কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১১৬ / একাদশ বর্ষ : ষষ্ঠ সংখ্যা




প্রয়াত হলেন সুবল দত্ত। গত ৩০শে জুলাই রোববার বিকেল পাঁচটায়। একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং চিত্রশিল্পী সুবল দত্ত যে খুব বেশিদিন আমাদের মাঝে থাকতে পারবেন না, আমরা যারা তাঁর নিকট সান্নিধ্যে ছিলাম, জানতাম। বছর কয়েক আগে তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়েছিল কলকাতায় বি এম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টারে। সার্জারির পর তিনি হার্টের সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে চিকিৎসাকালীন ধরা পড়ে তার থেকেও মারাত্মক আরও একটি সমস্যা, তাঁর প্রস্টেট গ্রন্থিতে ক্যানসার। শুরু হয় চিকিৎসা, প্রথমে জামশেদপুরে, তারপরে তামিলনাড়ুর ভেলোরে। তবে একেবারেই ভেঙে পড়েননি তিনি, বরং আরও দ্রততায় লিখে যেতে থাকেন অনেক অনেক লেখা। সেই লেখাগুলি প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। প্রকাশিত হয় কয়েকটি বই। এমনকি ভেলোরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বসেও মোবাইলে সমানে কম্পোজ করে গেছেন তাঁর নতুন লেখা। তিনি ছিলেন অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী। কিন্তু শরীরের ভেতরের ক্ষয় তাঁর শরীরকে ক্রমশই দুর্বল করে তুলছিল। শেষ পর্যন্ত অসম সেই লড়াইয়ে তাঁকে হেরে যেতেই হলো। আর সেই সঙ্গেই তিনি হারিয়ে গেলেন আমাদের নিকট সান্নিধ্য থেকে।

সুবল দত্ত সাহিত্যজীবনে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। না পাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ অনুমান করা যেতে পারে। প্রথমত তাঁর যাবতীয় লেখা ছিল পরীক্ষানিরীক্ষা মূলক। সাহিত্যের নতুন নতুন আঙ্গিক ও শৈলী তিনি অনুসন্ধান করতেন। সাহিত্যভাবনাতেও ছিল ভিন্নতর মনন ও মানসিকতা। বোধের অনেক গভীর থেকে উঠে আসত তাঁর  যাবতীয় সৃজন। তাঁর লেখালেখির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা উপলব্ধি করেছেন তাঁর চিন্তাভাবনার স্বাতন্ত্র্য। প্রচলিত মাত্রার বাইরে ছিল তাঁর পদচারণা ও খোঁজ। নিতান্ত সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে যা কিছুটা দুর্বোধ্য বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যখন তাঁর যাবতীয় লেখালেখির নিবিড় পাঠ ও মূল্যায়ন হবে, আমি নিশ্চিত, তিনি তখন বাংলাসাহিত্যের এক অনন্য সাহিত্যিক রূপে বিবেচিত হবেন এবং প্রাপ্য স্বীকৃতিও পাবেন। কিন্তু দুঃখ এটাই যে, তিনি তা কখনও অবহিত হবেন না, তাঁর অর্জন তিনি প্রত্যক্ষ করতে পারবেন না। তিনি আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। প্রায় নিয়মিত তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। আমার সম্পাদিত ‘কালিমাটি’ মুদ্রিত পত্রিকায় এবং ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রতিটি সংখ্যার জন্য লেখা পাঠাতেন। আর পাঠাবেন না। মনে মনে যে লেখাগুলি পাঠানোর কথা ভেবে রেখেছিলেন, তা চিরদিনের জন্য অলিখিতই থেকে গেল।

তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে জানাই আমার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।  

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

শিবাংশু দে

 

'আয় রে প্রাণের সুবল...'




বারো জুলাই ছিলো ওর জন্মদিন। ফোন করলুম একটু বেলায়। দু-চারবার রিং হবার পরেই ধরলো।

-হঁ রে, ফিরলি?

-না রে, পরের হপ্তায়...

-কোথায় আছিস এখন?

-এই হাসপাতালেই, ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বসে আছি।

-আবার কী বলছে ডাক্তার?

-বলছে আরেকবার একটা কেমো'র সাইকেল করতে।

-বলিস কী রে? আবার..?

-হঁ…

-তুই কী বললি?

-বললাম, মরে গেলেও আর কেমো করব না!

-হুমম, তবে কী করা যায়?

-এবার বাড়ি যাব। টিকিট হঁই গেছে।

তারপর যথারীতি নানা বিষয় নিয়ে কথা। প্রায় মিনিট চল্লিশ। শেষে ডাক্তারের ডাক আসতে কথা শেষ করতে হলো। আমি এখন কলকাতায় নেই। হায়দরাবাদে আছি। সুবলা জামশেদপুরে ফিরে এলেও দেখা হতে দেরি হবে। দিন হিসেব করে ফোন করলুম। রেবা ফোন ধরলো। খবর পেলুম সুবলা একেবারে শয্যাশায়ী। প্রচণ্ড যন্ত্রণা ভোগ করছে। কথা বলছে না। সাতদিন আগেই এতো কথা হলো। এতো দ্রুত এমন অবনতি? যদিও এই রোগে ব্যাপারটা ঠিক অপ্রত্যাশিত নয়।

সুবল দত্ত আমার বেশ কিছুদিনের বন্ধু। কিছুদিন, মানে ছেচল্লিশ বছর। ওকে চিনি সাতাত্তর সাল থেকে। আমি তখন কুড়ি, ও একুশ।  সেই বয়সে বাঙালিরা প্রথম দিন থেকেই তুই-তোকারি'তে উঠে যায়। এক্ষেত্রেও  ব্যতিক্রম হয়নি। সিংভূমে চলে মানভূমের প্রান্তিক বাঙালি ভাষা, নিয়মকানুন। এর মধ্যে অবশ্য 'জামশেদপুরি' কলচর বাদ যাবে। ওখানে ব্যাপারস্যাপার একটু কলকাত্তাই টাইপ। আমি যদিও আদতে কলকাত্তাই এবং চার পুরুষের 'জামশেদপুরি', তবু সিংভূম আমার জন্য মাটি-পাথর, বন-পাহাড়ের গ্রাম। মানভূমের নিয়ম অনুযায়ী সুবলের নামের শেষে আ-কার যোগ করে সম্বোধনের শুরুও তখন থেকেই। মানে, সুবলা। আমরা নিজেদের মধ্যে মানভূমিয়া ভাষাতেই কথাবার্তা বলতুম। সেই পুরাকালে  প্রথম চাকরি চাইবাসাতে। সিংভূমের 'রাজধানী'। তখনও আমার ভোটাধিকারের বয়স হয়নি। মানে পুরো একুশ। হয়নি। ভারতীয় স্টেট ব্যাংকে। সেখানে তার সঙ্গে দেখা। কারো কাছে খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছিলো। আমি  জামশেদপুর কোঅপারেটিভ কলেজ, সে চাইবাসার টাটা কলেজ। গায়ে পুরো দস্তুর কলেজের গন্ধ। সুবলার মাথায়  কোঁকড়া পপকর্ণ চুল, মোটা গোঁফ আর শ্যামলা চেহারা। মানবাজার থেকে আসা পাক্কা মানভূমিয়া। টাঁড়মাটির ছাপ সারা গায়ে। চরিত্রদোষ বলতে বাংলা সাহিত্যের প্রতি অকারণ বাতিক।  চাইবাসায় সে অর্থে  প্রথম বাংলা লিটল ম্যাগ 'উইঢিবি' নামক একটা কাগজটা প্রকাশ করে। নৈকষ্য 'বেকার'। শুরুটা এমনই ছিলো। তারপর সময়ের  বৃত্তে ঢুকে গেছে নানা প্লাবিত স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, ভালোবাসা, খিস্তি। ঢুকে গেছেন সন্তোষকুমার ঘোষ, সমীর  রায়চৌধুরী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি, সারান্ডা, কুচাই, খিচিং, লুপুংগুটু। চাপে পড়ে একটা ছোটো ইশকুলে 'বিজ্ঞান' পড়াতে ঢোকা। বেতন দিনে দু 'টাকা'। তবু বাঙালিরা তাকে 'চাকরি' বলে। আমার জীবনের প্রথম সৎকর্ম (জানি না শেষও  কি না? ) সুবলাকে রীতিমতো বলপ্রয়োগ করে তিন-চার মাস ধরে প্রতি সন্ধ্যায় ব্যাংকে চাকরি পাবার সুলুকসন্ধান শেখানো। যাকে বাংলায় 'কোচিন' বলে। এসব করে সে  এসবিআই'তে নাম লিখিয়েছিলো। কিছুদিন পরেই  ঝাইলদাতে বিহা।  এবং সিংভূম ছেড়ে  কয়লাকুঠির দেশে  অনিচ্ছার নির্বাসন। সারাজীবন ধানবাদ আর বোকারো নামক দুটি আধা গ্রামে মাথা ঠুকে কাটিয়ে দিলো। জায়গা বদল করতে অদ্ভুত অনীহা তার। বলি, আমাকে দেখ। এই চাকরি নিয়ে সারা দেশ ঘুরেছি। ভারতবর্ষকে চিনেছি। তোর জন্য ভালো পোস্টিং-এর ব্যবস্থা করে দেবো আমি। খুব ভালো থাকবি। দুনিয়াটা একটু বেরিয়ে দেখ। কাকস্য পরিবেদনা!

অবসরের পর জামশেদপুর। তবে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে। কারণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলুম আমিও ফিরে আসবো। আমার গ্রামে। সেখানে থাকবো। নয়তো ওই শহরে সে অর্থে 'নিজের' বলতে সুবলার কেউ নেই।  আমার জামশেদপুর ফেরা হলো না। সেজন্য প্রচুর গালাগালি খেলুম ওর কাছে। শেষে ঠিক হলো সুবলাই কলকাতা চলে আসবে। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক দূর এগোনো হয়েছিলো। তাও হলো না। অসুস্থ হয়ে পড়লো। কয়েকটা বই ছাপানোর আগে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে ছিলো। আমার 'মতামত'-এর জন্য। কিন্তু এভাবে হয় না। ওর ভাবনার জগৎ , ক্র্যাফ্ট, আমার সঙ্গে মেলে না। বললুম, তোর ফিজিক্স-মেটাফিজিক্সের টানাপোড়েন, গদ্যনির্মাণ, ক্রিয়াপদ ব্যবহার, স্পেস, পজ, রিদম কিছুই মিলবে না আমার সঙ্গে। শুধুমুদু দ্বিধায় পড়ে যাবি। তুই নিজের আনন্দে লেখ। তার মধ্যে আমি নাক গলাতে চাই না। ভুল বোঝেনি। জানতুম।

ছেচল্লিশ বছর আগে যখন তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো, তখন থেকেই আমার মনে হয়েছে সুবলার গল্পটা ইউনিক। একটা টিভি সোপ অপেরা হয়ে যেতে পারে। কোষ বিবর্তনের সন্ধান যাঁরা করেন, তাঁরা জানেন সেল মিউটেশনের থিওরি দিয়ে ওর মানসিক বিবর্তনটি বোঝা যেতে পারে। এক পুরুষের মধ্যে ওর পূর্বপুরুষদের থেকে নিজেকে কীভাবে আলাদা করেছিলো, সেটা নিঃসন্দেহে মনজাগানি। কোনও রকম পারিবারিক উত্তরাধিকার ব্যতিরেকে ছবি আঁকে, মূর্তি গড়ে, গান গায়, কবিতা লেখে, তুখোড় গদ্যকার, সঙ্গে প্রশ্নহীন গুরুবাদী। জিরাফ ও ধর্ম নিয়ে লোফালুফি করে আরাম পায়। অন্তত পেতো। কোনও এক সময়। মাস তিন-চার আগে ফোন করেছি একদিন সন্ধেবেলা। খুব কষ্ট পাচ্ছে তখন। বলি, হ্যাঁরে তোর ভগবান আর গুরুদেবকে একবার জিগ্যেস করিস, তোর অপরাধটা কী? খবরদার, গীতার কচকচি আওড়াস না আমার কাছে। রক্তমাংসের এই সামান্য শরীরটাকে যে এতো যন্ত্রণা দেয়, সে আবার সর্বশক্তিমান?? গোবিন্দ দাস পড়েছিস তো? এরা সব চিতায় মঠ দেবার দেবতা। সে বলে, জানি। ওসব একেবারে ভাঁওতাবাজি। তুইই ঠিক বলতি। আমি দেরিতে বুঝলম।  একটা অদ্ভুত সারল্য ছিলো ওর মধ্যে। টাকা ধার নেওয়া লোকজন উল্টে ওকেই চোখ রাঙাতো। অথবা উজবুক 'লেখক' জনতা। যাদের নিজেদেরই কোনও আক্কেল নেই, সুবলাকে এগিয়ে এসে জ্ঞান দিতো। কলকেতা শহরে লেখালেখির দুনিয়ার নামী লোকজনের সঙ্গে বাজে অভিজ্ঞতা হলে বলতো। আমার কানে এলে  খুব খারাপ লাগতো। এইসব দুনিয়া আমি খুব চিনি। নিস্পৃহ থাকার জন্য তাকেই বকাবকি করতুম। আমার বকুনি শুনে গোঁফের ফাঁকে তৃপ্তির হাসি ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখিনি কখনও। একবার বোকারোতে ওর বাড়িতে যথারীতি আমার বকুনি বেশ তারিয়ে তারিয়ে  ‘উপভোগ’ করছিলো। ওর মেয়ে, আমাদের আদরের পুঁচকে মামনি, আমায় এসে বকে দেয়। আমার বাবাকে এতো বকবে না তুমি।

আমার  কলকাতায় আসার পর অন্য একটা শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য সুবলা মাঝে মাঝে  আসতো এখানে। আমার বাড়িতেও থেকেছে। ভেবেছিলো আমার পাশেই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে কলকাতায় এসে থাকবে। টাকা আগামও দিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু হলো না। ২০১৮-র ঘোর গ্রীষ্মে সুবলা হঠাৎ জানালো বি এম বিড়লাতে ভর্তি হয়েছে। বাইপাস হবে। সেসব হলো কলকাতায়। এক-দেড়মাস ধরে নানা টানাপোড়েন। সেই সময়টায় দেখা হচ্ছিলো নিয়মিত। একটু ভালো হয়ে ফিরে গেলো জামশেদপুর। মাস দেড়েক পরেই ফোন এলো তার। নিস্পৃহ অনাসক্ত কণ্ঠে জানালো তাকে ইমার্জেন্সি অবস্থায় ভেলোরে আসতে হয়েছে। ডাক্তার বলছেন তার বাজে রকম 'কর্কট' রোগ হয়েছে। চিকিৎসকের বিভ্রান্তিজনিত কারণে বেশ ছড়িয়েও গেছে। তখনও বুকের অপারেশনের ঘা-গুলো হয়তো ঠিকঠাক শুকায়ওনি। এই খবরটা কীভাবে নেবো, ভাবতে সময় গেলো  বেশ কিছুটা। নিরুপায় মানুষ যেমন ভাবে। তাদের  মনে হয়, এসব কী হচ্ছে?

কেমোর প্রথম সাইকেল চলছিলো তখন। আঠেরোর ডিসেম্বরে আমার ছোটো মেয়ের  বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।  আসতে পারবে না সেই দুঃখে  সুবলা ফোনেই  কাতর হতাশা জানাচ্ছে। আমি বকাবকি করি। আগে ভালো হয়ে ওঠ। গুরু বলেছেন, 'সত্য যে কঠিন' এবং তাকে ভালোবাসতে হবে। কীভাবে বাসা যায়, তার মেড ইজি তিনি কিছু বলে দিয়ে জাননি। টানা সাতমাস ধরে অসম্ভব একটা যুদ্ধ দিলো সুবলা আর রেবা। অসম লড়াই। কিন্তু ওদের তেজ তাতে কম হয়নি একেবারে। কী ধরনের অসহনীয় শরীরকষ্ট, যাঁরা জানেন তাঁরাই জানেন। ল্যাপটপ সঙ্গে নেই।  মোবাইল ফোনে বড়ো বড়ো লেখা প্রতিশ্রুতি মতো পত্রিকার সম্পাদকদের পাঠিয়ে গিয়েছে ঐ অবস্থায়। অবশেষে বাড়ি ফিরে এলো। এর মধ্যে বিদেশে ছেলের বাড়িও ঘুরেটুরে এলো দুবার। কিন্তু আরোগ্য হলো না। সামলে নিতে চাইছিলো নিজস্ব যাপন, যথাসাধ্য। ভেলোর থেকে মাঝে মাঝে ফোন করে বলছে, বড্ডো কষ্ট রে! আমি ওকে পূর্ণদাস বাউলের লিংক পাঠাই,  'শোনরে  প্রাণের সুবল, হেরি ঐ নয়নযুগল, চল আজ যমুনা পুলিনে যাই।'

দু হাজার ঊনিশে জুন মাসে হঠাৎ দিন দুয়েকের জন্য জামশেদপুর যাওয়া হলো।  সুবলার সঙ্গে দেখা হওয়াটা জরুরি। মারণ রোগের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় যুদ্ধজয়ের পর তাকে অভিনন্দন জানানোটা ঠিক 'কর্তব্য' নয়। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ বলাটাই বিধেয়। ওর বাড়ি যাওয়া হয়নি। কদমাতেই একটা অনুষ্ঠানে দেখা হলো। স্বয়ং ডন এবং তার সাংকো পাঞ্জা রেবার সঙ্গে। স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোলা মাঠে আড্ডা হলো কতক্ষণ।  জামশেদপুরে শ্বাসরোধী গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায়। যতক্ষণ না তার শারীর ক্লান্তি ছাপিয়ে যায় মানসিক  আবেগের জলস্তর।

মাঝখানে ফোন করলো। কোনও এক সাহিত্যকর্মী বন্ধু নাকি উদ্যোগ নিয়েছেন তাকে নিয়ে একটা স্মারক সংকলন প্রকাশ করবেন। বলি, অতি উত্তম সংবাদ। তখন বলে, তুই একটা লেখা দিবি? নিশ্চয়ই দেবো। তবে লেখাটার মধ্যে ব্যক্তিগত সন্দর্ভ থাকবে। তোকেই পাঠাবো। দেখে নিস। তা লেখা পড়ে সে উচ্ছ্বসিত। কিছুদিন আগে ভেলোরেই ওকে  জিগ্যেস করলুম, হ্যাঁরে বইটা প্রকাশিত হয়েছে? বললো, তৈরি হচ্ছে। বেরোবে। জানি না, সেই বই সুবলা দেখে যেতে পেরেছে কি না।

ওর সঙ্গে শেষ আড্ডাটা জুলাইয়ের বারো তারিখেই। ‘শুভ জন্মদিন’ বলার জন্য ফোন করেছিলুম। শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কথাবার্তা হবার সময় আমি বললুম তুই কেন ইমিউনিটি বাড়াবার জন্য নিউক্লিয়ার চিকিৎসাটা করতে গেলি? এক একবার ছুঁচ নিতে সাড়ে তিন লাখ খরচ। তারপর তিনদিন তেজস্ক্রিয় বালক সেজে লোকজনের থেকে দূরে দূরে থাকা। 'মানুষ' থেকে গিনিপিগ হয়ে যাওয়া। সুবলা বলে, ঠিক বলেছিস। দুবার ঐ তেজস্ক্রিয় ছুঁচ খাওয়া একেবারে হিতে বিপরীত হয়ে গেলো। বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। শোন মজার গল্প একটা। বুঝলি, ডাক্তার আমাকে নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন, আইসোটোপ, হাফ লাইফ নিয়ে বেশ লেকচার দিচ্ছিলো। আমিও চুপচাপ শুনছি। হঠাৎ এমন একটা কথা বললো যেটা ফিজিক্সে নেই। আমি শুধরে দিতেই বলছে 'বাবা, আপকো ক্যয়সে পতা?' আমি বলি, তুই কি বলে দিলি? ফিজিক্স ব্যাপারটা ডাক্তারের থেকে বেশি বুঝিস? বলে, না রে। এমনিতেই ইংরেজি বলছিলাম দেখে ডাক্তার একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলো।  আরও একটা রগড়ের গপ্পো শোন। ইন্সিওরেন্সের ফর্ম যখন ভরছিলাম, কাউন্টারের মেয়েটা আমাকে শিখিয়ে দিলো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বরটা কীভাবে ভরতে হয়। লম্বা নম্বর তো। আমি বলি, দাড়িটা কেটেছিস, না ওরকমই বাবাজি সেজে রয়েছিস। নারে, কাটা হয়নি। এবার বাড়ি গিয়ে কাটবো। বলি, সে জন্যই তোকে গাঁয়ের বাবাজি ঠাউরেছে ওরা।  চাইবাসার জয়দেব দত্তের কথা ওঠে। অমন বাবাজির মেক আপ নিয়ে তাজ হোটেলে কর্পোরেট শেয়ারহোল্ডার্স এজিএমে ঢুকতে গেলে দ্বারপাল যেভাবে আটকে দিয়েছিলো ওঁকে। খুব খোশমেজাজে ছিলো সুবলা ওই দিন। বললুম, তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা। একবার তুই আর আমি চাইবাসায় অশোকদার সঙ্গে দেখা করতে যাবো। আবার আড্ডা হবে অনেকক্ষণ। যেমন হতো এককালে। ঘন্টার পর ঘন্টা।

রেবার কাছে শুনলুম আমার সঙ্গে কথা হবার দু-চার ঘন্টার মধ্যেই  নাকি অসম্ভব শরীর কষ্টে এলিয়ে পড়েছিলো। ওর জন্মদিনেই। কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলো। ভাবি, মানুষের জীবনটাই এরকম। পর মুহূর্তটি কোন ইত্তিলা  নিয়ে আসবে, কে জানে?

অভ্যেস বশে রোজ ফোন করি। রেবা'কে, মামনি'কে। কোনদিন ওরা ধরতে পারে। কোনওদিন পারে না। নতুন খবর তো আর কিছু নেই। তিরিশ তারিখে সাঁঝের দিকে মামনির ফোন। খুব কাঁদছে। কাকু, বাবা চলে গেলো। হয়তো মনে মনে চাইছিলুম সুবলা মুক্তি পাক এই অবর্ণনীয় শরীর কষ্ট থেকে। হয়তো সেটাও পুরো সত্য নয়। ছেচল্লিশ বছর ধরে তৈরি হওয়া একটা অতি জীবন্ত সম্পর্ক হঠাৎ 'নেই' হয়ে গেলে নিজস্ব ঐহিক সত্ত্বাটিও খান খান হয়ে যায়। আমরা পরস্পরের অনেক গোপন কথা জানি। 'বন্ধু' হয়ে থাকার মূল্যটি শতকরা একশো ভাগ মিটিয়ে দিতে আমাদের কোনও দ্বিধা ছিলো না।

এই লেখাটি যখন লিখছি, মামনি ফোন করলো। কাকু, ওরা বাবাকে নিয়ে গেলো। মা বলছে, কাকুকে খবরটা দিয়ে দে। আমাদের শহরে মানুষের গঙ্গালাভ হয় না। সুবর্ণরেখা-লাভ হয়। সুবলারও তাই হলো। ও'তো এসব ব্যাপার বিশ্বাস করতো। তাই আর বকবো না ওকে।

চার বছর দেখা হয়নি। কোভিড ইত্যাদির চক্করে আমার জামশেদপুর যাওয়া হয়নি। একবার যখন গেলুম, তখন সুবলা ভেলোরে। শেষবার যখন দেখা হয়েছিলো তার কথা লিখেছিলুম ফেবু'তে একটা পোস্টে। সেটা পড়ে সুবলা লিখলো,

'তুই এতো লম্বা চৌড়া, আমার বহুদিনের বাসনা তোকে জড়িয়ে ধরি, কিন্তু কুন্ঠিত। পারিনি। এখন অদৃশ্য আমার কৃষ্ণ সখাকে তাই করলাম।'

সবই মনে থাকবে রে সুবলা। তুই খুব ভালো থাকিস...


তমাল রায়

 

বিস্মরণের বিরুদ্ধে স্মৃতি-সত্তার লড়াই : দাহ-প্রদাহ / সুবল দত্ত

 


"The struggle of man against power is the struggle of memory against forgetting" (ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের

সংগ্রাম আসলে বিস্মরণের বিপক্ষে স্মৃতির লড়াই - মিলান কুন্দেরা)

মানবাজার, চাইবাসা, রাঁচি, ধানবাদ, বোকারো, টাটানগর। এতদ অঞ্চল বাংলা ও ঝাড়খণ্ড সীমান্ত অঞ্চল, মানভূম অঞ্চল বলেই একসময় খ্যাত ছিল। বর্তমান নিবন্ধের বিষয় যে মানুষটির সাহিত্যকর্ম, শ্রীসুবল দত্ত কবি, কথাসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, ভাস্কর সুবল দত্ত; তাঁর জন্ম, শিক্ষা-দীক্ষা, বড় হওয়া থেকে বুড়ো হওয়া এই অঞ্চল সীমানার মধ্যেই। স্বাভাবিক ভাবেই এই সৃজনশীল মানুষটির গল্পের বীজতলা যে এই প্রান্তিক অঞ্চলের মানব-মানবী ও তাদের মানুষী-না-মানুষী-অতিমানুষী যাপন-বিচিত্রাই হয়ে হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য।

বলতে দ্বিধা নেই যে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের পেটরোগা নরম সরম ভাত-মাছের ঝোলের নাদুসনুদুস পাঠকের কাছে সুবল দত্তর লেখা বদহজমের ট্যাবলেট। কারণ সুবল দত্তর আখ্যানের অনেকটাই জুড়ে রয়েছে রুখুসুখু, ৪৪-৪৬ ডিগ্রি উষ্ণতার প্রান্তিক ভুখা-নাঙ্গা আদিবাসী ঊন-মানুষদের গল্প। যা অববাহিকাময় রাজধানী শহরের পাঠকের কষ্ট কল্পনাতেও ছোঁয়া প্রায় অসম্ভব। আর ঠিক সেখান থেকেই 'দাহ-প্রদাহ' পড়তে বসে ধাক্কা আর ধাক্কায় প্রায় চিৎপাত হবার দাখিল।

'দাহ প্রদাহ' বইটি চারটি আখ্যান খণ্ডের সমষ্টি। এক একটি খণ্ড আখ্যানগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী  চিহ্নিত করা যাবে তা ঠিক নয়। সম্ভবত সময়কালের ভিত্তিতেই নির্মিত এক একটি গল্প সমষ্টি। দাহ ১। দাহ ২। দাহ ৩। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভাষাগতভাবে অনগ্রসর মানুষের এই পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত সমাজে প্রতিনিয়ত দহন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তো যেতে হয়। তাই সুচিন্তিত ভাবেই এক একটি আখ্যান খণ্ড চিহ্নিত হয়েছে দাহ শিরোনামেই। অথবা মনুষ্য জীবনের নিরিখেও যদি ভাবা যায়, তবে শৈশব ব্যতিরেক অবশিষ্ট যা - যৌবন, প্রৌঢ় বা তারও পর যে জীবন তা এক অবিরাম দহন প্রক্রিয়ারই তো অংশ। কেবল অন্তিম পর্যায়, মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান, কেবল তাই হয়ত কল্পিত প্রদাহ। হয়ত এ ভাবেই শ্রেণী বিন্যস্ত।

পেশায় ব্যাঙ্কার লেখক সুবল দত্ত, নিজে মধ্যবিত্ত তুলনামূলক সুখী জীবনের শরিক হলেও, তাঁর বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকা হত দরিদ্র প্রান্তিক সহনাগরিকদের দুঃখ কষ্ট, রীতিনীতিগুলি অনুপুঙ্খ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে কিন্তু অপারগ হননি। এখানেই লেখকের কালি কলমের সার্থকতা। আবার একই সাথে তার জীবনের বহু বিচিত্র শখ ও ভ্রাম্যমান জীবনের অভিজ্ঞতার রসে বিচিত্র বিষয়ে গল্পগুলি সাজিয়েছেন। সম্পূর্ণ বইটি, দাহ-প্রদাহ তাই সুপ্রাচীন গৌরবান্বিত ভারতীয় বহুত্ববাদেরই যেন এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। যা দরিদ্র অথচ ঐতিহ্যবাহী এবং নিরীক্ষণধর্মী হওয়ায় অবশ্যই আধুনিক।

নীচে প্রতিটি খণ্ড থেকেই প্রতিনিধিত্বমূলক গল্পগুলির সামান্য নির্যাস রাখা হল বর্তমান নিবন্ধটির পাঠকদের জন্য।

দাহ-১

পাইটক্যা। এমন পেশা কি সত্যি আছে? পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম আছে। পাইটক্যারি একটা পেশা। যে পেশায় যুক্ত মানুষরা আশপাশের অঞ্চলের কেউ মারা গেলে ঠিক টের পায়। আর মৃতের বাড়ির কেউ ডাকুক বা না ডাকুক, তারা ঠিক পৌঁছে যায় মরহারাদের বাড়ি। আর তারপর মৃতের আত্মীয় পরিজনরা চাক বা না চাক তারা বলতে শুরু করে মৃতের জীবনের সব গোপন কথা। তাতে কখনও শোকগ্রস্ত পরিজন ক্রুদ্ধ হয় অথবা আরও বেশি শোকার্ত, তাতে পাইক্যাদের কিছু যায় আসে না। তারা কেবল সত্য বলতে স্ব-নিযুক্ত। বদলে মৃতের বাড়ি থেকে হয়ত চাল ডাল অল্প কিছু টাকা পয়সা দেয়। আর ভয় ভক্তিতে কেউ কেউ হয়ত পাইটক্যাদের থেকে শেকড় বাকড় মাদুলি চায়। বদলে জোটে আরও কিছু জীবিকা নির্বাহের রসদ। তাদের নিজেদের কোনো রেট নেই। সত্য বলাই যে তাদের পেশা। এ অনেকটা সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধকের মতই ব্যাপার। তা এহেন মদন পাইটক্যা হল সুবল দত্তের 'পাইটক্যা' গল্পের নায়ক। সেও বাপের সাথে ঘুরতে ঘুরতে একদিন কবে যেন নিজেই পাইটক্যা হয়ে যায়। মদন কেমন যেন নিশিতে পাওয়া মানুষের মত মাঝরাতে আচম্বিত স্বপ্নের ডাক পেয়ে বেরিয়ে পড়ে মৃতের বাড়ি। বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়খণ্ডের বিবিধ আদিবাসী অঞ্চল হল তার কর্মস্থল। ঘোর লাগা কথা বলে, রাতের জঙ্গল মহলের সে একজন প্রেমিক। মদনের সাথে আমরা শহুরে পাঠকও রাতের প্রকৃতি দেখতে দেখতে পথ চলি, আর বিশ্বাস - অবিশ্বাসের সীমানায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করি, কখন যেন আমরাও পাইটক্যা। অদ্ভুত!

'পরিত্রাণ'। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। বিধবা কুঁজি বুড়ি বৃন্দার ঘরবাড়ি সবই ছিল। স্বামী গত হবার পর দুই সন্তান তাদের কলহ রুগ্ন বৃদ্ধা মাকে বাড়ি ছাড়া করেছে। বুড়ির আর তেমন কিছুই নেই, স্মৃতিটুকু ছাড়া। বৃন্দাবুড়ির কেবল তার সোয়ামির কথা মনে পড়ে। এমনই এক মফস্বল শহরের ভোররাতে, বৃন্দাবুড়ি চলেছে তার সোয়ামির ভুতের সন্ধানে, সাথে আর ত্রিশের কুব্জি যুবতী কুবলি। কুবলি কুঁজো হলে কি হবে,   বয়সের ধর্মে তার স্বাভাবিক ভাবেই প্রেম আছে, আছে নাগর কালাচাঁদের অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখাও। যেতে যেতে দুই বিকৃত শরীরি অসমবয়স্কার ছেঁড়া ছেঁড়া কথোপকথন চলছে, পথ আগলে বসে আছে, আর এক তৃতীয় প্রাণ যে আসলে স্ট্রীটডগ। তিন জনের গন্তব্য এক মফস্বলের স্টেশন। এখানে স্টেশন কি আর শুধুই স্টেশন? নাকি জংশন? যেমন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের চন্দনেশ্বরের মাচানতলার সেই মাঠ, যেখানে সাধারণ অতি সাধারণদের জীবনেও হবে অলৌকিক উপলব্ধি, এও কি তেমন নয়? পড়তে পড়তে এই ফ্রেমটা দেখতে একটু দূরে সরে গেছিলাম খানিক বাধ্য হয়েই। প্যানোরেমিক ভিউটা জরুরি ছিল। দুজন সর্বহারা নারী, দুজনেই কুব্জ। একজন বয়সজনিত কারণে, অপরজনের বিকৃতি নিয়েই জন্মগ্রহণ আর একটি কুকুর, এ কি মহাপ্রস্থানের ইঙ্গিতবাহী কিছু? একটা স্টেশন / জংশন... আর টপ শটে... কুকুরের পায়ে বৃদ্ধার প্রণাম, যুবতীর মাথা রাখা এক মাঝবয়সীর কোলে... আর তারপর?

রোলা বার্তের কথায় লেখার পর লেখকের মৃত্যু হয়, বেঁচে থাকে কেবল লেখক। সুবল দত্ত কি জানেন, তিনি জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে কি লিখে ফেলেছেন? স্তম্ভিত হই।

শেষ ঝাঁপান। ভবা গুণিন, হেমা বেবুশ্যে আর ভবার নাগিন(সাপ) প্রেমিকার ত্রিকোণ প্রেমের এক অদ্ভুত গল্প। সে এক প্রান্তিক অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প। যেখানে রথের দিনের বিবিধ আচার আচরণের সাথে কবে জড়িয়ে গেছিল সাপ আর সাপুড়েদের খেলাধুলা ওই রথকে কেন্দ্র করেই। রথের রশি চিরকালীন মানুষী রিপু দমনের উদ্যোগে নির্মিত এক মিথ, হয়ত সে মিথের সাথে কবেই জড়িয়ে গেছিল সর্পতে রজ্জু ভ্রম। তাই রথোৎসবকে কেন্দ্র করে কাম, কামিনী কাঞ্চন আর প্রেম, ক্রোধ ও আতিশয্যে কখন যেন দুই নারীর হত্যালীলাও সংঘটিত হয়। ক্লাইম্যাক্স এন্টিক্লাইম্যাক্স আর চিরায়ত দর্শনের এমন ধারা টানাপোড়েনের গল্প কি আমরা সতীনাথ ভাদুড়ি ছাড়া আগে পড়েছি?

দাহ-২

গল্প সংকলনের দ্বিতীয় ভাগের পরিত্রাণ ছাড়া বাকি গল্পগুলি, যেমন সবুজ মেঘ, অন্ধকারে উষ্ণ অবসাদ বা অস্থিরতা তুলনামূলক বিত্তবানদের গল্প। যেখানে যৌনতা - সুস্থ বা বিকৃত, নাগরিক জীবনের সম্পর্কের জটিলতা এবং সমাজ ব্যধির দূরতর স্পর্শে মানসিক ব্যধি যেখানে পরিস্ফুট হয় লেখকের কলমে নির্দ্বিধায়, প্রাণ পায় এবং নিশ্চির রূপেই বলা যায়, মনোরৈখিক এই বিকলন আসলে, একটা ত্রাসেরও জন্ম দেয়, যা বুঝতে সাহায্য করে, লেখাগুলো সার্থক হবার চেষ্টায় উদ্যমী। একমাত্র অন্ধ আলো গল্পটি এই পর্বের কিছুটা ব্যতিক্রম, কারণ এটিও বিত্তহীনদের গল্প। যদিচ গল্পের প্রেক্ষাপট এমনই অদ্ভুত, যে মীনা ও শিবলাল চরিত্রদ্বয় প্রান্তের প্রতিনিধি হয়েও গল্পের ট্রিটমেন্টেই তা হয়ে ওঠে পৃথক।

দাহ-৩

আগুনে মৃত্যু বিদায় জলে। বটুক আর অনিমেষ। অনিমেষের কথা,বটুকের কথা। ভবিষ্যৎ দর্শন ও নিয়তিবাদ। স্ট্রাকচারালি উপন্যাসধর্মী গল্প। শান্ত, স্থিতধী চলন অথচ একেবারেই অচেনা প্রকরণে মুগ্ধতার ছাপ রেখে যায়।

প্রদাহ

'অরঘ' অর্থাৎ অর্ঘ্য। মূল চরিত্র দিন আনি দিন খাই সুবাস মণ্ডল, বাঙালি হতদরিদ্র শ্রমিক। প্রতিহিংসাপরায়ণ মালিক সুবাসের জমি বাড়ি কেড়ে নেওয়ায়, অসহায় সুবাস আত্মহননের প্রবৃত্ত হয়, সাথে তার পরিবারের বাকিরাও... নিয়তি ঠাকরুণের কৃপায় বেঁচে যায় কেবল সুবাস, বাকিরা অবশ্য বাঁচেনি। এ হেন সুবাসের সাথে পুনর্বার তার অত্যাচারী মালিকের আবার এক কনট্রাকটরের মাধ্যমে অন্য কনস্ট্রাকশন সাইটে দেখা। সেটা আবার এক তীর্থস্থানও। এবার পোয়েটিক জাস্টিস। মালিক ফের অপরাধের নীল নকশা প্রস্তুতের আগেই সুবাসের মধ্যে জেগে ওঠে তার প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ স্পৃহা। শেক্সপিয়ারের ক্ল্যাসিক উপন্যাসের মতই এ গল্পের সাদা কালো বোধ চেতনা। যা মুগ্ধতার আমেজ রেখে যায়।

'পরা অনুভূতি'- গল্পে মূল আখ্যান  বিস্তার নেয় গল্পের কথক, তার ছেলেবেলার বন্ধু মাগরাম নামের এক আদিবাসী বন্ধুর শৈশবে বলা নাককাটি বুড়িকে নিয়ে। গল্পে এমন কিছু অদ্ভুত অকল্পনীয় দৃশ্য কল্প আছে যা রূপকার্থেও অনায়াস ব্যবহার করাই যায়। গল্পের শেষে অবশ্য কথককে হাসপাতালের বেডেই দেখা যায়, মানে সম্পূর্ণ গল্পটি আসলেই এক স্বপ্নদৃশ্য। যেমন কোলরিজের 'কুবলা খাঁ'।

'মহাদর্শন' - কামাখ্যা সম্মন্ধে যারা গেছেন, অথবা যারা মিথ নিয়ে আগ্রহী তারা জানেন, অম্বুবাচির তিন দিন দেবীর রজস্বলা হয়ে ওঠার দিন। সম্ভবত সনাতনী ধর্মের একমাত্র পীঠস্থান কামাখ্যা যেখানে রজস্বলা হওয়াকে অপবিত্র জ্ঞান করা হয় না। সেই কামাখ্যায় পুজো দিতে যাওয়া তিন নারীকে নিয়ে আখ্যান সম্প্রসারিত হয়েছে। যে আখ্যানে অতি সাধারণ তিন নারী আবহমান সনাতনী প্রথা পশুবলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এবং মন্দির প্রাঙ্গনেই রজস্বলা হন তিনজনের একজন। মিথ, রিয়েলিটি, সমাজতত্ত্বের মিশ্রণে আবহমান চেতনাকে ধাক্কা দেবার গল্পটি কিন্তু সরসভাবে লেখা। বাংলা কথাসাহিত্যে এ এক অতি বিরল উদাহরণ।

‘প্যান্ডোরার কৌটো’ - আঞ্চলিক ইতিহাসের সাথে সেকালের এক ভাইরাল রোগ গুটি বসন্তকে ও হাল আমলের মারিকাল কোভিড ১৯কে এক সূত্রে গেঁথেছেন লেখক। গল্পের প্রধান চরিত্র ভাইরোলজি গবেষক মোহন সিংকে। যা লেখকের নিরীক্ষামূলক প্রচেষ্টার আর এক সফল উদাহরণ।

শুরু করেছিলাম সম্প্রতি প্রয়াত বিশ্বখ্যাত চিন্তাবিদ ও লেখক মিলান কুন্দেরার উক্তি দিয়ে। সমাপ্তিতে সে কথাতেই আবার ফিরতে হবে। কবি, চিত্রকর, ভাস্কর আদ্যন্ত শিল্পী মনের সৃজনশীল লেখক সুবল দত্তের  অধিকাংশ গল্প, তাঁর পরিপার্শ্বের নিরন্ন, প্রান্তিক অথচ ভারতীয় আদি অকৃত্রিম বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সংগ্রামী বাহকদের গল্প। যাদের এই লড়াইয়ের আখ্যানগুলিও কি করে যেন ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম, আসলে বিস্মরণের বিপক্ষে স্মৃতির লড়াই-এর সাবস্ট্যান্সটুকু নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।

নিবন্ধটি যখন শেষ করছি, সে মুহূর্তে বইটির লেখক সুবল দত্ত চিতার বহ্নিমান আগুনে দাহ-প্রদাহর পথেই  অস্থি থেকে ব্যোমে বিলীন...

প্রণাম।

 


গৌরাঙ্গ মোহান্ত

 

তানিকাওয়া শুনতারোর কবিতা : সবুজ পত্রালির মর্মর ধ্বনি




পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মিত্রশক্তির কাছে অধীনতা স্বীকারের সময় থেকে এপ্রিল ১৯৫২ পর্যন্ত জাপান অধিকৃত থাকে। আর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দেই প্রকাশিত হয় তানিকাওয়া শুনতারোর প্রথম কাব্য Two Billion  Light-Years of Solitude; যুদ্ধোত্তর প্রজন্মের কবি উপলব্ধি করেছিলেন যুদ্ধভস্ম থেকে পুনর্জীবিত সমাজের সংকট ও প্রত্যাশার রূপকল্পিত বয়ান প্রথাগত হাইকু চর্চার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।কুয়াবারা তাকিয়ো ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর Daini Geijutsu (Second-Class Art) প্রবন্ধে আধুনিক হাইকুর অকারণ দুর্বোধ্যতা, গভীর বিষয়কে শিল্পশোভিত করার অক্ষমতা, হাইকু কবিগণের দলবাজি ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। জাপানে একটি সুসংস্কৃত জাতি নির্মাণের জন্য যুগোপযোগী শিল্পের অপরিহার্যতার বিষয়ে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন। যুদ্ধোত্তর জীবনের জটিল মনস্তত্ত্ব চিত্রায়ণের মাধ্যম হিসেবে আধুনিক হাইকু গ্রহণযোগ্য নয় বলে তিনি অভিমত উপস্থাপন করেন। কুয়াবারার বীক্ষণের সাথে তানিকাওয়ার চেতনার সাযুজ্য রয়েছে। পাশ্চাত্যের শিল্পযাত্রায় কার্যকরভাবে যুক্ত থাকবার জন্য জাপানের ঐতিহ্যিক কাব্যমাধ্যমের পরিবর্তে তিনি পাশ্চাত্য প্রকাশ শৈলীকে সাঙ্গীকৃত করে ফ্রি ভার্সে অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তানিকাওয়া শুনতারো, ইবারাগি নোরিকো ও কাওয়াসাকি হিরোশির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে Kai (Oars) ম্যাগাজিনের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমবারের মতো কাই কবিগণ জনসমক্ষে কবিতা পাঠ ও টেলিভিশনে কাব্যনাট্য সম্প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তানিকাওয়ার অভিনব, ইতিবাচক কবিতা শ্রোতা ও পাঠকবর্গের নিকট ব্যাপকভাবে আদৃত হতে থাকে। তানিকাওয়া তাঁর অস্তিত্ব ও পরিজ্ঞাত প্রতিবেশের ভেতর নিমগ্ন থেকে সংবেদী বর্ণে নির্মাণ করতে থাকেন অদৃষ্টপূর্ব ইন্দ্রচাপ।

জীবনের আলোকোজ্জ্বল, অসীম সম্ভাবনার দিকে  দৃষ্টিপাত করে তিনি অস্তিত্ব-চেতনার সঙ্গে জীবনের অনিশ্চয়তা ও নশ্বরতা সম্পর্কে তাঁর অন্তর্বীক্ষণ A Vast Field  কবিতার শেষাংশে উন্মোচন করেন।

It's a vast, vast field.

The night sky is completely filled with stars.

Walking, I wonder whether I'm not yet dead.

তানিকাওয়ার দৃষ্টিতে সমুদ্র পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড; এর রক্তপ্রবাহ অবিরাম বহমান। তিনি সমুদ্রের ভাষার মর্মার্থ উপলব্ধি করেন, সমুদ্রকে স্পর্শ করেন, সমুদ্র নিয়ে ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন এবং সমুদ্রকে ভালোবাসেন। বায়ুমণ্ডল তুল্য সমুদ্রের নীল পরিচ্ছদের উপযোগিতা  তানিকাওয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কবি উদ্ঘাটন করেন মানুষের অস্তিত্বের সাথে সমুদ্রজাত মাছ ও শুক্তির অনিবার্য সম্পর্ক।

The blue garb, the same color as air that protects earth...

the home of humans who share it with fish and shellfish...

কবির কাছে জলধি একটি জীবসত্তা রূপে প্রতিভাত; মানুষের সাথে তার যোগ এতো নিবিড় যে উভয়ে উভয়কে প্রত্যক্ষ করে; একে শ্রবণ করে অপরের অমোঘ বার্তা।

Not that people look at the sea--the sea with shining eyes looks at people,

eyes unchanged from the beginning of time.

Not that people hear the sea,

the sea hears people

with the ears of numberless shells under the seabed.

মানুষ যেমন কণ্ঠে তুলে নেয় সমুদ্রের গান, সমুদ্রও তেমনি মানুষের উদ্দেশ্যে গানকে সুরময় করে তোলে। সঙ্গীতের ভেতর দিয়ে সমুদ্র নিশ্চিত করে মানব-উদযাপন।

Not that people sing of the sea--the sea sings of people.

The sea celebrates people.

বস্তুত কবি সঙ্গীতকে কবিসত্তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর Breeze, Graveyard, Dulcimer কবিতার কথক কেবলমাত্র মোৎসার্টের সঙ্গীত-রস আস্বাদন করেছেন, মার্কস বা দস্তয়েভস্কি পাঠ করেন নি। তিনি শুধু নীরবতার আত্মীয় কবিতা ও অ্যান্ডান্টের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রয়াসী। সঙ্গীত মানুষকে বিশেষত কবিকে কল্পনার অদৃশ্য  ব্রহ্মাণ্ডে পরিভ্রমণের সুযোগ এনে দেয়। কল্পনা অধ্যাস সৃষ্টিতেও ভূমিকা পালন করে। Listening to Mozart কবিতায় তানিকাওয়ার উচ্চারণ প্রণিধানযোগ্য।

The person listening to Mozart curls up like a child,

his eyes following the curled wallpaper as if it were the blue sky,

just as though his invisible sweetheart were whispering in his ear.

সঙ্গীতানুরাগী কবি মোৎসার্টের জন্মভূমি সল্টসবার্গ নিয়েও কবিতা লিখেছেন। 'A Stroll throuhgh Salzburg' কবিতায় তিনি এ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সঙ্গীত যেভাবেই পরিবেশিত হোক না কেনো তা শ্রোতাকে অনাবিষ্কৃত একটি ভূমণ্ডলে স্থানান্তরিত করবার জাদুশক্তি প্রয়োগ করে। Mozarteum-এ পিয়ানোবাদনে নিরত শিশু শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ করে তানিকাওয়া অনিন্দ্য রূপকল্প সৃষ্টি করেন।

In the Mozarteum children were taking piano lessons,

and however faltering, the music was music.

It carried us away to some unfamiliar world for a moment,

কবি অবলীলায় নির্মাণ করেন সঙ্গীতের সাথে কল্পনার যোগসূত্র। সঙ্গীত হৃদয়ে  প্রতিষ্ঠা করে পদ্মের কোমল স্বভাব। সঙ্গীতের প্রভাবে অশ্রু বর্ষিত হলেও সে অশ্রতরঙ্গে ভেসে যায় আনন্দ-সাম্পান।

সঙ্গীত কবির নিকট Orgasms বা রাগমোচন তুল্য উত্তেজনাকর আনন্দের মায়াবী পরিমণ্ডল রচনা করে যার ফাঁদের ভেতর কবি স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব বরণ করেন। A Kita-Karuizawa Diary কবিতায় তানিকাওয়া উন্মোচন করেন গভীর সাঙ্গীতিক সংবেদনা।

Another sort of orgasm comes over me again.

Sunlight filtered through leaves flirts with Mozart

and the vacant old house whispers amorous words.

And now, as eternity deceives me with its beautiful cosmetics,

I willingly throw myself

again and again

into a snare set by someone unknown.

Though I know it's an illusion, the snare is so sweetly alluring

I can't escape it.

উপস্থাপিত শব্দচিত্ররাজি নিসর্গ, সঙ্গীত ও অপার্থিবতার উপচারকে আশ্রয় করে কথক বা কবির আবেগাকুল অবস্থাকে বোধগ্রাহ্য করে তুলেছে। 'Another sort of orgasm' এমন এক পরিপূর্ণতাপ্রদায়ী ও আনন্দকর সংবেদনা যা কবিতার কথককে অভিভূত করে রাখে। চরম আনন্দের এ মুহূর্তকে রূপকাত্মক ক্লাইম্যাক্স হিসেবেও গণ্য করা যেতে পারে। নিসর্গের সাথে শিল্পের নিবিড় অন্তরঙ্গতার বিষয়টি স্ফুট হয় যখন পত্ররাজির ভেতর দিয়ে পরিস্রুত সূর্যালোক মোৎসার্টের সঙ্গীতের সাথে প্রণয়রঙ্গে মেতে ওঠে। নৈসর্গিক জগতের সাথে সাঙ্গীতিক সৌন্দর্যের এ সুসংগত সংলিপ্তি শৈল্পিক অভিজ্ঞতার অতিন্দ্রীয় শক্তিকেই প্রকাশ করে। অনধিকৃত, জীর্ণ গৃহের প্রেমার্ত বচন রহস্য ও রোমান্সের ইঙ্গিতবাহী। অনধিকৃত গৃহ প্রধানত শূন্যতা বা নির্জনতাকে প্রতিকায়িত করলেও এ ক্ষেত্রে তা সম্মোহক বৈশিষ্ট্যের ধারক কেননা এ গৃহের নিভৃত সত্তায় জেগে রয়েছে গোপন আকাঙ্ক্ষার তরঙ্গ।

কিন্তু কাব্যিক পারসোনা অনন্তের সৌন্দর্য ও মায়ায় প্রবঞ্চিত এবং তিনি স্বেচ্ছায় এ প্রবঞ্চনাকে আলিঙ্গন করেন, কারণ কবিতার মায়াময় জগতের স্বরূপ সম্পর্কে তিনি সম্যকরূপে অবহিত এবং তিনি জানেন এ জগতের ট্র্যাপ থেকে তাঁর মুক্তি নেই। কবির এ জটিল, আবেগবিহ্বল অবস্থার প্রকাশ পাঠকের জন্য বিস্ময়কর।

জীবন ধারণের জন্য যেমন বাতাস আবশ্যক, সংবেদনাময় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তেমনি কবিতাও মূল্যবান বায়বীয় উপকরণ। তানিকাওয়া কবিতাকে 'silent air spilling from lover’s lips' (প্রণয়ীর ঠোঁট থেকে ছলকে পড়া নীরব সমীরণ) বলে দেখতে চেয়েছেন। সমীরণ তুল্য কবিতা 'soul's communion' (আত্মার ভাব বিনিময়) নিশ্চিত করবার জন্য রচনা করে হাওয়াই পথ : 'Poems are a breeze weaving a way between people' (On Giving People Poems)। বাতাসের অদৃশ্য শক্তির সাথে  কবি-স্বভাবেরও রয়েছে সাযুজ্য। শৈশব থেকেই তানিকাওয়া নির্জনতা পছন্দ করেন। তাঁর সৃষ্টিশীল মনের বিকাশে নির্জনতা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। কবিতা রচনার সময় তার সত্তা ও সংবেদনা জনবসতিহীন পার্বত্য হ্রদের মতো প্রশান্ত ও নির্জন হয়ে ওঠে; হৃদয়ের তলদেশ থেকে আনন্দ, রোষ, বেদনা ও সুখানুভূতি ক্রমে শব্দের শরীরে তরঙ্গিত হতে থাকে। Answering Questions কবিতায় তিনি সৃজন-মুহূর্তের পটচিত্র অঙ্কন করেন।

When I write a poem my heart is as calm

as a mountain lake far away from human habitation.

With its feelings of joy, anger, sorrow and pleasure laid sunken on its bed,

it is quietly spreading out its ripples.

একটি গ্রিক আর্নে উৎকীর্ণ মূর্তি, বৃক্ষশাখা, পত্রালি প্রত্যক্ষ করে জন কিটস যখন Ode on a Grecian Urn কবিতা রচনা করেন তখন তাঁর সৃষ্টি কেবল একফ্রাসিসে বৃত্তায়িত থাকে না; তাঁর কবিতার ভেতর অঙ্কুরিত হয় দর্শনের ঔজ্জ্বল্য। শিল্পময় আর্নের ভেতর কুমারী বধূর সৌন্দর্য যেমন কিটস আবিষ্কার করেন, তেমনি এ পাত্রকে তিনি 'foster child of silence and slow time' অথবা 'silent form' বলে অভিহিত করেন, এবং এ আর্নের সূত্র ধরে তাঁর অন্তর্বোধ সাকার হয়ে ওঠে : 'Beauty is truth, truth beauty'। কিটস সুন্দর ও সত্যের ভেতর কোনো প্রভেদ নিরীক্ষণ করেন নি। কিটসীয় এ প্রত্যয়কে কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে তানিকাওয়া গুরুত্ব দিয়েছেন। তানিকাওয়া 'সুন্দর'-এ সংগোপিত 'সত্য ও শুভ'র প্রতি আস্থাশীল থেকে কাব্যময়  সৌধ নির্মাণে দ্বিধাগ্রস্ততার সাথে  শব্দাবলির বিন্যাস ঘটান।

Believing in 'the true and the good' lurking in 'the beautiful',

I place words hesitantly.

কবিতা কেবল শব্দরাজির অলংক্রিয়া নয়। কবিতা কবির সংবেদনশীল সত্তার বিধান হেতু দুরধিগম্য বলে প্রতীয়মান হয়। বোদ্ধা পাঠক কবিতার রহস্য উন্মোচন করতে পারেন কিন্তু অদীক্ষিত পাঠকের কাছে কবিতা চিরকালই দুর্বোধ্য। One Poem কবিতায় কবিতার চারিত্র্যের ওপর তানিকাওয়ার আলোক প্রক্ষেপণ তাৎপর্যপূর্ণ।

Is the poem words only? No, not really.

It's the indescribable confusion and the order of a soul

that are beautiful to some people, incomprehensible to others.

কবিতা লেখবার জন্য নির্জনতা ও প্রমগ্নতা প্রয়োজন। মানুষের জীবনযাত্রার সাথে বৃক্ষের জীবনসংগ্রাম ভিন্নতর হলেও বৃক্ষের সাধনা শব্দসাধকের সৃজনশীলতার অনুশীলনে অনুকরণীয়। কেননা বৃক্ষের স্থবিরতা সৃষ্টিশীল মানুষকে অভিনিবিষ্ট হতে উদ্দীপিত করে।কর্মচঞ্চল জীবনের ভেতর স্থিতধী ও নির্জন হতে না পারলে কবিতা নির্মাণ সম্ভব নয়। Tree শীর্ষক রূপকাত্মক কবিতায় তানিকাওয়া বৃক্ষ রূপে আত্মপ্রকাশ করতে চান। তিনি প্রত্যক্ষ করেন তাঁর মধ্যমা, তর্জনি, অনামিকা আঙুল দিয়ে  সবুজ পত্রালি গজিয়ে উঠছে, শরীর রুক্ষ কাণ্ডে রূপান্তরিত হচ্ছে, পায়ের আঙুল কাদামাটিতে নিমজ্জিত হচ্ছে, আর নিশ্চল হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। কর্মমুখর জগতের কোনো মানুষ তাঁর প্রতি মনোযোগী নন। তিনি বাতাসে আন্দোলিত হয়ে পাতার ঝিরিঝিরি আওয়াজ তুলছেন অর্থাৎ নির্জনতার ভেতর তাঁর অন্তর্গত ধ্বনিপুঞ্জকে অর্থময় করে তুলছেন।

যে কোনো কবির মতো তানিকাওয়া ভাষা বিশেষত গদ্য ভাষা নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। গদ্যকবিতা রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত বলে অনায়াসে উপলব্ধি করেন যে, গদ্যের উৎকর্ষ নিশ্চিত না হলে কাঙ্ক্ষিত কবিতার স্ফুরণ সম্ভব নয়। গদ্যকে গোলাপরূপী নৈসর্গিক সৃষ্টি হিসেবে কল্পনা করলে কবিতা তার সৌগন্ধ্য এবং গদ্যকে আবর্জনা হিসেবে কল্পনা করলে কবিতা তার তীব্র দুর্গন্ধ রূপে প্রতিভাত হয়। তানিকাওয়ার A Kita-Karuizawa Diary কবিতার একটি স্তবক উদ্ধার করা যাক।

If prose is taken as a rose,

poetry is its fragrance.

If prose is taken as a garbage dump,

poetry is its stench.

মনে হতে পারে সহজবোধ্যতা তানিকাওয়ার কবিতার অনন্য বৈশিষ্ট্য। সহজগম্যতা তাঁর কবিতার একটি গুণ মাত্র। তানিকাওয়ার কাব্য ভাষা সান্দ্র, সংযত ও ঋজু। কখনো কখনো তিনি স্বয়ং কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেন; অকপটভাবে নিজের অবয়ব ও আচরণ উন্মোচন করেন। তবে কনফেশনাল কবিতায় যে ব্যক্তিগত ট্রমা, পারিবারিক সহিংসতা, যৌনাচার ও আত্মহননের প্রসঙ্গ বিবৃত থাকে তা তানিকাওয়ার কবিতায় দৃশ্যমান নয়। তানিকাওয়া যে স্থুল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কবিতায় প্রকাশ করেন তা মৃদুতা ও শোভনতার বাতাবরণকে বিবর্ণ করে না। Self-Introduction কবিতায় তানিকাওয়া তাঁর খর্বত্ব, কেশহীনতা ও বার্ধক্যের কথা অবলীলায় প্রকাশ করেন এবং অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে বিশেষ্য, ক্রিয়া, অনুসর্গ, বিশেষণ ও প্রশ্নচিহ্নের দ্বারা আন্দোলিত হয়ে জীবন-অভিজ্ঞতা বর্ণনার পর নীরবতাই তাঁর মনঃপূত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন; তাঁর বস্তুতন্ত্রীয় চেতনা কবিতায় হয়ে ওঠে দীপ্রতর।

What I'm describing here is factual

and yet I feel a false note is struck when things are put into words.

I have two children living separately and four grandchildren, and keep no dogs or cats.

I spend most of the summer in t-shirts.

The words I write are sometimes given prices.

সংবেদনার পরিপূর্ণ প্রকাশ শব্দে যে সম্ভব নয় তা তিনি স্বীকার করেন; নিজের সন্তান ও পৌত্রদের সংখ্যা উল্লেখ করেন; তাঁর প্রাণী পালনের যে সখ নেই সে বার্তা দিতেও তিনি সংকোচ বোধ করেন না। তিনি অবহিত করেন যে গ্রীষ্মের অধিকাংশ সময়ে তিনি টিশার্ট পরিধান করেন এবং কবিতা লিখে কখনো অর্থও উপার্জন করেন। ব্যক্তিগত জীবনের এ অনুপুঙ্খ বর্ণনাকে তিনি কল্পনার রঙে রাঙিয়ে তোলেন না। এভাবে তিনি বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞান নিঃসংকোচে অবিনাশী পটে উৎকীর্ণ করেন।

তানিকাওয়া মৃত্যু-সচেতন কবি। তবে প্রায় বিরানব্বই বছরের পার্থিব জীবনে তিনি পৃথিবীর রসোত্তীর্ণ ঐশ্বর্য সহযোগে যে কাব্য-ভাস্কর্য নির্মাণ করে চলেছেন তা অমরত্বের দীপশিখা প্রোজ্জ্বল রেখেছে।তাঁর কাছে মৃত্যু ভীতিপ্রদ নিরালোক ও চিরবিচ্ছেদের সংঘটক নয়। কবির দৃঢ় প্রত্যয়, মৃত্যু পার্থিব জীবনকে প্রতিফলিত করে না; মৃত্যু ব্যক্তির আত্মচেতনার বিলুপ্তি ঘটায়--মৃত্যুর মাধ্যমে ব্যক্তিগত পরিসীমা নিরাকৃত হয় বলে মহাবিশ্বের  সাথে মানুষের গভীরতম বন্ধন সূচিত হয়।

Since death lacks mirrors

we shall soon be unselfconscious

and able to be one with the world

জলধি, উদ্ভিদ, মৎস্য, মানুষের সঙ্গে তানিকাওয়ার সম্পর্ক এতো অন্তরঙ্গ যে তা মোচ্য নয়; তিনি নিজেকে 'rhythm in a refrain' কিংবা 'subtle wave and a particle having arrived' বলে উল্লেখ করেন বিধায় মানুষের হৃদয়-তরঙ্গের সাথে তাঁর রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তিনি ঘোষণা করেন যে, তিনি নিজের পরিচয় জেনেছেন বলে অন্যের পরিচয় তাঁর নিকট অপরিজ্ঞাত নয়। অন্যের কোনো তথ্যাদি রাষ্ট্রীয় নথিপত্রে সংরক্ষিত না থাকলেও অপরের সাথে তিনি তাঁর সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। I Am Me, Myself  কবিতায় তাঁর আত্মচেতনা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে; তিনি বিশ্বমানবতার সাথে অন্তঃসংজ্ঞা সূত্রে অন্বিত।


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩২    




        

প্রথিবীর প্রায় বেশির ভাগ জায়গার ছবি আমরা এ পর্যন্ত আমাদের আলোচনায় এনেছি। আজ আর মাত্র দুটো দেশ নিয়ে আমাদের কাটাছেঁড়া। প্রথম দেশ, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত ইজরায়েল। যার প্রতিবেশী দেশগুলো হল লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন ও প্যালেস্টাইন। সত্যি বলছি, আমার এই দেশটাকে একদম পছন্দ নয়। ভীষন যুদ্ধবাজ, ইহুদিদের জায়গা এবং জেরুজালেম এখানে অবস্থিত বলে এদের নাক খুব উঁচু। বাকিদের মানুষ বলে মনে করে না। কিন্তু সিনেমার জগতে ইজরায়েলের অবদান বেশ খানিকটা। সেটা অস্বীকার করলে ইতিহাস অস্বীকার করা হয়। তাই আজ ইজরায়েলকে নিয়ে আলোচনা। এবং আরেক দেশ হল কানাডা। আমেরিকার উত্তরে। ভারতবর্ষের ছেলেমেয়েদের পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপে যাবার খুব পছন্দসই জায়গা।

১৯৪৮ সালে ইজরায়েলের সিনেমা শুরু হবার পর থেকে হিব্রু ভাষায় (এবং আরবি বা ইংরাজি ভাষাতেও) একে একে ভাল সিনেমা তৈরি হতে থাকে। বিশেষ করে ষাটের দশকের তিন বিখ্যাত পরিচালক, এফ্রাইম কিশন, মেনাহেম গোলান ও উরি জোহার, ইজরায়েলের সিনেমাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। এবং এই দেশ এখনো অব্ধি মধ্য-প্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর তুলনায় সবথেকে বেশিবার অস্কার নমিনেশন পেয়েছে। ২০১১ সালে ছোট ডকু ফিল্ম ‘স্ট্রেঞ্জারস নো মোর বাইরে থেকে ইজরায়েলে পড়তে আসা বাচ্চাদের কঠিন লড়াই তুলে ধরে অস্কার পেয়েছে। আমার হিসেবে, এখানকার কিছু পূর্ণদৈর্ঘ্য উল্লেখযোগ্য ছবি হল - সালেহ্ (১৯৬৪), দ্য পুলিসম্যান (১৯৭০), আই লাভ ইউ রোজা (১৯৭২), এশার (১৯৮৬), আন্ডার দ্য ডোমিম ট্রি (১৯৯৫), ক্যাম্পফায়ার (২০০৪), নুডল্ (২০০৭), ওয়ালজ উইথ বশির (২০০৮), আজামি (২০০৯), লেবানন (২০০৯), গেটঃ দ্য ট্রায়াল অব ভিভিয়ান অ্যামসালেম (২০১৪), দ্য কেকমেকার (২০১৭)।

আজ আলোচনা করব এফ্রাইম কিশনের ‘সালেহ্ বা সালেহ্ সাবাতি নিয়ে। অনবদ্য স্যাটায়ার। হিব্রু উদ্বাস্তুদের সমস্যা ইজরায়েলে এক সময় ঠিক কি রকম ছিল, এই সিনেমা তার দলিল। এবং কিশনের প্রতি আমার আকর্ষণ আরো এক কারণে। উনি প্রাথমিকভাবে একজন লেখক। লেখালেখি করে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। এমনকি পুরস্কার পেয়েছেন সাংবাদিকতার জন্যও। 

সালেহ্ সাবাতি নামক এক হিব্রু ইয়েমেন থেকে তার সাতবাচ্চা ও গর্ভবতী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ইজরায়েলে উদ্বাস্তু হিসেবে আসে এবং তাদের স্থান হয় রিফিউজি ক্যাম্পে। সেখানে তাদের ভাগ্যে জোটে এক স্যাঁতস্যাঁতে এক-কামরার ভাঙা ঘর। সালেহ্ আশা করে কিছুদিনের ভেতরেই তারা সরকারী উদ্বাস্তু হাউজিং-এর পাকা ঘরে চলে যেতে পারবে, কিন্তু সেখানে  যাবার জন্য কিছু টাকা লাগবে এবং সেই টাকা জোগাড় করার জন্য সালেহ্ বিভিন্ন প্লট ভাঁজতে সুরু করে যা সেই সময়ের ইজরায়েলের রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাঙ্গচিত্র তুলে ধরে। কিছুদিন পর সে বোঝে, সেই উদ্বাস্তু ক্যাম্প থেকে হাউজিং-এ যাওয়া খুব কঠিন। কেউ কেউ উদ্বাস্তু ক্যাম্পে ছবছর কাটিয়ে ফেলেছে কিন্তু তাদের জীবনে কিছুই ঘটেনি। সে বুদ্ধি ভাঁজে এবং সরকারি হাউজিং অফিসের সামনে অনেককে সঙ্গে নিয়ে হোর্ডিং সহ স্লোগান দিতে থাকেঃ আমাদের উন্নয়ন চাই না, আমরা উদ্বাস্তু ক্যাম্পেই থাকতে চাই। এর ফল হয় মারাত্মক। সরকার ও পুলিশ সক্রিয় হয়ে একে একে উদ্বাস্তু পরিবারদের রিফিউজি ক্যাম্প থেকে তাড়িয়ে জোর করে সেই হাউজিং-এ ঢুকিয়ে দেয়।

এই ছবি কিশনকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ইজরায়েলকে এনে দিয়েছিল প্রথম অস্কার নমিনেটেড সিনেমা। বিদ্রুপ যে এরকম চাবুক হতে পারে, সেটা কিশন প্রথম দেখিয়েছিলেন। এমনকি নামেও। সালেহ্ সাবাতি-র হিব্রু ভাষায় আক্ষরিক অর্থ হল ‘ক্ষমা করবেন, আমি এসেছি’। সালেহ্র ভূমিকায় টোপোলের অভিনয় যথাযথ। ভাল লাগে গিলা আলমাগোরের ডেবিউ অভিনয় (পরবর্তীকালে উনি ইজরায়েলি ছবির প্রধান নায়িকা হয়ে উঠেছিলেন)। তবে হ্যাঁ, ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের এই সিনেমায় ক্যামেরার কাজ মোটেও আহামরি নয়। কিছু লং শট ছাড়া। বরং এই ছবির প্রধান শক্তি হল এর সংলাপ।

আরেক ছবির কথা উল্লেখ না করলে সেই ছবির সঙ্গে বেইমানি হবে। এবং কেন আমি ইজরায়েলি ছবির প্রতি আকৃষ্ট হলাম, সেটাও অজানা থেকে যাবে। আরি ফোলম্যানের অ্যানিমেশন ডকু সিনেমা ‘ওয়ালজ উইথ বশির’। ১৯৮২ সালে  ইজরায়েল লেবাননের যুদ্ধ কিভাবে সাধারন মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছিল, সেটা জানতে হলে দেড় ঘন্টার এই ছবি দেখতে হবে। এক ইনফ্যান্ট্রি সৈনিক, যে সেই যুদ্ধের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে, তার বন্ধুদের থেকে জানছে ঠিক কি হয়েছিল সেই যুদ্ধে। অদ্ভুত স্টাইল, অনবদ্য ন্যারেশন। এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৮। আমি সে বছরই গুয়াহাটি বসে এই ছবি দেখেছিলাম। এই ছবি দেখার পর কেউ যদি ‘লেবানন’ (২০০৯) দেখেন, আপনারা প্রাসঙ্গিকতা আরো ভাল বুঝতে পারবেন।   

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা প্রথমে ছিল বৃটিশ শাসিত উত্তর আমেরিকার অন্তর্গত। পরে ১৮৬৭ সালে এটি স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। এবং ১৯৮২ সালে দেশের সংবিধান তৈরি হবার পর এটি পূর্ণ গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রধান ভাষা ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ। এটা ঠিক যে বছরের প্রায় ৮ মাস কানাডা তুষারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে, জলবায়ুর জন্য এই দেশ প্রায় রাশিয়ার মতই। কিন্তু এখানে পার ক্যাপিটা ইনকাম এত বেশি যে শিক্ষিত বেকার প্রায় নেই বললেই চলে। তাই আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা ও চাকরির জন্য এক লোভনীয় গন্তব্য হল কানাডা। এবং এখানকার প্রধান তিন শহর টরান্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভ্যাঙ্কুবার খুবই উন্নত এবং প্রায় সমস্ত সুবিধাযুক্ত হবার জন্য এই তিন শহরে পৃথিবীর বেশিরভাগ উন্নতশীল দেশের লোকেরা পাড়ি জমায়। যাইহোক, কানাডার ছবির ইতিহাস সেই ১৮৯৬ থেকে শুরু। হলিউড সেই সময় থেকেই কানাডাকে ব্যবহার করত বিভিন্ন ছবির শুটিং স্পট হিসেবে। অন্য এক কারনও ছিল। কানাডাকে ব্যবহার করলে ব্রিটিশ ছবির আইনকানুন এড়িয়ে যাওয়া যেত। চল্লিশের দশকে ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অব কানাডা তৈরি হবার পর কানাডায় নিজস্ব ছবি তৈরির, বিশেষ করে এক্সপেরিমেন্টাল ছবি তৈরির সংখ্যা বেড়ে যায়। এবং ষাটের দশক থেকে কানাডার সিনেমা পৃথিবীর মূল ধারায় প্রবেশ করে।  

কানাডার উল্লেখযোগ্য ছবির ভেতর আমি যেগুলো দেখেছি - গোয়িং ডাউন দ্য রোড (১৯৭০), মাই আঙ্কল অ্যান্টোইন (১৯৭১), অর্ডারস্ (১৯৭৪), জেসাস অব মন্ট্রিয়ল (১৯৮৯), লিওলো (১৯৯২), দ্য সুইট হেয়ার-আফটার (১৯৯৭), আটানার্জুয়াটঃ দ্য ফাস্ট রানার (২০০১), ইনসেন্ডিজ (২০১১), মমি (২০১৪)। এছাড়াও ডকু ফিল্মের মধ্যে ম্যানুফ্যাকচার্ড ল্যান্ডস্কেপস্ (২০০৬) এবং এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা বললে ওয়েভলেন্থ (১৯৬৭), সেইলবোট (১৯৬৭) ও হার্ট অব লন্ডন (১৯৬৮)।

এখানে আমরা অ্যাটম ইগয়ানের ‘দ্য সুইট হেয়ার-আফটার নিয়ে আলোচনা করব। ১১২ মিনিটের সিনেমা। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এক ছোট্ট শহরে এক স্কুলবাস বরফে পিছলে গিয়ে এক লেকের মধ্যে পড়ে যায়। ১৪ জন বাচ্চা মারা যায়। সেই সময় শোকে পাগল সেই ১৪ বাচ্চার বাবা-মা এবং বাস ড্রাইভারের কাছে এক ধান্দাবাজ উকিল মাইকেল গিয়ে বোঝাতে শুরু করে যে শহর কর্তৃপক্ষ এবং বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে তৎক্ষনাত এক বড় অঙ্কের মামলা রুজু করা উচিৎ। কারন শহর কর্তৃপক্ষ যদি লেকের ধারে এক মজবুত লোহার রেলিং দিত, তাহলে হয়ত এই দুর্ঘটনা ঘটত না। সেই উকিল গিয়ে বোঝায় স্যাম নামক এক ব্যক্তিকে, যার ১৫ বছরের মেয়ে নিকোল এই দুর্ঘটনার একমাত্র সাক্ষী। এই ঘটনায় সে বেঁচে ফিরলেও কোমর থেকে পঙ্গু হয়ে গেছে। তার সঙ্গীতচর্চার আশা পুরোপুরি শেষ। স্যাম ও মাইকেল নিকোলকে চাপ দিয়ে চলে। কিন্তু নিকোল কোর্টে গিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়। বলে, ড্রাইভার তাড়াতাড়ি চালানোর জন্যই এই দুর্ঘটনা। সবাই বোঝে নিকোল মিথ্যে বলছে। কিন্তু সে যে ঘৃনার বদলা ঘৃনা চায় না, সে আবার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি চায়, সেটাও সবাই বুঝে যায়। শহর ধীরে ধীরে আবার ছন্দে ফিরে আসে।

এই ছবির ট্যাগলাইন ছিল ‘sometimes courage comes from the most surprising places’। কিন্তু আমি এর ভেতর এক বহুমাত্রিক ছবি দেখতে পেয়েছি। একদিকে ক্ষতি, অন্যদিকে কিছু সিক্রেট এবং মিথ্যের আশ্রয়, আবার অন্যদিকে প্যাশনেট। এবং সবার ওপরে হিউম্যান সাইকোলজি। লক্ষ্যনীয় বিষয় যে এখানে পরিচালক কিন্তু কোন প্রশ্ন বা আভাষ রাখেন নি। এক ড্রামা সিনেমা, যা আমাদের আত্মাকে নাড়িয়ে দেয়। এ সেই ছবি। নিকোল ঘুমোতে যাবার আগে তার ছোটবেলায় আবৃত্তি হয়ে চলা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা এই ছবির রূপককে আরো সজীব করে তুলেছে। ছবির মত ক্যাথারসিস। এবং আউটডোর শুটিং - লং শট, ক্লোজ শট, ফ্রিজিং শট। বেশ ভাল সিনেমাটোগ্রাফি। ইগয়ানের ক্যামেরায় আমি কিন্তু একটাই মানসিক ঘটনার ন্যারেশন নেভিগেশন দেখলাম। এবং সেটা সরাসরি নেভিগেশন নয়, ঘুরে ঘুরে, circumnavigation, বৃত্তাকারে, এসে যেন বারবার বলছে, শক্ত হও, জীবনে ফেরো। লালন ফকিরের গান মনে পড়ে গেল – ‘আয় চলে আয়/ দিন বয়ে যায়/ যাবি যদি নিত্য ভুবনে’।

কানাডার ছবি নিয়ে আমার কথা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অব কানাডা তৈরি হবার পর কানাডায় বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্টাল অ্যানিমেশন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আসল কাজ শুরু হয় ষাটের দশকে, যখন কয়েকজন চিত্রকর জ্যাক চেম্বার্স, মাইকেল স্নো ও জয়েস উইল্যান্ড ছবি বানাতে শুরু করেন এবং তাদের কাজের মধ্যে এক্সপেরিমেন্ট ঢোকাতে শুরু করেন। স্নো ও উইল্যান্ড তখন দম্পতি, তারা নিউ ইয়র্কে চিত্রকলা শিখছেন। আমি এই ধারাবাহিকের ১২ নং পর্বে মাইকেল স্নো-র ‘ওয়েভলেন্থ’ উল্লেখ করেছিলাম। স্ট্রাকচারাল ছবি হিসেবে। আজ এই সিনেমা একটু ছুঁয়ে যাব।

স্ট্রাকচারাল ফিল্ম বেশ সহজ একটা জিনিষ। এখানে সিনেমার ফর্মটাই আসল, কনটেন্ট নয়। এবং সহজ, আগে থেকে ঠিক করে রাখা ফর্ম নিয়েও কাজ করা চলে। ধরা যাক, ক্যামেরায় এক ফ্লিকার সাউন্ড বা ফ্লিকার ফ্রেম। অথবা লুপে ঘুরে চলা প্রিন্টিং। অথবা আগে থেকে নির্দিষ্ট করে রাখা ক্যামেরার অবস্থান। নির্দিষ্ট ফ্রেম। আর এই শেষ ব্যাপারটাই স্নো করে দেখিয়েছেন। তার ছবিতে কোন থিম নেই, প্লট নেই। কোন অ্যাকশন নেই। ক্যামেরা স্থির। শুধু চারটে চরিত্র ঘুরে বেরাচ্ছে। কেউ এসে বইয়ের তাক রেখে যাচ্ছে, কখনো মদ্যপান, একজনের মৃত্যু, আরেকজন এমারজেন্সি কল করছে। শেষে দূর থেকে পুলিসের সাইরেন। কিন্তু সাউন্ড প্রায় নেই বললেই চলে। মিনিমালিস্ট। তাহলে নাম ওয়েভলেন্থ কেন? কারন এর ব্যাস্তানুপাতিক হল ফ্রিকোয়েন্সি। অর্থাৎ টোন। সিনেমার শেষে সেই টোন যেভাবে খুশি পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। আর ক্যামেরা একটা স্থির জায়গা থেকে সেই ফ্ল্যাটের স্পেস আরো বিশ্লেষন করে চলেছে। মাত্র ৪৫ মিনিটের সিনেমা, কিন্তু সুযোগ পেলে দেখে নেবেন।    

কিন্তু এই সফর এক্ষুনি শেষ করব না। আমাদের সফর শেষ করার আগে আরেক দেশ। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে এবং এশিয়া মহাদেশের দক্ষিন-পশ্চিম দিকে এক আন্তঃমহাদেশীয় রাষ্ট্রের নাম ইজিপ্ট (মিশর)। ভুললে চলবে না, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এই দেশ প্রাচীন যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার পীঠস্থান ছিল। ইজিপ্ট নিয়ে  অনেক অনেক ছবি তৈরি হয়েছে। যদিও আমার উদ্দেশ্য সেইসব ছবির কাটাছেঁড়া নয়। তাহলে তো প্রথমেই জুলিয়াস  সিজার, ক্লিওপেট্রা এবং সেই চরিত্রে অনবদ্য লিজ টেলর, এদের নিয়ে বলতে হয়। কিন্তু আমি ইজিপ্টের নিজস্ব ছবি নিয়ে আলোচনায় উৎসাহিত। আমি দেখেছি, ইজিপ্টের এরকম কিছু ছবি হল - দ্য ফ্লার্টেশন অব গার্লস্ (১৯৪৯), কায়রো স্টেশন (১৯৫৮), দ্য নাইটিঙ্গেলস প্রেয়ার (১৯৫৯), দ্য সিন (১৯৬৫), দ্য ল্যান্ড (১৯৬৯), নাইট অব কাউন্টিং দ্য ইয়ারস (১৯৬৯), দ্য বাস ড্রাইভার (১৯৮২), টেররিজম্ অ্যান্ড দ্য কাবাব (১৯৯২), দ্য য়াকোবিয়ান বিল্ডিং (২০০৬), এবং আসমা (২০১১)।

এর আগে আমরা কিছু পুরনো ছবি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেছি, সুতরাং এখন এক নতুন ছবি। অমর সালামা-র দেড় ঘন্টার ছবি ‘আসমা। আসমা এক চরিত্র, এইডস আক্রান্ত। হয়ত এরকম চরিত্র আমাদের সমাজে অনেক লুকিয়ে আছে, আমাদের অজান্তে। এই সিনেমায় বছর চল্লিশের আসমা কায়রো এয়ারপোর্টে কাজ করে। স্বামী মারা যাবার পর একাই মেয়েকে বড় করে তুলছে। তার জেলফেরত স্বামী বেঁচে থাকাকালীন সে জানতে পারে স্বামীর এইডস হয়েছে। কিন্তু স্বামীর প্রতি ভালবাসায় এবং স্বামীর শেষ ইচ্ছেকে সন্মান জানাতে সে গর্ভবতী হয়। স্বামী মারা যায়, মেয়ে হয়। কিন্তু সে সমাজের কাছে, বন্ধু বান্ধবদের কাছে, নিজের মেয়ের কাছে এই রোগ জানাতে ভয় পায়। বেশ কিছু বছর। তার কষ্ট বেড়ে চলে। কিন্তু এবার তাকে একটা পথ বেছে নিতে হবে – সে এই রোগ সবার কাছে প্রকাশ করবে নাকি গোপনে ব্যাথা পেয়েই চলবে। কারণ এবার তাকে গলব্লাডার অপারেশন করাতে হবে। একদিকে সামাজিক, মনস্তাত্তিক সুইসাইড - অন্যদিকে ধীরে শারীরিক মৃত্যু। এই অবস্থায় তাকে এক টিভি শো-তে ডাকা হয়, তার শারীরিক সমস্যা জানানোর জন্য। কিভাবে তার এইডস হল, সেটা বলার জন্য। সে কি আদৌ যাবে?

আসমা চরিত্রে হেন্দ সাবরি অনবদ্য। সিনেমাটোগ্রাফিও বেশ ভাল। এবং জানলে অবাক হবেন, আসমা এক সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। এক মহিলা বিনা অপারেশনে গলব্লাডার ফেটে মারা যান কারন ডাক্তাররা তার এইডস ছিল বলে অপারেশন করেন নি। ভাবতে পারেন? তবে কি জানেন, আমার মনে হয়, আসমা ছবিটা শুধুমাত্র ইজিপ্টের জন্য নয়, ইজিপ্টের মহিলাদের জন্য নয়। আসমা সেইসব পেছিয়ে পড়া দেশের অভাগা মহিলাদের প্রতীক যারা রোজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক কিছু গোপন রাখতে বাধ্য হয়, নইলে প্রতিনিয়ত তাদের অনেক অসন্মানের মুখোমুখি হতে হয়। ফলে আমি আসমাকে নিছক এক সিনেমা হিসেবে দেখি না। আমার কাছে আসমার লড়াই যেন ‘love, courage, overcoming fear and fighting for personal rights’। এবং আসমা যেন আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমরা কবে একবিংশ শতাব্দীর কুসংস্কার মুক্ত মানুষ হব? 

(ক্রমশ)


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

সাহিত্যিক সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক কলমে তিন বাঙালী আইকন

 


সৌরভ মুখোপাধ্যায়, যুক্তি তক্কো আর গদ্য

প্রকাশকঃ অন্তরীপ পাবলিকেশন, ২০২৩

‘কথামুখ’-এ লেখক বলে দিয়েছেন যে তাঁর ‘আগের বইটির’ (ফোনের ওপারে নীললোহিত এবং অন্যান্য গদ্য) – যেটি ছিল ‘ব্যক্তিগত বা আত্মকথামূলক’ – তুলনায় বর্তমান সংকলনের লেখাগুলি ‘নৈর্ব্যক্তিক, বিচার-বিশ্লেষণ আর অনুসন্ধান-পর্যবেক্ষণে ঠাসা, তথ্য-যুক্তি-তর্কে খচিত।’ ন’টি লেখার মধ্যে পাঁচটিরই বিষয় বাঙালীর তিন ‘আইকন’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় এবং দেবব্রত বিশ্বাস। প্রথমে সেগুলি নিয়েই কথা হোক।

১ম পর্ব

বিষয় হেমন্ত

১। অন্তরীপ পত্রিকায় ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শারদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত ‘বন্ধু, বুঝো না ভুল’ উত্তম-হেমন্ত দ্বন্দ্ব’ নিয়ে কালিমাটি অনলাইন পত্রিকায় লিখেছিলাম। সেখানে এই দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ –‘দুই সফল পুরুষের সংঘাতের পিছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে-কারণটি অনিবার্য … নারী’ সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন সৌরভবাবু। সেই প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে আমি একটি ফরাসি প্রবাদ ব্যবহার করি, যেটি লেখক মূল লেখাটি পরিমার্জন করার সময় দেখছি গ্রহণ করেছেন। সৌরভবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমার আলোচনাটি এখানে আবার তুলে দিলামঃ

কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬) ছবিতে উত্তমের সুরে হেমন্তকণ্ঠে ‘আমি যাই, চলে যাই’-এর উল্লেখ এবং নেপথ্য-কাহিনি দিয়ে শুরু হয়েছে এই প্রতিবেদন। তার পরেই এসেছে (নির্মম?) পরিসংখ্যান, যা লেখাটির বাড়তি শীর্ষক ‘উত্তম-হেমন্ত দ্বন্দ্ব’-কে বাস্তবের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০ অবধি মাত্র ১১টি ছবিতে উত্তম ‘প্রত্যক্ষভাবে লিপ দিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়নে, এবং সেই গানগুলির সংখ্যা বড়জোর ২৭/২৮!’ আর ১৯৬৬-র আগেঃ

১৯৫৫ সালে ‘শাপমোচন’ ছবিতে এই জুটির বিজয়-বৈজয়ন্তী ওড়ার পর থেকে (যদিও এর চার বছর আগে প্রথমবার ‘সহযাত্রী’ ছবিতে তরুণ গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুটি গান ছিল নবাগত নায়কের লিপে, তেমন আলোচিত হয়নি তা) ওই ১৯৬৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ১১ বছরেই প্রায় ১৮/১৯টি ছবিতে আমরা দেখছি উত্তম-হেমন্ত চিত্রায়নের মণিকাঞ্চন— এবং সংখ্যাটি? প্রায় ৫০! … অন্তত প্রথম ওই একটি স্বর্ণমণ্ডিত দশক, উত্তমের নেপথ্য কণ্ঠদানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন সব্বাইকার প্রথম পছন্দ— দর্শকের, প্রযোজকের, পরিচালকের, সঙ্গীতকারের। সম্ভবত, প্রথম দিকের অনেকটা সময়, নায়কের নিজেরও। এই সময়পর্বে হেমন্ত যা-ই গেয়েছেন উত্তমের জন্য … সব হিট। অদ্ভুত মিল ছিল গায়কের ও নায়কের কণ্ঠের টিম্বারে, এমনকি বাচনভঙ্গিতেও। গানের মধ্যে টুকরো সংলাপ বলেছেন হেমন্ত, একেবারে মিলে গেছে উত্তমের গলার সঙ্গে। ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ কিংবা ‘মায়ামৃগ’ কিংবা ‘দুই ভাই’ ইত্যাদি অনেক ছবির গানে এমন নিদর্শন আছে।

১৯৬২ সালে হেমন্ত-প্রযোজিত প্রথম হিন্দী ছবি বিস সাল বাদ বম্বেতে নবাগত বিশ্বজিৎকে প্রভূত সাফল্য দেবার পরেই হেমন্ত স্থির করেন যে এর পরের ছবি শর্মিলা-র মাধ্যমে তিনি উত্তমকুমারকে হিন্দী ছবির জগতে প্রতিষ্ঠা দেবেন। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে, হেমন্তর প্রভূত আর্থিক ক্ষতি ঘটিয়ে উত্তম ছবি থেকে সরে দাঁড়ান। দুই ব্যক্তিত্বের দূরত্ব চরমে পৌঁছোয় ১৯৭০-এর পর। লেখক যথার্থই বলেছেনঃ

যে-জুটি একদা চার বছরে (’৫৮ থেকে ’৬১) মোট ১২টা ছবিতে ৩০টি গানে জুড়েছিলেন, ’৭১ থেকে ’৭৪ এই চার বছরে তাঁদের মিলন ঘটল মাত্র দুটি ছবির চারখানি গানে! তার মধ্যে প্রথম দু’বছরের স্কোর— শূন্য!

আর কাল তুমি আলেয়া-র বছর, ১৯৬৬-তেই শঙ্খবেলা ছবির মাধ্যমে দর্শকমানসে উত্তম প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর বিকল্প নেপথ্য কণ্ঠকেঃ মান্না দে। লক্ষ্যণীয় যে কাল তুমি আলেয়া-তে হেমন্তের কণ্ঠ আছে বটে, কিন্তু গানটি কিন্তু কোন ভাবেই তাসের ঘর-এর ‘শূন্যে ডানা মেলে’, বা শুধু একটি বছর-এর ‘মোর মিলন-পিয়াসী মন’-এর মতো উত্তমের মনের কথা ব্যক্ত করছে না! গানের কথা সদ্য-প্রয়াতা এক নারীর (অভিনয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) বিদায়-গাথাঃ

তাই, ’৬৬ সালের ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবির ওই গানটি শুনলেই আজ কেমন অন্যরকম একটা মাত্রা যোগ হয় আমার অনুভবে। এই সেই ভাঙন-লগ্নের গান, যেন ভবিষ্যৎবাণীর ঘ্রাণ মেলে। গায়ক আর নায়কের ব্যক্তিগত সম্পর্কের যেটুকু সুরভি, তা শেষ হয়ে আসছে— কাঁটাগুলি এবার প্রকট হবে। আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ফিরে ফিরে আসছে লিরিকে। ‘আমারে খুঁজোনা তুমি/ বন্ধু বুঝোনা ভুল/ কাল সে আলেয়া শুধু/ আমি সে আলোর ঝরা ফুল...’

এর পর লেখক পেশ করেছেন আগের চেয়েও নির্মম এক পরিসংখ্যানঃ

বোঝার সুবিধের জন্য রইল একটি চুম্বক-সার। কয়েকটি ছবির হদিশ মেলেনি, তাই approximate statistics.

# ১৯৬৬-পূর্ব গান: মান্না-উত্তম= ১ (ছবি ১), হেমন্ত-উত্তম= ৫৫+ (ছবি ১৮+)

# ১৯৬৬-পরবর্তী গান: মান্না-উত্তম= ৯০+ (ছবি ২৭+), হেমন্ত-উত্তম= ২৭+ (ছবি ১১+)

‘সিংহাসনচ্যুত’ কথাটা যে অত্যুক্তি নয় মোটেই, তা দেখাই যাচ্ছে।

সত্তরের দশকে এসেছে একাধিক ছবি যেখানে উত্তম-হেমন্ত যুগলেই উপস্থিত, কিন্তু উত্তমের কণ্ঠ মান্না দে, হেমন্ত গাইছেন অন্য শিল্পীর নেপথ্যে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ স্ত্রী, যেখানে হেমন্ত গেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। আবার সন্ন্যাসী রাজা-য় উত্তমের মুখে সমস্ত বাংলা গান মান্নার কণ্ঠে, শুধু ‘কা তব কান্তা’ স্তোত্রতে আমরা পেয়েছি হেমন্তকে, আর যে স্তোত্র উত্তম-অভিনীত চরিত্রের আগেই শোনা গেছে সেই সন্ন্যাসীদলের নেতার কণ্ঠে যারা সমুদ্রতীর থেকে অর্ধমৃত জমিদার (উত্তম)-কে উদ্ধার করছে। শোনা যায় যে শঙ্খবেলা-তে সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত নাকি ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’-তে চেয়েছিলেন হেমন্তর রোম্যান্টিক কণ্ঠ, আর মজলিসী গান ‘আমি আগন্তুক’-এ মান্না দেকে। তখন নাকি এই ছেঁদো যুক্তিতে হেমন্ত বাদ পড়েন যে এক অভিনেতার গলায় দু’জন ভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠ দর্শক নাকি নেবেন না! লেখকের কথায়ঃ

১৯৬৮-র ‘চৌরঙ্গী’ দিয়ে এর সূচনা, তারপর এক সময় যেন এটাই নিয়ম দাঁড়িয়ে গেল। উত্তমকুমার ছবিতে রয়েছেন, তবু ছবিতে হেমন্তর গান গেয়ে যাচ্ছেন অন্য অভিনেতারা! সাবরমতী, কমললতা, ধন্যি মেয়ে, স্ত্রী, অগ্নীশ্বর, ভোলা ময়রা...

উল্লেখিত ছবিগুলির মধ্যে নায়ক-গায়কের পরস্পর দূরত্ব, আমার কাছে, সবচেয়ে প্রকট সাবরমতী-তে। এখানে উত্তমের মুখে একটি গানে আমরা শুনছি কিশোরকুমারের কণ্ঠ! আর, সৌরভবাবুর ভাষায়ঃ

১৯৬৮র ছবি ‘সাবরমতী’, অনেকেই দেখে থাকবেন গোপেন মল্লিক সুরারোপিত অপূর্ব শ্রুতিমধুর সেই গানের চিত্রায়ন, ‘শোনো গো সজনী, পোহাল রজনী, দুখনিশি হল যে ভোর হে।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম পংক্তিগুলি যখন এক মায়াময় ঊষার প্রাকৃতিক পটভূমিতে ফুটে উঠতে থাকে, তখনও অনিশ্চিত— কে লিপ্ দিচ্ছেন। কিন্তু কণ্ঠের এমনই জাদু, শুরু থেকেই আমাদের মনের মধ্যে বাজতে থাকে, আহা, উত্তম...!

কিন্তু, না! অচিরেই দেখা যায়, পর্দায় রয়েছেন কিন্তু লিপ্ দিচ্ছেননা উত্তমকুমার। এক বৃদ্ধ বৈষ্ণব গান গাইছেন, উত্তমকুমার দূরে দাঁড়িয়ে, সুপ্রিয়া দেবীর মুখোমুখি।ঘাড়টি ঘুরিয়ে নায়ক একবার-দু’বার দেখলেন, শুনলেন গানটি, তারপর মুখটি ফের ঘুরিয়ে নিলেন নায়িকার দিকে।

কেমন আশ্চর্য একটা বিষণ্ণতা উঁকি দেয় এই গানটি শুনতে শুনতে। সবে ১৯৬৮, এইতো আগের বছরেও ‘নায়িকা-সংবাদ’ ছবিতে ‘এই পূর্ণিমা রাত’ গানে উত্তম-হেমন্ত রসায়ন ম্যাজিক তৈরি করেছে! ’৬৬তে নায়কের কণ্ঠদানে মান্না দে সফল হয়েছেন ঠিকই— কিন্তু তাই বলে হেমন্ত ছবিতে অংশ নিচ্ছেন তবু সে-গান অন্য লোকের ঠোঁটে আরউত্তম নীরব দর্শক, একই ছবিতে গান গাইবেন অন্য গায়কের গলায়— এতটা প্রথম ধাক্কায় মানতে কষ্ট হয়নি কি দর্শকদের?

দু’জনের এই দ্বন্দ্বের মোট তিনটি কারণ লেখক উল্লেখ করেছেন। এক, হেমন্তর শর্মিলা ছিল নায়িকা-প্রধান, কম বাজেটের, ছোট ব্যানারের ছবি। দুই, ছবিটি সফল হলে বিশ্বজিতের মতো উত্তমকুমারকেও হিন্দী ছবিতে ‘প্রতিষ্ঠা’ দেবার কৃতিত্ব পাবেন হেমন্ত, উত্তম সেখানে গৌণ হয়ে যাবেন। এবং, আমার, এবং, আমার মনে হয়, সৌরভবাবুরও, মতে উত্তম যে চরম অসৌজন্যতা হেমন্তর প্রতি দেখিয়েছিলেন, তার পেছনে ছিল সেই ফরাসী প্রবচনঃ cherchez la femme, ‘নারীটির সন্ধান করুন’! এবং সে নারী সুপ্রিয়া দেবী, যাঁর বাড়ীতে হেমন্ত কলকাতার স্টুডিওর কাজ সেরে মধ্যাহ্নে বিশ্রাম নিতেন। লেখকের কথায়ঃ

সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে প্রবল অধিকারবোধ ছিল উত্তমকুমারের। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থেকে নমুনা মেলে, তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিয়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সামান্যতম ঘনিষ্ঠতা এমনকী অধিক সৌজন্য পর্যন্ত দেখালে ছেলেমানুষের মতো ক্ষুণ্ণ হতেন মহানায়ক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও সম্ভবত জানতেন একথা, গুরুত্ব দেননি। ফলত তাঁকে ঘিরেও কি দূর গগনে কোনও মেঘ ঘনিয়েছিল? সুপ্রিয়া বলিউডে কাজ করতে যান, এ না-পসন্দ ছিল উত্তমের। সুপ্রিয়া কিছুটা তাঁকে অমান্য করেই হেমন্তর ডাকে বোম্বেতে গিয়েছিলেন। প্রিয় নারীর এহেন অবাধ্যতা, তাও আবার এমন পুরুষের প্ররোচনায়—যাঁর সঙ্গে ওই বোম্বের ছবি করা নিয়েই সদ্য মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে নায়কের নিজের— এর পুরো ক্রোধটি কি গিয়ে পড়েছিল ধুতি-শার্ট পরা দীর্ঘকায় মানুষটির ওপরেই?

এই প্রসঙ্গ শেষ করছি আবার লেখকের, আমার বিচারে, নির্ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েঃ

ইতিহাস শুধু বলছে— এত কিছুর মধ্যেও যখনই উত্তমকুমারের জন্য গাইতে ডেকেছেন কোনও সঙ্গীত-পরিচালক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন আমন্ত্রণ। এমন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাক্ষ্যও পাওয়া যায়না যেখানে অভিমান-ক্রোধ মনে রেখে— উত্তমের ছবিতে অন্য অভিনেতার কণ্ঠে, এমনকী খোদ উত্তমের হয়েও— নেপথ্য-কণ্ঠদানে ‘অসম্মত’ হয়েছেন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এমনকী, উত্তম-অভিনীত ছবির সুরারোপ পর্যন্ত করেছেন, সে-সবের মধ্যে এমন ছবিও আছে যেখানে হেমন্তর নিজের গাওয়া গানে লিপ দিচ্ছেন অন্য অভিনেতা।

আমাদের মনে হয়, এই হল আদর্শ পেশাদারের মতো কাজ; সব আঘাত সব রক্তপাত জামার নীচে লুকিয়ে রেখে, শুধু কাজটুকুকেই চূড়ান্ত গুরুত্ব দেওয়া।

দুঃখের সঙ্গে আমরা মানতে বাধ্য, নায়ক সেই উদাহরণ রাখতে পারেননি সবসময়। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে তেমনটাই উঠে এল।

এক হেমন্ত-পূজারী হিসেবে সৌরভবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানাব, বাস্তবে যা হয়নি, কল্পনার জগতে তা’ ঘটানোর জন্য। তাঁর সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া উপন্যাসে বয়স ও ব্যাধি-বিদ্ধস্ত অভিনেতা নীহার চট্টোপাধ্যায় লিখিত স্বীকারোক্তি রেখে যাচ্ছেন গায়ক মণিময়কে অন্যায়ভাবে সন্দেহ করে তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির ব্যাপারেঃ “তখন সত্যিই আমার কবচকুণ্ডল … খুইয়েছি … মণিদাকে ছেঁটে ফেলেছি নিজেই …” (পৃঃ ১৪৬) ।

২। ‘বিবিধ গানে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রবন্ধে (প্রহর ওয়েব পত্রিকা, ২০২০) রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলার কবি-গীতিকারের যেসব গান হেমন্ত গেয়েছেন, তাই নিয়ে আলোচনা আছে। ১৯৫৯-এ পরিচালক তপন সিংহ তাঁর ক্ষণিকের অতিথি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হেমন্তকে দিয়ে গাওয়ান অতুলপ্রসাদের ‘কে তুমি বসি’ নদীকূলে একেলা’। সৌরভবাবু এই গানটি নিয়ে বেশী কিছু বলেননি, কিন্তু আমার কাছে গানটির প্রয়োগ এবং গায়নভঙ্গী অসাধারণ। সাধারণত একটু দ্রুত লয়ে, গলা খেলিয়ে গানটি গাওয়া হয়। কিন্তু, ছবির এবং সঙ্গীতের পরিচালক দুজন মিলে গানটির মাধ্যমে সৃষ্টি করলেন উদাস করে দেওয়া, চাপা বিষণ্ণতায় ভরা এক অনবদ্য আবহ। কারণ গানটি তো গাইছে কোন আসরের ওস্তাদ গায়ক নয়, হাসপাতালের শয্যায় শায়িত একজন রোগী! দুর্ভাগ্যক্রমে, রেকর্ডে গানটির আস্থায়ী অসম্পূর্ণভাবে গাওয়া হয়েছে, ছায়াছবিতে ঠিক যেভাবে আছে। যেহেতু সে যুগে সরাসরি ছবির ‘সাউন্ড-ট্র্যাক’ থেকে গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি করা হত না, গায়নভঙ্গী অপরিবর্তিত রেখে সম্পূর্ণ আস্থায়ীটি কি রেকর্ড করা যেত না?

সৌরভবাবুর শ্রবণ এবং মন কেড়েছে অপর পিঠে, ৭৮ গতির রেকর্ড করার উদ্দেশে গাওয়া, ‘জল বলে চল, মোর সাথে চল’ঃ ‘বিশেষত, দ্বিতীয় গানটির তিনটি সপ্তকেই [হেমন্তর] কণ্ঠ এত সুখকর বিচরণ করেছে – ঈষৎ দ্রুত লয়েই, কিন্তু অভিঘাতে মোক্ষম!’ এর পরেই লেখক দাবী করেছেন যে এ-গান হেমন্তর অন্য গানের মতো খুব জনপ্রিয় হয়নি বা তেমন বাজার পায়নি। ‘তাই, তখনও হেমন্তর সাঙ্গীতিক ভুবনে এই জঁর তেমন পাকাপোক্ত আসন পেল না।’ কিন্তু অন্যরকম তথ্য দিচ্ছে ১৯৮৩-র পরিবর্তন পত্রিকার ৬ষ্ঠ বর্ষের ২২শ সংখ্যা। ১৬ নং পৃষ্ঠায় আছে গ্রামোফোন কোম্পানির পি কে ব্যানারজির সৌজন্যে প্রাপ্ত হেমন্তর ‘কালজয়ী কিছু হিট রেকরডের তালিকা’। একুশটি রেকর্ডের এই তালিকায় ১৮ নম্বরে পাই ‘কে তুমি বসি’ নদীকূলে, [এবং] জল বলে চল’! সত্যিই তো, বাজার-সচেতন রেকর্ড কোম্পানি ছায়াছবির একটিমাত্র গান যদি সেভাবে জনপ্রিয় না হয়, তাহলে আরেকটি গান তার অপর পিঠে রেকর্ড করিয়ে সেটি বাজারে ছাড়বে কেন? স্মর্তব্য, ১৯৫১ সালে হেমন্ত-সুরারোপিত ছবি জিঘাংসা-র একটিমাত্র গান – সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আমি আঁধার, আমি ছায়া’ – এতটাই জনপ্রিয় হয় যে হেমন্তকে দিয়ে তার অপর পিঠের জন্য সৃষ্টি করতে হয় একটি ‘বেসিক’ আধুনিক গান, ‘ভরা ঘট ছলছলি’! এই যুক্তি প্রমাণিত হয় সৌরভবাবুর নিজেরই পরের মন্তব্যেঃ

আরও পাঁচ বছর লেগে গেল পরের ধাপটি পেরোতে। ১৯৬৪ সালে ‘আরোহী’ ছবিতে গাইলেন দ্বিজেন্দ্রলালের গান – ‘তোমারেই ভালবেসেছি আমি’। খুব জনসমাদৃত হয়নি ছবি গান কোনোটিই, এবার আর নন-ফিল্মও কিছু হল না।

(প্রসঙ্গত, তপন সিংহ তাঁর প্রথম দিকের একাধিক ছবিতে হেমন্তকে শুধুই সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন তা নয়, দেখা যাচ্ছে যে হেমন্তকে তাঁর comfort zone-এর বাইরে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন রকমের গান গাইয়েছেন। উদাহরণ শুধু ক্ষণিকের অতিথি বা আরোহী নয়, হাঁসুলীবাঁকের উপকথা-ও! তরুণ মজুমদারও পলাতক থেকে শুরু করে এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটি বারবার করবেন, হেমন্তর আপত্তি সত্ত্বেও – এবং তার সুফল ভোগ করেছি আমরা সবাই!)

দীর্ঘ ছ’ বছর পরে, ১৯৭০-এ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন-এ শোনা গেল তিনরকম ‘বিবিধ’ গানঃ রজনীকান্তের ‘আমি অকৃতী অধম’, দেশবন্ধুর স্বরচিত ‘নামিয়ে নাও এ জ্ঞানের বোঝা’-র আস্থায়ীটুকু, এবং সংলাপের নেপথ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’-এর অংশ (যা সম্পূর্ণরূপে হেমন্ত গেয়েছিলেন ১৯৫১ সালে হিন্দী আনন্দমঠ ছবিতে, এবং যা তিনি আবার এক বছরের মধ্যে আবার গাইবেন বাংলা মহাবিপ্লবী অরবিন্দ ছবিতে, দুবারই ভিন্ন-ভিন্ন সুরে) ।

১৯৭৩-এ রজনীকান্তের গানের একটি লং-প্লে সংকলনের জন্য কান্তকবির দৌহিত্র দিলীপকুমার রায়ের পরিচালনায় হেমন্ত গাইলেন ‘ওই বধির যবনিকা’ এবং তালবিহীনভাবে ‘আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে’। সৌরভবাবুকেই উদ্ধৃত করিঃ

সেই মধ্য-সাতের দশকে তাঁর গম্ভীর নিনাদী কণ্ঠ আর বয়সোচিত গভীর অভিব্যক্তি এই দুটি গানকে এক আশ্চর্য মাত্রা দিয়েছিল। বিশেষত ধীর লয়ে … গাওয়া ‘আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে’ গানটি স্মরণীয় হয়ে আছে। নিবিষ্ট রসিকরা খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন।

দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে পরিচিতি থাকার সুবাদে তাঁর স্বীকারোক্তি শুনেছিলাম যে প্রশিক্ষণ দেবার সময় হেমন্তর গায়ন তাঁকে অপ্রত্যাশিতভাবে মুগ্ধ করেছিল। এই গানদুটি এতটাই জনসমাদর পায় যে ১৯৭৪ সালের ২৪শে নভেম্বর মাসে আকাশবাণীতে রাত ৮ঃ৪৫ মিনিটে হেমন্ত পরিবেষণ করেন তিনটি রজনীকান্তের গান। দ্বিতীয় গান ছিল ‘ওই বধির যবনিকা’ আর তৃতীয় গান পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠে বহুশ্রুত ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে’। আসল চমক হেমন্ত দেন প্রথম গানটির নির্বাচনে। রজনীকান্ত ভক্তিমূলক গানের জন্যই বিখ্যাত। হেমন্ত বাছেন কান্তকবির অল্পসংখ্যক প্রেমের গানের একটিঃ ‘স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি’! এই রেকর্ডিংটি আজ অবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি – আমার মতো হেমন্ত-পূজারীদের পক্ষে চরম দুর্ভাগ্যের কথা, কারণ তিনি যা গেয়েছিলেন তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই!

১৯৭৬-এ আরেকটি লং-প্লে সংকলনের জন্য হেমন্ত গাইলেন সেই ১৯৭০-এ প্রথম গাওয়া ‘আমি অকৃতী অধম’ আর ‘দেখ দেখি মন নয়ন মুদে’। প্রথম গানটি আমি দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠে এর আগে শুনেছি, কিন্তু আমি সৌরভবাবুর সঙ্গে একমত যে হেমন্তর ‘আগে, সমসময়ে বা পরেও – এইসব গান এর চেয়ে অধিক মর্মস্পর্শী অভিব্যক্তিতে আর কেউ গাইতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।’ ইংরেজ সাহিত্যগুরু ডাঃ স্যামুয়েল জনসন কবি টমাস গ্রে-র Elegy Written in a Country Churchyard কবিতাটির প্রশংসা করতে গিয়ে যা বলেছিলেন, তা সামান্য পালটে নিয়ে আমার বলতে ইচ্ছে করেঃ If he often sung thus, it would be vain to blame and useless to praise him! তাঁর প্রতিবেদনের শেষে ‘আমি অকৃতী অধম’ নিয়ে সৌরভবাবুর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই মনোভাবের ওপরেই সীলমোহর দেয়।

রজনীকান্তের গান নিয়ে শেষ তথ্যঃ ১৯৭৭ সালে দিন আমাদের ছবিতে রঞ্জিত মল্লিকের নেপথ্য কণ্ঠ হিসেবে হেমন্ত আমাদের উপহার দেন আরেকটি ব্যতিক্রমী, এবার হাসির, গানঃ ‘যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে র’তো’, যেখানে এক জায়গায় রঞ্জিত মল্লিক অভিনীত চরিত্রটির নামের জন্য ‘কান্ত আর খেতে পাবে না’-র বদলে হেমন্ত গেয়েছেন ‘তপু আর খেতে পাবে না’!

এর মধ্যে, ১৯৭৫ সালে অগ্নীশ্বর ছবিতে হেমন্ত, সঙ্গে সমবেত কণ্ঠ নিয়ে, অত্যন্ত সফলভাবে গাইলেন দ্বিজেন্দ্রগীতি ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’। সৌরভবাবু শুরুর শব্দতে ‘সামান্য ত্রুটি’-র কথা বলেছেন। আমি বড় হয়েছি কবিপুত্র দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠে গানটি শুনে; তিনিও গেয়েছেন ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’! সকলের সুবিধার্থে ইউটিউবে গানটির লিঙ্ক আর তার সঙ্গের মন্তব্য এখানে দিলামঃ

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা গানটা “ধনধান্য পুষ্প ভরা” নাকি “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা? কোনটা সঠিক? “ধনধান্যে পুষ্পে” কি গাওয়ার ভুল নাকি “ধনধান্য পুষ্প” ছাপার ভুল, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। … তর্কের মীমাংসা হবে কিনা জানি না তবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুযোগ্য পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের কণ্ঠে গানটা শুনে নেওয়া যাক...https://www.youtube.com/watch?v=QuT0LrNeWu0

এরপরেই আমি সৌরভবাবুর সঙ্গে দ্বিমত হবো। তিনি সঠিকই লিখেছেন যে ১৯৭৮ সালে হেমন্ত প্রথম কোনও ছবিতে (বারবধূ) নজরুলগীতি গাইলেন। কিন্তু এর অনেক আগেই, ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, তিনি বেতারে রাত ১০ঃ৫০ মিনিটে পরিবেষণ করেছিলেন দুটি নজরুলগীতি, যার মধ্যে প্রথমটির স্বরলিপিও, এখন জানা গেছে, তিনি নিজে করে রেখেছিলেনঃ ‘সেদিন বলেছিলে, সেই সে ফুলবনে,/ আবার হবে দেখা, ফাগুনে তব সনে।’ দ্বিতীয় গানটি ছিল গজল-ধর্মী ‘পথ চলিতে, যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণপ্রিয়’। গান নির্বাচন এবং গায়ন এককথায় নিখুঁত । আমার মনে হয়, ১৯৭৩-এ রজনীকান্তের গান রেকর্ড করে সাফল্য পাবার পর, এবং বিভিন্ন সময়ে রজনীকান্তের গান গাইবার অনুরোধ পাবার পর – আমি নিজে রবীন্দ্র সদনে এবং চন্দননগরের জ্যোতি সিনেমায় এই অনুরোধ করেছিলাম, তবে অনুষ্ঠানগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছিল বলে হেমন্ত সে অনুরোধ রাখেন নি – তিনি ১৯৭৪-এর শেষ থেকে প্রথমে রজনীকান্ত এবং পরে নজরুল এবং – ১৯৫৯-এর পর এই প্রথম – অতুলপ্রসাদের গান গাইতে সচেষ্ট হন।

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬-এর মধ্যে বেতারে হেমন্ত রাত ৮ঃ৪৫-এ পরিবেষণ করেন যথাক্রমে দুটি অতুলপ্রসাদের গান এবং আরও দুটি নজরুলগীতি। চারটির একটি গানও, প্রবল প্রত্যাশা সত্ত্বেও, বর্তমান প্রতিবেদকের হৃদয়স্পর্শ করতে পারেনি। এবং চারটির ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে নজরুলগীতি দুটির, সৌরভবাবুর ব্যাখ্যা নির্ভুলঃ এক, হেমন্তর কণ্ঠে ধ্রুপদী রেওয়াজ বা তালিম-প্রাপ্ত গায়নশৈলীর অভাব, দুই, সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধের আগেই তাঁর সমসাময়িক, এমনকি অনুজ, শিল্পীরাও নজরুলগীতিতে বিশেষ করে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। সেখানে অপেক্ষাকৃত সরল ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, বা ‘আমার গানের মালা আমি করব কারে দান’-এর জায়গায় ‘বসিয়া বিজনে, কেন একা মনে’ বা ‘এ কী সুরে তুমি গান শোনালে’ নির্বাচন করা হেমন্তর বিবেচনার অভাবই প্রকট করে। মুক্তি-না-পাওয়া লায়লা-মজনু ছবির ‘লায়লি তোমার এসেছে ফিরিয়া’, যেমন সৌরভবাবু বলেছেন, তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু নয়।

এই প্রসঙ্গে প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে শোনা ঘটনার কথা বলি। প্রয়াত হেমন্ত-ভক্ত বরুণ বক্সীর বাড়িতে সান্ধ্য-ভোজে আমন্ত্রিত ছিলেন সুনীল। আলোচনা চলছিল হেমন্তর অপেক্ষাকৃত অল্পশ্রুত গান নিয়ে। সুনীল বলেন যে তিনি বারবধূ ছবির চিত্রনাট্য রচনা করার পর নির্মাতারা স্থির করেন যে যে দুটি নজরুলগীতি আছে, সেগুলি গাইবেন মান্না দে। কিন্তু ‘চোখ গেল, চোখ গেল’ গাইতে হবে শুনেই মান্না দে ‘শচীনকর্তার’ দোহাই দিয়ে অব্যাহতি চান! তখনই ভাবা হয় হেমন্তর কথা। দ্বিতীয় গানটি – ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’ – কয়েক বছর আগেই হেমন্ত যথেষ্ট সফলভাবে বেতারে গেয়েছেন, আর ছবিতে গানের একটি স্তবক বাদও দেওয়া হয়। ‘চোখ গেল, চোখ গেল’ কি হেমন্ত ১৯৭৮ সালের এই ছবিটির প্রেক্ষিতে এক ধরণের ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে গ্রহণ করেন, গানটি তাঁর অন্যতম আদর্শ গায়ক-সুরকার শচীন দেববর্মনের গাওয়া বলে? ১৯৭৬-এ তো মহালয়ায় ‘দেবিং দুর্গতিহারিণীং’ আলেখ্যতে তিনি সুরারোপ করেন সম্ভবত আরেক ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবেই। এতদিনে প্রয়াত বিকাশ রায়ের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছিঃ

১৯৪৪ সালে হঠাৎ শোনা গেল পঙ্কজ মল্লিক সেবারের মহিষাসুর মর্দিনীর অনুষ্ঠান থেকে সরে যাচ্ছেন, রেডিও কর্তাদের সঙ্গে কোনও মতবিরোধের দরুণ। … বীরেনদা … বাণীকুমার, দক্ষিণামোহন ঠাকুর এরা সবাই আলোচনায় বসলেন। এমন কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে যিনি সব গানগুলি মোটামুটি জানেন। তিনজনেই স্থির করলেন হেমন্তবাবুর নাম … এই গুরুদায়িত্ব কিন্তু হেমন্ত যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে পঙ্কজবাবু ফিরেছিলেন কিন্তু কতগুলো গানে হেমন্তবাবুর করা সুরগুলোই রেখে দিয়েছিলেন, সেটা আজ আর কেউ জানে না।

‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ঃ শতবর্ষে শতস্মৃতি’, সম্পাদনা জয়দীপ চক্রবর্তী (কলকাতাঃ আজকাল, ২০১৯) পৃঃ ৬১

সৌরভবাবু মত দিয়েছেন যে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫, যখন হেমন্তর কণ্ঠমাধুরী, দম ও সপ্তকবিহারের সাবলীলতা ছিল শীর্ষে, সেই সময় উচিৎ ছিল ‘তাঁর মীড় ও স্পর্শস্বর-সমৃদ্ধ সতেজ কণ্ঠের চলনের সঙ্গে মানানসই’ কিছু নজরুলগীতি রেকর্ড করানো। এইরকম সময়েই কি মহাজাতি সদনে ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র হেমন্তকণ্ঠে শুনেছিলেন ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী’, যে কথা তিনি বলেছিলেন সম্ভবত আনন্দলোক পত্রিকায়? ১৯৬২-তে দাদাঠাকুর ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার পর নাকি কোন এক অনুষ্ঠানে শোনা গিয়েছিল হেমন্তকণ্ঠে ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু’ (ছবিতে গানটি আছে সুলতা চৌধুরীর মুখে, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্যদের কণ্ঠে) । আর শঙ্করলাল ভট্টাচার্যকে সাক্ষাৎকারে হেমন্ত বলেছিলেন বেতারে ‘মেঘলা নিশিভোরে’ গাওয়ার কথা।

বেতারে পরিবেষিত অতুলপ্রসাদের গান দুখানিও মন ছুঁতে পারে নিঃ ‘কেন এলে মোর ঘরে আগে নাহি বলিয়া’ আর ‘তব অন্তর এত মন্থর’। অথচ, মনে করুন, সেই ১৯৫৯-এ মন পাগল-করা ‘কে তুমি বসি’ নদীকূলে একেলা’! বছর ছয়েক পরে, ১৯৮২-তে, তরুণ মজুমদার তাঁর খেলার পুতুল ছবিতে রাখলেন নেপথ্যে হেমন্তকণ্ঠে ‘ক্রন্দসী পথচারিণী’-র আস্থায়ী ও অন্তরা। রেকর্ড/ক্যাসেটে পাওয়া গেল গানের আভোগও, সঞ্চারী সম্পূর্ণ বাদ! সৌরভবাবুর সঙ্গে একেবারে সহমতঃ ‘গলায় বার্ধক্য থাবা বসিয়েছে, কিন্তু ধীরলয়ের গানটিতে অতি অপরূপ দরদী অভিব্যক্তি – যা একান্তভাবে তাঁর স্বকীয় গুণ।’ পরের বছর আবার অতুলপ্রসাদের ‘আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে’চেনা অচেনা ছবিতে। প্রথমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-অভিনীত চরিত্রের অপেক্ষাকৃত কম বয়সে গানটির আস্থায়ী শোনা গেছে দ্রুত লয়ে, উৎফুল্ল গায়কীতে। সম্পূর্ণ গানটি আসবে ছবির দ্বিতীয়ার্ধে, চরিত্রটি যখন পরিণত-বয়স্ক। সৌরভবাবুর মূল্যায়ন নির্ভুলঃ ‘বাচনভঙ্গি পর্যন্ত কিঞ্চিৎ জরাগ্রস্ত শোনায় এখানে, শ্বাসের সংকট, তবু এমন অননুকরণীয় ভাব-প্রকাশ, সামান্য ডিলে-অনুরণন সমেত এক আশ্চর্য বিষণ্ণ-মধুর কণ্ঠস্বর – সব দুর্বলতা ছাপিয়ে স্তব্ধ করে রাখে শ্রোতাদের।’ ১৯৮৫ সালে অজান্তে ছবিতে অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর সঙ্গে ‘কেন এলে মোর ঘরে’ সেই সত্তরের দশকে একক কণ্ঠে পরিবেষণার চেয়েও, আমার কাছে, হতাশাব্যঞ্জক। গলায় সপ্তকের সব পর্দাগুলি লাগছে না। এমতাবস্থায় ছবির অন্য গানগুলি যেহেতু ব্যঙ্গাত্মক (‘ওই ঝান্ডাটা নামিয়ে, গলাবাজি থামিয়ে’ বা ‘আমার ল্যাজও নেই শিঙও নেই’) এই ত্রুটি সেগুলিতে তেমন কাণে লাগেনি) কিন্তু অতুলপ্রসাদের গানে, বিশেষ যেখানে সহশিল্পীর গলায় প্রতিটি সুর সঠিক লাগছে, হেমন্তর গায়ন বেশ দায়সারা লেগেছে। সৌরভবাবুর সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।??

এই চার কবির বাইরেও হেমন্তকণ্ঠে আমরা পেয়েছি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে’, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’খানি গান, প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের ‘শুভ আশীর্বাদ দানে’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের গান, সুরারোপ করে গাওয়া সজনীকান্ত দাস, কুমুদরঞ্জন মল্লিক এবং কালিদাস রায়ের কবিতা, জয়দেব ও বিদ্যাপতির গান, কালিদাসের শ্লোক, স্বামী সত্যানন্দের গান – তালিকা সম্পূর্ণ করা প্রতিবেদকের সাধ্যের বাইরে।

এখন ইউটিউবে ‘আনন্দধারা’ নামক চ্যানেলের সৌজন্যে হেমন্তর বহুমুখী সঙ্গীতচর্চার নিদর্শন, অনেক ক্ষেত্রে মূল্যবান ধারা-বিবরণী সম্বলিত, সহজলভ্য হয়েছে।

সবার শেষে উল্লেখ করতেই হবে ১৯৭৮ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এবং অপর্ণা দেবীর কয়েকটি কবিতা হেমন্তকে দিয়ে সুরারোপ করিয়ে বিভিন্ন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ানোর প্রচেষ্টার। হেমন্ত একক কণ্ঠে গেয়েছেন সেই ‘নামিয়ে নাও জ্ঞানের বোঝা’ – ১৯৭০-এর ছায়াছবির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা সুরে ও লয়ে। দ্বিতীয় একক গানটি যে একটি চতুর্দশপদী কবিতা বা ‘সনেট’-এর সুরারোপিত রূপ, সৌরভবাবু না দেখিয়ে দিলে প্রতিবেদকের মাথায় কখনোই আসত না। তাঁর সঙ্গে আমি পূর্ণ সহমত যে ‘মন্দ্র-গম্ভীর সপ্তকে বাঁধা ‘আমার এ প্রেম’ গানটি শুনলে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকতে হবে।’ এককালে, যখন কণ্ঠে সুর ছিল, বিভিন্ন বন্ধু-পরিচিতদের সমাবেশে এই গান গেয়ে অনেককেই চমৎকৃত করেছি!

তবে, হেমন্তর বিবিধ গান সম্পর্কে শেষ – এবং মোক্ষম – কথা অবশ্যই সৌরভবাবুর বলা। তা এতই ব্যক্তিগত এবং মর্মস্পর্শী যে প্রতিবেদক তাঁর বিরুদ্ধে ‘ইমোশনাল অত্যাচার’-এর অভিযোগ এনে এই প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা শেষ করছে।

৩। ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাল হয়নি?’ (যুগ, বইমেলা সংখ্য, ২০২০)

এই ভুয়ো-উন্নাসিকতার যা ক্ষুরধার বিশ্লেষণ সৌরভবাবু করেছেন তা নিয়ে পূর্ণ সহমত পোষণ করা ছাড়া খুব বেশি কিছু করার থাকে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত সিংহভাগ বাঙালীকে কারা ভালবাসতে শিখিয়েছেন প্রশ্ন করলেই সবার আগে উঠে আসবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম – এবং তারপর, এই প্রতিবেদকের মতে, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ও সাগর সেনের। যে সব বিচিত্র জীবেরা ‘হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত ঠিক পিওর রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়নি, আধুনিক গান হয়ে গেছে’ বলে, সৌরভবাবুর ভাষায় ‘স্নব ঠোঁটদু’টি’ বাঁকান, তাদের মধ্যে কিন্তু আছে কিছু নমস্য ব্যক্তিত্বের নাম! ঠিক এই কথা আমি শুনেছি পন্ডিচেরীর শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে রবীন্দ্র-সাহচর্য এবং আশীর্বাদ-ধন্যা সাহানা দেবীর মুখেঃ “গলা ভাল, আধুনিক গাইলেই পারে!” এবং এই মতের সমর্থনে বলা হয় যে হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সঠিক সুরে’ গান নি! সত্তরের দশকে, এক ২৩শে জানুয়ারি, রবীন্দ্র সদনে হেমন্ত গাইছেন ‘আগুনের পরশমণি’। সঞ্চারীতে এসে ‘আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব’ লাইনটিতে ‘পরশ তব’ হঠাৎ একটু অন্যভাবে গেয়েছিলেন। স্বরলিপি কঠোর ভাবে মেনে ‘গগনে গগনে আপনার মনে’ গাইতেন না বলে দীর্ঘকাল ঐ গানটি রেকর্ড করার অনুমোদন বিশ্বভারতী তাঁকে দেয়নি।



সৌরভবাবু আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে স্বরলিপি-বিচ্যুতি পাওয়া যাবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বৃদ্ধ বয়সের রেকর্ডিঙে, এবং তার সমর্থনে ‘স্রষ্টা নিজে যা খুশি করুন গে’ একটা গা-জোয়ারি কুযুক্তি ছাড়া কিছু নয়। আসলে হেমন্তর বিরুদ্ধে যে সরলীকরণের অভিযোগ তোলা হয় সেটাই তাঁর রবীন্দ্র-গানে সফলতার চাবিকাঠি। সৌরভবাবুর ভাষায়, ‘স্বরলিপির যান্ত্রিক নিক্তি-মাপা শুদ্ধতার চেয়ে অভিব্যক্তির প্রাণময়তার ওপরেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন, কী সৌভাগ্য যে তিনি অমন দৈব কণ্ঠের দরদ-মীড়-স্পর্শস্বরের ওপর চালাননি প্রাতিষ্ঠানিক যান্ত্রিকতার স্টিমরোলার!’ আর ঠিক এই কারণেই প্রতিষ্ঠানের যে সব স্বনিযুক্ত অভিভাবকেরা রবীন্দ্রনাথের গানকে বাঙালীর দৈনন্দিন সম্পদ করে তোলায় হেমন্তর সাফল্যের সিকিভাগও অর্জন করতে পারেননি, তাঁদের একমাত্র আত্মশ্লাঘার উপায় হয়েছে ‘সমবেতভাবে হেমন্তকে ব্রাত্য মন্ত্রহীন পথভ্রষ্ট ঘোষণার … রাজনীতি।’

প্রায় ষাট বছর বয়সে তরুণ মজুমদারের নির্বাচনে এক কিশোর-যুব চরিত্রের কণ্ঠ হয়ে যখন হেমন্ত গাইলেন ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’, তখন প্রেক্ষাগৃহে বসে যে অনির্বচনীয় ভাবাবেগের অভিজ্ঞতা এই প্রতিবেদকের হয়েছিল, তার নির্ভুল বর্ণনা সাধারণভাবে দিয়েছেন সৌরভবাবুঃ ‘ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁয়া দিয়ে আড়াল করতে যাননি বলেই [হেমন্ত] একেবারে অ-প্রথাগত, স্বচ্ছ-সহজ ভঙ্গিতে চরণ ছুঁয়ে ফেলেছেন!’

(ক্রমশ)