কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

পঙ্কজকুমার চ্যাটার্জি

 

বিজন ভট্টাচার্য এবং দেবীগর্জন




বিজন ভট্টাচার্য কলম ধরেছিলেন দেশভাগ ও মন্বন্তরের পটভূমিকায়, বাঁক বদল ঘটিয়েছিলেন বাংলা নাট‍্য সাহিত‍্যের। তাই বিজন ভট্টাচার্যের নাটক আলোচনার আগে জেনে নিই তাঁর নাটক রচনার কাল ও পরিসর।

১৯৩৯ – ১৯৪৭ সাল, একদিকে বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসী প্রভাব অন‍্যদিকে আভ‍্যন্তরীণ রাষ্ট্রবিপ্লব – এই দুয়ে মিলে বাঙালির সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। এসব কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর্ব শেষে এল মহাপ্রস্থানের পথে অর্থাৎ দেশভাগ। অসহায় অগণিত ছিন্নমূল মানুষ পুরনো শিকড় ছেড়ে পাড়ি দিল আরো অন্ধকার অনিশ্চয়তার পথে। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ বাঙালির জীবনকে করাল বিপর্যয়, কুৎসিত বিভীষিকার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে সামাজিক পারিবারিক পরিবর্তনকেও ত্বরান্বিত করল। বাঙালি পরিবারের আদর্শের বদল ঘটল, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেল, শ্রম ও বিত্তের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠল, মেয়েদের গৃহলালিত লজ্জা খসে গেল, সর্বোপরি বেদনা ও বঞ্চনা তাদের নিত‍্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়াল। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়ল সংস্কৃতি জগতেও। ছায়াসুনিবিড় গ্রামের পটভূমি বদলে গেল শ্রীহীন কোলাহলময় শহরতলিতে, নাট‍্যকার‌ও অভিনিবেশ করলেন জীবনের রূঢ় সত‍্য প্রতিষ্ঠায়। এবং এর সঙ্গে নাট‍্যকার বিষয়ের গুরুত্বকে অতিক্রম করে আঙ্গিকের অভিনবত্বের ব‍্যাপারে ঝুঁকলেন। পরিচিত রূঢ় বাস্তব ভরা কাহিনি নয়, তার উপযুক্ত সাধারণের জন‍্য বাহুল‍্য বর্জিত বাস্তব মঞ্চ‌ই দর্শককে আকর্ষণ করবে – এই ভাবনা থেকেই নাটকগুলিতে দর্শকের সঙ্গে সমন্বয় করার প্রয়াস দেখা দিল। এবং এই ভাবনা থেকেই নাট‍্যসাহিত‍্যের ইতিহাসে গণনাট‍্যের জন্ম দিল। অর্থাৎ গণনাট‍্যের উদ্ভব ঘটল সমাজমানসের এক রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকারণে। বাংলাদেশ থেকে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’র পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, বিনয় ঘোষ, শম্ভু মিত্র এবং বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ। এদের প্রচেষ্টায় এখান থেকেই সর্বভারতীয় সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে “Indian People’s Theater Association” বা ভারতীয় গণনাট‍্য সংঘ।

বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ নাটকের মধ‍্য দিয়ে এই ভারতীয় গণনাট‍্য সংঘের পথচলা শুরু হয়েছিল। চল্লিশের দশকে এসে গণনাট‍্য এবং বিজন ভট্টাচার্য প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের নাট‍্যজীবনে ২৬টি নাটক রচনা করেছেন। এই পটভূমিকায় বিজন ভট্টাচার্যের ‘দেবীগর্জন’ নাটক নিয়ে আলোচনা থাকল।

নির্যাতিত নিপীড়িত সাঁওতাল আদিবাসী কৃষকদের জোতদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিত্র প্রকাশ পেয়েছে এই ‘দেবীগর্জন’ নাটকের মধ‍্যে দিয়ে। জমিদার প্রথার বিলোপ হলেও মধ‍্যস্বত্ত্বভোগী প্রভঞ্জন সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পঞ্চায়েতি প্রথাকে পিছনে রেখে কৃষকদের জমি নিজের দখলে করে নেন। এদিকে কৃষি ঋণ ও সুদ জোগাতে দরিদ্র আদিবাসী কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়। অবশেষে এই ব‍্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তারা, নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়।

‘নবান্ন’ নাটকে বিজন ভট্টাচার্য অসহায় কৃষকদের এবং অত‍্যাচারী হারু দত্তকে দেখালেও কৃষকদের অসহায়তার মূল কারণ হিসাবে দেখিয়েছিলে প্রতিকূল প্রাকৃতিক শক্তি কে। তবে সেখানেও ‘নবান্ন’ উৎসবের মধ‍্য দিয়ে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সফল লড়াই চিত্রিত হয়েছে। আর ‘দেবীগর্জন’ নাটকেও লড়াই শোষকের বিরুদ্ধে তার অত‍্যাচারের বিরুদ্ধে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিন অঙ্কের এগারোটি গর্ভাঙ্কে ‘দেবীগর্জন’ হয়ে উঠেছে সার্থক গণনাট‍্য। এখানে ‘আমি রাজা আমার‌ই নীতি ইটাই রাজনীতি’ প্রভঞ্জনের এই কথায় যেমন সমকালীন জোতদারের মুখোশ খুলে যায়, ধর্মগোলার মজুত ধানের বিতরণের দাবিতে চাষিদের সঙ্গে জোতদারের বিরোধ বাঁধে তখন মংলার চেতনায় প্রশ্ন জাগে – ‘কে রাজা, কার রাজ‍্য ?’ এটাই গণনাট‍্যের মূল। নাটকের শেষে সঞ্চরিয়া ও মংলার নেতৃত্বে জোটবদ্ধ ভুঁইচাষির দল পঞ্চায়েতি শাসন চালুর দাবি জানায়। সেই দাবির গর্জন‌ই আসলে ‘দেবীগর্জন’ – এই দেবী ধরিত্রী। অবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে চাষিদের সংঘবদ্ধ বিরোধ এবং তাতে জয়লাভ ও অবস্থার পরিবর্তন এই আলেখ‍্যে ‘দেবীগর্জন’ সার্থক গণনাট‍্য এমনি ‘নবান্ন’ অপেক্ষা অনেক পরিণত।



প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, ‘দেবীগর্জন’ নাটকটি বিজন ভট্টাচার্যের ‘কলঙ্ক’ নাটকের কাহিনি সূত্র ধরেই লেখা, মোড়ল বা সর্দার, তার স্ত্রী গিরি, পুত্র মংলা, পুত্রবধূ রত্না – এরা ‘কলঙ্ক’ নাটকের মতো ‘দেবীগর্জন’ নাটকেও আছে। তবে পটভূমির পরিবর্তন হয়েছে – বাঁকুড়া গ্রাম থেকে নাট‍্যকার তাদের নিয়ে গেছেন বীরভূমের প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে, আর গোরা সৈন‍্যদের বদলে তাদের বিদ্রোহ দেশীয় জোতদারদের বিরুদ্ধে।

অর্থাৎ ‘দেবীগর্জন’ কৃষক নাটক, উৎসর্গ করা হয়েছে কৃষক আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ‍্যে, উনিশ – বিশ শতক জুড়ে নীল – তেভাগা সহ সমস্ত কৃষক যারা আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। এছাড়া ‘দেবীগর্জন’ নাটকে দুটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে হয় –

১) বিজন ভট্টাচার্য জানান যে আদিবাসী সাঁওতালরা তাদের আরাধ‍্য হিসাবে কালীকে আরাধনা করেন, সেই মাতৃশক্তির আবির্ভাবের কথা খেয়াল রেখেই নাটকে ‘দেবীগর্জন’ নাম এবং প্রসঙ্গ এসেছে। এর ফলে নাটকটি লোকনাট‍্যের কাছাকাছি যেতে পেরেছে।

২) কৃষক আন্দোলন নাটকে প্রেক্ষাপট হলেও দুটি প্রসঙ্গ নাটকে প্রধান – ধর্মগোলা ও পঞ্চায়েত ব‍্যবস্থা – এর মধ‍্য দিয়েই বিজন ভট্টাচার্য সমস‍্যার সমাধানের সূত্র খুঁজেছেন।

এখানে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা খুবই প্রাসঙ্গিক যে গ্রুপ থিয়েটার নাগরিক সমস্যাভিত্তিক হয়ে পড়েছিল। নাট্য সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন যে, বিজন ভট্টাচার্য গ্রুপ থিয়েটারের এই প্রবণতা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তিনিই একজন ব্যক্তি যিনি গ্রামকে শহরের মঞ্চে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। এটা তিনি করেছেন, মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারণে নয়, মধ্যবিত্তের বুদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে। বন্দ্যোপাধ্যায় তার বক্তব্য তুলে ধরতে কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। দেবীগোর্জনের খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত রূপ, যেভাবে গানে, প্রায় অনাট্যভাবে,  আলাদা করা হয়েছিল, যেভাবে প্রেম, নিঃসঙ্গতা, লোভ ধর্মের প্রতারণা এবং জোতদারের ছলচাতুরির সাথে মিলিত হয়েছিল। এর ফলে তিনি সম্পূর্ণরূপে একটি ভিন্ন এবং একটি বিশেষ ধরণের থিয়েটার তৈরি করেছিলেন। চিত্রগুলি সরাসরি লোকজীবন থেকে আবির্ভূত হয়েছিল, এবং তবুও বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্য দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল৷ এখানেই আমরা IPTA-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য স্মরণ করতে পারি।

বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছেন, ভট্টাচার্যের গোষ্ঠী, কলকাতা থিয়েটারের অভিনয়শিল্পীরা তাদের বক্তৃতায় এবং তাদের আন্দোলনে গ্রামীণ দেহকে পুনর্ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তার পাশাপাশি বিজন যে কাব্য বারবার তৈরি করেছেন – দেবীগর্জন,  মংলার রূপকথার স্বপ্নের ধারাবাহিকতায়, - গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতাকে অতিক্রম করে অন্য কোথাও এসে পৌঁছেছে। এবং এই মুহূর্তে, শহুরে, মধ্যবিত্ত দর্শকরা এতটাই জড়িত হয়েছিলেন যে তাঁরা নাটকের অংশ হতে পেরেছিলেন।

তবুও, বাণিজ্যিকভাবে বিজন ভট্টাচার্যের পরীক্ষাগুলি ব্যর্থ হয়েছিল। বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এটি প্রমাণ করে যে শহুরে থিয়েটারের একটি অংশ থেকেও কৃষক ও শ্রমিকের থিয়েটার যথাযথ সততার সাথে করার প্রচেষ্টার মধ্যে গুরুতর অসঙ্গতি ছিল।

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন