কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

সমীর দে রায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


বানভাসি

ঈশ্বর মাইতি একটু উঁচুতে থাকেন। সেখানে বিরাট উনুনে ক’দিন খিচুড়িভোগ রান্না হচ্ছে। তার ঠিক গজ দুই নীচে কাঠা দশেকের একটা চর শুধু আজ জেগে আছে। কয়েকটা জারুল, মহানিম, মেহগিনি, দেবদারু, বাবলা, পিটুলি আর গরাণ গর্জন দিয়ে ঘেরা। ভাঙা পাওয়ার-টিলার, দুটো ডিঙি-পানসি, একগাদা নাইলন জাল। এর চারদিকে সুবিশাল জলরাশি—স্রোতস্বিনী, শব্দময়, মহাসমতল। কোন তটরেখা নেই, শ্মশান ও প্রসূতিগৃহ একাকার ডুবে আছে। দূরে ও অদূরে কিছু বৃক্ষচিহ্ন, আধজাগা টালিচাল, ছাদ।       

এই চর আজ জেগে আছে মহাকলরবে। খান পঞ্চাশের লোক—মেয়ে-মদ্দ জোয়ান বুড়োবাচ্চা পোয়াতি কিশোরী, খানছয়েক গাইগরু, ডজন-খানেক ছাগল হাঁস মুরগী পায়ে দড়ি বাঁধা, একটা কুকুর।

বিষ্টুপদ, টাকা শোধ পায়নি বলে কদিন আগে ভজনকে খানকির ছেলে বলে বেধড়ক প্যাঁদাচ্ছিল; তারা দুজনেই আজ পাশাপাশি বসে বিড়ি খাচ্ছে, পঞ্চানন গাল পাড়ছে ‘শালা ডিভিসির বাচ্চা’—সাথে দুটো নোংরা কথা, তিনটে লাংটো বাচ্চা হিসি দিয়ে কাটাকুটি খেলছে, বিশু বলছিল একশ দিনের কাজে পঞ্চায়েত তার নাম নিয়ে গেছে, তিলক-কাটা বুড়ো বোষ্টম বিড়বিড় করছিল—নিজের হরিনামটা বোধহয় নিজেকেই গাইতে হবে, ভাঙা পাওয়ার-টিলারের খোঁচায় ভোটোর প্যান্টুলের পোঁদ ছিঁড়ে গেছে,  কচি তার মায়ের পিঠ চুলকে দিচ্ছে, পেটে বড় টান—পোয়াতির দিদি তাকে বাতাস করছে। এখন বৃষ্টি নেই, জলও কমছে না।

বেলা একটু গড়িয়ে এসেছে, এমন সময় হঠাৎ একটা চপার; পূব আকাশ থেকে হাওয়া কেটে ছুটে আসতে দেখা গেল বিকট আওয়াজে। ‘আসছে, আসছে’ বলে হইহই, আত্মহারা, চেঁচিয়ে উঠল সবাই। গরু-ছাগলগুলো ভয়ে ছটফট করছিল, কুকুরটা বেদম চেঁচাচ্ছে, হাঁস-মুরগীগুলো ঠিক বুঝতে পারছে না কি হতে চলেছে। মেয়েমানুষেরা আঁচল মেলে ধরছে আর মদ্দরা গামছা, চক্কর কেটে চপারটা টপাটপ ফেলতে লাগল, চিঁড়ে, জলের পাউচ, বাতাসা, বিস্কুট। আর দুটো তেরপল, একটা পড়ল জারুল গাছের ডালে, আর একটা ভাসতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে জলের স্রোতে। মিত্যুন একটা বিস্কুট পেয়েছে, জলের ধারেই সে দাঁড়িয়ে তেরপলের ভেসে আসা দেখছিল। আকাশের দিকে তাক করে দৌড়তে দৌড়তে তেরপলের সাথে পড়ল জলে, চকিতে তলিয়ে গেল স্রোতের গভীরে।  ‘মিত্যুন, মিত্যুন’—সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই।  সলিলা নির্বিকার, স্রোতোস্বিনী, শব্দময়।  অপরাহ্ন আলোয় অস্তরাগ ফুটে উঠছে দিগন্তরেখায়। 

ঠিক সাড়ে চারটেয়, ওপর থেকে ঈশ্বরের বড় বেটা ভগীরথ, যেন শিঙা ফুঁকছে, ‘লাইন, লাইন’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। খান পঞ্চাশের লোক — মেয়ে-মরদ-বুড়ো-বাচ্চা হুড়োহুড়ি, লুটোপুটি--থালা, বাটি, গামলা, কাঁসি নিয়ে দুদ্দাড়ে ছুটে এসে লাইন লাগালো সিঁড়ির কাছটায়। লব দুলে, জোয়ান গাঁট্টাগোঁট্টা লাইনের সামনের দিকেই ছিল। ঈশ্বরের চোখ এড়ায়নি, উঁচু দাওয়া থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘এই যে, লবাবপুত্তুর লবা, বেইমানের বাচ্চা-- দুলেপাড়ার আঠাশটা ভোট, একটাও আমার পাতে পড়েনি, তাও খেতে দিচ্ছি, ব্যাপারটা মাথায় রাখিস।’  নেতাই দুলে একটু দূরে বসে ছিল। গরাস যেন আর মুখে উঠছে না, পশ্চিমে তাকালো—শেষ সূর্য রক্তের ফিনকি ছড়িয়ে খসে পড়ছে দিগন্তের জলে।   

গাছগাছালির চরে অন্ধকার নামে তাড়াতাড়ি। ঝিঁঝিঁগান—পড়ন্ত আলো-আঁধারিতে ঠাহর হয় না কোনকিছু।  শুনশান গরাণের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ একটা আলোর রেখা—চিকচিক করে উঠে আঁধারে সরে সরে আসছে। কী ওটা ? একঝাঁক সাঁঝপাখি শব্দ করে উড়ে গেল। ভয় আর আশ্বর্য্ মেশা গুঞ্জন আর তার প্রতিধ্বনি—কী ওটা ? কেউ একজন ? কেউ।  বিধ্বস্ত, অবসন্ন এক ছায়ামূর্তি, হেঁটে আসছে ধীরে ধীরে। আদুল গায়ে জল ঝরছে, পিঠে রাখা পলিথিনের তেরপল ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল সে। ‘মিত্যুন, মিত্যুন’—সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই। মিত্যুন—বাগদি পাড়ার মৃত্যুঞ্জয়।  

আবার ভগীরথ চেঁচাচ্ছে। ‘শোনো, শোনো সবাই। লাইফ-বোট আসার কথা ছেলো। বোধহয়, আমাদের চর ঠাহর করতে পারেনি, ফিরে গেছে। কাল দ্যাখো কি হয়। প্রধানের মোবাইলে চাজ নেই। তাই কাউকে আর ধরা যাচ্ছে না। জল বাড়ছে। একটু সাবধান সজাগ থেকো গো সবাই।’

রাত বাড়ছে। অস্ফুট কান্নার শব্দ ভেসে আসছে বিষণ্ন গানের মত। উঠোনে ছিন্নমায়া পুঁইমাচা, বেগুন গাছ, তাকে তুলে রাখা অহংকার গঙ্গাজলঘটি, হেগো-কাপড়ের খুঁটে বাঁধা দশটাকা—হারানোর কিছু বাকি পড়ে নেই আর। ঈর্ষা, অধিকারবোধ, খুনসুটি, সব একাকার, জলের গভীরে নতজানু হয়ে আছে। অনন্ত আকাশ আধখানা চাঁদ আর একরাশ তারা নিয়ে ঝুলে আছে মাথার ওপর—মায়াব্রহ্ম অসীম, অপার।

জল বাড়ছে—জলধ্বনিও। এই চরে কাল ভোরে সূর্য উঠবে কিনা কেউ তা জানে না।


8 কমেন্টস্:

  1. লেখা প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. মানুষ আর প্রকৃতি এ-ওর গায়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে-যাওয়া এক তেলরঙে-আঁকা ছবি। চমৎকার লাগল!

    উত্তরমুছুন
  3. অত্যন্ত সুন্দর লেখনী।

    উত্তরমুছুন
  4. বেশশ ভাল লাগল ।।।।।।।।।।।।।।।।।

    উত্তরমুছুন
  5. তীর্থঙ্কর নন্দী বেশশশ লাগল গল্পটি।।।।।।।।।।।।।।।।।।।

    উত্তরমুছুন
  6. চমৎকার লাগল। আপনার গদ্য আরও ধারাবাহিকভাবে পড়া দরকার আমার। শ্রদ্ধা জানবেন।

    উত্তরমুছুন