নারীর মূল্য নির্ধারণে পুরষের পরিবার ছিল
স্বঘোষিত দাদা, আর তাদের যাবতীয় মনের কোণে গচ্ছিত চাহিদা মেটানোর দায়
ছিল মেয়ের বাবার। সেখানে সে বাধ্য, অসহায় ছিল। এটা জেনে বুঝে আমি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিই। মা মাঝে মাঝেই নাকে কাঁদতেন, এত কালো মেয়ের বিয়ে কী করে দেব? টাকা কোথায় পাব? তারপর ধমকের সুরে বলতেন, ভালো করে পড়! চাকরি না পেলে কিন্তু বিয়ে হবে
না! হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরলেই বাড়ির কোন মেয়ের কত ভালো বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে, সেই গল্প শোনাতেন। খাবার ছেড়ে উঠতে হতো আমায়, কেননা আমি ততদিনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, চাকরি না পেলে আমার বিয়ে সত্যিই হবে না। আর সেটা পেতে আমার
দেরী হবে, আর খুব বেশি দেরী হয়ে গেলে পরিবারের একটি বড় লজ্জা!
নিজের সাবজেক্ট পড়তে গিয়ে
আমা্র জীবনে বদল আসে। এসপ্ল্যানেডের পড়ে থাকা বই টানতে থাকে আ্মায়। সেখানে যাবতীয় ক্ল্যাসিক
নভেল জলের দরে বিক্রি হয় দেখে সেসব কিনে ফেলি। পড়ার পরিধি বাড়ে। মায়ের ও পরিবারের বানিয়ে
দেওয়া পৃথিবী থেকে আমি নিজেকে টেনে তুলে এগিয়ে যেতে থাকি। পরিচয় হয় এক মেডিক্যাল স্টুডেন্ট-এর সাথে। মায়ের ড্রিম প্রোজেক্ট
আকস্মিক ভাবে সাফল্যের মুখ দেখে। এক সুদর্শন ডাক্তার জামাই সে পেয়ে যায় তারই ‘পুণ্যি’র জোরে। ধর্মের বাধা কর্পূর হয়ে ভ্যানিস হয়ে যায়।
আসল জীবন শুরু হয় দাম্পত্যের প্রথম দিন থেকে। বুঝি, মায়ের আশা পূরণ করতে গিয়ে আমি অগাধ জলে পড়েছি। সাঁতরে পার হবার ক্ষমতা নেই, তাই অলটারনেটিভ পথ বার করতেই হবে। আমার বয়ফ্রেন্ড স্বামী হতেই খুব মুশকিল হয়। সে বোঝে রাতের বিছানা, খাওয়া আর অপারেশন বা মেডিসিন সংক্রান্ত জিনিস নিয়ে পড়ে থাকা। আমি তার কাছে ব্যবহারের জিনিস মাত্র বা মেন্টাল সাপোর্টের এক উপাদান মাত্র। যে ব্যক্তি এত অপছন্দের, তার সাথে এক শয্যায় থাকা খুব দুরূহ হয়ে ওঠে। আমি জবরদস্তি থেকে রেহাই পেতে পালিয়ে আসি একরকম দুয়ার ভেঙে। কিন্তু বয়ে নিয়ে আসি অন্দরে আরেক জীবনের বীজ।
আসল জীবন শুরু হয় দাম্পত্যের প্রথম দিন থেকে। বুঝি, মায়ের আশা পূরণ করতে গিয়ে আমি অগাধ জলে পড়েছি। সাঁতরে পার হবার ক্ষমতা নেই, তাই অলটারনেটিভ পথ বার করতেই হবে। আমার বয়ফ্রেন্ড স্বামী হতেই খুব মুশকিল হয়। সে বোঝে রাতের বিছানা, খাওয়া আর অপারেশন বা মেডিসিন সংক্রান্ত জিনিস নিয়ে পড়ে থাকা। আমি তার কাছে ব্যবহারের জিনিস মাত্র বা মেন্টাল সাপোর্টের এক উপাদান মাত্র। যে ব্যক্তি এত অপছন্দের, তার সাথে এক শয্যায় থাকা খুব দুরূহ হয়ে ওঠে। আমি জবরদস্তি থেকে রেহাই পেতে পালিয়ে আসি একরকম দুয়ার ভেঙে। কিন্তু বয়ে নিয়ে আসি অন্দরে আরেক জীবনের বীজ।
বছর দুই যুদ্ধ চালিয়ে চাকরি মেলে। হাইস্কুলে জয়েন করি ২০০২
সালে। তখন যুব সমাজ অনেকটাই অনগ্রসর, মানে নেটের বাইরে জীবন তাদের। ক্লাসে গিয়ে জানতে পারি, অষ্টম শ্রেণীর ফার্ষ্টবয় পড়াশোনা করছে না। তার বাবা আবার ডাক্তার। আমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে তিনি
আমায় হাতজোড় করে অনুরোধ করেন, দুষ্টু ছেলেকে পড়ানোর
জন্য। আমি সেই যজ্ঞে আদর্শ শিক্ষকের ভাবনায় সামিল হই।
সেই ছেলে আমায় দেখলেই
পালাতে থাকে। কারণ জানতে চাইলে সে বলে, আমি সুন্দর নই আর অসুন্দর
মেয়েমানুষদের তার পছন্দ নয়। ইতিহাস ভূগোলের বাইরে যাবতীয় বিষয় আমি তাকে পড়াতে গিয়ে দেখি
সে একদম পড়াশোনার ট্র্যাকে নেই। আমার স্কুল করে গিয়ে নিজের বাচ্চা বাড়িতে রেখে তাকে পড়ানোর
পরিশ্রম তার ভাবনায় পরিবর্তন আনে। সে পড়ামুখী হয়। এবারে সে বলে ফেলে, ম্যাম
আমি একটা ভুল কথা বলেছিলাম! আপনি খুব সুন্দর। তার ফোকাস বদল দেখে আমি
সতর্ক হই। সে তার ছোট্ট জীবনের কথা আমাকে এক এক করে বলে, কেন তার পড়তে ভালো লাগত না
জানায়। সে বলে, আমাকে কোনো ভালো হোটেলের খাবার খাওয়াবেন অর্ডার দিয়ে? আমি তার পচ্ছন্দ মতো সেখানে নিয়ে যাই, ঘর বুক করে তাকে খাওয়াই। সে কথা দেয় আর পেছনে তাকাবে না। তার লক্ষ্য আমার স্বপ্ন পূরণ মানে সে ডাক্তার হতে চায়। এভাবেই এগিয়ে যেতে
থাকে তার মন ও সিলেবাসের সম্পর্ক। পরীক্ষায় সে তার প্রথম স্থান উদ্ধার করতে সফল হয়। ছাত্রের স্বপ্নের সঙ্গে আমি
পাল্লা দিই, দেখি সে কতদূর যেতে পারে! এবারে নবম শ্রেণী। এদিকে আমার ছাত্র নিয়ে হোটেলে খেতে যাওয়াটা বেশ সেনশেসন
ফেলে। অনেকেই নানা প্রশ্ন তোলে, তবে আমার কাছে কেউ জবাবদিহি চায় না।
এদিকে আমার সন্তানের পিতা জানতে পারেন, আমি বাচ্চার প্রতি অবহেলা করছি অন্যের ছেলের জন্য, যে কিনা স্কুলের ফার্ষ্ট বয়। হিংসায় জ্বলতে থাকে এক ডাক্তার, এক বাবা, এক অনাহুত স্বামী। তাকে পড়ানো বন্ধের জন্য মাঠে বাবাকে নিয়ে নামে দুর্বল সৈনিক। বাবা ফোনের ওপার থেকে বলেন, আমার একটা সম্মান আছে, সেখানে যেন কোনো দাগ না পড়ে! আমি অবাক হই। বাবা বলেন, তুমি এক বখাটে ছেলের জন্য নিজের সন্তানের যত্ন নাও না? উত্তরের জন্য এই ফোনকল ছিল না, আসলে একটি অলিখিত হুমকি ছিল। পড়ানো না ছাড়লে ব্যবস্থা নেব, এমন! মানে আমি এখনও সাবালক নই। স্বামী ও বাবা আমার ভালোটা বলে দেবেন, আর সেটাই আমার চলার পথ হবে। আমি আরও দৃঢ় হই। পড়ানো অব্যাহত থাকে।
এদিকে আমার সন্তানের পিতা জানতে পারেন, আমি বাচ্চার প্রতি অবহেলা করছি অন্যের ছেলের জন্য, যে কিনা স্কুলের ফার্ষ্ট বয়। হিংসায় জ্বলতে থাকে এক ডাক্তার, এক বাবা, এক অনাহুত স্বামী। তাকে পড়ানো বন্ধের জন্য মাঠে বাবাকে নিয়ে নামে দুর্বল সৈনিক। বাবা ফোনের ওপার থেকে বলেন, আমার একটা সম্মান আছে, সেখানে যেন কোনো দাগ না পড়ে! আমি অবাক হই। বাবা বলেন, তুমি এক বখাটে ছেলের জন্য নিজের সন্তানের যত্ন নাও না? উত্তরের জন্য এই ফোনকল ছিল না, আসলে একটি অলিখিত হুমকি ছিল। পড়ানো না ছাড়লে ব্যবস্থা নেব, এমন! মানে আমি এখনও সাবালক নই। স্বামী ও বাবা আমার ভালোটা বলে দেবেন, আর সেটাই আমার চলার পথ হবে। আমি আরও দৃঢ় হই। পড়ানো অব্যাহত থাকে।
এবারে সন্তানের পিতা এবার ভিলেন হয়ে ওঠেন। আমার পড়াতে যাওয়ার পথ রুদ্ধ
করা হয়, কেড়ে নেওয়া হয় আমার মোবাইল। প্রশ্ন করা হয়, কীসের আকর্ষণ? আমার ব্লাডপ্রেসার ‘হাই’ হলে ডাক্তারবাবু জানতে চান, আমি কন্ট্রাসেপ্টিভ ব্যবহার করি কিনা। বিদ্যুতে পুড়ে যাওয়ার মতো আমি জ্বলতে থাকি। প্রশ্ন করে ফেলি, ক্লাস এইটে পড়া বাচ্চাকে নিয়ে এত
নোংরামী কেন? উত্তর আসে, মেডিক্যাল সায়েন্স বলে, একজন এই বয়সী ছাত্র
পেনিট্রেসনে সক্ষম। ঘৃণায় বমি আসে আমার। মনে হতে থাকে, এই লোকটি আমার স্বামী হতেই
পারে না! গা গুলিয়ে আসে ভাবতে। মন, শরীর, আত্মার দরজা সপাটে বন্ধ করে ফেলি সব দায়বদ্ধতার সীমানা
লঙ্ঘন করে।
ছাত্রের সব স্বপ্ন, সব ইচ্ছা পূরণের দায় আমি কাঁধে তুলে নিই
সব্বাইকে একটি ‘ফিটেড আনসার’ দেবার অপেক্ষায়। শুধুমাত্র সাফল্যের দোড়গোড়ায়
অপেক্ষা। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সে, কিন্তু আমার কাছে সে সেই ছোট্ট ছেলে যে দিদিমণি সুন্দর চেহারার নয় তাই
পড়তে অপরাগ। একদিন সন্ধেবেলায় তাকে পড়াতে গিয়ে দেখি সে দরজা খুলছে না। অনেকবার ‘নক’ করার পর বেরিয়ে এলো। ঘরের আলো নেভানো। কী হয়েছে? জিজ্ঞাসা করতেই হু হু করে কেঁদে ওঠে সে। আমি কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত দিতে সে আমায়
জড়িয়ে ধরে বলে, ম্যাম আমি খারাপ হতে চাই না! আমি বড় হতে চাই! আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন
না তো? আমি খুব অবাক হয়ে পড়ি। কথা হারিয়ে যেতে থাকে আমার। সেদিন ছাত্রের দিকে তাকিয়ে আমার দৃষ্টি ঘোলাটে হতে থাকে। একজন প্রতিভাধর ছাত্রকে
ছাড়তে হবে আমায় আমার লক্ষ্য সম্পূর্ণ হবার আগেই, তা বুঝতে পারি।
আসলে শিক্ষকতার প্রথমে
আদর্শের ভূত আমার মাথায় এতটা চড়ে বসে যে আমি ভুলতে থাকি ছাত্রের সাথে
একটা সীমারেখা মেনে চলতে হয়। কিন্তু সেটা মানলে এই বখাটে ছাত্রটা আরও বয়ে যেত, আর তাই তার মননে নেমে তার মতো করেই আমি তাকে জয়
করেছিলাম। ভাবিনি, সেটা আমার নারীসত্ত্বা নিরপেক্ষ নাও হতে পারে তার কাছে। আজ সেই ছেলের সব চেয়ে বড়
সমস্যা আমার বায়োলজিক্যাল কাঠামো হয়ে উঠেছে। বুঝতে পেরেও মাধ্যমিক
পর্যন্ত আমায় থামতে হয়। তারপর সে আলামিন মিশনে একাদশ শ্রেণীতে পড়তে যায়। ফিরে এসে
বলে, আমার কাছে থাকলে পড়া ভালো হবে। যে ব্যক্তি একদিন হাতজোড় করেছিলেন নিজের ছেলের ক্যারিয়ারের
জন্য, সেই মানুষটি বেইমানের মতো বলতে থাকেন, আমার জন্যই নাকি ছাত্র পালিয়ে এসেছে, সে আমাতে ‘আয়াডিক্টেড’ হয়ে পড়েছে।
আমার মেয়ে বড় হতে থাকে। সেইসঙ্গে ছাত্রের বৃহত্তর ভবিষ্যতের কথা সামনে রেখে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিই। পাকাপাকিভাবে ছেড়ে আসি তারপর। আমার জুতোর ওপর সে পড়ে ফুপিয়ে কাঁদে, ম্যাম কার ভরসায় আমায় ফেলে যাচ্ছেন? সে জুতো আজও রেখেছি নিজের কাছে। আসলে ওকে বলতে পারিনি, কী রকমের সামাজিক চাপ এসেছিল। সব জায়গায় প্রচার করা হয়েছিল, আমি আমার ক্লাস নাইনে পড়া ছাত্রকে বিয়ে করেছি কলকাতায়। এই জঘন্য প্রচারের সামনে আমি আমার শিক্ষকতার বিরাট আদর্শকে মুছে ফেলতে বাধ্য হই। সমাজ সবচেয়ে বড় ‘জায়েন্ট’। এর কাছে মাথা নুইয়ে ফেলা ছাড়া আমার কাছে কোনো বিকল্প সেদিন ছিল না।
আমার মেয়ে বড় হতে থাকে। সেইসঙ্গে ছাত্রের বৃহত্তর ভবিষ্যতের কথা সামনে রেখে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিই। পাকাপাকিভাবে ছেড়ে আসি তারপর। আমার জুতোর ওপর সে পড়ে ফুপিয়ে কাঁদে, ম্যাম কার ভরসায় আমায় ফেলে যাচ্ছেন? সে জুতো আজও রেখেছি নিজের কাছে। আসলে ওকে বলতে পারিনি, কী রকমের সামাজিক চাপ এসেছিল। সব জায়গায় প্রচার করা হয়েছিল, আমি আমার ক্লাস নাইনে পড়া ছাত্রকে বিয়ে করেছি কলকাতায়। এই জঘন্য প্রচারের সামনে আমি আমার শিক্ষকতার বিরাট আদর্শকে মুছে ফেলতে বাধ্য হই। সমাজ সবচেয়ে বড় ‘জায়েন্ট’। এর কাছে মাথা নুইয়ে ফেলা ছাড়া আমার কাছে কোনো বিকল্প সেদিন ছিল না।
এমনি করে সারাটা জীবন পালিয়ে আসা ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে, পছন্দের মানুষ ছেড়ে, সংসার ছেড়ে। সেই ছাত্র পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ার
হয়েছে খবর পেয়েও কোনো ভাবান্তর আসেনি। আসলে জীবনে একটা ‘স্পেস’ খুজে পাওয়ার জন্য ‘সার্চ’ চলতেই থাকে। কখনও সমাজ তার চালক, কখনও এই বেপরোয়া মন।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন