কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১০৩


সেদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। ব্যক্তিগত কাজে সকাল এগারোটা নাগাদ একটা ব্যাঙ্কে গেছিলাম। কাজটা শেষ করে যখন উঠতে যাব, বাঙ্কের যে কর্মীর সঙ্গে কাজটা করছিলাম, তিনি একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে বসলেন, আচ্ছা স্যার, আপনি ব্যাঙ্ক থেকে যে সুবিধেটা নেবার জন্য আবেদন করলেন, সেই সুবিধেটা তো শুধুমাত্র সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য। তা আপনি…! আমি বললাম, হ্যাঁ ঠিকই তো! সিনিয়র সিটিজেনদের জন্যই তো! ব্যাঙ্ককর্মী কৌতূহলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু স্যার, আপনি তো ষাটের থেকে কিছুটা  পিছিয়ে আছেন বলেই মনে হচ্ছে আমার, মানে এখনও তো আপনি কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেননি, তাই না? আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তার মানে? আপনি আসলে কী বলতে চাইছেন? আমি সিনিয়র সিটিজেন নই? আশ্চর্য! তা আপনার কী মনে হয়, আমার বয়স কত? ব্যাঙ্ককর্মী একটু থতমত খেয়ে বললেন, স্যার, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, বাহান্ন-তিপান্নর বেশি আপনার হতেই পারে না! বলা বাহুল্য, ব্যাঙ্ককর্মীর এই অনুমান আমাকে উৎফুল্ল করল। মনটা আমার এক অনস্বাদিত আনন্দে ভরে গেল। সৌজন্যে গদগদ হয়ে বললাম, জানেন, আপনার এই পর্যবেক্ষণ ও অনুমান আজ আমার দিনটাকেই বদলে দিল, চারিদিকের প্রকৃতিটা ফুরফুরে হয়ে উঠল। তবু আপনার অবগতির জন্য জানাই, আমি বিগত জানুয়ারী মাসে সত্তর পেরিয়ে গেছি। আমার কথা শুনে ব্যাঙ্ককর্মী যথার্থই চমকে উঠলেন। বললেন, বলেন কী স্যার, আপনি সত্তর অতিক্রান্ত? দেখলে কিন্তু একেবারেই তা মনে হয় না! আমি এবার কিছুটা খেলার ছলে প্রতিপ্রশ্ন করলাম, তা আপনার বয়সটা তো জানা হলো না! আপনার কত হলো? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, সেটা স্যার আপনিই অনুমান করে বলুন! আমি রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলাম তাঁকে। মুখটা বেশ ভারি, দু’গাল চিবুক গলা সবকিছুই ঘন দাড়িতে ঢাকা। চুল ব্যাকব্রাশ করা। মাথার চুলে সামান্য রূপোলি ঝলক। জুলফিতেও কালোর পাশে দু’চারটে সাদা রেখার সহবস্থান। আমি বেশ নিশ্চিত হয়েই বললাম, আপনার বয়স এই পঁয়তাল্লিশের ধারে কাছেই হবে। ইতিমধ্যেই প্রৌঢ়ত্বের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। আমার কথা শুনে, মনে হলো, ব্যাঙ্ককর্মী খুবই হতাশ হয়ে পড়লেন। সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতে খেলতে আচমকাই লেফট ডিফেন্ডার পজিশনে নেমে গেলেন। কাচুমাচু মুখে বললেন, না স্যার, গত ফেব্রুয়ারীতে আমার সবে তিরিশ কমপ্লিট হলো।

না, এই মজার ঘটনাটা উল্লেখ করে আমি একথা বলতে চাইছি না যে, আমরা এই প্রবীণ বয়সে পৌঁছে এখনও তরুণ বয়সের মতোই আছি বা বিচরণ করছি, আর আজকের তরুণরা অকালেই প্রবীণের পংক্তিতে অনুপ্রবেশ করছে। কেননা এখানে যে তুলনামূলক ব্যাপারটা এসে গেল, তা নিছকই শরীর কেন্দ্রিক। এবং এটা হয়তো নিছকই ব্যতিক্রমী উদাহরণ। কেননা, যেমন আমার সমসাময়িক অনেকেই বয়সের ভারে অনেকটা শ্রান্ত ক্লান্ত এবং অসুস্থ, তেমনি আবার কেউ কেউ বয়সকে উপেক্ষা করে শরীরের সতেজতা জিইয়ে রেখেছেন। কিন্তু শরীরের পরিপ্রেক্ষিত যাই হোক না কেন, আসল হচ্ছে মনের পরিপ্রেক্ষিত। মনটাকে বুড়িয়ে যেতে না দেওয়া। আসলে তরুণদের শরীর ও মন তরুণই থাকবে বা থাকে, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যাঁরা প্রবীণ বা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন বয়সের বিচারে, তাঁদের শরীর প্রকৃতির নিয়মে অশক্ত বা দুর্বল হয়ে পড়লেও, মনটাকে তরুণ করে রাখাটাই হচ্ছে বেঁচে থাকার সার্থকতা। আমরা সবাই জানি যে, জেনারেশন গ্যাপ বা প্রজন্মের দূরত্ব একটা বড় সমস্যা বা বাধা উভয় প্রজন্মের জন্যই। কিন্তু  তবুও যদি প্রবীণ প্রজন্ম আগ্রহী হন এই দূরত্বকে কমিয়ে আনতে, তবে তাঁদের বয়সোচিত অভিমানকে উপেক্ষা করে যতটা সম্ভব মনটাকে তরুণের স্তরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পজিটিভ অর্থে শিং ভেঙে বাছুরের দলে নিজেকে মানানসই করে তুলতেই হবে।  

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই বর্ষার শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।  

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব


মলয় রায়চৌধুরী

 

আভাঁগার্দ সাহিত্য কাকে বলে?

আভাঁগার্দ মানে 'অ্যাডভান্স গার্ড' বা 'ভ্যানগার্ড', আক্ষরিক অর্থে 'ফোর-গার্ড', ভাবকল্পটি এমন একজন ব্যক্তি বা কাজ যা শিল্প, সংস্কৃতি বা সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যা পরীক্ষামূলক, নতুন বা অপ্রথাগত। কাজগুলো প্রথমদিকে নান্দনিক উদ্ভাবন এবং প্রাথমিক অগ্রহণযোগ্যতা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো। আভাঁগার্দ শব্দটা, মূলত ফরাসি সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত একটি শব্দ ছিল। এই সামরিক রূপকটি সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ আরম্ভ হলো, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রথানুগত লেখালিখি থেকে পার্থক্য চিহ্ণিত করার জন্য। শব্দটি সেনাবাহিনীর সামনের জওয়ানদের নির্দেশ করে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে শত্রুদের মুখোমুখি হয় এবং যারা পরে আসে তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করে। অর্থাৎ আভাঁগার্দ বলতে বোঝায়, সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে, যাঁরা সমসাময়িক কালখণ্ড থেকে এগিয়ে। বলা বাহুল্য যে তাঁরা আক্রান্ত হবেন এবং তার জন্য  তাঁরা নিজেদের সেইমতো প্রস্তুত করেন, এরকম মনে করা হয়। তবে বিবর্তনমূলক অর্থে নয়। কারণ এটি বুর্জোয়া সমাজে সাহিত্য-শিল্পের মূল নীতি সম্পর্কে আমূল প্রশ্ন তোলে, যে বক্তব্যটি হলো এই যে, ব্যক্তি-একক বিশেষ সাহিত্য-শিল্পের কাজের স্রষ্টা বা ব্র্যাণ্ড, পুঁজিবাদী কাঠামোয় বিক্রয়যোগ্য। আভাঁগার্দ ভাবকল্পটি সর্বদা প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে যাঁরা বুর্জোয়া এস্টাব্লিশমেন্টের স্থিতাবস্থাকে চুরমার করে এগিয়ে যাবার কথা বলেন। কবি বা শিল্পী কী বলিতেছেন নয়, কবিতা বা শিল্পটি কী করিতেছে, এটাই হলো আভাঁগার্দের নবায়ন। স্বদেশ সেন লিখিত ‘জাদু’ কবিতাটা পড়লে টের পাওয়া যাবে আমি কী বলতে চাইছি :

একটা কি চাঁদ উঠেছে না বৃষ্টিতে ভিজেছে অর্জুন গাছ

সেই অর্জুন গাছে বসেছে পায়রা

লাল পা, শাদা গা, নীল ঘুম?

ও জাদুবাজ তামাড়িয়া, সিল্ক, গরদ আর টায়রা

একটা কি সূর্য উঠেছে না আগুনের ব্লুম?

আভাঁগার্দ কবিতা তার আগেকার অন্যান্য কবিদের কাব্যাদর্শ প্রত্যাখ্যান করে এগোয় এবং পরিবর্তে নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ বাকপথের সন্ধান করে। অর্থাৎ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্পের মনোবিজ্ঞান এবং আদর্শে, ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করা হয় যে (হেগেলীয় এবং মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি যাকে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা বলবেন) ভবিষ্যতবাদী প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করে, তাই বলতে গেলে, একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক এবং ইউটোপিয়ান পর্যায়, আভাঁগার্দের বিচরণক্ষেত্র। ব্যাপারটাকে অনেকে মনে করেন, আভাঁগার্দ নিজেই বিপ্লব না হলেও তা ঘোষণা এবং বিপ্লবের জন্য একটি প্রস্তুতি। একইভাবে ছবি আঁকা আর ভাস্কর্যের নবায়ন করে আভাঁগার্দ। উদ্ভাবন ব্যাপারটা আভাঁগার্দ কাজের কেন্দ্র । ফলত, অনেক সময়ে, আভাঁগার্দ লেখা সম্পূর্ণ নতুন, দুর্বোধ্য, দুরূহ, মজার এবং প্রায়শই সমসাময়িক পাঠকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। কবি বা শিল্পী তার ফলে হতাশ হন না, ঠিক যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, পেছিয়ে আসার প্রশ্ন ওঠে না। মরে যাবে জেনেই  আভাঁগার্দ জওয়ানরা শত্রুনিধনে বেরোয়। কখনও কখনও কবি বা শিল্পীরা, যাঁরা আভাঁগার্দ  থিমের সাথে জড়িত, তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেতে কয়েক দশক লেগে যায় কিংবা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন। ক্রমশ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প মূলধারার অংশ হয়ে যায় এবং অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, একদা যে ডাডাবাদী কাজগুলো আভাঁগার্দ হইচই হিসাবে নিন্দিত হয়েছিল, তা প্রয়োগ করছে বিজ্ঞাপনের এজেন্সিগুলো। প্রাথমিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যা আদর্শ বা স্থিতাবস্থা হিসেবে বহুকাল যাবত গ্রাহ্য, তার সীমানা অতিক্রম করে আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প। আভাঁগার্দকে কেউ কেউ আধুনিকতার শেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন যার হাত ধরে উত্তরাধুনিকতা প্রবেশ করেছে। অনেক শিল্পী আভাঁগার্দ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে নিজেদের কাজকে উত্তরাধুনিক হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন। ‘শ্রুতি আন্দোলনের কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমেরিকার ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েটদের বহু আগে উত্তরাধুনিক কবিতা লিখেছিলেন; যেমন ‘আমি সারাদিন আমি’ কবিতাটি :

আমার মা সারাদিন মালা জপেন

আর আমি

আমার বোন সারাদিন উল বোনে

আর আমি

আমার বউ সারাদিন আলনায় জামাকাপড় সাজায়

আর আমি

আমার প্রতিবেশীরা সারাদিন বাড়ি তোলে

আর আমি

আমার বন্ধুরা সারাদিন লিফটে চড়ে

আর আমি

আমি সারাদিন শুধু আমি।

আভাঁগার্দ আমূল সামাজিক সংস্কারও সমর্থন করে।  সেইন্ট সিমোঁর মতাবলম্বী ওলিন্ডে রড্রিগেস তাঁর প্রবন্ধে (‘শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং শিল্পপতি’, ১৮২৫)  বলেছিলেন যে, সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের উচিত সমাজে আভাঁগার্দ পরিবর্তন আনা। রড্রিগেস বলেছিলেন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য "সাহিত্য ও শিল্পের শক্তি প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং দ্রুততম হতে পারে আভাঁগার্দ কাজের মাধ্যমে"।  ভাবকল্পটি উনিশ শতকে বামপন্থী ফরাসি র‍্যাডিকালদের সাথে যুক্ত হয়েছিল, যাঁরা রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য  আন্দোলন করছিলেন। সেই শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে, শব্দটি সাহিত্য-শিল্পের সাথে যুক্ত হয়, এই ধারণার মাধ্যমে যে সাহিত্য-শিল্প হলো সামাজিক পরিবর্তনের উপকরণ। শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে আভাঁগার্দ কাজকর্ম সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক বিষয়গুলির সাথে আরও বেশি করে সংযুক্ত হওয়ার দরুন বামপন্থী সামাজিক কারণগুলো থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছিল। বিশুদ্ধ রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে নান্দনিক বিষয়গুলোর উপর জোর দেওয়ার এই প্রবণতা  অব্যাহত, তার কারণ রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে অসাধু লোকেরা যাদের আসল উদ্দেশ্য টাকা কামানো।

আভাঁগার্দ আজ সাধারণত বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং শিল্পীদের গোষ্ঠীকে বোঝায়, যার মধ্যে ভাস্কর আর  স্থপতিও রয়েছেন, যাঁরা বর্তমান সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে শৈল্পিক পদ্ধতির নবায়নের চিন্তাভাবনা করেন এবং পরীক্ষা করেন। আভাঁগার্দ কাজগুলো, বিশেষ করে যদি তারা সামাজিক সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে চায়, প্রায়শই এমন সমাজ-কর্তাদের মুখোমুখি হয় যারা সমাধানগুলো  আত্মীকরণ করতে বড়ো বেশি সময় নষ্ট করে। সমস্যা হলো যে গতকালের প্রতিষ্ঠানবিরোধিরা মূলধারায় পরিণত হয়, সরকারে যোগ দেয় বা ক্ষমতাবান মিডিয়ার মুখপত্র হয়ে ওঠে। ফলে আবার নতুন প্রজন্মের বিরোধিদের উদ্ভবের পরিবেশ তৈরি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য।

আন্দোলনটির কাজ প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন   কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্যতে। ডাডাবাদীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল। সবচেয়ে বিশিষ্ট আভান্ট-গার্ড কবিদের মধ্যে আমরা ভিসেন্তে হুইডোব্রো, নিকোলাস গুইলেন, সেজার ভালেজো, জর্হে লুইস বোর্হেস, অক্টাভিও পাজ, জুয়ান কার্লোস ওনেটি, মারিও বেনেদেত্তি, পাবলো নেরুদা, অলিভেরিও গিরোন্ডো, ভাসকো পোপা এবং আরও অনেককে খুঁজে পেতে পারি। সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণকারী বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমগুলো আভাঁগার্দ প্রবণতাকে সমর্থন করতে পারে এমন পাঠকদের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অমন পাঠকদের এলাকা সর্বদা সামাজিক অবস্থার সম্পূর্ণতা দ্বারা সীমাবদ্ধ। আভাঁগার্দ প্রবণতাগুলো সাধারণত স্বতন্ত্র ভিত্তিতে স্বীকার করা হয়, এবং সেই স্বাতন্ত্র্য হল গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যায়তনিক প্রত্যাখ্যানের মূল্যে। বিতর্কের মৌলিক বিষয় হল আভাঁগার্দ লেখক-শিল্পীদের ত্যাগ। তাঁদের কাজকে খণ্ডিত  গ্রহণযোগ্যতায় মাপা হয় যখন কিনা তাঁদের রচনাগুলো খোলা একাধিক গভীর পাঠ দাবি করে। এই বাণিজ্যিক প্রতিরোধ আভাঁগার্দ ভাবকল্পকে পরিসর তৈরি করে দেয়। উদ্ভাবন বিপ্লবের মাধ্যমে শিল্পে নবায়নের জন্য উদ্ভাবনার বিপ্লব জরুরি। বাস্তবতা অনেকটা একইভাবে শিল্পে নিজেকে প্রকাশ করে যেভাবে মাধ্যাকর্ষণ নিজেকে প্রকাশ করে যখন একটি ছাদ তার মালিকের মাথায় ভেঙে পড়ে। নতুন শিল্প-সাহিত্য, নতুন শব্দ, নতুন অভিব্যক্তির জন্য আগেকার ছাদ ভেঙে ফেলে নতুন ছাদ পাততে হয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের। ভেঙ্গে পড়ার চেষ্টায় কবি বা শিল্পী কষ্ট পান; শব্দ এবং বাস্তবতার মধ্যে বাধা পান। আমরা ইতিমধ্যে তাঁর কলমে বা তুলিতে নতুনত্ব অনুভব করতে পারি’  বলেছেন ভিক্টর শক্লোভস্কি। এই প্রসঙ্গে বাংলায় সৌমনা দাশগুপ্তর ‘শনির বলয় ভেঙে’ কবিতাটি উল্লেখ্য :

বরং

শূন্যের দিকে উড়ে যাক কসমিক হরিণের ছায়া, প্রেম ও প্রতীতি

নিজেকে সুচের মধ্যে ভরে ক্রসস্টিচ ফোঁড়, ছুরিতে কুড়ুলে শান

বরং

প্ল্যাটফর্মে থইথই করুক আগুন

প্ল্যাটফর্মে হইহই করুক শকুন

ওপাশে সরাইখানা, মেঘের শরীরঠেসে পেরেকের কুচি, ট্যাক্সিডার্মি

যেয়ো না যেয়ো না সখী, শুদ্ধ কল্যাণ-ঠাটে লেগে যাবে মরিচার দাগ

ডাউন-সিনড্রোমের গলি, পিছলা রাস্তায় কত পিতলা-পিরিত নাচে গায়

শনির বলয় ভেঙে ছিটকে ছিটকে পড়ে নিকেলের পাশা, ধুলো ও বরফ

সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায়, আভাঁগার্দরা তাঁদের লেখার নতুন পদ্ধতিতে উদ্ভাবন করেছেন।  কবিতায় তাঁরা কিছু ব্যাকরণ যেমন সঠিক বানান এবং সংযোগকারী শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেননি; বা নিয়ম বা কাঠামো যা আগে গ্রাহ্য ছিল তাকে অস্বীকার করেছেন। এই কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁদের অনন্য করে তুলেছিল, যেহেতু পূর্বোক্তগুলি মেনে চলার পাশাপাশি, তাঁরা সম্পূর্ণ মুক্ত উপায়ে কবিতা চর্চার ঝুঁকিও নিয়েছিলেন; তাঁরা নতুন শব্দ উদ্ভাবন করতেন, নতুন হরফ ব্যবহার করতেন, এমনকি একই টেক্সট (ক্যালিগ্রাম নামে পরিচিত) বা তাদের সাথে ছবি দিতেন পরে। তাঁরা ১) কবিরা ভাবনাকে উপস্থাপন করতে  ছবি ব্যবহার করতেন। ২) পুরনো কবিতার প্রতি কবির অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং নতুন কিছুর সন্ধান করতেন। ৩) কাব্যিক ভাষা আমূল পরিবর্তন করতেন। ৪ ) আলোচিত বিষয়গুলি খুব বৈচিত্র্যময়, অস্বাভাবিক এবং উদ্ভাবনী হিসাবে উপস্হাপন করতেন। ৫) নতুন পাঠকের কাছে যা অর্থহীন ছিল তা পিছনে ফেলে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। এই প্রসঙ্গে শম্ভু রক্ষিত-এর ‘মুক্তিবাদ’ কবিতাটি উল্লেখ্য:

যারা আমাকে ডিগডিগে

আমার রুহকে যুদ্ধের হিরো

আমার ঈশ্বরকে অনিষ্টজনক

আমার কবিতাকে

চাকচিক্যময় আভিজাত্য বা বিক্ষিপ্ত প্রলাপ মনে করে

 

আহ ভাইরে

তারা বাণিজ্যের অযথার্থ ক্ষমতা দিয়ে

তাদের নাক মুখ কান দখল করে

এই শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের

অস্তিত্ব রক্ষা করুক

 

যারা বালি ফুঁড়ে

আমাকে বাল্যপাঠ শেখাচ্ছে

আহ ভাইরে

তারা মেকি সুন্দরের মিথ্যে সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে

অন্তত্ব একটা ছোটখাটো দেবদূতের সন্ধান করুক

 

অকেজো জ্যুকবক্সে স্থির ডিস্ক

জীবনের আর ভাঙা ইঁটের

অশুভ যুদ্ধপরা যন্ত্রণায় আন্তর্জাতিক কোরাস

আহ ভাইরে

কবরখানা আর টাউনশিপের সুড়ঙ্গের মধ্যে গুঞ্জন করা

আস্তাবলের ধূর্ত পিটপিটে মায়া

মধ্যে মধ্যে ফ্যাঁকড়া

আহ ভাইরে


কাঁধে অগ্নিবর্ণের ক্যামেরা

হাতে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ট্রানজিস্টর

অন্য সম্রাটের দায় যাতে মেটে

মাংস ভেদ করে সচল ফ্রেস্কোর মত

এইসব রেডিয়ো-টিভি-অ্যাকটিভ যুবশক্তি

মুক্তিবাদ এবং জাঁকজমক খুঁড়ে নৈশস্তব্ধতা

আহ ভাইরে

ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্ত্বায়নের মালিকানা,  কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা। ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা। ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরনের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি। এই কারণেই হাংরি আন্দোলনকে বুঝতে পারেন না  অনেকে, হাংরিদের কবিতা ও গদ্যকে পূর্বের কবি ও লেখকদের কাজের পাশে রেখে তুলনা করতে চান। বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’। অথচ লেখক হতে চান না এরকম  লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন! তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন,  আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন। তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না। হাংরি আন্দোলনকারীদের, ডাডাবাদীদের মতনই, এই প্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হবে।

 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২০ 




ইউরোপ এশিয়া ছেড়ে এবার লাতিন আমেরিকা। চিনের পর লাতিন আমেরিকা ধরলাম এক বিশেষ কারণে। চিনের সিনেমায় যেটার অভাব ছিল – সাহস,  সেটার ভরপুর প্রয়োগ আপনারা দেখতে পাবেন লাতিন সিনেমায়। থিম, গল্প, চরিত্রায়ন – সবেতেই। ফলে আমার মনে হল এই সুযোগ, আপনারা দেখুন বৈপরীত্য কীভাবে ফুটে ওঠে। ছবির বাছাই সেভাবেই করা হয়েছে। তবে শুরুতেই  একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে রাখা ভাল। লাতিন আমেরিকা মূলত ইউরোপের ঔপনিবেশিক দেশগুলোর ঘাঁটি হবার জন্য এখানে এখনো প্রধান তিনটি ভাষা হলঃ স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং ফ্রেঞ্চ। এখানকার বেশিরভাগ ছবি এইসব ভাষাতেই কিন্তু তৈরি হয়। খুব কম ছবিই আছে যেগুলো এখানকার পুরনো নেটিভ ভাষা নিয়ে বানানো হয়। সেজন্য আমি আমার বাছাই ২০টার প্রতিটি সিনেমার ভেতরে ভাষাও উল্লেখ করে দিলাম।  

দ্য ইয়ং অ্যান্ড ড্যাম্‌ড (১৯৫০, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), মাকারিও (১৯৬০, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), ডেথ অব আ বুরোক্র্যাট (১৯৬৬, কিউবা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), এন্ট্রান্সড আর্থ (১৯৬৭, ব্রাজিল, ভাষাঃ পর্তুগিজ), দ্য প্লেস উইদাউট লিমিটস্‌ (১৯৭৮, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), ডার্ক সাইড অব দ্য হার্ট (১৯৯২, আর্জেন্টিনা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), স্ট্রবেরি অ্যান্ড চকোলেট (১৯৯৪, কিউবা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), সেন্ট্রাল স্টেশন (১৯৯৮, ব্রাজিল, ভাষাঃ পর্তুগিজ), দ্য রোজ সেলার (১৯৯৮, কলম্বিয়া, ভাষাঃ স্প্যানিশ), লাভ ইজ আ বিচ (২০০০, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), অ্যান্ড ইয়োর মাদার টু (২০০১, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), সন অব দ্য ব্রাইড (২০০১, আর্জেন্টিনা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), সিটি অব গড (২০০২, ব্রাজিল, ভাষাঃ পর্তুগিজ), সাইলেন্ট লাইট (২০০৭, মেক্সিকো, ভাষাঃ জার্মান), দ্য মেইড (২০০৯, চিলি, ভাষাঃ স্প্যানিশ), দ্য সিক্রেট ইন দেয়ার আইজ (২০০৯, আর্জেন্টিনা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), নো (২০১২, চিলি, ভাষাঃ স্প্যানিশ, ইংলিশ), ওয়াইল্ড টেলস্‌ (২০১৪, আর্জেন্টিনা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), অ্যাকোয়ারিয়াস (২০১৬, ব্রাজিল, ভাষাঃ পর্তুগিজ), রোমা (২০১৮, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ)। 

তাহলে কী কী দেশের কতগুলো ছবি আমরা এখানে পাচ্ছি? ব্রাজিল – ৪, আর্জেন্টিনা – ৪, মেক্সিকো – ৭, চিলি – ২, কিউবা – ২, কলম্বিয়া – ১। এবং সবেতেই স্প্যানিশ ভাষার আধিক্য, তাই না? এবার এর ভেতর থেকে বেছে নেব আজকের আলোচনার জন্য মাত্র ৭খানা ছবি - দ্য ইয়ং অ্যান্ড ড্যাম্‌ড, ডেথ অব আ বুরোক্র্যাট, ডার্ক সাইড অব দ্য হার্ট, লাভ ইজ আ বিচ, সিটি অব গড, নো, রোমা। তাহলে বুনুয়েল ও কোয়ারনের দেশ মেক্সিকোকে সামনে রেখে বাকি প্রায় সব দেশের ছবিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে।

লুই বুনুয়েলের ৭৬ মিনিটের ছবি ‘দ্য ইয়ং অ্যান্ড ড্যাম্‌ড’ বেশ কয়েকটা কারণে  গুরুত্বপূর্ণ। মেক্সিকো শহরের বস্তির দারিদ্র থেকে উঠে আসা টিনেজাররাও কীভাবে অপরাধ জগতে মিশে যায়, সেই সামাজিক অভিশাপ এই সিনেমার  প্রতি রিলে। এই ছবি নিয়ে মেক্সিকোয় এত হৈ-চৈ হয়েছিল যে সরকার বাধ্য হয়ে ছবি রিলিজের তিনদিনের মাথায় এই সিনেমা বন্ধ করে দেয়। অবশ্য ছ’মাস পর  আবার সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তবে বুনুয়েলের সিনেমা, সুতরাং সামাজিক বাস্তবের মাঝে মাঝেই পরাবাস্তব উঠে এসেছে ছবিতে। আবার অনেকে বলে থাকেন, এই ছবিতে বুনুয়েলের আগের সিনেমা ‘ল্যান্ড উইদাউট ব্রেড’ এর ছায়া ফুটে উঠেছে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কিন্তু যেটা না বললেই নয়, তা হল, এরপর আমরা যখন ‘লাভ ইজ আ বিচ’ বা ‘সিটি অব গড’ নিয়ে আলোচনা করব, তখন  এই সিনেমার প্রভাব আমরা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারব না।

ছবি শুরু হচ্ছে অজানা এক বস্তির ছেলেদের লিডার এল হাইবোর জেল থেকে ছাড়া পাবার দৃশ্যে। ছাড়া পেয়ে সে আবার সেই বস্তির ছেলেদের মাঝে গিয়ে নিজের গ্যাং চালাতে শুরু করে, রাস্তায় লুটপাট রাহাজানি শুরু করে। পেড্রো নামক এক টিনেজারের সাহায্যে এল হাইবো জুলিয়ানকে খুঁজে বের করে যে তাকে জেলে পাঠিয়েছিল। এবং জুলিয়ানকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করে। এদিকে পেড্রোর মা ছেলের এই অধঃপতন দেখে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। পেড্রো মায়ের আচরণ দেখে দুঃখ পেয়ে নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করে কিন্তু এল  হাইবো তাকে চুরির কেসে ফাঁসিয়ে দেয়। পেড্রোর জেল হয়। ফিরে আসার পর এল হাইবো তাকেও খুন করে। এবং পুলিশের হাত থেকে পালাতে না পেরে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় পেড্রোর মা পেড্রোকে পাগলের মত খুঁজে চলেছে। সে তখনো জানে না পেড্রো খুন হয়ে গেছে। খুব কমখরচের সিনেমা। কারণ ছবিতে অভিনয়ের জন্য বস্তির ও রাস্তার ছেলেদের ব্যবহার করা  হয়েছিল। কর্কশ কিন্তু চিন্তার খোরাক জোগানো ছবি। এবং সাদা কালো ক্যামেরার কাজ, বুনুয়েলের সিনেমা মানেই, অসাধারণ।   

কিউবার পরিচালক টমাস গুতিয়ারেজ আলেয়া-র ৮৫ মিনিটের ‘ডেথ অব আ বুরোক্র্যাট’ একটু অন্য ঘরানার ছবি। রাজনৈতিক স্যাটায়ার। এই সিনেমা  কিউবার রাজনৈতিক ইতিহাসের সামাজিক উত্থান-পতনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ।  অবশ্য পরিচালক আলেয়ার ভাষায় উনি এই সিনেমা বানিয়েছিলেন নেহাত মজা করার জন্য - “However, I have to say that I don’t have much faith in the efficacy of satire as a ‘driving force of history’. When making film we thought that we are laughing at the bureaucrats, but then the bureaucrats will come and not only will the film make them laugh, but they will laugh at themselves.”

কিউবার এক রাজনৈতিক নেতা মারা যাবার পর ভুল করে তাকে তার ইউনিয়ন কার্ড সমেত কবর দেওয়া হয়। কিন্তু সেই কার্ড তার বিধবা বউয়ের দরকার, না হলে সে সামাজিক সুযোগ সুবিধে থেকে বঞ্চিত হবে। এদিকে কিউবার আইন খুব শক্ত – একবার কবর দিলে তার দু’বছরের ভেতর সেই শবদেহ বাইরে বের  করে আনা যায় না। অগত্যা সেই মৃত নেতার ভাইপো দু’জন চোরকে কাজে  লাগায় রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে মৃতদেহ তুলে আনার জন্য। কিন্তু মৃতদেহের কফিনে যে রেড টেপ থাকে, সেটা খুলে নেওয়ার পর সেটা জোড়া যায় না, ফলে মৃতদেহ আর কবর দেবার সুযোগ থাকে না। সেই নিয়ে শুরু হয় গন্ডগোল। হাসির দৃশ্যায়ন। এবং এক খুন। ‘ডেথ অব আ বুরোক্র্যাট’কে দুর্দান্ত সিনেমা বললে কম বলা হবে। সাহসী তো বটেই, নাহলে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ কমিউনিজম এবং তার রেড টেপ নিয়ে এমন মজা করতে সাহস পায়!     

এলিসিও সুবিয়েলার দু’ঘন্টা সাত মিনিটের দীর্ঘ সিনেমা ‘ডার্ক সাইড অব দ্য হার্ট’ মূলত কবিতা ও জাদুবাস্তবতার মিশ্রণ। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এয়ার্সে এক  তরুণ কবি থাকেন। সেই কবি উরুগুয়ে বেড়াতে গিয়ে এক যৌনকর্মীর প্রেমে  পড়ার পর তাদের উদ্দাম ভালবাসার গল্প। এবং ফ্রেম থেকে ফ্রেমে সেক্স ও কবিতা পাঠের ফিউশন। এমন কিছু অদ্ভুত কবিতা যা পিকাসোকে মনে পড়িয়ে দেয় - “Don’t stay motionless by the roadside/ Don’t freeze the joy/ Don’t love reluctantly/ Don’t save yourself/ Now or ever/ Don’t fill yourself with calm/ Don’t book in the world/ Just a quiet corner/ Don’t lower the eyelids/ Heavy as judgments/ Don’t stand without lips/ Don’t sleep without sleep…”

অলিভিয়ারো নামক এক তরুণ কবি, যাকে নিজের পেট চালানোর জন্য মাঝে  মাঝেই অ্যাড এজেন্সির কাছে নিজের শিল্প ও কবিতা বেচে দিতে হয়, একবার উরুগুয়ে বেড়াতে গিয়ে আনা নামক এক সুন্দরী যৌনকর্মীর প্রেমে পড়ে। আনা কবিতা ভালবাসে। অলিভিয়ারো নিজের সুররিয়েল জগতে থাকতে ভালবাসে। সে প্রতি নারীর পিঠে ডানা খোঁজে, উড়তে পারে কিনা দেখে। বিছানায় কোন নারীর পিঠে ডানা না দেখলে সে খাটের অন্যদিকের হাতল ঘুরিয়ে তাকে অতলে ফেলে  দেয়। সে আনার পিঠে ডানা খুঁজে পায়, উদ্দাম ভালবাসা খুঁজে পায়। ঠিক যেন ম্যাজিক। অন্যদিকে আরেক মহিলার প্রতিও অলিভিয়ারো আকৃষ্ট যার নাম মৃত্যু। সে কবিকে আস্তে আস্তে মেরে ফেলতে চায়। আর অলিভিয়ারো চায় আনার সঙ্গে অনন্ত যৌনতা। অবশেষে সে তার হৃদয় খুলে আনার সামনে তুলে ধরে। কিন্তু আনার সেই হৃদয়ে নয়, টাকায় লক্ষ্য।

এই সিনেমা প্রথম দেখেছিলাম রাজেশের বাড়ি। সেটা খুব সম্ভব ১৯৯৯। তখনো যাদবপুরে মাস্টার্স করছি। আমি, রাজেশ আর মোটা। স্বাভাবিকভাবে, সেই সময় ঐ সিনেমা দেখে তরুণ কবি হিসেব খুব চার্জড হয়েছিলাম। যৌনতা দেখে,  সাহসী কবিতার পদক্ষেপ দেখে। কিন্তু তখন কিছুই বুঝিনি। অনেক পরে গুয়াহাটিতে একা বসে এই সিনেমা রিওয়াইন্ড করে করে দেখে বুঝেছিলাম কেন এটা কাল্ট সিনেমা, কেন এর ক্যামেরায় এত অন্ধকার, কী সেই ফ্যান্টাসি যা  এক কবিকে পরাবস্তবতা আর জাদুবাস্তবতার মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখে। জাগিয়ে রাখে। তার হৃদয় নিজে হাতে খুলে আনতে বাধ্য করে। জীবনানন্দ কি তার কবিতায় সেইসব অস্থিরতার কথা বলেননি? 

মেক্সিকান পরিচালক আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজের প্রথম ফিচার ছবি ‘লাভ ইজ আ বিচ’। মনস্তাত্বিক ড্রামা। গঞ্জালেজের ডেথ ট্রিলজির প্রথম ছবি। পরের দুটো হল  – ‘21 গ্রামস’ এবং ‘ব্যাবেল’। প্রায় আড়াই ঘন্টার এই সিনেমায় তিনটে আলাদা  গল্পের ভেতর দিয়ে পশু ও অন্যান্য মানুষের প্রতি মানুষের নৃশংসতা দেখানো হয়েছে। এবং প্রতিবার পশু হিসেবে কুকুর দেখানো হয়েছে বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে।

তিনটে আলাদা গল্প, জোড়া হয়েছে মেক্সিকোয় কোন এক গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের মাধ্যমে। বস্তির এক টিনেজার যে ডগফাইটিং পছন্দ করে, এক উঠতি মডেল যার পায়ে দুর্ঘটনা ঘটে, এবং এক অজ্ঞাত আততায়ী। এদের নিয়ে তিন গল্প। বস্তির টিনেজার অক্টাভিও নিজের দাদার বৌ সুসানা-কে মনে মনে ভালবাসে, তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সুসানা একদিন অক্টাভিওর টাকা নিয়ে তার বরের সঙ্গেই পালিয়ে যায়। ওদিকে এক উঠতি মডেল ভ্যালেরিয়া তার ভালবাসার মানুষ ড্যানিয়েলকে নিয়ে নতুন এক ফ্ল্যাটে চলে যায়। আবার এক পেশাদার আততায়ী এল শিভো, যে নিজের ছেড়ে আসা মেয়েকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, এক ব্যবসায়ীকে মারতে চলেছে। ঠিক সেই সময় অক্টাভিওর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট এদের সবার জীবন বদলে দেয়। এল শিভো ব্যবসায়ীকে মারতে না পেরে অক্টাভিও-র আহত কুকুরকে গাড়ি থেকে তুলে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। ভ্যালেরিয়ার পা ভেঙে গিয়ে সে সারাজীবনের মত মডেলিং থেকে ছিটকে যায়। এবং ড্যানিয়েল তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের স্ত্রীর কাছে আবার ফিরে যায়। সুসানা, তার বর মারা যাবার পরেও, অক্টাভিওর কাছে আর ফিরে আসে না। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের কিছুদিন পর এরা সবাই বুঝতে পারে প্রকৃত ভালবাসা বলে কিছু হয় না। এই সিনেমার প্রতি গল্পে নৃশংসতা লুকিয়ে, বিশেষ করে ডগ ফাইট যা নিয়ে এই ছবিকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সিনেমার বহমান গল্প দর্শককে আড়াই ঘন্টা বসিয়ে রাখতে সক্ষম। বুনুয়েলের ধাঁচে। আর সেখানেই এই ছবির মুন্সিয়ানা।

সিটি অব গড’ ব্রাজিলের অন্যতম সেরা ছবি, যা ষাটের দশক থেকে আশির দশক অব্ধি ব্রাজিলের অপরাধজগৎ প্রায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ১৯৯৭ সালের এক উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে ১৩০ মিনিটের এই ছবির পরিচালক দুজন – ফার্নান্দো মিরেলিস এবং কাটিয়া লান্ড। এই সিনেমা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ দুটো কারণে। এক, বস্তির ক্লোজ সিনেমাটোগ্রাফি এবং প্যানোরামিক  দৃশ্য কীভাবে মেলানো যায়, পরিচালক তা দেখিয়েছেন। দুই, দৃশ্য থেকে দৃশ্যে  যাবার সময়ের যে মসৃণ এডিটিং, তা আজকালকার উঠতি পরিচালকদের শেখা  দরকার। এছাড়াও প্রাণশক্তিতে ভরপুর স্ক্রীনপ্লে এবং সাহসী-শক্তিশালী উপস্থাপনা।

ষাটের দশকের এক ফাভেলা, ছোট্ট এক হাউজিং বস্তি ‘সিটি অব গড’, যেখানে  তিনজন টিনেজ ছিঁচকে চোর – শেগি, ক্লিপার আর গুজ আস্তে আস্তে ডন আর ডাকাত হয়ে উঠছে, সেই ফাভেলা সত্তরের দশকে এক কংক্রীটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। প্রচুর জনবসতি। অপরাধ বেড়ে গেছে। সেদিনের সেইসব ছোট ছেলেরা ড্রাগ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের আলাদা আলাদা গ্রুপ হয়ে গেছে। আশির দশকে তাদের নিজেদের ভেতর খুন জখমের প্রভাবে আবার সেখানে উঠে আসছে ছোট ছোট টিনেজ ছেলেদের দল। তারা অপরাধী হয়ে উঠছে, হাতে পিস্তল। খুন করতে পিছপা নয়। ‘দ্য ইয়ং অ্যান্ড ড্যাম্‌ড’-এর যেন আক্ষরিক ও আধুনিক পর্তুগিজ অনুবাদ। এই সিনেমাকে আমি দশে দশ দেব।

চিলির পরিচালক পাবলো ল্যারেইন-এর প্রায় দু’ঘন্টার ছবি ‘নো’ এক  রাজনৈতিক সাসপেন্স। দেখলে হঠাৎ আমাদের রাজ্যের ভোটকুশলী পিকে-র কথা মনে পড়তে বাধ্য। এই সিনেমার এক বিশেষত্ব হল, ল্যারেইন এখানে থ্রি কোয়ার্টার ইঞ্চি ইউ-ম্যাটিক ম্যাগনেটিক টেপ (পাতি আগেকার দিনের থ্রি-ফোর্থ ইঞ্চি ভিডিও ক্যাসেট) ব্যবহার করেছিলেন। কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন যাতে এই সিনেমা সর্বসাধারণের মাঝে কম দামে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

প্রায় পনেরো বছরের একনায়কতন্ত্র শেষ করে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে চিলির একনায়ক জেনেরাল অগাস্তো পিনোশে ১৯৮৮ সালে জনসাধারণের ভোটের মুখোমুখি হবেন। এই ভোট নির্ধারণ করবে উনি আগামী আট বছর ক্ষমতায়  থাকবেন কিনা। জেনেরালের বিরোধীপক্ষের নেতারা সাভান্দ্রা নামক এক অ্যাডনিপুণ ভোটকুশলীকে নিয়োগ করে যাতে পিনোশে কিছুতেই আর ক্ষমতায়  না ফেরেন। সেই নিয়ে ‘নো’ সিনেমা। কি, পিকে-র কথা মনে পড়ল তো? দাঁড়ান, এই সিনেমা তার থেকে আরেকটু এগিয়ে। সাভান্দ্রা বুঝতে পারে সেই মিলিটারির দেশে কাঠখোট্টা সংখ্যাতত্বের ক্যাম্পেন করে কোন লাভ নেই। বরং প্রতিদিন যদি  বিভিন্ন বিষয়ের মানুষদের দিয়ে বিনোদন ও আনন্দমূলক ক্রিয়েটিভ ক্যাম্পেন করা যায় এবং মিলিটারির ভীতি দূর করা যায়, তাহলে সাধারণের কাছে ‘নো’  বার্তা পৌঁছতে বেশি সুবিধে হবে। এদিকে সাভান্দ্রার বস তার এই গোপন কার্যকলাপ জেনে গিয়ে তাকে চাপ দেয় এই ক্যাম্পেন ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য। ব্যর্থ হয়ে তার বস জেনেরাল পিনোশের চাপে পড়ে শেষে নিজেই ‘ইয়েস’ ক্যাম্পেন করার জন্য নিজের টিম তৈরি করে ফেলে। একদিকে ‘নো’ ক্যাম্পেন, অন্যদিকে ‘ইয়েস’ ক্যাম্পেন। ২৭ রাত চিলির টিভিতে দু’পক্ষের এই ক্যাম্পেন সম্প্রচার করা হয়। অবশেষে ‘নো’ ক্যাম্পেনের জয় হয়, একনায়কতন্ত্রের  অবসান। নতুন স্বাধীন চিলি তৈরি হবার পর দেখা যায় সাভান্দ্রা আর তার বস আবার নতুন নতুন অ্যাড তৈরি শুরু করেছে, যেটা তাদের স্বাভাবিক পেশা।

শুরু করেছিলাম মেক্সিকোর লুই বুনুয়েল-কে দিয়ে (অবশ্য বুনুয়েল স্প্যানিশ পরিচালক বললেই বেশি মানানসই হয়), শেষ-ও করব মেক্সিকোর আরেক পরিচালককে দিয়ে। আলফোনসো কোয়ারন। এবং তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ‘রোমা’। কোয়ারনের আধা আত্মজীবনী। দু’ঘন্টা পনেরো মিনিটে সেলুলয়েডের পর্দায় ফুটে  ওঠা সাদা-কালোয় এক অনবদ্য সিনেমাটোগ্রাফি। অবশ্য বলে রাখা ভাল যে এই সিনেমা মেক্সিকো ও হলিউডের যৌথ প্রযোজনা।

সত্তরের দশকে ক্লিও নামক এক পরিচারিকা এক উচ্চবিত্ত পরিবারের সঙ্গে তাদের বাড়িতে থাকে। বাবা, মা, ঠাকুমা এবং চার বাচ্চা – এই নিয়ে পরিবার। ক্লিওর প্রেমিক আছে এবং তাদের শারীরিক সম্পর্কও আছে। সেই সম্পর্ক থেকে ক্লিও গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এদিকে, সেই উচ্চবিত্ত পরিবারের বাবা ডাক্তারির ছলে অন্য জায়গায় যাবার নাম করে নিজের প্রেমিকার সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলে যায়। মা নিজের চার সন্তানকে এবং ক্লিওকে নিয়ে এক জায়গায় বেড়াতে যাবে বলে স্থির করে। ফিরে আসার পর কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে ক্লিও এক মৃত সন্তান প্রসব করে। আবার তারা সবাই সমুদ্রে বেড়াতে যায়। সেখানে গিয়ে সেই পরিবারের মা তার চার বাচ্চা ও ক্লিওকে ডেকে বলে দেয় যে তাদের বাবার সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপর নিজেদের মত সি-বিচে আনন্দে মেতে ওঠে। 

গল্পের ধরন থেকে বোঝা যায় যে এটা কোয়ারনের ছেলেবেলার ব্যক্তিগত গল্প, সেজন্য এত ইমোশনাল। কিন্তু এটাও ঠিক যে শুধু ইমোশনাল গল্প দিয়ে মাস্টারপিস হয় না। তাহলে? মনে করে দেখুন ইতালির নব্য-বাস্তব সিনেমায় ফেলিনির ছবিগুলো। লা ডোলচে ভিটা, এইট অ্যান্ড হাফ – সেলুলয়েডে জীবন ফুটিয়ে তোলা। ফেলিনির ‘রোমা’ (১৯৭২) দেখুন। পরিচালক হিসেবে প্রথম যখন উনি ইতালিতে এসেছিলেন, মুসোলিনির সময়ে। জীবনের প্রথম দিকের গড়ে  ওঠার সময়টা। কোয়ারনের ‘রোমা’, ফেলিনির সেই ‘রোমা’র প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সাদা- কালোয় নব্য-বাস্তব জীবনের উপাখ্যান ফুটিয়ে তোলা, খানিক ব্যক্তিগত, খানিক ডকু, জীবনের ওঠানামার মাঝে শুরুর দিক থেকে পরিণত হয়ে ওঠা। সূক্ষ্মভাবে এক ক্লাস ডিভিসন, উচ্চ ও নিম্নবিত্ত। এটাই লাতিন আমেরিকার নব্য-বাস্তবতা। সেজন্যই কোয়ারনের ‘রোমা’ এক মাস্টারপিস।         

পরিশেষে, আর এক সিনেমা, ইচ্ছে থাকলে দেখুন। গুয়াতেমালার পরিচালক বাস্তামান্তের ছবি ‘ইকানুল’ (দ্য ভলক্যানো, ২০১৫)। কাকচিকেল ভাষায়  বানানো। এই ভাষা মায়া সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু ভাষা, টিমটিম করে মাত্র কিছু সংখ্যক গুয়াতেমালার আদিবাসীদের ভেতর এখনো কথ্য হিসেবে রয়েছে। সেই ভাষায় এক সুররিয়েল ছবি।

আজ শেষ করি এই লেখার খানিক ইতিহাস টেনে। এই ধারাবাহিকে আমরা হলিউডের ক্লাসিক নিয়ে আলোচনা করেছি, সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বের। এছাড়াও আর্ট হাউজ, এক্সপেরিমেন্টাল ছবি। আবার এশিয়া মহাদেশ থেকে জাপান, দক্ষিণ  কোরিয়া, ইরান, চিন; ইউরোপ থেকে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া; উত্তর ও দক্ষিন আফ্রিকা; লাতিন আমেরিকার মেক্সিকো, চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা – প্রায় সব মহাদেশ থেকেই আলোচনা করেছি। বাকি রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আর কিছু সংখ্যক বাছাই দেশ, যেমন বার্গম্যানের সুইডেন, যেগুলো আমরা পরে কোন এক সময় ফিরে দেখব। তাহলে এবার কয়েকটা পর্বে আমার বাছাই কিছু নায়ক, নায়িকা আর পরিচালককে নিয়ে একটু চর্বি চিবোনো যাক। কেমন! তারপর আবার পৃথিবী ঘুরতে বেরোব।

(ক্রমশ) 

 


কিম জ্যে-হিউন

 

পরিচালক কিম কি-দুক সততার সাথে সিনেমা বানাতে চান

 

(কিম কি-দুক মানব সত্ত্বার সর্বজনীন দিকটিকেই খোঁজেন)

 

(অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী )




কিম কি-দুক একজন কোরীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা যাঁর ছবিগুলো সম্ভবত বহির্পৃথিবীতেই বেশি জনপ্রিয়। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্রের দূর্ঘটনা নিয়ে তাঁর নির্মিত সিনেমা ‘স্টপ’ সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে।  মঙ্গলবার ‘কোরিয়ান ফিল্ম কমিশন’ প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী এই ছবিটি মাত্র ২৪১  জন দর্শক দেখেছেন। একই সময়ে কোরিয়াতেই কোন পারমাণবিক বিদ্যু কেন্দ্রে কল্পিত দূর্ঘটনা নিয়ে বানানো সিনেমা ‘প্যান্ডোরা’ একই দিনে ১.৭৮ মিলিয়ন দর্শক দেখেছে এবং কোরিয়ার স্থানীয় বক্স অফিসে ছবিটি ১ নং অবস্থানে থেকেছে। ‘স্টপ’ ও ‘প্যান্ডোরা’- এ দুই ছবির টিকিট বিক্রির পরিমাণ তুলনা করা অনুচিত হবে যেহেতু কিম কি-দুক ছবিটি বানিয়েছেন মাত্র ১০ মিলিয়ন ইওন বা ৮,৫৪১ মার্কিনী ডলার ব্যয়ে আর ‘প্যান্ডোরা’ ছবির নির্মাণে খরচ হয়েছে ১০ বিলিয়ন ইওন বা ৮.৫ মিলিয়ন মার্কিনী ডলার। ‘স্পট’ ছবিটি যেখানে শুধুই একটি মাত্র  ইন্ডি ফিল্ম হাউসে এবং ঘরে বসে অনলাইন প্লাস আইপিটিভিতে দেখার সুযোগ মিলছে, তখন ‘প্যান্ডোরা’ দেখানো হচ্ছে দেশ জুড়ে। যাইহোক, কিম তাঁর ছবির  দর্শনের দিকে নির্দেশ করে সবাইকে বুঝিয়েছেন যে কেন তাঁর সিনেমা দেশের  চেয়ে বহির্পৃথিবীতেই বেশি সমাদৃত।

“বহু বিদেশী সাংবাদিকরাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে কেন আমার ছবি কোরিয়ার চেয়ে বিদেশে বেশি সমাদৃত”, গত মঙ্গলবার মধ্য সিউলের ‘জোংনো’ নামে এক কাফেতে ‘দ্য কোরিয়া টাইমস’ পত্রিকার সাথে এক আলাপচারিতায়  কিম কি-দুক একথা বলেছেন। “আমাকে তখন বলতে হয় যে হতে পারে আমার গল্পগুলো মানবসত্ত্বার সর্বজনীন দিকে আলোকপাত করাতেই বেশি মনোযোগী। সোজা কথায় আমি যেটা বোঝাতে চাইছি যে পৃথিবীর প্রতিটি জাতিই তার জনগণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, তবে আমরা বা কোরীয়রা নিজেদের বিষয়ে অধিকতর গর্বিত। যেহেতু আমাদের শেখানো হয় যে আমরা অন্যদের চেয়ে উন্নততর। কিন্ত আপনি যদি ভ্রমণ করেন এবং সারা পৃথিবী ঘুরে দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে প্রতিটি জাতিরই রয়েছে তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য এবং সেই স্বাতন্ত্র্যকে আমি আমার সিনেমায় অন্তর্ভুক্ত করতে ভালবাসিক”।

“কোরিয়ায় জনপ্রিয় সিনেমাগুলো জাতিগত গৌরবে পরিপূর্ণ এবং এসব সিনেমায় দেখানো হয় যে আমরা পৃথিবীর সেরা। কিন্ত আমার কৌতূহল হচ্ছে যে এমন দাবির আসলে বস্তগত নিরপেক্ষতা কতটুকু। আমার সিনেমা সারা পৃথিবীতেই দেখা হয় - দক্ষিণ আমেরিকা, রাশিয়া বা চীনে মানুষ এ কারণেই আমার ছবি দেখে যে আমি মূলত: মানব সত্ত্বার সর্বজনীন দিক নিয়েই কাজ করি”। কিম বলেন।

গত বিশ বছরে কিম কি-দুক ২২টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন যার ভেতর ‘পিয়েতা’ ৬৯তম ‘ভেনিস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল‘-এ ‘গোল্ডেন লায়ন’  জয় করেছে এবং এর আগে কিম ৬১তম ‘ভেনিস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ তাঁর ‘থ্রি-আয়রন’ ছবির জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার অর্জন  করেছিলেন। কিমের ছবিগুলো ভীতিকর এবং অস্বস্তিদায়ক নানা দৃশ্য অসঙ্কোচে প্রদর্শন করে এবং তিনি তাঁর বক্তব্য প্রকাশে যতটা সম্ভব বাস্তববাদী হবার চেষ্টা করেন।

এই পরিচালক আরো বলেন যে সামনে তিনি ফ্রান্স, নিউ ইয়র্ক, লস এ্যাঞ্জেলস এবং এমনকি কাজাখস্থানের আলমেটিতে ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন যাতে তিনি তাঁর সামনের সিনেমার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতে পারেন।

প্রশ্ন: দূর্ঘটনা নিয়ে কেউ একটি সিনেমা বানাতে চাইলে আশপাশে কত রকমের দূর্ঘটনার ঘটনাই ত’ আছে। আপনি বিশেষ ভাবে কেন ফুকুশিমার বিষয়েই  আগ্রহী হলেন?

উত্তর: হারিকেন, বিশাল মাত্রার ভূমিকম্প বা ভয়ানক তুষারঝড়ের মত নানা ধরনের দূর্যোগই বর্তমানে আমাদের আশঙ্কিত করছে। কিন্ত একটি পারমাণবিক  বিদ্যুত কেন্দ্রে বিষ্ফোরিত দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থদের সংখ্যা ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিসরটি একটু ভিন্ন। পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার ক্ষরণ আমাদের চোখে এই দূর্ঘটনার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটু পরেই ধরা পড়ে এবং সাথে সাথে ধরা পড়ে না।

অথচ একই সময়ে কোরিয়া ও চীনের মত দেশগুলো পারমাণবিক প্ল্যান্টের সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত অনেক দেশই পারমাণবিক বিদ্যুতের উপর রীতিমতো নির্ভরশীল। আমি এই ভয়ানক প্রবণতাটিকেই থামাতে চেয়েছি।

আমার ছবির দর্শক শুধু কোরীয় দর্শকেই সীমাবদ্ধ নয়। বরঞ্চ আমার আছে বৈশ্বিক দর্শক শ্রেণি। একারণেই আমার সিনেমাটির ঘটনা ঘটেছে জাপানে এবং জাপানী অভিনেতারা এ ছবিতে অভিনয় করেছেন।

প্রশ্ন: কিন্ত আপনার ছবিতে কিছু অস্বস্তিকর দৃশ্য আছে। যেমন, কোথাও কোথাও জাপানী কোন অভিনেতাকে দেখা যাচ্ছে কোরীয় কাপ ন্যুডলস খাচ্ছেন বা তাঁর কম্পিউটার কোরীয় ভাষায় সেট করা।

উত্তর: ‘স্টপ’ একটি স্বল্প-বাজেট চলচ্চিত্র এবং ছবিটির নির্মাণগত নানা ত্রুটি  লক্ষ্য ও সংশোধন করার জন্য দরকারী একটি ‘আর্ট টিম’ নিয়োগ করার মত আর্থিক সামর্থ্য তখন আমার ছিল না। অবশ্য আমার আগের ছবিগুলোতেও এমন কিছু না কিছু ভুল-ত্রুটি থেকে থাকবে। তবু দর্শক এসব ভুল-ত্রুটি মেনে নেয় যেহেতু এই কাজগুলো কিম কি-দুকের। খুঁটি-নাটি নানা ডিটেইলেসর বদলে আমি সবসময়ই আমার মূল বক্তব্য প্রকাশে বেশি আগ্রহী।

প্রশ্ন: একা হাতে একটি দূর্যোগের সিনেমা বানানোর শক্তির দিকটি কি?

উত্তর: সত্যি বলতে এটাকে একটি ‘দূর্যোগ সিনেমা’ বলাটা আমার জন্য  অস্বস্তিকর। প্রথমে আমি টোকিও শহরে ইস্পাতের মিনার ভেঙ্গে পড়ছে এমন দৃশ্য দেখানোর জন্য কিছু কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজ করেছিলাম। কিন্ত পরে আমি দৃশ্যটি বাদ দিয়ে দিই, যেহেতু এটা বড্ড অপেশাদারী দেখাচ্ছিল। কাজেই  আমি এই সিনেমাটি অনেকটা নাটকের আঙ্গিকে বানাতে চাইলাম। দেশ জুড়ে নানা ধ্বংস ও অর্থনৈতিক ক্ষয়-ক্ষতির কিছু দৃশ্য দেখানোর চেয়ে পারমাণবিক বিদ্যু কেন্দ্রের নি:সরিত তেজষ্ক্রিয়তার কারণে সাধারণ মানুষের মনের মানসিক পরিবর্তনকেই আমি আমার কাহিনীর উপজীব্য করলাম। সম্ভবত: এই ধারার ছবিতে আমি বড় গভীরে যেতে চাইলাম।

প্রশ্ন: দর্শকের কাছ থেকে সাধারণত: আপনি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া বা মতামত পেতে ভালবাসেন?

উত্তর: একবার ‘য়্যুবারি‘তে একটি জাপানী চলচ্চিত্র উৎসবে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সেখানে আমি ‘স্টপ’ নিয়ে গেলাম ও স্থানীয় দর্শক-শ্রোতাদের  সাথে আমার কথা হলো। তাঁরা জানতেন যে আমার এই ছবিটিতে বাজেট কম এবং ছবিটির কিছু কিছু জায়গায় আরো উত্তরণ ঘটানোর বিষয় আছে। তবে তাঁরা এসব খুঁটি-নাটি বিষয় নিয়ে কথা তেমন বলেননি। বরঞ্চ তাঁরা এ বিষয়টিই ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিলেন যে একজন কোরীয় পরিচালক জাপানে ঘটা একটি দূর্ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন যা কোন জাপানী পরিচালক বানাননি। এবং তাঁরা আশা করছিলেন যে এই সিনেমাটি তাঁরা তাঁদের দেশে দেখাতে পারবেন।

প্রশ্ন: আপনার ছবিগুলো মুখ্যত: মূল চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক দিককে তুলে ধরে। কেন?

উত্তর: গত বিশ বছর ধরে আমি সিমেনা বানাচ্ছি। তবে, অন্তিমে এই সব সিনেমাই মানবীয় কিছু গল্প বলে। আরো যেহেতু আমি নিজেই আমার সিনেমার অর্থলগ্নীকারী, সিনেমাগুলোর আয়তন আমি খুব বেশি বাড়াতে পারিনি। সিনেমার কারিগরী নানা দিক, যেমন, স্পেশাল এফেক্ট বা রূপসজ্জায় আমি খুব বেশি খরচ  করতে পারি না বলে আমার কাজগুলোর আবেদন প্রায়ই একটু নাটকীয় বা চরিত্রগুলোর উপর আলোকসম্পাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। টাকা ফিল্ম বা সিনেমার পরিসরকে বড় করে। তবে বড় আকারের বিনিয়োগ ছাড়া একটি ছবির পরিসর আর একটি উপায়েই বাড়ানো যায় : সেটা হচ্ছে কীভাবে আপনি আপনার  চরিত্রগুলোর আবেগকে একটি অর্থপূর্ণ উপায়ে গঠন করছেন। সুতরাং, আপনি যদি আমার সিনেমা দেখেন, তবে আপনাকে আমার ছবির বাণীকে গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্ন: আপনার সিনেমা প্রায়ই নানা ভয়ানক ও অস্বস্তিকর দৃশ্য প্রদর্শন করে। কেন আপনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এমনটা প্রদর্শন করেই চলেছেন?

উত্তর: আমি আমার ছবিতে কোন মিথ্যা কথা বলতে চাই না। প্রতিবারই যখন আমি একটি নতুন সিনেমা রিলিজ করি, আমি যেন একটু হলেও নিজের উত্তরণ ঘটাই এবং আমি মনে করি যে ওসব দৃশ্য খোলাখুলি ভাবে দেখানোর আমার অধিকার আছে। সমাজে নানা ‘স্বস্তিদায়ক‘ ছবি ত’ আছেই। আমার ছবি যদি শুধু  একটি ছোট্ট দর্শক বৃত্তই দেখে থাকে, সেক্ষেত্রে আমি ত’ চাইবই যে এই ছবিগুলো দিয়ে আমি যেসব বিষয়ে জোর দিতে চাই, সেটা তাঁরা দেখুক। আমার সিনেমায় আমার আপন ভুবন বিধৃত এবং সেটাই গল্পের কেন্দ্র। সময় বয়ে চলার  সাথে সাথে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে আমার সিনেমার ব্যাখ্যা করতে পারে এবং সিনেমা দেখার পর দর্শক নিজের কাছে ফেরার সময়ও তাঁর মত করেই আমার সিনেমার ব্যাখ্যা করতে পারেন।

প্রশ্ন: একটি সিনেমা বানানোর সময় আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি?

উত্তর: সত্যি। একটু আগেই আমি এটা বলেছি। কিম কি-দুক হলেন কিম কি-দুক। পুরো বিষয়টিই হলো সততার সাথে একটি ছবি বানানো হচ্ছে কি না। যে  মূহূর্তে আমি দর্শকের স্বাদ অনুসারে আমার ছবিটি বানাতে বা বাজারজাত করতে  চাইব এবং জনপ্রিয় অভিনেতাদের অভিনয়ে ডাকব, পরিচালক হিসেবে তখনি আমি হারিয়ে যাই এবং সিনেমা থেকে আমার সত্যও হারিয়ে যায়। আমি কিন্ত আমার বক্তব্যকেই তুলে ধরতে চাই। যেহেতু আমার বানানো সিনেমাগুলোয় আমি নিজেই নিজের হৃদস্পন্দন শুনি।



 

কিম কি দুকের এই আলাপচারিতাটি কোরীয় পত্রিকা ‘‘দ্য কোরিয়ান টাইমস‘-এর ‘শিল্প ও বিনোদন‘  পাতায় ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ তারিখে প্রথম প্রকাশিত হয়। অন্তর্জাল থেকে সেটারই বঙ্গানুবাদ এখানে পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো।

 

(কিম কি দুক ১৯৬০ সালের ২০শে ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল ড্রপ আউট কিম কারখানায় শ্রমিক ও সেনাবাহিনীতে নিচু পদে কাজ করে পরবর্তীতে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্যারিসে সড়ক অঙ্কণ বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন করেন। এরপর নিজ দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে এসে শুরু করেন চিত্রনাট্য লেখার কাজ এবং ১৯৯৫ সালে কোরিয়ান ফিল্ম কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান। পরের বছর তিনি ক্রোকোডাইল নামক একটি স্বল্প বাজেটের চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ছবি রিয়্যাল ফিকশন ২৩তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নেয়। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সামারিটান গার্ল চলচ্চিত্রের জন্য এবং ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ৩-আয়রন চলচ্চিত্রের জন্য তিনি সেরা পরিচালকের সম্মানে ভূষিত হন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে পিয়েটা নামক তার চলচ্চিত্রটি ভেনিস, বার্লিন ও কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের সম্মান লাভ করে এবং ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার লাভ করে। জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক দূর্ঘটনার প্রেক্ষিতেও সিনেমা নির্মাণ করেছেন তিনি। তবে তাঁর সব কীর্তি ছাপিয়ে গেছে জেন বৌদ্ধ দর্শনের বাণী সম্বলিত স্প্রিং, সামার, অটাম, উইন্টার... এ্যান্ড স্প্রিং সিনেমাটি। মাত্র ৪৪ বছরে এমন গভীর আত্মিক দর্শন সম্বলিত সিনেমা নির্মাণ সত্যিই অভাবিত। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর লাটভিয়ায় তাঁর শেষ ছবির শ্যুটিংয়ের  কাজে গিয়ে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে এই অমিত প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারের অকাল মৃত্যু ঘটে। ‘কালিমাটি’-র পাঠকদের জন্য জাপানের  ফুকুশিমা পারমাণবিক দূর্ঘটনা নিয়ে ‘স্টপ’ সিনেমা নির্মাণের পর ‘দ্য কোরিয়ান টাইমস’ পত্রিকার সাথে কিমের আলাপচারিতার অনুবাদ তুলে ধরা হলো।

২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমায় ঘটা পারমাণবিক দূর্ঘটনার প্রেক্ষিতে কিম কি-দুকের চলচ্চিত্র ‘স্ট’ সারা পৃথিবীতে প্রথম প্রদর্শিত হয় ২০১৫ সালের ৯ই  জুলাই তারিখে। এই সিনেমার কাহিনী এক তরুণ জাপানী দম্পতিকে ঘিরে আবর্তিত। বধূটি যখন গর্ভবতী, তখনি ফুকুশিমার দূর্ঘটনা ঘটে। তেজষ্ক্রিয়া বিষ্ফোরণের প্রভাবে গর্ভবতী মেয়েটির সন্তান পঙ্গু হয়ে জন্ম নিতে পারে। এখন কি তবে এই দম্পতি নব সম্ভাবনাময়ী মায়ের গর্ভপাত ঘটাতেই সম্মত হবে? এই মানসিক দোটানা ও অস্থিরতায় একটা সময় দুজনেই যেন উন্মাদ হয়ে পড়ে।)

অদিতি ফাল্গুনী

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)




(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)


অধ্যায় - ২ / ৩

উৎস (Origin):

একইভাবে দেখা গেছে যে, পরাজিত দলপতিদের মধ্যে কয়েকজন নতুন সমাজে উচ্চ সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছিল। বলবুথা (Balbutha) এবং তারুকসা'র (Taruka) মতো দাস দলপতিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহারগুলি যাজকীয় স্বীকৃতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে অকুন্ঠ প্রশংসা লাভ করেছিল এবং নতুন ব্যবস্থায় তাদের পদমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দাসেরা যে উপহার প্রদান করার মতো অবস্থায় বিদ্যমান ছিল এবং উদার ও দানশীল হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল, তা থেকে তাদের উৎস 'দাস' হওয়ার এবং তাদের 'দাস' বিশেষণটির উৎপত্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। পরবর্তীকালে তাদের আত্মীকরণের প্রক্রিয়া চলেছিল, যাতে ভবিষ্যত সাহিত্যসমূহ এই ঐতিহ্যকে নথিভুক্ত করে যে প্রতার্দনা (Pratardana) দৈবদাসী ঈন্দ্রের জগতে পদার্পণ করেছিল, যে ঈন্দ্র ঐতিহাসিক ভাবে আর্য আক্রমণকারীদের ঔপাধিক শাসক ছিলেন।

পুরাতন ইতিহাস, সাধারণ আর্য জনসাধারণ ও পূর্ববর্তী সমাজের বেঁচে থাকা মানুষদের আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার উপর কষ্টসহকারে hardly) কোনো আলোকপাত করেছে। সম্ভবত তাদের বেশিরভাগই পরিনত হয়েছিল, যাকে বলা হয় আর্য সমাজের চতুর্থ বর্ণে। কিন্ত আমরা যদি 'পুরুষাসুক্ত'র (Purusasukta) বাইরে অবস্থান করি, সেক্ষেত্রে ঋগবেদ-এর পর্যায়কালের মধ্যে শূদ্র বর্ণের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। যদিও প্রাক-আর্য যুগে, নারীদাসীদের একটি ক্ষুদ্র ক্রীতদাসসুলভ গোষ্ঠী বিদ্যমান ছিল। এটি মনেহয় যে, আর্যদের শত্রুদের মধ্যেকার পুরুষ সদস্যেরা যখন মারা পড়েছিল, তখন তাদের স্ত্রীলোকেরা দাসত্বে পর্যবসিত হয়েছিল। এইভাবে, এটি কথিত আছে যে, পুরুকুৎসা'র (Purukutsa's) পুত্র ত্রাসাদস্যু (Trasadssyu), পঞ্চাশটি স্ত্রীলোক-কে উপহার স্বরূপ দান করেছিল। পুনরায়, নারী দাসেদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় অথর্ববেদ-এর শুরুর দিকের অংশগুলিতে। সেখানে নারী ক্রীতদাসেরা প্রদর্শিত হয়েছে সিক্ত হস্তে মুষল ও হামানদিস্তা ব্যবহার করতে এবং গরুর গোবর দিয়ে ঘুঁটে লেপন করতে, যা দর্শায় যে তারা গৃহস্থালীর কাজে ব্যপৃত ছিল। এই সঙ্কলন সুপ্রাচীন কালো-দাসী'র (black dasi) প্রাচীনতম উল্লেখ উপলব্ধ করায়। এইসব উল্লেখসমূহ সেইজন্য সুপারিশ করে যে গোড়ার দিকের বৈদিক সমাজে নারী ক্রীতদাসদের গৃহস্থালীর কাজে নিয়োগ করা হতো। দাসী শব্দটির ব্যবহার এটি সুনিশ্চিত করে যে এই সমস্ত নারীরা ছিল পরাজিত দাসেদের নারীজাতি।

দাস শব্দটির ক্রীতদাস অর্থে ব্যাবহার সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায় ঋগবেদের শেষের দিকের অংশগুলিতে। দুটি উল্লেখের ঘটনা দেখা গেছে প্রথম পুস্তকে, একটি দশম পুস্তকে এবং একটি সন্নিবেশিত হয়েছে অষ্টম পুস্তকের অনুপূরক স্তোত্রগুলির মধ্যে, যেগুলিকে বালখিল্য (valakhilya) বলা হয়। এই ধরনের গোড়ার দিকের একমাত্র উল্লেখটি পাওয়া গেছে অষ্টম পুস্তকে। ঋগবেদে ক্রীতদাস অর্থে আর অন্য কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি, এবং সেইজন্য এটি পরিষ্কার যে, গোড়ার দিকের ঋগবৈদিক পর্যায়ে পুরুষ-ক্রীতদাসের অস্তিত্ব ছিলোনা বললেই চলে।

শেষের দিকের ঋগবৈদিক পর্যায়ে দাসেদের সংখ্যা ও চরিত্র সম্পর্কে উল্লেখসমূহ কেবলমাত্র একটি অস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে। বালখিল্য (valakhilya) একশ'টি ক্রীতদাসের উল্লেখ করেছে, যাদের গাধা-ভেড়ার সরণীতে ধরা হয়েছে। অন্য একটি পরবর্তী উল্লেখে 'দাস-প্রভর্গ (dasa-pravarga) শব্দটি, সম্পদ বা ক্রীতদাসদের সমাবেশ বোঝাতে পারে। এটি সুপারিশ করে যে, ঋগবৈদিক পর্যায়ের শেষের দিকে ক্রীতদাসেরা সংখ্যাগত দিক থেকে বেড়ে চলেছিল, কিন্ত তাদের উৎপাদনের কাজে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। তারা তাদের যাজকীয় অথবা যোদ্ধা প্রভূদের গৃহস্থালী কাজের পরিচারক হিসেবে নিযুক্ত ছিল বলে প্রতীত হয়। এইসব প্রভূরা সাধারণভাবে যোদ্ধা ছিল ; কেবলমাত্র একটি উল্লেখে ক্রীতদাসদের প্রভূ হিসেবে  যাজক দীর্ঘতামস (Dirghatamas)-এর কথা উদ্ধৃত করেছে। তাদের স্বাধীনভাবে গবাদিপশুর সাথে ছেড়ে দেওয়া যেতো। এটি মনে হয় যে, ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতাই ছিল ঋণখেলাপকারীর দাসত্ববন্ধনের কারণ। কিন্ত বিশেষত দাস নামটি বোঝায় যে, বৈদিক যুগে যুদ্ধ্ই ছিল দাসত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

কারা ছিল দাসেরা? তাদের সাধারণত দস্যুদের সাথে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্ত 'দস্যু-হত্যা'র (dasyu-hatya) বিপরীতে 'দস-হত্যা' (dasa-hatya) শব্দটির অনুপস্থিতি, পার্বত্য- উপজাতীয় যুদ্ধে আর্যদের সহায়ক হিসেবে দাসেদের উপস্থিতি, 'অপ-ব্রত' (apa-vrata), 'অন্য-ব্রত' (anya-vrata) ইত্যাদির বিবরণের অনুপস্থিতি, তিন জায়গায় দাস-ভিসাস (dasa-visas)-এর উল্লেখ এবং সর্বোপরি 'ইরানী দাহায়' (Iranian Dahae) এক সেথিয়ান (Seythian) উপজাতি'র সাথে তাদের একীভবন প্রভৃতি, দাসেদের সাথে দস্যুদের তীক্ষ্ণ পার্থক্য নির্দেশ করে, যাদের আর্যদের সাথে কষ্টকল্পিতভাবেও (hardly) কোনো সাদৃশ্য আছে বলে মনে হয় না। ভারতীয়-ইউরোপীয় ভাষায় দস্যু শব্দটির কোনো সাধারণ শব্দ (common word) নেই। দস্যু শব্দটি পুরাতন পারসিক (Old Parsian) এবং অবেস্তান (Avestan) ভাষাগুলিতে রয়েছে, কিন্ত সেগুলির অর্থ মানুষের বাসস্থান, জেলা, প্রদেশ, দেশ প্রভৃতি ; এগুলি প্রাচীন ভারতীয় দস্যুদে'র সাথে বৈসাদৃশ্যমূলক শব্দ, দস্যু বলতে বোঝায় কোনো মানুষ, কোনো দেশ নয়।অপরদিকে 'দাস' শব্দটি বহুবিধ ভাষাই সাধারণ (Common) অর্থে ব্যবহার করে। এইভাবে, গ্রীক 'দৌলাস' (doulas), সার্ভাস (servus) মাইশেনেয়েন, (Mycenaean) দোয়েরা (doera)-তে প্রত্যায়িত (attested) হওয়া শব্দটি সংশৃষ্ট হয়েছে ইরানীয় 'দাহা'র সাথে এবং সেটি ইঙ্গিত করে ইন্দো-ইউরোপীয় 'দোস' (dos) শব্দের দিকে। এই সমস্ত ভাষতেই শব্দটির অর্থ হয় 'মানুষ' বা 'বীর', যেটি অবশেষে এসে দাঁড়িয়েছে জাতিগত তাৎপর্যে। গ্রীকেরা জানতো, একটি মানুষকে দাই (Daai), দাঐ (Daoi), দোয়াই (Doai) প্রভৃতি বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এইচ ডব্লিউ বেইলী (H W Baily) তুলে ধরেছেন যে, দাস শব্দটি ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে কষ্টসাধ্য ভাবেও (hardly) একটি যথার্থ শব্দ নয়। কিন্ত ঋগবেদের অসংখ্য উল্লেখসমূহে বলা হয়েছে যে দাসেরা হয় আর্যদের বিরোধী ছিল অথবা সহযোগী। প্রাচীন ভারতে দাসা (dasa) শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে তার ভিত্তি --- দাস থেকে, যার মানে ক্রোধপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হবে (to treat violently)। তারা একটি সমগোত্রীয় জাতিগত বংশ নাও হয়ে থাকতে পারে কিন্ত তারা নিঃসন্দেহে বৈদিক পর্যায়ের একটি জনগোষ্ঠী ছিল। প্রফেসর বেইলী (Proessor Baily) নিজেই এমন কিছু মানুষের অস্তিত্বের বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন যাদের ডাকা হতো তাদের জাতিগত নাম ইরানীয় দাহা (Iranian daha) নামে, পরবর্তীকালে ক্সেরক্সেস (Xerxes) নামক একটি শিলালিপিতে, যাদের নাম উল্লেখিত হয়েছিল সাকা (saka) নামের আগে। এটি যথার্থ ভাবে প্রস্তাবিত করা হয়েছে যে, প্রাচীন ভারতের দাস পদটি পরবর্তীকালের সামাজিক পরিবেশজনিত কারণে মর্যাদাহানিকর হয়ে উঠেছিল।

সম্ভবত দাসেরা ছিল সংযুক্ত ইন্দো-আর্য জনসাধারণের একটি অগ্রবর্তী রক্ষীবাহিনী, যারা ভারতে এসেছিল সেই সময় যখন ক্যাসিটেস-রা (Kassites) খ্রীষ্টপূর্ব ১৭৫০ সালে ব্যাবেলোনিয়া'য় আবির্ভূত হয়েছিল। বিষয়টিকে সংযুক্ত করা যেতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফলের সাথে, যেটি অনুমান  করেছে যে, উত্তর পার্সিয়া (Northern Persia) থেকে ভারতের দিকে মানুষজনের গতিবিধির, হয় একটি ক্রমিক গতি সক্রিয় ছিল (Continues movement of people) অথবা দুটি বিশাল গতিবিধি সঙ্ঘটিত হয়েছিল এবং প্রথমটির কাল নির্ধারিত করা হয়েছে ২০০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দের ঠিক পরে। যেহেতু দাসেরা ঋক-বৈদিক জনতার সাথে ভাষা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান ভাগ (share) করে নিয়েছিল, তাই শেষোক্তরা তাদের প্রতি এক মীমাংসাসূচক নীতির অবলম্বন করেছিল এবং সহজেই দেবদাস (Divodas), বলবুথা (Balbutha) ও তারুক্সা (Taruksa) নামক দাস-দলপতিদের সাথে সংমিশ্রিত হয়েছিল। এটিই কারণ ছিল যে দাসেরা, তাদের উপজাতীয় পারস্পরিক সংঘর্ষগুলির ক্ষেত্রে বারংবার আর্যদের মিত্রশক্তি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এইভাবে এটি অধিষ্ঠিত হয় যে, ক্রীতদাস অর্থে 'দাস' নামটি ভারতের অনার্য বসবাসকারীদের মধ্যে থেকে উদ্ভুত হয়নি বরং সেটি হয়েছে ইন্দো-আর্য সংমিশ্রিত বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে। ইরানে যারা উৎকীর্তিত (lauded) হয়েছিল, ভারতে তারা নিন্দিত হয়েছে, সম্ভবত ইন্দো-আর্যদের একটি ভূতপূর্ব জন-তরঙ্গের কারণে, যারা পরবর্তী সেই একই লোকেদের জন-তরঙ্গের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঋগবেদের পরবর্তী পর্যায়ে, দাস শব্দটি হয়ত নির্বিচারে প্রযুক্ত হয়েছে কেবলমাত্র বেঁচে থাকা ইন্দো-ইউরোপিয়ান দাসেদের আচ্ছাদিত করার জন্যই নয় বরং প্রাক-আর্য দস্যু ও রাক্ষস এবং আর্যদের সেই সমস্ত অংশের জন্যও, যারা তাদের নিজ বর্গের আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে অধীনতায় হ্রস্বীকৃত (reduced) হয়েছে।

সম্ভবত দাসেরা ছিল সংযুক্ত ইন্দো-আর্য জনসাধারণের একটি অগ্রবর্তী রক্ষীবাহিনী, যারা ভারতে এসেছিল সেই সময় যখন ক্যাসিটেস-রা (Kassites) খ্রীষ্টপূর্ব ১৭৫০ সালে ব্যাবেলোনিয়া'য় আবির্ভূত হয়েছিল। বিষয়টিকে সংযুক্ত করা যেতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফলের সাথে, যেটি অনুমান  করেছে যে, উত্তর পার্সিয়া (Northern Persia) থেকে ভারতের দিকে মানুষজনের গতিবিধির, হয় একটি ক্রমিক গতি সক্রিয় ছিল (Continues movement of people) অথবা দুটি বিশাল গতিবিধি সঙ্ঘটিত হয়েছিল এবং প্রথমটির কাল নির্ধারিত করা হয়েছে ২০০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দের ঠিক পরে। যেহেতু দাসেরা ঋক-বৈদিক জনতার সাথে ভাষা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান ভাগ (share) করে নিয়েছিল, তাই শেষোক্তরা তাদের প্রতি এক মীমাংসাসূচক নীতির অবলম্বন করেছিল এবং সহজেই দেবদাস (Divodas), বলবুথা (Balbutha) ও তারুক্সা (Taruksa) নামক দাস-দলপতিদের সাথে সংমিশ্রিত হয়েছিল। এটিই কারণ ছিল যে দাসেরা, তাদের উপজাতীয় পারস্পরিক সংঘর্ষগুলির ক্ষেত্রে বারংবার আর্যদের মিত্রশক্তি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এইভাবে এটি অধিষ্ঠিত হয় যে, ক্রীতদাস অর্থে 'দাস' নামটি ভারতের অনার্য বসবাসকারীদের মধ্যে থেকে উদ্ভুত হয়নি বরং সেটি হয়েছে ইন্দো-আর্য সংমিশ্রিত বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে। ইরানে যারা উৎকীর্তিত (lauded) হয়েছিল, ভারতে তারা নিন্দিত হয়েছে, সম্ভবত ইন্দো-আর্যদের একটি ভূতপূর্ব জন-তরঙ্গের কারণে, যারা পরবর্তী সেই একই লোকেদের জন-তরঙ্গের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঋগবেদের পরবর্তী পর্যায়ে, দাস শব্দটি হয়ত নির্বিচারে প্রযুক্ত হয়েছে কেবলমাত্র বেঁচে থাকা ইন্দো-ইউরোপিয়ান দাসেদের আচ্ছাদিত করার জন্যই নয় বরং প্রাক-আর্য দস্যু ও রাক্ষস এবং আর্যদের সেই সমস্ত অংশের জন্যও, যারা তাদের নিজ বর্গের আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে অধীনতায় হ্রস্বীকৃত (reduced) হয়েছে।

আর্যরা যদি সংখ্যায় কম হতো, তাহলে তারা বিজয়ী মানুষদের উচ্চতর শ্রেণীর এক নতুন, সংখ্যালঘু শাসক হিসেবে নিজেদের অধিষ্ঠিত করতে পারতো, যেমনটি করেছিল হিট্টিটাস (Hittites), অ্যানাতোলিয়া (Anatolia) এবং ক্যাসিটেস (Cassites) ও মিটান্নিস-রা (Mitannis), মেসোপোটেমিয়াতে (Mesopotania)। কিন্ত ইরান ও ভারত, উভয় ক্ষেত্রেই ভাষাবিদ্যাগত অবস্থান ইঙ্গিত করে ব্যাপক পরিযানের (Mass migration) দিকে। ঋক-বৈদিক তথ্য-প্রমাণ এই অনুমনের পক্ষে মারাত্মক যে, আর্যরা সংখ্যালঘু অবস্থায় ভারতে নিজেদের আরোপিত করেছিল। বৈদিক রচনাসমূহে আমরা আর্য জাতির অসংখ্য গতিবিধি ও বসতি স্থাপনের ঘটনার সম্মুখীন হই। ১৯৪৭ সাল থেকে সম্পন্ন হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানসমূহ আর্যদের চিহ্নিতকরণ সম্পর্কিত এক ঝাঁক উন্নত তত্ত্বের ফসল উৎপাদিত করেছে। এইসব তথ্যসমূহের বেশ কয়েকটির মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করা যায়, যদি আমরা নবাগতদের ধারাবাহিক প্রবাহকে স্বীকার করে নিই, যারা ১৫০০ থেকে ৫০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দ পর্য্যন্ত সম্পুর্ন উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাদের সাংস্কৃতিক উপাদান সমূহের অজস্র ছাপ রেখে গেছে। যদিও গোড়ার দিকের ঋক-বৈদিক সভ্যতার অবশিষ্টাংশের শনাক্তকরণ কষ্টকর, তবুও গান্ধারা কবরগুলি হয়ত ১৮০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দে আর্যদের প্রথম অভ্যাগমন (arrival) ঘোষিত করতে পারে। সে যাই হোক, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং পাকিস্তান সংলগ্ন বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য উৎকীর্ণ শিলালিপি ও ধূসর মাটির পাত্র সম্বলিত নানান ভগ্নাবশেষ সমূহ সুপারিশ করে যে, ১০০০ থেকে ৫০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দের মধ্যে এইসব অঞ্চলে ব্যাপক হারে নবাগতদের জনবসতির পত্তন (settlements) হয়েছিল। সংখ্যাগত দিক থেকে মোট ৩১৫টি পি জি ডব্লিউ সাইটের (PGW Sites) (ভগ্নস্তুপ) উদ্ধার হয়েছে, বেশিরভাগই অবস্থিত উপরি গঙ্গা ও সাতলেজ অববাহিকায় এবং ঘাগ্গর (Ghaggar) উপত্যকায়। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানগুলি হরিয়ানার সরস্বতী (Sarasvati) ও দ্রসদবতী (Drsadvati) নদীর তীরে প্রায় ৩০০টি, পি জি ডব্লিউ সাইট-কে (ভগ্নস্তুপ-কে) প্রচারের আলোয় এনেছে এবং ইতিমধ্যে এই ধরনের সমস্ত ভগ্নস্তুপের সংখ্যা হয়ত ৫০০ অতিক্রম করে গেছে। যে সমস্ত ভগ্নস্তুপের খনন করা হয়েছে, জানা গেছে যে সেগুলি দুই থেকে তিন শতক যাবত জনপদ অধ্যুষিত ছিল।

পুনরায়, ভারতের বৃহত্তর পরিসর জুড়ে আর্য ভাষাগুলির বিন্যাস থেকে, তাদের ভাষাভাষীদের ব্যাপক পরিযানের বিষয়টি পূর্বাহ্নেই স্বীকৃত হয়ে গেছে। সংস্কৃত শব্দের প্রারম্ভে নানান মুন্ডা ও দ্রাবিড়ীয় শব্দের মজুত থাকা সত্ত্বেও, বৈদিক পর্যায় থেকেই উত্তর ভারতের মানুষের প্রাক-আর্য জীবনযাত্রা, নবাগতদের দ্বারা এত বেশি প্লাবিত হয়েছিল যে, তারা নিজেদের ভাষাকেও ধরে রাখতে পারেনি। যেমন পরবর্তীতে দেখানো হবে যে উত্তর ভারতে শূদ্ররা, বৈশ্যদের সহযোগ সহকারে জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু অংশ ছিল, কিন্ত সেক্ষেত্রে এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না যার দ্বারা দেখানো যায় যে তারা অনার্য ভাষা বলতো। কিন্ত অপর দিকে বৈদিক পর্যায়ের পরবর্তীতে, উপজাতীয় শূদ্রেরা আর্য-বাক্য বুঝতো, যা পরিস্ফুট হয়েছে বলিদানের সময় ব্যবহৃত তাদের ঠিকানার প্রস্তুত-প্রণালির মধ্য দিয়ে। এই সূত্রে মহাভারতের একটি পরম্পরাগত প্রথা তাৎপর্যপূর্ণ : "বেদ-এ অঙ্গীভূত সরস্বতীসমূহ, ব্রহ্মা দ্বারা ইতিপূর্বে সকল চার বর্ণের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল ; কিন্ত শূদ্রেরা, ধন উপার্জনের তাড়নায় অজ্ঞতার শিকার হয়ে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল, যে কারণে তারা তাদের বেদ সম্পর্কিত অধিকার থেকে বিচ্যুত হায়েছিল।" ওয়েবার (Weber) এই অংশটিকে এই অর্থে উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রাচীনকালে শূদ্ররা আর্যদের ভাষায় কথা বলতো। এটি সম্ভব যে কানাডীয় সীমান্তের উপজাতিরা তাদের নিজেদের স্থানীয় ভাষা ভুলে গিয়েছিল আর্য ভাষার স্বপক্ষে, যেমন বর্তমান সময়ে বিহারের কতিপয় পার্বত্য উপজাতি, তাদের নিজেদের ভাষা পরিত্যাগ করেছে এবং কুরমালি (Kurmali), সাদানা (Sadana) প্রভৃতি আর্যদের স্থানীয় ভাষা গ্রহণ করেছে, যদিও তাদের সংখ্যা, যাদের ভাষা তারা গ্রহণ করেছে, তাদের তুলনায় অনেক কম। এমনকি আধুনিক কালে, যখন আর্যভাষী জনসাধারণ, তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার-কে কেন্দ্র করে অনেক বেশী সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছে, তারা কিন্ত অনার্য ভাষাগুলিকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়নি, যে ভাষাগুলির কিছু ক্ষেত্রে, সতেজ বিকাশ ঘটানোর সামর্থ্য আছে।

(ক্রমশ)