ফেরিওয়ালা
বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়
বাসের জানালার ধারে বসে সুলেখা দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। কত যাত্রী উঠছে নামছে সুলেখার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দূরের প্রকৃতির আঁচলে দৃষ্টি পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে কোনো অতীত দিনের বিকেল রঙের আলোয়। বাঁ হাতে করে চোখের জল মুছে
সুলেখা আবার হারিয়ে যায় বনানীর ছায়ায়। একদিন তো এই পথ ধরেই যাতায়াত করত সঞ্জয়ের সাথে। মাঝে মাঝে কবিতার বই নিয়ে বসত গাছের নিচ পড়ে থাকা পাতার ওপর। সেসব কবেকার হারিয়ে যাওয়া কলেজ জীবনের গল্প। মা বাবার অমতেও একদিন বাড়ি ছেড়েছিল সঞ্জয়ের হাতে হাত রেখে। টিকলো না শেষ অবধি সম্পর্খটা। বাঁধনটা আলগা হতে হতে কবেই খুলে গেছে। যদিও বাঁধন খোলার জন্য সে নিজেই দায়ী। দুরন্ত যৌবনের জটিল জালে জড়িয়ে একদিন নিজেই সঞ্জয়ের সিঁদুরের ওপর আরেক হাতের সিঁদুর চাপিয়েছিল। আজ সেই লালিমাও হারিয়ে গেছে নিভে আসা যৌবনের দরজায় দাঁড়িয়ে। তাই আবার পাড়ি, সেই ফেলে আসা বাড়ির বিছানার দিকে।
পড়ন্ত বিকেলের হলুদ রঙটুকু ঝুলছে সুলেখার চোখের জলে। একটা মন্দির দেখে ধড়ফড় করে উঠে পড়ে সুলেখা, বিষ্ণুপুর এসে গেছে। আবার কত বছর পর লাল মাটিতে পা পড়ল সুলেখার। অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে তার আবার এখানে আসা। মনের ভেতর সঞ্জয়ের জানালা বেয়ে যে ক্ষীণ আলো আসছে, ওটাই হয়তো তার বাঁচার শেষ স্বপ্নটুকু। সহর হতে না পারার অভিমানে বিষ্ণুপুর যেন আজ সন্ধ্যার আলো ফোটাতেই ভুলে গেছে। এখানের পথঘাট সুলেখার স্মৃতির এলবামে যত্নে বাঁধানো। তাই পা’কে চেনাতে হবে না ফেলে যাওয়া রাস্তাটুকু।
(দুই)
অবশেষে দূরের দোকানের আলোগুলো একটা একটা করে ফুটে উঠছে রাস্তার ধারে।
মন্ত্র মুগ্ধের মতো তার পা দুটো চলেছে সঞ্জয়ের দরজার দিকে। সঞ্জয় দ্বিতীয় বিয়ে করেছে কিনা সেটা ভাবার মতো সাহসটুকুও এখন তার নেই। বুকের অন্তর্বাস ঘামের সাথে শরীরে চিটে গেছে। ঐতো ঐ গলির শেষের বাড়িটাই সঞ্জয়ের। কানের পাস দিয়ে সাপের মতো গড়িয়ে নামছে গরম ঘাম। আর যে পা চলতেই চাইছে না, অজানা অশনি সংকেতের ভয়ে! তবুও জোর করে পা দুটোকে টানতে টানতে বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে সুলেখা। হাজার প্রশ্নের পাখিগুলো মাথার ওপর বসে অবিরাম কিচির মিচির করছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করেও কান্না চাপা দিতে পারছে না সে। ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? সব ঠিকানাই এখন হারিয়েছে দিন বদলের সাথে সাথে। যৌবনের সব মধু শুকিয়ে শুধু দেহের মৌচাকটাই পড়ে আছে শাড়ির নিচে।
কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেলটায় চাপ দেয় সুলেখা। সন্ধ্যার নীরবতা নষ্ট করে চিৎকার করে বেজে উঠল বেলটা। অনেকক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার চাপ দিল সে। আবার কেঁপে উঠল বাড়িটা। অনেক দূরে তখন বেশ কয়েকটা কুকুর লড়াই করছে, এলাকা দখলের লড়াই।
(তিন)
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু হলো না। মৃদু শব্দ করে খুলে গেল আট বছর আগের ফেলে যাওয়া দরজাটা। আলো আঁধার আবছা সন্ধ্যাতেও সুলেখা দেখলো, শকুন্তলা দেবীর বাসি ফুলের মতো হটাৎ শুকিয়ে যাওয়া মুখটা। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। বিশ্বের যত নীরবতা যেন আজ এখানে এসে থেমে গেছে! ‘মা’ বলে ডাকাটাও যে বড় সোজা কথা নয়! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সুলেখা শকুন্তলা দেবীর ঠাণ্ডা পায়ে হাত রাখল। শকুন্তলা দেবীর মুখে কোনো সাড়া শব্দ নেই। যেন কো্নো অভিমানী দানব প্রাণপণ চেষ্টায় মুখ চেপে আছে। নাট্যমঞ্চ থেকে সরে যাবার মতোই সুলেখা সরে গেল সিঁড়ির দিকে। একপা একপা করে উঠতে লাগলো ওপরে। সঞ্জয় হয়তো দ্বিতীয় বউয়ের সাথে সন্ধ্যার খুনসুটিতে ব্যস্ত; কিম্বা আনমনে ডুবে আছে শক্তি সুনীলে!
আলতো ভাবে ঠেলা দিতেই খুলে গেল কপাট দুটো। কোথায় সঞ্জয়! বিছানা বা চেয়ার দুটোই ফাঁকা। বেশ একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো নাক মুখ দিয়ে। যাক নিজেকে একটু সামলে নেওয়া যাবে। সঞ্জয় এই সন্ধ্যার দিকে ক্লাবে যায় বরাবর। ও ফিরলে কীভাবে মুখোমুখি হবে, সেই এলোমেলো কথাগুলো আবার মনে মনে ঝালিয়ে নিতে থাকে সুলেখা। টেবিলের বইগুলোতে ধুলো জমেছে। ঘরের কোণায় মাকড়শার বাসা। পশ্চিমের জানালার ওপর একটা টিকটিকি দেখছে আগন্তুককে। একটা অজানা অচেনা ভয় আবার বিদ্যুতের মতো খেলে গেল সুলেখার মাথায়। দ্বিতীয়বার বিয়ের কোনো ছাপ নেই বাড়িতে। সুলেখা চুপচাপ বসল বিছানায়। হাজার যদি’র প্রশ্ন উঠছে বুকের ভেতর থেকে বুদবুদের মতো। আর ভাবতে পারছে না সুলেখা। গা বমি বমি করছে তার।
(চার)
এভাবে অনেকটা সময় বসে থাকার পর সুলেখা অনুভব করল খুব আস্তে আস্তে দুটো পা উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে। সঞ্জয় কি তবে বাড়ি ফিরেছে! এবার গলাটাও শুকিয়ে আসছে সুলেখার। থরথর করে কাঁপছে বুক দুটো। পায়ের আওয়াজ ক্রমশ সামনে আসছে। আরও আরও সামনে। একদম দরজার কাছাকছি চলে এসেছে এবার। দু’হাতে মুখ ঢেকে সুলেখা মৃদু সুরে গুমরে উঠল, ‘ভগবান’! পা দুটো দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। ওপরের দিকে মুখ করে আরও একবার ‘ভগবান’কে ডাকলো সুলেখা। হাতের আড়াল সরে যেতেই হঠাৎ চোখ পড়ল সঞ্জয়ের একটা ছবির ওপর। অভিমানী চোখ দু’টোতে কত যে প্রশ্ন জেগে আছে! ঠোটের কোণে একটা ব্যঙ্গের হাসি। গলায় ঝুলছে অনেক দিন আগের একটা শুকনো ফুলের মালা। সুলেখা এবার চিৎকার করে বলে উঠল -- ‘ভগবান’! ফুলের মালাটা শুধু দুলতে লাগলো, দুলতেই লাগলো।
বাসের জানালার ধারে বসে সুলেখা দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। কত যাত্রী উঠছে নামছে সুলেখার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দূরের প্রকৃতির আঁচলে দৃষ্টি পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে কোনো অতীত দিনের বিকেল রঙের আলোয়। বাঁ হাতে করে চোখের জল মুছে
সুলেখা আবার হারিয়ে যায় বনানীর ছায়ায়। একদিন তো এই পথ ধরেই যাতায়াত করত সঞ্জয়ের সাথে। মাঝে মাঝে কবিতার বই নিয়ে বসত গাছের নিচ পড়ে থাকা পাতার ওপর। সেসব কবেকার হারিয়ে যাওয়া কলেজ জীবনের গল্প। মা বাবার অমতেও একদিন বাড়ি ছেড়েছিল সঞ্জয়ের হাতে হাত রেখে। টিকলো না শেষ অবধি সম্পর্খটা। বাঁধনটা আলগা হতে হতে কবেই খুলে গেছে। যদিও বাঁধন খোলার জন্য সে নিজেই দায়ী। দুরন্ত যৌবনের জটিল জালে জড়িয়ে একদিন নিজেই সঞ্জয়ের সিঁদুরের ওপর আরেক হাতের সিঁদুর চাপিয়েছিল। আজ সেই লালিমাও হারিয়ে গেছে নিভে আসা যৌবনের দরজায় দাঁড়িয়ে। তাই আবার পাড়ি, সেই ফেলে আসা বাড়ির বিছানার দিকে।
পড়ন্ত বিকেলের হলুদ রঙটুকু ঝুলছে সুলেখার চোখের জলে। একটা মন্দির দেখে ধড়ফড় করে উঠে পড়ে সুলেখা, বিষ্ণুপুর এসে গেছে। আবার কত বছর পর লাল মাটিতে পা পড়ল সুলেখার। অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে তার আবার এখানে আসা। মনের ভেতর সঞ্জয়ের জানালা বেয়ে যে ক্ষীণ আলো আসছে, ওটাই হয়তো তার বাঁচার শেষ স্বপ্নটুকু। সহর হতে না পারার অভিমানে বিষ্ণুপুর যেন আজ সন্ধ্যার আলো ফোটাতেই ভুলে গেছে। এখানের পথঘাট সুলেখার স্মৃতির এলবামে যত্নে বাঁধানো। তাই পা’কে চেনাতে হবে না ফেলে যাওয়া রাস্তাটুকু।
(দুই)
অবশেষে দূরের দোকানের আলোগুলো একটা একটা করে ফুটে উঠছে রাস্তার ধারে।
মন্ত্র মুগ্ধের মতো তার পা দুটো চলেছে সঞ্জয়ের দরজার দিকে। সঞ্জয় দ্বিতীয় বিয়ে করেছে কিনা সেটা ভাবার মতো সাহসটুকুও এখন তার নেই। বুকের অন্তর্বাস ঘামের সাথে শরীরে চিটে গেছে। ঐতো ঐ গলির শেষের বাড়িটাই সঞ্জয়ের। কানের পাস দিয়ে সাপের মতো গড়িয়ে নামছে গরম ঘাম। আর যে পা চলতেই চাইছে না, অজানা অশনি সংকেতের ভয়ে! তবুও জোর করে পা দুটোকে টানতে টানতে বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে সুলেখা। হাজার প্রশ্নের পাখিগুলো মাথার ওপর বসে অবিরাম কিচির মিচির করছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করেও কান্না চাপা দিতে পারছে না সে। ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? সব ঠিকানাই এখন হারিয়েছে দিন বদলের সাথে সাথে। যৌবনের সব মধু শুকিয়ে শুধু দেহের মৌচাকটাই পড়ে আছে শাড়ির নিচে।
কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেলটায় চাপ দেয় সুলেখা। সন্ধ্যার নীরবতা নষ্ট করে চিৎকার করে বেজে উঠল বেলটা। অনেকক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার চাপ দিল সে। আবার কেঁপে উঠল বাড়িটা। অনেক দূরে তখন বেশ কয়েকটা কুকুর লড়াই করছে, এলাকা দখলের লড়াই।
(তিন)
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু হলো না। মৃদু শব্দ করে খুলে গেল আট বছর আগের ফেলে যাওয়া দরজাটা। আলো আঁধার আবছা সন্ধ্যাতেও সুলেখা দেখলো, শকুন্তলা দেবীর বাসি ফুলের মতো হটাৎ শুকিয়ে যাওয়া মুখটা। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। বিশ্বের যত নীরবতা যেন আজ এখানে এসে থেমে গেছে! ‘মা’ বলে ডাকাটাও যে বড় সোজা কথা নয়! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সুলেখা শকুন্তলা দেবীর ঠাণ্ডা পায়ে হাত রাখল। শকুন্তলা দেবীর মুখে কোনো সাড়া শব্দ নেই। যেন কো্নো অভিমানী দানব প্রাণপণ চেষ্টায় মুখ চেপে আছে। নাট্যমঞ্চ থেকে সরে যাবার মতোই সুলেখা সরে গেল সিঁড়ির দিকে। একপা একপা করে উঠতে লাগলো ওপরে। সঞ্জয় হয়তো দ্বিতীয় বউয়ের সাথে সন্ধ্যার খুনসুটিতে ব্যস্ত; কিম্বা আনমনে ডুবে আছে শক্তি সুনীলে!
আলতো ভাবে ঠেলা দিতেই খুলে গেল কপাট দুটো। কোথায় সঞ্জয়! বিছানা বা চেয়ার দুটোই ফাঁকা। বেশ একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো নাক মুখ দিয়ে। যাক নিজেকে একটু সামলে নেওয়া যাবে। সঞ্জয় এই সন্ধ্যার দিকে ক্লাবে যায় বরাবর। ও ফিরলে কীভাবে মুখোমুখি হবে, সেই এলোমেলো কথাগুলো আবার মনে মনে ঝালিয়ে নিতে থাকে সুলেখা। টেবিলের বইগুলোতে ধুলো জমেছে। ঘরের কোণায় মাকড়শার বাসা। পশ্চিমের জানালার ওপর একটা টিকটিকি দেখছে আগন্তুককে। একটা অজানা অচেনা ভয় আবার বিদ্যুতের মতো খেলে গেল সুলেখার মাথায়। দ্বিতীয়বার বিয়ের কোনো ছাপ নেই বাড়িতে। সুলেখা চুপচাপ বসল বিছানায়। হাজার যদি’র প্রশ্ন উঠছে বুকের ভেতর থেকে বুদবুদের মতো। আর ভাবতে পারছে না সুলেখা। গা বমি বমি করছে তার।
(চার)
এভাবে অনেকটা সময় বসে থাকার পর সুলেখা অনুভব করল খুব আস্তে আস্তে দুটো পা উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে। সঞ্জয় কি তবে বাড়ি ফিরেছে! এবার গলাটাও শুকিয়ে আসছে সুলেখার। থরথর করে কাঁপছে বুক দুটো। পায়ের আওয়াজ ক্রমশ সামনে আসছে। আরও আরও সামনে। একদম দরজার কাছাকছি চলে এসেছে এবার। দু’হাতে মুখ ঢেকে সুলেখা মৃদু সুরে গুমরে উঠল, ‘ভগবান’! পা দুটো দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। ওপরের দিকে মুখ করে আরও একবার ‘ভগবান’কে ডাকলো সুলেখা। হাতের আড়াল সরে যেতেই হঠাৎ চোখ পড়ল সঞ্জয়ের একটা ছবির ওপর। অভিমানী চোখ দু’টোতে কত যে প্রশ্ন জেগে আছে! ঠোটের কোণে একটা ব্যঙ্গের হাসি। গলায় ঝুলছে অনেক দিন আগের একটা শুকনো ফুলের মালা। সুলেখা এবার চিৎকার করে বলে উঠল -- ‘ভগবান’! ফুলের মালাটা শুধু দুলতে লাগলো, দুলতেই লাগলো।
ধন্যবাদ কালিমাটি
উত্তরমুছুন