নিঃসঙ্গ এবং বিতর্কের নেতিবাচকতায় ঢাকা মৃত্যুর নিখুঁত শিল্পী
সিলভিয়া প্লাথ (২৭শে অক্টোবর ১৯৩২ - ১১ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৩)
I shut my eyes and all the world drops dead;
I lift my lids and all is born again."
(I think I made you up inside my head.)
- Mad Girl's Love Song- Sylvia Plath
সিলভিয়া প্লাথ আমেরিকান কবি, এটি অবশ্যই তাঁর জাতিগত পরিচয়, কিন্তু সাহিত্য প্ল্যাটফর্মে তিনি পরিচিত বিশেষ কিছু বিতর্কিত অফবিট বৈশিষ্ট্যর জন্য।
আত্মহত্যাকেন্দ্রিক প্রচেষ্টা ছিল প্লাথের মধ্যে, ‘Neurotic Poet’ এই আখ্যাতেই সর্বাধিক পরিচিত তিনি। প্লাথ-এর জন্ম ম্যাসাঢুসেটস-এ। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে প্লাথ, বাবা জার্মান, আর মা অষ্ট্রিয়ান। বাবা অটোপ্লাথ ছিলেন স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক ও তৎসময়ের মৌমাছি গবেষণার পথিকৃত। প্লাথের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনে তাঁর পিতার ভূমিকা ব্যাপক ও বিশিষ্টতায় চিহ্নিত, যদিও তা অনেকাংশেই নেতিবাচ। পরবর্তী কালে প্লাথের বহু কবিতা্য সেই negativityর ছাপ প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্নভাবে দৃশ্যমান।
বাবা যখন মারা যান তখন প্লাথের বয়স মাত্র আট। স্বইচ্ছায় জীবন শেষ করার এই ঘটনা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বাবার মৃত্যুর দু’বছরের মাথায় তিনি আত্মহত্যা করার প্রথম প্রচেষ্টা করেন স্লিপিং পিলের সাহায্যে এবং পরবর্তীতে তাঁর এই প্রবণতা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। দুঃখ, নেতিবাচকতা, বিষাদ ও বৈকল্য তাঁর অধিকাংশ কবিতায় বিশেষভাবে পরিদৃশ্যমান। তাঁর নিজের কথায় – “কখনো পারব কি, এই যে এত বই, সব পড়ে শেষ করতে? ইচ্ছে তো খুব, একার মধ্যে বহু হয়ে থাকার; জীবন কাটাব যখন যেভাবে খুশি। সাধ হয় সব কিছুতে পটু হতে, সাধ্য নেই। বাঁচতে ইচ্ছে করে সব রং, আলো, ছায়া, রস, রূপ, সুরভি নিয়ে। যত রকম মানসিক আর শারীরিক অস্তিত্ব সম্ভব। সবটুকু শুষে নিয়ে যেন সোচ্চারে বাঁচি। কিন্তু আমার যে অসহায় সীমাবদ্ধতা!”
২০১৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী সিলভিয়া প্লাথের আত্মাহুতির অর্ধশত বর্ষ পালিত হয়, এবং এই আত্মাহুতির পরই তিনি মূলত বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ১৯৮২ সালে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘The Bell Jar’এর জন্য পান মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার।
বিষাদমগ্নতা ক্রিয়েটিভ মানুষদের মধ্যে গভীর ভাবে বিদ্যমান একথা মেনে নিয়েই বলা চলে, বিশ্ব ইতিহাসে নজর কাড়া আত্মহত্যার প্রতিটি পাত্র পাত্রীই ছিলেন তুলনামূলক ভাবে বিখ্যাত এবং স্বেচ্ছায় জীবন বিসর্জন দেওয়ার আগে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁরা... (মৃত্যুর পরও মানুষের মনে স্থায়ী আসন করতেই কি?)। ভার্জিনিয়া উলফ, ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস, স্প্যাল্ডিং গ্রে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং মেরিলিন মনরো’র নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। কিন্তু সিলভিয়া ছিলেন এর ব্যতিক্রম।
অ্যান্ড্রু উইলসন রচিত সিলভিয়া প্লাথের জীবনীগ্রন্থ ‘ম্যাড গার্লস লাভ সং’-এ তাঁর জীবনের শুরুর দিকটায় আলো ফেলা হয়েছে। তখনও তিনি টেড হিউজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েননি। বিতর্কের সৃষ্টি হয় তখনই, যখন টেড হিউজ কীভাবে প্লাথের মৃত্যুর পর তাঁর রচনা সম্পাদনা করলেন, সে নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলেন অ্যান্ড্রু।
১৯৪১-এ ‘বোস্টন হেরাল্ড’-এর ছোটদের পাতায় প্রকাশিত হয় প্লাথের প্রথম কবিতা। একটি ছোট কবিতা। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। সমগ্র জাতির জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন মুড। ১৯৪৯ সালে ‘দা আটলান্টিক মান্থলি’ পত্রিকায় যৌথভাবে গদ্য লেখেন সিলভিয়া, যার শিরোনাম ছিল- ‘আ রেসপনসিবল লাইফ ইন এ ম্যাড ওয়ার্ল্ড’। নামকরণেই স্পষ্ট সিলভিয়ার নিঃসঙ্গতা।
১৯৫০ সালে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেন সিলভিয়া। ১৯৫৬ সালে বিয়ে করেন কবি টেড হিউজেসকে। প্রচণ্ড পরিশ্রম ও অনড় অটল মনোভঙ্গী অসংখ্য সাময়িকপত্রে প্রকাশিত রচনা তাঁকে stability দেয়। কিন্তু ক্রিয়েটিভ জগৎ খুব আনসার্টেন, তাই কখনো কখনো প্রত্যাখ্যানপত্রও আসত সিলভিয়ার কাছে। নিজের সক্ষমতা নিয়ে সংশয়ী হয়ে পড়েন প্লাথ, ভাবতে থাকেন তাঁর ট্যালেন্ট কি হারিয়ে যাচ্ছে? ফলবশত তিনি এমন এক প্যাটার্ন নির্মাণ করেন, যেখানে তাঁর জীবন নিমজ্জিত হলো অনন্য এক অসুস্থতায়। .হতাশা আর বেদনাকে ঘিরে বাঁচতে থাক্লেন সিলভিয়া। অদ্ভুত এক দোলাচলতা ঘিরে ধরে তাঁকে, ধীরে... ধীরে...। ১৯৫৩র অগাস্ট, একগাদা ঘুমের ওষুধ খান তিনি। তিনদিন ওভাবেই অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকেন, কিন্তু মৃত্যু আসেনি। সিলভিয়ার নিজের কথায় – “আমি নিঃশর্ত ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলাম এক চির অন্ধকারের কাছে”।
সিলভিয়ার লেখায় একাধিক বার ফিরে এসেছে বিষাদ, অসুস্থতা এবং নেতিবাচক অন্ধকারের ছবি। হাসপাতালের গন্ধ, ভ্রূণ, চাঁদ, রক্ত বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। ১৯৬০ সালের পর সিলভিয়ার কবিতায় আসে আমূল পরিবর্তন, আসে পরিণত মনস্কতার প্রভাব। surrealistic নৈসর্গিক ছবি দেখা দেয় তাঁর কবিতায়, আর তাঁকে ঘিরে থাকে অব্যক্ত যন্ত্রণার সাদা কালো কোলাজ।
“তুষার বিন্দুর মতো তারাদের ধোঁয়াটে মেঘের নামে
লালবাঁশি পায়ের পায়রা হেঁটে যায়
নার্সিসাসের ছবি প্রতিভাত হয় সলোমানের উপমার মতো
আমরা আবারও প্রতারিত হই, এবং শেষমেষ এই বুঝি—
আমদের বয়স কমে গেছে”।
সিলভিয়ার কবিতাতেই স্পষ্টমান তাঁর অস্থিরচিত্ততা, বিষাদমগ্নতা। “একটা পেঁচার তীক্ষ্ণ নখর আমাকে চেপে ধরেছে এবং আমার হৃদয়কে সংকুচিত করে তুলছে” - মৃত্যু বিষয়ক ভাবনাকে এভাবেই তুলে ধরেছিলেন প্লাথ।
১৯৬৩ সালের ঝিমঝিমে ছায়া ছায়া আলো ঘেরা ১১ই ফেব্রুয়ারীর রাতে জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরবিদায় নেন প্লাথ।
আমদের বয়স কমে গেছে”।
সিলভিয়ার কবিতাতেই স্পষ্টমান তাঁর অস্থিরচিত্ততা, বিষাদমগ্নতা। “একটা পেঁচার তীক্ষ্ণ নখর আমাকে চেপে ধরেছে এবং আমার হৃদয়কে সংকুচিত করে তুলছে” - মৃত্যু বিষয়ক ভাবনাকে এভাবেই তুলে ধরেছিলেন প্লাথ।
১৯৬৩ সালের ঝিমঝিমে ছায়া ছায়া আলো ঘেরা ১১ই ফেব্রুয়ারীর রাতে জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরবিদায় নেন প্লাথ।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন