কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৩

০৬ লিপিকা ঘোষ

তরী
লিপিকা ঘোষ



রূপ। একটা নাম, রূপবানও হতে পারত। নামটা রূপক। ছোটতে রূপকের ঠাকুমা ডাকতেন, ‘রূপ, অ রূপ, কই গেলি?’ রূপের কোনো সাড়া শব্দ নেই। মায়ের বকুনি খেয়ে চুপ করে বাগানে বসে আছে। রূপ কখনো কাঁদে না। সাংঘাতিক সব দুষ্টুমি করে মা’র কাছে বেধড়ক মার খেয়েও কোনোদিন চোখ থেকে একফোঁটা জল বেরোয়নি। মাঝে মধ্যে খুব অভিমান হলে একটা লাঠির ডগায় পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে দেশান্তরী হতে রওনা দিত ছোট্ট রূপ। এখন শেষবেলায় এসে নাগাল পায় না ও আসলে কে? রূপ? অ-রূপ? না কি সত্যি একটা রূপক?

রাজারহাটের ফ্ল্যাটে বারান্দায় একা বসে আছে। সন্ধ্যার মা একটু পরেই রান্না সেরে চলে যাবে। মেঘ করেছে খুব। সকালে এক পশলা ঝরল। পুজোর আগে প্রায় সব ক’টা ছুটির দিনেই বৃষ্টি লেগে থাকছে। তাতে অবশ্য রূপকের কোনো অসুবিধে নেই। বিদ্যুৎ চমকালে মেয়েটার মুখ মনে পড়ে। এখনও সেই একই রকম ভয় পায় মেয়েটা? মোবাইলটা বেজ়ে উঠল, ‘কাকু, প্রেসার চেক করিয়েছো?’ ‘হ্যাঁ রে নীলু, ঠিক আছি, চিন্তা করিস না’। টুকটাক কিছু কথা হলো নীলের সঙ্গে। নীল, ওর ভাইঝি-জামাই। ছেলেটা খুব ভালো। রূপকের-ই ছাত্র ছিল। ওর অন্ধ ভক্ত বলা যায়। প্রায় প্রতিদিন ওর খোঁজ নেবে। প্রয়োজনে সব কাজ ফেলে চলে আসে। রূপক তো একলা মানুষ। অথচ রূপকের ভরাট সংসার। সবরকম ভাবে সফল পরিপূর্ণ একটি মানুষ। এখন ওর একমাত্র ছেলে মা বৌকে নিয়ে আলাদা থাকে। ন’মাসে ছ’মাসে খোঁজ নেয়, তাও দায়ে পড়ে। রূপকের হাসি পায়। এই বুবাই এক রাতও বাবাকে আঁকড়ে না ধরে ঘুমতে পারত না। একটা সময় এলো যখন রূপক ক্রমশ বুবাই আর মনিকার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। অথচ দায়-দায়িত্ব কর্তব্য ভালোবাসায় তো কোনো অবহেলা ছিল না রূপকের। সাহিত্যজীবন, কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ওর স্ত্রী মনিকা কথাটা তুলল। বুবাই মা’কে নিয়ে আলাদা থাকতে চায়। রূপক বাধা দেয়নি। তারপর ওরা নতুন ফ্ল্যাটে চলে যায়। ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র পায় রূপক। খুশি মনেই আশীর্বাদ করতে গিয়েছিল। গিয়ে বুঝল, বড় ভুল হয়ে গেছে।

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। ‘দাদাবাবু, খাবার ঢেকে রাখলাম। খেয়ে নেবেন। দেরি করবেন না। আজ রাতে আসতে পারব না। বারাসাত যাব ভাইয়ের বাড়ি। পুজোর দেওয়া-থোওয়া, ১২ই আশ্বিন হয়ে গেল আজ’। সন্ধ্যার মায়ের মাইনেটা আগাম দিয়ে দিল রূপক, সঙ্গে বাড়তি কিছু। দুপুরের খাওয়া শেষ করে নিয়ম মাফিক ওষুধগুলো খেয়ে বারান্দায় এসে বসল। ইস্‌ এই বৃষ্টিতে সন্ধ্যার মা গেল কেমন করে? ছাতা আছে কিনা জিজ্ঞাসাও করা হয়নি। মোবাইলটা বেজে উঠল। মনিকার ফোন। ‘খেয়েছো?’ ‘হ্যাঁ’। ‘আজ় বুবাইয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে সকলে আসবে’। ‘বাহ, ভালো তো’! ওপাশে কিছুক্ষণ চুপ। নতুন বংশধর আসতে চলেছে, রূপক জানে। প্রথম যখন নীলের কাছে খবরটা পায়, নিজেকে সামলাতে পারেনি, ছুটে গেছিল পুত্রবধূকে আশীর্বাদ করতে। সেদিনও অপ্রস্তুত। ‘চিন্তা কোরো না, আমি হঠাৎ উপস্থিত হবো না’। ‘সেটা না করাই ভালো, তোমার সোনার তরীর কথা জানতে তো কারো বাকি নেই আর’! কট করে ফোনটা কেটে দিল মনিকা।

মনিকা ঝকঝকে তকতকে আধুনিকা ঝলমলে এক মেয়ে ছিল। প্রেম, সংসার, চাকরি, স্বামী, সন্তান সবকিছু নিয়ে ভরপুর এক মেয়ে। মনিকার প্রতি ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি ছিল না রূপকেরও। সোনার তরী... মেয়েটা ওকে ‘সোনার তরী’ বলে ডাকত। ‘রাশি রাশি ভারা ভারা’ সোনার ধানে নাকি পূর্ণ হয়ে উঠেছিল রূপকের জীবন। আর মেয়েটা নাকি ‘কূলে একা’ বসে আছে। শেষ মেসেজ পাঠিয়েছিল অভ্রকে, ‘যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী’। তারপর আর কখনো মেয়েটার সঙ্গে কারও যোগাযোগ হয়নি। কোথায় কতদূরে আছে মেয়েটা! একবার যদি সামনে এসে দাঁড়াতো! অনেক কথা বলার আছে রূপকের। যা বছর কুড়ি আগে ও কিছুতেই বলতে পারেনি। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেক খোঁজ করেছে রূপক মেয়েটার। কেউ বলতে পারেনি। অনেক চেষ্টা করে শ্রাবস্তীর ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোন করলো, ‘শ্রাবস্তী, আমি রূপক বলছি, পূর্বাশার খবর জানো?’ ‘আমাকে আর ফোন করবেন না কখনো’ বলে ফোন কেটে দিল শ্রাবস্তী। শ্রাবস্তী পূর্বাশার সবচেয়ে কাছের আর একমাত্র বন্ধ। রূপকের অনেক কিছু বলার ছিল, মেয়েটার মুখ মনে পড়ে। সংসারের দায়িত্ব কর্তব্য, লেখক জীবনের যশ খ্যাতি সব কিছুর মধ্যেও ঐ একটা মুখ ওর মনের মধ্যে জেগে থাকত। জোর করে ভুলতে চেয়েছে, নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছে ‘পূর্বাশা নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে, বিয়ে করে সংসার করছে’! কিন্তু কিছুতেই রূপক এক মুহূর্ত ভুলে থাকতে পারেনি পূর্বাশাকে। বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে, অনেক কিছু বলার আছে রূপকের।

কলিংবেল বাজল। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। এ সময়ে ওর কাছে আবার কে এলো? দরজা খুলে দেখে, একটা আধভেজা ছেলে, ক্যুরিয়ার আছে। প্রেরক শ্রাবস্তী সরকার। প্যাকেটটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে তাড়াতাড়ি খোলে, পূর্বাশাকে দেওয়া রূপকের লেখা দুটো বই, রূপকের লেখার কিছু জেরক্স, একটা রঙচটা মোবাইল ফোন, কিছু পুরনো ছবি। সঙ্গে একটা ভাঁজ করা কাগজ। তাতে পূর্বাশার হাতের লেখায় শ্রাবস্তীর কারুকার্য, ‘এই সবগুলো সোনার তরীকে পাঠিয়ে দিস’। রূপকের বইয়ের ভেতর থেকে একটা শ্রাদ্ধের কার্ড বেরিয়ে এলো, আদ্যশ্রাদ্ধ ও ব্রাহ্মণভোজন : ১২ই আশ্বিন।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন