কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


দুঃখ-পথ

 

-একেনে লেমে যাও দিদি। কোথায় যাবে বললে না হয়...

ভ্যানচালকের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই প্রমিতা নেমে পড়ল। যেখানে নামাল রাস্তাটা ওয়াই আকৃতির। একপাশে ঝোপঝাড়। সন্ধ্যা নেমেছে বলে বাকিটা ঠিক দেখা যায় না। ঝিঁঝির ডাক স্পষ্ট। ‌ছোট একটা আলো জ্বলছে রাস্তাটায়। প্রমিতা জানে শহুরে ভাষায় একে স্ট্রীটল্যাম্প বললেও তার আলো এত ম্লান হয় না। কিন্তু এই গ্রামের রাস্তার আলোটা কেমন যেন দুঃখ পথের হদিস দেয়।

-কী গো দিদিমুণি! ট্যাকাটা দাও। তা কোথায় যাবে গা?

কুড়ি টাকার নোটটা বাড়িয়ে দেয় প্রমিতা ভ্যানচালককে। কিন্তু কথার উত্তর দেয় না। প্রমিতার এই অব্যক্ত অবজ্ঞা মোটেই পছন্দ হলো না ভ্যানচালকের। সে মরিয়া।

-এই গেরামের এমন কোনো দিক নেই যা এই পেসাদ জানে না। পরে কিন্তু আবার আমায় খুঁজতে যেয়ো না। তুমি ন্যাড়া মাঠের মোড় বলেছিলে, সেখেনেই নামিয়ে দিয়ে গেলুম। কিন্তু নেড়া মাঠের মোড়ে ওই বুড়ি ছাড়া তো আর কেউ থাকে নেকো। তুমি কার কাছে এয়েচো?

-আপনি এখন যান। অন্ধকারে সেই বড় রাস্তা পর্যন্ত যেতে হবে তো!

ভ্যানচালকের কথায় ভাঙে না প্রমিতা। উত্তরটা দিয়ে সামনের দিকে হনহন করে এগিয়ে গেল ও। যেটুকু খোঁজ নিয়েছিল, ওইদিকেই রাস্তা বোধহয়। ওই তো আবছা আলো। প্রমিতা আলোকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের পাশের পথ বেয়ে। চাঁদের আলো এসে পড়ছে পায়ে। খানিকটা এগোতেই কাঁটাগাছের সঙ্গে ঠোক্কর লাগে। নীল সালোয়ার ফুঁড়ে একটা কাঁটা ক্ষতবিক্ষত করছে হাঁটুর নীচের অংশটা। নাহ! অস্বস্তি হচ্ছে না প্রমিতার। এসব খুচরো অসুবিধার গণ্ডি কবেই পার করেছে ও।

অবশেষে ঘরটায় পৌঁছলো। বাড়ি বলা চলে না। পারতপক্ষে একটা ঘর। একটাই ঘর। ঘরের চালে অজস্র হাঁ করা মুখ দৈন্যের গল্প শোনাচ্ছে। ঘরের ভেতরে একটা টিমটিমে মোমবাতি। ফুরিয়ে যাবে কিছুক্ষন পরেই। বুড়িটা শুয়ে রয়েছে। হাঁ করা মুখ। চোখদুটো আধবোজা। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে বুড়িটা। বিড়বিড় করে বলছে কিছু।

হ্যাঁ, এই তো মিলে গেছে। অবিকল সেই চোখ। শোভারানী চ্যাটার্জী। কী দেখতে পাচ্ছে প্রমিতা সেই চোখে? ঘেন্না নাকি অসহায়তা! প্রমিতা কাছে যায়।

-সাধন এলি?

সাধন চ্যাটার্জী। নামটা শুনেই একটা শিরশিরে স্রোত বয়ে গেল প্রমিতা শরীরের ভেতর। প্রমিতা। শুধু প্রমিতা! কাজের ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত শুধু এটাই ব্যবহার করে ও। প্রমিতা চ্যাটার্জী কেয়ার অফ সাধন চ্যাটার্জী লিখতে ঘেন্না করে ওর। অস্বস্তি হয়।

-সাধন! অ সাধন!

বুড়ি বিড়বিড় করে ওই একই নাম বলছে। প্রমিতা ফোন বার করে।

-হ্যাঁ এই বাড়িটাই। ন্যাড়া মাথার মোড়ের বাড়িটা। তবে আগে বোধহয় এরা বড় রাস্তার কাছে থাকতো। পুরনো বাড়িতে ছেলে বউ থাকে বোধহয়। তোমরা একেবারে এই বাড়ি পর্যন্ত এসো।

ফোন রেখে ব্যাগ থেকে বিস্কুট খুলে দেয় বুড়ির মুখের সামনে। প্রমিতার হাত ধরে বুড়ি উঠে বসে। বিস্কুট দুটো ফোকলা দাঁতে চেটেপুটে খায়।

-জল দিবি একটু?

প্রমিতা জলের গ্লাস বাড়িয়ে দেয়। ঢকঢক করে জল খায় বুড়ি। জলের গ্লাসটা ফেরত নিতে গিয়ে নীল রঙের প্লাস্টিকে পা পিছলে যায় প্রমিতার। কাঁটাগাছের থেকেও বেশি জোরে বেঁধে নিরীহ প্লাস্টিকটা। সেই নীল প্লাস্টিক। একটা দমবন্ধ পরিস্থিতি জন্ম নেয় প্রমিতার ভেতরে। এমন নীল রঙের প্লাস্টিক পেঁচিয়েই তো মেরে ফেলতে চেয়েছিল ওকে। মেয়ে হওয়ার অপরাধে। সাধন চ্যাটার্জী তখন প্রাণপণে প্লাস্টিকটা প্রমিতার মুখের ওপর চেপে ধরে রয়েছে। মা-হারা আট বছরের প্রমিতা তখন একটু প্রাণবায়ুর জন্য হাঁপাচ্ছে। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে  সেদিন এই শোভারানী চ্যাটার্জীও অপেক্ষা করেছিল নাতনির মৃত্যু দেখার। ভাগ্যিস প্রমিতার স্কুলের দিদিমণি সেই সময়ে এসে পড়েছিল ওর রেজাল্ট দিতে!  প্রমিতা তখন কোনমতে এই মরণফাঁদ থেকে পালিয়ে দৌড়চ্ছে। থামিয়েছিল একটা সাইকেলের ধাক্কা। অবশেষে সেই দিদিমনির হাত ধরেই ‘আলোর ঠিকানা’য় পৌঁছেছিল প্রমিতা। এখন মূলত প্রমিতাই সামলায় এনজিওটা। অত্যাচারিতা মহিলাদের নিয়ে কাজ করে ওরা। উদ্ধার করে, জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

প্রথম যেদিন শোভারানী চ্যাটার্জীর খবরটা পায়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি ওর। বাবা আর ঠাকুমার মধ্যে কখনো কোনো মনোমালিন্য দেখেনি প্রমিতা। কিন্তু তারপর খবর নিয়ে জেনেছে সাধন চ্যাটার্জী বয়সকালে আবার বিয়ে করে অন্য কোথাও ঘর বেঁধেছে। সম্পত্তি থেকে বেদখল করে দিয়েছে মাকে। রীতিমতো আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে সাধন চ্যাটার্জী শোভারাণী চ্যাটার্জীকে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে শোভারানী চ্যাটার্জী। এনজিওর পক্ষ থেকে প্রমিতা নিজেই নাম, ঠিকানা খুঁজে এসেছে এখানে। এমনকি সাধন চ্যাটার্জীর নামে পুলিশের খাতায় অভিযোগ দায়ের করার চিন্তাভাবনা করা হয়েছে এনজিওর পক্ষ থেকে। এনজিওতে এখানে আসার আগে প্রমিতা বলেছিল সব খবর সঠিক হলে ও জানাবে। আজ সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে।

প্রমিতার হাতে সেই নীল প্লাস্টিকটা। একটা অদ্ভুত তৃপ্তি হচ্ছে কী এখন? নাকি উল্লাস? প্রমিতার অসহায়তাটুকু যারা চেটেপুটে নিয়েছিল আজ তাদের জীবন  নিয়ন্ত্রণ করছে প্রমিতা। তৃপ্তিবোধ হচ্ছে প্রমিতার মনে। কিন্তু শুধু এটুকুই? একটা বেয়াড়া ইচ্ছে কী জাগছে? গোটা ঘর জুড়ে বয়স্ক মহিলার বাহ্যের গন্ধ। কেমন যেন মৃত্যু-গন্ধ। নীল রঙের প্লাস্টিকে যন্ত্রণার গন্ধ লেগে রয়েছে। শোভারানী চ্যাটার্জী আবার শুয়ে পড়েছে। কয়েক হাত দূরেই। নীল প্লাস্টিকটা হাতে নিয়ে বুড়ির দিকে এগিয়ে যায় প্রমিতা।

ফোনটা ঝমঝম করে বাজছে।

-হ্যালো!

-ম্যাডাম আমরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাইরে।

-ভেতরে এসো তোমরা, পাঁজাকোলা করে তুলতে হবে বুড়িকে, ফিরে গিয়ে ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে হবে। তোমরা চলে এসো এখনি। তোমরা এলে আমি অ্যাম্বুলেন্সে উঠে বসবো।

ফোনটা রেখে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে প্রমিতা।

 


5 কমেন্টস্: