কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন / ৭ 

সারা বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন বিষয় ও ভাবনায়, বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিদিন  যে সাহিত্য সৃজন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে হয়ে চলেছে, তার সংখ্যা ও আয়তন আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে অনুমান করা একেবারেই অসম্ভব। না, এখনও পর্যন্ত তা গণনা করার কোনো পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা, আমাদের জানা নেই। আর যদি তা কোনোদিন সম্ভবও হয়, তা শুধুমাত্র পত্র পত্রিকায় এবং আন্তর্জালে প্রকাশিত লেখাগুলির স্ট্যাটিক্টিস তুলে ধরতে পারে। কিন্তু এর বাইরে যে বিশাল ও বিপুল রচিত অথচ অপ্রকাশিত রচনাসম্ভার প্রতিটি সাহিত্যসৃজনশীল মানুষের ব্যক্তিগত ভাঁড়ারে মুখ লুকিয়ে আছে, তার হিসেব নিকেষের ব্যবস্থা কী হবে! আমার একটি  সাহিত্য সন্ধ্যার কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। অনেক বছর আগে জামশেদপুরে আয়োজিত একটি সাহিত্য সভায় স্বনামধন্য সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল মশাই এসেছিলেন। তিনি তাঁর সাহিত্য আলোচনায় প্রাসঙ্গিক ভাবে এই বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছিলেন। এই যে এত সাহিত্য সৃজন হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে, তার ভবিষ্যত কী? এবং যা লেখা হচ্ছে, তা সবই তো আর মুদ্রিত হচ্ছে না! এমনিতেই  সবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত লেখা অন্য সবার পড়ার সুযোগ ঘটে না। আর যে লেখা  মুদ্রিত না হয়ে লেখকের কাছেই থেকে গেল, তা অন্য কারও পড়ার সম্ভাবনা আরও কম। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কারও লেখা অন্য কেউ পড়ার সুযোগ পেল না, বা মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র পড়ার সুযোগ পেল, তাহলে কি সেই লেখাটার প্রতি কোনো সুবিচার করা গেল না? আর যদি লেখাটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত না হওয়ার জন্য কেউই পড়ার সুযোগ পেল না, তাহলে সেই লেখাটির জন্মই কি ব্যর্থ হয়ে গেল? আসলে প্রশ্ন হচ্ছে, লেখক লেখেন কার জন্য! সহজ উত্তর হচ্ছে, পাঠক-পাঠিকাদের জন্য। কোনো লেখকের কোনো লেখা যদি কোনো পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌঁছতেই না পারে, তাহলে ভাবা যেতেই পারে, সেই লেখাটির সৃষ্টির উদ্দেশ্য মাঠে মারা গেল। আর সেক্ষেত্রে সেই লেখাটির গুণমান যেমন আদৌ বিচার করা গেল না, তেমনি সিদ্ধান্ত নেওয়াও গেল না লেখাটি বস্তুত পাতে দেবার উপযুক্ত কিনা। সুতরাং লেখক  যা কিছু লিখেছেন তা পাঠক-পাঠিকার কথা ভেবেই লিখেছেন। তা কারও পছন্দ হবে  কী হবে না, তা পরের কথা। এখন যাদের লেখা মুদ্রণের সহায়তায় প্রকাশের মুখ দেখার সৌভাগ্য লাভ করছে, তাদের সৃজনের উদ্দেশ্য না হয় চরিতার্থ হলো এবং মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো। কিন্তু যাদের লেখা মুদ্রণ ও প্রকাশের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থাকল, তাদের সৃষ্টির কি কোনো মানেই থাকল না? তারা কি সেই সৃষ্টি না করলেই পারতেন? প্রয়াত নারায়ণ সান্যাল মশাই সেদিন একটা খাঁটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সব লেখাই মুদ্রিত হয় না, প্রকাশিত হয় না। আর তা না হওয়াই ভালো। এবং আপনারা শুধু পাঠক-পাঠিকার কথা ভেবেই লিখবেন না বা তাদের জন্যই লিখবেন না। বরং নিজের জন্যও লিখুন। এবং সেই সৃষ্টির মধ্যে নিজের আনন্দটুকু খুঁজে নিন। আজ বহু বছর পর নারায়ণ সান্যাল মশাইয়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল সেদিনের এক ঘরোয়া আড্ডার পরিপ্রেক্ষিতে। এত এত যে লেখা হচ্ছে এবং সমান তালে তা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়ে চলেছে অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় ও আন্তর্জালে, এটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। আসলে সব লেখাই তো আর সমান ভালো হয় না বা মানোত্তীর্ণ হয় না। আর তাই আসল ও নকল আলাদা করা যায় না, অথচ একই দরে বিকিয়ে যাচ্ছে। গুলিয়ে যায় ভালো ও মন্দের ভাবনা। না, আমরা কারও  সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াসকে নিরুৎসাহিত করছি না আদৌ, বরং স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু সেইসঙ্গে এ ব্যাপারেও সচেতন থাকতে অনুরোধ করছি যে, কোন্‌  লেখাটি তারা শুধুমাত্র নিজের পড়ার জন্য রাখবে আর কোন্‌, লেখাটি পাঠক-পাঠিকাদের জন্য প্রকাশ করবে, এটা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা প্রয়োজন। কেননা যে  লেখাটি লেখার পর সেই লেখককে আনন্দদান করতে পারে, তা হয়তো অন্য পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিতান্তই বিরক্তির কারণও হয়ে উঠতে পারে!  

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আবার আমাদের বিনীত অনুরোধ, আপনারা অনুগ্রহ করে প্রকাশিত লেখা ও ছবি সম্পর্কে আপনাদের অভিমত ব্লগজিনের ‘কমেন্টবক্সে’ লিপিবদ্ধ করবেন। প্রতিটি লেখা ও ছবির নিচে ‘কমেন্টবক্স’ আছে।

সবাইকে আমাদের শ্রাবণী শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই।        
     
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

দূরভাষ যোগাযোগ :           
0657-2757506 / 09835544675
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

      

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


শিবাংশু দে

মন ভুলো না কথার ছলে




তন্ত্র একটি জটিল বিষয় ভারতবর্ষের আর্যকেন্দ্রিক অধ্যাত্ম ঐতিহ্যে এর স্থানটি নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণা রয়েছে বস্তুতঃ এর উৎস ছিল অনার্য উপাসনা পদ্ধতি ব্যাপকভাবে বিকেন্দ্রিত লোকাচারের মধ্যে এর উদ্ভব প্রাক বৈদিক যুগেরও আগে এবং আর্যদের পরবর্তীকালের বৈদিক আচারবিচারে, বিশেষতঃ অথর্ববেদের সময়েআগম তন্ত্রের প্রভাব চোখে পড়ে তন্ত্রের উদ্ভব বিবর্তনে সমাজতত্ত্ব রাজনীতির ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আগ্রহ পোষণ করার সূত্রে বহু ধরনে প্রবণতা লক্ষ্য করেছি ভারতবর্ষের আবহমান নিম্নবর্গীয়  সমাজতত্ত্ব, আর্য-অনার্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব বৌদ্ধধর্মের সম্পূর্ণ কায়াপলটের পরিপ্রেক্ষিতে তন্ত্রশাস্ত্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক সত্যি কথা বলতে কি, তন্ত্র সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু লিখে ফেলা আমার মতো অনধিকারীর পক্ষে অসম্ভব বিপুল  এর ইতিহাস, বিশাল এর বিস্তৃতি সচরাচর গুহ্যশাস্ত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ আগ্রহী হলেও বিষয়ে কৌতূহল নিবৃত্ত করার মতো আকরগ্রন্থ  বিশেষ পাওয়া যায় না কারণ অসংখ্য সাধক বিদ্বানের বহুধাবিভক্ত চর্চা অভ্যাসের দৌলতে সাধারণ পাঠকের উপযুক্ত সহজ আলোচনা আমাদের ভাষায় বিরল
এখানে মনে রাখতে হবে, এই গুহ্যতন্ত্রসাধনা ষোড়শ শতক পর্যন্ত এক বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল পরবর্তীকালে বিদেশী মুসলমান রাজশক্তির নিষ্পেষণে  যখন মূলস্রোতের ব্রাহ্মণ্য পূজা-আরাধনা প্রকাশ্যে, সমারোহ সহকারে উদযাপন করার পথে অন্তরায় দেখা দিল তখন উচ্চকোটীর বিপর্যস্ত ব্রাহ্মণ্যধর্ম শরণ নিয়েছিল অনার্য কৌম সমাজের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা দেবী প্যান্থিয়নের আশ্রয়ে এই সময় থেকেই তন্ত্রশাস্ত্র পূর্বতন অসংগঠিত রূপ থেকে ব্রাহ্মণ্যমনীষার যোগদানের ফলে এক বিস্তৃত স্ট্রাকচার্ড মাত্রা পেয়ে ছিল বৌদ্ধতন্ত্র সনাতনধর্মীয় তন্ত্রের মধ্যে বস্তুত কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভেদ নেই আসলে সেভাবে দেখলে তন্ত্র কোনও ধর্মীয় মতবাদ নয়, তন্ত্র এক সাধনপদ্ধতি মাত্র মনুষ্যদেহকে এক যন্ত্রস্বরূপ বিচার করে সেই সূত্রে এক গুহ্যসাধনপদ্ধতিকেই তন্ত্র বলে এই সাধনপদ্ধতিতে অনুগামীদের বিভিন্ন দেবীর নামে দীক্ষা নিতে হয় বেছে নেবার মতো অসংখ্য দেবী থাকলেও আমাদের দেশে (বাংলায়) শাক্তরা  জগদ্ধাত্রী মন্ত্রেই অধিক দীক্ষিত হন  তারা, অন্নপূর্ণা, ত্রিপুরা ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে দীক্ষিত শাক্তদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম

তন্ত্রসাধনার মূল স্রোতটি যে আচারপদ্ধতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তা হলো পঞ্চ -কার ক্রিয়া এই পদ্ধতিটি নিয়ে আবহমানকাল ধরে নানা ধরনের পরস্পর বিপ্রতীপ মতামত প্রচলিত রয়েছে প্রায় সোয়াশো বছর আগে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবার উপক্রমনিকা হিসেবে একটি কৈফিয়ৎ যেমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, “...ভারত-প্রচলিত তান্ত্রিক উপাসনার প্রকৃত মর্ম পঞ্চ -কারের মূল উদ্দেশ্য   আমাদের জ্ঞানে যতদূর উদ্বোধ হইয়াছে এবং ইহার আধ্যাত্মিক-তত্ত্ব যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে... ইত্যাদি অর্থাৎ এই ব্যাখ্যাটির প্রামাণ্যতা নির্ভর করছে দুটি বিষয়ের উপর, আমাদের জ্ঞান যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে বিষয়ে  সাক্ষী মানা হয়েছে আগমসার নামের একটি প্রাচীন গ্রন্থের এই গ্রন্থে প্রথম-, অর্থাৎ মদ্য সাধন বিষয়ে বলা হয়েছে,  
সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে
পীত্বানন্দময়ীং তাং এব মদ্যসাধকঃ।।
তাৎপর্যঃ- হে পার্বতি! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক

মাংসসাধনা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, মা, রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশভূত; যে ব্যক্তি সতত উহা ভক্ষণ করে, তাহাকেই মাংসসাধক বলা যায় মাংসসাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে বাক্যসংযমী মৌনাবলম্বী যোগী


মৎসসাধনার তাৎপর্য আরও গূঢ় প্রতীকী গঙ্গা-যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য  সতত চরিতেছে, যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে, তাহার নাম মৎস্যসাধক আধ্যাত্মিক মর্ম গঙ্গা যমুনা, ইড়া পিঙ্গলা; এই উভয়ের মধ্যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস, তাহারাই দুইটি মৎস্য, যে ব্যক্তি এই মৎস্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ প্রাণারামসাধক শ্বাস-প্রশ্বাস, রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টিসাধন করেন, তাঁহাকেই মৎস্যসাধক বলা যায়

মুদ্রাসাধনা এরকম, “...শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ  পারদতুল্য আত্মার অবস্থিতি, যদিও ইহার তেজঃ কোটিসূর্য্যসদৃশ, কিন্তু স্নিগ্ধতায়  ইনি কোটি চন্দ্রতুল্য এই পরম পদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনী শক্তি সমন্বিত, যাঁহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, তিনিই প্রকৃত মুদ্রাসাধক হইতে পারেন 

মৈথুনতত্ত্ব সম্বন্ধে অতি জটিল বিশেষণ আরোপ করা হয়েছে আগমসার গ্রন্থে সেখানে বলা হয়েছে, মৈথুনসাধক পরমযোগী কারণ তাঁরা বায়ুরূপ লিঙ্গকে  শূন্যরূপ যোনিতে প্রবেশ করাইয়া কুম্ভকরূপ রমণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন আবার অন্য ঘরানার তন্ত্রে বলা হচ্ছে,মৈথুনব্যাপার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ, ইহা  পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইলে সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে। 


 যে সাধারণ লোকেরা  তন্ত্রের প্রথম উদ্গাতা ছিল এবং -কার যাদের দৈনন্দিন  জীবনের ছন্দ, তাদের প্রতি পুরোহিতশ্রেণীর আশংকা, ...সাধারণ লোকে উদ্দেশ্য প্রকৃত মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তন্ত্রশাস্ত্র তন্ত্রোক্ত পঞ্চ-মকারের প্রতি ঘোরতর ঘৃণা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন  উল্লেখ্য, বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য, উভয় ঘরানার  তন্ত্রেরই আকর উৎস বিভিন্ন আগমশাস্ত্র আগমশাস্ত্র বস্তুতঃ আদি প্রযুক্তি প্রকৌশলের গ্রন্থিত সংগ্রহ খেটেখাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষই আদিতে যাবতীয় আগমশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিল কালক্রমে এইসব ভৌতশাস্ত্র আধিদৈবিক অতীন্দ্রিয় কর্মকান্ডের রূপ পরিগ্রহ করে ইতরজনের নাগালের বাইরে চলে যায় 'সাধারণ' জনগোষ্ঠীর নৈতিকতায় মৈথুন কখনই কদর্য, কুৎসিত বোধ হয়নি এই বোধটি আর্যায়নের সঙ্গে এসেছিল শাস্ত্রকার এভাবে ব্যাখ্যা করছেন, ...আপাততঃ মৈথুন ব্যাপারটি অশ্লীলরূপে প্রতীয়মান হইতেছে, কিন্তু নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিলে, তন্ত্রশাস্ত্রে ইহার কতদূর গূঢ়ভাব সন্নিবেশিত আছে তাহা বুঝা যাইতে পারে যেরূপ পুরুষজাতি পুংঅঙ্গের সহকারিতায় স্ত্রীযোনিতে প্রচলিত মৈথুন কার্য করিয়া থাকে, সেইরূপ  এই বর্ণে আকারের সাহায্যে এই বর্ণ মিলিত হইয়া তারকব্রহ্ম রাম  নামোচ্চারণ রূপে তান্ত্রিক অধ্যাত্ম-মৈথুন ক্রিয়া নিষ্পাদিত হইয়া থাকে

শারীরিক মৈথুনের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন আলিঙ্গন, চুম্বন, শীৎকার, অনুলেপ, রমণ রেতোৎসর্গ - তেমনই আধ্যাত্মিক মৈথুন যোগক্রিয়ায় তার সমান্তরাল কৃত্য,   সেখানে তত্ত্বাদিন্যাসের নাম আলিঙ্গন, ধ্যানের নাম চুম্বন, আবাহনের নাম শীৎকার, নৈবেদ্যের নাম অনুলেপন, জপের নাম রমণ আর দক্ষিণান্তের নাম রেতঃপাতন এই সাধনাটির নাম ষড়ঙ্গসাধন এবং শিবের ইচ্ছায় একে অতীব গোপন মোহর দেওয়া হয়েছিল তাছাড়া কলির জীব পঞ্চ -কারের মর্ম বুঝিতে  পারিবে না বলিয়া কলিতে ইহা নিষিদ্ধ হইয়াছে অতএব ইতরজনের জন্য এইসব দর্শন নিষিদ্ধ হয়ে গেল এবং উচ্চবর্গ তাদের হাতে শেষ পর্যন্ত পেন্সিল ছাড়া আর কিছু থাকতে দিল না


ইতরজন নারীজাতি এই সব শাস্ত্র প্রণয়নের সময় একই ধরনের সম্মান(?) লাভ করত সাধনসঙ্গিনী নির্বাচনের যে প্রথাপ্রকরণ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, সেখানে নারীকে এক ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বোধ হতে পারে নামে নারীই শক্তি, কিন্তু শক্তি সাধনের ষটকর্মে সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ নির্দেশ করা  হয়েছে, তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে কিছু  উল্লেখ করা যায় যেমন, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিনী নারী শান্তিদায়িনী সে হবে গৌরাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, সর্বদা অমৃতভাষিণী রক্তনেত্রা শঙ্খিণী নারী হয় মন্ত্রসিদ্ধকারী সে হবে দীর্ঘাঙ্গী এবং নিখিল জনরঞ্জনকারিণী যে নারী নাগিনী গোত্রের, তার লক্ষণ হলো শূদ্রতুল্যদেহধারিণী, নাতিখর্বা, নাতিদীর্ঘ, দীর্ঘকেশী, মধ্যপুষ্টা মৃদুভাষিণী এরপর কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, দন্তুরা, মদতাপিতা, হ্রস্বকেশী, দীর্ঘঘোণা, নিরন্তর নিষ্ঠুরবাদিনী, সদাক্রুদ্ধা, দীর্ঘদেহা, মহাবাবিনী, নির্লজ্জা, হাস্যহীনা, নিদ্রালু বহুভক্ষিণী নারীকে ডাকিনী বলা হয়(যোগিনীতন্ত্রম)

শাক্তদের মধ্যে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের নাম পশ্বাচারী বীরাচারী দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল প্রভেদ হচ্ছে বীরাচারে পঞ্চ- কারের প্রচলন আছে, পশ্বাচারে তা নেই কুলার্ণবতন্ত্রে এই দু প্রকার আচারকে আবার সাত ভাগ করা হয়েছে সেখানে বলা  হচ্ছে, বেদাচার উত্তম (এই বেদাচারের সঙ্গে বৈদিক আচারের কোনও সম্পর্ক নেই), বেদাচারের থেকে বৈষ্ণবাচার উত্তম, বৈষ্ণবাচার থেকে শৈবাচার উত্তম, শৈবাচার থেকে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার থেকে বামাচার উত্তম, বামাচার থেকে সিদ্ধান্তাচার উত্তম, সিদ্ধান্তাচারের চেয়ে কৌলাচার উত্তম কৌলাচারের চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই (“...রামপ্রসাদ বলে নিদানকালে পতিত হবি কুল ছাড়িলে / মন   ভুলো না কথার ছলে...”, এখানে কুল শব্দ দ্ব্যর্থবোধক তা বংশসম্প্রদায়  কৌলাচারের প্রতি আনুগত্য দুইই বোঝায়)


বিভিন্ন দেবতার যেমন নিজস্ব বিশেষ বীজমন্ত্র আছে, বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়ারও বিশেষ বীজ আছে কালিকার বীজ একাক্ষর, তারার বীজ ত্র্যক্ষর এবং বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা বজ্রবৈরেচনী বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী পূর্ণাভিষেকের সময় স্বয়ম্ভূ-কুসুমাদির প্রতি যে শুদ্ধিমন্ত্র উচ্চারিত হয় তা এরকম,  প্লূং ম্লূং স্লূং শ্লূং স্বাহা আবার ব্রহ্মশাপ বিমোচন মন্ত্র, শুক্রশাপ বিমোচন মন্ত্র  বা কৃষ্ণশাপ  বিমোচন মন্ত্র মদ্যের প্রতি উৎসর্গিত হয় এই সব শুদ্ধি মন্ত্র বা উৎসর্গ মন্ত্রে যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তা এরকম খপুষ্প মানে রজস্বলা  স্ত্রীলোকের রজ, স্বয়ম্ভূ পুষ্প বা স্বয়ম্ভূ কুসুম মানে স্ত্রীলোকের প্রথম রজ (...যত  বিষয় মধু তুচ্ছ হল, কামাদিকুসুম সকলে... কমলাকান্ত), কুন্ডপুষ্প মানে সধবা স্ত্রীলোকের রজ, গোলকপুষ্প মানে বিধবা স্ত্রীলোকের রজ এবং বজ্রপুষ্প মানে চন্ডালীর রজ (তন্ত্রসাধনায় এই চন্ডালী নারীর বিশেষ কদর আছে) এই লক্ষণটি  তন্ত্রচর্চায় ইতরযানী স্বীকৃতির নিদর্শন এই সব পুষ্প বামাচারী তন্ত্র সাধনার  জরুরি উপকরণ বাউলচর্যাতেও আমরা এজাতীয় পদ্ধতির প্রচলন দেখতে পাই

তন্ত্র শাস্ত্রে বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা আছেন ব্যক্তি বিশেষে কেউ কালী, কেউ তারা কেউ বা জগদ্ধাত্রীকে ইষ্ট করেন এছাড়া অন্যান্য দেবীরাও আরাধ্যা হয়ে থাকেন উক্ত সব শক্তি দেবীর দীর্ঘ তালিকা নথিবদ্ধ আছে এই সাধন প্রণালীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অতি জরুরি বিষয় বিভিন্ন তন্ত্রে, যেমন পিচ্ছিলা তন্ত্র, বিশ্বসার তন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতিতে গুরুর লক্ষণ বিবৃত হয়েছে গুরুকে সর্বশাস্ত্র পরায়ণ, নিপুণ, সর্ব শাস্ত্রজ্ঞ, মিষ্টভাষী, সুন্দর, সর্বাবয়ব সম্পন্ন, কুলাচার বিশিষ্ট, সুদৃশ্য, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী ইত্যাদি গুণশীল হতে হবে শিষ্যের জন্যও নানা লক্ষণবিচার রয়েছে

শিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু বীজমন্ত্র উপদেশ দেন এই বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবীর জন্য পৃথক হয় এই বীজমন্ত্রগুলি অতীব গুহ্য তাই তন্ত্রকারেরা তাদের গোপন রাখার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ তার নতুন অর্থ সৃষ্টি করেছেন এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকারী ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন একে আদিম ক্ল্যাসিফায়েড কোডিং প্রসেসও বলা যায়

এক আধটা উদাহরণ দিই কালীবীজ মন্ত্র, বর্গাদ্যং বর্ণহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম এখানে বর্গাদ্য শব্দের প্রতীক হচ্ছে , বর্ণহি শব্দের ,  ‘রতি শব্দে এবং তাতে বিন্দু যুক্ত সব মিলিয়ে যে প্রতীকী শব্দটি তৈরি হলো তা হচ্ছে ক্রীং ভাবে ভুবনেশ্বরী বীজ  হ্রীং, লক্ষ্মীবীজ শ্রীং যৌগিক  বীজও আছে, যেমন তারাবীজ হ্রীং স্ত্রীং হূ ফট বা দুর্গাবীজ ওঁ হ্রীং দূং দুর্গয়ৈ নমঃ এই তালিকাটি অতি দীর্ঘ এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন এছাড়া  এমন কিছু বীজ আছে যেগুলি বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত


 
তন্ত্রশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকটি বিষয়সূত্র নিয়ে যে আলোচনা এখানে করলুম, সঙ্গতভাবেই তা অসম্পূর্ণ অগভীর কিন্তু আমার চর্চার সূত্রে তন্ত্র-আগম-পুরাণ বিষয়ে বাংলায় যেসব চর্চা-ব্যাখ্যান দেখেছি, সেগুলি হয় ভক্তের উদ্গার নয়তো নিন্দুকের প্রচার অথবা বাজারি গালগল্পের নিকৃষ্ট ভোজন ইতিহাস সমাজতত্ত্বের নিরিখে আমাদের দেশের তন্ত্র শক্তিসাধনার ইতিবৃত্ত এখনও প্রকৃত অধিকারীর মনোযোগ পায়নি আশা করি বিষয়টি কখনও ধীমান আলোচনার উপজীব্য হয়ে উঠবে ততদিন পর্যন্ত আমরা রামপ্রসাদেই আশ্রয় নিয়ে রয়ে যাই না হয়,

...আমায় মনমাতালে মাতাল করে,  
আর মদমাতালে মাতাল বলে,
মন ভুলো না কথার ছলে...”