কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

অঞ্জন সেনগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

রূটম্যান

 


(৫)

 

খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁন্ধো মন

এ বছর ঠান্ডাটা জম্পেশ পড়বে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে কুয়াশার আস্তরণ যে ক্রমশই গাঢ় হচ্ছে তা বাইরে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। সাধারণত গ্রাম-গঞ্জে আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যের চলন দেখে লোকেরা বেলার একটা আন্দাজ পেয়ে থাকে। ইদানীং তার উপায় নেই। রাস্তায় পা দিয়ে যেমন সামনে কিছুই দেখা যায় না, তেমনি মাথা যতই উঁচু করা যাক না কেন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সূর্যের মুখ দেখা মানুষের কম্মো নয়। যেন নব বধূ সারাক্ষণ এমন ভাবে অবগুন্ঠনের আড়ালে তার মুখ ঢেকে রেখেছে যে, তার নিজের লোকের একান্ত ইচ্ছে হলেও মুখ দেখার উপায় নেই। এ এক বিড়ম্বনাই বটে!

গ্রামের রাস্তায় সারারাত শিশির পড়লে সকাল হতে না হতেই তাতে হরেক রকমের আলপনার ছবি দেখা যায়। ধুলোর উপর তৈরি হয় সেই আলপনার প্রলেপ। তখনও গ্রামের সবাই বিছানা ছাড়লেও ঘর ছাড়ে না। বরং গায়ের চাদরটাকে আরো লেপ্টে নেয় শরীরের সাথে। হয়তো আঙিনায় মালসা বা অব্যবহৃত লোহার কড়াইয়ে আগুন জ্বলে ওঠে। কচি-কাঁচারা ছুটে আসে সেই আগুনে শরীর সেঁকতে। তাদের হাতগুলো মেলে ধরে আগুনের উপর। আর সেই গোল করে ঘিরে বসা হাতগুলোর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে আগুনের তাপ। সারা শরীর ধীরে ধীরে তাপ পায়। শিশুদের বাদ দিলে বাকিরা কিছু পরেই উঠে পড়ে। কারণ তখনও গোয়াল থেকে পোষ্যদের বাইরে আনা হয়নি। এর পরে আবার দুধে্ল গাভি হলে তার বাচ্চাকে কিছুটা মায়ের দুধ খাইয়ে তাড়াতাড়ি বেঁধে রাখতে হবে। তা না হলে সে একাই হয়তো মায়ের শরীর নিঙরে সব দুধটুকু খেয়ে নেবে। অবশ্য গৃহস্থেরা একেবারে মায়ের শরীরের সব দুধ নিঃশেষ করে না। কিছু রেখে দেয় তার সন্তানের জন্য। একটু পরে তাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। সে তখন তিড়িং বিড়িং করে মায়ের স্তন মুখে নিয়ে মনে মনে হাসে। এ হাসির কারণ ভিন্ন। গৃহস্বামীর তা বোধগম্যের বাইরে। যদিও বা বুঝতে পারেও তবু তার করার তেমন কিছুই থাকে না। এই ধরনের গাভিকে দুধ চুরানি বলে।  গৃহস্বামীর থেকে সে আরো চালাক। সে ইচ্ছে করেই মাতৃস্নেহে সব দুধ একবারে ছাড়ে না। দুধ দোয়ানোর লোকটি যতই পটু হোক না কেন, যতই দুধের বাঁটে বার বার গুঁতো দিক বা সুড়সুড়ি দিক না কেন কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা দুধ ভান্ডার গোয়ালার হাতের নাগালে আসে না। এ এক মজার খেলা চলে গোয়ালা আর গাভির মধ্যে! শেষে গোয়ালা ক্লান্ত হয়ে এক সময় কাজে ক্ষান্ত দেয় আর গৃহস্বামী এমন দুধ চুরানি গাভিটিকে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য তাতে গভিটির বয়েই গেছে। কারণ সে তার সন্তানকে একেবারে ক্ষুধার্ত রেখে সব দুধ ঐ পাষন্ড গোয়ালাকে কখনই দেবে না। পিঠে দু’ঘা পাচনবাড়ি পড়লেও নয়।

বেলা কত হল তা কিছুতেই বোঝার উপায় নেই। মালসার আগুন নিভে গেলেও সূর্যি যেন কিছুতেই উঠতে চায় না। কিন্তু আর তো গোয়াল আটকে অবলাদের রাখা যায় না। তাই প্রায় সব গৃহস্থ বাড়ি থেকেই একে একে বেরিয়ে আসে অবলাদের দল। আর তখনই সেই ভোরের রাস্তায় পাখিদের পায়ে কাটা নকশাগুলো একে একে পায়ের চাপে ভেঙে যেতে থাকে। আর বিরক্ত হয়ে পাখিরাও একটু সরে বসে।

এমনটা প্রাত্যহিক ছবি। আর এভাবেই পক্ষীকুলের প্রাতঃরাশ গ্রামের ধুলো ভরা রাস্তার পোকা থেকেই সারা হয়ে যায়। তবে সারা দিনের উদরপূর্তির জন্য চরৈবেতিই সম্বল। কখনও গাছের পাতায় লেগে থাকা পোকার স্বাদ গ্রহণ করে আবার কখনও গ্রামের গরু-মহিষের পিঠে চেপে তাদের শরীর খুঁটে বা কানের ভিতর থেকে নোংরা খেয়ে দিব্বি কেটে যায়। পাখিরা জানে এপার বা ওপারের খাবারের মধ্যে তারতম্য নেই। তবু তারা গরুর পিঠে উঠে একেবারে নদীর কিনারে চলে এলেও গরুটি যখন নদীর জলে নেমে পড়ে তখন পাখিরা বরং উড়ে গিয়ে পারের গাছে বসে ওদের ভেসে যাওয়াটা দেখে। কখনও আবার উড়তে উড়তে ফিরে আসে নিজেদের গ্রামের বাসায়।

কয়েক বছর ধরেই এই গানটি সীমান্ত ছোঁয়া গ্রামগুলোয় খুব চলছে। সবাই জানে সুবল কেন এই গানটি গায়। ও নিজে শিউলি হলেও গানটির নিগূঢ় অর্থ সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীদের কানে পৌছে দেওয়াটা ওরই কাজের মধ্যেই পড়ে। তবে একেবারে বিনামূল্যে নয়। হাজার হোক পরিশ্রমের তো একটা দাম আছে, নাকি!

আকাশের চলন দেখে সুবল আজ বেশ ভোর ভোর খেজুর রসের হাঁড়ি বাঁকে ঝুলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। মুখে লেগে রয়েছে সেই একই গানের কলি-‘খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁন্ধো মন। সময়ের কাজ না সারিলে মন যে হবে উচাটন’। সে নিজের ইচ্ছেমতো শব্দ জুড়ে জুড়ে গানটিকে আরো বাড়িয়ে নেয়। কারণ এই আদি গানের বাকিটুকু তার জানা নেই বা ভুলে গেছে। তবে ওতেই তার কাজ চলে যায়।

এ গানের বার্তা যারা বোঝার তারা ঠিকই বোঝে। সবার বোঝার জন্য নয়। তাই গান চলাকালীন কেউ বা ওর পাশে এসে শুধু বলে, কবে থেকে?

সুবল যৎসামান্য ঠোঁট ফাঁক করে বলে, কাল থেকে ।

এ যেন এক অমোঘ মন্ত্র, যা কিনা গুরুর নির্দেশের মতো সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। ব্যস! এবার আর কোন অসুবিধা নেই। কিছু লোকের মধ্যে শুরু হয়ে যায় এক গভীর চঞ্চলতা। কাজটা বেশিক্ষণের নয়। শুধু সন্তরণ প্রতিযোগিতার মতো। ভাগ্যিস গঙ্গা বা পদ্মায় কুমির নেই! কিন্তু তার আগের প্রস্তুতিটাই হল আসল। অনেক হ্যাপা। চোখ-কান দুটোকেই সজাগ রাখতে হয়। বলা যায় না। বিপদ তো সব সময় ওৎ পেতেই থাকে। একটু গন্ধ বা সন্দেহ হলেই সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

গানটা যদি সুবল না গাইতো তাহলে এমন গাঢ় কুয়াশায় সুবলকে দেখাই যেত না! কাঁধের বাঁকে সামনের দিকে দু’হাঁড়ি খেজুরের মিষ্টি রস আর পেছনের দিকে দু’হাঁড়ি তাড়ি নিয়ে এমন ঘন কুয়াশার আস্তরণ সরিয়ে সরিয়ে সুবল এগিয়ে  যায়। মিষ্টি রসের দাম পাঁচটাকা গেলাস। আগে ছিল অনেক কম। কিন্তু ইদানীং অনেক গাছের মালিক আর শিউলি দিয়ে গাছ কাটিয়ে মিষ্টি রসের হাঁড়ি ঝোলাতে চায় না। এর থেকে তাড়ির চাহিদা বেশি থাকায় মালিক তাড়িতেই মজেছে। ফলে সারা রাতে সুবলের দুটো মিষ্টি রসের হাঁড়ির বেশি হয় না। কাজেই দামটাও বেড়েছে।

সুবল এবার একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে বেবাক রাস্তাটাই যেন হারিয়ে গেছে ঘন কুয়াশায়! তাই রাস্তার হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ফেলে আসা রাস্তাটা যেন নদী হয়ে গেছে। অজানা লোক ভয়ে হাঁটতে পারবে না। সুবল মনে মনে হেসে অন্য রাস্তা ধরে। ও আশেপাশের দু’দশ গ্রামের রাস্তা নিজের হাতের তালুর মতোই চেনে। তাই রক্ষা।

পারদেওয়ানপুরের কাছেই গঙ্গাটা অদ্ভুতভাবে বেঁকে গিয়ে সোজা বাংলাদেশে পদ্মায় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই পথটা বা ঘাটটিকে গ্রামের লোকেরা পারলালপুরের ঘাট বলে জানে। এটাই ছিল অবলাদের সন্তরণের পথ। আজ আর সেই পথটা অতটা খোলামেলা নেই। এর অনতিদূরেই রয়েছে বহু পুরনো একটি রাধামাধবের মন্দির। আর সেই মন্দির সংলগ্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে বি এস এফের ক্যাম্প। আর ওদের চোখ রয়েছে পারলালপুরের ঘাটের দিকে। সুবল ধীরে ধীরে সেই পথ বেয়ে এগিয়ে যায়।

হাতঘড়ি বা মোবাইলের ঘড়ি ছাড়া এখনও বেলার আন্দাজ করা মুশকিল। ক্যাম্পের সামনের খোলা চত্বরে এখনও ঘন কুয়াশা। সুবল এগিয়ে গিয়ে একটা হাঁক দেয়, খেজুরের রস আইনেছি, লিবেন নাকি কর্তারা? শরীল মন শীতল কইরে লিন কর্তারা।

সুবলের অমন হাঁকটা যে একেবারে কেউ শোনেনি, তা নয়। একে একে তারাই ক্যাম্পের সামনের চত্বরে এসে হাজির হয়। চার চারটে হাঁড়ি দেখে একজন সেপাই বলে, এক গেলাস কিতনে করকে?

-দাম ফের বাড়লো কুনঠে। ঐ একই দাম চইলছে। সুবল পারলে সব দাঁত বের করে হাসে।

-মাল উস দিনকা মাফিক হোগা না? অন্য একটি সেপাই জানতে চায়।

-হাঁ কত্তা, এক্কেবারে কড়া মাল আছে। এ তল্লাটে সুবলের মালের নাম আছে। সেদিনকার মাল কি ভালো ছিল না? মুখ ফুটে কহেন একবার। আমি বেশি লাভের জন্য মালে জল মিশাই না। সুবল এবার ওর হাঁড়ির কাছে উটকো হয়ে বসে।

ওরা সুবলের কথার উত্তর না দিয়ে প্রায় সব জোয়ানই নিজের নিজের বাটি ও গেলাস নিয়ে আসে। সুবল বুঝতে পারে আজ ওর তাড়ির হাঁড়িতে এক ফোঁটাও তাড়ি থাকবে না। এই ঘন কুয়াশায় সেপাইরা সবাই শরীর গরম করে নিয়ে ডিউটিতে যেতে চাইছে। আর সেও চাইছে ওরা যেন একটু দেরি করেই কাজে যায়। একে কুয়াশার ঘন আস্তরণ, তারপর আবার ঢুলু ঢুলু চোখে বেশিদূর নজর যাবে না। এর মধ্যে যা হবার তা হয়ে যাবে। আর আমেনুলের গদি থেকে সুবলও ওর প্রাপ্যটা পকেটে পুরে নেবে।

-এক গিলাস করে মিঠা রস খাবেন না কত্তা? সুবল তাড়ি দেওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করে নেয়।

-তাড়ি খানেকা বাদ খায়েগা। তব না আচ্ছা লাগেগা! একজন জোয়ান হাসতে হাসতে বলে।

ওদের চাহিদা মতোই সুবল তাড়ির হাঁড়ি থেকে ঢালতে থাকে। আর সাত সকালে শুধু শরীরটাকে গরম করার জন্য জোয়ানরা ঢক ঢক করে খেতে থাকে। পয়সা বুঝে নিয়ে সুবল যখন ওর বাঁক কাঁধে নিয়ে হাঁটা দেয় তখন কুয়াশার আস্তরণ একটু হাল্কা হয়েছে। সুবল জানে যতক্ষণ না চড়া রোদ উঠছে ততক্ষণ পর্যন্ত গঙ্গার বুক থেকে কুয়াশা সরবে না। কখনও বেলা বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশা হাল্কা হয়ে যায়। আবার কখনও সারাটা দিনই এমন ভাবেই কেটে যায়। আর এর মধ্যেই চলে হাত সাফাইয়ের ব্যবসা।

সুবলের মূল ব্যবসাই হল শিউলির কাজ। খেজুর গাছ কাটা এর হাঁড়ি ঝোলান। এটা অনেকদিনের ব্যবসা। তবে যখন শিউলির কাজ থাকে না তখন অন্যের জমিতে সে পাইট খাটে। আর এমন রসের ঋতুতেই ওর পকেটের ভার বেশ বেড়ে যায়। এটাও এক ধরনের আদান-প্রদানের কাজ। অন্যের মনের কথা জেনে নিয়ে তা যথাস্থানে ঢেলে দেওয়া আর কী! এতে বাড়তি কোন পরিশ্রম নেই। আজ তা নিজের দৈনন্দিন কাজেরই অঙ্গ হয়ে গেছে। কোন আলাদা ঝুক্কি নেই। শুধু কিছুটা সময় আটকে রাখা আর ওদের পা টলমল করে দেওয়া। এ আর এমন কি কঠিন কাজ! আমেনুলের গদিতে টাকা নিতে গেলে ওরা হাসতে হাসতে বলে, ‘ঐ যে রুটম্যান চলে এসেছে’। অবশ্য এর যে মানে কী, তা সুবল জানে না বা কোনদিন জানার চেষ্টাও করেনি। ও ভেবে নেয় এটা হয়তো কোন মজার শব্দ হতে পারে। ওরা তাকে সেই নামে ডেকে হয়তো মজা পায়। তা পায় পাক গে। ওর এখন বাড়তি রোজগারের সময়। তবে সারা বছর যদি এভাবেই আমদানি হত তাহলে এতদিনে সুবল বেশ কয়েক বিঘা জমির মালিক হয়ে যেত। এক সময় সুবল ক্যাম্পের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গ্রামের রাস্তা ধরে। আর কুয়াশা তখন ওকেও গ্রাস করে নেয়।

সবাই বলে আমেনুলের গদি। আর সুবলও তাই জানে। ওখানে টাকা নিতে গেলে যে ক’জন বসে থাকে তাদের সবার নাম জানলেও সে আমেনুল বলে কাউকে কোনদিন দেখেনি। অথবা কেউ কাউকে আমেনুল বলে কখনও ডাকেনি। অথচ ঐ গদিটা বা ব্যবসাটা আমেনুলের নামেই চলে। আর সে যে কোন গ্রামের বা তার বাড়ি কোথায় তা জানতে চাইলে সবাই তাদের ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ে! তাহলে কি ওর মতো বাকিরাও সঠিক ভাবে জানে না! গ্রামের দোরে দোরে এক চক্কর দিতেই সুবলের মিষ্টি রস প্রায় শেষ হয়ে যায়। ও হাঁটা দেয় গদির উদ্দেশে।

কালিয়াচকের তিন নম্বর ব্লকের অধীনে এই পারদেওনাপুরের পারলালপুরের ঘাট হল গঙ্গাঘাট। এই ব্লকে আর একটা ব্যবসাও বেশ দীর্ঘদিনের। আর তা হল ছানার ব্যবসা। গ্রামে গ্রামে গোয়ালা। আর ঘরে ঘরে গরু-মহিষ। কাজেই ছানা তৈরি এদের কুটির শিল্পের মধ্যেই পড়ে। দুপুর থেকেই সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে গোয়ালারা শহরের উদ্দেশে চলে তাদের ছানা নিয়ে। অনেকেরই মিষ্টির দোকানদাররাই হচ্ছে বাঁধা খদ্দের। সেখানে চাহিদা মতো ছানা নামিয়ে বাকিটা চলে যায় অতুল মার্কেটের ছানাবাজারে। যাদের বাঁধা ধরা খদ্দের নেই তারা সরাসরি ছানাবাজারেই যায়। বহু আগে এরা দিব্বি অনেকটা পথ দল বেঁধে হেঁটেই আসত। এখন ঘরে ঘরে সাইকেল থাকায় বাড়ি থেকে একটু পরে বের হলেও অসুবিধা নেই। কারণ ইংরেজ বাজার টাউনের অতুল মার্কেটে অবস্থিত এই ছানা বাজারটি সন্ধ্যা পেরিয়েও বেশ কিছুটা সময় থাকে। আর তখন একটু  কমের আশায় টাউনের বাবুরা গুটি গুটি পায়ে ছানাবাজারে এসে হাজির হয়। আর এই গোয়ালাদের সাথে কেউ উলটো পালটা কথা বলার সাহস পায় না। কোন মস্তানও চট করে এদের ঘাঁটায় না। এরা এমনিতেই বেশ সরল মানুষ কিন্তু রেগে গেলে এরা এতটাই হিংস্র হয়ে যায় যে তখন এদের সবার সাথে আনা একটি করে পাকা বাঁশের লাঠিই রীতিমত কথা বলে। আর তাই ডাকাতেরাও ওদের লাঠিকে সমঝে চলে।

যারা পারলালপুরের মতো সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে থাকে তারা খেত-খামারের কাজ ছাড়াও আরো একটি কাজে ব্যস্ত থাকে। আর তা হল কাঁচা টাকার পেছনে ছোটা। সবাই যে এভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটে এমনটা নয়। যারা প্রাণকে বাজি রেখে ছোটে তারা ছোটে। অনেক নারী বিধবা হয়! অনেক বাবা-মা তাদের সন্তান হারায়! তবু তারা ছোটে। এ ছোটার কোন বিরাম নেই! নগদ টাকা যেমন মানুষকে সাময়িক উষ্ণতা দেয়, তেমনি মানুষকে মোহতিমিরের দিকে ক্রমশই আকর্ষণ করে। এভাবেই কেউ কেউ তলিয়ে যায়। অবশ্য সুবলের তেমন কোন ভয় নেই। সে কোনদিনই বড় মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়নি। সে অল্পেই সন্তুষ্ট।

আমেনুল নামটাই যথেষ্ট। মালদা-মুর্শিদাবাদ জুড়েই তার সাম্রাজ্য। সে জানে ভাত ছড়ালে কাকের যেমন অভাব হয় না, তেমনি চাঁদির কাছে বহু মানুষের মাথা ক্রমশই কুকুরের ল্যাজের মতো নুইয়ে পড়ে। আর কোন দেবতা কোন ফুলে সন্তুষ্ট তা আমেনুলের জানা। তাকে সরাসরি অনেকেই না চিনলেও সে অনেককেই চেনে। নামেও চেনে আবার মুখাবয়বেও চেনে। আর এই চেনাটাই এসব ব্যবসায় ভীষণ জরুরি। কারণ উভয়েই একে অপরের পরিপুরক। যেমন সীমান্ত রক্ষীদের চাল-চলনের খবরাখবর বাতাস বয়ে এনে দেয়। আবার ওর নির্দেশেই ঠিক হয় কোন সীমান্তে কতক্ষণ ফাঁকা রাখতে হবে। আর সেই স্বল্প সময়েই ভেসে যাবে শত শত মান্দাস। সে দৃশ্য দেখার মতো। শুধু মান্দাসগুলোয় একটা করে পিদীম থাকলে মনে হত এ যেন হরিদ্বারের হরকেপিয়ারী ঘাটে শত শত প্রদীপের ভেসে যাওয়ার মনোরম দৃশ্য!

কুমার সাব সহকারী কমাডান্ট থেকে কমাডান্টের চেয়ারে বসার সাথে সাথে আমেনুলকে আর পায় কে! কাকে কখন কোথায় রাখতে হবে, কে বা কতজন অমুক সীমান্তের বাইরে এক পাও যাবে না, এসব নির্দেশের রিমোর্ট চলে এল আমেনুলের হাতে। আর অন্যদিকে কুমার সাবের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স স্বনামে-বেনামে গরম দুধের ফেনার মতো উথলে উঠতে লাগল। লে হালুয়া! একেই বলে কপাল!

কাকের মুখে খবর পেয়ে বা কাগজের খবরে হৈচৈ হলে প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে। তাই ইদানীং মাঝে মাঝেই ফোন আসে আমেনুলের কাছে। আর এটাকে কুমার সাব বলেন ‘আই ওয়াশ’। শুধু ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নেওয়া। যেমন আজ রাতে হঠাৎ আমেনুলের কাছে একটা ফোন এল। আমেনুল বলে

-হ্যালো স্যার, ইতিনে রাতমে কই খাস কাম হ্যাঁ? আমেনুল অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

-হাঁ, হ্যাঁয়। আপকা আদমিনে পাকড় গয়া। কুমার সাব বলেন।

-স্যার কৌনসি বর্ডারকা বাত কর রহে আপ? আমেনুল ওর লুঙ্গি সামলে বিছানায় উঠে বসে।

-আপকা আদমি আজ বামনগোলা থানাকা অন্দর আদাডাঙা, খুটাদহ বর্ডার সে লগভগ ঢাইশো বয়েল লেকে যা রহে থে। অব তো নদীমে পানি নহি হ্যাঁয়। লেকিন আপকা আদমিনে দেখা নহি উধার নদীকা বিচ হামারা জওয়ানভি ডিউটিমে থে। ব্যস! পাকড় গয়ে। কুমার সাব বলেন।

-বাতাইয়ে কুমার সাব, অব কেয়া কিয়া যায়। মেরা বহত লোকসান হো যায়েগা। আমেনুল বলে ।

-ইয়ে আপকা গলতি হ্যাঁয়। ম্যায়নে আপকো বোলা না যব যব মাল ভেজেগা উসকে পহলে মুঝে এয়লান কর দেনা চাহিয়ে। ম্যায় উধার সে জওয়ানকো হটা লেঙ্গে। লেকিন ইয়ে বাত আপনে সমঝে নহি।

-অব ম্যায় সমঝ গিয়া, ইয়ে মেরিহি গলতি হ্যাঁয় স্যার। দোবারা এইসা গলতি নহি হোগা। ইস বার কুছ তো কিজিয়ে। মেরা বহতসা লোকসান হো যায়েগা। ব্যবসা চৌপাট হো যায়েগা সাব। আমেনুলের গলায় একরাশ আকুতি ঝরে পড়ে।

-আপ কান খোলকর শুনিয়ে, ডে আফটার টুমরো হামারা অফিসকা সামনে পাকড় গয়া আপকো ঢাইশো বয়েলকা নিলাম হোগা। আপকা চার-পাঁচ আদমি ভেজ দেনা চাহিয়ে নিলাম মে হিস্যা লেনেকে লিয়ে।

-লেকিন কুমার সাব, ইতনে মালকা দাম তো এক ক্রোড় পড় যায়েগা না? ম্যায় তো মর যাউঙ্গা। আমেলুনের গলায় কান্না জড়িয়ে আসে।

-উ মেরা উপর ছোড় দিজিয়ে। ম্যায় দেখ লুঙ্গা। লেকিন মেরে বারে মে আপকো ভি সোচনে পরেগা। কুমার সাব এবার ফিক ফিক করে হাসেন।

-আরে সাব, উসকা বারে মে ফিকর মত কিজিয়ে। ম্যায় হুঁ না! এবার আমেনুলের গলায় হাসির ঝলক শোনা যায়। সে একটা দামি সিগারেট ধরিয়ে নিশ্চিন্তে সুখটান দিতে থাকে।

 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন