সমীরদাকে
নিয়ে আমার স্মৃতিগুলো
মনে পড়ছে বহুদিন
আগে ‘বাংলা কবিতায় আমার পিতা ও পরিজনেরা’ নামে একটি লেখা লিখেছিলাম ‘কালিমাটি’
পত্রিকায়। তখন প্রিন্ট ইস্যুই শুধু ছিল ‘কালিমাটি’র। যাকে আমরা মজা করে বলি ‘অ্যানালগে’র যুগ। বাংলা
সিনেমায় পোসেনজিত রিতুপন্নার গোলগাল
চেহারা, গোলাপি মুখ, ব্যাগি প্যান্টস ইত্যাদির যুগ।
ন’য়ের দশক বা দু’
হাজারের একেবারে গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় আমার পিতা ও পরিজনেদের শনাক্ত করার সময়ে পঞ্চাশের বেশ কিছু
কবির নাম তুলে এনেছিলাম। তাঁরা আমার অক্ষর পরিজন। একজন কবির কবি তকমা পাবার পেছনে
অনেক অনেক অক্ষর-কর্মী–কবি-লেখকের ভূমিকা থাকে। তাঁদের কেউ কেউ সাক্ষাতে কাজ করেন,
কেউ কেউ একেবারে আড়ালে, গোপনে, নীরবে।
সে লেখায় সমীর
রায়চৌধুরীর কথা কিন্তু ছিল না। তখন তিনি জীবিতই শুধু না, রমরমিয়ে ওই অ্যানালগ
যুগের ‘কালিমাটি’তে লিখে চলেছেন অধুনান্তিক নিয়ে তাঁর অবিস্মরণীয় লেখাগুলি। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে,
আমার বোধে, সমীর রায়চৌধুরী সেই পিতা ও পরিজন, যিনি না থাকলে আমি হয়তো ‘আমি’ হতাম
না। আমার লেখাজীবন অপরিপূর্ণ, অশনাক্ত, অনারব্ধই থেকে যেত।
পিছিয়ে যেতে হবে
আরো কিছু বছর। ১৯৯৩-৯৪। এই সময়েই আমার নিজস্ব পদার্পণ কবিতার ক্ষেত্রটায়। তার আগে
শুধুই সলতে পাকানো। বয়স প্রায় ত্রিশ তখন আমার। যে আঠাশের মধ্যে বড় বড় কবিদের
জীবনের দু’ তিনটে বই হয়ে যায়, আমার ঝুলিতে
না ছাপা কবিতার দু’ তিনটে ডায়েরি শুধু। খুব দেরিতে এসেছি, এই ‘লাইনে’... ১৯৯৪
বইমেলাতেই সম্ভবত আর এক প্রয়াত, ‘অমৃতলোক’ পত্রিকার সম্পাদক সমীরণ মজুমদার আমার
সঙ্গে আলাপ হবার পর, বলেছিলেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
তো, এই সময়েই
হাজরায় আমাদের বাড়ির পাশেই, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে প্রভাত চৌধুরীর বাড়িতে গুটি
গুটি পদক্ষেপে আমার যাওয়া আসা শুরু। তার আগে কলেজ স্ট্রিট পাতিরাম থেকে কিনেছি ‘কবিতা পাক্ষিকে’র
কয়েক ইস্যু। পড়েছি সাম্যব্রত জোয়ারদারের
কবিতা। চমকে গেছি ডিকশন দেখে। ছুঁয়ে ফেলেছি আমার ডিকশন যা তখনো হয়ে ওঠেনি, তার
আঁচ... নব্বইয়ের কবিতার আঁচে।
এই সব সময়ে
প্রভাতদার সূত্রেই রায়চৌধুরী ভ্রাতাদের সঙ্গে আমার আলাপ। কানাইলাল জানার আলিপুর জেল-স্থিত কোয়ার্টারে মলয়দার
কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে, ইতিপূর্বে পঠিত মলয়দার হাংরি কবিতা, বিশেষত ‘প্রচন্ড
বৈদ্যুতিক ছুতার’ (সে বই পেয়েছিলাম কলেজ
জীবনের বন্ধু বাংলা ভাষাদক্ষ অধুনা ‘থির বিজুরি’ সম্পাদক অপূর্ব সাহার হাংরি কালেকশনের অন্যান্য বইগুলোর সঙ্গে
এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাংরি হয়ে ওঠে আগ্রহের বিষয়... এই ঘটনা তারও চার পাঁচ
বছর পরের বলছি) এর কথা তুলে ‘কেয়াবাত’ ধরনের পিঠ চাপড়ানি পেয়েছি সমীরদা প্রভাতদা ও
বলা বাহুল্য, মলয়দার কাছে।
সেই সব আলাপের সূত্রপাতের পর পর সমীরদা মলয়দা, অর্থাৎ রায়চৌধুরী ভ্রাতাদের
কাছে অনেকটা লেখার উৎসাহ পেয়েছি, বললে কিছুই বলা হয় না। আসলে তরুণ আমাকে যে
গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যতটা লেখালেখির স্পেস তৈরি করে দিয়েছিলেন, এগুলো লিখে বলার নয়।
অধুনান্তিক পর্বের সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারা, এবং ওঁদের অধুনান্তিক নিয়ে ভাবনা চিন্তা,
কথাবার্তায় বার বার অংশগ্রহণ করার সুযোগ, একেবারে যখন পায়ের নিচের মাটি তৈরি হয়ে
উঠছে, সে সময়ে খুব জরুরি ছিল আমার কাছে, বলাই বাহুল্য।
এর কিছুদিন পর
পরই, সমীরদা বলেন ‘হাওয়া ৪৯’এর জন্য লিখতে। লিখেছিলাম মেয়েদের যৌনতাবোধ নিয়ে একটা লেখা। যেটা পরে আবার
পুনর্মুদ্রিত হয় ‘তেহাই’ পত্রিকায়।
‘হাওয়া ৪৯’এ
মলয়দাকে নিয়েই একটা লেখা লিখেছিলাম। যেটা পরে আবার ছাপে ‘সৃষ্টি’ পত্রিকা (রোহণের সৃষ্টি)। ‘হাওয়া ৪৯’এর পাতায় অনেক লেখা
পড়েছি। এভাবেই লেখার সুযোগ পেয়েছি বার
বার। আমার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করিয়েও ছাপানো হয়েছে ‘হাওয়া ৪৯’এ।
এ গেল আমার
ব্যক্তিগত ঋণের কথা। বাকিটা সবাই লিখেছেন, লিখবেন। সমীরদার নিজস্বতা, তাঁর
অধুনান্তিকতাকে প্রায় একটা ইনস্টিট্যুশনের রূপদান। বারংবার তাঁর নানা কাজে, কবিতা
ও প্রবন্ধে তাঁর অনস্বীকার্য মেধা। কেউ তাঁর সঙ্গে একমত না হতেও পারতেন, কিন্তু
অস্বীকার অবশ্যই করতে পারেননি তাঁর এই কাজগুলিকে।
একটা কথা বার বার
বলতে হচ্ছে ইদানীং। বলতে ভালোও লাগছে না আর। তবু কথাটা সত্যি। একে একে নিবিছে দেউটি। ওই প্রজন্মটাই, চলে
যাচ্ছে। যাঁদের দিকে তাকাতাম, যাঁরা মাথায় ছাতা ধরেছিলেন, মহীরূহ হয়ে অনেকটা ছায়া
দিয়েছিলেন। সেই ব্যক্তিত্বদের স্পর্শ বা তাঁদের উৎসাহ বাংলা লেখালেখির
ধারাবাহিকতার ভেতরে নিজেকে অংশীভূত ভাবতে কতটা সাহায্য করেছিল, বলে বোঝাবার নয়। এ
এক অসাধারণ অনুভব।
সমীরদার চলে
যাওয়া আবার ‘শেষ যোদ্ধা’দের অপসারণের মতো লাগছে। বুদ্ধিমেধার চর্চার, বাঙালি রেনেসাঁসের পরবর্তী
ঔপনিবেশিকোত্তর বাংলার জ্ঞানচর্চার, যে সব যোদ্ধাদের কেউ না কেউ, রোজ রোজ চলে
যাচ্ছেন। সম্প্রতি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, ভূমেন্দ্র গুহ, উৎপলকুমার বসু প্রমুখের চলে
যাওয়ার খবরে ঠিক যেভাবে নিঝুম হয়েছি, সেভাবেই আবার হলাম সমীরদার চলে যাওয়ায়। সমীরদাদের পারিবারিক উন্নত পরিবেশ, বাংলা রেনেসাঁসের সমবয়স্ক
মেধাবুদ্ধি ও শিল্প বিজ্ঞানের চর্চা, এগুলো থেকেই সেই সূত্র পেয়েছি, কীভাবে একটি
প্রজন্ম আলোকপ্রাপ্তির শিখরে ছিল।
আজকের বেনোজল
আবহাওয়ায়, ডিজিট্যাল যুগে, কে কোথা থেকে আসছে এটা আর গুরুত্বের নয়, কে কী পড়ছে,
লিখছে এটা গুরুত্বের নয়। সেলফি জমানায়, নিজের মুখে আলো ফেলাটুকু ছাড়া আর কিছুই
গুরুত্বের নয়! বিপ্রতীপে, কতটাই না ‘আমি’ ‘আমি’ রোগ থেকে বিচ্যুত ছিলেন সমীরদা।
কতটাই না আত্মগত। অথচ তাঁকে বা তাঁর পঞ্চাশ দশকের বন্ধুদের ঘিরে তো
গল্প মিথ কম ছিল না! আমাদের মুখে মুখে ফিরত সে সব। বিশেষত হাংরি নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিখ্যাত সেই সব তরজা। অথবা
চাইবাসা ও অন্যান্য বিহার ছোটনাগপুর অঞ্চলে সমীরদারই আতিথ্যে বা ব্যবস্থাপনায়
বসবাস নিয়ে যে সব বিখ্যাত লেখাগুলো। বিশেষত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। এত বেশি বেশি
করে আলোচিত, সমীরদাদের এই ইতিহাস। সুনীল শক্তি আদি কৃত্তিবাসীদের আড্ডা / লেখা /
প্রসঙ্গ /কেচ্ছা... সব মিলিয়ে এই ব্যক্তিত্বগুলি উজ্জ্বল, আকর্ষণীয়, গল্পকথামিথের
বিষয়ীভূত। তথাপি আমরা তা নিয়ে যত উৎসাহে কথা বলেছি, সমীরদাকে কখনো নিজের অতীত নিয়ে
স্মৃতি কন্ডুয়ন করতে তো দেখিনি!
সেই সমীরদা চলে
গেছেন। ‘হাওয়া ৪৯’এর সংকলন জরুরি। জরুরি তাঁর লেখার সংকলনও।
ব্যক্তিগতভাবে
শেষের দিকে একেবারেই যোগাযোগ ছিল না। আসলে ২০০০এর পরে, নিজেকে ‘অধুনান্তিক’ লেবেলে আটকাতে আমার এক
কুন্ঠা দেখা দেয়। তাছাড়া বাসস্থান বদল হতে
থাকে। উপর্যুপরি বদলি, সংসারের কাজকর্ম ও অফিসের নানা ঝঞ্ঝাটে সমীরদার সঙ্গে
একেবারেই যোগাযোগ হারায়। মলয়দা যেহেতু পরে ফেসবুকে আসেন, এখনো অব্যাহত সে যোগাযোগের
ধারা। কিন্তু সমীরদার খোঁজ সেভাবে রাখিনি। অসুস্থতার খবরও নেট যোগে পেয়েছি।
প্রণাম সমীরদাকে। প্রণাম আমার এই পরিজনকে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন