কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

তুষ্টি ভট্টাচার্য

রিয়া আর আমি  




রিয়া, রিয়া, রিয়া... কে যেন কাকে ডাকছে! কিন্তু কেউ তো নেই এখানে আমি ছাড়া! আমাকেই যেন কেউ রিয়া নামে একটানা ডেকে চলেছে! অথচ আমি রিয়া নামে কাউকে চিনি না, আমার ওরকম কোনো ডাকনামও নেই। তবে কি যে ডাকছে,  সে আমার সঙ্গে কাউকে গুলিয়ে ফেলেছে! আমার কি সাড়া দেওয়া উচিৎ? এসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই কখন যেন পিছন ফিরে তাকিয়ে ফেলেছি। আর অমনি আমি সেই রিয়া নামের মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে গেছি।

রিয়া অবিকল আমার মতোই দেখতে। অথচ আমি নয়। ওর স্বর, কথা বলার ভঙ্গি,  রেগে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়ার অভ্যেস থেকে বিরক্ত হওয়াটুকু পর্যন্ত আমারতোন।  আমি রিয়াকে বললাম, তোমায় কেউ অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে। ও বলল, উঁহু, আমায় না, তোমায় ডাকছে। আমি অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি এতক্ষণে। বললাম, কই, কে  ডাকছে? কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না! রিয়া বলল, কেন আমায় দেখতে পাচ্ছ না?  আমিই তো ডাকছি। রিয়া রিয়াকে ডাকছে অথচ বলছে আমাকে ডাকছে! আমি এসব সাত-পাঁচ পেঁচিয়ে যাওয়া ভাবনাদের ভাবা ছেড়ে দেব ঠিক করে ফেললাম এবার। ভাবলাম, যা হচ্ছে হোক। বরং এই রিয়ার সঙ্গে একটু গল্প করা যাক।



নাম তো জানাই হয়ে গেছে, তাই কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করাতে ভীষণ অবাক হলোবলল, সে কী! তুমি নিজের ঠিকানা ভুলে গেছ! বুঝলাম, এই পাগলীকে আর কিছু   জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না। নিজের মনে একটুখানি গুনগুন করে উঠতেই দেখি ওই রিয়া স্পষ্ট উচ্চারণ করে খোলা গলায় গানটা গাইতে শুরু করেছে। আমি থেমে গিয়ে ওর গানে মন দিলাম। এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। ঠিক করলাম, আর কিছু কথাই বলব না। গুনগুন-টুনগুনও না। দেখি কী করে ওই রিয়া! ওমা! ওমনি দেখি ফিক ফিক করে হাসছে! আমি গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলাম, হাসির কিছু হয়েছে কি? বলল, হ্যাঁ। কারণটা শুনি একটু। বলে কিনা – এই যে তুমি চুপ করে থাকতে চাইছ, আদপে চাইছ না বলেই এই অযথা গম্ভীর ভাব দেখানো। মন খুলে দাও দেখি একবার। আমি বললাম, মন খুলব? কার কাছে? সে কি আর খোলার বস্তু? বলল,  হ্যাঁ, খোলার বস্তুই। যেমন ভাবে পিঁয়াজের খোসা ছাড়ায়, সেভাবে পরতের পর পরত মন খুলে দিতে হয়। আর কার কাছে? এই বাতাসের কাছে, মাটির কাছে, আকাশের কাছে। দেখবে এক একটা পরত ঝরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি কেমন হালকা হয়ে  উঠছ। বিস্ময়ে আমার তখন চোখ কপালে উঠেছে আর কী! কী বলে রে বাবা এই পাগলীটা! মন খুলব, তাও আবার পিঁয়াজের মতো! পিঁয়াজের মতো পরত খুললে  চোখ জ্বলবে না! চোখ দিয়ে জল বেরোবে না! চোখ না জ্বলার গ্যারেন্টি ও কি দেবে? জিজ্ঞেস করেই ফেললাম আর চুপ না থেকে। উত্তরে বলল, তা একটু জ্বলবে বই কীতোমার মনের যা ঝাঁজ! তবে যত খুলবে, তত জ্বলুনি কমে আসবে। চোখ  দিয়েও আর জল পড়বে না।

  
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। ভাবতে চেষ্টা করলাম একটা পিঁয়াজকে। পিঁয়াজের মাথার ওই যে শেকড়গুলো লেগে থাকে, কেন থাকে? উপড়ে নিয়ে আসার পরেও কেন শেকড় থেকে যায়? ওদের শেকড়ের তো আর সেই গভীরতা নেই যে মাটির ভেতরে ঢুকে গিয়ে নুনজল খাবে! তবু ওই এক গুচ্ছ সুতোর মতো শেকড় মাটির  ভেতরে তেমন ভাবে না সেঁদিয়েও জল পায়, আবার ছেড়েও যায় না ওই পিঁয়াজকে। উপড়ে নিয়ে আসার পর তো আর তাদের কোনো কাজ নেইতবু লেগে থাকে।  আচ্ছা এসব না হয় প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়াল। পিঁয়াজ বেচারির কোনো দায় নেই এর জন্য। শেকড়ের চিহ্ন বহন করাই তার নিয়তি। কিন্তু ওই রিয়ার কথা মতো যদি ধরি, আমার মনটাও পিঁয়াজের মতো, তাহলে কি আমার মনেরও উপড়ে যাওয়ার পরে শেকড়-চিহ্ন থাকে? কেউ দেখতে পায় বলে তো মনে হয় না। আমিও দেখি নি কোনোদিন।  

এবারও যথারীতি ওই রিয়া না কে যেন ফোড়ন কাটল – অত ভেব না গো! শুধু মনটাকে মেলে দাও পাখির মতোউড়তে দাও ওকে। বেঁধে রেখো না। আবারও  ভাবতে বসলাম, একবার পিঁয়াজের মতো পরতে পরতে খুলে দিতে বলছে মনটাকে। আর একবার পাখির মতো উড়ে যেতে বলছে মনটাকে। মাঝখান থেকে এই রকম   ছিটিয়াল মেয়ের পাল্লায় পড়লে আমার মনের দফারফা নিশ্চিত তাড়াতাড়ি বিদেয় করি ওকে মানে মানে। এবার দেখলাম আর কিছু বলল না। চুপ করে উঠে চলে গেল। ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মনটা খারাপ হলো একটু। ভাবলাম বোধহয়  দুঃখ পেল মেয়েটা, অভিমান নিয়ে চলে গেল। যতই হোক, কোনো ক্ষতি তো করে নি আমার। ভালোই বুদ্ধি দিচ্ছিল। এ বাজারে কেই বা যেচে এত শুভ বুদ্ধি দেয়! যাক্‌,  চলেই যখন গেছে, কী আর করা যাবে! নিজে থেকেই এসেছিল, নিজে থেকেই গেছে। আমার আর কী করার আছে!

রাতে ঘুম আসছিল না তেমন ভাবে। ভাবছিলাম সেই পিঁয়াজের মতো মনের কথা। পাখির ডানার মতো মনের কথা। এই সব মন কি আসলে একটাই, না আলাদা  আলাদা? যার পরত খুলে ফেলে দেওয়া যায়, তারই কি ডানা থাকে? হঠাৎ কোথা  থেকে একটা ঠান্ডা হাত কপাল ছুঁয়ে চুলে উঠে বিলি কাটতে লাগল। আমার দুচোখে তখন ঘুম নেমে আসছে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আবছা ভাবে যেন দেখলাম রিয়ার মুখআমার দিকে ঝুঁকে আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছে! যদিও সকালে উঠে আর তাকে  দেখতে পেলাম না। দিনের দৌড় শুরু হলো রোজকার মতোযেভাবে আর পাঁচটা  দিন কাটে, সেভাবে আজকের দিনটা কাটছে না। মানে একটা যন্ত্রের মতো লাগছে না  আর নিজেকে। মাঝে মাঝে কপাল ছুঁলেই সেই ঠান্ডা হাতটা অনুভব করতে পারছি আর বেশ আরাম হচ্ছে মনে। আরাম মানে যে আরাম করে বসছি, তা নয়। মাঝে মাঝে ওই পিঁয়াজের মতো মনটার একেকটা পরত খসে পড়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।  আর আমি বেশ হালকা হচ্ছি। আবার থেকে থেকেই ডানা গজাচ্ছে মনের। তখন পোঁ করে এক চক্কর উড়ে নিয়ে আবার কাজ। এই রকম মজায় মজায় দিন কাটে নি আগে। এখন মনে হচ্ছে ভাগ্যিস রিয়া এসেছিল রাতে! সে বাস্তবে না স্বপ্নে তা আমার  জানার দরকার নেই। কিন্তু ভাগ্যিস এসেছিল! আর আমিই কিনা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছি একরকম! নাহ্‌, মেয়েটা বেশ ভালোআমিই এত ভালো নই, আজ বুঝছি।



       


তারপর থেকে রিয়াকে আর দেখি নি। আমি জানি, ও অনেক অভিমান নিয়ে চলে গেছে। আসলে কিন্তু যায় নি। আছে। আমার পাশেই আছে। আমাকে জানান না দিয়ে আমার সঙ্গেই লেপটে আছে। আমাকে বুঝতে দিতে চায় না ওর অস্তিত্ব। একটা শুশ্রূষার মতো হাত আমি অনুভব করি প্রায়শই। আর আয়েশ করে নিজেকে ছেড়ে  দিই সেই হাতের কাছে। এই আরামটুকু আমার পাওনা, আমি জানি। এ পাওনা থেকে আমাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না। 

2 কমেন্টস্: