ধারাবাহিক
উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(১৬)
অনেকগুলো মানুষ শীর্ণ নদীটির পাড়ে বসে আছেন। ঠিক পাড়ও না।
নদীর মাঝেই জেগে উঠেছে পাথুরে এক চর। বড় বড় সব পাথর হড়কা বানের টানে টানে পাহাড়
থেকে নিচে নিয়ে আসে ডুলুং। সেই পাথরের কিছু গড়িয়ে যায়, কিছু থেকে যায়। জলের ধাক্কায়
ধাক্কায় জমে গিয়ে কাছাকাছি হয়েছে। জলেরই বদান্যতায় শ্যাওলা হয়েছে, মাটি হয়েছে ক্ষয়ে ক্ষয়ে, জমেছে, এই ক্ষেত্র রচিত হয়েছে যা ডুলুংকে দু'ভাগ করে দিয়েছে। এধার ওধার দিয়ে যায় ডুলুং। যেতে গিয়ে একধারে সরু ফিতের মতো, বর্ষা ছাড়া অন্য সব ঋতুতেই গোড়ালি ডোবানো। অন্যধারে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একসা
করে গর্ত করেছে বড় একখানা। সেখানে এখনো গলা জল আছে।
সেই জলে দুই
পুরুষ আর দুই নারী খেলে বেড়াচ্ছে। জলের ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে পুরুষদের পরনে ধুতি, উদলা গা। নারীদের নতুন আনকোরা মিলের শাড়ি। ওরা ভেসে ভেসে একে
অপরের কাছে আসছে। জলের তলায় হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে একে অপরের থেকে কিছু কাড়ার চেষ্টা
করছে। জড়িয়ে জাপটে সাপটে। জলের তলাতেই পুরুষে পুরুষে এবং পুরুষে নারীতে হাত বদল
হয়ে যাচ্ছে সেই বস্তুটা। এ যেন চোর পুলিশ খেলা। আমরা খেলেছি
মাটিতে, শুকনো ডাঙায়। ওরা খেলছে জলে। আমাদের প্রকাশ্য ছোঁয়াছুঁয়িতে থাকত অন্যদের না দেখার সতর্কতা।
এখানে যাঁরা দেখছেন তাঁরা হাস্যে-লাস্যে উজ্জ্বল। যাঁরা খেলছেন তাঁরা জলের নিচে কত কী, সে সব নিছক কল্পনার বিষয়।
সুনীল এখনো
দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। এমন কী এদিকেও নজর নেই তার। আমি আরেকটু এগোলাম। হাঁটতে হাঁটতে
একেবারে এসে দাঁড়ালাম পাড়ে বসা মানুষদের কাছে। তাঁরা নিতান্ত নিমগ্ন। আমাকে দেখেও
দেখছেন না। গ্রাহ্যই করছেন না। উত্তেজনা যেন থমকে আছে শরীরের সব রেখায়। সামান্য
নড়লে চড়লেই দেখতে পাচ্ছি টলটলে জলের মতো উপচে উপচে পড়ছে। আর জলকেলীরত ও রতারা বাকি পৃথিবীকেই দেখছেন না। মনে হলো, অরণ্যের মধ্যে যখন গাছেদের একান্তে দাঁড়াই তখন তারা যেমন
আমাকে আলাদা করে জানেই না, যেমন ছিল তেমনই
থাকে, এঁরা সব তেমন প্রাকৃতিক।
দেখতে দেখতে
বসে পড়ি। অজস্র
বলিরেখাঙ্কিত শ্রী মুখকে জিজ্ঞেস করি-
- আজ কি আপনাদের কোনো উৎসব?
জলের দিকে
চেয়েই জবাব দেন-
- বিহা।
আমি কিছু বলার
আগেই বললেন-
- বেটার বিহা!
- এটা কী হচ্ছে?
তাকালেন একবার।
এক ঝোঁকেই তাকালেন এবং ঘুরে গেলেন। উত্তর দিলেন না। চুপ করে বসে রইলাম। খেলা চলছে। আমি তাঁর
উত্তেজনায় বাধা দিচ্ছি। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বসলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম।
জলের মধ্যে
ডুবে আছে জীবন। কখনো গলা অবধি, কখনো বুক বা পেট। ওরা সব লাস্য নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে, যৌবন
নিয়ে লুকোচুরি খেলছে, আমরা দেখছি পাড়ে বসে।
উন্মাদনা ছড়িয়ে
যাচ্ছে জলের প্রতিটি ভেঙে পড়ায়। জলের কুচিতে শেষ দিনের আলোও খেলছে না, যৌবনের খুশি খেলছে।
সুনীল এখানে
আসেনি।
অনেক দূরে...!
আমি খেলছি।
সুনীল খেলছে। বিতস্তা খেলছে। তিতলী খেলছে। যুবতী খেলছে। জল খেলছে।
এবং উপন্যাসের
সমস্যা হচ্ছে, আমরা যতক্ষণ না জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে আসছি ততক্ষণ পাঠক অতৃপ্ত
থেকে যাবে।
জলে স্নান, জলে প্রাকৃতিক থেকেই সুনীলের চণ্ডাশোকে
রূপান্তর। কৌরবাকী পরিচিতি। পরিচিতি থেকে কামনা। কামনা থেকে সম্প্রসারণ।
সম্প্রসারণ থেকে যুদ্ধ। যুদ্ধ থেকে জয় ও পরাজয় এবং অবশেষে পরাজয়। সুনীল এখন অশোকের
জামাটাও আর পরতে পারছে না। জলখেলা থেকে চোখ তুললেই আমি দেখতে পাচ্ছি সম্পূর্ণ উল্টো
দিকে মুখ করে একটা পাথরের ওপর বসে পড়েছে সুনীল। ওর আশেপাশে বেশ কয়েকটা বাঁদর ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ওর খুব কাছেই একটা মা-বাঁদর তার সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ওরা সবাই
ওখানে আছে, কিন্তু কেউই আলাদা করে আর নেই।
সব মিলে মিশে গেছে। এই অবস্থায় ওদের আঁকতে গেলে রেখাগুলোও আলাদা করা যাবে না। সব
রেখা মিলে মিশে একসা। এই নদী, এই পাহাড়, এই সব গাছপালা - এরাই সব কবে যেন বাঁদর হয়েছে, মানুষ হয়েছে; হতেও পারেনি
কিছু বলে বাতাস হয়েছে অথবা হতে চেয়েছে বাতাস বলে। ওদের পৃথক করব কী দিয়ে?
এবং পাঠককে
তৃপ্ত করতেই হবে, এ বাসনা থেকে কিছুই লেখা চলে না।
লেখা ক্রমে পণ্যে পরিণত হয়। লেখক সেই বণিক।
আর বাণিজ্য
বন্ধ হয়ে যায় কলিঙ্গে। সুনীল দেখতে পেতে থাকে একটা দেশ ক্রমে মরে যাচ্ছে। একটা
যুদ্ধক্ষেত্রে অজস্র শবদেহের মধ্যে দাঁড়িয়ে, পচনের গন্ধে নিজের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছিল অশোক। এই তো মরে যাওয়া। খানিক
আগেই এরা সব ছিল। হাসছিল খেলছিল তার ক’দিন আগেও। পরিবার ছিল; শিশু, উচ্ছলতা, উপভোগ সব ঢেউ
তুলে তুলে আসত। দুঃখ দারিদ্র মশা মাছির মতো ভনভন করত। আজ
সব মরে পড়ে আছে। দেহ কারো অক্ষত না। কারো আছে গোটাটা এক জায়গায়। কারো
তাও নেই। এই দেহের অধিকারী ছিল এরা। মেনে নিয়েছিল সেই অধিকার স্বাভাবিক জ্ঞানে।
অথচ আজ দেখ, সেই স্বাভাবিকতা কোথায় গিয়েছে! কোথায় গিয়েছে কেউ
জানে না! কেউ না! সেই না জানাটাকে আমরা মৃত্যু বলে একটা দাঁড়ি দিয়ে দিই। দাঁড়ি
মানে শেষ, খতম।
এবারে কাগজ কলম
নিয়ে আপনি একটা দাঁড়ি আঁকুন। সোজা একটা খাড়াটে রেখা টানবেন। সেই রেখাটার মাথায়, পায়ের নিচে, উল্টোদিকে আর ক’টা রেখা টেনে দিন। ঘর হয়ে যাবে। মানে ওই একটা রেখা আসলে অমন খাড়াটে
দাঁড়ালে তাকে দেওয়াল বলবেন। দেওয়াল উঠলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন। অথচ দাঁড়ানোর থেকেও
দাঁড়ি আসতে পারে। সুনীল দাঁড়িয়েছিল। অশোক দাঁড়িয়েছিল। আশেপাশে একটু দূরত্বে জনা ক’য় প্রহরী। মশালের কাঁপা কাঁপা আলো ঠিকরোচ্ছে। অশোক তাকিয়ে
ছিলেন মৃতদেহগুলোর
স্তুপের দিকে। পেছন থেকে ভেসে এলো নারীকন্ঠ-
- সম্রাট, আকাশ দেখেছেন কখনো?
অশোক আচম্বিতে
ঘুরে দাঁড়ালেন। নারী, বৌদ্ধ শ্রামণিক।
মুন্ডিতা মস্তক। মশালের ছায়া চুলেও আটকাচ্ছে না। এ কন্ঠস্বর তাঁর অভ্যন্তরের জলের
স্রোত থেকে উঠে আসছে। ওই যে শান্ত এবং তীক্ষ্ণ
চক্ষুদ্বয়, ওগুলো একদিন এক গর্ভিণী বাঘিনীর মৃত্যুতে জ্বলে
উঠেছিল।
তিনি আকাশ
দেখার মতো বিরাট কখনো হতে পারেননি। তিনি কৌরবাকীকে দেখেছেন এবং
দেখেছেন বলে ভেবেছেন। এখন দেখছেন আসলে তিনি সবটা দেখতে পাননি। কলিঙ্গের কন্যা
কাউকে বিবাহ করেননি। শ্রমণ হয়েছেন। এত রক্তপাতের শেষে ক্ষমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
অশোক ক্ষমা চাইছেন। কিন্তু ক্ষমা চাইতে চাইতেও মনে রাখতে হচ্ছে তিনি ক্ষমতাসীন।
কৌরবাকী আকাশ
দেখাতে শেখাতে শুরু করলেন। সুনীল বসে রইল পাথরের টিলাতে।
আরেকরকম দাঁড়ি
হয় যারা নৌকায় দাঁড় টানে। যখন নদী বা সমুদ্রের হাওয়া কাজ করে না, তখন দাঁড়ের ওপর ভরসা। যখন কাজ করে তখনও দাঁড় বাওয়া চলে।
এই যে আমি
দাঁড়িয়ে পড়লাম এখন, জল খেলা চলছে তখনো। বয়স্কা আমাকে দাঁড়াতে দেখে
বলতে শুরু করতে যাচ্ছিলেন আখ্যান। আমি হাসলাম। বললাম-
- দেখুন দেখুন! আমার পরে শুনলেও চলবে।
তিনি আশ্বস্ত হলেন। আবার ডুবে গেলেন জলে।
দেখা শেষ হয়
না। জানা শেষ হয় না। একটা প্লট খুঁজতে খুঁজতে এই সংসারের কতই না জল ঘাঁটলাম আমি। স্বচ্ছ, ঘোলাটে, নোংরা,
ক্ষারীয় – কত্ত রকমের জল! ডুলুং-এর খাড়াই পাড় ধরে আমি উঠতে শুরু করলাম। মাথার ওপর চাপ চাপ অন্ধকার নেমে আসছে। অন্ধকার নেমে এলেই আমি মহাশূন্যতা টের
পাই। হাত বাড়ালেই আমার হাতে অন্ধকার লেগে যায়। সেই হাত নিয়ে উপর্যুপরি সাদা পাতার
কাছে আসি। কালি দিয়ে হরফ বানাই। সাদাতে কালো দিয়ে আলো লেখার একটি ক্রমণ্বয়িক
প্রচেষ্টাকে আখ্যান বলি। তার সঙ্গোপনে যে ঠিকরে যাওয়া অন্ধকার লুকিয়ে থাকে, তা উপন্যাস হয়ে যেতেও পারে!
(সমাপ্ত)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন