কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৩

কালিমাটি অনলাইন / ০৮



সম্পাদকীয়


এখন শরৎকাল। উৎসবেরও কাল। মূলত বাঙালি জনসাধারণের কাছে শারদোৎসব নামে যা পরিচিত। অন্যদের কাছে নয়ই বা কেন! শুনেছি, ভরা বর্ষার পর যখন প্রকৃতি স্বচ্ছ ও সুন্দর হয়ে উঠতো, আকাশের নীল ও গাছের সবুজ এক অসামান্য ভালোবাসার রঙ ছড়িয়ে দিত চতুর্দিকে, তখন বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্য ও দেশের রাজা-মহারাজারা বেরিয়ে পড়তেন শিকারে এবং যুদ্ধে। অরণ্যে নিছকই খেলার আনন্দে পশুবধ এবং নিজ নিজ রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর অভিপ্রায়ে মানুষবধ ছিল তাঁদের উৎসবের মূল ‘অ্যাজেন্ডা’। তা রাজা-মহারাজাদের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা! কিন্তু সাধারণ প্রজাদের অর্থাৎ পাতি জনসাধারণের কাছে শরৎকাল বয়ে নিয়ে আসত অন্য এক আনন্দ ও উৎসবের চেহারা। বয়ে নিয়ে আসতো নতুন ফসলের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। আর এই স্বপ্ন ও সম্ভাবনাই সম্ভবত সাধারণ মানুষকে অনুপ্রেরিত করেছিল প্রকৃতি আরাধনায়; পরবর্তীকালে প্রকারান্তরে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে যা রূপান্তরিত হয় দেবী আরাধনায়। সে যাইহোক, উৎসবের অনুষঙ্গে সেই সময় যেমন ছিল শস্য-ফসলের প্রচুর সম্ভাবনা ও সম্ভার; ইদানীংকালেও তেমনি আরও অনেক সম্ভারের পাশাপাশি বাঙালি জনসাধারণের কাছে উপস্থিত হয় বাংলা সাহিত্য-ফসলের বিপুল সম্ভার। এবং বলা বাহুল্য, উৎসবমুখর শরৎকালের সৌজন্যে বাংলাসাহিত্য এভাবেও সমৃদ্ধ হয়ে আসছে দীর্ঘদিন। আমাদের ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের অষ্টম সংখ্যাও প্রকাশিত হলো এই আনন্দমুখর উৎসবের আবহাওয়ায়। আমরাও এই শারদ উৎসবের শরিক। আমাদের আন্তরিক শারদ প্রীতি, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ভালো থাকার শুভেচ্ছা জানাই আপনাদের সবাইকে।

প্রসঙ্গত দু’একটি বিষয়ে যৎসামান্য আলোচনা করা যেতে পারে এখানে। কবিতা, দীর্ঘ কবিতা, ঝুরোগল্প, অণুরঙ্গ বিভাগগুলির পাশাপাশি একটি উল্লেখযোগ্য বিভাগ ‘কালিমাটির কথনবিশ্ব’। আমাদের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে বিনম্র নিবেদন, আপনারা এই বিভাগটিকে আরও সমৃদ্ধ ক’রে তুলতে পারেন আপনাদের নিজেদের জীবনের ও মনের বিভিন্ন ভাবনা-চিন্তা, অনভূতি, অভিজ্ঞতা, বোধ এবং কোনো বিষয় ও বস্তুভিত্তিক প্রসঙ্গকে কলমবন্দী ক’রে। বৈচিত্র্যে ও বহু রৈখিকতায় তাকে লিপিবদ্ধ ক’রে। আমরা আপনাদের কাছে এই ব্যাপারে সক্রিয় সহযোগিতা আশা করছি। এবং একইসঙ্গে সহযোগিতা আশা করছি ‘ছবিঘর’ বিভাগের জন্যও। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, যে ছবিগুলি এই বিভাগে প্রকাশ করা হয়, সেই ছবিগুলির মধ্যে থাকে কোনো কবিতা বা গল্প, অথবা আরও স্পষ্ট ক’রে বলা যেতে পারে, কোনো কবিতা বা গল্পের উপাদান। এই ভাবনা মনে রেখে আপনারা ছবি পাঠান ‘ছবিঘর’-এর জন্য। এছাড়া কবিতা, দীর্ঘ কবিতা, ঝুরোগল্প এবং ‘অণুরঙ্গ’ বিভাগের জন্য ছোট নাটক পাঠানোর জন্যও অনুরোধ জানাই। সেইসঙ্গে একটি ছোট্ট নিবেদন, অনুগ্রহ ক’রে আপনারা যে কোনো লেখা পাঠাবেন বাংলা ‘অভ্র’ ফন্টের ‘বৃন্দা’তে কম্পোজ ক’রে। অন্য কোনো বাংলা ফন্টে কম্পোজ ক’রে পাঠালে আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হব।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :


kalimationline100@gmail.com / kajalsen1952@gmail.com

প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :

0657-2757506 / 09835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002,
Jharkhand, India.

<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


০১ অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

‘খড়ের প্রতিমা পূজিস রে তোরা...’
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী



সাধারণভাবে বাঙালি হিন্দুসমাজে বাৎসরিক দুর্গোৎসবকে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ বলেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে, আর এই আগমনীর সুরই যে তার প্রাণের তন্ত্রীকে বারেবারে নাড়া দিয়ে যায়, এ নিয়ে বোধ হয় বিশেষ তর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু সেইসঙ্গে এই প্রশ্নটিও ভেবে দেখা যায় যে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাঙালির প্রাণবীণায় সবসময় কি আনন্দের সুরই বেজেছে? কখনও কি প্রতিবাদী সুরও শোনা যায়নি? আনন্দের গানের সঙ্গে কখনও কি বেজে ওঠেনি বেসুর তান?

এদেশে ব্রিটিশ শাসনের পত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় ইংরেজ রাজপুরুষদের অনুগ্রহ লাভের তাগিদে এক শ্রেণীর উঠতি ও বনেদি বিত্তবানেরা নিজেদের বাড়িতে দুর্গোৎসবের আয়োজন ক’রে সেই উপলক্ষে খানাপিনা, নাচগান ও লাগাম-ছাড়া হৈ-হুল্লোড়ের একটা পরম্পরা তৈরি করে। আবার শিক্ষিত বাঙালি মানসে এই অবাঞ্ছিত পরম্পরার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী সুরও জেগে উঠতে থাকে। এই দুর্গোৎসবকে উপলক্ষ করে আড়ম্বরের আতিশয্য, অপচয় ও সাধারণ মানুষের প্রতি অবহেলা ইত্যাদির বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, কবি ও সাংবাদিকদের ধিক্কার ধ্বনিত হতে দেখা যায়। তারপর ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিবাদী সুরে যুক্ত হয় নতুন কিছু বিষয়। ধর্মীয় উৎসবের নাম করে ইংরেজদের খোশামোদ, শক্তির আরাধনা আর জাতীয় জীবনে দুর্বলতা ও ক্লৈব্যের সহাবস্থান এবং তথাকথিত আনন্দ-উৎসবের মধ্যে অর্থনৈতিক দুরবস্থার তিক্ত যন্ত্রণাকে বিষয়বস্তু করে রচিত হয়েছে অনেক ব্যঙ্গবাণী ও ধিক্কার-কবিতা।

আঠারো শতকের বাঙলার সবচেয়ে পরিচিত সামাজিক নকশার রচয়িতা হুতোমের লেখায় বাঙালি বাবুসমাজের দুর্গোৎসব-কেন্দ্রিক কান্ডকারখানা নিয়ে প্রচুর মোলায়েম ব্যঙ্গ ছড়িয়ে আছে। দুর্গোৎসবের মূলে রয়েছে পৌত্তলিকতা, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হুতোমের আক্ষেপ -- “কত কত কৃতবিদ্য বাঙালি সংসারের ও জগদীশ্বরের সমস্ত তত্ত্ব অবগত থেকেও হয় সমাজ, না হয় পরিবার পরিজনের অনুরোধে পুতুল পূজে আমোদ প্রকাশ করেন।” [‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’] বাবুদের দুর্গোৎসবের নানা দৃষ্টিকটু প্রথা ও কেতা এ-ভাবে তাঁর তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের লক্ষ্য হয়েছে। এই সব প্রথার কয়েকটির উল্লেখ এখানে করা যেতে পারে। বাবুর বাড়ির পূজোতে এসে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের পুরোহিতের সামনে বা কর্মকর্তা বাবুটির সামনে প্রণামীস্বরূপ টাকা দিতে হতো এবং সে-জন্য বাবুটি সামনে গোলাপপাস, আতরদান সাজিয়ে “পয়সার দোকানের পোদ্দারের মতো বসে থাকেন” এবং সে-জন্য নিমন্ত্রিতদের সেঁধুতে ভরসা হয় না, “পাছে কর্মকর্তা তেড়ে কামড়ান”। হুতোমের ভাষায় “কর্মকর্তার ব্যাভার দেখে প্রতিমে পর্যন্ত অপ্রস্তুত হন।”

হুতোমের মতো সামাজিক নকশা সেকালে শ্রী দশ অবতার, টেকচাঁদ ঠাকুর জুনিয়র প্রমুখ আরো কেউ কেউ রচনা করেছেন। শ্রী দশ অবতার রচিত ‘আসমানের নকশা’য় বাবুদের দুর্গোৎসবের বর্ণনার ছলে পূজোতে সাত্ত্বিক মিষ্টান্নের সঙ্গে নিষিদ্ধ ভক্ষ্য ইত্যাদিরও যথেচ্ছ প্রচলন, ব্রাহ্মসমাজের উৎসাহী ভক্তদেরও পৌত্তলিকতার ভন্ডামি ইত্যাদিকে আক্রমণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে-পুরোহিত বাবুর কাছ থেকে হবিষ্যের পয়সা নিয়ে ‘দিব্বি মাছ ভাত খেয়ে’ ষষ্ঠীর রাতে তন্ত্রধারককে নিয়ে বোধন করতে এলেন ও অকুতোভয়ে মৃতের তর্পণের মন্ত্র পড়ে প্রতিমার চক্ষুদান করে ফেললেন, তার সঙ্গে সঙ্গে এই নকশায় কশাঘাত করা হয়েছে শ্বেতাঙ্গ-স্তাবক হিন্দুদের আর আলোকপ্রাপ্তির দাবিদার ব্রাহ্মদেরও -- “পূজা ও বলিদানের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালিদের সভ্যতার পরিচয় হয়ে থাকে। যারা আপিসে ‘আমি হিঁদুয়ানি মানিনি’, ‘আমার কোনো প্রেজুডিস নেই’ বলে সায়েবদের সঙ্গে খানা খেয়েছেন, তাঁরা আজি কোমর বেঁধে কাদামাটি মেখে কাদামাটি করবেন। ...হায়! এ রকম লোক হতেই বাঙ্গালিদের ‘হিপোক্রিট’ নামটি সৃষ্টি হয়েছে।”

এই নকশাকারদের তুলনায় সাংবাদিকদের ভাষা ও বক্তব্য স্বভাবতই অনেক সোজাসুজি। যেমন ধরা যাক, ১৮৩৩ সালে ‘জ্ঞানান্বেষণ' পত্রিকাটি পূজা উপলক্ষে ‘স্বীয় পরিশ্রমের এবং পিতৃপিতামহাদির সঞ্চিত সম্পত্তি’ এ-দেশের লোকেরা নাচগানে ব্যয় করে বলে ক্ষুণ্ন হয়ে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, এ-সব ধর্মের অঙ্গ নয় এবং “আবশ্যক বিষয়ে শৈথিল্য করিয়া অনাবশ্যক বিষয়ে অধিক ব্যগ্র’’ দেখলে তা নিবারণের চেষ্টাই করা উচিত। ১৮৯৩ সালে বাবুদের দুর্গোৎসবের নাচগান দেখতে খৃস্টানেরা অল্প সংখ্যায় এসেছিলেন – এতে খুশি হয়ে পত্রিকাটি আশা প্রকাশ করেছিল যে, জনসধারণ এ-সব বিষয়ে একেবারে উৎসাহ পরিত্যাগ করলে ‘জ্ঞান ও সুনীতি ও অন্যান্য বিদ্যার আধিক্য’ হবে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশের ‘লোকদিগের আহ্লাদে’র প্রতিবন্ধক হতে না চেয়েও পত্রিকাটি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিল -- “পুত্তলিকাপূজাদিকে আমরা ঘৃণিত ব্যাপার কহি”।

‘সম্বাদ প্রভাকর’ পত্রিকাটি অবশ্য পৌত্তলিকতার সমালোচক নয়, বরং নব্যদের দৃষ্টিতে ভগবতীস্বরূপা দুর্গা পুতুল ছাড়া আর কিছুই নন, এখানেই তার ক্ষোভ। ১৮৫৯ সালে পূজা প্রসঙ্গে এই কাগজটির মন্তব্য -- “প্রাচীনেরা যে শারদীয়া পূজার জন্য ধূপ দীপ বাদ্যাদির উদ্যোগ করিয়া থাকেন, নব্যেরা সেই উৎসবের জন্য শেরি, সেমপিন ও বেরান্ডির আস্বাদন করিতে ব্যস্ত হয়েন।” আবার বাবুদের দুর্গাপূজায় নাচগানের ঘটা, সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে আনা, সান্ত্রী বসিয়ে ভিড় আটকানোর জন্য সাধারণ দর্শণার্থীদের বেত্রাঘাত ইত্যাদি ন্যক্কারজনক ব্যাপার সম্পর্কে ‘সমাচার দর্পন’ পত্রিকায় বিরূপ মন্তব্য দেখা যায়। বাবুদের পূজার নামে এই সব অনাচারের ছবি আছে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় -- “...এসেছিল দ্বারে পূজা দেখিবারে দেবীর বিনীত ভক্ত,/ কেন যায় ফিরে অবনত শিরে অবমানে আঁখি রক্ত?/ উৎসবশালা, জ্বলে দীপমালা, রবি চলে গেছে অস্তে--/ কুতূহলীদলে কি বিধানবলে বাধা পায় দ্বারী হস্তে ?/... না না এরা সবে ফিরিছে নীরবে দীন প্রতিবেশীবৃন্দে, --/ সাহেবসমাজ আসিবেন আজ, এরা এলে হবে নিন্দে।” [‘উন্নতিলক্ষণ’]

দুর্গাপূজায় সাত্ত্বিকতার অভাব দেখে ১৮৭৯ সালে ‘সুলভ সমাচার’ লিখেছিল -- “পালপার্বনে দেবভক্তি যত থাকুক, না থাকুক, পেটপূজাটা ষোড়শোপচারে চলে ভাল।” ‘ছুটির সুলভ’-এ ১৮৭৯ সালের এক কবিতায় দেখা যাচ্ছে, দেবী দুর্গা মর্ত্যে এসে মা মেনকার কাছে বঙ্গবাসীদের সম্পর্কে অভিযোগ জানাচ্ছেন -- “অন্ন বিনা ছন্নছাড়া হইনু গো আমি, পূজায় নাহিক ভক্তি, কেবল ভন্ডামি। / ...আমার নামেতে মদ বোতলে বোতলে / ঢালে আর খায় সবে পড়ে ধরাতলে।” [‘আগমনী’] সেকালের বিখ্যাত ব্যঙ্গ-পত্রিকা ‘বসন্তক’ দুর্গাপূজার নামে এই সাহেব-তোষামোদের উদ্দেশ্য যে সরকারি খেতাব বা উপাধি অর্জন, সে ব্যাপারে কটাক্ষ করে একটি কবিতায় এক গরিব ব্রাহ্মণের জবানিতে বলেছিল -- “উপাধিতে মান পেলে যত স্বজাতিরে। / বাঁচুক মরুক তারা, তাকাবো না ফিরে।...” [‘বসন্তকের দুর্গোৎসব’]

উনিশ-বিশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও দুর্গোৎসবের সঙ্গে মিশে যাওয়া নানা কুরীতিকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি। ‘কলকাতা কমলালয়’-প্রণেতা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গোৎসবকে ‘ঝাড় উৎসব’, ‘কবি উৎসব’, ‘বাই উৎসব’ ইত্যাদি নাম দিয়েছিলেন। রাজা কালীকান্ত ও রাজা রাধাকান্ত দেবের মতো হিন্দুদের বাহ্য ঠাঁট বজায় রাখার জন্য মদ্যপান ইত্যাদির নিন্দা করেছেন রাজনারায়ণ বসুর মতো হিন্দুরা। ‘বেঙ্গল হরকরা’ এঁদের পরামর্শ দিয়েছিল অপচয় কমানোর, আর কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন -- “রাখ মতি রাধাকান্ত, রাধাকান্ত পদে।/ দেবীপুজা করি কেন টাকা ছাড় মদে।।” সাহিত্যিক অক্ষয়চন্দ্র সরকার হুতোমের মতোই দুর্গাপূজায় পূজারী পুরোহিত, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের ভন্ডামি ও প্রবঞ্চনাকে উদ্ঘাটিত করেছেন তাঁর ‘মহাপূজা’ নামে এক রচনায়।

সেকালের সংবাদপত্রগুলো কিন্তু দুর্গোৎসবের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে প্রায়ই চরম মন্তব্য করতে দ্বিধা করেনি। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাহ্মসমাজের ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র মতে সারা বছর দেশে যত ‘দুষ্কর্ম’ হয়, দুর্গোৎসবের এই তিন দিনে তা সম্পূর্ণ হয়, যা দেখে “যথার্থ দেশহিতৈষীর মন নিরুৎসাহে পূর্ণ হয়।” নিরাকারবাদী ব্রাহ্মদের কথা ছেড়ে দিলেও অন্য পত্রপত্রিকাগুলোও কিন্তু দুর্গাপূজায় অর্থনৈতিক অপব্যয় নিয়ে কথা তুলতে ছাড়েনি। ক্যালকাটা জার্নালে ১৮২০ সালে মন্তব্য করা হয়েছিল, এই পূজাগুলির উদ্দেশ্য ভক্তি নয়, ঐশ্বর্য ও গরিমা প্রদর্শন। এর ফলে সঞ্চিত সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়ে কত পরিবার নিঃস্ব হয়েছে, তারও উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৮৩৩ সালে ‘সমাচার দর্পন’-এ গৃহস্থ লোকের দরজায় চুপিচুপি প্রতিমা ফেলে যাবার ‘কদর্য ব্যবহারে’র নিন্দা করা হয়েছিল।

বাঙালি সাহিত্যিকেরাও কিন্তু সর্বদা দুর্গোৎসবের আনন্দের সুরে তাল দেননি – প্রতিবাদী সুরও তাঁদের রচনায় ধ্বনিত হয়েছে। একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মসমাজভুক্ত বলে নয়, জনজীবনের একজন সংবেদনশীল রূপকার বলেই রবীন্দ্রনাথ “আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে”-- এটা লক্ষ্য করেও ধনীর দুর্গামন্ডপের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা কাঙালিনী মেয়েটিকে ভুলতে পারেননি। তাকে কেন্দ্র করে কবির মনে জেগে ওঠা তীব্র ও তীক্ষ্ণ প্রশ্নটি যেন আজও আমাদের বিদ্ধ করে -- “মাতৃহারা মা যদি না পায় / তবে আজ কিসের উৎসব! / দ্বারে যদি থাকে দাঁড়াইয়া / ম্লানমুখ বিষাদে বিরস,- / তবে মিছে সহকার শাখা / তবে মিছে মঙ্গল কলস!” এ-ছাড়াও নানা রচনায় দুর্গাপূজা-সংশ্লিষ্ট নানা কুপ্রথা ও অমিতাচার রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার লক্ষ্য হয়েছে, যেমন -- বাবুদের তামসিক দুর্গাপূজার চিত্রায়ন তাঁর ‘উন্নতিলক্ষণ’ কবিতায়, পূজায় বলিদানের জন্য নির্ধারিত অবোধ পশুর নিষ্ফল কান্নার ছবি ‘ছুটির আয়োজন’ কবিতায়, কিংবা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় দু’পক্ষের রেষারেষি থেকে রক্তারক্তির উল্লেখ তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে পাওয়া যায়। রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিতায়ও দুর্গোৎসব নিয়ে প্রতিবাদী সুর অলভ্য নয়। পঞ্চাশ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় মোহিতলাল মজুমদার লিখেছিলেন -- “মাতৃশক্তিপূজা নয়, মাতৃশ্রাদ্ধ দিন / বাৎসরিক – দায়গ্রস্ত পুত্র দীনহীন / করিয়াছে কোনোমতে তার উদ্‌যাপন / আজি তার বর্ষকৃত্য প্রেতের তর্পণ!’’ ‘বিজয়চন্ডী’ কবিতায় যতীন্দ্রমোহন বাগচি বলেছেন, অন্নবস্ত্রহীন দেশে ভীরু ও শঙ্কিত প্রাণের পূজা দেবী গ্রহণ করেন না -- “দুর্বল দেহ, দুর্বল প্রাণ – আনন্দহীন ভীরুর দলে -/ মৃন্ময়ী মাতা চিন্ময়ী হন কোন্‌ কল্পনাশক্তিবলে?/ বিরাট বিশ্বমাতারে বরিয়া কেমনে সে মূঢ় বাঁধিবে কাছে, / বক্ষের নীচে শূন্য জঠর হাঁ করিয়া যার পড়িয়া আছে।” স্বদেশ-সমকালের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ উৎসবের সময় ভুলে থাকা স্বাভাবিক ভাবেই এই কবিদের কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। গৃহস্থের আর্থিক অনটনের উপলব্ধি দুর্গাপূজার সময় যেভাবে হয়, তার প্রকাশ দেখা যায় তরুণ বয়সে লেখা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় -- “ হাহাকার বঙ্গদেশে টাকার জ্বালায়! / তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে আরও দায়। / কেন এসো কেন যাও, কেন চালকলা খাও / তোমার প্রসাদে যদি টাকা না কুলায়!...” একই দারিদ্র্যের কারণে আগমনীর সানাই শুনে কাজী নজরুলের মনে হয়েছে -- “ও যেন কাঁদিছে শুধু, নাই, কিছু নাই!” আবার এই কবিই রাজনৈতিক পরাধীনতার গ্লানিতে দেবী দুর্গাকে গঞ্জনা দিয়ে বলেন -- “দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি / ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?” অনেকটা পূর্বসূরি কবি যতীন্দ্রমোহনের মতোই বিদ্রোহী কবি নজরুলেরও মনে হয়েছে, পরাধীন দেশের ভীরু মানুষের দুর্গাপূজা শক্তিপূজার নামে অভিনয় মাত্র। তিনি মনে করেছেন, সংগ্রামীদের রক্তদান সার্থক হতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতায় এবং সেটাই যথার্থ আগমনী -- “বছর বছর এ-অভিনয় অপমান তোর, পুজা নয় এ / কি দিস আশিস কোটি ছেলের প্রণাম চুরির বিনিময়ে! / ...দুর্বলদের বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তিপূজা / দূর করে দে, বল মা ছেলের রক্ত মাগে দশভূজা।।...” [‘আনন্দময়ীর আগমনে’]। দুর্গাপূজাকে কবির অভিনয় মনে হয়েছে বাঙালিদের নিরস্ত্র ভীরুতা আর সুবিধাবাদ দেখে। তাই তিনি ব্যঙ্গ করে লেখেন, -- “বলি দেয় ওরা কুমড়ো ছাগল, বড় জোর দুটো পোষা মহিষ / মহিষাসুরেরে বলি দিতে নারে, বলে – মাগো, ওটা তুই বধিস্‌।।...” এই নির্মম ব্যঙ্গের শেষে তাঁর আক্ষেপ -- “দেবতারে যারা করিছে সৃজন, সৃজিতে পারে না আপনারে / আসে না শক্তি, পায় না আশিস, ব্যর্থ সে পূজা বারেবারে।” [‘পূজা অভিনয়’]। একই চিন্তা থেকে নজরুলের একটি গানেও ধ্বনিত হয়েছে মৃন্ময়ী মা’কে চিন্ময়ীরূপে দেখতে পাবার আর্তি -- “খড়ের প্রতিমা পূজিস নে তোরা, মা’কে তো তোরা পূজিস্‌নে-/ প্রতি মা’র মাঝে প্রতিমা বিরাজে – হায় রে অন্ধ বুঝিস্‌ নে।। / বছর বছর মাতৃপূজার করে যাস অভিনয়, / ভীরু সন্তানে হেরি লজ্জায় মাও যে পাষাণময়।।....”

০২ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

বাংলা কবিতার সেকাল-একাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



বাংলা কবিতার সেকাল-একাল বিষয়ে কলম চালানোর আগে একটা খুচরো গৌরচন্দ্রিকা করে নেওয়া দরকার। তা হলো এ বিষয়ে কিছু বলার এক্তিয়ার আমার আছে কি না, সে বিষয়েই আমি সন্দিহান, কারণ আমি কবি নই, তাত্বিকও নই। নির্ভেজাল পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেকাল ও একালের কবিতার বিষয় ভাবনাকে বুঝতে চেয়েছি এবং সমকালীন সময়ের অনুষঙ্গে বাংলা কবিতার কয়েকটি ঝোঁক বুঝতে চেষ্টা করেছি।

রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতাকে আধুনিক, অতি আধুনিক, উত্তর আধুনিক ইত্যাদি নানান অভিধায় দাগিয়ে দেবার প্রবণতা চলে আসছে বরাবরই। এখন আবার একালের কবিকুলের একাংশ বলছেন, শূন্য দশকের কবিতা, যেন একুশ শতকে সমাজ ভাবনায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে! আমরাই বাংলা কবিতার আসল আগমার্কা প্রতিনিধি, আমরাই আধুনিক, আধুনিকের চেয়েও আধুনিক, এমন শূন্যগর্ভ দাবি সেকাল একাল সবকালের কবিকুলই করে থাকেন। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ‘পথ ছাড়ো রবীন্দ্রনাথ’ বলে ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর কবিরা নিজেদের জানান দিয়েছিলেন যে, ভাবের দিক দিয়ে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত তাদের কবিতাই ‘আধুনিক কবিতা’। বললেন বটে, কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার যে সংকলনগুলি তাঁরা প্রকাশ করলেন, তার কোনোটি থেকেই রবীন্দ্রনাথকে বাইরে রাখতে পারলেন না। ১৯৫৪তে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে রবীন্দ্রনাথের ১৬টি কবিতা স্থান পেয়েছিল এবং সংকলনটির ভূমিকায় তিনি স্বীকার করেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের পর নতুন তো রবীন্দ্রনাথ নিজেই”। বাংলা কবিতার অনুরাগী পাঠক হিসাবে আমার মনে হয়, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিক, অতি আধুনিক, উত্তর আধুনিক এইসব অভিধাগুলি সাময়িক বাগাড়ম্বর মাত্র, আমি বলতে চাই ‘বাংলা কবিতা’।

বাংলা কবিতার সেকাল-একাল কথাটির মধ্যে একটা বৃহত্তর ক্ষেত্রের ইঙ্গিত থেকে যায়। রবীন্দ্র পরবর্তী পর্বে নানান ধারায় বিবর্তিত হয়ে সে শক্তি সঞ্চয় করেছে – তার বিন্যাস ও নির্মাণ কৌশল বিবর্তিত বয়েছে নানান ধারায়, কোনো একটি ধারা দিয়ে বাংলা কবিতাকে চিহ্নিত করা যায় না।

এই একুশ শতকের আমরা, যারা স্বাধীনতার আগে চল্লিশের দশকে জন্মেছি, তাদের সকলেরই কবিতার কাছে আসার শুরু পঞ্চাশের দশকে – রবীন্দ্রোত্তর পর্বে। তার আগেই তিরিশের দশকে বাংলা কবিতার দিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই। দেশকাল, সমাজ পারিপার্শ্বিক, জীবন সম্পর্কে সচেতন আগ্রহের প্রকাশ, সংকট, অবসাদ, আত্মানুসন্ধান ইত্যাদি যে ভাবনাসমূহকে আধুনিকতার লক্ষণ ধরা হয়, সেগুলি তো ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কবিতাতেও। সুতরাং বলা যায়, বাংলা কবিতার আধুনিক হয়ে ওঠার সূচনা রবীন্দ্রনাথের হাতেই।

বাংলা কবিতার রবীন্দ্রপ্রভাব বলয়ের চৌকাঠ পেরনো শুরু হলো তিরিশের দশকে ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘পরিচয়’ পত্রিকার হাত ধরে, প্রবল উপস্থিতি জানালেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। আধুনিক নগর জীবনের সংশয়, ক্লান্তি, বিতৃষ্ণা, মূল্যবোধের বিপর্যয় নিঃসঙ্গতা বোধ ও বিশ্বাসের সংকট - এসবই ছিল তাঁদের কাব্যসৌন্দর্য সাধনার উপকরণ। তাঁদের কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার প্রবল অভিযোগও উঠেছিল।

মধ্যতিরিশ থেকে চল্লিশের দশক জুড়ে বাংলা কবিতার বিষয় ভাবনায় আর একটি ধারা স্পষ্ট রূপ পেল – যার প্রভাব বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে হলো সুদূর প্রসারি, এই ধারাটিকে কেউ কেউ বলেন ‘বিপ্লবী আধুনিকতার ধারা’। আমার মতো যাঁদের বাংলা কবিতার কাছে আসা শুরু পঞ্চাশের দশকে, তাঁদের কাছে এই ধারাটি চিহ্নিত ছিল প্রগতিবাদী বা জীবনবাদী ধারা রূপে। স্বল্পায়ু সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখলেন, “প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা - / কবিতা, তোমায় দিলেম আজকে ছুটি /ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়; / পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”। ১৯৩৭এ দীনেশ দাশ লিখলেন, “চাদের শতক আজ নহে তো / এযুগের চাঁদ হ’ল কাস্তে”।

১৯৩০এ জার্মানীতে হিটলারের উথ্বান, ফ্যাসিবাদর মানবতা বিরোধী আগ্রাসন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠা এই সংকটময় বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতেও গঠিত হয়েছিল ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘ। ১৯৩৬এ কলকাতায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রথম সম্মেলনে পৌরোহিত্য করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এ দেশে তখন এক তোলপাড় করা সময় বিয়াল্লিশের আগস্ট বিপ্লব, তেতাল্লিশে মানুষের তৈরি করা মন্বন্তরে কলকাতার রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল, গণনাট্য সঙ্ঘের প্রবল আবির্ভাব, ডাক ও তার ধর্মঘট, ছেচল্লিশের নৌ বিদ্রোহ, দাঙ্গা, সাতচল্লিশে দেশভাগ ও ছিন্নমূল উদ্বাস্তু স্রোত। এই উত্তাল সময়ের আবহে বাংলা কবিতা আর শুধু ‘কলা কৈবল্যবাদী’ থাকে কি করে? থাকলো না, বিষয় ভাবনায় এলো আমূল পরিবর্তন। এই কাব্যধারার মূল কথা ছিল এই যে, কবিতা শোনাবে সময়ের শব্দ, তার শরীরে থাকবে গণ মানুষের জীবন। কবিতা হবে সহজ, আবেদন প্রত্যক্ষ, সমাজ বাস্তবতা ও সদর্থক আশাবাদের চিত্রকল্প, কবিতার দায় নতুনতর এক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখানো। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ধারাটি প্রবলতর ছিল। এমনকি দুর্বোধ্যতার দায়ে অভিযুক্ত বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখদেরও যেন জন্মান্তর ঘটে গেল এই জীবনবাদী ধারার ছোঁয়ায়। আপনভোলা নির্জনতায় আত্মমগ্ন জীবনানন্দ দাস মুখোমুখি হলেন ‘মহাপৃথিবী’র, লিখলেন, “তবুও নগরে, যুদ্ধে, বাজারে, বন্দরে / জেনে গেছি কারা ধন্য / কারা স্বর্ণ প্রাধান্যের সূত্রপাত করে”। বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, “... শুধু জেগে আছে তাই নয়, কাজ করে যাচ্ছে গোপনে- গোপনে, / সৃষ্টি করে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম, কবর ফেটে অবুঝ / অদ্ভুত উৎসারণ, পাথর ভেঙে স্রোত, বরফের নিথর আস্তরণে” (‘স্পন্দন’), – “যখন ঘোমটা ছিঁড়ে উঁকি দেবে ক্ষীণ, প্রবল, উজ্বল আশ্চর্য সবুজ / বসন্তের প্রথম চুম্বনে ...” (‘শীত রাত্রির প্রার্থনা’)। চল্লিশের দশকে এলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ – যাঁদের কবিতার শব্দে গভীরতর জীবনবোধ ও সামাজিক চৈতন্যের অঙ্গীকার। সমর সেন লিখলেন, “তবু জানি কালের গলিত গর্ভ থেকে বিপ্লবের ধাত্রী / যুগে যুগে নতুন জন্ম আনে, / তবু জানি জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে, চূর্ণ হবে, ভষ্ম হবে / আকাশ গঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে... / ততদিন নারী ধর্ষণের ইতিহাস / পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া / অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মতো, / ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে / বণিকের মানদন্ডের পিঙ্গল প্রহার”।

পঞ্চাশের কবিতায় বিপ্লবী আধুনিকতার প্রভাব স্তিমিত হলো বটে কিন্তু জীবনবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ আরো বিচিত্র বিন্যাসে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো। আর এই পঞ্চাশের দশকেই যেন তিরিশের জীবনানন্দ নতুন ভাবে আবিষ্কৃত হতে থাকলেন। ১৯৫৪য় মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে প্রয়াত হবার আগে নির্জনতা প্রিয় জীবনানন্দ সমকালীন অন্যান্যদের মতো আলোচিত ছিলেন না। কিন্তু এই উচ্চারণে সংশয়ের জায়গা নেই যে, পঞ্চাশ ও ষাট দশকের কবিদের ঋণ প্রধানত জীবনানন্দের কাছেই, তিনিই সেকাল- একালের সার্থক যোগসূত্র। জীবনানন্দের পরের প্রজন্মের কবি প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো বলেছিলেন, “তিনি কবিদের কবি”। সেই কবে ১৯৫২তে ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় লেখা একটি নিবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “বাঙালি কবির পক্ষে বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কোনো কবি জীবনানন্দের মতো রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন, আবার কেউ কেউ তাঁকে আত্মস্থ করেই শক্তি পেলেন তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াবার। ...এরপরে যাঁরা এসেছেন বা আরো পরে যাঁরা আসবেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে আর কোনো ভয় থাকলো না তাঁদের। অবশ্য অন্যান্য দুটো একটা বিপদ ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে, যেমন জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে বা অন্য কারো্র আবর্ত, যা থেকে বেরোতে পারছেন না আজকের দিনের নবাগতরা। অর্থাৎ জীবনানন্দ পূর্ণতর ভাবে আবিষ্কৃত হবার অনেক আগেই পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের ওপর তাঁর অনিবার্য প্রভাবের ইংগিত দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বাংলা কবিতায় রাবীন্দ্রিকতার অবসান ঘটিয়ে নতুন বীজ বপন করলেন জীবনানন্দই। নিশ্চিত ভাবে তিনিই বাংলা কবিতায় সেকাল ও একালের যোগসূত্র।

১৯৫৩তে প্রকাশিত হলো ‘কৃত্তিবাস’। উঠে এলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, তারাপদ রায়, শঙ্খ ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী প্রমুখ। মধ্য তিরিশের দিনেশ দাস, চল্লিশের সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ তখন পূর্ণ দীপ্তিতে। বস্তুত বাংলা কবিতায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল সৃজনের স্বর্ণসময়। নবলব্ধ স্বাধীনতার ফলশ্রুতিতে একদিকে সঞ্জীবনী স্বপ্ন দেখা, আবার স্বপ্ন ভঙ্গের সময়কালও বটে। মধ্যপঞ্চাশেই স্লোগান উঠলো, “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মত্‌, ভুলো মত্”। এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলন, ঊনপঞ্চাশের শিক্ষক ধর্মধট, কাকদ্বীপ আন্দোলন, ৫৯এর খাদ্য আন্দোলনে কলকাতার রাস্তায় তাজা রক্তের স্রোত। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার তীব্র সুর স্থান পেল পঞ্চাশ-ষাটের কবিতায়। শঙ্খ ঘোষ লিখলেন, “নিভন্ত এই চুল্লি তবে / একটু আগুন দে / হাড়ের শিরায় শিখার মাতন / মরার আনন্দে”।

উত্তাল সময়েই সৃষ্টির প্রাচুর্য সর্বকালে সর্বদেশে। আমাদের সেই সময়টা কেমন ছিল? পঞ্চাশের কবি প্রয়াত পূর্ণেন্দু পত্রীর পংক্তিতে –

“সে এক কলকাতা ছিল আমাদের
শ্যামবাজার ছুঁয়ে ব্রহ্মপুত্র
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ জুড়ে গারো পর্বতমালা
আর হ্যারিসন রোডে চিতোরের সারসার দূর্গ।
বিরাট সামিয়ানার নীচে
সারারাত নাচের গানের আর
কবিতার উৎসব।
যেখানে পা রাখছি
আগুনের আলপনা।
যেখানে হাত সেখানেই রক্তরাখী।
তখন সূর্য সেন বলে হাঁক দিলেই
খুলে যেত এক লাখ দরজা।
সে এক কলকাতা ছিল আমাদের।
কলেজ স্ট্রীটের গায়ে কাকদ্বীপ
ডালহৌসির গায়ে তেলেঙ্গানা
আর রাজভবনের সামনে চট্টগ্রাম”।
এই সমকালেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে নারী, নিসর্গ আর কবিতা একাকার হয়ে যায় অপাপবিদ্ধ পবিত্রতার অন্বেষণে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রকৃতি প্রেম আর জীবন সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ। বাংলা কবিতার স্বর্ণ সময়ই বটে!

সত্তরের দশক আমাদের সমাজ জীবনের আর এক উত্তাল, অস্থির সময়। নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের আকর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হাজার হাজার তরুণ অপরাজেয় রাষ্ট্রশক্তির বন্দুক-বেয়োনেটের সামনে। কাশীপুর, বরানগরের ট্রাক ভর্তি লাশ উধাও হয়ে গেল গঙ্গাগর্ভে, বস্তাবন্দি লাশ বারাসাতের রাস্তায়, মৃতদেহ মাড়িয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ, কয়েদখানায় হত্যা – সে এক মৃত্যুর দশক! বিমলচন্দ্র ঘোষের পংক্তিতে – “কিনু গোয়ালার গলি / সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি / বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোৎস্না / ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুঁস না ।/ ওরে মন পৃথিবীর গভীর / গভীরতর অসুখ এখন”। সেই গভীরতর অসুখের সমকালে, সত্তরের দশক সৃজনের দশকও হয়ে উঠেছিল। এই দশকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক রাজনৈতিক কবিতা সব্যসাচী দেব, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, কমলেশ সেন, সমীর রায় প্রমুখের কলমে। এবং বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন চল্লিশ ও সত্তরের যোগসূত্র।


সমকালীন সময়ের অনুষঙ্গে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বিষয় ভাবনার কয়েকটি ঝোঁক ছুঁয়ে গেলাম মাত্র এক কবিতা পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে। সত্তরে এসেই থামলাম। কেননা, আশি পরবর্তী সময়কে আমার মনে হয় শূন্যতা বোধের সময়কাল। বিশ্বায়ন নামক দানবের গ্রাসে বিপন্ন এখন আমাদের অনেক কিছুই। – বিপন্ন মূল্যবোধ, বিপর্যস্ত আমার মাতৃভাষার অহংকার। তবুও কবিতা থাকে, কবিতা আছে। জীবন পবিত্র, এই পবিত্রতার বোধকে আঁকড়ে থাকুক একালের কবিতা, পীড়িত মানুষের বেদনার কেন্দ্রে হাত রাখুক আজকের কবিতা। দেশজ জীবন আর মানুষের বেদনার বার্তা সংবেদনশীল চরণে ঠাঁই পাক আজকের কবিতার শরীরে, এই-ই তো দাবি! হয়তো আশি পরবর্তী চল্লিশ বছরের কিংবা রবীন্দ্রোত্তর একশ বছরের কবিতার কথা লিখবেন আর কেউ। আমি তার কিছু সূত্র রেখে গেলাম মাত্র।

“সময়-স্বদেশ–মনুষ্যত্ব–কবি–কবিতা–কবিতার পাঠক কোথাও যদি একসূত্রে বাঁধা যেত! হয়তো একদিন সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে; আমরা সবাই মিলে পরিশুদ্ধ হব”। (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা। এই সূত্র বন্ধন করুক একালের কবিতা, অপেক্ষায় থাকি।



০৩ রমিত দে

দ্য প্রফেট
রমিত দে

“স্মৃতি হলো এক ধরনের সাক্ষাৎ । বিস্মরণ এক ধরনের স্বাধীনতা।
মানবিকতা যেন এক আলোর নদী, অনিশ্চয়তা
ছাড়িয়ে অবিনশ্বরতায় বয়ে যাচ্ছে সে ।
তাদের জাগরণে আমাকে তারা বলে, তুমি আর
তোমার পৃথিবী এক অনন্ত সমুদ্রের অসীম তটভূমিতে
এক কণা বালির মতো শুধু ।
স্বপ্নে আমি উত্তর দিই, আমিই অনন্ত সমুদ্র ।
আর সারা পৃথিবী আমার তটরেখায় বালির কয়েকটি কণামাত্র”।

(মূল - কাহলিল জিব্রান / অনুবাদ - অমিতাভ মৈত্র)

একজন কবি ঠিক কী কী কারণে আলোচিত হতে পারেন? তাঁর গ্রন্থনা তাঁর বোধ তাঁর অধ্যয়ন তাঁর প্রতিভা অথবা তাঁর স্পন্দনা অথবা তাঁর প্রাণশক্তি অথবা গভীরতা বা ছন্দ বা তার অনুপ্রাস! কেবল এই কি তার বীজ, এই কি তার তৃষ্ণা! কিন্তু একজন কবির ভ্রমণসূচিতে যখন জড়িয়ে যায় আধ্যাত্মবাদ, যখন তার প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে কবিতার পটভূমি হয়ে ওঠে ঈশ্বরের ‘প্রশান্তি শুভ্র স্বাগত স্নেহের’, ভাবতে ভাবতে পথ চলতে চলতে এগিয়ে আসে এক বিবিধ চৈতন্য এক ধূ ধূ নিরবতা, যেখানে উদ্ঘাটন হয়ে যায় কবি স্বয়ং, সমর্পিত হয়ে যান সেই বিন্দুপ্রভ প্রকৃত পরিত্রাণের আশায়, তখন তাঁর অভিজ্ঞতাকে আমরা কি নাম দেব? স্বাপ্নিক! জ্ঞান! সুস্থ! বিস্মৃত! নাকি হাওয়া এসে খুঁজে নেবে কবিতার হারানো শরীর! খুঁজে নেবে তার ছোট ছোট চোখ, তার সাবেক সংক্ষোভ আর পেছনের দরজাটা ভেঙে দিয়ে ছোট ছায়াটিকে রেখে যাবে আমাদের সান্ধ্যস্নানের জন্য। ঠিক সে মুহূর্তে কবি কি বোধের ভাণ্ডারী, নাকি কান্ডারি! তিনি কি একা একা এলেন নিজস্ব নাটক দেখবেন বলে? খুলে দিলেন অনায়াস সিঁড়ির দরজা! তার অর্ধেকই অর্থহীন তবু যেন বাকি অর্ধেক নিয়ে তিনি পৌঁছতে চাইছেন ঈশ্বরের পূর্বরাগে, সেখানে শব্দ আসলে এক ছবি, তার দু’পায়ে আলো, সে মাঠের ওপর একা, হয়তো তাকে কবি ধরবেন কুয়াশা ভেবে আর মুঠি খুলে দেখবেন আদতে একটা সদ্যোজাত কাঁচপোকা, বন্ধ করবেন মুঠি এবং খুলবেন, দেখবেন আলোকিত সমন্বয়ে কেমন করে তা হয়ে গেছে কখন একটা পাখি। আর তারই ভেতর স্পষ্ট হতে থাকে এক মানুষ এক বিষণ্ন তমসালীন অভিসারিক, আবার তাকেই মুঠি বন্ধ করলে আদতে এই এতো দুর্ধষ ওড়াউড়ির শেষে হাত ভর্তি কুয়াশা ছাড়া আর কিছু নয়, আত্মমগ্ন বালির ওপর কি দীর্ঘ স্বাধীনতা নিয়ে এক নিঃশীল চেতাবনি; এই কি সেই আদিপর্ব! সেই ভাসমান শূন্যতা! জ্ঞানার্থী কবি যেন গোল পৃথিবীর ওপর এভাবেই ঘুরে চলেছেন কেবল এক সাধনায়, এক নবীন প্রার্থনায়। দু’হাত জুড়ে তাঁর কবিতার মুহূর্ত প্রবাহিত মুহূর্ত। জেতবনের ভিক্ষুকের মতো তিনি কেবল প্রশ্নের উত্তর চান, পংক্তির পুনরাবিষ্কার চান; জ্ঞানযোগী জ্ঞানকে অলংকৃত করেন। ভক্তিযোগী ঈশ্বরকে তবে কবি কি করবেন? তাঁর কাছে আছে কেবল এক আপেক্ষিক শূন্যতা, একটা দ্বৈত, একটা সাগর থেকে ফেরা। যেন সমস্ত বীজ অপেক্ষা করছে স্পর্শের ,অনুভবের, বাতাস আবার বুদবুদের কাছে বারংবার ঠকে যাওয়ার মতো আরও এক বিশ্বাসযোগ্য সত্যের।

এই স্বরাট সত্যেরই সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন কাহলিল জিব্রান। পেয়েছিলেন ভাষা দিয়ে মানবাত্মার সিনট্যাক্স। ঠিক এখানেই কোনো স্থির ভূখন্ডের মাঝে জিব্রানকে আর বেঁধে রাখা যায় না, ঠাঁই পাওয়া যায় না কোনো নির্দিষ্ট মানচিত্রের। অথচ তিনি দিশেহারা নন, লেবাননের বা মার্কিন দেশের কবি জিব্রান নন বরং সত্তার নতুন আবির্ভাবে সত্তার শুভকামনায় ভেসে গেছে তাঁর সম্ভাবনার বয়া, তাঁর ছড়ানো বালিয়াড়ি আর ক্রমেই তা হয়ে উঠেছে সব জানার ভেতর শূন্যস্থিত অজানা, হয়ে উঠেছে বোধের এক বিশুদ্ধ বাণিজ্য। প্রশ্ন করেছেন বারবার, না, মনোহারিত্বের জন্য নয়, প্রত্যাখ্যানের জন্যও নয়, বরং সেই উৎসমুখে পৌঁছাবার জন্য, সেই অস্থিরতার বীজ ছুঁয়ে দেখবার জন্য। অনন্ত মিউজিকররুম খোলা রেখে পৃথিবীর ঘুমঘোর নুনকান্না খোলা রেখেই ভেতর থেকে যেন বারবার প্রশ্ন করেছে, কবিকে! কবিতাই বা কি -- সে কি দেহের! মনের! জীবের! জীবনের! নাকি কেবল এক উচ্ছেদবাদের! কেবল এক সুবাতাস ভেঙে প্রগাঢ় আহ্বানের! এই সামান্যতম প্রশ্নে তাঁর ছিল তুমুল ভাঙন; না কোনো এগিয়ে যাবার কাল্ট ফিগার নন, বরং তাকে আমরা পাই এই বাসনাবৃত্তের বর্হিবয়বের থেকে অনেক দূরে, কোনো কম্প্রোমাইজ নয় বরং বেড়া ভাঙার কম্পনটুকুই তাঁর প্রতিপাদ্য। অন্ধকারকে পছন্দ করেননি অথচ অন্ধকার ছিল তাঁর দ্বিতীয়তা, সুতীব্র আর্তস্বর, যেন আলো জোগাতেই অন্ধকারকে উসকে তুলতেন, বিশ্বাস করতেন ক্ষতপ্রাণ অথচ তারই ওপর বিছিয়ে দিতেন বিবশ ঘাসের প্রীতিময় জাফরি। এই জীবন, এই যাপন --সবই যে আসলে কুয়াশা থেকে ক্রিস্টাল থেকে নয়, সেই যে প্রতিফলন, দিল হাজার রঙের ভিড় দি্‌ সেই তো পেরিয়ে গেল প্রশ্নকে, পেরিয়ে গেল পথিককে, কিন্তু পথ! তার যেন আলিঙ্গন সহজ উজ্জ্বল তার যেন কিছুতেই অভিমান নেই, সে যেন আনন্দের দিকে যাবে স্পন্দনের দিকে যাবে। জিব্রান খুব দূর থেকেও অনুভব করেছিলেন আসলে এই পথই কাছের, এই পথকেই একমাত্র ধারণ করা সম্ভব, আর তাই ভরাজীবন থেকে ক্ষণমুহূর্ত থেকে তিনি যেন পর্যটক হয়ে উঠেছেন নির্বিরোধে, এক বিন্দুও ঘুমাননি, কেবল জল নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখেছেন কীভাবে গুলিয়ে যায় এই জন্ম এই পরিক্রমা এই যাত্রাপথের ঝনঝনানি। কীভাবে ফিরে চলে কসমিক কেওস। জিব্রান যেন দু’পাশের টান নয়, কেবল কেন্দ্রের ম্যাজিকটাকেই খুঁজতে চেয়েছেন বারংবার । কবিতা সম্পর্কে জিব্রানের ধারণা নিজের থেকে ক্রমশঃ মুক্তি আর নির্মোহ উদাসীন তীব্র লাফিয়ে পড়া থেকেই বিপরীত মানসে আবাদযোগ্য হওয়া। What is poetry? "An extension of vision. An expression of that sacred desire to find this world and behold it naked; and that is the soul of the poetry of Life. Poets are not merely those who write poetry, but whose hearts are full of the spirit of life. প্রতিটি শব্দই সত্য। প্রতিটা শব্দই শান্তিতে পুড়ছে। কবিতার থেকে শব্দের বিপরীত এক ছবি নিয়ে প্রতিটা শব্দই চলেছে কবিতার অন্য কোনখানে। তবে কি অর্থবিমুক্তি চাইলেন জিব্রান! রক্তের মধ্যে ঘুলিয়ে ওঠা সেই পোলার ডার্কনেস অথবা কাঠপাতার ঘর থেকে রিপুবায়ু আর রিপুপীড়া থেকে ফিরে আসার ঐশীক প্রেসক্রিপশন। জিব্রানকে আমরা কি কবি বলতে পারি, নাকি একজন চিত্রকর! নাকি সেই শ্রুতিময়ী প্রজ্ঞা সেই চিন্তনময়ী প্রজ্ঞা!

১৯২৬এ বেরোলো ‘বালি ও বুদবদ’ আর ১৯২৩এ ‘দ্য প্রফেট’। বড় আলোর নিচে মোমদানী রাখার সাহস দেখালেন জিব্রান। সে গলে গলে মনখারাপ নয় বরং ক্রমশ হয়ে উঠল এক নিবেদন -- চিন্তার, বিষয়ের, আধেয়ের; হয়ে উঠল এক অনুপম সাধনা, ভঙ্গুর প্রাণসামগ্রীর থেকে তুচ্ছ কোলাহল থেকে কোথাও সংজ্ঞাহীন নির্দেশহীন ক্রমজায়মানের দিকেই। উৎসারিত আলোর প্রহরী বিনয় মজুমদারকে তাঁর ডায়েরীর জ্বরপঞ্জিতে লিখতে দেখা গেছিল “…টগর গাছের তলায় একটি অলৌকিক বালিকা দাঁড়িয়ে আছে। একটি বালিকা আসে পৃথিবীর উদ্যানে একাকী”। জিব্রানের উচ্চারণও যেন এই একাকে ঘিরেই, কিন্তু সে আলো ছাড়া নয়, শরীরভরা রুগ্ন ফরসেপ ছাড়া নয়, আর এর মাঝেই তিনি খুঁজতে বেরোলেন সেই বোকা আত্মাকে সেই উত্তরণের ঘনককে। এই তো সেই গোপনতম সত্য, মুকুলিত সমর্পণ। যে সত্যের দিকে জিব্রানও হয়ে উঠেছেন নিরুদ্দেশ যাত্রী; মহৎ এবং ব্যতিক্রমী কবিতা লিখতে চাননি জিব্রান, টানতে চাননি কোনো সমান্তরাল সরলরেখা, বরং শব্দের সরলরেখা ধরে এগোতে এগোতে শব্দের শেষে জড়ো করেছেন সেই প্রথম শব্দ যা কোনো কিছুর মধ্যেই আর নেই, যা সৃষ্টির আয়োজনেও আসলে অজ্ঞেয় অদৃশ্যের। আর এখানেই তিনি বিছিয়ে দিলেন তাঁর ভাবনার ক্যানপি, খুলে দিলেন বন্ধ তালা।


তোমার সন্তানেরা তোমার নয়, তারা জীবনেরই আকাঙ্ক্ষা, তোমরা তাদের উৎস নও, মালিকও নও। কেবল এক প্রক্রিয়ার শরিক। কী করে দেবে তাদের উত্তরাধিকার! তাদের চেতনা তো তাদের, তাদের সুষম প্রতিধ্বনি; তাঁর জীবনচিন্তা জ্যামুক্ত, বার বার জিব্রান ফিরে ফিরে যেতে চেয়েছেন স্থান কাল চরিত্রের সংশ্লেষের বাইরে, তাঁর পাঠ ও প্রাসঙ্গিকে বারবার বিংগস পরিনত হয়েছে বিকিরণে। তাঁর বিশ্বচিন্তা সেই সকালবেলার ঘুমভাঙা বৃষ্টির মতো, যা কেবল পবিত্র জলকুন্ডটি ভরে দিতে থাকে আশ্চর্য হেঁয়ালি আর বিস্ময় নিয়েই। নিজেকে উৎসর্গ করে, তিনি কেবল নির্জনের উৎসর্জনে যেতে চেয়েছেন, নির্সগের একজন হতে চেয়েছেন, পৃথিবীর মানচিত্রে দাঁড়িয়ে কোনো পার্টিকল ফিজিক্স নয় বরং এই মহাবিশ্বের শেকলের দাগগুলো মুছতে চেয়েছেন, হতে চেয়েছেন আমিহীন। তাঁর নব জীবনায়নবোধ বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে ‘আমিকে’। জগৎস্থিত অভেদকে নিয়ে গেছেন পরার্থ সত্তায়। পরম শূন্য তাপমাত্রা জিব্রানের কবিতার, বরফের নিচে লুকিয়ে রাখা আমাদের গানের রাস্তাগুলোকে অকস্মাৎ যেন পাখি আর অসংখ্য সবুজের হাতে অর্পিত করেছেন ফাম আল মিলিয়াবের ভূমিপুত্র, স্থাপনের নিরূপণ নয় বরং সব আয়োজনের সব হয়ে ওঠার সব স্থাপনের নির্বাণই ছিল যার দুর্বলতা, যার দিদৃক্ষা।

এ বিষয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, জিব্রান মূলত চিত্রকর নাকি কবি! আসলে কবিতা আর ছবির নিষাদ ও গান্ধারকে মিলিয়ে দেওয়াই ছিল জিব্রানের ভাষা জিব্রানের সেনস্যরি ইমেজারী; প্রতিতুলনাহীন এক ভ্যানিশিং পয়েন্ট অবধি পৌঁছে যাওয়া। কাদিসা উপত্যকা বা বিশারি গ্রামের পবিত্র সিডার গাছ, লেবানন পাহাড়, মরোনাইট গীর্জা বা ধূসর মেষপালকেরা শৈশবেই অগ্রন্থিত জিব্রানের আত্মার অ্যালবাম খুলে রেখে গেছিল আর্টিস্টিক লাইসেন্স; তুলি বা তারপিনে না, বিসারি গ্রামের প্রতিটা ঘুমন্ত ভাষ্য উঠে এসেছিল জীবন্ত বয়ানের ঢঙে; পবিত্র সিডার গাছ খিলখিল করে হাসে -- গল্প করে -- মাঝে মাঝে পাশ ফেরে আর আঙুল তুলে দেখায় কাদিসা উপত্যকার মাঝে মাঝে লেগে থাকা আধখানা রোদ্দুর, পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নেমে আসা ফিকে সবুজ গাঢ় সবুজ, নীরবে চিনিয়ে দেয় মুসলিম দ্রুজ আবহ আর প্রাচীন কিথারা। কাঠ কয়লা দিয়ে তিনিও এঁকে রাখতেন এতসব প্রত্ন করিডোর এতসব অতৃপ্ত তৃষ্ণার কথা, যা পরবর্তী কালে হয়তো সম্পূর্ণতা পেতেই হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা তাঁর শাব্দিক কোরেল; জিব্রানের সংস্কৃতি আর অস্তিত্ববোধের সাথে কবিতা আর ছবির কোথাও এক শূন্যতত্ত্ব এক একক মালিকানাবোধ কাজ করে। কিছু কিছু ছবি হয়তো জিব্রানকে তাঁর কবিতার আন-কনসাস মনিটরিং থেকে নিয়ে চলে আসে স্থির ইমেজে; যেখানে রহস্যময় অফুরন্তের থেকে মুখই হয়ে ওঠে তীক্ষ্ণ প্রত্যক্ষতা, সেখানে ধ্রুপদ ভেঙে খেয়াল তৈরি করা নয়্‌ দুনি চৌদুনি তান নয় বরং উঠে আসে রক্ত মাংসের কিছু পিচ্ছিল প্রেক্ষাপট; কিন্তু এই রঙের দ্যোতনাতেই কখনও কখনও ভারি বাতাস লাগে, ছুঁয়ে যায় অর্জিত পুরবৈয়া। ঠিক সেখান থেকেই আমরা পেয়ে যাই দেহজ পিপাসা থেকে ‘মুগ্ধ সারসের মতো’ উড়ে যাওয়া ‘প্রফেট’ জিব্রানকে, যার স্থল ও অন্তরীক্ষের ঠিকরে পড়া আলোটুকু ছাড়া কোথাও কোনো অস্তিবাচক অভিপ্রায় নেই, অভিপ্রায়মুক্ত এক প্রকাশিত জাহাজ, যে তার সমস্ত জীবনকে নিয়ে চলেছে ভরমুক্ততার দিকে, নিয়ে চলেছে সেই ভোরের পাঠশালায়, যেখানে বিশ্বসংযোগে খুব শান্ত খুব একাগ্র এক ভালোবাসা -- সেই তাঁর শান্তি, সেই তাঁর আরোগ্য, সেই তাঁর ঘুম বহ্নির নীড়ে এক গুল্মাচ্ছাদিত অবধারিত।

ভালোবাসা প্রসঙ্গ জিব্রানের কাছে অনেকটা সেই ফিনফিনে ঘুমের মতো, সমস্ত জীবন অতিবাহিত করার পর সূর্যাস্ত অবধারিত জেনেও যেন বলছে, আর ক’টা দিন রোদ্দুরে কাটাই। তার আলোয় এক আধ্যাত্মিক ত্বরণ, ঘড়ি বেজে ওঠে হৃদয়ের অবস্থানে, ফেনা যেমন খুঁজে ফেরে জলকে, ধোঁয়া খোঁজে আকাশকে, ঠিক তেমনি জিব্রান ভালোবাসাকে মুক্তি দিয়ে দেন এক ভাষাহীন উচ্চারণে when love beckons to you, follow him… and when his wings enfold you yield to him… And when he speaks to you believe in him... love gives naught but itself and takes naught but from itself. Love possesses not nor would it be possessed. For love is sufficient unto love.When you love you should not say, ‘God is in my heart, ‘but rather, ‘I am in the heart of God.’ And think not you can direct the course of love, for love, if it find you worthy, directs your course. ভালোবাসার কাছে এভাবেই আত্মসর্মপিত জিব্রান; তাঁর অ্যানেক্সিটি প্যার্টান গান গেয়ে ওঠে যখনই দুঃখ পায়, ছবি আঁকে যখনই দৃশ্যে কাতর হয়ে ওঠে এক জন্মান্ধ ‘আমি’, অথবা শব্দকে সর্বময় করে তোলে যখন আঠার মতো জড়িয়ে যায় চিৎকার। স্থানিক থেকে কালিক থেকে বারবার যেন হাঁটতে চাইছেন ট্রাপিজে, ক্রমশ মুছে ফেলছেন ‘আমি’ নামক ছায়াফসিল, মুছে ফেলছেন ইমোটিভ ফেনা মাখানো পা আর ফুসফুসের বিষণ্ন মেহেন্দী।

জিব্রানের নিজের শৈশব কৈশোর কেটেছে পারাবারিক বিচ্ছিন্নতায়, অথচ তাঁর নাতিউষ্ণ কবিজীবনের ফরম্যাটে তিনভাগ নয় হয়তো পুরোটাই জলে টলমল, পুরোটাই মেঘ মেখে খাওয়া নয় বরং বৃষ্টির জন্য হাত পাতা, তিনি কথাকে মন্ত্রের জায়গায় কনভার্ট করেছেন, ‘ভয়েস ইনটু জিরো’। পাকা দেওয়ালের মাঝে গড়ে তুলেছেন এক চমৎকার সিঁড়ি, যা দিয়ে উঠলেই মৃত্যু যা দিয়ে উঠলেই মুক্তি, আর সে মৃত্যু বাতাসে নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই নয় অথবা সূর্যের তাপে গলে যাওয়া মাত্র। মৃত্যুকে এভাবেই হু হু করে ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছেন জিব্রান, তুলতে চাননি, বরং এক নিরাময়হীন গল্পের মাথার দিকে দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে সাজিয়ে রেখেছেন, সেখানে কান দিলেই প্রতিবেশীরা পাবে এক সুগন্ধী নিঃশ্বাস, এক ঝাঁপিয়ে পড়া আকুতি, ছদ্মবেশ খুলে বেড়িয়ে যাওয়া অতিশূন্যের ফরমুলা। পায়ের তলায় মাটি থাকলেও আসলে আকার সীমায় জিব্রানের ছিল না কোনো শেকড়, কেবল স্রোতে ও আবর্তে আলো নিভিয়ে জিব্রানের বেড়ে ওঠা। মা কামিলা, সৎ বাবা খলিল বে। মদ্যপ জুয়াড়ি বাবা আর মায়ের সাথে নিত্যনৈমত্তিক সাংসারিক ঝগড়ায় তাঁর যাপনের টূকরোগুলো কোথাও সম্পৃক্ত হতে চায়নি ওই উদাসীন অর্থহীন শীতার্ত শৈশবেই; তাই কি জিব্রান শব্দ থেকে পালাতে চাইলেন? পালাতে চাইলেন বাস্তব থেকে! আসলে প্রাণ নয় প্রাণরসের ষড়জেই মজে ছিলেন জিব্রান; তিনি এমনই কথা খুঁজছিলেন যা থেকে নীরবতা তৈরি করা যেতে পারে। প্রকৃতিরই ফুলে তিনি খুঁজেছিলেন ফুলহীনতা, সেই মহৎ শূন্যস্থান। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তিনি কি চেয়েছিলেন শব্দের নীরবতা, নাকি নীরবতার শব্দ! এক সাংঘাতিক দৃশ্যের সামনে গুঞ্জিত চিরন্তনের সামনে এসে লাফ দিলেন আরও এক চিরন্তনে। নিভে যাওয়া আলোর দিকেই ইঙ্গিত করলেন জেগে থাকা বীজের কথা। এক আর্তস্বরের মানুষকে এক ঘন আবহময় মানুষকে প্রাক্‌রচিত গন্ডির বেড়ার থেকে নিয়ে গেলেন সেই উপচ্ছায়ার দিকে, নিয়ে গেলেন প্রথম দিনের সূর্যের কাছাকাছি, মুক্তো জন্মের কাছাকাছি, ধীর সম্পন্ন পায়ে জিব্রান যেন ঈশ্বরের প্রথম শব্দ হিসেবেই চুরি করতে চাইলেন মাটিতে পড়ে থাকা মানুষকে। নিভে যাওয়া আলোকে নিয়ে গেলেন সবুজ অন্ধকারের ছায়ায়। প্রফেট আসলে সেই বন্দরগামী জাহাজ যাতে তিনি নিজেই উঠতে চেয়েছেন ভোর হয়ে। চেয়েছিলেন জাগরণের এক নিবিড় আয়তন, এক ঐশী অন্ধকার, সে অন্ধকার আলোর টুপি খুলে রেখেছে, সে অন্ধকার আসলে আমাদের রিফিউজি পাড়াগুলোকে শ্বাসরোধকারী ঘুমগুলোকে অসীম কাপড়ে মুড়ে রেখেছে; কখনও কখনও মনে হয়, নিজেরই অজান্তে হয়তো জিব্রান লিবারেট করতে চেয়েছেন সুখ দুঃখ জন্ম মৃত্যু প্রেম ঘৃণা প্রেমের মতো ডাউন সাইকেলগুলোকে, তুলে ফেলেছেন অনন্ত সমুদ্রের ভারি বয়ামের ঢাকা আর ভেতরের ফাঁকাতে রেখে দিয়েছেন আমি বা আমাদের মতো বালির কয়েকটি কণামাত্র, এই আমি বা আমাকে যেন যেতেই হবে কোনো এক ‘নিভৃত লাল কোণে’, যেতে হবে এক নশ্বর পূর্ণতার কাছাকাছি এবং সেখানে কোনো দ্বন্ধতা নয়, এক পা বাড়ানো নয় পথের ওপর বরং সম্পূর্ণ পথটাকেই তিনি পথিকের থেকে পর্যটনের দিকে প্রয়াস করে দিলেন, দৃঢ় পোক্ত করে দিলেন। পালাবার কথা বলেননি জিব্রান বরং পৃথিবীর মাটিটা ফাঁক করে দেখিয়ে দিলেন প্রতিটা বীজই আসলে এক তৃষ্ণা, এক অপেক্ষ্‌ কেউ তাকে টানছে এক আশ্চর্য আকর্ষকের দিকে। ১৯২৩এর অক্টোবর মাসে বেরোলো ‘দ্য প্রফেট’। প্রকাশ পেল এক অচেনা দ্বীপে জীবনের সহবাসে থাকার শেষে প্রকৃত ফেরার অপেক্ষায় জাহাজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা সেই চিরন্তন প্রফেটকে চিরন্তন প্রজ্ঞাকে ঘিরে একের পর এক পরত খুলে যাওয়া উপরিভাগের, আর মিলিয়ে নেওয়া হলো ইথারমন্ডিত গভীরতাকে; এই প্রফেটের মুখ যেন সেই ছায়ার গান সেই অতিদীন কেউ যেন তাঁরই সামনে এনে নামিয়ে রেখেছেন একের পর এক জিজ্ঞাসা, নামিয়ে রেখেছেন সফেদ যন্ত্রণা কিংবা মৌন বিষাদ। আবার কখনও বা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে তাঁর তেষ্টা, তাঁর প্রাণের ভজনা তাঁর মিশ্রিত অনুভূতি আর এক ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো পবিত্র পুরুষের মতো প্রফেটের আদলেই এই একাকী নিঃসঙ্গ আগন্তুক মানুষকে জিব্রান দেখিয়ে গেছেন জীবন আবর্তের বাইরে আসবার রাস্তা, চিনিয়ে গেছেন বাসনায় ঘুরে বেড়াবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে বিশেষ হওয়ার লিপিরূপা। বিশ্বাসের পাত্রে ভরেছেন ঈশ্বরের মুখ।

যন্ত্রণা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, তোমার যন্ত্রণা হচ্ছে আবহমান আবরণকে ভেঙে ফেলা যা তোমার বিশ্বাসের, বোধের চারপাশকে ঘিরে রাখে। এমনকি কোনো পাথরকে বা কোনো ফলকেও ভেঙে ফেলতে হয়। আর এভাবেই তাঁর হৃদয় মাথা রাখে সূর্যের নিচে। তোমাকে জানতে হবে তোমার যন্ত্রণার ভাষা। প্রতিদিনের এই অতিরিক্ত এবড়োখেবড়ো জীবন যাপনের ভেতর তুমি কি তোমার হৃদয়কে সাজিয়ে রাখতে পারবে? তোমার যন্ত্রণা তোমার আনন্দের চেয়ে কম বিস্ময়কর নয়। এবং তাকে তুমি গ্রহণ করবে। যেমনটা তোমার শস্য ক্ষেতের উপর দিয়ে নিঃশ্বাসের মতো যেমন ভেসে যাওয়া সব ঋতুকে সাবলীলভাবে গ্রহণ কর। আসলে বেশিরভাগ যন্ত্রণাই তোমার নিজের পছন্দ করা। আর এটাই সেই আনন্দ, সেই প্রকৃত তিক্ততা যা তোমাকেই দেওয়া হয়েছে তোমারই অসুখের উপশমে। এইবার সমস্তটুকু শূন্যতা আর নীরবতা মিশিয়ে বিশ্বাস করে তুমি পান করে ফেল এই যন্ত্রণা। সে যতই ভারি হোক না কেন আসলে সে ক্রমশ হালকা হয়ে উঠছে এক অলৌকিক টানে, এক বিমূর্ত ও বিশুদ্ধ নির্দেশনায়। আর যে পাত্র সে হাতে করে এনেছে তাতে তোমার ঠোঁট পুড়বে নিশ্চয়, কিন্তু সে পাত্রও তৈরি হয়েছে কুমোরের চোখের জলে আর মাটির মৃদু গানে। মুখোশহীন দুঃখকেই কাহলিল হাসিমুখে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর আনন্দ শব্দের দিকে, চরম শূন্যতাতেই দাঁড় করিয়েছেন তাঁর চরম ভারসাম্যের বিশ্বাস।
জিব্রানের মা কামিলার জীবন খুব একতা নিশ্চিন্তির কোনোদিনই ছিল না, জাতিতে ছিলেন কাদিসা উপত্যকায় পালিয়ে আসা মারোনাইট খ্রিষ্টান। ফাম আল মিলোয়াব পাহাড়ের নিচে বিবাহবিচ্ছিন্না মানুষটির দ্বিতীয় বিবাহও হয়েছিল মদ্যপ জুয়াড়ি খলিল বে র সাথে, যার অবশ্যম্ভাবী ফল দ্বিতীয় স্বামীকে ছেড়ে কিশোর জিব্রান তার বোন সুলতানা আর আগের পক্ষের সন্তান পিটার ও মারিয়ানাকে নিয়ে জুবেই বন্দর হতে ফিরে আসা আমেরিকার বোস্টন শহরে। বাকি জীবনটুকু কামিলার কাটে বাড়ি বাড়ি লেস বিক্রী করে আর সাহিত্যমোদী ও চিত্রকর ফ্রেড হল্যান্ডের ক্যানভাসের সামনে পোর্টেট মডেল হয়ে দাঁড়িয়েই। ১৯০২এ কামিলা মারা গেলেন দুরারোগ্য ক্যান্সারে, একই বছরে তাঁর সৎ ভাই পিটার ও বোন সুলতানাও মারা যান। আর ঘুমহীন একটা বেলুনের মতো গাঢ় সূর্যাস্তের নিচে উড়তে থাকেন কিশোর জিব্রান; কেবল এক অস্বস্তিকর শীত ও জড়তা জিব্রানের প্রাচীন কিথারাটি বাজিয়ে তুলত, রক্ত অনুসরন করে ছুটে আসত এক বরফসাদা রং; অথচ দুঃখ জিব্রানকে কখনও নিঃশব্দে ভেঙে পড়তে দেয়নি, ঠেলে দেয়নি পাপকীর্ণ কোনো টোল খাওয়া বাতাসে, কেবল এক প্রার্থনা, প্রার্থনা যেন জিব্রানের একটা স্বভাব, যেখান থেকে তিনি অভাব অনুভব করছেন সেখান থেকেই যেন বারবার সচেষ্ট হয়েছেন অভাবমোচনের। তিনি পারছেন না, সর্বশক্তিমানকে আশ্রয় করছেন, প্রাণের মধ্যে স্মরণ করছেন তাঁকে; আর এভাবেই যেন নির্জনতার অন্ধকারেও খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক প্রকাণ্ড শোভাযাত্রা। তাঁর কবিতার সাথে তাঁর ছবির হয়তো অনেকাংশেই মিল নেই, কিন্তু এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী হিসেবে তাঁর চিত্রপটেও ধরা দেয় এক স্বতন্ত্র স্রষ্টার উত্তরণ। অবয়বের মাঝেই গড়ে ওঠে এক অন্তর্লীন হারমনি। মাঝে মাঝে দেখা যায় ছবি আঁকার আগে তিনি হয়তো কল্পনা করে নিয়েছেন তাঁর কবিতারূপ তাঁর কল্পরূপ, আবার কখনও বা কবিতা সেখান থেকেই শুরু হয়েছে যেখানে তাঁর ছবি কলমের হাতে ছেড়ে দিয়েছে তাঁর আকারের জগত, অজস্র প্রবেশদ্বার। তাঁর বেশিরভাগ ছবিতেই ব্যক্তির তীব্র অভিব্যক্তির অন্তরালেও কোথাও রয়ে গেছে আলোচক জিব্রান কবি জিব্রান, রয়ে গেছে ব্যক্তিক আলো আঁধারীর বাইরে বর্গের অবচেতন। ‘পেইন’, বা ‘কামিলা‘ ছবির প্রতিমাভঙ্গীতে প্রতিফলিত হয়েছে প্রতিচ্ছায়াবাদী এক জ্যামিতি, পথ সন্ধানী এক ইর্টানাল জয়, যেন এলিজিক জীবনেও শান্তরঙের বাণী বিতর্ণ করেছেন জিব্রান। প্রুশিয়ান নীল দুঃখের মাঝেও জিব্রান শান্ত স্থির, যেন পচনের মর্মমূলেও ঘৃণা বা বিদ্বেষের গরল নয় বরং অকলুষ বিশুদ্ধ প্রেমই তাঁর আশ্রয়; মা কামিলার যে আত্মপ্রতিকৃতি তাও যেন অধিকার করেছে এক সর্বজনীন আধ্যাত্মিক উৎসবের অর্ঘ্য হয়ে। যেন তাঁরই বাবা খলিল বে-কে ক্ষমা করে দিয়েছেন কামিলা, ক্ষমা করে দিয়েছেন এই জন্মান্ধ সমাজের অস্থাবর সত্যকে, কোথাও যেন নুড়ির মতো গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে এক ডিটাচমেন্ট, গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে রিলিফ; আসলে তাঁর কাছে দুঃখও সবুজ সুগোল, সে যেন সাদা পোশাক পরে স্বর দিচ্ছে আমাদের সুস্থতায়। প্রাচীনতা সেখানে কোথাও নেই। নিঃশব্দ পাতা ঝরার মধ্যেও সেখানে রয়েছে এক বিশুদ্ধ বনানী। কোথাও কি তিনি পিছিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন? হেরে যেতে চেয়েছিলেন! আত্মসর্মপন বোঝাতেই কি ব্যবহার করেছেন সাদা রঙ? নাকি শুদ্ধতা, প্রজ্ঞার আর সারল্যেরই প্রতীক কামিলা! যার নিবেদনের ভার নিয়েছেন জিব্রান। কোথাও কিছু যুক্ত করতে চাননি জিব্রান, তাঁর ছবিও যেন এই অভিলাষের কথা বলে, বলে সভ্যতার জালিবোট ফাঁকা করে দিয়ে শাশ্বত সিডারের বনে এক গুঞ্জনহীন ঠিকানা খোঁজা। কোন্‌ ঠিকানা খুঁজতে চেয়েছেন জিব্রান! তাঁর পারিবারিক দলিলপত্রে তাঁর পুরনো মুদ্রাগুলোতে যে বিস্তর ধূলো তা সরালে আমরাও কি পেয়ে যাই চেতনার সব কটি দূর বিস্মরণ! ‘পেইন’ ছবিতে যীশুর আদলেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে এক রমণীকে আর তাকে ঘিরে আরও দুই পুরুষ। চার্চের পরিপ্রেক্ষিতে নীল রঙের যে অতিরিক্ত কিছু ব্যঞ্জনা আছে -- মনে পড়ে যায় ধীমান দাশগুপ্তের সেই উক্তি। নীল যেন এক নির্মলতার প্রতীক, আন্তরিকতার প্রতীক। ঠিক কোন্‌ প্রায়শ্চিত্ত করতে তাঁর অবয়বেরা হাত পেতেছে অবশ এক ফালিতে, হাত পেতেছে সেই পুঁজগন্ধ পেরেকে! তাদের কাঁপতে থাকা শরীরের থেকে মৃত্যু নয় বরং জিব্রান অবাধে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন সেই ঈশ্বরকে, সেই ঐশ্বরিক চেতনাকে, যার কাছে ধরা দিতে এক অশ্রুত অপূর্ব আগুনে বার বার পুড়তে চাওয়া যায়, বার বার শ্বাস নেওয়া বন্ধ করা যায় স্রেফ ঈশ্বরের সাজানো বাগানে নামার জন্য, একটিবার ছোঁওয়ার জন্য ঈশ্বরকে, তাঁর ‘সিফন সীমানা’কে। And what is it to cease breathing but to free the breath from its restless tides,that it may rise and expand and seek God unencumbered ।
জিব্রানের প্রেমপর্বেও বিচিত্র উল্কির ছোপ। বিশারি গ্রাম, পবিত্র সিডার বন একা ও অস্পষ্ট এক যৌথস্বপ্নের মতো লেগেই ছিল জিব্রানের ক্যানভাসে, যেন কোনো দিনই ছাড়তে পারেননি জলের দরে কিনে রাখা এমন স্মৃতি। তখন সদ্য সদ্য মারা গেছেন মা, মারা গেছেন সৎ ভাই ও নিজের বোনও; বিপর্যস্ততার মাঝেই নৈঃশব্দ্যতার কাছে অবনত হয়েছেন জিব্রান, ধরেছেন সংগীত নিয়ে ‘আল মুসিকা’ লেখার কাজ। ঊনিশশো তিনের মাঝামাঝি এ সময়েই বোস্টনের ওয়েলেসলি কলেজে চলছিল তাঁর ছবির একক প্রদর্শনী, যেখানে জিব্রানের প্রেমে পড়ে যান বছর দশেকের বড় এলিজাবেথ হাসকেল। তেইশ বছর ধরে একটানা চলে মারোনাইট জিব্রানের সাথে ইংরেজি সাহিত্যের দিদিমণি এলিজাবেথের অদ্ভুত সুরের খেলা, তাঁদের অকথিত চাওয়া-পাওয়া। তাঁদের অতীন্দ্রিয় অনুভূতি ভেঙে টূকরো টূকরো হয়ে জমা হয়ে থাকে তেইশ বছরের চিঠিপত্রে। এলিজাবেথই নিজের খরচে জিব্রানকে পাঠিয়েছিলেন প্যারিসে ভাস্কর অগাস্টিন রোঁদিনের কাছে পাথর ভাঙার কৌশল শিখতে, যা তাঁর ভাষায় নিয়ে আসে এক নতুন সংস্কারমুক্ততা এক নতুন প্রয়োগবোধ; তাঁর কবিতা ছবি একা না থেকে জগৎকে স্বীকার করতে শেখে, বাইরের জগৎ তাঁকে সম্ভব্যতার কথা বলে, নিজের চারপাশের দেখা পৃথিবীর থেকে জিব্রান কোথাও পাতিয়ে নেয় সেই বিশ্বজনীন আওয়াজ, সেই অ্যাবস্যুলিউট ওরিজিনাল সেই অবধারিত আনন্দ ধ্বনি। ততদিনে ‘আল মুসিকা’ লেখা শেষ করে ফেলেছেন জিব্রান, প্যারিসে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসেও শিক্ষানবিসের কাজ শেষ। প্যারিসে বসেই তিনি কুহকের মতো ছটফট করেছেন এলিজাবেথের জন্য, লিখে চলেছেন একের পর এক চিঠি। ঊনিশশো তেইশ-এ জ্যাকব নামের একজনকে বিয়ে করে এলিজাবেথ চলে যান জর্জিয়া, আর ততদিনে নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন জিব্রান। অথচ উদ্বেগ উৎকন্ঠার শেষেও তাঁকে দেখা গেল না পথচ্যুত, পাওয়া গেল না পার্থিব অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বরং অনুভূতির চরম উচ্চগ্রামে তিনি যেন মহাশূন্যের সর্বোচ্চ ঘনতায় লিখলেন তাঁর প্রকৃত খসড়া। ঊনিশশো বাইশের বারোই মার্চ হাসকেলকে লেখা চিঠি থেকেই বোঝা যায়, জীবন মৃত্যুর বাইরে তাঁর ভালোবাসার স্থিরবিন্দু ঠিক কোথায়। মেঘ যেখানে শেষ হচ্ছে ঠিক সেখানেই তাঁর হাওয়াকল কীভাবে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আবহমান হরিনাঙ্ক। That deepest thing, that recognition, that knowledge, that sense of kinship began the first time I saw you, and it is the same now - only a thousand times deeper and tenderer. I shall love you to eternity. I loved you long before we met in this flesh. I knew that when I first saw you. It was destiny. We are together like this and nothing can shake us apart.
বন্ধুতা প্রসঙ্গে জিব্রান যখন বলেন, বন্ধু তো সেইজন, যে এলে বুঝতে পারবে আলো, আলো আসছে। সে তার নিজেরই জমিতে বীজ পুঁতবে আর ফসল তুলবে অবারিত কৃতজ্ঞতায়। সে তো স্বর্গীয়, অপার্থিব, আনন্দের মধ্যেই জন্ম নেই সেই পাখালি নিস্তব্ধতা। বন্ধুতায় প্রত্যাশা রেখো না। যদি রাখো তবে তা বন্ধুতা নয়, সে শর্তহীন, বেহিসেবী, তোমার সবটুকু ভালো উৎসর্গ কর এমনই বন্ধুতার জন্য। সে যদি শূন্যতাকে ভাটা বলে তবে তাকে জানাও জোয়ার এখুনি আসবে। এখুনি আসবে আবহমান জলধারা। শ্রাবণময় শূন্যতা তাকে দেখিও না বরং তার ভেজা আঙুল ধরে বেঁচে ওঠো, বাঁচিয়ে তোলো তাকেও এমনই এক জলীয় সন্মোহনে। দুজন পরস্পরকে আলোকিত কর, যে আলো আত্মময় যে আলোয় সব রং হয়ে গেছে তোমার বাড়ি, যে আলোয় সজীবতা আসছে থেকে থেকে, জীবন আসছে থেকে থেকে। ঠিক এখান থেকেই ঠাওর হয় জিব্রানের বিশাল বাগানে তিনি আসলে একা নন, পাশাপাশি হেঁটে চলেছে যে বিবিক্ত বনভূমি, যে স্থবির গোধূলি, যেন তাদের কাছেই বুঝে নিতে চান মানুষের ভাষা, কুড়োতে চান মিলনলগ্নের গন্ধ।
আসলে জিব্রানের শেওলা জমা কন্ট্যুররেখাগুলো ভালোবাসা থেকেই এসেছে আর আবার ফিরে গেছেও ভালোবাসার আশ্রয়ে। ঊনিশশো একত্রিশে মৃত্যুর আগে তিনি যেন তাই ফিরতেও চেয়েছিলেন তাঁর নিরাসক্ত আরক্ত সময়ের দিকে, ফিরতে চেয়েছিলেন জলপাই গাছের ছায়ায় ঘেরা বিশারি গ্রামে, মার সারকিস চ্যাপেলের কাছে বারবার যেন বলতে চেয়েছেন পথ দেখতে না পেলে ভেতরে কীভাবে যাব! ‘দ্য প্রফেট’ বই-এর সেই তৃষ্ণারহিত প্রফেট, যিনি বারো বছর থাকার পর এক স্বতঃস্ফূর্ত সমর্পনের দিকে ফিরতে প্রস্তুত, যার দিকে ভেসে আসছে সেই অভ্রান্ত জাহাজ, সেই মাতৃগৃহে ফেরার অমোঘ আনন্দ, সে কি জিব্রান স্বয়ং নন? প্রফেটের আদলে জিব্রানই তো সম্পূর্ণ আলো না হওয়া অবধি অস্থির হয়ে আছে। পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়লেও ভ্রমণ যে আবহমান, পথের রেখা দিয়েই তৈরি যে আমাদের পার্থিব -- শূন্য থেকে কোনো কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না। আসলে সৃষ্টি বলে হয়তো কিছুই নেই; যা আছে তা প্রকাশ মাত্র। এই উদ্দেশ্যহীন তরঙ্গময়ী জীবনলীলার শেষে পাকা ফলের মতো কেবল কিছু ছড়িয়ে যাওয়া, সে কিছুই বলতে চাইছে না কেবল পৌঁছতে চাইছে হাওয়া শব্দটার কাছে, যে খুলে দেবে তার বেড়া, তাকে ছড়িয়ে দেবে এই বিশ্বশব্দের মাঝে। জিব্রানও তো তাই চেয়েছিলেন, বারবার দূরে সরে যাওয়া অথবা বারবার ফেরা। আসলে এক আশ্চর্য মরুময়তা বা শূন্যতার পেছনেই ছিল তাঁর ফসলের ক্ষেত। সেখানে তাঁর শব্দ ছোট অবস্থান, ছোট কিন্তু অনুরণন! সে তো দানা হয়ে কুরে কুরে খাচ্ছে দীর্ঘ দীর্ঘতম পরিসর। তিনি নিজেকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন অথবা দাঁড় বাইতে চেয়েছেন একটা পৌঁছনো অবধি, অথবা একটা সর্বতো ফেরা অবধি। এক সম্পূর্ণ মানুষের কাছেই এক সম্পূর্ণ ‘আত্মজৈবনিক অধ্যাত্মবিভার’এর কাছেই রেখে দিতে চেয়েছেন তাঁর কবিতার শিরোনাম, তাঁর যাবতীয় রূপকল্প যা কেবল শব্দ নয় কেবল শোনার জন্য যার আয়োজন নয়, যার জোয়ারে বেঁধে থাকার জন্য নয় যার ভাটাতে ভেসে থাকার জন্য নয়, বরং বারবার বিশ্বনিয়মের সাবেকি আবহাওয়ায় এক সক্ষম প্রস্তুতি এক অরক্ত সময়ই খুঁজেছেন জিব্রান; সাপ্তাহিক স্বত্ত্বার ভেতর কোথাও তিনি সেই স্পিরিচ্যুয়াল টিচার যিনি আদতে সৃষ্টির অতীত আর সৃষ্টির অভিব্যক্ত -- এই এক ও বহুকেই নাড়াচাড়া করেছেন জগতের জাগ্রত জগতের অতীত হিসেবে। এই তাঁর বাকশস্য, এই এক প্রফেটের ডিস্ট্যান্স মেলোড্‌ এই সেই পর্যটনবিষয়ক রচনা যা রেখে গেলেন জিব্রান, রেখে গেলেন এক শেকড়প্রক্রিয়া যা শরিকহীন যা প্রতিনিয়ত পাঁচ পৃষ্ঠা জীবনের কাছে গোল্লা পাকানো মানুষগুলোর কাছে জানতে চায় --“Stranger, Stranger, lover of unreachable heights, why dwell you among the summits where eagles build their nests?why seek you the unattainable?what storms could you trap in your net, and what vaporous birds do you hunt in the sky?
COME and BE OnE OF US….
COME and BE OnE OF US….

এক কণা বালির মতো আমরাও কি বুদবুদকে বলি আরও একটু এগোই, চলো আরও একটু!


০৪ অর্ক চট্টোপাধ্যায়

কবীর সুমন, সাংস্কৃতিক স্মৃতি এবং নামের কমিউন
অর্ক চট্টোপাধ্যায়

কবীর সুমন নিজের ওয়েবসাইটে ২০১২র দোসরা ডিসেম্বর একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন যার নাম 'An Important Statement'। প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক পুরস্কার বিতর্ক যা বহুদিনের বন্ধু অঞ্জন দত্তর সাথে এক অস্বস্তির জায়গা তৈরি করেছিল। অঞ্জনের 'রঞ্জনা' ছবির জন্য নীল দত্ত জাতীয় পুরস্কার পেলেও সেখানে সুমনের গাওয়া 'গানওলা' বা তাঁর বেছে দেওয়া “জাগরণে যায় বিভাবরি”র কোনো ঋণস্বীকার হয়নি বলে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। জাতীয় পুরস্কারে ওভাবে নাম পাঠানো যায় না বলে জানানো হয়েছিল অঞ্জনের তরফে। এই সিকুয়েন্সের মহামুহূর্ত হলো সুমনের বহুদিনের বন্ধু জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের থেকে তাঁর জানতে পারা যে, International Bengali Film Critics' Award-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। জগন্নাথবাবু বিচারকদের একজন হওয়ায় সুমন জানতে পেরেছিলেন, এই প্রতিযোগিতায় নাম পাঠানোর বন্দোবস্ত ছিল। সুমনের কন্ঠে তাঁর নিজের কম্পোজিসন রয়েছে ছবিটিতে। সেক্ষেত্রে সংগীত পরিচালনার জন্য নাম পাঠানো হলে নীল দত্তর পাশে সুমনের নামটাও পাঠানো সংগত বলেই মনে হয়। সুমনের দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তবে কি এতদিনের আপোষহীন প্রতিরোধের পর কবীর সুমন পুরস্কারাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠলেন? এই বিভ্রান্তি দূর করতেই তাঁর বিবৃতি, যেখানে তিনি স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন, পুরস্কার পেতে আর পাঁচটা লোকের মতো তাঁরও ভালোই লাগে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন পুরস্কারের নয়, প্রশ্ন নমিনেশনের। তিনি লিখেছেন: “Nomination as a gesture, as a metaphor”. যদিও নিজেই এই ইংরেজি বাক্যটিকে কটাক্ষ করেছেন আবার: “এই এতক্ষণে আমি আঁতেল ভাষায় ব্যপারটা বলতে পারলাম”।

আমরা এই আঁতেল ভাষাকে ঘিরেই কিছু কথা বলব। “অনেককালের বন্ধুর এক টুকরো নমিনেশন” নিয়ে কথা বলব। ‘নমিনেশন’ শব্দের অর্থ মোদ্দায় নির্বাচন। বাংলায় যাকে বলে মনোনয়ন। সন্ধি-সমাস-প্রত্যয়ের ভাষায় দেখলে, মনের ভিতর কোনো কিছুকে নিয়ে আসার নাম মনোনয়ন। কী নিয়ে আসা হবে মনের ভিতর? ‘নমিনেশন’ শব্দেই তার উত্তর রয়েছে। নাম; কোনো এক প্রিয়জনের নাম মনের ভিতর, মুখের ভিতর আর মুখের ভিতর থেকে মুখের বাইরে নিয়ে আসাই আসল মনোনয়ন বা ‘নমিনেশন’! সুমন কি আমাদের প্রজন্মকে, আত্মবিস্মৃতি ভালবাসে এমন বাঙালি জাতিকে এই ঋণী এবং কৃতজ্ঞ মনোনয়নের পাঠ দেননি তাঁর গান ও পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে? সুমনের এই দাবি আসলে যতটা না যুক্তির, তার থেকে অনেক বেশি আবেগের, বন্ধুতার! তিনি বরাবরের মতো এখানেও আমাদের থেকে সেই উপহারটাই চেয়েছেন; যে উপহারের মূল্য বহুদিন ধরে তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন বা অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করেছেন!



প্রতিটি দেশ, ভাষা আর সংস্কৃতির একটা স্মৃতি থাকে। তা কখনো বইয়ে ধরা থাকে, কখনো আবার মুখের মধ্যে, মনের মধ্যে। আর্কাইভ শুধু বইয়ের পাতা নয়, চলন্ত জীবন্ত মানুষও এক একটা আর্কাইভ, যেখানে বিস্মৃতপ্রায় অথচ স্মরণীয় এক এক প্রিয়জনের নাম ধরা থাকে। আমরা চলতে ফিরতে যখন তাঁদের নাম করি, তখন সেই মনোনয়ন আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে। যেমন আমার মাস্টারমশাই শ্রীঅম্লান দাশগুপ্ত তাঁর মাস্টারমশাই শ্রীঅরুণকুমার দাশগুপ্তর নাম করেন বা আমার আরেক মাস্টারমশাই শ্রীশান্ত্বনু বিশ্বাস প্রফেসর গিলের নাম করেন। সুমনও এভাবেই আমাদের ‘রাই জাগ’তে শেখান তাঁর গানে। ধারণ করার চেষ্টা করেন বাংলার সাংগীতিক সংস্কৃতির ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতিকে তাঁর মিউজিক্যাল প্র্যাকটিস দিয়ে। ‘খোদার কসম জান’ গানে হঠাৎ ঢুকে পড়েন শ্যামল মিত্র আর তাঁর গান ‘তরীখানি ভাসিয়ে দিলাম’; ‘নাগরিক কবিয়াল’ আঁকড়ে ধরে লালনকে; ‘জাগে জাগে রাত’ মনে করে আমীর খানের ললিতকে; পান্নালাল ঘোষের ‘নূপুরধ্বনি’ রাগে খেয়াল বাঁধেন; হিমাংশু দত্তর ভুলে যাওয়া গান ফিরিয়ে দেন; সুধীরলাল চক্রবর্তীর গান গেয়ে ওঠেন অনুষ্ঠানে— এই বাক্য অসমাপ্য। কলামন্দিরে তাঁর ২০১২র জন্মদিনের অনুষ্ঠানে স্টেজের তিনটে ভাগের দ্বিতীয়টায় অর্থাৎ মধ্যিখানে দুটো চেয়ার রাখা ছিল বন্ধুদের জন্য। এক বাল্যবন্ধুকে ডেকে এনে বসিয়ে গান শুনিয়েছিলেন তিনি; আবারও চেয়েছিলেন তাঁর বন্ধুতা।

সুমনের গান এমনি সব বন্ধুদের গান। শহিদ কাদরির জন্য ‘তোমাকে অভিবাদন’, ‘UAPA-র শহীদ স্বপন দাশগুপ্ত’ কিম্বা বন্ধু আয়ান রশিদের জন্য এসব গান। এসব গান সুফিয়া কামালের জন্য, ফুলমণি, কাঞ্চন, সঞ্জীব পুরোহিত এবং আরও অসংখ্য সময়ের গিলোটিনে আটক নামের জন্য। সুমন ক্রমশ সঙ্গীত ছাড়িয়ে আমাদের গোটা সময়ের স্মৃতিটাকে ধরে রাখতে চান। সেলিব্রেট করেন এইসব নামকে। এক-একটা নাম এক-একটা প্রতিরোধ; কখনো তা সাংগীতিক, কখনো প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক। সুমন একটি গানে লিখেছিলেন, “কার নাম ঝরে যায় একা বিলকুল”। সুমনের গানের প্র্যাকটিস এইসব নামকে ঝরে যেতে না দেবার প্র্যাকটিস; এভাবেই তো ইতিহাস তার তাবড় স্মৃতি নিয়ে রক্ষা করে কত কত বিশেষ নামবাচক শব্দকে; ব্যতিক্রমের নামে, প্রতিরোধের নামে, আবার ভালবাসারও নামে; বন্ধুতারও নামে। আমাদের সমসময়ে কবীর সুমন এমন এক নমিনেশনের নাম, যিনি নিজেই নৈতিক বিশ্বস্ততার এক মনোনয়ন। এই মনোনয়নের মধ্য দিয়ে নিজের গানে একরকমের কমিউন গড়েন কবীর। নিজের নামও পাল্টাতে থাকেন। তাঁর নামের কমিউন বদল ধরে রাখে, ধরে রাখে “পাল্টে দেবার স্বপ্ন”টাকে। ফরাসী দার্শনিক আলেন বাদিউ তাঁর The Communist Hypothesis গ্রন্থে কমিউনিজমের ধারণা দিয়ে এভাবেই ব্যক্তি-নামকে রক্ষা করার কথা বলেছেন---“[...] the communist idea […] refers directly to the infinity of the people—needs the finitude of proper names”। ইতিহাসের প্রক্ষেপণে যে সব নামেরা একা একা ঘুরে বেড়ায় ইতি উতি, তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করে একটা বয়ান তৈরি করে সুমনের গান। সেখানে সাহিত্য-সঙ্গীতের মহান নামগুলির পাশে অমোঘ এক সমতা নিয়ে বসবাস করে সাধারণ সব ব্যক্তি-নাম। একই সূত্রে গ্রথিত হন অনিতা দেওয়ান আর অখিলবন্ধু ঘোষ। তাঁরা বন্ধু হয়ে ওঠেন ক্রমশ!



২০১২র ২৫শে নভেম্বর আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে ‘সুমনামি’ বিভাগে কবীর সুমন ট্রাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো নিয়ে লিখেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ট্রাফিক সিগনাল সঙ্গীত শোনার আদর্শ পরিবেশ হতে পারে কিনা তা নিয়ে। এখানেও কি অন্য আর একরকম মনোনয়ন নেই! ট্রাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানোও তো এক ধরনের নমিনেশন! বেশ তো লোকে বাসে যেতে যেতে এক টুকরো হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়ে যাচ্ছে! তাঁদের নাম মনে রাখছে! এও তো সাংস্কৃতিক স্মৃতি! প্রশ্ন হলো, ঐ কণ্ঠ আসলে কার? হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের? সুচিত্রা মিত্রর? নাকি ঐ সকল কণ্ঠই এক এবং অদ্বিতীয় এক রাজার, যিনি কয়েকটি অসামান্য নাম ও তাঁদের কণ্ঠকে বাজেয়াপ্ত করেছেন? তাঁর মহামহিমায় আমরা “ব্যঙ্গ করে ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গ করে ব্যঙ্গমী”! আমাদের চারপাশে এই দুই ধরনের মনোনয়নের খেলাধুলা চলছে। কেউ নাম দিয়ে জলের আলপনা করে সংস্কৃতির ধ্বজা ধরছেন; কেউ আবার কয়েকটা নাম দিয়ে আমাদের ‘অন্ধ সাজার অনুরাগ’কে মেপে নিচ্ছেন। আর আমরা ‘গ্যালারিতে বসে গালিলিও’!

০৫ পূর্ণেন্দু মিত্র

স্বাধীনতা দিবস
পূর্ণেন্দু মিত্র


স্বাধীনতার বয়স যখন সবে দশ, আমার তখন ছয়। নেহরুজী দেশের প্রধানমন্ত্রী। দশ নম্বর স্বাধীনতা দিবস মর্যাদার সাথে পালন করতে দেশজুড়ে সাজো সাজো রব তুলেছেন তিনি। তার আঁচ লেগেছে আমাদের পাঁচমিশালী রেলশহরেও। অন্যান্যদের মতো রেল কলোনীর বাংলা মিডিয়াম স্কুলে চলছে উৎসবের মহড়া। প্রভাত ফেরীর তোড়জোড়। ভোরের আলোয় ট্রাকবাহিত দিদিরা গাইবেন – ‘ধন ধান্যে পুষ্পেভরা…’ থেকে ‘ও আমার দেশের মাটি…’, সব দেশাত্মবোধক গান। আর দাদারা ট্রাকের সামনে ড্রাম বিউগল বাজিয়ে, ‘চল চল চল ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল…’এর তালে তালে মার্চ্চ। আমরা কিছু কুচোকাঁচা ট্রাকের উপর শূন্যস্থান পূরণ। কলোনী ঘুরে স্কুলে পৌঁছে প্রভাত ফেরী শেষ হবে, তারপর বড়দিদিমণির বক্তৃতা, পরিশেষে সাদা পায়রা উড়ানো এবং বালক-বালিকাদের পাউডার গোলা দুধ, লজেন্স, কলা, সেও-বঁদিয়া বন্টন। ছুটি।

তখন ইংরেজ কাগজে কলমে চলে গেলেও ফেলে গেছে ভগ্নাংশ। ডড, রড্রিগস, কুক, স্যামপায়োরা আমাদের পাশের পাড়ায় থাকে। তাদের কচিকাঁচা টাইগার, ফ্রেড, ডরোথি, লিলিরা বিভেদের বেড়া ডিঙিয়ে সাহেবপাড়া থেকে নেটিভ পাড়ায় খেলতে আসে। তাদের মধ্যে সেরা লোকো ড্রাইভার ডডের কন্যা ডরোথি। অনর্গল কথার খই ফুটছে, ছটফটে জীবন্ত। এক এক দিন বেবী সাইকেল চালিয়ে বোঁ করে আমাদের চমকে দিয়ে, ঘুরপাক খেয়ে, সোঁ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্যদিন লাল রঙের গোটা তিনেক বড় বড় রিং এক এক করে মাথা গলিয়ে অসীম দক্ষতায় কোমরে ঘোরাতে থাকে বন বন বন বন। সে মেরীর ঘর বানাতে শেখায়, বড়দের দেখাদেখি গানের তালে তালে রক এন্ড রোলের স্টেপিং শেখায়। এহেন ডরোথিকে ওর মা একবার, য়ুরোপিয়ান ইনিস্টিটিউটে ম্যাটিনি শো’তে ‘উড়ান খাটোলা’ চলচ্চিত্র দেখতে যাবেন বল্‌ আমার মা’এর জিম্মায় রেখে গিয়েছিলেন। সেই দুপুরে নাচে গানে বহুমুখি প্রতিভায় আমার মা’কে সে এমন মোহিত করে যে, ভবিষ্যৎ-এ আমাদের দু’ভাই-এর একজনকে মা ডরোথি নিমিত্ত সমর্পিত করে রাখেন। অথচ স্বাধীনতা উৎসবে ডরোথির পাড়া একেবারে নিঝুম।

আর ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী প্রেম সিং হোড়া। রেলকোম্পানীর টিকিট চেকার, প্রাক্তন লাহোরী, শিখ সর্দার। স্বাধীনতার নামে তাঁর মাথায় আগুন জ্বলত। এমনিতে গোটা বছর সর্দারজী সাত চড়ে রা কাড়তেন না। লাইন ফেরতা সাদা প্যান্ট, কালো কোট পরা বেঁটেখাটো স্থূলকায় সিংজীকে, টিফিন ক্যারিয়র দুলিয়ে, স্টেশন থেকে মন্থর পায়ে ঘরে ফিরতে দেখা যেত। ঘরে ফিরেই হাঁক দিতেন – অয় জিড্ডু কি মা... সুখী ওয়ে… ইত্থে আ…! সর্দারের ডাক শুনেই সর্দরিনী সুখবিন্দার কাউর উর্ফ সুখী আন্টি শশব্যস্ত হয়ে একটি থালা হাতে নিয়ে সর্দারের সামনে দাঁড়াতেন। সর্দার প্রথমে ডান প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাতেন, তারপর বাঁ পকেটে, কোটের ডান তারপর বাঁ, কোটের বুক পকেট ডান-বাঁ, একে একে সব পকেট থেকে মুঠো মুঠো এক আনি, দু আনি, সিকি, আধুলির খুচরো বের করে থালার ওপর ঢেলে জড়ো করতেন। তারপর দিন দুই ছুটি। দেওয়ালে টাঙানো গুরু গোবিন্দ সিং-এর বিশাল ছবিতে দু’ফুট লম্বা কৃপাণ ছুঁইয়ে, চামর দুলিয়ে গুরুগ্রন্থ পাঠ। বাকি সময় উঠোনে খাটিয়া ফেলে চিৎপাত। ক্বচিৎ কদাচিৎ নীল ডোরাকাটা আন্ডারপ্যান্ট এবং স্যান্ডো গেঞ্জী পরিহিত সিংজীকে খোলাচুলে বাগান পরিচর্যারত দেখা যেত। সন্ধ্যাবেলায় সোডা এবং জনি ওয়াকারের বোতল নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়তেন সিংজী। ঢুকু ঢুকু পর্ব শেষ হতো মাঝরাতে নিস্তব্ধতা চেরা হাহাকার মেশা কান্নায়। সুখী আন্টি আমার মা’কে বলতেন, পার্টিসনের দাঙ্গায় বাপ-মা-ভাই-বোন খুইয়ে নাকি সর্দারের এই অধগতি। আমার মা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন, আহা রে! ঠাকুর! ঠাকুর!



“ফাঁসীর মঞ্চে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান” তাঁদের প্রতি আমার মা’এর ছিল অচলা ভক্তি। মাস্টারদা সূর্য সেন, শহীদ ভগৎ সিং, বীর ক্ষুদিরামের আত্মবলিদানের কাহিনী আমাদের দু’ভাইকে পাখিপড়া করে মুখস্ত করিয়েছিলেন। নয় নম্বর স্বাধীনতা দিবসে মা কোয়ার্টারের সামনের বাগানে একটা বাঁশ পুতে তাতে তিরঙ্গা ঝান্ডা টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। নিচে টেবিলের ওপর নেতাজীর গলায় মালা আর থালায় রাখা গুজিয়াবাতাসার স্তুপ। প্রেম সিং পুত্র জিড্ডু সমেত পাড়ার সব ক্ষুদেরা জড়ো হয়েছিল সমবেত কন্ঠে ‘জন গন’ গাইবে বলে, আর গুজিয়াবাতাসার লোভে লোভে । নীলুর পিসি ছিলেন মা’এর অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাঁর বর অনিল পিসেমশাই, যাঁকে আমি দেখিনি, ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। এক কালে জেল খেটেছেন, বোমা ছুঁড়েছেন। দেশভাগের পরে পরে স্ত্রীকে নিয়ে বেনাপোলের বর্ডার পার হতে গিয়ে, রাতের অন্ধকারে লুটপাট হানাহানির মাঝে তিনি যে কোথায় হারিয়ে গেলেন, কেউ জানে না। আজও তাঁর খবর নেই। সেই থেকে নীলুর পিসি ভাইয়ের পরিবারে অন্নভুক্ত। আজ স্বামীগরিমায় তিনি প্রধান অতিথি।

নবীন জাতীয় পতাকা পত পত করে উড়ছে, অনুষ্ঠান শুরু হব হব, এমন সময় ‘যো বোলে সো নিহাল’ হুঙ্কার দিয়ে মাথার ওপর বন বন করে কৃপাণ ঘোরাতে ঘোরাতে টলোমলো পায়ে আকন্ঠ জনি ওয়াকারে নিমজ্জিত প্রেম সিং হোড়া ঝাঁপ দিলেন। শিশুরা আতঙ্কে চীৎকার করে উঠল, হুটোপাটি শুরু। মা’এরা প্রাণপণে সামলাচ্ছেন সন্তানদের। ‘বাহে গুরু দা খালসা বাহে গুরু দা ফতে’ রব তুলে গোটাকয় বেলি-রজনীগন্ধা-গোলাপ গাছের মাথা কেটে তিরঙ্গাবেদীর তলায়, নেতাজীর পাদদেশে কৃপাণ হস্তে সর্দার ধরাশায়ী হলেন। নিশ্চুপ। নিমেষে ঘটে গেল ঘটনাটা। ধাতস্থ হতে দেখি, সর্দারিনী সুখবিন্দার কৌর উর্ফ সুখী আন্টি বিলাপ করতে করতে সর্দারের জ্ঞানশূন্য দেহ পরম যত্নে তুলে ধরার চেস্টা করছেন – ‘বস কর সর্দ্দার তুসি বস কর! যো ইনসান মরযাওন্দা ওহো কদি ওয়াপিস নহি আউন্দা… ভুল যা… তুসি বস কর…!’

আমরা স্থানুবৎ।

দশ নম্বর স্বাধীনতা দিবস। ১৫ আগষ্ট ১৯৫৭-র প্রাতঃকালে গানের সুরে, ব্যান্ডের তালে তালে, ভোরের আলোয়, ট্রাক আমাদের পাড়ায় এসে থামলো। টুল নামিয়ে দিতে তাতে পা রেখে চড়ে বসতেই কোলে করে ডালার ওপরে। আমার পিছনেই মুর্শিদাবাদ নিবাসী রেল সিগনালার হাকিম সাহেবের দুই ছেলে আরিফ আর শরিফ। শরিফের আবার সর্বক্ষেত্রে বীররসের প্রাবল্য। সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে এক হাত মুঠো করে আকাশের দিকে তুলে অন্য হাত মুখের কাছে নিয়ে সদ্য দেখা ‘টার্জান দ্য এপম্যানের’ কায়দায় খুশির প্রকাশ ‘ও…ও... ও... ও’! তাই শুনে পিছন থেকে নীলুর প্রতিক্রিয়া, ‘পাকিস্তানি পাকিস্তানি’! চরম অপমানে শরিফ – ‘কী বললি?’ বলেই নীলুর উপর ঝাঁপ। জড়াজড়ি হুটোপাটি। অতর্কিতে ‘ও আমার দেশের মাটি’ বিপন্ন। দিদিরা দুজনকে তুলে ট্রাকের দু’কোণায় বসিয়ে দিলেন। ‘দেশের মাটি’ জোড়া লেগে গেল। শান্তি।





বুদবুদের মতো ঘটনাটি মিলিয়ে গেলেও, শিশুমহলে বিকেল বেলার খেলার মাঠে তা ছিল হেডলাইন। নীলুর মুখে বৃত্তান্ত শুনে প্রেমপুত্র জিড্ডু উর্ফ গুরদয়ালের দেশপ্রেম টগবগিয়ে উঠল। শরিফের প্রসিনিয়মে প্রবেশ হতে না হতেই জিড্ডু ‘পাকিস্তানি’-র চুল খামচে ধরে ঝুলে পড়ল। ভাইয়ের দুর্দশা দেখে আরিফ জিড্ডুর কোমর ধরে প্রবল টানাটানি শুরু করলো। নীলু ওদিকে শরিফের ঠ্যাং ধরে টানছে। প্রবল আলোড়ন। অশ্বক্ষুরের দাপটে রণক্ষেত্রে ধূলো উড়ছে। আমরা ক’জন কিংকর্তব্যবিমূঢ় দর্শক। পানিপথের যুদ্ধে কী হয় কী হয় অবস্থা! হঠাৎই একটা সাদা পায়রা শান্তির ধড়াচূড়ো ছেড়ে তড়িৎ গতিতে জিড্ডুর পেটে ঢুঁ, তারপর দু’হাতের ধাক্কায় শরিফকে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিয়ে মাঝখানে বীরাঙ্গনার মতো দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। ‘--- ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- মাই ফুট--- ইউ বাডি কাওয়ার্ড --- থুঃ--- তুমলোগ জানতা ম্যান--- হমলোগ সব অস্ট্রেলিয়া চলা যায়গা--- ড্যাডি টোল্ড মি--- স্টে উইথ ইয়োর বেগার ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- থুঃ---

হায়রে---

‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়...’


০৬ স্বপন রায়


রেলা – ২
স্বপন রায়



মাঝরাতের  চক্রধরপুর১২ জানুয়ারি ১৯৭১, আমি আমার ঠোঁটে চা নেওয়ার  মুহূর্তে, সেই আমানবিক শীতের কম্প্রমান আদেখলাপনায় খন আমি অবশ আর প্রায়   নৈরাজ্যবাদী, যেন চা ছাড়া আর  অন্য কিছু এই পনেরো বছরের তুচ্ছ জীবনের কাছে গ্রাহ্য নয়, এরকম একটি অসংবৈধানিক চাঞ্চল্যে খন আমি মৃতপ্রায়, তখন সেই মৃত্যুধার মুহূর্তেই অভি সামনের লোকটিকে হাত দিয়ে ডেকে উঠলো। অভির ঠোঁটে  সিগারেট, সে তখন তুমুলভাবে অগ্নিপ্রবণ এবং থরথর। লোকটি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে   তাকালো, অরূপের বাবা!
তার আগে অভি বলে দিয়েছে, দাদা আগুনটা দেবেন?
লোকটি এখন বাবা, অরূপের বাবা!
-অভি না?
অভি সিগারেট মুখে নিয়ে কিছু একটা বললো।
অরূপের বাবার চোখে তখন এক ঠাণ্ডা বিচারকের চাউনি... গলার সুর একটু তুলে আবার বললেন, অভি তো?


শীতের এই মজা! অভি’র জ্যাকেট, অভির টুপি/মাফলার, আর শীতের ভারি কুয়াশা  একটা বোদলেরীয় রোমান্টিসিজিমে নিয়ে যাচ্ছিলো আমাদের, ভয়ানক কিন্তু আবছা, সংহারক কিন্তু দ্বিধাপ্রবণ, তো এই শীতের সুযোগ নিয়ে অভি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমায় ডাক দেয়, আরে হো লাখন, মাচিস হ্যায় নু? আমি বুঝে যাই। এরে কয় ডিসিভ করা, থ্রু ভাষা!
অরূপের বাবা একটু অবাক যেন, বলেন, পাকামি হচ্ছে, আমি কিন্তু ধরে ফেলেছি...  
অভি মুখের বাঁক ঘুরিয়ে আবার বলে, লাখন হ্যায় নু মাচিস... আগে চলকে দেখ  নু...
আমি ঘাবড়ে যাই, যে হারে অভি নু নু করে চলেছে... একটা ইয়ে না হয়ে যায়...
অরূপের বাবা এবার এগোচ্ছেন, শুনতে পেলাম তাঁর রাগী আওয়াজও, এই এতো নুনু নুনু করছিস কেন? তোর বিহারী সাজা বের করছি হারামজাদা...  
এরপর আর কী? পুরো ন্যুভেল ভাগ সিনেমা... ভাগ ভাগ...
    আমরা দৌড় দিই... অরূপের বাবা পিছিয়ে পড়েন... আমাদের কামরা পিছনের  দিকে... এসে উঠি। আমাদের পনেরো বছরের কৈশোর তখন ঘর্মাক্তঅভি  হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, মাঙ্কি ক্যাপ আছে না? পরে নে... আমি ইশারা বুঝে  মাঙ্কি ক্যাপ পরে নিই। অরূপের বাবা আমায় সে ভাবে দেখেননি, আমি চাই  না দেখুক! আমরা দুজনেই অতএব মাঙ্কি ক্যাপড। আমাদের জুলজুল করে তাকানো, আমাদের নার্ভাসনেস, এ সবই আর একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে দিয়েছে তখন। আমাদের সামনে এমন একজন ছিল কাল রাতে, যাকে দেখে  ‘হুস্ন কি রানী / বাহারোঁ কি মালিকা...’ ইত্যাদি ভুল সুরে চাপা গলায় গাইতে শুরু করে দিয়েছিল অভি। মেয়েটি কি হেসেছিল, আড়চোখে কি ছিল আড়ঝারির আস্কারা? আমার সেরকম মনে হয়নি, অভি কিন্তু বারবারই  বলছিলো, হাসছে রে! আমি, বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, তোকে দেখে, না তোর গান শুনে? মেয়েটির বাবা, মা তাদের মেয়েকে ডাকছিলো খুকুমণি, খুকুমণি... বারেবারেই... অভি আমার দিকে ঝুঁকে একসময় বলেই ফেললো, খুকুমণি!হেব্বি নাম, না?
        
    সেই খুকুমণি শুনলাম ওর মাকে বলছে, মা আমি বলেছিলাম না, এই দুটো চোর!... আমি আর অভি বাঁদুরে টুপির কেয়ারে বাক হারিয়ে অবাক হারিয়ে ভ্যাবা! বলে কী? অফ অল থিংস, চোর! কাল রাত থেকে চোর ভাবছে আমাদের... অভি কীভাবে যেন হাসলো। ‘হুস্ন কি রানী’ এখন মাকে জাগিয়ে, বাবাকে জাগিয়ে, সপরিবারে আমাদের তাকিয়ে। আমাদের ঘাম, আমাদের  দৌড়জনিত হাঁপ, আমাদের অচানক মাঙ্কি ক্যাপ পরে নেওয়া,  আমাদের যে চোরের ব্যক্তিত্বে নিয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি। আমি প্রতিবাদ করতে যাব, ঐ আলো না থাকা কামরায় আমার অপমানিত মুখে প্রায় একটা চরম প্রতিবাদ  এসে যাচ্ছিল যখন, দেখলাম আধা অন্ধকারে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে অরূপের বাবা। আমি থেমে যাই। অভি হঠাৎ মুখটাকে প্যরালিটিক করে তুললো। খুকুমণি বললো, দেখো বাবা মুখটাকে অন্যরকম করে লুকোতে চাইছে! আমাদের সামনে চোরদেখা পরিবারের প্রত্যেকের মুখে প্রবল সন্দেহ। একটু দূরে করিডোরে দাঁড়ানো অরূপের বাবা আর আমরা
    দু’জনে এক রাতজাগা ট্রেনের দুলুনিতে সব খোঁজা, সব অপমানের বদলা নিতে শুরু করি ঘুমোবার ভান করে!
        
    আর ঘুমিয়েই পড়ি একসময়ঐ ঘুম ছিলো এতটাই লম্বা যে, ঘুম ভাঙার পরে  আমরা বুঝতে পারি, যে স্টেশনে ট্রেন এসে থেমে  আছে, তার নাম সম্বলপুর। আমাদের স্টেশন রাউরকেলা প্রায় পাঁচ ঘন্টা আগে পেরিয়ে গেছে। আর নেমে গেছেন অরূপের বাবা, হুস্ন কি রানীর পরিবারও!
        
    আমরা টি.টি’র হাতে ধরা পড়ার ভয় নিয়ে নেমে আসি সম্বলপুর স্টেশনের  প্ল্যাটফর্মে... সকাল জাপ্টে ধরে আমাদের।            

<<< চারানা আটানা >>>


০১ অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা
অমিতাভ প্রামাণিক


(৪) পুজো


অক্টোবরের মাঝামাঝি এই সংখ্যার চারানা আটানার বিষয়বস্তু আর কী হতে পারে, পুজো ছাড়া? কেসটা হচ্ছে, এটা যখন লেখা হচ্ছে, তখনও পুজো শুরু হয়নি। আর আপনারা যখন পড়ছেন, তখন পুজো খতম। মাঝখানে কী যে হলো, মা-ই জানেন!

পুজো আসছে মানেই পুজো সংখ্যা এসে গেছে। আগে মাত্র কয়েকটা পত্রিকারই পুজো সংখ্যা বের করার সামর্থ ছিল। এখন রাম-শ্যাম-যদু-মধু সবাই পুজো সংখ্যা বের করছে। যে কাগজ না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়, যে কাগজ ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পায় না, যে কাগজ পড়ুন ও পড়ান বলে দেওয়ালে দেওয়ালে চেটানো থাকে (আচ্ছা, ঐ কাগজটা দু’পিঠে কেন ছাপানো হয়, এক সাইড ব্ল্যাঙ্ক রাখলেই তো পারে, যদি দেওয়ালে আঠা দিয়ে সাঁটানোই তার মুখ্য ব্যবহার হয়) – সবার পুজো সংখ্যা রমরমিয়ে বেরোয়। সেখানে সার্ত্র, দস্তয়ভস্কি, গুয়েভারা – এই সব গালভরা নামের ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গূঢ় আলোচনা হয়। কেননা, তাঁরা যা যা বলে গেছেন, সেসব না মানলে বাংলা ভাষা জাতে উঠবে না। দাদু সেই কবে দেহ রেখেছেন, এখন সেই ঘি থেকে নাকি আর সুবাস বেরোয় না। তবে যাবার আগে ভাগ্যিস লিখে গেছেন – ‘তোমার শঙ্খ ধূলায় পড়ে, কেমন করে সইব’ অথবা ‘প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি’। তাই দাদুকে ছেড়ে শঙ্খ ঘোষ আর বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে আলোচনা হলে সেটা কিঞ্চিৎ মডার্ণ বলে গণ্য করা হয়। আর তার সাথে, ইয়েস, কার পেছনে কাঠি করতে হবে, এই নিয়ে প্রবল আঁতলামোও। জাত বাঙালির ধর্ম এটাই। তাই দেখা যায়--

পাতায় পাতায় চর্চা হচ্ছে শঙ্খ ঘোষ আর বুদ্ধ বসুর।
দুদিন পরেই মা আসবে, তার সঙ্গে আসবে ক্রুদ্ধ অসুর।
কবিতা রয়েছে, শিল্পকলাও, কত গুণ আছে এ মৃত্তিকার।
তবুও বাতাসে হানাহানি, বলো রক্ত ঝরাতে প্রবৃত্তি কার?

তবে কিনা, শরৎ তো এসে গেছে বহুদিন। শরৎচন্দ্র পণ্ডিত আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এসে চলে গেছেন কম দিন হলো না। এঁরা অবশ্য শরৎ নিয়ে তত আদিখ্যেতা দেখাননি, যতটা দেখিয়েছিলেন দ্য গ্রেট দাদু। শরৎকে নিয়ে কত নির্ভেজাল গান! বোটে বসে বসে প্রকৃতি দেখতেন আর গান বেরিয়ে আসত। উনি কি আর জানতেন, তখনকার শিলাইদহে পুজোর সময় সোনালি রোদ, পেঁজা তুলোর মেঘের বদলে আজকের শিয়ালদহে আকাশ ছেয়ে থাকবে বাদলায়? আর জনগণ হাঁসফাস করবে গরমে, মরে যাবে মরমে, তাদের দশা চরমে উঠে হবে এই রকম –

‎'অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ-মধুর হাওয়া...'
কচি পাঁঠা হয়ে ঝুলে আছি তারে
কেটে রেঁধে সারো খাওয়া!

আমাদের দশা কি এর চেয়ে খুব আলাদা? দাদু রোমান্টিক হয়ে শারদ সকালের গান লিখে গেছেন, আর আমরা সকালে উঠে কী ভাবি?

"শারদপ্রাতে আমার রাত পোহালো ..."
খিদে পেয়ে গেছে, ব্রেকফাস্ট দে, নিয়ে আয় পোহা, লো।
বাড়ি ঘর দোর নোংরা, যেন ঘর না, গোয়াল ও!

এ রকম চ্যাটাং চ্যাটাং চালাতে থাকলে দাদুর চ্যালারা চ্যালাকাঠ দিয়ে আমার মাথায় মারবে। তাই একটু বিরতি দিই। আশা করা যাক, বৃষ্টিটা ধরে আসবে আর দূরের মাঠের বা নদীর তীরের কাশবন থেকে ছুটে আসবে পুজোর গন্ধ, সকালের বাতাসে মিশে থাকবে শিউলির সুবাস।

কাল বৃষ্টিতে ভিজেছি, আজকে শুকনো বাতাসে ছন্দ –
ঢাকে কাঠি প'লো? কাশবন থেকে এলো শিউলির গন্ধ?
আসতেই হবে। সব্বাই তাই দরজা রেখো না বন্ধ,
মা আসছে, তার সাথে আলো-হাসি সুখ-শান্তি-আনন্দ!

শরৎ এলেই পুজো চলে আসে, আর অবশ্যম্ভাবী তার আগে এসে যায় মহালয়া। খুব ভদ্র-সভ্য একটা অনুষ্ঠান হয় সেদিন ভোরবেলা রেডিওতে, তার পুরো ক্রেডিটটা চলে যায় ভদ্রবাবুর ঝোলায়। স্ক্রিপ্টটা যে লিখেছিলেন বাণীকুমার বলে এক ভদ্রলোক, আর গানের সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক নামে আর এক ভদ্রজন, তা অনেকে খেয়াল করেন না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভাষ্যে মধুকৈটভ নামের দুই অসুরের সৃষ্টির বর্ণনা নিশ্চয় ভুলে যাননি। অবশ্য আজকের দিনে সেটা একটু অন্যরকম –

বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের দৌলতে অবিরাম বর্ষণে কলকাতার রাস্তাঘাট যখন কারণসলিলে পরিণত হলো, তখন নগরীর রাজপথের ওপর নতুন প্রযুক্তিতে তৈরি হাওয়া-ফুলানো এক ভাসমান আরামনৌকা পেতে বিপিনবাবু সকালের কাগজ খুলে বসলেন। তাঁর এ টি এমের পিন হারিয়ে গেছে, তাই তিনি বি-পিন। বিপন্নমুখে নিউজপেপার খুলেই তিনি দেখলেন পাপের শাস্তির মতো প্রথম পাতায় খবর 'অবিরাম বর্ষণে নগরী বেহাল'। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো তাঁর। যাক বাবা, বহুদিন পরে 'ধ'-টা 'ব' হয়েছে!

তবে বীরেনবাবুর ঐ উদাত্ত চণ্ডীপাঠের কোনো তুলনা হয় না। ইয়া দেবী সর্বভূতেষু সিরিজ শুরু হয়ে গেলে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মা তখন কখনো শক্তি, কখনো ভক্তি, কখনো দয়া, কখনো মায়া, এই সব বিভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছেন। মা-র দশ হাতে দশটা অস্ত্র, একটাও তুলি নেই, পায়েও নেই মুগুর ছাপ অজন্তা হাওয়াই চপ্পল। তখন বলতে ইচ্ছে করে –

সব পুড়ে যাক, যত জঞ্জাল, যেন পশু না জ্বালায় চিতা –
এই দেবী... সর্বভূতে... শক্তিরূপে... সংস্থিতা।
আজ ঘুচে যাক যত দৈন্য, যত কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ –
নমি তোমাকে, নমি তোমাকে, নমি তোমাকে, নমো, নমোহ।

দেখতে দেখতে মা এসে যায়। একা না, সঙ্গে দু’ছেলে দু’মেয়ে। ভুঁড়ি বাগিয়ে আসে গণেশ, আর ভাই রমণীমোহন কার্তিক। এদের দাপটে লক্ষ্মী-সরস্বতী কেঁদে কূল পায় না, তাই তারা রেগেমেগে বলে, আমরা আলাদা করে এসে পেসাদ খেয়ে যাব। প্যাঁচা- ইঁদুর জাতীয় নক্টারন্যাল এনিম্যালদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নগরীর প্যান্ডেলে রাত জেগে ভিড় করে যাবতীয় যুবক-যুবতী। তারা মুখে বলে, রথ দেখতে যাচ্ছি, আসল উদ্দেশ্য কলা বেচা। শরৎ এলে মন উড়ু উড়ু হয়, গরমে ভিড়ে পুজোপ্যান্ডেলে এমনি এমনি কি কেউ ঢোকে, একটু চারানা আটানা না হলে? মূর্তি একচালা হোক বা আলাদা আলাদা, কতজন যে তা খেয়াল করে কে জানে। করলে দেখতে পেত –

দুগ্‌গা মায়ের সঙ্গে এলো সিঙ্গিটা আর অসুর –
দেখতে যেন শ্যামবাজারের নগেনবাবুর শ্বশুর।
এক সাইডে সরস্বতী, তার পাশেতে কেতো –
যাত্রাদলে নায়ক হলে দু’দশ টাকা পেতো।
অন্যদিকে লক্ষ্মীরাণীর পায়ের নিচে প্যাঁচা –
ড্যাবড্যাবিয়ে রথ দ্যাখে, তার সঙ্গে কলা বেচা।
তার পাশে শ্রীগণশা বসে, সঙ্গে মিনি মাউস,
সিক্সপ্যাক তার কভার করে চর্বিপাহাড় ঢাউস।
তার পাশে কে, গামছা-ঢাকা ঘোমটায় একগলা?
আজও তেমনি লাজুক আছো, হায়, শ্রীমতী ‘কলা’!

দেবীর এজেন্ট মানে পুরোহিত এসে পুজো শুরু করেন। মন্ত্রে দেবীর বোধন হয়, টলিউডের বা টিভি সিরিয়ালের বগলকাটা ড্রেস-পরা কোনো এক দেবীর কাঁচিতে পুজোর উদ্বোধন হয়। মন্ত্রপাঠ হতে থাকে, ঢাকে কাঠি পড়ে, কালিপটকা, দোদমা আর উড়ন্ত হাউইয়ের আওয়াজের মাঝে কেউ খেয়াল করে না একচালার প্রতিমায় অসুর আর গণেশের মধ্যে ইন্টারেস্টিং কথাবার্তা হচ্ছে। মহিষাসুর গণেশকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে কিছু বলছে, আর গণেশ তার উত্তর দিচ্ছে বলিউডি ভাষায়।

মহিষাসুর –
আমার গলা ভেজাই আধেক রাতে
তোমার শুঁড়ে শুঁড়ে, শুঁড় মেলাতে
আমার গলা ভেজাই...

গণেশ –
শালে কুত্তে কামিনে মোষ, খামোশ!

ষষ্ঠী গড়িয়ে সপ্তমীতে পড়ে, তারপরে অষ্টমী। সন্ধিপুজো, নবমী, ব্যাস, যায় যায় রব উঠে যায়। বিসর্জনের বাজনা বাজতে আরম্ভ হলেই লোকজনের মুখ ভার। পরদিন এয়োস্ত্রীরা সিঁদুর ফিদুর মেখে শারদীয় হোলিখেলা খেলে নেয়। মাল ফাল টেনে পাড়ার দাদারা লরি নিয়ে ঠাকুর ভাসান দিতে যায়। রাস্তায় লরি দাঁড় করিয়ে লুঙ্গিডান্স। ট্রাফিক পুলিশ হাঁ করে দেখে যায়, কিছু বলার নেই, সিগন্যালে অবশ্য দাদুর গান বাজছে, সেটা বন্ধ করে দিলে দিদি খচে যাবে।

পুজোর মধ্যে উন্নাসিক কিছু আছে, যারা বাংলার বাইরে বেড়াতে চলে যায়। আর এক দল আছে, যারা ভিড়ে যেতে আগ্রহী নয়, তারা টিভিতে পুজো দেখে। ইয়েট অ্যানাদার আঁতেলগোষ্ঠী এখন অনলাইন পুজোতে মেতেছে। ইউটিউব-ফেসবুক। নিউইয়র্কের পুজো কলকাতার আগেই হয়ে যায়, ওরা সব ব্যাপারেই অনেক অ্যাড্‌ভান্স্‌ড্‌ কিনা! তখন বলতে হয় –

পুজো তো এখন পরীক্ষা, কেউ পড়ে পাশ, কেউ টুকে –
এতদিন ছিলো টিভি-পুজো, আর এ বছর ফেসবুকে।
দরকার নেই ভিড়ে হুড়োহুড়ি, ঘেমো বগলেতে সেন্ট
ফেসবুকে জানা যাবে কাকে দিলো প্রাইজ এশিয়ান পেন্ট।
বাইরে বৃষ্টি, শাড়ি কাদামাখা, নেটের পুজোতে বাড়তি
সেভ হবে কিছু ই-পুজোতে, দেবী হরে সর্বেস্যার্তি।
পাপ-ভাণ্ডার ফুলে ফেঁপে গেছে, শুনে গসিপ আর কেচ্ছা -
পুজো শেষ হলে ফেসবুকে দিও বিজয়া প্রীতি-শুভেচ্ছা।

এই অধমের পক্ষ থেকেও আপনাদের সবার জন্যে বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল। এই লেখা যখন আপলোড হবে, তখন অনেক প্রতিমারই বিসর্জন হয়ে গেছে। আর আমি মনশ্চক্ষে দেখছি –

গাঙের জলে ভাসছে আমার চিৎ-হওয়া মা –
উল্লাসে তাও নাচছে মানুষ, গায়ে তাদের নতুন জামা!