড, সেই তিথিতে কেন, তার পর সাত সাতটা দিন কেটে গেলো, অমাবস্যা চলে এলো, তাও তার ব্রেন ডেথ হলো না। অসিতকে যারা অনেকদিন ধরে চিনতো সেইসব বন্ধুরা ডাক্তার মহিতোষ চ্যাটার্জিকে অনেক বোঝালেন যে, অসিতকে বসিয়ে বা দাঁড় করিয়ে না রাখলে তার মাথায় ভাবনার আনাগোনা থামানো যাবে না; এত বছরের অভ্যেস কিনা! কিন্তু মহিতোষবাবু বিজ্ঞানের লোক, এইসব আষাঢ়ে গপ্প শুনতে যাবেন কেন? অগত্যা অসিতকে ব্রেন ডেথের অপেক্ষায় তার কেবিনেই রেখে দিলেন তিনি। এইভাবে আরো একটা সপ্তাহ কেটে গেল। বডি পচতে শুরু করায় প্রেসেরভেটিভ দিতে হলো। কিন্তু না, ব্রেন ডেথের কোনো সীন-ই নেই। মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ডাক্তাররা। অসিতও ক্রমশ একটা সেনসেশন হয়ে উঠতে লাগলো। মহিতোষবাবুও থই করে উঠতে পারলেন না আর। তার সিনিয়রদের সাথে অনেক আলোচনা-আলাপ করেও যখন কোনো কুল বা কিনারা হলো না, তখন অগত্যা অসিতবাবুর বন্ধুদের কথা মেনে নিয়ে বললেন "আচ্ছা, ঠিক আছে, একবার না হয় অসিতবাবুকে একটা সুযোগ দেওয়া হোক"। অতএব মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে শনিবারের মাঝরাতে অসিতকে মর্গে ট্রান্সফার করা হলো; সেখানে বিশেষ এক যন্ত্রের সাহায্যে বরফের ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখা হলো তাকে। এইভাবে রাখার পর দিন দুয়েকের মাথায় অবশেষে অসিতের মগজ স্থির হলো এবং তারপর বন্ধুদের কথামতো সোমবার মাঝরাতে দক্ষিণ ভারতের এক জনগোষ্ঠির কায়দায় অসিতকে পালকির মতো একটি বস্তুতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো কবরখানায়; পাছে আবার মাথা কাজ করতে শুরু করে! এরপর ওই দক্ষিণী কায়দাতেই বসে থাকা অবস্থায় তাকে কবর দেওয়া হলো; শুইয়ে দিলে পাছে আবার মাথা নড়ে ওঠে ভেতর থেকে! তাকে না পোড়ানোর কারণটা এর থেকেই আন্দাজ করা যায়! অবশ্য পোড়ানোর মতো সেরকম কিছু আর ছিল না সে শরীরে! এইভাবে আমরা আরো একবার বুঝলাম যে, চিন্তা ব্যাপারটাকে না থামানো গেলে কী ঘোর বিপত্তি হতে পারে!

রুচিস্মিতা ঘোষ

যে গল্পটা হয়ই নি
রুচিস্মিতা ঘোষ



জ্যোৎস্নার রাত। আকাশে ছোট ছোট সাদা মেঘে রহস্যের বিছানা। রিডিংল্যাম্প... বই-খাতা... ল্যাপটপ... গরম কফি। আপনা আপনিই সময় কেটে যায়। পড়তে যাই, লিখতে চাই। হয় না। ভাবনাগুলো ভূমিকম্পের বারোতলায় দোলে। রাত গভীর। সেখানে অজস্র মুখ। ঘটনারা –- একের পরে এক ঢেউয়ের মতো।

কেউ এলো।

ঝাঁকরা চুল –- তামাকের গন্ধ –- উদাস চাহনি। একেবারে কাছে। বিছানায়। নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ। দুজনেই কথা বলে উঠি। আর কেউ শুনতে পায় না সেসব কথা। অতীত দুলে ওঠে ভূমিকম্পের বারোতলায়।

--‘এসেছি’। সে বলেনি, তাও শুনতে পাই।

--‘কেন এলে? আমি তো চাইনি’।

--‘চেয়েছ। এখনও চাইছ’।

নিঃশ্বাস দ্রুত। তামাকের তীব্র পুরুষালি গন্ধ; বিভোর।

রিডিংল্যাম্পটা নিভিয়ে দিই। অন্ধকার ঘন। কয়েক সেকেন্ড। পল-অনুপল অনুভবে মাপি।

--‘এত তো চাই, চাই; নাও এখন’!

--‘না’।

অন্ধকারে চোখ জ্বলে ওঠে। সেই বিদ্যুতের দৃষ্টি চিরে ফেলে অন্ধকার।

--‘তাহলে এতদিন ধরে রেখেছ কেন?’

--‘যখন চেয়েছি, তখন আসোনি’।

--‘এখন তো এলাম। নাও!’ সে দু’হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়।

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তার নিঃশ্বাস ঘন। অন্ধকার কেঁপে উঠল। যত কাছে টানছে, তত ঠান্ডা হয়ে আসছে শরীর। গাল বেয়ে দু’ফোঁটা জল।

--‘কাঁদছ কেন?’

--‘মুক্তি চাই’।

--‘মুক্তি দিতেই তো এলাম’।

কথায় কথায় সময় পার হয়ে যায়। এত কাছে –- বারবার ছুঁয়ে দেখি। নিজেকেও খুঁজি। বিশ্বাস হয় না। আরও কি বাঁধা পড়ে গেলাম! না, এমনি করে মুক্তি হয়! চাওয়ার থেকে মুক্তি পেতে চাই-ই বা কেন! চাওয়াটা তো কত কিছুর সঙ্গে মিশে ছিল। একান্ত সময়, কবিতা, অজানা-অচেনা সেই ভালোবাসা!



হাত বাড়িয়ে ল্যাম্পটা জ্বালালাম। মৃদু আলোয় ভরে উঠল ঘর। মনে হলো, বিছানা ছেড়ে কেউ উঠে চলে গেল।

কফির মগ উলটে গেছে। চাদরে দাগ। বইয়ের পাতা উড়ছে। খাতা খোলা। ল্যাপটপের আলো জ্বলে উঠল।

অতীত নেই। স্মৃতি নেই। খাতা টেনে নিলাম। কলমও। ফ্লাস্ক থেকে কফি। নির্ভার লাগছে। কেউ নেই। পোড়া তামাকের গন্ধটা জ্বালাচ্ছে।


অর্পণ চক্রবর্তী

হাফ-মার্ডার
অর্পণ চক্রবর্তী


ঝোপঝাড়ের ভিতরে বডিটা পড়েছিল। শুধু পা দুটো বাইরে। দেখে বোঝার উপায় ছিল না লোকটার জান এখনো লেগে আছে বডিতে। ক্যানিং অঞ্চলের গ্রামের রাজনীতি আর জমিজমার ভাগাভাগি নিয়ে এরকমটা হামেশাই হয়। খবর পেয়ে ছেলে প্রদীপ ফিরল কলকাতার নামকরা কলেজের হস্টেল থেকে পড়াশুনো মাথায় তুলে, হাতে একটা রামদা আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই গাঁ ঐ গাঁ ঘুরণপাক মারল। যারা হাফ-মার্ডার করেছিল বাবাকে, তারা ধাঁ। বাবার জমিজিরেত আছে, পাশের গাঁয়ের সেকেন্ডারি স্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টার, পার্টির লিডারও বটে। প্রদীপ থানায় ডায়েরি করল একটা, আততায়ীদের নামে কেস শুরু হলো। কলকাতার নার্সিংহোমে বাবাকে ভর্তি করে চিকিৎসা চলল অনেকদিন। ফলে কলকাতার কাছেই সোনারপুরে বাড়ি ভাড়া করে মা’কে নিয়ে থাকতে শুরু করল প্রদীপ। বাবা সেরেও উঠলেন, কিন্তু ততদিনে মা আর ছেলে মিলে সোনারপুরেই কয়েক কাঠা জমি কেনার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে বায়নাও দিয়ে রেখেছে। নার্সিংহোম থেকে ফিরে প্রদীপের বাবার প্রথম কাজ হলো জমির দাম মেটানো। দীর্ঘদিন চিকিৎসার খরচ, তার সঙ্গে এই জমি কেনার খরচ -- ভদ্রলোক একটু বেশি মাত্রায় খিটখিটেই হয়ে উঠলেন। ছেলেকে বললেন -- '' দেখো বাপু, টাকাপয়সা আর আমার নেই। বাড়ি তৈরির খরচ আমি দিতে পারব না। সে ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে, এইটা ভালো করে বুঝে যাও।'' অতঃপর তাঁর কাজ হলো সপ্তায় দু’তিনদিন ট্রেনে করে গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে জমিজিরেত চাষবাস সামলে আসা। আর ফেরার সময় স্টেশন থেকে হেঁটে সদ্যকেনা জমিটার সামনে বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। মাঝে মাঝে ওখানেই ছেলের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায় তাঁর। সেও কলেজফেরতা ওখানে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধের আবছায়া একটা একতলা বাড়ির আকার নিতে থাকলে বাপ-ছেলে ভাড়া বাড়ির পথে পা বাড়ায়। এই পথটুকু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। এইভাবে বাবা আর ছেলের নিশ্চুপ হয়ে পাশাপাশি হাঁটাটা একটা অভ্যেসে রূপ নেওয়ার মাস ছয়েক পর একদিন এর প্রথম ব্যত্যয় ঘটল।

সেদিনটাও অন্যদিনের মতোই জমির দেখভাল করে ক্যানিং থেকে ট্রেন ধরে সোনারপুর ফিরছিলেন প্রদীপের বাবা। ছুটির দিন ছিল বলে ট্রেনটা মোটামুটি ফাঁকা। হঠাৎই কয়েকটা স্টেশন পর তিনজন লোক নিজেদের মধ্যে উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে বলতে বাবার সামনের সিটে এসে বসে পড়েই বাবাকে দেখে চুপ করে গেলো। বাবাও চুপ। তারা হাঁ করে দেখছে বাবাকে, আর বাবা তাদেরকে। এদের দেখে এখন কল্পনা করাও অসম্ভব, এরাই সেদিন শাবল-টাঙ্গি-হেঁসো-দা নিয়ে মেরে ফেলে রেখে এসেছিলো তাঁকে। বাবা মারাত্মক ভয় পেয়ে চুপ করে গেলেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না তাঁর। মনে হচ্ছিল সেদিনের আধা কাজটা আজ পুরো করার প্রস্তুতি নিয়েই এরা এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি ভেবে নিলেন, এদের যে তিনি আদৌ চিনেছেন সেটাই বুঝতে দেবেন না । এটাই একমাত্র বাঁচার রাস্তা, নইলে আজ ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েই মার্ডার করবে এরা। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টায় তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন। টেনশনে বিড়িও ধরিয়ে ফেললেন একটা। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলেন, ম্যাচিস জ্বালাতে গিয়ে একটুও হাত কাঁপল না তাঁর। বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই তিনি বুঝতে পারছিলেন, একটা হাত এসে তাঁর হাঁটুর ওপর আলতো করে ছুঁয়েছে। না-তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারছিলেন, এটা সেই হাত যে-হাতের শাবলের প্রচণ্ড বাড়িটা মাথার ওপর নিয়েই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। মেরুদণ্ডের শিরশিরে অনুভূতির বদলে একটা অবাক হওয়ার ভাব তাঁকে ছেয়ে ফেলায় তিনি যখন এদের দিকে ফিরে তাকালেন, আলাদা করে অপরিচিতের অভিনয় করতে হলো না। তাঁর সারা শরীরে তখন একটা অপরিচয়ের জিজ্ঞাসা ফুটে বেরোচ্ছে। তিনি দেখলেন, একজন তাঁর হাঁটুর কাছটা চেপে ধরে আছে খুব অনুনয়ের সঙ্গ্‌ আর অন্যরা দু’হাত জোড় করে করুণ মুখে তাকিয়ে আছে।

যে লোকটি শাবল চালিয়েছিল, সে আমতা আমতা করে বলল -- ''দাদা এখন সুস্থ তো? ব্যথা কি আছে এখনো?''

যে লোকটি দা চালিয়ে দিয়েছিল পিঠে, সেও খুব লজ্জার সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করল -- ''আসলে আমরা সেদিন আপনাকে ঐভাবে ফেলে চলে এসেছিলাম... সেটা ঠিক হয় নি কিনা... মানে আপনি যে বেঁচে আছেন সেটাই বুঝতে পারিনি...''

বাবা উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলেন। তৃতীয় লোকটি, যে টাঙ্গি দিয়ে চিরতে এসেছিলো, সে এবার ধমকে থামাল দ্বিতীয়জনকে... তার হাত তখনো জোড় করা। সে খুব বিনীত ভাবে বলল -- ''কিছু মনে করো না চিনুকাকা... যা হবার তা' তো হয়েই গেছে... তোমারও কপালে দুর্ভোগ ছিল, আমাদেরও। তোমার ফাঁড়াটা তো কাটল, কিন্তু আমাদের ভোগান্তির কি শেষ আছে কিছু? এই দেখো না, পুলিশের ভয়ে বাড়ির পানে যেতেই পারি না। চাষবাস তো লাটে উঠেছে... বাচ্চাটার মুখটাও কদ্দিন দেখি না। মাঝে শুনলাম জ্বর হয়েছিল, তাও যেতে পারলাম না। ওদের অবস্থাও হরে দরে একইরকম। এখন কী করবো তুমিই বল কাকা!''

বাবা ততক্ষণে গাম্ভীর্য ফিরে পেয়েছেন... সেটা মুখে যথাযথ বসাতে বসাতে জিজ্ঞেস করলেন -- ''এখন থাকছ কোথায়?''

- ''কাকা, তুমি আবার পুলিশে খবর দেবে বলে জিজ্ঞেস করছ না তো?''

বাবা এবার উঠে দাঁড়ালেন -- ''থাক, বোলো না... সোনারপুর এসে গেলো... আমি চললাম।'' নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তিনজনেই লাফ মেরে উঠে পড়লো -- ''না কাকা , আমরাও নামব... তুমিও সোনারপুরে থাকো? আমরাও তো এখানেই ঠেক গেড়েছি...''



খানিকক্ষণ পরে বাবার সঙ্গে ঐ তিনটি লোককেই দেখা গেলো সেই ফাঁকা জমিটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে... তারা অপেক্ষা করছিলো কখন প্রদীপ আসবে। এদের ক্ষমা করা যাবে কিনা, সেটা প্রদীপের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবা। প্রদীপ এলো, যেমনটা আসে। বিস্ময় রাগ ভয় আতঙ্ক প্রতিশোধস্পৃহা -- সবই পরপর খেলা করে গেলো তার মুখে চোখে শরীরে... তারপর বাবাকে বলল '' তুমি বাড়ি যাও, আমি এদের সঙ্গে কথা বলে পরে আসছি।'' বাবা একটু ভয়ে ভয়েই ফিরলেন... প্রদীপের জন্যে চিন্তা নিয়ে। খুব বেশি সময় গেলো না... মিনিট কুড়ির মধ্যেই চলে এল ছেলে... মুখে পরিতৃপ্তি আর অবসাদ একই সঙ্গে। ঠাণ্ডা এক গ্লাস জল চোঁ চোঁ করে খেয়ে বলল -- ''কেসটা তুলে নেওয়ার জন্যে হাতে-পায়ে ধরছিল। পাঁচ চেয়েছিলাম, তিনে রাজি হলো... যাক্‌ একতলাটা উঠে যাবে, কি বল বাবা! আরও কিছু লাগলে তুমি তো আছই!''



ছেলের শেষ কথাটার মানে আজও ভালো করে বুঝে উঠতে পারলেন না চিন্তামণিবাবু।


সুদেষ্ণা দত্ত

ধাক্কা
সুদেষ্ণা দত্ত


রুবান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ভাবছিল চলেই যাবে। সার্কুলার রোডের ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে রিচি রোডের কাফেতে বসা ভালো। পিয়াল আসবে বলেছিল ঠিক এগারোটায়।

অদ্ভুত সময়ে। এ সময়ে অফিস থেকে বেরোনোর অনেক হ্যাপা। তবু না বলতে পারেনি। কলেজের পুরনো দিন -- নস্ট্যালজিয়া -- বিশেষত তপস্যাকে বিয়ের পর পিয়ালের একদম গুটিয়ে যাওয়া -- এসব নড়েচড়ে কেমন ব্যথা জানান দিচ্ছে বুকের ভেতর। গাড়ি, বাড়ি -- সব করতে বড় জোর বছর বারো লেগেছে । এত বড় একটা পোস্টে পৌঁছতে আরও পাঁচ বছর।

তবুও সেদিনের কষ্টটা একটুও কমল না। কলেজের পোর্টিকোয় তপস্যার পাঞ্জাবির কোণটা দেখামাত্র রুবান বলতে পারত, সে কোন্‌ মুডে আছে, কী রঙের লিপস্টিক পড়েছে অথবা বড় টিপ পড়েছে কি না! তপস্যার মতো আর কাউকে এতটা খুঁটিয়ে কখনো দেখেনি সে। মা’কে একবার পুজোর সময় রুবান শাড়ির কুঁচি ধরে দিয়েছিল, সেদিন মা’কে এমনই খুঁটিয়ে দেখেছিল। বড় টিপ, শাড়ি এসবে মা’কে একদম অন্যরকম দেখায়।

কাফের দরজায় অন্যমনস্ক ধাক্কা খেল রুবান। ভেতরটা একদম ফাঁকা। আচ্ছা, আজ কি তপস্যা আসবে? ওদের মেয়ে? ''আমাদের মেয়ে হলে নাম রাখব রূপসা -- রুবান আর তপস্যার মেয়ে '' -- তপস্যা বলত। সেই মেয়ে যেদিন হলো, রুবান অসম্ভব কেঁদেছিল। খুব ইচ্ছে ছিল যাবে মা-মেয়েকে দেখতে। ঈশা বারণ করেছিল-- ''দাদা তোর কি কোনো পার্সোনালিটি নেই?'' কাল পিয়ালের ফোন পেয়ে এখনো অবধি অপেক্ষায়। কেন আসবে, কে কে আসবে, কিছুই জানা নেই। শুধু এক অমোঘ আকর্ষণে কাউকে না জানিয়েই ছুটে এসেছে। গাড়ি না নিয়েই। তার স্ট্যাটাস বাদ দিয়ে রুবান আজ সেই কলেজের দিনের মতোই দেখা করতে চায়। কার সঙ্গে আসলে? পিয়াল না তপস্যা? না, ঐ ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে? যার স্বপ্ন আজকাল প্রায়শই দেখে...

পিছনে পিয়াল দরজায় দাঁড়িয়ে... প্রায় বুড়ো। চুল দাড়ি সব আগের মতোনই... শুধু ছাই রঙের। আরও দেখতে চায় রুবান। বিপর্যয়ের ছাই রঙ যেন ওদের পুরো সংসারযাত্রায় ছিটিয়ে দিতে চায় রুবান। কিন্তু এই ভেঙে-পড়া পিয়ালের অসম্ভব দুটো জ্বলজ্বলে চোখ যে প্রতিফলিত হচ্ছে ওর প্রায় হাঁটুর উচ্চতার ছোট্ট একটা মুখে! তপস্যাকে ছোটবেলায় দেখেনি রুবান। এমনই হয়তো ছিল, নিশ্চয়ই !

''আমি পিয়াসা... তুমি তো রুবান... বাবা বলেছে, তোমাকে প্রণাম করলে তুমি রাগ কর ...তুমি বিপ্লবী?'' রুবান কোনো উত্তর দিতে পারছে না -- স্বপ্নের রূপসা এসে ধাক্কা দিচ্ছে বুকে। ‘পিয়াসা’!... ‘রূপসা’ নয়! -- যাকে দেখবে বলে প্রায় পাগলের মতো এতটা পথ হেঁটেছে।

''চেকটা নিয়ে যা... যখন পারিস্‌ ফেরত দিস্‌... তাড়া নেই। দেখিস্‌... ভালো ডাক্তার দেখানোই ভালো... যদিও...'' রুবান থামে। ''এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, তাই তো!'' পিয়াল হাঁটতে থাকে রুবানের পিছনে।

রুবান প্রায় ভূতগ্রস্তের মতোন দৌড়ায়...


পম্পা বিশ্বাস

পাশের বাড়ির মাসিমা
পম্পা বিশ্বাস



পাশের বাড়ির মাসিমা ঠিক যেন মানুষ নন, মানুষের মতো কোনো এক প্রাণী! এই ভাবনাটা আমাকে বেশ কিছুদিন ধরেই জ্বালাচ্ছে। তাই তাঁকে আমি গোপনে খুবই নজর করি। একটু টানও যে তাঁর প্রতি অনুভব করি না, তা নয়। এই যেমন সেদিন ওঁকে কালিঘাটে নিয়ে যেতে হলো। উনি পুজো দেবেন। ফেরার পথে একটা বাসে উঠলাম। প্রচন্ড ভিড় বাসে। ভিড়ে আর গরমে মাসিমা ঘামছিলেন দরদর করে। ওনার ঘামে আমার পরনের জামা ভিজে যাচ্ছিল। বাড়ি ফিরে দেখলাম, মাসিমার ঘামে ভেজা আমার সাদা জামার জায়গাগুলো হালকা বাদামী হয়ে গেছে। বুঝলাম, মাসিমার ঘামের রঙ বাদামী। অনেক ধুয়েও সেই দাগ আমি তাড়াতে পারিনি।

এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরে, একগোছা নিমপাতা নিয়ে আমি ঢুকছিলাম মাসিমার বাড়ি। ঘরে এক-পা রেখেছি, হঠাৎ বাজ পড়ার মতো গর্জন। সেইসঙ্গে ঠকাস্‌ করে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ। দেখি, মেসোমশাই ক্রুদ্ধ বাঘের মতো গজরাচ্ছেন। একটা পেপারওয়েট ছিটকে পড়েছে মাটিতে। মাসিমা কপালে হাত দিয়ে স্লো-মোশানে পড়ে যাচ্ছেন। ওঁর কপাল থেকে ছিটকে লাল রক্ত বেরোচ্ছে। তাহলে নিশ্চয়ই মাসিমা মানুষ!... কিন্তু কী আশ্চর্য, মাসিমার গলা থেকে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না! ছুটে গেলাম আমি। তাঁকে তুলে কপালে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম। তিনি সস্নেহে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে আমার থুতনি উঁচু করে ধরে একটু হাসলেন। ঠিক করলাম, মাসিমা মানুষ কি মানুষ-নন, এই দ্বন্দ্ব দূর না হলে আমি আর ও বাড়ি যাব না।

তারপর অনেক দিন যাইনি আমি মাসিমার বাড়ি। কিন্তু একদিন মাসিমার ছেলেমেয়েরা আমাকে ডেকে পাঠালো। শুনলাম, এ-গলির যে ল্যাজনাড়া ঘেয়োটাকে উনি রোজ খেতে দিতেন, সেটা দু’দিন আগে বেপাড়ায় মারা গেছে। তারপর থেকে

উনি কিছুই খাচ্ছেন না। শুধুই কাঁদছেন। ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! মাসিমাকে তো কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি! গিয়ে দেখি, মাসিমার চোখ থেকে ছাইরঙা জলের স্রোত নেমে বুকের কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে। চোখের জলের এমন রঙ আগে কখনও দেখিনি। মাসিমার চোখ মোছাতে গিয়ে আমার হাতেও ছাই-ছাই তরল লেগে গেল। অনেক ধুয়েও সেই রঙ আমি তাড়াতে পারিনি।

তাহলে কি আমার ভাবনাই ঠিক, মাসিমা ঠিক যেন মানুষ নন, মানুষেরই মতো কোনো এক প্রাণী!

মেঘ অদিতি

বৃত্ত পেরিয়ে
মেঘ অদিতি



বিন্দু, বহুদূরে কালো হয়ে আসা একটা বিন্দুর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছি। চৈত্রের ঝাঁঝালো দুপুর। দু’চোখ পুড়ে যাচ্ছে তবু তাকিয়ে আছি। গ্রামের স্কুলগুলো কেমন যেন ফাঁকা মাঠের ওপর একলা দাঁড়িয়ে থাকে। ধারে কাছে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু দূরে দূরে ঘন সবুজেরা এ ওর হাত ধরে আছে, আর কিছু ঘরবাড়ি। মনে হয় আজন্ম একা থাকার জন্যই স্কুলগুলো যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে অথচ যতক্ষণ ক্লাস চলে ততক্ষণ এমনটা লাগে না। কেবল ছুটির পর কলরোল থেমে গেলে হঠাৎ এই নীরবতায় মনে হয়, স্কুলবাড়ি আর আমি দুজনেই যেন সমবয়সী, দুজনেরই যে না বলা কত কথা জমে আছে!

মাইলখানেক হাঁটাপথ পেরিয়ে তবে আমার আবাসন, স্কুল থেকে বেরোবার আগে রোজই রোদে চোখ সয়ে নিতে জানালার ধারটায় চেয়ার টেনে কিছুক্ষণ বসি। চুপচাপ তাকিয়ে থাকি শূন্য মাঠটার দিকে। আজও বসেছি কিন্তু দূরের সেই বিন্দু আমাকে কী যেন বলতে চাইছে, আর কী আশ্চর্য, কোথা থেকে একটানা ভেসে আসছে একটাই শব্দ - টুসু।

কোথা থেকে! টুসু নামের কাউকে কি আমি চিনি!

- কথা বলবে না?

বুকের খাঁচা সামান্য দুলে উঠে খুব ডানা ঝাপটে দিল সে অচিন পাখি। মোটেই আমি জেদি বা রাগি নই। কারো সাথে রাগ ধরে রাখার মতো ক্ষমতা বা কাউকে ধমকে দেবার সাহসও মোটে আমার নেই, তবু এখন পাখিটাকে জোর ধমকে দিলাম। খাঁচাটাও দোলা বন্ধ করে আবার একলা হয়ে গেল।

- টুসুউউউ...

বিপদসংকেতের মতো আবার ভেসে এল ডাক। কে ডাকে! টুসু কে? সে এক কিশোরীকে চিনতাম, এমন চৈত্রের দুপুরে বুকে বই নিয়ে আকাশের নীলে ভেসে যেত, সেই টুসু? সে তো কবেই হারিয়ে গেছে। আমি টুসু নই, তবে কেন চারপাশ মুখর হয়ে উঠছে একটাই নামে - টুসুউউউ! এ ডাকে চুপ করে থাকা অসম্ভব অথচ ওই খাঁচাটা, ওকে চেপেচুপে বন্ধ করে গহীন দেশে পাঠাতে গিয়ে ওই ডাকের উত্তরে কী বলা উচিত, ভাবতে পারছি না। ভেতরে অস্থির লাগে, তবু স্থির কন্ঠে বলে উঠি, কে ডাকছ টুসু বলে!

- মৌ!

আমার পাশ থেকে একটা ছায়া হঠাৎ সামান্য দুলে যায়। দূরের বিন্দুটা কখন যেন মিলিয়ে গেছে। পাশ থেকে একটা ছায়া সামান্য দুলে এবার ফেরাতে চাইছে তার দিকে। মিলিয়ে যাওয়া বিন্দু থেকে জ্বালা ধরা চোখ সরিয়ে ঘাড় ফেরাই। ছায়ার মতো তবে ঠিক ছায়া নয়, মানুষেরই আদল তবে ঠিক মানুষও সে না। রাহাত এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। ঘুরে তাকাতেই স্পষ্ট হয় দীর্ঘদিনের অদেখা রাহাত আর তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিব্রত হাসি। টুসু নয়, মৌকে ডাকছে সে। কিন্তু রাহাত এখানে কী করে এল?

আপাতত কোনো পাণ্ডুলিপি নেই আমার কাছে অথবা কথা চালাবার মতো কোনো নিয়মবদ্ধ রূপরেখাও নেই, তবে একটা স্থির সিদ্ধান্ত আছে। তাতে ভর করে বললাম, রাহাত! ভালো আছ? অনেকদিন আগের এলোমেলো মৌ অথবা তারও অনেক অনেক দিন আগে রূপকথার বইতে যেমন ছবি থাকে সেরকম টুসু যাকে সে কুড়ি বছর আগে ঘরে এনে ক্রমাগত টুসুকে ভেঙে মৌমিতার আদল দিতে গিয়ে তাকে ভেঙেচুরে ফেলেছিল, সে দুজনের কাউকেই দেখতে পেল না রাহাত। ওর ঠোঁট থেকে হাসিটা মুছে কেমন একটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠল।

- এদিকে কোনো কাজে এসেছিলে?

- না, তেমন কিছু নয়।

তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, কিছু খাবে? যদিও স্কুল তো ছুটি হয়ে গেছে।



রাহাত রুমাল বের করে আনল পকেট থেকে, পথের ক্লান্তি মুখ থেকে মুছতে মুছতে বলল, ঠিক আছে। কিছু দরকার নেই।

চারপাশটা আবার নীরব হয়ে উঠল। কিছুটা বাতাস যেন উবে গেল ঘর থেকে। দূরের যে বিন্দুটা মিলিয়ে গিয়েছিল সেখানে দেখা গেল দুই বেণী করা টুসুকে দাঁড়িয়ে থাকতে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে মৌমিতা। রাতভর কেঁদে ফুলে ওঠা চোখ নিয়ে বাসন মাজবে বলে সে ছাই তুলে নিচ্ছে হাতে। সব কাজ শেষ করে যে কলেজে যাবে আর ফিরে এসে মুখ বুজে কাজের ফাঁকে বইয়ের পাতা ওল্টাবে। টুসু মৌমিতাকে দুলে দুলে কোনো একটা গান শোনাচ্ছে আর মৌ ছাই হাতে টুসুকে আদর করছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন খুব মেঘ হলো, টুসু তখন নেই। একলা মৌমিতা তার উসকোখুসকো চুল সামলে রান্নার ফাঁকে খাতা খুলেছে। রাহাতকে তখনই হঠাৎ দেখা গেল মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে আর আর্তনাদে ভরে উঠল চারপাশ। চুলোর জ্বলন্ত কাঠ চেপে ধরেছে রাহাত মৌমিতার ডান হাতে...

বুকের ভেতর পাখিটা আবার ডানা ঝাপ্‌টে উঠছে। দূরের টুসু আর মৌ-এর বদলে দূরে আবার সেই বিন্দুটা। নিজের কাছে সরে আসতে আসতে জানতে চাইলাম, তবে কি আমার কাছেই এসেছে রাহাত? এতগুলো বছর পর এসে দাঁড়িয়েছে কি শুধু আমাকে একবার দেখে যেতে? দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের কু ঝিকঝিক আমাকে মাঝপথে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে দিল। যেন ওয়েটিং রুমের অপেক্ষায় ছিলাম, কখন ট্রেন আসবে। অপেক্ষার সে সময়টুকু জুড়ে চলছিল যেন কোনো সাদাকালো ছবি। রাহাতের দিকে ফিরে বললাম, আমাকে বেরোতে হবে। পিছনের ক্যানভাস জুড়ে নিখাদ কালো মেঘে মেঘে খোদাই করা রাহাতের হতভম্ব মুখ, বাইরে গনগনে রোদ। অচিন পাখিটা বুকের ভেতর তখন একটানা ডাকছে, টুসু... টুসু... টুসু...




শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৩

যশোধরা রায়চৌধুরী

একটি শরীরী গল্প
যশোধরা রায়চৌধুরী



ভদ্রলোকটি, ও মহিলাটি। শরীরী... খুবই শরীরী কারণেই ওদের দেখা সাক্ষাত। পেশাগত ভাবে মেয়েটি…

না, ভদ্রলোকের বগলে ব্রাউনপেপারে মুড়ে মদের বোতল বা পকেটে বেলফুলের মালা নেই। রেস্তরাঁয় সঙ্গিনীকে ড্রিংকসে ড্রাগস মুড়ে দিয়ে কাত করে ফেলাটাও অবাস্তব। এর পক্ষে। ভদ্রলোকটি, অকালে স্ট্রেসজনিত কারণে যার সুগার হয়ে গেছে, এবং টাক পড়ে গেছে, এবং ভুঁড়িটি নাদা থেকে চুপসাতে চুপসাতে এখন সেমি বাতাপিলেবু স্টাইল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক হিরো। এই মুহূর্তে।

ভদ্রমহিলাকে নিয়ে শরীরী চিন্তাগুলি কেন যেন থামতেই চাইছে না। উনি ঘামছেন, প্রোফিউজলি ঘামছেন, ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হবার আগের মুহূর্তে। দেখা হবার জায়গা একটাই। সেখানেই, যেখানে প্রথমবার দেখা। মহিলার কর্মস্থলে।

করিডোর। মহিলা মুখে পান ঠুসে বেরিয়ে এলেন কাচের দরজা ঠেলে। মরণ হয় না বুড়োর, টাইপস মুখ। বললেন, গজাননবাবু, আবার এসেছেন।

ইয়েস ম্যাডাম। আপনার জন্য একটা ছোট্ট ইয়ে...

আপনাকে তো অনেকবার বলেছি, এভাবে আমাকে মিসড কল দেবেন না। আমার হাজব্যান্ডের নজর খুব খারাপ। সব কল লিস্ট চেক করে আজকাল। ওর সন্দেহবাতিক আছে।

গজানন পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছলেন। স্বপ্নে এই মহিলাকে বহুবার আদর করেছেন। এখন পারবেন না।

অথচ এই করিডোর নীরব, অর্ধ অন্ধকার, শুনশান। পেছনে ভ্যাট রাখা তিন রঙের। তিনটিতে তিন রকমের বর্জ্য ফেলার নিয়ম, বিপজ্জনক বায়োডিগ্রেডেবেল যথা, অসুখ ঘটিত, শরীরাংশ সমেত, এমনি বায়োডিগ্রেডেবল, নন বায়োডিগ্রেডেবল ইত্যাদি...

একটা গোলাপ ফুলের মতো আকৃতির জিনিস বার করলেন তিনি একটা কালো, পাশ দুমড়ে যাওয়া, ফুলে উঠে ফেটে যাওয়া ফোলিও ব্যাগ থেকে। খোলার পর বোঝা গেল ওটা বেনারসি জর্দার প্যাকেট। তমসার জন্য।

তমসার মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটল। ‘যাঃ কী করছেন! এসব কেউ আনে? আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’

‘প্লিজ, প্লিজ, অ্যাক্সেপ্ট ইট। আপনি কেমন আছেন?’

‘আপনি কেমন আছেন? রিকাভারি ঠিকঠাক হয়েছে?’

‘ঈশ্বর রক্ষা করেছেন, ওই রিপোর্টটা, ইয়ে হয়েছে।’

‘বলেই ছিলাম আপনাকে! রুটিন বায়োপ্সি। কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। তাছাড়া পেলেই বা কী! আমাকে তো দেখছেন। যমেরও অরুচি।’

‘ছিঃ এভাবে কেন বলছেন?’

এদিক ওদিক দেখলেন গজানন। একবার হাতটা ছোঁবেন? ভর্তি ছিলেন আড়াই সপ্তাহ। তখনই ব্যাপারটা দানা বাঁধে।

একটা অঙ্গ বাদ যাবার পর শরীরে কী যেন নেই কী যেন নেই বোধ হয়। সারাদিন মন আনচান করে। তমসাদি বলেছিলেন, ‘বায়োপ্সিতে অঙ্গ গেলে মানুষের, বিশেষত মধ্যবয়সী পুরুষ মানুষের, অদ্ভুত ইনসিকিওরিটি হয়। আপনার যা হচ্ছে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই।’

গলা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘আমারও ব্রেস্ট ক্যানসারের একদম ফার্স্ট স্টেজে কাটা পড়েছে। এখন ভালো আছি। প্যাডেড ব্রা, সঙ্গে সাপ্লিমেন্ট।’

স্বপ্নে লজ্জাহীন দেখেন গজাদা। ফুলন্ত, ভরন্ত, পুরন্ত বুক; তমসা তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন।

এখন ঘামছিলেন। আড়চোখে ঐ তিনটে বর্জ্যর ভ্যাট দেখলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কোনো অস্বাভাবিক গ্রোথ বা ম্যালিগন্যান্সি পাওয়া যায়নি। এই ছোট্ট স্যাম্পল ছাড়া বাকি সব পরিত্যাগ করা হলো।

একটা অঙ্গ কি ওই ভ্যাটের মতোই কো্নো একটা ভ্যাটে চলে গেল?

সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। তমসার শরীর ভাবেন রাতে শুয়ে। পরিপূর্ণ নারীর শরীর, মাতৃত্বময়, পৃথুল, তাঁকে ঢেকে দিচ্ছে স্তনদুটি, শ্বাসরোধ করে ফেলছে।

গজানন চলে গেলে, হাতের জিনিসদুটো নিয়ে তমসা ভ্যাটগুলোর দিকে এগিয়ে যান। বুড়ো বয়সের চুলকুনির দোষ। যাকগে, প্রৌঢ় লোক, এমনিতে ভদ্র টদ্র। গায়ে তো আর হাত দিতে সাহস পায়নি! রাতে, কেবিনে ইঞ্জেকশন পুশ করতে করতে চোখে যেন জলও দেখেছিলেন দু’একবার। বেচারা!