কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ৮




অচেনা জায়গায় ঘুম ভাঙলে প্রথমে ঠিক ঠাহর হয় না যে কোথায় আছি। ভোরবেলা  চোখ খুলে মাথার ওপরে অচেনা সিলিং, ঘরের অচেনা আসবাব দেখে একটু ভেবলে মতো গেলেও টেবিলের ওপরে আমার লাল ব্যাকপ্যাক দেখে সব মনে পড়ে গেল। এই তো সেই মানকাটো, যে শহরে কেউ বড় একটা আসে না, যে শহরের নাম কেউ বড় একটা শোনেনি, যে শহরে তেমন দেখবার মত  কিছুই নেই...

গত রাতেই চায়ের সরঞ্জাম ব্যাকপ্যাক থেকে বার করে গুছিয়ে রেখেছিলাম। ছোট একটা ইলেক্ট্রিক কেটলি, দার্জিলিং চায়ের নিজের তৈরী টি ব্যাগ, থিন অ্যারারুট বিস্কুট যা  চায়ে ডুবিয়ে, এক্কেবারে মাহেন্দ্রক্ষণে তুলে নিয়ে মুখে ফেলতে হয়... ইত্যাদি। এই ঘরে একটা বেশ বড় জানালা রয়েছে যা দিয়ে বাইরের সেই ঘাসজমি দেখা যায়। জানালার কানাচে একটা বসবার মত পরিসর। আমি চোখ মুখ ধুয়ে, ফাটাফাটি এককাপ চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে সেখানে বসে বসে একটা নতুন দিনের উদ্ভাস দেখলাম। চুপ করে বসে ভাবছিলাম... এই যে এতটা পথ আমি কেন এলাম?... সামনের অতখানি রাস্তা আমি কেন যাবো? এক মহাসমুদ্র থেকে আর এক মহাসমুদ্র কেন ছুঁয়ে ফেলতে চাইছি?... এ কিসের টান?...

'শিশিরভেজা শুকনো খর শিকড়বাকড় টানছে

মিছুবাড়ির জানলা দোর ভিতের দিকে টানছে

প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে

ভাল ছিলুম জীর্ণ দিন আলোর ছিল তৃষ্ণা

শ্বেতবিধুর পাথর কুঁদে গড়েছিলুম কৃষ্ণা

নিরবয়ব মূর্তি তার, নদীর কোলে জলাপাহার…

বনতলের মাটির ঘরে জাতক ধান ভানছে

শুভশাঁখের আওয়াজ মেলে জাতক ধান ভানছে

করুণাময় ঊষার কোলে জাতক ধান ভানছে

অপরিসীম দুঃখসুখ ফিরিয়েছিলো তার মুখ

প্রসারণের উদাসীনতা কোথাও ব’সে কাঁদছে

প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে'


এই আসমুদ্র  পথে পড়বে সবুজ বনাঞ্চল, উদ্ধত পর্বতমালা, দীর্ঘতম নদী, বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত, অনুর্বর রুক্ষ প্রান্তর। আমি আমার পথে কেবল এই সবই দেখতে চেয়েছিলাম। প্রশাখাছাড় হৃদয় আজ মূলের দিকে টানছে।... বড় বড় শহর, চকচকে শপিংমল, নামজাদা সংগ্রহালয় এইসব এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তাই বাজ বাহাদুর আমাকে এই সব ছোট ছোট শহর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমার কাঙ্ক্ষিত গমনে।

মনে মনে দিনের প্ল্যানটা একবার ঝালিয়ে নিলাম। আজকে যাবো সাউথ ডাকোটার ওয়াল (Wall)  শহরে।  মানকাটো থেকে ৪৪০ মাইল দূরে এই শহরের গায়েই রয়েছে ব্যাডলান্ডস ন্যাশনাল পার্ক। সাউথ ডাকোটার এই ওয়াল শহরকে এক সময় বলা হতো 'Geographical center of nowhere.' এমন শহর যে আমার যাত্রাপথে জায়গা পাবে তা বলাই বাহুল্য! ১৯৩০ সালে এখানে ৩০০ জন মানুষ বসবাস করতো। ২০১১তে পৌঁছে  সেটি বেড়ে হয়েছে ৮৭৬। এইখান দিয়ে ব্ল্যাক হিল পর্বতমালা চলে গেছে ওয়াওমিং অভিমুখে। আক্ষরিক অর্থে কালাপাহাড়! কালো গ্রানাইট পাথরের কৃষ্ণরূপ এই পর্বতমালায়। ১৭৭৬ সনে এই এলাকা ছিল লাকোটা উপজাতির নেটিভ আমেরিকানদের কব্জায়। এই কালো পাহাড় ছিল তাদের Axis mundi... তাদের cosmic axis...  sacred center of the world. বিস্তীর্ণ  ব্যাডলান্ডস অঞ্চল ছিল তাদের বধ্যভূমি। এইখানে তারা বাইসন, এল্ক, হরিণ শিকার করে জীবনধারণ করত। এইখানে, প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হতো তাদের ঘোস্টডান্স... মৃত পূর্বজ এবং বাইসনের আত্মাকে পুনর্জীবিত করার অভিষেক। কিন্তু ১৮৭৪-এ এই এলাকায় সোনার খনির সন্ধান পাওয়া যায়। ব্যাস... আর যায় কোথা! পালে পালে স্বর্ণলোভী মানুষ  সোনার খোঁজে এসে পড়ল এই কালো সোনার পাহাড়ে। শুরু হলো গোল্ডরাশ। লাকোটা নেটিভ আমেরিকানদের সরিয়ে দেওয়া হলো আরও পশ্চিমে। তাদের সমস্ত জমি জবরদস্তি করে বিক্রি করে দেওয়া হলো। রক্তগঙ্গা বইল এই পাহাড়ের কালো পাথরে। ওয়াইট নদীর (White  রিভার) ধূসর সাদা জলে ভাসল রক্তাক্ত মৃতদেহ। প্রকৃতিকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা ঘোড়সওয়ার মানুষগুলি মুছে যেতে লাগলো... নিভে যেতে লাগলো।

'তীরে কি প্রচন্ড কলরব

‘জলে ভেসে যায় কার শব

কোথা ছিল বাড়ি?’

রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় —‘আমি স্বেচ্ছাচারী’।

সমুদ্র কি জীবিত ও মৃতে

এভাবে সম্পূর্ণ অকর্কিতে

সমাদরণীয়?

কে জানে গরল কিনা প্রকৃত পানীয়

অমৃতেই বিষ!

মেধার ভিতর শ্রান্তি বাড়ে অহর্নিশ

তীরে কি প্রচন্ড কলবর

‘জলে ভেসে যায় কার শব

কোথা ছিলো বাড়ি?’

রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় — ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’।


নাহ এবার উঠতে হবে। জানালার কাণায় বসে বসে ভাবলে তো আর ব্যাডলান্ডস পৌঁছনো যাবে না! ঘড়িতে ৭টা বাজতে চলল। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে, স্নান সেরে সারাদিনের মতো তৈরী হয়ে নিলাম। আজ ৬ জুলাই, মঙ্গলবার। মা বলতো মঙ্গলবারে ওয়ার্ম কালার্স পরতে। আমি একেবারে একটা বাইসন চমকানো লাল কুর্তা আর কালো জিন্স পরে লটবহর সমেত একতলায়  নামলাম। ব্রেকফাস্ট কাউন্টারে কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট সাজানো। কেউ কোত্থাও নেই। টোস্ট, মাফিন, কর্নফ্লেক্স, আপেল, কলা, দুধ , দই, চা কফি এইসব। আমি তো ঘরেই দার্জিলিং চা বানিয়ে মগ ফ্লাস্কে ঢেলে নিয়েছি। সেটিই গরম গরম পথে খাওয়া যাবে। ব্রেকফাস্ট কাউন্টারে একটা কলা খেলাম। দু বোতল জল, একটা আপেল, একটা ব্লুবেরি মাফিন আর একটা দই সঙ্গে নিয়ে কাউন্টারে বেল বাজালাম। রাতের ডিউটিতে ছিল এক হাসিমুখ তরুণ। তাকে চাবি ফেরত দিয়ে বাইরে এসে দেখি সকালের আলোয় ঝকঝক করছে বাজ বাহাদুর। গায়ে রাতের শিশির পড়েছে। কে বলবে গতকাল এতটা পথ এসেছে সে। জিনিসপত্র তুলে দিয়ে পাশের সীটে  খাবার দাবার রেখে, চায়ের মগ আর এক বোতল জল কাপ হোল্ডারে রেখে... দুগ্গা দুগ্গা। এবারে যেতে হবে ঘোড়সওয়ার মানুষগুলির দেশে… কালো গ্রানাইট পাথরের কৃষ্ণরূপ  পর্বতমালায়।

'এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।

সেই পাহাড়ের পায়ের

কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ

কঠিন পাহাড়।

একেবারে চূড়ায়, মাথার

খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,

চরাচরে তীব্র নির্জনতা।

আমার কন্ঠস্বর সেখানে কেউ

শুনতে পাবে না।

আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো,

প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা-

এখানে আমার কোন অহঙ্কার নেই।

এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।

হে দশ দিক, আমি কোন দোষ করিনি।

আমাকে ক্ষমা করো'।




(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন