কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৩

০৩ রমিত দে

দ্য প্রফেট
রমিত দে

“স্মৃতি হলো এক ধরনের সাক্ষাৎ । বিস্মরণ এক ধরনের স্বাধীনতা।
মানবিকতা যেন এক আলোর নদী, অনিশ্চয়তা
ছাড়িয়ে অবিনশ্বরতায় বয়ে যাচ্ছে সে ।
তাদের জাগরণে আমাকে তারা বলে, তুমি আর
তোমার পৃথিবী এক অনন্ত সমুদ্রের অসীম তটভূমিতে
এক কণা বালির মতো শুধু ।
স্বপ্নে আমি উত্তর দিই, আমিই অনন্ত সমুদ্র ।
আর সারা পৃথিবী আমার তটরেখায় বালির কয়েকটি কণামাত্র”।

(মূল - কাহলিল জিব্রান / অনুবাদ - অমিতাভ মৈত্র)

একজন কবি ঠিক কী কী কারণে আলোচিত হতে পারেন? তাঁর গ্রন্থনা তাঁর বোধ তাঁর অধ্যয়ন তাঁর প্রতিভা অথবা তাঁর স্পন্দনা অথবা তাঁর প্রাণশক্তি অথবা গভীরতা বা ছন্দ বা তার অনুপ্রাস! কেবল এই কি তার বীজ, এই কি তার তৃষ্ণা! কিন্তু একজন কবির ভ্রমণসূচিতে যখন জড়িয়ে যায় আধ্যাত্মবাদ, যখন তার প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে কবিতার পটভূমি হয়ে ওঠে ঈশ্বরের ‘প্রশান্তি শুভ্র স্বাগত স্নেহের’, ভাবতে ভাবতে পথ চলতে চলতে এগিয়ে আসে এক বিবিধ চৈতন্য এক ধূ ধূ নিরবতা, যেখানে উদ্ঘাটন হয়ে যায় কবি স্বয়ং, সমর্পিত হয়ে যান সেই বিন্দুপ্রভ প্রকৃত পরিত্রাণের আশায়, তখন তাঁর অভিজ্ঞতাকে আমরা কি নাম দেব? স্বাপ্নিক! জ্ঞান! সুস্থ! বিস্মৃত! নাকি হাওয়া এসে খুঁজে নেবে কবিতার হারানো শরীর! খুঁজে নেবে তার ছোট ছোট চোখ, তার সাবেক সংক্ষোভ আর পেছনের দরজাটা ভেঙে দিয়ে ছোট ছায়াটিকে রেখে যাবে আমাদের সান্ধ্যস্নানের জন্য। ঠিক সে মুহূর্তে কবি কি বোধের ভাণ্ডারী, নাকি কান্ডারি! তিনি কি একা একা এলেন নিজস্ব নাটক দেখবেন বলে? খুলে দিলেন অনায়াস সিঁড়ির দরজা! তার অর্ধেকই অর্থহীন তবু যেন বাকি অর্ধেক নিয়ে তিনি পৌঁছতে চাইছেন ঈশ্বরের পূর্বরাগে, সেখানে শব্দ আসলে এক ছবি, তার দু’পায়ে আলো, সে মাঠের ওপর একা, হয়তো তাকে কবি ধরবেন কুয়াশা ভেবে আর মুঠি খুলে দেখবেন আদতে একটা সদ্যোজাত কাঁচপোকা, বন্ধ করবেন মুঠি এবং খুলবেন, দেখবেন আলোকিত সমন্বয়ে কেমন করে তা হয়ে গেছে কখন একটা পাখি। আর তারই ভেতর স্পষ্ট হতে থাকে এক মানুষ এক বিষণ্ন তমসালীন অভিসারিক, আবার তাকেই মুঠি বন্ধ করলে আদতে এই এতো দুর্ধষ ওড়াউড়ির শেষে হাত ভর্তি কুয়াশা ছাড়া আর কিছু নয়, আত্মমগ্ন বালির ওপর কি দীর্ঘ স্বাধীনতা নিয়ে এক নিঃশীল চেতাবনি; এই কি সেই আদিপর্ব! সেই ভাসমান শূন্যতা! জ্ঞানার্থী কবি যেন গোল পৃথিবীর ওপর এভাবেই ঘুরে চলেছেন কেবল এক সাধনায়, এক নবীন প্রার্থনায়। দু’হাত জুড়ে তাঁর কবিতার মুহূর্ত প্রবাহিত মুহূর্ত। জেতবনের ভিক্ষুকের মতো তিনি কেবল প্রশ্নের উত্তর চান, পংক্তির পুনরাবিষ্কার চান; জ্ঞানযোগী জ্ঞানকে অলংকৃত করেন। ভক্তিযোগী ঈশ্বরকে তবে কবি কি করবেন? তাঁর কাছে আছে কেবল এক আপেক্ষিক শূন্যতা, একটা দ্বৈত, একটা সাগর থেকে ফেরা। যেন সমস্ত বীজ অপেক্ষা করছে স্পর্শের ,অনুভবের, বাতাস আবার বুদবুদের কাছে বারংবার ঠকে যাওয়ার মতো আরও এক বিশ্বাসযোগ্য সত্যের।

এই স্বরাট সত্যেরই সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন কাহলিল জিব্রান। পেয়েছিলেন ভাষা দিয়ে মানবাত্মার সিনট্যাক্স। ঠিক এখানেই কোনো স্থির ভূখন্ডের মাঝে জিব্রানকে আর বেঁধে রাখা যায় না, ঠাঁই পাওয়া যায় না কোনো নির্দিষ্ট মানচিত্রের। অথচ তিনি দিশেহারা নন, লেবাননের বা মার্কিন দেশের কবি জিব্রান নন বরং সত্তার নতুন আবির্ভাবে সত্তার শুভকামনায় ভেসে গেছে তাঁর সম্ভাবনার বয়া, তাঁর ছড়ানো বালিয়াড়ি আর ক্রমেই তা হয়ে উঠেছে সব জানার ভেতর শূন্যস্থিত অজানা, হয়ে উঠেছে বোধের এক বিশুদ্ধ বাণিজ্য। প্রশ্ন করেছেন বারবার, না, মনোহারিত্বের জন্য নয়, প্রত্যাখ্যানের জন্যও নয়, বরং সেই উৎসমুখে পৌঁছাবার জন্য, সেই অস্থিরতার বীজ ছুঁয়ে দেখবার জন্য। অনন্ত মিউজিকররুম খোলা রেখে পৃথিবীর ঘুমঘোর নুনকান্না খোলা রেখেই ভেতর থেকে যেন বারবার প্রশ্ন করেছে, কবিকে! কবিতাই বা কি -- সে কি দেহের! মনের! জীবের! জীবনের! নাকি কেবল এক উচ্ছেদবাদের! কেবল এক সুবাতাস ভেঙে প্রগাঢ় আহ্বানের! এই সামান্যতম প্রশ্নে তাঁর ছিল তুমুল ভাঙন; না কোনো এগিয়ে যাবার কাল্ট ফিগার নন, বরং তাকে আমরা পাই এই বাসনাবৃত্তের বর্হিবয়বের থেকে অনেক দূরে, কোনো কম্প্রোমাইজ নয় বরং বেড়া ভাঙার কম্পনটুকুই তাঁর প্রতিপাদ্য। অন্ধকারকে পছন্দ করেননি অথচ অন্ধকার ছিল তাঁর দ্বিতীয়তা, সুতীব্র আর্তস্বর, যেন আলো জোগাতেই অন্ধকারকে উসকে তুলতেন, বিশ্বাস করতেন ক্ষতপ্রাণ অথচ তারই ওপর বিছিয়ে দিতেন বিবশ ঘাসের প্রীতিময় জাফরি। এই জীবন, এই যাপন --সবই যে আসলে কুয়াশা থেকে ক্রিস্টাল থেকে নয়, সেই যে প্রতিফলন, দিল হাজার রঙের ভিড় দি্‌ সেই তো পেরিয়ে গেল প্রশ্নকে, পেরিয়ে গেল পথিককে, কিন্তু পথ! তার যেন আলিঙ্গন সহজ উজ্জ্বল তার যেন কিছুতেই অভিমান নেই, সে যেন আনন্দের দিকে যাবে স্পন্দনের দিকে যাবে। জিব্রান খুব দূর থেকেও অনুভব করেছিলেন আসলে এই পথই কাছের, এই পথকেই একমাত্র ধারণ করা সম্ভব, আর তাই ভরাজীবন থেকে ক্ষণমুহূর্ত থেকে তিনি যেন পর্যটক হয়ে উঠেছেন নির্বিরোধে, এক বিন্দুও ঘুমাননি, কেবল জল নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখেছেন কীভাবে গুলিয়ে যায় এই জন্ম এই পরিক্রমা এই যাত্রাপথের ঝনঝনানি। কীভাবে ফিরে চলে কসমিক কেওস। জিব্রান যেন দু’পাশের টান নয়, কেবল কেন্দ্রের ম্যাজিকটাকেই খুঁজতে চেয়েছেন বারংবার । কবিতা সম্পর্কে জিব্রানের ধারণা নিজের থেকে ক্রমশঃ মুক্তি আর নির্মোহ উদাসীন তীব্র লাফিয়ে পড়া থেকেই বিপরীত মানসে আবাদযোগ্য হওয়া। What is poetry? "An extension of vision. An expression of that sacred desire to find this world and behold it naked; and that is the soul of the poetry of Life. Poets are not merely those who write poetry, but whose hearts are full of the spirit of life. প্রতিটি শব্দই সত্য। প্রতিটা শব্দই শান্তিতে পুড়ছে। কবিতার থেকে শব্দের বিপরীত এক ছবি নিয়ে প্রতিটা শব্দই চলেছে কবিতার অন্য কোনখানে। তবে কি অর্থবিমুক্তি চাইলেন জিব্রান! রক্তের মধ্যে ঘুলিয়ে ওঠা সেই পোলার ডার্কনেস অথবা কাঠপাতার ঘর থেকে রিপুবায়ু আর রিপুপীড়া থেকে ফিরে আসার ঐশীক প্রেসক্রিপশন। জিব্রানকে আমরা কি কবি বলতে পারি, নাকি একজন চিত্রকর! নাকি সেই শ্রুতিময়ী প্রজ্ঞা সেই চিন্তনময়ী প্রজ্ঞা!

১৯২৬এ বেরোলো ‘বালি ও বুদবদ’ আর ১৯২৩এ ‘দ্য প্রফেট’। বড় আলোর নিচে মোমদানী রাখার সাহস দেখালেন জিব্রান। সে গলে গলে মনখারাপ নয় বরং ক্রমশ হয়ে উঠল এক নিবেদন -- চিন্তার, বিষয়ের, আধেয়ের; হয়ে উঠল এক অনুপম সাধনা, ভঙ্গুর প্রাণসামগ্রীর থেকে তুচ্ছ কোলাহল থেকে কোথাও সংজ্ঞাহীন নির্দেশহীন ক্রমজায়মানের দিকেই। উৎসারিত আলোর প্রহরী বিনয় মজুমদারকে তাঁর ডায়েরীর জ্বরপঞ্জিতে লিখতে দেখা গেছিল “…টগর গাছের তলায় একটি অলৌকিক বালিকা দাঁড়িয়ে আছে। একটি বালিকা আসে পৃথিবীর উদ্যানে একাকী”। জিব্রানের উচ্চারণও যেন এই একাকে ঘিরেই, কিন্তু সে আলো ছাড়া নয়, শরীরভরা রুগ্ন ফরসেপ ছাড়া নয়, আর এর মাঝেই তিনি খুঁজতে বেরোলেন সেই বোকা আত্মাকে সেই উত্তরণের ঘনককে। এই তো সেই গোপনতম সত্য, মুকুলিত সমর্পণ। যে সত্যের দিকে জিব্রানও হয়ে উঠেছেন নিরুদ্দেশ যাত্রী; মহৎ এবং ব্যতিক্রমী কবিতা লিখতে চাননি জিব্রান, টানতে চাননি কোনো সমান্তরাল সরলরেখা, বরং শব্দের সরলরেখা ধরে এগোতে এগোতে শব্দের শেষে জড়ো করেছেন সেই প্রথম শব্দ যা কোনো কিছুর মধ্যেই আর নেই, যা সৃষ্টির আয়োজনেও আসলে অজ্ঞেয় অদৃশ্যের। আর এখানেই তিনি বিছিয়ে দিলেন তাঁর ভাবনার ক্যানপি, খুলে দিলেন বন্ধ তালা।


তোমার সন্তানেরা তোমার নয়, তারা জীবনেরই আকাঙ্ক্ষা, তোমরা তাদের উৎস নও, মালিকও নও। কেবল এক প্রক্রিয়ার শরিক। কী করে দেবে তাদের উত্তরাধিকার! তাদের চেতনা তো তাদের, তাদের সুষম প্রতিধ্বনি; তাঁর জীবনচিন্তা জ্যামুক্ত, বার বার জিব্রান ফিরে ফিরে যেতে চেয়েছেন স্থান কাল চরিত্রের সংশ্লেষের বাইরে, তাঁর পাঠ ও প্রাসঙ্গিকে বারবার বিংগস পরিনত হয়েছে বিকিরণে। তাঁর বিশ্বচিন্তা সেই সকালবেলার ঘুমভাঙা বৃষ্টির মতো, যা কেবল পবিত্র জলকুন্ডটি ভরে দিতে থাকে আশ্চর্য হেঁয়ালি আর বিস্ময় নিয়েই। নিজেকে উৎসর্গ করে, তিনি কেবল নির্জনের উৎসর্জনে যেতে চেয়েছেন, নির্সগের একজন হতে চেয়েছেন, পৃথিবীর মানচিত্রে দাঁড়িয়ে কোনো পার্টিকল ফিজিক্স নয় বরং এই মহাবিশ্বের শেকলের দাগগুলো মুছতে চেয়েছেন, হতে চেয়েছেন আমিহীন। তাঁর নব জীবনায়নবোধ বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে ‘আমিকে’। জগৎস্থিত অভেদকে নিয়ে গেছেন পরার্থ সত্তায়। পরম শূন্য তাপমাত্রা জিব্রানের কবিতার, বরফের নিচে লুকিয়ে রাখা আমাদের গানের রাস্তাগুলোকে অকস্মাৎ যেন পাখি আর অসংখ্য সবুজের হাতে অর্পিত করেছেন ফাম আল মিলিয়াবের ভূমিপুত্র, স্থাপনের নিরূপণ নয় বরং সব আয়োজনের সব হয়ে ওঠার সব স্থাপনের নির্বাণই ছিল যার দুর্বলতা, যার দিদৃক্ষা।

এ বিষয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, জিব্রান মূলত চিত্রকর নাকি কবি! আসলে কবিতা আর ছবির নিষাদ ও গান্ধারকে মিলিয়ে দেওয়াই ছিল জিব্রানের ভাষা জিব্রানের সেনস্যরি ইমেজারী; প্রতিতুলনাহীন এক ভ্যানিশিং পয়েন্ট অবধি পৌঁছে যাওয়া। কাদিসা উপত্যকা বা বিশারি গ্রামের পবিত্র সিডার গাছ, লেবানন পাহাড়, মরোনাইট গীর্জা বা ধূসর মেষপালকেরা শৈশবেই অগ্রন্থিত জিব্রানের আত্মার অ্যালবাম খুলে রেখে গেছিল আর্টিস্টিক লাইসেন্স; তুলি বা তারপিনে না, বিসারি গ্রামের প্রতিটা ঘুমন্ত ভাষ্য উঠে এসেছিল জীবন্ত বয়ানের ঢঙে; পবিত্র সিডার গাছ খিলখিল করে হাসে -- গল্প করে -- মাঝে মাঝে পাশ ফেরে আর আঙুল তুলে দেখায় কাদিসা উপত্যকার মাঝে মাঝে লেগে থাকা আধখানা রোদ্দুর, পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নেমে আসা ফিকে সবুজ গাঢ় সবুজ, নীরবে চিনিয়ে দেয় মুসলিম দ্রুজ আবহ আর প্রাচীন কিথারা। কাঠ কয়লা দিয়ে তিনিও এঁকে রাখতেন এতসব প্রত্ন করিডোর এতসব অতৃপ্ত তৃষ্ণার কথা, যা পরবর্তী কালে হয়তো সম্পূর্ণতা পেতেই হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা তাঁর শাব্দিক কোরেল; জিব্রানের সংস্কৃতি আর অস্তিত্ববোধের সাথে কবিতা আর ছবির কোথাও এক শূন্যতত্ত্ব এক একক মালিকানাবোধ কাজ করে। কিছু কিছু ছবি হয়তো জিব্রানকে তাঁর কবিতার আন-কনসাস মনিটরিং থেকে নিয়ে চলে আসে স্থির ইমেজে; যেখানে রহস্যময় অফুরন্তের থেকে মুখই হয়ে ওঠে তীক্ষ্ণ প্রত্যক্ষতা, সেখানে ধ্রুপদ ভেঙে খেয়াল তৈরি করা নয়্‌ দুনি চৌদুনি তান নয় বরং উঠে আসে রক্ত মাংসের কিছু পিচ্ছিল প্রেক্ষাপট; কিন্তু এই রঙের দ্যোতনাতেই কখনও কখনও ভারি বাতাস লাগে, ছুঁয়ে যায় অর্জিত পুরবৈয়া। ঠিক সেখান থেকেই আমরা পেয়ে যাই দেহজ পিপাসা থেকে ‘মুগ্ধ সারসের মতো’ উড়ে যাওয়া ‘প্রফেট’ জিব্রানকে, যার স্থল ও অন্তরীক্ষের ঠিকরে পড়া আলোটুকু ছাড়া কোথাও কোনো অস্তিবাচক অভিপ্রায় নেই, অভিপ্রায়মুক্ত এক প্রকাশিত জাহাজ, যে তার সমস্ত জীবনকে নিয়ে চলেছে ভরমুক্ততার দিকে, নিয়ে চলেছে সেই ভোরের পাঠশালায়, যেখানে বিশ্বসংযোগে খুব শান্ত খুব একাগ্র এক ভালোবাসা -- সেই তাঁর শান্তি, সেই তাঁর আরোগ্য, সেই তাঁর ঘুম বহ্নির নীড়ে এক গুল্মাচ্ছাদিত অবধারিত।

ভালোবাসা প্রসঙ্গ জিব্রানের কাছে অনেকটা সেই ফিনফিনে ঘুমের মতো, সমস্ত জীবন অতিবাহিত করার পর সূর্যাস্ত অবধারিত জেনেও যেন বলছে, আর ক’টা দিন রোদ্দুরে কাটাই। তার আলোয় এক আধ্যাত্মিক ত্বরণ, ঘড়ি বেজে ওঠে হৃদয়ের অবস্থানে, ফেনা যেমন খুঁজে ফেরে জলকে, ধোঁয়া খোঁজে আকাশকে, ঠিক তেমনি জিব্রান ভালোবাসাকে মুক্তি দিয়ে দেন এক ভাষাহীন উচ্চারণে when love beckons to you, follow him… and when his wings enfold you yield to him… And when he speaks to you believe in him... love gives naught but itself and takes naught but from itself. Love possesses not nor would it be possessed. For love is sufficient unto love.When you love you should not say, ‘God is in my heart, ‘but rather, ‘I am in the heart of God.’ And think not you can direct the course of love, for love, if it find you worthy, directs your course. ভালোবাসার কাছে এভাবেই আত্মসর্মপিত জিব্রান; তাঁর অ্যানেক্সিটি প্যার্টান গান গেয়ে ওঠে যখনই দুঃখ পায়, ছবি আঁকে যখনই দৃশ্যে কাতর হয়ে ওঠে এক জন্মান্ধ ‘আমি’, অথবা শব্দকে সর্বময় করে তোলে যখন আঠার মতো জড়িয়ে যায় চিৎকার। স্থানিক থেকে কালিক থেকে বারবার যেন হাঁটতে চাইছেন ট্রাপিজে, ক্রমশ মুছে ফেলছেন ‘আমি’ নামক ছায়াফসিল, মুছে ফেলছেন ইমোটিভ ফেনা মাখানো পা আর ফুসফুসের বিষণ্ন মেহেন্দী।

জিব্রানের নিজের শৈশব কৈশোর কেটেছে পারাবারিক বিচ্ছিন্নতায়, অথচ তাঁর নাতিউষ্ণ কবিজীবনের ফরম্যাটে তিনভাগ নয় হয়তো পুরোটাই জলে টলমল, পুরোটাই মেঘ মেখে খাওয়া নয় বরং বৃষ্টির জন্য হাত পাতা, তিনি কথাকে মন্ত্রের জায়গায় কনভার্ট করেছেন, ‘ভয়েস ইনটু জিরো’। পাকা দেওয়ালের মাঝে গড়ে তুলেছেন এক চমৎকার সিঁড়ি, যা দিয়ে উঠলেই মৃত্যু যা দিয়ে উঠলেই মুক্তি, আর সে মৃত্যু বাতাসে নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই নয় অথবা সূর্যের তাপে গলে যাওয়া মাত্র। মৃত্যুকে এভাবেই হু হু করে ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছেন জিব্রান, তুলতে চাননি, বরং এক নিরাময়হীন গল্পের মাথার দিকে দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে সাজিয়ে রেখেছেন, সেখানে কান দিলেই প্রতিবেশীরা পাবে এক সুগন্ধী নিঃশ্বাস, এক ঝাঁপিয়ে পড়া আকুতি, ছদ্মবেশ খুলে বেড়িয়ে যাওয়া অতিশূন্যের ফরমুলা। পায়ের তলায় মাটি থাকলেও আসলে আকার সীমায় জিব্রানের ছিল না কোনো শেকড়, কেবল স্রোতে ও আবর্তে আলো নিভিয়ে জিব্রানের বেড়ে ওঠা। মা কামিলা, সৎ বাবা খলিল বে। মদ্যপ জুয়াড়ি বাবা আর মায়ের সাথে নিত্যনৈমত্তিক সাংসারিক ঝগড়ায় তাঁর যাপনের টূকরোগুলো কোথাও সম্পৃক্ত হতে চায়নি ওই উদাসীন অর্থহীন শীতার্ত শৈশবেই; তাই কি জিব্রান শব্দ থেকে পালাতে চাইলেন? পালাতে চাইলেন বাস্তব থেকে! আসলে প্রাণ নয় প্রাণরসের ষড়জেই মজে ছিলেন জিব্রান; তিনি এমনই কথা খুঁজছিলেন যা থেকে নীরবতা তৈরি করা যেতে পারে। প্রকৃতিরই ফুলে তিনি খুঁজেছিলেন ফুলহীনতা, সেই মহৎ শূন্যস্থান। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তিনি কি চেয়েছিলেন শব্দের নীরবতা, নাকি নীরবতার শব্দ! এক সাংঘাতিক দৃশ্যের সামনে গুঞ্জিত চিরন্তনের সামনে এসে লাফ দিলেন আরও এক চিরন্তনে। নিভে যাওয়া আলোর দিকেই ইঙ্গিত করলেন জেগে থাকা বীজের কথা। এক আর্তস্বরের মানুষকে এক ঘন আবহময় মানুষকে প্রাক্‌রচিত গন্ডির বেড়ার থেকে নিয়ে গেলেন সেই উপচ্ছায়ার দিকে, নিয়ে গেলেন প্রথম দিনের সূর্যের কাছাকাছি, মুক্তো জন্মের কাছাকাছি, ধীর সম্পন্ন পায়ে জিব্রান যেন ঈশ্বরের প্রথম শব্দ হিসেবেই চুরি করতে চাইলেন মাটিতে পড়ে থাকা মানুষকে। নিভে যাওয়া আলোকে নিয়ে গেলেন সবুজ অন্ধকারের ছায়ায়। প্রফেট আসলে সেই বন্দরগামী জাহাজ যাতে তিনি নিজেই উঠতে চেয়েছেন ভোর হয়ে। চেয়েছিলেন জাগরণের এক নিবিড় আয়তন, এক ঐশী অন্ধকার, সে অন্ধকার আলোর টুপি খুলে রেখেছে, সে অন্ধকার আসলে আমাদের রিফিউজি পাড়াগুলোকে শ্বাসরোধকারী ঘুমগুলোকে অসীম কাপড়ে মুড়ে রেখেছে; কখনও কখনও মনে হয়, নিজেরই অজান্তে হয়তো জিব্রান লিবারেট করতে চেয়েছেন সুখ দুঃখ জন্ম মৃত্যু প্রেম ঘৃণা প্রেমের মতো ডাউন সাইকেলগুলোকে, তুলে ফেলেছেন অনন্ত সমুদ্রের ভারি বয়ামের ঢাকা আর ভেতরের ফাঁকাতে রেখে দিয়েছেন আমি বা আমাদের মতো বালির কয়েকটি কণামাত্র, এই আমি বা আমাকে যেন যেতেই হবে কোনো এক ‘নিভৃত লাল কোণে’, যেতে হবে এক নশ্বর পূর্ণতার কাছাকাছি এবং সেখানে কোনো দ্বন্ধতা নয়, এক পা বাড়ানো নয় পথের ওপর বরং সম্পূর্ণ পথটাকেই তিনি পথিকের থেকে পর্যটনের দিকে প্রয়াস করে দিলেন, দৃঢ় পোক্ত করে দিলেন। পালাবার কথা বলেননি জিব্রান বরং পৃথিবীর মাটিটা ফাঁক করে দেখিয়ে দিলেন প্রতিটা বীজই আসলে এক তৃষ্ণা, এক অপেক্ষ্‌ কেউ তাকে টানছে এক আশ্চর্য আকর্ষকের দিকে। ১৯২৩এর অক্টোবর মাসে বেরোলো ‘দ্য প্রফেট’। প্রকাশ পেল এক অচেনা দ্বীপে জীবনের সহবাসে থাকার শেষে প্রকৃত ফেরার অপেক্ষায় জাহাজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা সেই চিরন্তন প্রফেটকে চিরন্তন প্রজ্ঞাকে ঘিরে একের পর এক পরত খুলে যাওয়া উপরিভাগের, আর মিলিয়ে নেওয়া হলো ইথারমন্ডিত গভীরতাকে; এই প্রফেটের মুখ যেন সেই ছায়ার গান সেই অতিদীন কেউ যেন তাঁরই সামনে এনে নামিয়ে রেখেছেন একের পর এক জিজ্ঞাসা, নামিয়ে রেখেছেন সফেদ যন্ত্রণা কিংবা মৌন বিষাদ। আবার কখনও বা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে তাঁর তেষ্টা, তাঁর প্রাণের ভজনা তাঁর মিশ্রিত অনুভূতি আর এক ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো পবিত্র পুরুষের মতো প্রফেটের আদলেই এই একাকী নিঃসঙ্গ আগন্তুক মানুষকে জিব্রান দেখিয়ে গেছেন জীবন আবর্তের বাইরে আসবার রাস্তা, চিনিয়ে গেছেন বাসনায় ঘুরে বেড়াবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে বিশেষ হওয়ার লিপিরূপা। বিশ্বাসের পাত্রে ভরেছেন ঈশ্বরের মুখ।

যন্ত্রণা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, তোমার যন্ত্রণা হচ্ছে আবহমান আবরণকে ভেঙে ফেলা যা তোমার বিশ্বাসের, বোধের চারপাশকে ঘিরে রাখে। এমনকি কোনো পাথরকে বা কোনো ফলকেও ভেঙে ফেলতে হয়। আর এভাবেই তাঁর হৃদয় মাথা রাখে সূর্যের নিচে। তোমাকে জানতে হবে তোমার যন্ত্রণার ভাষা। প্রতিদিনের এই অতিরিক্ত এবড়োখেবড়ো জীবন যাপনের ভেতর তুমি কি তোমার হৃদয়কে সাজিয়ে রাখতে পারবে? তোমার যন্ত্রণা তোমার আনন্দের চেয়ে কম বিস্ময়কর নয়। এবং তাকে তুমি গ্রহণ করবে। যেমনটা তোমার শস্য ক্ষেতের উপর দিয়ে নিঃশ্বাসের মতো যেমন ভেসে যাওয়া সব ঋতুকে সাবলীলভাবে গ্রহণ কর। আসলে বেশিরভাগ যন্ত্রণাই তোমার নিজের পছন্দ করা। আর এটাই সেই আনন্দ, সেই প্রকৃত তিক্ততা যা তোমাকেই দেওয়া হয়েছে তোমারই অসুখের উপশমে। এইবার সমস্তটুকু শূন্যতা আর নীরবতা মিশিয়ে বিশ্বাস করে তুমি পান করে ফেল এই যন্ত্রণা। সে যতই ভারি হোক না কেন আসলে সে ক্রমশ হালকা হয়ে উঠছে এক অলৌকিক টানে, এক বিমূর্ত ও বিশুদ্ধ নির্দেশনায়। আর যে পাত্র সে হাতে করে এনেছে তাতে তোমার ঠোঁট পুড়বে নিশ্চয়, কিন্তু সে পাত্রও তৈরি হয়েছে কুমোরের চোখের জলে আর মাটির মৃদু গানে। মুখোশহীন দুঃখকেই কাহলিল হাসিমুখে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর আনন্দ শব্দের দিকে, চরম শূন্যতাতেই দাঁড় করিয়েছেন তাঁর চরম ভারসাম্যের বিশ্বাস।
জিব্রানের মা কামিলার জীবন খুব একতা নিশ্চিন্তির কোনোদিনই ছিল না, জাতিতে ছিলেন কাদিসা উপত্যকায় পালিয়ে আসা মারোনাইট খ্রিষ্টান। ফাম আল মিলোয়াব পাহাড়ের নিচে বিবাহবিচ্ছিন্না মানুষটির দ্বিতীয় বিবাহও হয়েছিল মদ্যপ জুয়াড়ি খলিল বে র সাথে, যার অবশ্যম্ভাবী ফল দ্বিতীয় স্বামীকে ছেড়ে কিশোর জিব্রান তার বোন সুলতানা আর আগের পক্ষের সন্তান পিটার ও মারিয়ানাকে নিয়ে জুবেই বন্দর হতে ফিরে আসা আমেরিকার বোস্টন শহরে। বাকি জীবনটুকু কামিলার কাটে বাড়ি বাড়ি লেস বিক্রী করে আর সাহিত্যমোদী ও চিত্রকর ফ্রেড হল্যান্ডের ক্যানভাসের সামনে পোর্টেট মডেল হয়ে দাঁড়িয়েই। ১৯০২এ কামিলা মারা গেলেন দুরারোগ্য ক্যান্সারে, একই বছরে তাঁর সৎ ভাই পিটার ও বোন সুলতানাও মারা যান। আর ঘুমহীন একটা বেলুনের মতো গাঢ় সূর্যাস্তের নিচে উড়তে থাকেন কিশোর জিব্রান; কেবল এক অস্বস্তিকর শীত ও জড়তা জিব্রানের প্রাচীন কিথারাটি বাজিয়ে তুলত, রক্ত অনুসরন করে ছুটে আসত এক বরফসাদা রং; অথচ দুঃখ জিব্রানকে কখনও নিঃশব্দে ভেঙে পড়তে দেয়নি, ঠেলে দেয়নি পাপকীর্ণ কোনো টোল খাওয়া বাতাসে, কেবল এক প্রার্থনা, প্রার্থনা যেন জিব্রানের একটা স্বভাব, যেখান থেকে তিনি অভাব অনুভব করছেন সেখান থেকেই যেন বারবার সচেষ্ট হয়েছেন অভাবমোচনের। তিনি পারছেন না, সর্বশক্তিমানকে আশ্রয় করছেন, প্রাণের মধ্যে স্মরণ করছেন তাঁকে; আর এভাবেই যেন নির্জনতার অন্ধকারেও খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক প্রকাণ্ড শোভাযাত্রা। তাঁর কবিতার সাথে তাঁর ছবির হয়তো অনেকাংশেই মিল নেই, কিন্তু এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী হিসেবে তাঁর চিত্রপটেও ধরা দেয় এক স্বতন্ত্র স্রষ্টার উত্তরণ। অবয়বের মাঝেই গড়ে ওঠে এক অন্তর্লীন হারমনি। মাঝে মাঝে দেখা যায় ছবি আঁকার আগে তিনি হয়তো কল্পনা করে নিয়েছেন তাঁর কবিতারূপ তাঁর কল্পরূপ, আবার কখনও বা কবিতা সেখান থেকেই শুরু হয়েছে যেখানে তাঁর ছবি কলমের হাতে ছেড়ে দিয়েছে তাঁর আকারের জগত, অজস্র প্রবেশদ্বার। তাঁর বেশিরভাগ ছবিতেই ব্যক্তির তীব্র অভিব্যক্তির অন্তরালেও কোথাও রয়ে গেছে আলোচক জিব্রান কবি জিব্রান, রয়ে গেছে ব্যক্তিক আলো আঁধারীর বাইরে বর্গের অবচেতন। ‘পেইন’, বা ‘কামিলা‘ ছবির প্রতিমাভঙ্গীতে প্রতিফলিত হয়েছে প্রতিচ্ছায়াবাদী এক জ্যামিতি, পথ সন্ধানী এক ইর্টানাল জয়, যেন এলিজিক জীবনেও শান্তরঙের বাণী বিতর্ণ করেছেন জিব্রান। প্রুশিয়ান নীল দুঃখের মাঝেও জিব্রান শান্ত স্থির, যেন পচনের মর্মমূলেও ঘৃণা বা বিদ্বেষের গরল নয় বরং অকলুষ বিশুদ্ধ প্রেমই তাঁর আশ্রয়; মা কামিলার যে আত্মপ্রতিকৃতি তাও যেন অধিকার করেছে এক সর্বজনীন আধ্যাত্মিক উৎসবের অর্ঘ্য হয়ে। যেন তাঁরই বাবা খলিল বে-কে ক্ষমা করে দিয়েছেন কামিলা, ক্ষমা করে দিয়েছেন এই জন্মান্ধ সমাজের অস্থাবর সত্যকে, কোথাও যেন নুড়ির মতো গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে এক ডিটাচমেন্ট, গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে রিলিফ; আসলে তাঁর কাছে দুঃখও সবুজ সুগোল, সে যেন সাদা পোশাক পরে স্বর দিচ্ছে আমাদের সুস্থতায়। প্রাচীনতা সেখানে কোথাও নেই। নিঃশব্দ পাতা ঝরার মধ্যেও সেখানে রয়েছে এক বিশুদ্ধ বনানী। কোথাও কি তিনি পিছিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন? হেরে যেতে চেয়েছিলেন! আত্মসর্মপন বোঝাতেই কি ব্যবহার করেছেন সাদা রঙ? নাকি শুদ্ধতা, প্রজ্ঞার আর সারল্যেরই প্রতীক কামিলা! যার নিবেদনের ভার নিয়েছেন জিব্রান। কোথাও কিছু যুক্ত করতে চাননি জিব্রান, তাঁর ছবিও যেন এই অভিলাষের কথা বলে, বলে সভ্যতার জালিবোট ফাঁকা করে দিয়ে শাশ্বত সিডারের বনে এক গুঞ্জনহীন ঠিকানা খোঁজা। কোন্‌ ঠিকানা খুঁজতে চেয়েছেন জিব্রান! তাঁর পারিবারিক দলিলপত্রে তাঁর পুরনো মুদ্রাগুলোতে যে বিস্তর ধূলো তা সরালে আমরাও কি পেয়ে যাই চেতনার সব কটি দূর বিস্মরণ! ‘পেইন’ ছবিতে যীশুর আদলেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে এক রমণীকে আর তাকে ঘিরে আরও দুই পুরুষ। চার্চের পরিপ্রেক্ষিতে নীল রঙের যে অতিরিক্ত কিছু ব্যঞ্জনা আছে -- মনে পড়ে যায় ধীমান দাশগুপ্তের সেই উক্তি। নীল যেন এক নির্মলতার প্রতীক, আন্তরিকতার প্রতীক। ঠিক কোন্‌ প্রায়শ্চিত্ত করতে তাঁর অবয়বেরা হাত পেতেছে অবশ এক ফালিতে, হাত পেতেছে সেই পুঁজগন্ধ পেরেকে! তাদের কাঁপতে থাকা শরীরের থেকে মৃত্যু নয় বরং জিব্রান অবাধে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন সেই ঈশ্বরকে, সেই ঐশ্বরিক চেতনাকে, যার কাছে ধরা দিতে এক অশ্রুত অপূর্ব আগুনে বার বার পুড়তে চাওয়া যায়, বার বার শ্বাস নেওয়া বন্ধ করা যায় স্রেফ ঈশ্বরের সাজানো বাগানে নামার জন্য, একটিবার ছোঁওয়ার জন্য ঈশ্বরকে, তাঁর ‘সিফন সীমানা’কে। And what is it to cease breathing but to free the breath from its restless tides,that it may rise and expand and seek God unencumbered ।
জিব্রানের প্রেমপর্বেও বিচিত্র উল্কির ছোপ। বিশারি গ্রাম, পবিত্র সিডার বন একা ও অস্পষ্ট এক যৌথস্বপ্নের মতো লেগেই ছিল জিব্রানের ক্যানভাসে, যেন কোনো দিনই ছাড়তে পারেননি জলের দরে কিনে রাখা এমন স্মৃতি। তখন সদ্য সদ্য মারা গেছেন মা, মারা গেছেন সৎ ভাই ও নিজের বোনও; বিপর্যস্ততার মাঝেই নৈঃশব্দ্যতার কাছে অবনত হয়েছেন জিব্রান, ধরেছেন সংগীত নিয়ে ‘আল মুসিকা’ লেখার কাজ। ঊনিশশো তিনের মাঝামাঝি এ সময়েই বোস্টনের ওয়েলেসলি কলেজে চলছিল তাঁর ছবির একক প্রদর্শনী, যেখানে জিব্রানের প্রেমে পড়ে যান বছর দশেকের বড় এলিজাবেথ হাসকেল। তেইশ বছর ধরে একটানা চলে মারোনাইট জিব্রানের সাথে ইংরেজি সাহিত্যের দিদিমণি এলিজাবেথের অদ্ভুত সুরের খেলা, তাঁদের অকথিত চাওয়া-পাওয়া। তাঁদের অতীন্দ্রিয় অনুভূতি ভেঙে টূকরো টূকরো হয়ে জমা হয়ে থাকে তেইশ বছরের চিঠিপত্রে। এলিজাবেথই নিজের খরচে জিব্রানকে পাঠিয়েছিলেন প্যারিসে ভাস্কর অগাস্টিন রোঁদিনের কাছে পাথর ভাঙার কৌশল শিখতে, যা তাঁর ভাষায় নিয়ে আসে এক নতুন সংস্কারমুক্ততা এক নতুন প্রয়োগবোধ; তাঁর কবিতা ছবি একা না থেকে জগৎকে স্বীকার করতে শেখে, বাইরের জগৎ তাঁকে সম্ভব্যতার কথা বলে, নিজের চারপাশের দেখা পৃথিবীর থেকে জিব্রান কোথাও পাতিয়ে নেয় সেই বিশ্বজনীন আওয়াজ, সেই অ্যাবস্যুলিউট ওরিজিনাল সেই অবধারিত আনন্দ ধ্বনি। ততদিনে ‘আল মুসিকা’ লেখা শেষ করে ফেলেছেন জিব্রান, প্যারিসে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসেও শিক্ষানবিসের কাজ শেষ। প্যারিসে বসেই তিনি কুহকের মতো ছটফট করেছেন এলিজাবেথের জন্য, লিখে চলেছেন একের পর এক চিঠি। ঊনিশশো তেইশ-এ জ্যাকব নামের একজনকে বিয়ে করে এলিজাবেথ চলে যান জর্জিয়া, আর ততদিনে নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন জিব্রান। অথচ উদ্বেগ উৎকন্ঠার শেষেও তাঁকে দেখা গেল না পথচ্যুত, পাওয়া গেল না পার্থিব অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বরং অনুভূতির চরম উচ্চগ্রামে তিনি যেন মহাশূন্যের সর্বোচ্চ ঘনতায় লিখলেন তাঁর প্রকৃত খসড়া। ঊনিশশো বাইশের বারোই মার্চ হাসকেলকে লেখা চিঠি থেকেই বোঝা যায়, জীবন মৃত্যুর বাইরে তাঁর ভালোবাসার স্থিরবিন্দু ঠিক কোথায়। মেঘ যেখানে শেষ হচ্ছে ঠিক সেখানেই তাঁর হাওয়াকল কীভাবে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আবহমান হরিনাঙ্ক। That deepest thing, that recognition, that knowledge, that sense of kinship began the first time I saw you, and it is the same now - only a thousand times deeper and tenderer. I shall love you to eternity. I loved you long before we met in this flesh. I knew that when I first saw you. It was destiny. We are together like this and nothing can shake us apart.
বন্ধুতা প্রসঙ্গে জিব্রান যখন বলেন, বন্ধু তো সেইজন, যে এলে বুঝতে পারবে আলো, আলো আসছে। সে তার নিজেরই জমিতে বীজ পুঁতবে আর ফসল তুলবে অবারিত কৃতজ্ঞতায়। সে তো স্বর্গীয়, অপার্থিব, আনন্দের মধ্যেই জন্ম নেই সেই পাখালি নিস্তব্ধতা। বন্ধুতায় প্রত্যাশা রেখো না। যদি রাখো তবে তা বন্ধুতা নয়, সে শর্তহীন, বেহিসেবী, তোমার সবটুকু ভালো উৎসর্গ কর এমনই বন্ধুতার জন্য। সে যদি শূন্যতাকে ভাটা বলে তবে তাকে জানাও জোয়ার এখুনি আসবে। এখুনি আসবে আবহমান জলধারা। শ্রাবণময় শূন্যতা তাকে দেখিও না বরং তার ভেজা আঙুল ধরে বেঁচে ওঠো, বাঁচিয়ে তোলো তাকেও এমনই এক জলীয় সন্মোহনে। দুজন পরস্পরকে আলোকিত কর, যে আলো আত্মময় যে আলোয় সব রং হয়ে গেছে তোমার বাড়ি, যে আলোয় সজীবতা আসছে থেকে থেকে, জীবন আসছে থেকে থেকে। ঠিক এখান থেকেই ঠাওর হয় জিব্রানের বিশাল বাগানে তিনি আসলে একা নন, পাশাপাশি হেঁটে চলেছে যে বিবিক্ত বনভূমি, যে স্থবির গোধূলি, যেন তাদের কাছেই বুঝে নিতে চান মানুষের ভাষা, কুড়োতে চান মিলনলগ্নের গন্ধ।
আসলে জিব্রানের শেওলা জমা কন্ট্যুররেখাগুলো ভালোবাসা থেকেই এসেছে আর আবার ফিরে গেছেও ভালোবাসার আশ্রয়ে। ঊনিশশো একত্রিশে মৃত্যুর আগে তিনি যেন তাই ফিরতেও চেয়েছিলেন তাঁর নিরাসক্ত আরক্ত সময়ের দিকে, ফিরতে চেয়েছিলেন জলপাই গাছের ছায়ায় ঘেরা বিশারি গ্রামে, মার সারকিস চ্যাপেলের কাছে বারবার যেন বলতে চেয়েছেন পথ দেখতে না পেলে ভেতরে কীভাবে যাব! ‘দ্য প্রফেট’ বই-এর সেই তৃষ্ণারহিত প্রফেট, যিনি বারো বছর থাকার পর এক স্বতঃস্ফূর্ত সমর্পনের দিকে ফিরতে প্রস্তুত, যার দিকে ভেসে আসছে সেই অভ্রান্ত জাহাজ, সেই মাতৃগৃহে ফেরার অমোঘ আনন্দ, সে কি জিব্রান স্বয়ং নন? প্রফেটের আদলে জিব্রানই তো সম্পূর্ণ আলো না হওয়া অবধি অস্থির হয়ে আছে। পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়লেও ভ্রমণ যে আবহমান, পথের রেখা দিয়েই তৈরি যে আমাদের পার্থিব -- শূন্য থেকে কোনো কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না। আসলে সৃষ্টি বলে হয়তো কিছুই নেই; যা আছে তা প্রকাশ মাত্র। এই উদ্দেশ্যহীন তরঙ্গময়ী জীবনলীলার শেষে পাকা ফলের মতো কেবল কিছু ছড়িয়ে যাওয়া, সে কিছুই বলতে চাইছে না কেবল পৌঁছতে চাইছে হাওয়া শব্দটার কাছে, যে খুলে দেবে তার বেড়া, তাকে ছড়িয়ে দেবে এই বিশ্বশব্দের মাঝে। জিব্রানও তো তাই চেয়েছিলেন, বারবার দূরে সরে যাওয়া অথবা বারবার ফেরা। আসলে এক আশ্চর্য মরুময়তা বা শূন্যতার পেছনেই ছিল তাঁর ফসলের ক্ষেত। সেখানে তাঁর শব্দ ছোট অবস্থান, ছোট কিন্তু অনুরণন! সে তো দানা হয়ে কুরে কুরে খাচ্ছে দীর্ঘ দীর্ঘতম পরিসর। তিনি নিজেকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন অথবা দাঁড় বাইতে চেয়েছেন একটা পৌঁছনো অবধি, অথবা একটা সর্বতো ফেরা অবধি। এক সম্পূর্ণ মানুষের কাছেই এক সম্পূর্ণ ‘আত্মজৈবনিক অধ্যাত্মবিভার’এর কাছেই রেখে দিতে চেয়েছেন তাঁর কবিতার শিরোনাম, তাঁর যাবতীয় রূপকল্প যা কেবল শব্দ নয় কেবল শোনার জন্য যার আয়োজন নয়, যার জোয়ারে বেঁধে থাকার জন্য নয় যার ভাটাতে ভেসে থাকার জন্য নয়, বরং বারবার বিশ্বনিয়মের সাবেকি আবহাওয়ায় এক সক্ষম প্রস্তুতি এক অরক্ত সময়ই খুঁজেছেন জিব্রান; সাপ্তাহিক স্বত্ত্বার ভেতর কোথাও তিনি সেই স্পিরিচ্যুয়াল টিচার যিনি আদতে সৃষ্টির অতীত আর সৃষ্টির অভিব্যক্ত -- এই এক ও বহুকেই নাড়াচাড়া করেছেন জগতের জাগ্রত জগতের অতীত হিসেবে। এই তাঁর বাকশস্য, এই এক প্রফেটের ডিস্ট্যান্স মেলোড্‌ এই সেই পর্যটনবিষয়ক রচনা যা রেখে গেলেন জিব্রান, রেখে গেলেন এক শেকড়প্রক্রিয়া যা শরিকহীন যা প্রতিনিয়ত পাঁচ পৃষ্ঠা জীবনের কাছে গোল্লা পাকানো মানুষগুলোর কাছে জানতে চায় --“Stranger, Stranger, lover of unreachable heights, why dwell you among the summits where eagles build their nests?why seek you the unattainable?what storms could you trap in your net, and what vaporous birds do you hunt in the sky?
COME and BE OnE OF US….
COME and BE OnE OF US….

এক কণা বালির মতো আমরাও কি বুদবুদকে বলি আরও একটু এগোই, চলো আরও একটু!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন