কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

মেঘ অদিতি

সে করবী ঝোপে

প্রতিদিন না হলেও লিপিকে মাঝে মাঝে দেখা যায় করবীর ঝোপের আড়াল থেকে একা বেরিয়ে আসতে সে সময়ে তার চোখ মুখ কেমন থমথমে হয়ে ওঠে, যেন ঝড় নেমে আসার আগের মুহূর্ত বাড়ি ফেরার রাস্তাটা কাঁচাপথ, এবড়োখেবড়ো লিপিও আনমনা, হোঁচট খেতে খেতে সে প্রতিবার বাড়ি ফেরে এত অন্যমনস্ক, তবু লুকিয়ে  দেখতে গিয়ে বার দুয়েক ধরা পড়েছে সুজন লিপির কাছে কী করে যে বুঝে ফেলে আর ঘাড় ফিরিয়ে এমন তাকায় যেন ভস্ম করে দেবে! আজকাল সুজন আর লিপির  পিছু নেয় না সময়মতো ঘুম ভেঙে যায় আপনি আর করবী ঝোপের কাছাকাছি  প্রতিদিন সে অদৃশ্যে প্রহর গোনে প্রতিদিন নয়, কোনো কোনো দিন লিপি আসে, অন্ধকার মেখে ওই ঝোপটার ভেতর ঢুকে যায় ওর ফিরে আসার অপেক্ষায় সুজন আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে ফেরার পথে লিপি আজকাল আবার সুচিত্রা সেন স্টাইলে পিছন ফিরে ঝোপের দিকে তাকায় তারপর বাড়ির পথ ধরে

ঝোপের ভেতর কী এমন যে লিপি বারবার সেখানে আসে, এ কৌতূহল সুজনের খুব নেই বরং সে ভাবে, ভোরের আলো মেখে এই যে লিপির আসা থাকবে, এটুকু দেখতে পাওয়া কি কম! সুজন বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে যায় বিছানায় শুয়ে খানিক এপাশ ওপাশ করে এবছর গরম পড়েছে খুব গায়ে ঘামাচি কুটকুট কামড়ায় একটু বৃষ্টিতে ভিজতে পারলে ঘামাচিগুলো মরতো, কিন্তু বৃষ্টি কই! মাঠ ঘাট খা খা করছে  ঘরে নিতু চা আর মুড়ি রেখে যায় দরজার কাছে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, একটা তিব্বত পাউডার দিবা ভাইজান? সুজন চায়ের কাপ টেনে নিতে নিতে মাথা নাড়ে  তার আবার লিপিকে মনে পড়ে লিপিকে আলতা, পাউডারে সাজিয়ে দু’ চোখের তারায় বসিয়ে দীর্ঘসময় সে চোখ বুঁজে থাকে


ডলিবুআজ চল্লিশ দিন বাড়িছাড়া  মা ঘরে সকাল থেকে একটানা কোরান শরীফ পড়ে চলেছে বাবা নিরুদ্দেশ সেই কবে থেকে! ডলিবুর কথা বাবা হয়তো কোনোদিন  জানবে না লিপিদের বাড়িতে পাড়াপড়শি কেউ উঁকি দেয় না একে তার বাবা নিরুদ্দেশ হবার পর থেকে বাবাকে নিয়ে নিত্য কেচ্ছার কথা এখনো ফুরোয়নি তার ওপর ডলিবু... ওড়নায় চোখ মোছে ও, হতদরিদ্র তিন মহিলাকে গত রাতে বলে রেখেছিল আজ ওদের সামনে চারটে ডালভাত রেখে লিপি দাঁড়িয়ে থাকে খাওয়া হলে ওদের তিনজনের হাতে একশটা করে টাকা গুঁজে দেয় আবার মন খুব ডানা ঝাপটাতে থাকে করবীর ওই ঝোপ... আহা, রাতদিন তাকে ডাকে যে কেন! পা  বাড়াতে গিয়ে মনে হলো আজ সকালেই তো গেছিল ও, আবার কি যাওয়া ঠিক হবে...? উঠোনের উত্তরদিকে আমড়া গাছটার নিচে পিঁড়ি পেতে বসে থাকে সে  অনেকক্ষণ ঘর থেকে মার কোরান তেলোয়াতের সুর ভেসে আসে মা ঘর থেকে  পারতপক্ষে বেরোয় না লিপির সাথে কথা বলে না কেবল টিপু, লিপিদের ভাইটা বাড়ি ফিরলে মা ওকে জিগ্যেস করে, আজ এত দেরি! ব্যস এটুকুই কোরান   তেলওয়াত, নামাজের বাইরে অল্প যেটুকু সময়, তাতে সে ডুবে যায় নিজের ভেতরই যেন টিপুরও হাড়ভাঙা খাটুনি বাড়ি ফিরে চারটে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে পুরো বাড়িতে সেই লিপি, একা লিপিই ভূতের মতো ঘুরে বেড়ায়

সারা রাত এপাশ ওপাশ করে ভোরের আলো যখন ফোটে লিপির আর কিছুতেই ঘরে মন টেকে না সটান রওনা দেয় সে ঝোপের দিকে একটা ছিমছাম সকালে একটা তছনছ সংসারের বুকে লাথি মারতে ইচ্ছে করে তার

ডলি ছিল বাবা মায়ের প্রথম সন্তান লিপির বড় বুবু বি এ পাশ দিয়েছিল মার ইচ্ছেতে গ্রামের স্কুলেই একটা চাকরি জুটে যায় পরে বাবা নিরুদ্দেশ না হলে হয়তো  ডলির বিয়ে হয়ে যেত ঢের আগে কিন্তু যে নেই আর যা হয়নি তা ভেবে লাভই বা কী! তাই ডলি ধীরে ধীরে ঢুকে পড়েছিল কর্মব্যস্ততার ভেতর স্কুল শেষে বাড়িতেই  ছাত্রী পড়ানো, একটা সেলাই স্কুল করে মেয়েদের সেলাই শেখানো, ভালো চলছিল সব  মিলিয়ে কিন্তু ভাগ্য যাদের অপ্রসন্ন, তাদের মুক্তি নেই, নইলে ডলিবু’কে কেন মরে যেতে হয়! আর তার সন্তান, যার পিতৃপরিচয় শেষ মুহূর্তেও ডলিবু’ দেয়নি, তার জন্ম নিয়ে মৃত্যুর কেন এত আয়োজন! ডলিবু’ কী আশ্চর্য কৌশলে নিজের শরীরের  স্ফীতি লুকিয়ে রাখতে শিখেছিল শাড়ির আড়ালে এতগুলো দিন লোক জানাজানির ভয়ে মা ঘরে ধাত্রী ডাকেনি আনাড়ি হাতে প্রসব পুরনো ব্লেডে নাড়ি কাটা নবজাতকের মুখে মধুর বদলে দু’ ফোঁটা করবী পাতার রস ডলিবু’, সেও তো কোন  ফাঁকে করবীর কাছেই নিজেকে সমর্পণ করল হঠাৎ বুকফাটা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ও

সুজন এক দৌড়ে ঝোপের ভেতর ঢুকে পড়ে দেখে দুহাতে মাটি খুবলে তুলছে লিপি, আর চিৎকার করছ্‌ তোকে এই বিষ-মাটিতেই কবর কেন দিল মা রাতের  অন্ধকারে... তোর কী দোষ ছিল... করবীর পাতা থেকে বীজ সবই তো বিষ, এই  দ্যাখ, দ্যাখ আমার মতো, ডলির মতো, বাবার মতো বিষ...! সুজন বিস্ফারিত  চোখে লিপিকে দেখে, দু’ হাতে মাটি তুলছে মুখে মাখছে আর চিৎকার করে কাঁদছে  
সুজন দু’ পা এগিয়ে যাবে ভেবে ক্রমেই এক পা করে পিছিয়ে যেতে থাকে





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন