কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৩

০১ অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

‘খড়ের প্রতিমা পূজিস রে তোরা...’
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী



সাধারণভাবে বাঙালি হিন্দুসমাজে বাৎসরিক দুর্গোৎসবকে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ বলেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে, আর এই আগমনীর সুরই যে তার প্রাণের তন্ত্রীকে বারেবারে নাড়া দিয়ে যায়, এ নিয়ে বোধ হয় বিশেষ তর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু সেইসঙ্গে এই প্রশ্নটিও ভেবে দেখা যায় যে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাঙালির প্রাণবীণায় সবসময় কি আনন্দের সুরই বেজেছে? কখনও কি প্রতিবাদী সুরও শোনা যায়নি? আনন্দের গানের সঙ্গে কখনও কি বেজে ওঠেনি বেসুর তান?

এদেশে ব্রিটিশ শাসনের পত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় ইংরেজ রাজপুরুষদের অনুগ্রহ লাভের তাগিদে এক শ্রেণীর উঠতি ও বনেদি বিত্তবানেরা নিজেদের বাড়িতে দুর্গোৎসবের আয়োজন ক’রে সেই উপলক্ষে খানাপিনা, নাচগান ও লাগাম-ছাড়া হৈ-হুল্লোড়ের একটা পরম্পরা তৈরি করে। আবার শিক্ষিত বাঙালি মানসে এই অবাঞ্ছিত পরম্পরার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী সুরও জেগে উঠতে থাকে। এই দুর্গোৎসবকে উপলক্ষ করে আড়ম্বরের আতিশয্য, অপচয় ও সাধারণ মানুষের প্রতি অবহেলা ইত্যাদির বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, কবি ও সাংবাদিকদের ধিক্কার ধ্বনিত হতে দেখা যায়। তারপর ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিবাদী সুরে যুক্ত হয় নতুন কিছু বিষয়। ধর্মীয় উৎসবের নাম করে ইংরেজদের খোশামোদ, শক্তির আরাধনা আর জাতীয় জীবনে দুর্বলতা ও ক্লৈব্যের সহাবস্থান এবং তথাকথিত আনন্দ-উৎসবের মধ্যে অর্থনৈতিক দুরবস্থার তিক্ত যন্ত্রণাকে বিষয়বস্তু করে রচিত হয়েছে অনেক ব্যঙ্গবাণী ও ধিক্কার-কবিতা।

আঠারো শতকের বাঙলার সবচেয়ে পরিচিত সামাজিক নকশার রচয়িতা হুতোমের লেখায় বাঙালি বাবুসমাজের দুর্গোৎসব-কেন্দ্রিক কান্ডকারখানা নিয়ে প্রচুর মোলায়েম ব্যঙ্গ ছড়িয়ে আছে। দুর্গোৎসবের মূলে রয়েছে পৌত্তলিকতা, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হুতোমের আক্ষেপ -- “কত কত কৃতবিদ্য বাঙালি সংসারের ও জগদীশ্বরের সমস্ত তত্ত্ব অবগত থেকেও হয় সমাজ, না হয় পরিবার পরিজনের অনুরোধে পুতুল পূজে আমোদ প্রকাশ করেন।” [‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’] বাবুদের দুর্গোৎসবের নানা দৃষ্টিকটু প্রথা ও কেতা এ-ভাবে তাঁর তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের লক্ষ্য হয়েছে। এই সব প্রথার কয়েকটির উল্লেখ এখানে করা যেতে পারে। বাবুর বাড়ির পূজোতে এসে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের পুরোহিতের সামনে বা কর্মকর্তা বাবুটির সামনে প্রণামীস্বরূপ টাকা দিতে হতো এবং সে-জন্য বাবুটি সামনে গোলাপপাস, আতরদান সাজিয়ে “পয়সার দোকানের পোদ্দারের মতো বসে থাকেন” এবং সে-জন্য নিমন্ত্রিতদের সেঁধুতে ভরসা হয় না, “পাছে কর্মকর্তা তেড়ে কামড়ান”। হুতোমের ভাষায় “কর্মকর্তার ব্যাভার দেখে প্রতিমে পর্যন্ত অপ্রস্তুত হন।”

হুতোমের মতো সামাজিক নকশা সেকালে শ্রী দশ অবতার, টেকচাঁদ ঠাকুর জুনিয়র প্রমুখ আরো কেউ কেউ রচনা করেছেন। শ্রী দশ অবতার রচিত ‘আসমানের নকশা’য় বাবুদের দুর্গোৎসবের বর্ণনার ছলে পূজোতে সাত্ত্বিক মিষ্টান্নের সঙ্গে নিষিদ্ধ ভক্ষ্য ইত্যাদিরও যথেচ্ছ প্রচলন, ব্রাহ্মসমাজের উৎসাহী ভক্তদেরও পৌত্তলিকতার ভন্ডামি ইত্যাদিকে আক্রমণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে-পুরোহিত বাবুর কাছ থেকে হবিষ্যের পয়সা নিয়ে ‘দিব্বি মাছ ভাত খেয়ে’ ষষ্ঠীর রাতে তন্ত্রধারককে নিয়ে বোধন করতে এলেন ও অকুতোভয়ে মৃতের তর্পণের মন্ত্র পড়ে প্রতিমার চক্ষুদান করে ফেললেন, তার সঙ্গে সঙ্গে এই নকশায় কশাঘাত করা হয়েছে শ্বেতাঙ্গ-স্তাবক হিন্দুদের আর আলোকপ্রাপ্তির দাবিদার ব্রাহ্মদেরও -- “পূজা ও বলিদানের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালিদের সভ্যতার পরিচয় হয়ে থাকে। যারা আপিসে ‘আমি হিঁদুয়ানি মানিনি’, ‘আমার কোনো প্রেজুডিস নেই’ বলে সায়েবদের সঙ্গে খানা খেয়েছেন, তাঁরা আজি কোমর বেঁধে কাদামাটি মেখে কাদামাটি করবেন। ...হায়! এ রকম লোক হতেই বাঙ্গালিদের ‘হিপোক্রিট’ নামটি সৃষ্টি হয়েছে।”

এই নকশাকারদের তুলনায় সাংবাদিকদের ভাষা ও বক্তব্য স্বভাবতই অনেক সোজাসুজি। যেমন ধরা যাক, ১৮৩৩ সালে ‘জ্ঞানান্বেষণ' পত্রিকাটি পূজা উপলক্ষে ‘স্বীয় পরিশ্রমের এবং পিতৃপিতামহাদির সঞ্চিত সম্পত্তি’ এ-দেশের লোকেরা নাচগানে ব্যয় করে বলে ক্ষুণ্ন হয়ে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, এ-সব ধর্মের অঙ্গ নয় এবং “আবশ্যক বিষয়ে শৈথিল্য করিয়া অনাবশ্যক বিষয়ে অধিক ব্যগ্র’’ দেখলে তা নিবারণের চেষ্টাই করা উচিত। ১৮৯৩ সালে বাবুদের দুর্গোৎসবের নাচগান দেখতে খৃস্টানেরা অল্প সংখ্যায় এসেছিলেন – এতে খুশি হয়ে পত্রিকাটি আশা প্রকাশ করেছিল যে, জনসধারণ এ-সব বিষয়ে একেবারে উৎসাহ পরিত্যাগ করলে ‘জ্ঞান ও সুনীতি ও অন্যান্য বিদ্যার আধিক্য’ হবে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশের ‘লোকদিগের আহ্লাদে’র প্রতিবন্ধক হতে না চেয়েও পত্রিকাটি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিল -- “পুত্তলিকাপূজাদিকে আমরা ঘৃণিত ব্যাপার কহি”।

‘সম্বাদ প্রভাকর’ পত্রিকাটি অবশ্য পৌত্তলিকতার সমালোচক নয়, বরং নব্যদের দৃষ্টিতে ভগবতীস্বরূপা দুর্গা পুতুল ছাড়া আর কিছুই নন, এখানেই তার ক্ষোভ। ১৮৫৯ সালে পূজা প্রসঙ্গে এই কাগজটির মন্তব্য -- “প্রাচীনেরা যে শারদীয়া পূজার জন্য ধূপ দীপ বাদ্যাদির উদ্যোগ করিয়া থাকেন, নব্যেরা সেই উৎসবের জন্য শেরি, সেমপিন ও বেরান্ডির আস্বাদন করিতে ব্যস্ত হয়েন।” আবার বাবুদের দুর্গাপূজায় নাচগানের ঘটা, সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে আনা, সান্ত্রী বসিয়ে ভিড় আটকানোর জন্য সাধারণ দর্শণার্থীদের বেত্রাঘাত ইত্যাদি ন্যক্কারজনক ব্যাপার সম্পর্কে ‘সমাচার দর্পন’ পত্রিকায় বিরূপ মন্তব্য দেখা যায়। বাবুদের পূজার নামে এই সব অনাচারের ছবি আছে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় -- “...এসেছিল দ্বারে পূজা দেখিবারে দেবীর বিনীত ভক্ত,/ কেন যায় ফিরে অবনত শিরে অবমানে আঁখি রক্ত?/ উৎসবশালা, জ্বলে দীপমালা, রবি চলে গেছে অস্তে--/ কুতূহলীদলে কি বিধানবলে বাধা পায় দ্বারী হস্তে ?/... না না এরা সবে ফিরিছে নীরবে দীন প্রতিবেশীবৃন্দে, --/ সাহেবসমাজ আসিবেন আজ, এরা এলে হবে নিন্দে।” [‘উন্নতিলক্ষণ’]

দুর্গাপূজায় সাত্ত্বিকতার অভাব দেখে ১৮৭৯ সালে ‘সুলভ সমাচার’ লিখেছিল -- “পালপার্বনে দেবভক্তি যত থাকুক, না থাকুক, পেটপূজাটা ষোড়শোপচারে চলে ভাল।” ‘ছুটির সুলভ’-এ ১৮৭৯ সালের এক কবিতায় দেখা যাচ্ছে, দেবী দুর্গা মর্ত্যে এসে মা মেনকার কাছে বঙ্গবাসীদের সম্পর্কে অভিযোগ জানাচ্ছেন -- “অন্ন বিনা ছন্নছাড়া হইনু গো আমি, পূজায় নাহিক ভক্তি, কেবল ভন্ডামি। / ...আমার নামেতে মদ বোতলে বোতলে / ঢালে আর খায় সবে পড়ে ধরাতলে।” [‘আগমনী’] সেকালের বিখ্যাত ব্যঙ্গ-পত্রিকা ‘বসন্তক’ দুর্গাপূজার নামে এই সাহেব-তোষামোদের উদ্দেশ্য যে সরকারি খেতাব বা উপাধি অর্জন, সে ব্যাপারে কটাক্ষ করে একটি কবিতায় এক গরিব ব্রাহ্মণের জবানিতে বলেছিল -- “উপাধিতে মান পেলে যত স্বজাতিরে। / বাঁচুক মরুক তারা, তাকাবো না ফিরে।...” [‘বসন্তকের দুর্গোৎসব’]

উনিশ-বিশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও দুর্গোৎসবের সঙ্গে মিশে যাওয়া নানা কুরীতিকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি। ‘কলকাতা কমলালয়’-প্রণেতা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গোৎসবকে ‘ঝাড় উৎসব’, ‘কবি উৎসব’, ‘বাই উৎসব’ ইত্যাদি নাম দিয়েছিলেন। রাজা কালীকান্ত ও রাজা রাধাকান্ত দেবের মতো হিন্দুদের বাহ্য ঠাঁট বজায় রাখার জন্য মদ্যপান ইত্যাদির নিন্দা করেছেন রাজনারায়ণ বসুর মতো হিন্দুরা। ‘বেঙ্গল হরকরা’ এঁদের পরামর্শ দিয়েছিল অপচয় কমানোর, আর কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন -- “রাখ মতি রাধাকান্ত, রাধাকান্ত পদে।/ দেবীপুজা করি কেন টাকা ছাড় মদে।।” সাহিত্যিক অক্ষয়চন্দ্র সরকার হুতোমের মতোই দুর্গাপূজায় পূজারী পুরোহিত, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের ভন্ডামি ও প্রবঞ্চনাকে উদ্ঘাটিত করেছেন তাঁর ‘মহাপূজা’ নামে এক রচনায়।

সেকালের সংবাদপত্রগুলো কিন্তু দুর্গোৎসবের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে প্রায়ই চরম মন্তব্য করতে দ্বিধা করেনি। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাহ্মসমাজের ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র মতে সারা বছর দেশে যত ‘দুষ্কর্ম’ হয়, দুর্গোৎসবের এই তিন দিনে তা সম্পূর্ণ হয়, যা দেখে “যথার্থ দেশহিতৈষীর মন নিরুৎসাহে পূর্ণ হয়।” নিরাকারবাদী ব্রাহ্মদের কথা ছেড়ে দিলেও অন্য পত্রপত্রিকাগুলোও কিন্তু দুর্গাপূজায় অর্থনৈতিক অপব্যয় নিয়ে কথা তুলতে ছাড়েনি। ক্যালকাটা জার্নালে ১৮২০ সালে মন্তব্য করা হয়েছিল, এই পূজাগুলির উদ্দেশ্য ভক্তি নয়, ঐশ্বর্য ও গরিমা প্রদর্শন। এর ফলে সঞ্চিত সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়ে কত পরিবার নিঃস্ব হয়েছে, তারও উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৮৩৩ সালে ‘সমাচার দর্পন’-এ গৃহস্থ লোকের দরজায় চুপিচুপি প্রতিমা ফেলে যাবার ‘কদর্য ব্যবহারে’র নিন্দা করা হয়েছিল।

বাঙালি সাহিত্যিকেরাও কিন্তু সর্বদা দুর্গোৎসবের আনন্দের সুরে তাল দেননি – প্রতিবাদী সুরও তাঁদের রচনায় ধ্বনিত হয়েছে। একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মসমাজভুক্ত বলে নয়, জনজীবনের একজন সংবেদনশীল রূপকার বলেই রবীন্দ্রনাথ “আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে”-- এটা লক্ষ্য করেও ধনীর দুর্গামন্ডপের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা কাঙালিনী মেয়েটিকে ভুলতে পারেননি। তাকে কেন্দ্র করে কবির মনে জেগে ওঠা তীব্র ও তীক্ষ্ণ প্রশ্নটি যেন আজও আমাদের বিদ্ধ করে -- “মাতৃহারা মা যদি না পায় / তবে আজ কিসের উৎসব! / দ্বারে যদি থাকে দাঁড়াইয়া / ম্লানমুখ বিষাদে বিরস,- / তবে মিছে সহকার শাখা / তবে মিছে মঙ্গল কলস!” এ-ছাড়াও নানা রচনায় দুর্গাপূজা-সংশ্লিষ্ট নানা কুপ্রথা ও অমিতাচার রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার লক্ষ্য হয়েছে, যেমন -- বাবুদের তামসিক দুর্গাপূজার চিত্রায়ন তাঁর ‘উন্নতিলক্ষণ’ কবিতায়, পূজায় বলিদানের জন্য নির্ধারিত অবোধ পশুর নিষ্ফল কান্নার ছবি ‘ছুটির আয়োজন’ কবিতায়, কিংবা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় দু’পক্ষের রেষারেষি থেকে রক্তারক্তির উল্লেখ তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে পাওয়া যায়। রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিতায়ও দুর্গোৎসব নিয়ে প্রতিবাদী সুর অলভ্য নয়। পঞ্চাশ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় মোহিতলাল মজুমদার লিখেছিলেন -- “মাতৃশক্তিপূজা নয়, মাতৃশ্রাদ্ধ দিন / বাৎসরিক – দায়গ্রস্ত পুত্র দীনহীন / করিয়াছে কোনোমতে তার উদ্‌যাপন / আজি তার বর্ষকৃত্য প্রেতের তর্পণ!’’ ‘বিজয়চন্ডী’ কবিতায় যতীন্দ্রমোহন বাগচি বলেছেন, অন্নবস্ত্রহীন দেশে ভীরু ও শঙ্কিত প্রাণের পূজা দেবী গ্রহণ করেন না -- “দুর্বল দেহ, দুর্বল প্রাণ – আনন্দহীন ভীরুর দলে -/ মৃন্ময়ী মাতা চিন্ময়ী হন কোন্‌ কল্পনাশক্তিবলে?/ বিরাট বিশ্বমাতারে বরিয়া কেমনে সে মূঢ় বাঁধিবে কাছে, / বক্ষের নীচে শূন্য জঠর হাঁ করিয়া যার পড়িয়া আছে।” স্বদেশ-সমকালের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ উৎসবের সময় ভুলে থাকা স্বাভাবিক ভাবেই এই কবিদের কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। গৃহস্থের আর্থিক অনটনের উপলব্ধি দুর্গাপূজার সময় যেভাবে হয়, তার প্রকাশ দেখা যায় তরুণ বয়সে লেখা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় -- “ হাহাকার বঙ্গদেশে টাকার জ্বালায়! / তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে আরও দায়। / কেন এসো কেন যাও, কেন চালকলা খাও / তোমার প্রসাদে যদি টাকা না কুলায়!...” একই দারিদ্র্যের কারণে আগমনীর সানাই শুনে কাজী নজরুলের মনে হয়েছে -- “ও যেন কাঁদিছে শুধু, নাই, কিছু নাই!” আবার এই কবিই রাজনৈতিক পরাধীনতার গ্লানিতে দেবী দুর্গাকে গঞ্জনা দিয়ে বলেন -- “দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি / ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?” অনেকটা পূর্বসূরি কবি যতীন্দ্রমোহনের মতোই বিদ্রোহী কবি নজরুলেরও মনে হয়েছে, পরাধীন দেশের ভীরু মানুষের দুর্গাপূজা শক্তিপূজার নামে অভিনয় মাত্র। তিনি মনে করেছেন, সংগ্রামীদের রক্তদান সার্থক হতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতায় এবং সেটাই যথার্থ আগমনী -- “বছর বছর এ-অভিনয় অপমান তোর, পুজা নয় এ / কি দিস আশিস কোটি ছেলের প্রণাম চুরির বিনিময়ে! / ...দুর্বলদের বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তিপূজা / দূর করে দে, বল মা ছেলের রক্ত মাগে দশভূজা।।...” [‘আনন্দময়ীর আগমনে’]। দুর্গাপূজাকে কবির অভিনয় মনে হয়েছে বাঙালিদের নিরস্ত্র ভীরুতা আর সুবিধাবাদ দেখে। তাই তিনি ব্যঙ্গ করে লেখেন, -- “বলি দেয় ওরা কুমড়ো ছাগল, বড় জোর দুটো পোষা মহিষ / মহিষাসুরেরে বলি দিতে নারে, বলে – মাগো, ওটা তুই বধিস্‌।।...” এই নির্মম ব্যঙ্গের শেষে তাঁর আক্ষেপ -- “দেবতারে যারা করিছে সৃজন, সৃজিতে পারে না আপনারে / আসে না শক্তি, পায় না আশিস, ব্যর্থ সে পূজা বারেবারে।” [‘পূজা অভিনয়’]। একই চিন্তা থেকে নজরুলের একটি গানেও ধ্বনিত হয়েছে মৃন্ময়ী মা’কে চিন্ময়ীরূপে দেখতে পাবার আর্তি -- “খড়ের প্রতিমা পূজিস নে তোরা, মা’কে তো তোরা পূজিস্‌নে-/ প্রতি মা’র মাঝে প্রতিমা বিরাজে – হায় রে অন্ধ বুঝিস্‌ নে।। / বছর বছর মাতৃপূজার করে যাস অভিনয়, / ভীরু সন্তানে হেরি লজ্জায় মাও যে পাষাণময়।।....”

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন