কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৮৪

 

করোনা ভাইরাসের করাল গ্রাস থেকে যদিও এখনও পর্যন্ত মুক্তি পায়নি বিশ্বপ্রকৃতি, কিন্তু যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে, লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিশ্বে  বসবাসকারী মানুষের মন থেকে ক্রমশ ভয়মুক্তি ঘটছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে আশঙ্কা এবং আতঙ্ক মানুষের শরীর ও মনকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল, এখন সেই আশঙ্কা এবং আতঙ্কের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে অনেকটাই যেন রেহাই মিলেছে। দীর্ঘদিন মানুষ চিকিৎসকদের পরামর্শে এবং স্বাভাবিক বিচার ও বিবেচনায় স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী হয়ে থেকেছে। থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যাপনের একঘেয়েমিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তারপর আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে পা রেখেছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রত্যাবর্তনের জন্য মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে মনের আগলকে। আসলে মানুষ এখন এই ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে আগের থেকে অনেক বেশি স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন। বেড়েছে বিজ্ঞান সচেতনাও। যেমন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে ‘মাস্ক’ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছে, কিন্তু তাতে শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসের সংক্রমণই নয়, অন্যান্য যে কোনো বিষাক্ত ও প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেও নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং ‘স্যানিটাইজার’ দিয়ে হাত পরিষ্কার করার ক্ষেত্রেও একই যুক্তি কাজ করে। আবার একটা মানুষের থেকে আর একটা মানুষের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখা, যাকে ইংরেজিতে ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স’ এবং বাংলায় ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে, (আমি অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবনায় এই দুটি শব্দ-বন্ধকেই ভুল মনে করি, বরং ‘শারীরিক দূরত্ব’ ও ‘বডি ডিস্ট্যান্স’ শব্দ-বন্ধ দুটিকে সঠিক মনে করি), তাও একই কারণে। বিশেষত আমাদের বিশ্বের সামগ্রীক আবহাওয়া দূষিত হতে হতে আজ এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, আমরা এখন যথার্থই বিষাক্ত পরিবেশের ভেতর বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছি। এবং শুধুমাত্র আমরা মানুষেরাই নই, বরং প্রকৃতিজাত সবকিছুই, প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ, জল-হাওয়া-মাটির মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে সেই বিষ। আর বলা বাহুল্য, বিশ্বকে দূষিত করার জন্য দায়ী এবং দোষী স্বয়ং মানুষই। দীর্গদিন ধরে মানুষ প্রকৃতিকে যেভাবে নিগৃহীত ও বিষাক্ত করেছে, আজ যেন মনে হয়, প্রকৃতি তারই প্রতিশোধ নেবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। মানুষ বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। সংকট ঘনিয়ে আসছে মানুষের জীবনযাত্রায়, এবং তারই ধারাবাহিকতায় দেশ তথা রাষ্ট্রের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি সর্বত্র। বস্তুতপক্ষে, আমাদের কারও জানা নেই, কবে আমরা এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব! 

 

নিজেরা সবাই ভালো থাকুন। সবাইকে ভালো রাখার জন্য সহযোগিতা করুন।   

 

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

                                                                                                   

দূরভাষ যোগাযোগ :           

08789040217 / 09835544675 

 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

                                         

<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩



             

এবার জীবন ও কিছু চড়াই উৎরাইয়ের শেষে তার উপভোগ্যতা নিয়ে হলিউডের কয়েকটা ক্লাসিক সিনেমা আলোচনা করার পালা। পুজোর আবহে যাতে মন ভাল  হয়। যাতে আমরা সবাই মাথায় রাখি যে, মেঘ আর কুয়াশা জীবনের শেষ কথা নয়  – ঝলমলে রোদ একদিন উঠবেই। সেটা কোভিড প্রসঙ্গেও সত্যি।

আমরা আজ আলোচনা করব ফ্রাঙ্ক কাপরা-র ‘ইটস্‌ এ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ (১৯৪৬), হ্যাল অ্যাশবি-র ‘হ্যারল্ড অ্যান্ড মড’ (১৯৭১), স্টিভেন স্পিলবার্গ-এর ‘দ্য কালার পার্পল’ (১৯৮৫) আর ফ্রাঙ্ক ডারাবন্ট-এর ‘দ্য শ্যশঙ্ক রিডেম্পশন’ (১৯৯৪) নিয়ে এগুলো বেছে নিয়ে আলোচনা করার দুটো উদ্দেশ্য। এক, এগুলো সত্যিই ভাল সিনেমা (আমার মতে) এবং আমি মনে করি জীবনের ইতিবাচক দিক ফুটিয়ে তোলার জন্য এইরকম ছবি আরো হওয়া দরকার। দুই, এই চারটে ছায়াছবির এক অদ্ভুত যোগসূত্র আছে। তা হল, এগুলো খুব ভাল সিনেমা হওয়া সত্বেও কোন অস্কার পায়নি। এর থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। অস্কার পেলে তবেই সেই ছবি দারুন, নচেৎ নয় – এই ধারণা ভুল। বরং এভাবে বলা উচিৎ,  অস্কার কমিটির সদস্যদের মনের ভেতর কিছু স্থিরচিত্র গাঁথা থাকে। তার সঙ্গে ফিট করলে তবেই সেই সিনেমা সেরা ছবি হিসেবে অস্কার পায়, নইলে ভাল সিনেমা হলেও পুরস্কার জোটার সম্ভাবনা কম। এবং অনেক বড় বড় চিত্র-সমালোচক অস্কার পাওয়া নিয়ে বহুবার বহু বিতর্ক তৈরি করেছেন, বারবার তাঁরা একটাই কথা   বলেছেন – অস্কার পাবার সমীকরণ খুব জটিল। এই চারটে সিনেমা নিয়েও সমালোচকরা বলেছেন যে, এইসব ছবির সমসাময়িক যে ছবিগুলো সেরা ছবির  অস্কার পেয়েছে - ‘বেস্ট ইয়ারস অফ আওয়ার লাইভস্‌’ (১৯৪৬), ‘ফ্রেঞ্চ কানেক্‌শন’ (১৯৭১), ‘আউট অফ আফ্রিকা’ (১৯৮৫) ও ‘ফরেস্ট গাম্প’ (১৯৯৪) – সেইবছর এগুলোর অস্কার পাওয়া উচিৎ ছিল। আমি দুটো ছবির বিষয়ে একটু ভিন্নমত পোষ করি, কার আমার মতে ১৯৭১ সালে কিউব্রিকের ‘ক্লকওয়ার্ক  অরেঞ্জ’ ছিল সেরা সিনেমা আর ‘হ্যারল্ড অ্যান্ড মড’ তারপরেই। এই দুটো সিনেমাই সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি। আর ১৯৯৪ সালের ‘ফরেস্ট গাম্প’ আমার খুব প্রিয় ছবি, কিন্তু ‘শ্যশঙ্ক রিডেম্পশন’ যে একটাও অস্কার পায়নি, সেটা সেই কমিটির  অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত। এবং পাঠক, আমার এই ধারাবাহিক লেখা যত এগোবে, তত দেখবেন আমি মাঝে মাঝেই হয়ত অস্কার কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করব। কিন্তু সেগুলো আমার ব্যক্তিগত মতামত। ওগুলো মনে রাখবেন না। কার আপনারাও যখন নিয়মিত সিনেমা দেখতে শুরু করবেন, তখন বুঝবেন  আপনাদেরও নিজস্ব এক মতামত তৈরি হচ্ছে – কোন্‌ ছবির পুরস্কার পাওয়া উচিৎ আর কার পুরস্কারপ্রাপ্তি ভুল, সেই নিয়ে




যাইহোক, আমরা সিনেমায় ফিরি। ‘ইটস্‌ এ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ জীবনের এক মন ভাল করা গল্প। বাস্তব ও অলৌকিক জগৎ যেখানে মিলেমিশে একাকার। মুখ্য চরিত্রে জেমস স্টুয়ার্ট ও ডোনা রিড। খুব ভাল অভিনেতা-অভিনেত্রী। দুজনেই একবার করে অস্কার ও গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার পেয়েছিলেন। অনেকেই হয়ত জানেন না, অভিনয়ের পাশাপাশি জেমস স্টুয়ার্ট ছিলেন একজন পাইলট ও পরবর্তীকালে আমেরিকান সেনা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনেরাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে উনি এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। সিনেমা শুরু হচ্ছে ক্রিসমাসের সন্ধেবেলা স্টুয়ার্টের (এই সিনেমার একজন সফল ব্যবসায়ী) জন্য অনেকের প্রার্থনা দিয়ে। এই ছবিতে ব্যবসায়ীর ভূমিকায় স্টুয়ার্ট বেডফোর্ড ফল্‌স নামক এক শহরে সারাজীবন সবার ভাল করেছেন, কিন্তু তার এক পারিবারিক শত্রু পটার তাকে পথে বসানোর জন্য এমন কিছু কাজ করে যে স্টুয়ার্টের মনে হয় তার এবার মরে যাওয়াই ভাল। তবেই ইন্সিওরেন্সের টাকায় তার বউ-ছেলে-মেয়ে ভালভাবে বেঁচে থাকবে। সে ব্রীজের মাথা থেকে নদীতে ঝাঁপ মারবে বলে এগোয়। সেই সময় সবার সম্মিলিত প্রার্থনায় স্বর্গ থেকে একজন অ্যাঞ্জেলকে পাঠান হয় স্টুয়ার্টকে বাঁচানোর জন্য। সেই অ্যাঞ্জেল স্টুয়ার্টকে বোঝায় যে সে গোটা জীবনে অনেকজনের ভাল করেছে, সুতরাং তার যদি কোন অস্তিত্ব না থাকে তাহলে এই সব জীবনগুলো অন্যরকম হয়ে যাবে। স্টুয়ার্ট বুঝতে পারে যে বেঁচে থাকার আসল অর্থ পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। সে খুশিমনে আবার তার বউ-ছেলে-মেয়ের কাছে ফিরে যায়।

এই ছবি রিলিজ করেছিল ক্রিসমাস সিনেমা হিসেবে। প্রথমে এই ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। প্রচুর লোকসান হয়। সেই সময় প্রচার এখনকার মত হত না। ফলে কাপরা অন্য সিনেমায় হাত দেন। এই ছবিও অন্ধকারেই পড়ে থাকে। বহু পরে, এই সিনেমা যখন পাবলিক ডোমেনে আসে, তখন ক্রিসমাসের ছবি হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। দেখুন, এখানে মাথায় রাখতে হবে যে ফ্রাঙ্ক কাপরা হলিউডের খুব বিখ্যাত পরিচালক। ওনার ছবি ৩০-৪০এর দশকে দুবার সেরা ছবির অস্কার পেয়েছে, উনি নিজে তিনবার সেরা পরিচালকের অস্কার পেয়েছেন। ফলে ‘ইটস্‌ এ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ বক্স অফিসে হিট হল কী হল না, অস্কার পেল কী  পেল না, তাতে ওনার কিছু যায় আসে না। কিন্তু স্টুয়ার্ট ও ডোনার মনকাড়া অভিনয় সত্বেও দর্শক ও সমালোচক যেভাবে এই সিনেমা থেকে প্রথম দিকে মুখ ফিরিয়েছিল, সেটা বেশ অবাক ব্যাপার। এটা ঠিক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রাঙ্ক কাপরার কোন ছবি আর বক্স অফিসে হিট হয় নি। এবং সমালোচকরাও এই ছবি নিয়ে সেই সময় বিশেষ কোন মন্তব্য করেন নি। অনেক পরে, ১৯৯৮ সালে, আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট এই ছবিকে শেষ ১০০ বছরের সেরা ১০০ ছবির তালিকায় স্থান দেয়। এবং ২০০৭ সালে এই সিনেমাকে আমেরিকার সর্বকালের সেরা অনুপ্রেরণাদায়ক ছবি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।




‘হ্যারল্ড অ্যান্ড মড’ আবার একদম অন্যধারার ছবি। একে ডার্ক কমেডি বলাই ঠিক হবে। এক ২০ বছরের ছেলে হ্যারল্ড, যার ভূমিকায় বাড কর্ট, আর এক ৮০ বছরের বৃদ্ধা মড, যার অভিনয়ে রুথ গর্ডন, এদের নিয়ে এই সিনেমা। হ্যারল্ড বন্ধুবিহীন এক যুবক যার সারাক্ষণের ইচ্ছে সুইসাইড করা, আর তার জন্য সে কখনো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে, কখনো স্প্রিং লাগানো ছুরি দিয়ে নিজেকে হত্যা করার সিন  তৈরি করে। হ্যারল্ডের মা তার জন্য চিন্তিত হয়ে মাঝে মাঝে যুবতী মেয়েদের এনে হ্যারল্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা করে, কিন্তু হ্যারল্ডের তাতে কোন উৎসাহ নেই। এইসময় এক শবযাত্রায় হ্যারল্ডের আলাপ হয় চটপটে আর পাগলাটে এক বৃদ্ধার সাথে। মড। মড হ্যারল্ডকে বিভিন্ন রকম পাগলামোর মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে শেখায় জীবনের প্রতি ভালবাসা। এবং এক সময় সে হয়ে ওঠে হ্যারল্ডের ‘গার্লফ্রেন্ড’। মডের হাতে আঁকা ট্যাটু থেকে হ্যারল্ড জানতে পারে সে ছিল নাৎজি ক্যাম্পের থেকে বেঁচে ফেরা একজন। হ্যারল্ড জীবনের প্রতি আবার উৎসাহ পায়। সেই সময় হঠাৎ মড ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে। শেষ সিনে দেখা যায় হ্যারল্ড সমুদ্র উপকূলে নিজের গাড়ি ফেলে দিয়ে ব্যাঞ্জো বাজাতে বাজাতে ফিরে আসে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু সিং আউট, সিং আউট...’। বিষয়বস্তু দারু। এই সিনেমার শুটিং হয়েছিল সান ফ্রানসিস্কোর উপকূল এলাকায়, ফলে  সিনারিও দারু। এবং এই সিনেমা নিজের সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল এক  ২০ বছরের ছেলে আর ৮০ বছরের বৃদ্ধার পাগলামোয় ভরা রোমান্টিক জুটি তৈরি করে। হয়ত সেজন্য অস্কার কমিটির বাঁধা চিন্তাধারায় এই সিনেমার নাম আসেনি। অবশ্য পরবর্ত্তীকালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট এই ছবিকে সর্বকালের সেরা ১০০ কমেডি ছবির তালিকায় ৪৫ নম্বর স্থান দেয়।




১৯৮২ সালে পুলিৎজার প্রাইজ পাওয়া অ্যালিস ওয়াকারের উপন্যাস অবলম্বনে স্পিলবার্গের সিনেমা ‘দ্য কালার পার্পল’। সেই সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা ছবি। হ্যারল্ড অ্যান্ড মড-এর মত। বিশ শতকের শুরুতে একজন কালো মহিলাকে আমেরিকায় বছরের পর বছর কীভাবে সামাজিক ও যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে  সেই নিয়ে এই সিনেমা। এবং সবশেষে সেই মহিলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কীভাবে নিজের কন্ঠস্বর ফিরে পাচ্ছে। এর মাঝে অনেক নাটকীয়তা আছে, অনেক টানটান  মুহূর্ত আছে। শেষে মন ভাল করা মুহূর্ত আছে। দেখলে বুঝতে পারবেন। এই  সিনেমা কিন্তু প্রকৃত অর্থেই আমেরিকার ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিল। এবং সেই সময় এই বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কেউ আমেরিকায় মুখ খুলতে চাইত না। হয়ত সেজন্যই ১১টা বিভাগে নমিনেটেড হয়েও এই সিনেমার ভাগ্যে একটাও অস্কার জোটে নি। তবে এটা ঠিক, এটাই ছিল স্পিলবার্গের প্রথম সিরিয়াস ছবি। তার আগে উনি শুধু গ্রীষ্মকালীন বক্স অফিস হিট সিনেমা তৈরি করতেন। এই ছবিতে এমন কিছু কথাবার্তা আছে, এমন কিছু দৃশ্য আছে, যা অনেকদিন মনে থাকে। দেখুন, পরবর্ত্তী কালে ‘টুয়েলভ ইয়ারস এ স্লেভ’ কালো মানুষদের দুর্দশা দেখিয়ে সেরা ছবি হিসেবে আকাদেমী পেল, অথচ তার বহু বছর আগেই এই এপিক সিনেমা পেল না। কেন? কোন্‌ দিক থেকে ‘আউট অফ আফ্রিকা’ এই ছবিকে টপকে গেছিল? এগুলোর উত্তর আজও কেউ জানে না।    




‘দ্য শ্যশঙ্ক রিডেম্পশন’এ মুখ্য চরিত্র দু’জন – টিম রবিন্স আর মর্গান ফ্রিম্যানপুরো ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে ফ্রিম্যানের গলায় ধারাবিবরণী। টিম রবিন্স এই ছবির একজন হতভাগ্য ব্যাঙ্কার। শ্যশঙ্ক জেলে আসা থেকে শুরু করে তার খুন না করেও খুনের আসামি হয়ে যাওয়া আর আজীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আস্তে আস্তে শ্যশঙ্ক জেলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, পুরোটাই ফ্রিম্যানের ভাষ্যে। ফ্রিম্যান সেই জেলে ‘রেড’ নামক এক কয়েদি যে বাইরে থেকে বিভিন্ন ছোটখাট জিনি স্মাগল করে  জেলের ভেতর আনতে পারে। সিনেমা যত এগোয়, আমরা দেখতে পাই রবিন্স আর ফ্রিম্যান দুজনেই মূলত ভাল স্বভাবের দুজন মানুষ যারা বন্ধুদের সাহায্য করে। রবিন্স বইপত্র নিয়ে থাকতে ভালবাসে, জেলের লাইব্রেরী সে পুরোদস্তুর সাজিয়ে তোলে। এর মাঝে জেলর আর তার কয়েকজন সহযোগীর অসাধুচক্রে রবিন্স ফেঁসে যায়। বেরিয়ে আসতে চাইলেও পারে না। এমনকি অন্য এক কয়েদি রবিন্সের নিরপরাধ হবার প্রমা দিলেও জেলর তা মানতে চায় না, উল্টে সেই কয়েদিকেই  মেরে ফেলে। রবিন্স সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এবং ২০ বছর পর সুযোগ পেতেই জেল থেকে পালিয়ে মেক্সিকো চলে যায়। যাবার আগে ফ্রিম্যানকে বলে যায়, সে ছাড়া পেলে যেন মেক্সিকো এসে রবিন্সের সঙ্গে ব্যবসায় হাত লাগায়। অনেকদিন পর ফ্রিম্যান প্যারোলে ছাড়া পায়। আর সোজা মেক্সিকো গিয়ে পুরনো বন্ধু রবিন্সের কাছে ওঠে।

এই সিনেমাও বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কার সহজেই বোঝা যায়।  জেলের ওপর এই ছবি তৈরি, নায়িকা নেই। অতএব ফিল্ম হিট হতে পারে না। তাছাড়া, সেই সময় লোকেরা এই সিনেমার নামের মানে ঠিক বুঝতে পারে নি। ‘শ্যশঙ্ক জেল থেকে মুক্তির স্বপ্ন’ – এইরকম গোদা নাম রাখলে হয়ত কারো বুঝতে অসুবিধে হত না। আমার আক্ষেপ দুটো কারণে। এক, এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি  তারিফ করার মত। বিশেষ করে ক্লোজ শটগুলো। দুই, অনবদ্য সংলাপ। মর্গান ফ্রিম্যানের শেষ প্যারোল ইন্টারভিউতে রিহ্যাবিলিটেশন নিয়ে সংলাপ আমাদের সভ্য মানুষ হিসেবে চুপ করিয়ে দেয়। এবং সবার ওপরে এই সিনেমার থিম - মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে ফেঁসে গেলেও আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। সে একদিন কোন এক জিহুয়াটানেহো বা শান্তির জায়গায় পৌঁছবে, এটাই প্রত্যেকের স্বপ্ন থাকে। এত বড় এক স্বপ্ন দেখানোর পরেও এই সিনেমার অস্কারের ঝুলি রইল শূন্য। যদিও  আকাদেমী না পেলেও শেষ হাসি কিন্তু হাসল এই ছবিই। ২০০৮ সাল থেকে আজ অব্ধি এই ছবি IMDB-র টপ রেটেড মুভিজ-এর ১ নম্বরে। কেউ নড়াতে পারে নি। এরপরেও কি অস্কার নিয়ে আর কিছু বলা উচিৎ?




এই প্রসঙ্গে আরেকটা সিনেমার কথা দু’এক লাইন বলে বিদায় নেব স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ (১৯৯৩)। এই ছবি নিয়ে আমার এক নস্টালজিয়া আছে। আমার কলেজ জীবনে সিনেমা হলে গিয়ে দেখা প্রথম ইংরাজি ছবির নাম ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’। ১৯৯৪-এর জানুয়ারি মাসে ব্যারাকপুরের দেবশ্রী নামক এক হলে এই সিনেমা এসেছিল (এখন আর সেই হল নেই)। তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। সেই সময়, এর গভীরতা না বুঝলেও একজন টিনেজার হিসেবে ছবিটা বেশ ভাল লেগেছিল। অনেক বছর পরে, গুয়াহাটিতে নিজের কোয়ার্টারে একা এই সিনেমা দেখে কোন খুঁত ধরতে পারিনি বলে তারিফ করেছিলাম। বলতেই হয়, যোগ্য সিনেমা হিসেবেই এ ছবি সাতখানা অস্কার পেয়েছে, এগারোটায় নমিনেটেড হয়ে। আমি খুশি যে এই ছায়াছবি সেরা সিনেমাটোগ্রাফি বিভাগেও অস্কার পেয়েছে কার সাদা-কালো এই সিনেমার ক্যামেরার কাজ চুপ করে দেখার মত। এক জার্মান ব্যবসায়ী অস্কার শিন্ডলার পোল্যান্ডে কীভাবে প্রায় ১১০০ জন ইহুদিকে নাৎসি  ক্যাম্প থেকে বাঁচায়, সেই নিয়ে তৈরি এই ছবির মুখ্য চরিত্রে লিয়াম নিসন, বেন কিংস্‌লে আর র‍্যালফ্‌ ফিনেস। এই ছবির কাহিনি ভেঙে বলব না, চাইব পাঠক-পাঠিকা নিজে দেখুন। সিনেমার শেষদিকে শিন্ডলারকে যখন তার কর্মচারীরা সবাই মিলে একটা সোনার আংটি দেবে যেখানে হিব্রুতে ছোট করে লেখা - ‘হুএভার সেভস্‌ ওয়ান লাইফ, সেভস্‌ দ্য ওয়ার্ল্ড এন্টায়ার’, তখন দেখবেন মন ভাল হয়ে যাবে। এই সিনেমা দেখে আমার শঙ্খ ঘোষের ‘ধূম লেগেছে হৃদকমলে’র প্রথম কবিতা মনে পড়ে গেছিল – ‘দেখে এসেছি ক্যানসার হাসপাতালে সকলেই আজ বেশ হাসিখুশি’।

পায়েল মণ্ডল

জয়েস, ইউলিসিস, সিলভিয়া বীচ, ফেনিগ্যান্স ওয়েক, নাজী গেস্টাপো অফিসার…




                               

“Sylvia carried pollen like a bee. She cross-fertilized these writers. She did more to link England, the United States, Ireland, and France than four great ambassadors combined. It was not merely for the pleasure of friendship that Joyce, Hemingway, Bryher, and so many others often took the path to Shakespeare and Company in the heart of Paris . . .”

-  Andre Chamson

মর্ডানিস্ট সাহিত্যের গডমাদার। মনখোলা সদা হাসিখুশি এই নারীর ভূমিকা মর্ডানিস্ট সাহিত্যের অনেক দিকপালদের জীবনে অসীম। সিলভিয়া বীচ শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী নামের ছোট্ট বুকস্টোরের সত্ত্বাধিকারী। মর্ডানিস্ট সাহিত্যের নক্ষত্র এজরা পাউন্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, টি এস এলিয়ট, জেমস জয়েসের মত লিখিয়েদের উপস্থিতিতে মুখরিত থাকতো সিলভিয়া বীচের বুকস্টোর। নিজের অজান্তেই বিশ্বসাহিত্যে জায়গা করে নেন সিলভিয়া বীচ এবং তার বুকস্টোরটি।  ১৮৮৭ সালে আমেরিকার বাল্টিমোরে জন্মগ্রহণ করেন সিলভিয়া বীচ। বীচের বাবা প্যারিসে আমেরিকান চার্চে চাকুরী করতেন। সেই সূত্রে প্যারিস আগমন। বীচ স্পানিশ, ইটালিয়ান, এবং ফ্রেঞ্চ ভাষা শিক্ষা নেন। ১৯১৭ সালে সর্বোনে ফরাসী সাহিত্যে পড়াশোনা করার সময় পরিচিত হন এইড্রিন মুনিয়ের সাথে। রুঁ-দ্যা-দিওনে তরুণী মুনিয়ে একটি বইয়ের দোকান চালাতেন। স্টোরটির নাম ছিল ‘লা মেইসন ডেস এ্যামিস দেস লিভ্রে!’ বইয়ের খোঁজে প্রায়ই আসতেন স্টোরটিতে আর এমনভাবে সখ্যতা গড়ে ওঠে মুনিয়ের সাথে। সখ্যতা গড়ায় বন্ধুত্বে যে বন্ধুত্ব অটুট থাকে আমৃত্যু। দুজনের বয়েস ছিল উনিশ বছর। মুনিয়ে মূলত মর্ডান লিটেরেচারের বই বিক্রি করতেন। ইন্টিরিয়র সাজান পেইন্টিং এবং ফটোগ্রাফ দিয়ে। গ্রাহকদের জন্য ছোট্ট চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা রাখেন যেখানে বসে ক্রেতারা বই পড়েতে পারবেন। এইড্রিন তার বই বিক্রয়ের পেশাকে বুদ্ধিদীপ্ত আর্টিস্টিক প্রফেশনের পর্যায়ে নিয়ে যান।

এইড্রিনের অনুপ্রেরণায় সিলভিয়া বীচ নিজের একটি বুকস্টোর খোলেন। শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী। বান্ধবী এইড্রিনের মতই তিনি মর্ডানিস্ট লিটেচারের বই দিয়ে দোকান সাজান। ফিতে কাটার সালটা ছিল ১৯১৯। সেসময় প্যারিস মুখরিত ছিল স্কট ফিটজেরাল্ড, এজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট, হেমিংওয়ে, গার্টুড স্টেইন, জর্জ এ্যান্টহিল, জুনা বারর্নস, মিনা লয়, ম্যানরে, জেমস জয়েসের মত লিখিয়ে শিল্পীদের উপস্থিতিতে। বান্ধবী এইড্রিন একটি পত্রিকা বের করেন যেখানে বিদেশী এই মার্ডানিস্ট লিখিয়েদের লেখা ছাপতেন ফ্রেঞ্চ রিডারদের কাছে মর্ডানিস্ট ইংরেজি সাহিত্যকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।

দুই তরুণী সিলভিয়া বীচ এবং এইড্রিন মুনিয়ে বিশ্বসাহিত্যের আভন্ট-গার্দ লিখিয়েদের বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। প্যারিসে এই দুজনের বুকস্টোরে বসে প্রবাসী উঠতি মর্ডানিস্ট লিখিয়েরা তাদের সৃষ্টিশীল চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি শুধু বইয়ের ব্যবসার জন্য দোকান খোলেননি বরং তিনি চাইছিলেন স্থানটা যেন শিল্পী সাহিত্যিকদের মিলনমেলার স্থান হয়, যেখানে তারা শান্তি করে বসে চিন্তা করতে পারবেন, পারবেন প্রকাশিত বইয়ের সাথে পরিচিত হতে। সিলভিয়া শিল্পের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দোকানে আগত শিল্পী সাহিত্যিকদের জন্য বিনা পয়সায় চা এবং স্নাক্সের ব্যবস্থা করেন। টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা রাখেন যেন তারা বসে বই পড়তে পারেন অথবা লিখতে পারেন। একজন কুরিয়ার রাখেন যার মাধ্যমে প্রয়োজন হলে চিঠিপত্র আদান প্রদান করতে পারেন এ ছাড়াও বিছানার ব্যবস্থা করেন যেন ভবঘুরে ঠিকানাবিহীন কোন লিখিয়ে দু’একদিন থাকতে চাইলে থাকতে পারেন।

১৯২০ সালে হেমিংওয়ে সিলভিয়া বীচ এবং তার বুকস্টোরকে আবিস্কার করেন। পকেটে বই কেনার মত অর্থ না থাকায় সিলভিয়া তাঁকে একগুচ্ছ বই ধার দেন। ইউরোপ এবং আমেরিকায় এমন ঘটনা ছিল বিরল, বলা যায় নেই বললেই চলে যে কোন বই বিক্রেতা বিনা পয়সায় বই দিয়ে দেন পাঠকদের। হেমিংওয়ে সিলভিয়ার এই আচরণে আপ্লূত হন। হেমিংওয়ে আমৃত্যু মনে রাখেন তার এই ক্ষুদে বান্ধবীকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘A Moveable Feast‘-এ সিলভিয়া সম্পর্কে এমন ভাবে স্মরণ করেন –‘She was kind, cheerful and interested, and loved to make jokes and gossip. No one I knew was ever nicer to me.’ হেমিংওয়ের পরিবারের সাথে বন্ধত্ব গড়ে ওঠে সিলভিয়া এনং তাঁর বান্ধবী এইড্রিনের সাথে। উইকএন্ডে হেমিংওয়ে, তাঁর স্ত্রী হেডলি, এইড্রিন এবং সিলভিয়া চলে যেতেন আউটিংএ আবার কখনো বক্সিং ম্যাচ দেখতে অথবা বাইক রেসিং দেখতে।

১৯২০ সালের জুলাইয়ের একদিন। বান্ধবী এইড্রিন সিলভিয়া বীচকে নিমন্ত্রণ করেন ফ্রেঞ্চ কবি অদ্রে স্পায়ারের বাড়িতে। ব্যাক্তিগত ভাবে অদ্রেকে চিনতেন না বীচ, তবে তাঁর কবিতা পড়েছেন। ব্যাক্তিগত পরিচয় না থাকার জন্য প্রথমে পার্টিতে যেতে চাননি বীচ।  এইড্রিনের চাপাচপিতে রাজী হন। সেই সন্ধেয় অদ্রের বাড়িতে পৌঁছলে এইড্রিন তাঁকে টেনে নিয়ে যান এক কোণে। ফিসফিস করে বলেন –‘The Irish writer James Joyce is here.’ পার্টিটি ছিল জয়েসকে প্যারিসে স্বাগত জানানোর জন্য। প্যারিসে থিতু হবার কোন পরিকল্পনা ছিল না জয়েসের। এজরা পাউন্ড জয়েসকে বুদ্ধি দেন প্যারিসের সেটেল করার জন্য। জয়েস এই শহরেই পরের কুড়ি বছর কাটান। এজরা পাউন্ড চাইছিলেন জয়েসের মত একজন লিখিয়ে যেন মর্ডানিস্টদের মক্কা প্যরিসে অবস্থান করেন। নতুন দেশে স্থানান্তরের এটাই ছিল উপযুক্ত সময়। জুরিখ থেকে জয়েস ইতিমধ্যে তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল উপন্যাস ইউলিসিসের মোট আঠারো এপিসোডের মধ্যে চোদ্দ এপিসোড লেখা শেষ করেন। ইউলিসিস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল আমেরিকার ‘লিটল রিভিউ’ পত্রিকায়।  ইতিমধ্যে ‘ডাবলিনার্স’ এবং ‘পোট্রেট অফ দ্যা আর্টিস্ট’ বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকা ইউলিসিসকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করলে মর্ডানিস্ট এই লিখিয়ে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে পড়েন। প্যারিসের সাহিত্যিক সমাজ জয়েসের স্বভাব সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন, চাষাড়ে, প্রচণ্ড ইগোয়িস্ট, ক্ষুরধার বুদ্ধি, বিশাল শব্দভাণ্ডার, এবং অসম্ভব পড়ুয়া, ভয়াবহ মদ্যপ, ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষ। সহজে কেউ জয়েসের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চাইতেন না, সাহিত্য আলোচনা তো নয়ই কারণ সাহিত্যকে তিনি যে স্তর থেকে বুঝতেন তেমন বোঝার মানুষ হাতে গোনা কয়েকজন ছিল মাত্র।

সেদিন এজরা পাউন্ড নীল ভেল্ভেট জ্যাকেট পরে এসেছিলেন। সাথে ছিল তাঁর স্ত্রী ডরোথি পাউন্ড। তুমুল আড্ডার মাঝে ছিলেন পাউন্ড। স্ত্রী ডরোথি আর একজন মহিলার সাথে আলাপে ব্যস্ত। মহিলাটি আর কেউ নয় নোরা বার্ণাকল, জেমস জয়েসের স্ত্রী (তখনো ধর্মীয় বা আইনগত ভাবে বিয়ে হয়নি নোরা এবং জয়েসের)। অনেক দিন পরে ইংরেজিতে কথা বলার মানুষ পেয়ে নোরাকে সেই সন্ধেয় খুব খুশি মনে হচ্ছিল।  পার্টির হোস্ট স্পায়ার ডিনার টেবিলে সমবেত গেস্টদের আসবার জন্য অনুরোধ করেন। তাদের গ্লাসে নিজে ওয়াইন ঢেলে দেন। সব অতিথিদের গ্লাস ওয়াইনে পূর্ণ হলেও জয়েসের গ্লাস সুরা শূন্য। জয়েসের পরিচিতজনরা প্রচণ্ড ভাবে বিস্মিত হন। ভয়াবহ লিকারপ্রেমীর গ্লাস কিনা শূন্য। বন্ধু এজরা পাউন্ড জয়েসের সামনে এক এক করে ডজন খানেক ওয়াইনের বোতল সার করে সাজিয়ে রাখেন। এই ভয়াবহ মদ্যপ আইরিশ লিখিয়ে নাকি সন্ধে আটটার আগে মদ স্পর্শ  করেন না!  এজরা পাউন্ডের এহেন কর্ম আর জয়েসের মদ্য বর্জনে উপস্থিত অতিথিরা ভীষণ মজা পেয়েছিলেন। ডিনার শেষ হলে জয়েস ডাইনিং রুম থেকে সোজা স্পায়ারের ছোট লাইব্রেরী রুমে গিয়ে বসেন হাতে একটি বোতল নিয়ে। জয়েসকে অনুসরণ করে বীচ লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন ওর সাথে পরিচত হতে। জয়েস গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি বইয়ের উপর চোখ বুলোচ্ছিলেন। ওর মনোযোগ ভঙ্গ হয় বীচের প্রশ্নে- “Is this the great James Joyce?”

চোখ তুলে দেখতে পান শুকনো লিকলিকে এক তরুণীর হাসি মুখ। খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিলেন জয়েস-

“James Joyce.”

সেটাই ছিল জয়েস বীচের বন্ধুত্বের সূত্রপাত।

বীচের সাথে কথা বলার সময় জয়েস ছিলেন খুব সতর্ক যেন ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কথা বলছেন। আইরিশ এ্যাকসেন্টে জয়েসের ইংরেজি বীচের খুব ভালো লেগেছিল। বীচ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন জয়েসকে তাঁর পরিচয় দিতেই পকেট থেকে একটি নোট বই বের করে চোখের খুব কাছে নিয়ে মেলে ধরেন। ঠিক যেই মুহূর্তে বীচের ঠিকানা লিখতে যাবেন তখনই কুকুরের ডাক শোনা যায়। তৎক্ষণাৎ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ান জয়েস। বীচ জানালার পাশে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন স্পায়ারের কুকুর ডাকছে।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বীচকে প্রশ্ন করেছিলেন- “Is it coming in? Is it feerrce?”


বীচ জয়েসকে ছোট্ট বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করেছিলেন কুকুরটি ঘরে আসবে না তো! বীচ পরে জানতে পেরেছিলেন জয়েসের কুকুর ভীতির কথা। শৈশবে কুকুর কামড়েছিল, সেই থেকে কুকুরের ভয় তাড়া করে ফিরেছে জয়েসকে। বীচ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন কুকুরের ভয়ে জেমস জয়েস নামের বিখ্যাত বদমেজাজী লেখক কি না কুঁকড়ে গেছেন! সেই সময় খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল জয়েসকে। একেবারে শিশু! পরদিন শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানীতে যান জয়েস। পরনে ছিল ডার্কব্লু সার্জ স্যুট, মাথায় কালো হ্যাট, পায়ে জীর্ণ ক্যানভাস স্যু। স্টোরের ভেতরের দেয়ালে ঝোলানো অস্কার ওয়াইল্ড এবং ওয়াল্ট হুইটম্যানের  ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলেন। বীচ বেশ দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলেন না-জানি জয়েস কী আবার বলে ফেলেন। ভদ্রলোক আর্মচেয়ারে বসলে বীচ কিছুটা  আশ্বস্ত হন। সেদিন স্টোর থেকে বের হবার আগে জয়েস বলেছিলেন বই ভাড়া করার জন্য তিনি মাত্র এক মাসের খরচ বহন করতে পারবেন। বীচ জয়েসকে এই ব্যাপারে না ভাবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। পরে বীচ আবিষ্কার করেন এই পরিণত বয়েসেও জয়েস ভয় পান বজ্রপাতে, কুকুরকে, সাগরকে, উচ্চতাকে, ঘোড়া, এবং যন্ত্রে। খুব ছেলেমানুষ মনে হয় জয়েসকে। এজরা পাউন্ড জয়েসের জন্য যে এ্যপার্টমেন্ট খুঁজে বের করেন সেটার অবস্থান ছিল এ্যাপার্টমেন্টের পঞ্চম তলায়। খুবই ছোট ফ্লাট। বাথটব ছিল না, ছিলো না ইলেক্ট্রিসিটি। মাঝের স্পেসে কোনমতে লেখার টেবিল বসানো হয়। গ্যাস বার্ন্ট টেবিল ল্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়। জয়েস ইউলিসিস লিখছিলেন সেসময়। উপন্যাসটি শেষের দিকে। দৃষ্টিশক্তি কমে যাবার জন্য স্বল্প আলোয় লিখতে পারছিলেন না।


১৯২০। বছরটা ছিল আইরিশ লিখিয়ে জেমস জয়েসের জন্য অশুভ বছর। আমেরিকার লিটল রিভিউতে তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল উপন্যাস ইউলিসিস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হচ্ছিল (১৯১৮ – ১৯২০)। বাদ সাধে ইউ এস সেন্সরশিপ ডিপার্টমেন্ট। ‘কিয়র্কি’ এপিসোডে উপন্যাসের প্রটাগোনিস্টের প্রকাশ্যে মাস্টারবেশনের দৃশ্যের জন্য আমেরিকায় উপন্যাসটির প্রকাশ, ধারাবাহিক প্রকাশ এবং প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ভীষণ ভেঙ্গে পড়েন জয়েস।  তার আগের দুটো বই ‘ডাবলিনার্স’ এবং ‘পোট্রেট অফ আর্টিস্ট’ প্রকাশ নিয়েও প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়, বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন,  এমনকি আদালতে গড়াতে যায়। গল্পগ্রন্থ ‘ডাবলিনার্স’ প্রকাশ করতে দীর্ঘ আট বছর জয়েসকে প্রকাশকদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়।  ইউলিসিস পুরোটা প্রকাশের আগেই নিষেধাজ্ঞায় জয়েস ভীষণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েন।

সিলভিয়া বীচ তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন –

‘ইংলিশ প্রকাশকের কাছে কোন সাহায্য পান না জয়েস। তাঁর জন্য সময়টা ছিল ভয়াবহ হতাশার। এই সময় জয়েস প্রায়ই আমার বুকস্টোরে আসতেন। চুপচাপ বসে বই পড়তেন অথবা নতুন প্রকাশিত বই নেড়েচেড়ে দেখতেন। বুঝতাম আট বছর ধরে লেখা উপন্যাস ইউলিসিস আমেরিকায় প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞায় তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। ভেঙ্গে পড়েছেন আর একটি কারণে যে কোন ইংলিশ প্রকাশনী সংস্থা তাঁর এই উপন্যাস ছাপতে রাজী নয়। ওর মলিন মুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল এই জিনিয়াস লিখিয়ের জন্য আমার কিছু করা উচিৎ। একদিন বিকেলে দেখি জয়েস খুব বিষণ্ণ হয়ে স্টোরের এক কোণে বসে আছে। পরনে লন্ড্রী না করা ড্রেস। টাকার অভাবে ড্রেস লন্ড্রি করাতে পারতেন জয়েস। গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখছে। এবার আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ওর সামনে যেয়ে দাঁড়াতেই মুখ তুলে চাইলেন। সরাসরি চোখে চোখ রেখে ওঁকে বললাম - “Would you let Shakespeare and Company have the honour of bringing out your Ulysses?” আমার চোখে চোখ রেখে সেইদিন বিন্দু মাত্র সময় নষ্ট না করে আমার প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। এমন ভাবেই আমার মত এক অচেনা প্রকাশকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কম পুঁজি, প্রকাশনায় অভিজ্ঞতা ছাড়াই ইউলিসিসের মত এক মহান উপন্যাস প্রকাশের সাহস করি’।

সিলভিয়ার প্রস্তাবে জয়েস সরাসরি রাজী হন। মর্ডানিস্ট সাহিত্যের প্রতি বীচের শ্রদ্ধা এই চ্যালেঞ্জকে নিতে অনুপ্রাণিত করে। বীচ যখন ইউলিসিস প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন, শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ছিল না। তিনি অভিজ্ঞ প্রকাশকও ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন তরুণী শখের গ্রন্থ বিক্রেতা। দূর্বোধ্য এই বইটির পাণ্ডুলিপি টাইপ করতে যেয়ে ভীষণ বিপদে পড়েন সিলভিয়া বীচ। প্রাথমিক ভাবে নয়জন স্টেনোগ্রাফারকে নিয়োগ দেন ইউলিসিস টাইপ করার জন্য। বইটি ভয়াবহ দূর্বোধ্য হওয়াতে স্টেনোগ্রাফার দের স্ক্রিপ্ট টাইপ করতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। বইটি টাইপ করতে যেয়ে স্টেনোগ্রাফারদের পারিবারিক জীবন পর্যন্ত হয়ে পড়ে তিক্ত । সারাদিন জয়েসের এই দূর্বোধ্য স্ক্রিপ্ট টাইপ করতে যেয়ে তাদের মেজাজ হয়ে পড়ে খিটখিটে, বাড়ি ফিরে প্রায়শই  স্বামীদের সাথে বাধে ঝগড়া। স্বামীদের সাথে তাদের সম্পর্ক হয়ে পড়ে শীতল। একজন স্টেনোগ্রাফারের স্বামী ডিভোর্সও দেয়। স্টেনোদের কয়েকজন ইউলিসিসের কপি  সিলভিয়া বীচের দরজার সামনে রেখে যায়, সাথে নোট অন্য স্টেনো নিয়োগ দেবার অনুরোধ জানিয়ে। জয়েস বলে কথা, পারফেক্ট আর্টিস্ট বলে কথা! আর্টিস্ট হবার পথ জয়েসের জন্য সোজা ছিল না। প্রতিটি বিষয়ে তাঁকে যুদ্ধ করে এগোতে হয়েছে। যেমনটা ভাবতেন জয়েস, আর্টিস্ট হবেন, হয়েছেন, হার্ড আর্নড আর্টিস্ট।

জয়েসের ইউলিসিস প্রকাশের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করার সাথে সাথে নিজের অজান্তেই সিলভিয়া বীচ বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে যান। এর আগে বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ছিল না বীচের। নিজের অর্থ খরচ করে দিন রাত খেটে বইটিকে আলোর মুখ দেখান সিলভিয়া বীচ। প্রথম এডিসনে ১০০০ কপি ছাপার পরিকল্পনা করেন এর মধ্যে ১০০ কপি ছিল লেখকের সাক্ষর যুক্ত। মজার ব্যাপার হলো কমিউনিস্ট চিন প্রথম এডিশনের ১০ কপি ইউলিসিস প্রিঅর্ডার করে। শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী থেকে ইউলিসিস প্রথম প্রকাশিত হয় জয়েসের জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে। ইউলিসিসের মত একটি মনুমেন্টাল উপন্যাসকে  পোড়ানো হয় লিখিয়ের নিজের দেশ আয়ারল্যান্ড এবং কানাডায় ১৯২২ সালে, ইংল্যন্ডে ১৯২৩ সালে। উপন্যাসটি ইংল্যান্ডে অফিশিয়ালি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ১৯২৯ সালে। সিলভিয়া বীচ জয়েসকে আগাম রয়ালটি দিয়ে সাহায্য করেন। জয়েস কিন্তু সিলভিয়া বীচের আবেগ এবং আর্থিক সহায়তার প্রতি সম্মান শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি। আমেরিকায় ইউলিসিসের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ৪৫০০০ ইউ এস ডলারে র‍্যান্ডম হাউজের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন দ্বিতীয় এডিশন প্রকাশের জন্য। সিলভিয়া বীচ খুব আশা করেছিলেন জয়েস শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানীর মাধ্যমেই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করবেন। ১৯২২ সালে ইউলিসিস বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হলে ইউরোপ এবং আমেরিকাতে রাতারাতি বিখ্যাত হন। বইটির উপর নিষেধাজ্ঞা এবং আয়ারল্যান্ড, কানাডা এবং ইংল্যান্ডে বইটি পোড়ানোর জন্য সাহিত্যবোদ্ধাদের মাঝে প্রচণ্ড আগ্রহ সৃষ্টি হয় এটা  জানার জন্য যে আসলে জয়েস উপন্যাসটিতে কী বলেছেন কেমন ভাবে উপন্যাসটি নির্মাণ করেছেন।

ইউলিসিস প্রকাশের পরে কিছুদিন রাইটার্সব্লকে পড়েন জয়েস। এই অবস্থা কাটতে বেশিদিন সময় লাগে না। এবার তিনি প্লানেট আর্থের ভয়াবহতম দূর্বোধ্য উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। নাম দেন ‘ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস’। উপন্যাসটার কাজ শুরু করে লেখা এগোলে জয়েস তার নাম ঠিক করেন। কঠিন গোপনীতায় রাখেন নামটা। বন্ধু ইউজেন জোলাসকে পড়ে শোনাতেন। জোলাস ছিলো তার ডাইহার্ড শ্রোতা। এদিকে ফোড ম্যাডক্স উপন্যাসটি তার পত্রিকা ট্রান্স আটলান্টিক রিভিউতে ধারাবাহিক ভাবে ছাপানোর জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। ম্যাডক্সকে জয়েস বলে দেন তিনি ছাপতে দেবেন কিন্তু নাম ছাড়া। সিরিজটা যাবে ‘ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস’ নামে। হ্যারিয়েট শ ওয়েভারের সাথে উপন্যাসটির নাম নিয়ে গেসিং গেম হয় জয়েসের। সেটা ছিলো মে ২৯২৭ সালে। জয়েস তাকে হিন্টস দেন যে তার এই উপন্যাসটির নাম হবে খুব সাধারণ। হ্যারিয়েট কয়েকটি নামের ধারণা করেন যেগুলো হলো – ওয়ান স্কোয়ার্ড, ডাবলিন এইল, আয়ারল্যান্ডস আই, ফিনিক্স পার্ক ও ফিন্স টাউন। এগুলোর একটিও জয়েসের গোপন রাখা নামের সাথে মেলেনি। জয়েস তার উপন্যাসটি নিয়ে গেসিং গেম খেলতে থাকলেন বন্ধুদের সাথে। জুলাই ১৯৩৮এর এক রাতে মাতাল হয়ে বন্ধু দম্পতি জোলাসদের সাথে গেসিং গেম খেলতে শুরু করলেন। জয়েস সূত্র দিচ্ছিলেন গেস করার জন্য। মারিয়া জোলাস ইউজেন জোলাসের স্ত্রী একবার সঠিক নামের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছান। ইউজেনের মাথায় ভূত চাপে জয়েসকে হারিয়ে দিতে। পুরো জুলাই মাস জুড়ে ইউজেন চিন্তা করতে থাকেন আর উপন্যাসটির ম্যান্সক্রিপ্ট বারবার পড়ে শোনেন। আগস্ট ২-এ তাঁর মাথায় একটা নাম ঝিলিক দিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় ডিনারের সময় জয়েসের সামনে নামটি উচ্চারণ করেন ইউজিন। নামটি শুনে জয়েস হতচকিত হয়ে যান। তিনি তার স্ত্রীকেও বলেননি নামটি। জয়েস ইউজিনকে জানান যে তিনি সঠিক নামটি বলেছেন। পরদিন অর্থাৎ আগস্ট ৩ তারিখে জয়েস ইউজিনের ফ্লাটে ব্যাগ হাতে হাজির হন। হাজার ফ্রাঁর কয়েন ভর্তি ব্যাগ ইউজিনকে হস্তান্তর করেন বাজীর টাকা পরিশোধ করার জন্য। জয়েস পাবলিশার্সেকেও বলেননি নাম কি হবে উপন্যাসটির তাই ইউজিনকে অনুরোধ করেন নামটি গোপন রাখার জন্য। প্রকাশক মিস ওয়েভার উপন্যাসটির নামটি দেখেন যখন তার টেবিলে টাইটেল পেজের প্রুফ কপি পান। দিনটি ছিল ফেব্রুয়ারি ৪, সাল ১৯৩৯। উপন্যাসটির নাম – ‘ফেনিগ্যান্স ওয়েক!’ ধারণা করা হয় উপন্যাসটি নিয়ে তিন শত বছর গবেষণা হবে। লন্ডনে এক সন্ধেয় ডিনার টেবিলে মাতাল জয়েস বন্ধু হ্যারি শ ওয়েভারকে উপন্যাস ফেনিগ্যান্স ওয়েকের মূল ম্যনস্ক্রিপ্টটা উপহার দেন ইউলিসিস লেখার সময় দীর্ঘ আট বছর তাঁর নিজের পরিচয় গোপন রেখে জয়েসকে সংসার খরচের অর্থ সাহায্য করার জন্য। জয়েসের কাছে এই মহান বান্ধবীর আর্থিক ঋণ শোধ দেবার মত কিছুই ছিল না, তাই তিনি ফেনিগ্যান্স ওয়েকের মূল ম্যনস্ক্রিপ্টটিই উপহার দেন যার বর্তমান অকশন মূল্য বিলিয়ন ডলারেরও উপরে। জয়েস বলে কথা!  ওর সব কিছুই আলাদা। একক ও অনন্য। উপন্যাসটি লিখতে জয়েস সময় নেন দীর্ঘ সতেরো বছর। ১৯৩৯ সালে আর এক বিশ্ব যুদ্ধের মাঝে বইটি ‘ফেনিগ্যান্স ওয়েক’ নামে প্রকাশিত হয়। লন্ডনের ফেবার এন্ড ফেবার এবং নিউইয়র্কের ভাইকিং থকে বইটি এক সাথে প্রকাশিত হয়।

‘ওয়েক’ প্রকাশের সাথে সাথে ইউরোপ এবং আমেরিকায় স্টোরগুলোতে বইটি পৌঁছে যায়। ফ্রান্সেও বইটি পরিবেশিত হয়। জয়েসের বইয়ের প্র থম প্রকাশক শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী ফেনিগ্যান্স ওয়েক ডিসপ্লে করেন। তখনো নাজী বাহিনী প্যারিসে পৌঁছেনি। তাঁর আগেই ফেনিগ্যান্স ওয়েকের সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। সিলভিয়া বীচ একটি (নিজের কপি) কপি ডিসপ্লেতে রেখে দেন। ১৯৪০, জুন ১৪ তারিখে প্যারিস দখল করে নেয় নাজী বাহিনী। এর পরে প্রায়ই জার্মানী গেস্টাপো অফিসার এসে হানা দিতে থাকে বুক স্টোরে। তারা ইহুদি মেয়ের খোঁজ করতো। স্টোরে এক ইহুদি সেলস গার্ল কাজ করতো। প্যারিস দখলের পরে সে পালিয়ে আত্মগোপন করে। গেস্টাপোদের কাছে সেই খবর ছিল আর তাই তারা চড়াও হতো স্টোরে। একদিন মজার ঘটনা ঘটে। সেদিন গেস্টাপোরা ইহুদি সেলস গার্লের খোঁজে আসে না। আসে অন্য কিছুর দাবী নিয়ে। এক স্মার্ট গেস্টাপো অফিসার স্টোরে এসে ডিসপ্লেতে রাখা জয়েসের ফেনিগ্যান্স ওয়েক প্যাক করে দিতে বলে। আকাশ থেকে পড়েন সিলভিয়া বীচ জার্মান সেনা অফিসারের জয়েসপ্রীতি দেখে। বীচ খুনে জার্মানীদের হাতে ফেনিগ্যান্স ওয়েক তুলে দিতে চাননি। অফিসার হুমকি দিয়ে যায়। সেইদিনই বীচ স্টোরের সব বই প্যাক করে এক বান্ধবীর এ্যাপার্টমেন্টের সেলারে লুকিয়ে ফেলেন। বুকস্টোর বন্ধ করে দেন।

গেস্টাপোরা সিলভিয়া বীচকে আটক করে অন্যান্য আমেরিকান বন্দিদের সাথে চিড়িয়াখানার বাঁদরের ঘরে আটকে রাখে। একমাস চিড়িয়াখানার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রাখার পরে ভিটেলের ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয় যেখানে ১৯৪৩ সালের বসন্ত অব্দি বন্দি অবস্থায় থাকেন সিলভিয়া বিচ। ১৯৪৩ সালের বসন্তে কয়েকজন বন্ধুর সাহায্যে ছাড়া পান বীচ। প্যারিসে নিজের ফ্লাটে ফিরে আসেন বীচ। খাবার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির রেশনিং এ দিন পার করতে হয়। আগস্ট ১৯৪৪, প্যারিসের র‍্যু-দ্য-ওদিওঁ হলো প্যারিসের সর্বশেষ এলাকা যেটাকে মিত্র বাহিনী জার্মানীদের অকুপেশন থেকে মুক্ত করে। মিত্রবাহিনী যখন র‍্যু-দ্য-ওদিওঁতে প্রবেশ করে এলাকার বাসিন্দারা বারান্দায় এসে দাঁড়ায় বীরসন্তানদের  অভ্যর্থনা জানাতে। বীচ এবং এইড্রিনও সেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সিলভিয়া বীচ বলেন - “I heard a deep voice calling: Sylvia!” And everybody in the street took up the cry of Sylvia! It’s Hemingway!  It’s Hemingway! Cried Adrienne.  I flew downstairs: we met in a crash. He picked me up and swung me around and kissed me while people on the streets and in the windows cheered.”

এটা যেন ওল্ড ম্যান এন্ড সীর ম্যারিনার সান্তিয়াগোর সেই জলদগম্ভীর আহ্বান…!

 

সূত্র :

১। Shakespeare and Company by Sylvia Beach

২। Books and Their Makers: Sylvia Beach and James Joyce- By Macy Halford

৩। James Joyce by Richard Ellmann

৪। Man from Babel by Eugen Jolus


 

ফারহানা রহমান

 

মহাদেব সাহা : সময়ের বিশুষ্ক ও বিশীর্ণ কাব্যধারার কবি       

 


মহাদেব সাহা যতই পড়েছি মনে হয়েছে কবি যেন এক সীমাহীন অন্ধকারের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পান সূর্যাস্তের রঙে আঁধারের প্রতিটি আস্তরণ,   যেখানে আমাদের অনুভূতির নীল দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে। কুহেলি মাঠের  প্রান্তরে দাঁড়িয়ে অবিনাশী জীবনের আলোক সম্ভাবনার ইঙ্গিতও পাই সেখান থেকেই...। নিজের সৃষ্ট এক স্বতন্ত্র কবিতার ভুবনে যিনি ধ্যানমগ্নতায় ব্যথিত বিভোর হয়ে গত চার দশকে সৃষ্টি করে চলেছেন একের পর এক হৃদয়স্পর্শী, অশ্রুসজল বিধুর চিত্রময় প্রেমের পঙক্তি। মহাদেব সাহা, আমাদের দেশের ষাট দশকের কবিদের মধ্যে একজন প্রধান ও খ্যাতিমান কবি। পাঠকের চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন পথের দিকে -  নির্লিপ্ত, উদাসীন, কখনো বিষণ্ণ ও অভিমানী, কখনো হাস্যোচ্ছল কিন্তু সর্বদাই ভালোবাসায় নত। অসামান্য সাবলীলতায় তিনি সংবেদনশীলতার প্রকৃত রূপটি তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। মানুষের শুভবোধ,  মানবিকতা, প্রেম, বেদনা, নিঃসঙ্গতার হাহাকার, জাতীয়তাবোধ ও সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশেষ ঝোঁক, তাঁর কবিতার মুল বিষয়। আবেগের স্বতঃস্ফূর্ততা ও প্রেম- প্রকাশের সরলতায় ও মননশীলতায় তিনি কাব্যরচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সহজিয়া প্রেমাবেগের সঙ্গে  সমকালীন সামাজিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে তিনি অনিবার্য সত্যের মতোই কাব্যরূপ দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় যেমন মূর্ত হয়ে  উঠেছে আমাদের এই চিরপরিচিত জীবন, এই প্রকৃতি, চরাচর – তেমনি উন্মোচিত হয়েছে এক অজানা রহস্যের জগৎ। তাঁর কবিতা, আশ্চর্য কোমল ও গীতল স্বতঃস্ফূর্ত, চিত্রময়, হৃদয়স্পর্শী।  

ষাটের দশক ও তার পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের কবিতা বিষয় ও শিল্পমুল্যের বিচারে এক অভূতপূর্ণ স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন করে, ফলে এ সময়ে এসে কবিতায়  নতুন এক আন্দোলন সৃষ্টি করা ছিল অত্যন্ত কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। ষাটের কাব্যান্দোলনের অন্তরালে যে রুগ্নতা, ক্রন্দন, অন্তঃসারশূন্যতা ও অপূর্ণতা ছিল,  তার প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো যেসব কবিতা, তাতে ছিল সচেতনভাবে রাজনীতি  বিচ্ছিন্নতা। জাতীয়তাবোধের প্রেরণা থেকে সরে এসে এসময়ের কবিরা কাব্যচর্চা  করেছিলেন পচন, ক্লেদ আর রুগ্নতার নিঃসঙ্গ ঘরে নিজের ভিতর নিজেকে আবদ্ধ করে রেখে।  সেই বিচ্ছিন্নতার পৃথিবীতে দেশ জাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে লেখক- কবিদের নন্দন ভাবনায় প্রাধান্য পেয়েছিলো ব্যক্তিসর্বস্বতা, রুগ্নতা ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতির ধারা। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে এ ভূখণ্ডের কবিতায় সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতার যে উন্মেষ হয় তাতে বিষয়গত মৌলিকতার ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার স্বার্থে নতুন প্রজন্মের কবিতা তা থেকে সচেতনভাবে সতর্ক দূরত্বে অবস্থান করে। এই জন্মান্ধ ও জন্মেই কুঁকড়ে যাওয়া স্বপ্নের বাস্তবতার মুখোমুখি, আত্মরতিপ্রবণ মধ্যবিত্তের জীবনচক্রে ঘূর্ণায়মান কাব্যলোক থেকে বেরিয়ে আসার আন্তরিক চেষ্টাও ছিল এসময়ের কবিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এবং একইসাথে এই দশকের শেষ দিকে এসে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে আর ঊনসত্তরের গণআন্দোলন শুরু হলে ষাটের কবিরা জাতীয়তাবাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। 

কবি মহাদেব সাহার জন্ম বাংলা ১৩৫১ সালের ২০ শ্রাবণ, ইংরেজি ১৯৪৪ সনের ৫ আগস্ট বৃহত্তর পাবনা জেলার ধানঘড়া গ্রামে। পিতা গদাধর সাহা, মাতা  বিরাজমোহিনী। পিতামাতার একমাত্র সন্তান তিনি। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় দেখা হয় কুমিল্লার মেয়ে নীলা সাহার সাথে। বার দুয়েকের দেখাশোনায় নিজেদের একটু জানাশোনাও হয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে নিজেদের পছন্দে দুজন বিয়ে করে ফেলেন। তাঁদের দুই পুত্র সন্তান তীর্থ সাহা ও সৌধ সাহা।

শিক্ষাজীবনের শুরু কালীতলা প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৬১ সালে ধুনট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় চলে আসেন তিনি এবং ঢাকা কলেজে  ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। কিছুদিন পর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ফিরে যান বগুরায় এবং সেখানেই ভর্তি হন কলেজে। সে সময় সিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি  চর্চার ভীষণ অনুকূল পরিবেশ ছিল বগুরা শহর, ফলে কবি মহাদেব সাহা  তুমুলভাবে সেখানে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। শহরের বুকে ‘বেণীপুর বুক হাউজ’  ছিল সকল সাহিত্যমোদীদের প্রিয় ঠিকানা। সে সময় তিনি ও কিছু আধুনিক প্রগতিশীল তরুণ মিলে বের করেন  লিটিল ম্যাগাজিন ‘বিপ্রতিক’। একই সময়  তিনি অভিভূত হন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’এর  সংস্পর্শে এসে। নিজ জীবন দর্শনের প্রতিফলন তিনি দেখতে পান এই পত্রিকায়। কণ্ঠস্বর পত্রিকার শ্লোগান ছিল, “যারা সাহিত্যের স্বনিষ্ঠ প্রেমিক, যারা শিল্প উন্মোচিত, সৎ, অকপট, রক্তাক্ত, শব্দতাড়িত, যন্ত্রণাকাতর, যারা উন্মাদ, অপচয়ী, বিকারগ্রস্ত, অসন্তুষ্ট, বিবরবাসী, যারা তরুণ, প্রতিভাবান, অপ্রতিষ্ঠিত,  শ্রদ্ধাশীল, অনুপ্রাণিত, যারা পঙ্গু, অহংকারী, যৌনতাপিষ্ট - কণ্ঠস্বর তাদেরই পত্রিকা”। এরই মধ্যে ডাক আসে স্বাধীনতার। দেশ এগোতে থাকে স্বাধীনতার যুদ্ধের দিকে। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে  এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর বাংলায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৮ সালে। সেই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রকৃতপক্ষেই সাহিত্যের তীর্থভূমি। কবিতা লিখে মহাদেব সাহা সর্বস্তরের সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। একই সময়ে ঢাকার অনেক পত্রিকাতেও নিয়মিত ছাপা হতে থাকে তাঁর কবিতা। ৬৯-র জুন মাসে 'কন্ঠস্বর' সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ উদ্যোগ নেন তরুণ কবি-লেখকদের নিয়ে প্রথম সাহিত্য উত্সব করার। এই সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পড়ার জন্য মহাদেব সাহাকে অনুরোধ করেন 'কন্ঠস্বর' সম্পাদক। ঢাকায় এসে উঠলেন আবু সায়ীদেরই গ্রীন রোডের ছোট্ট দুই রুমের বাসায়। সম্মেলনে নতুন লেখকদের সঙ্গে পরিচয় হল আর প্রবন্ধ পড়ে পেলেন যথেষ্ট প্রশংসা। এরপরই গভীর অনুরাগ আর ভালোবাসার শহর রাজশাহী ছেড়ে, প্রমত্তা পদ্মা ছেড়ে চিরতরে পাড়ি জমান ঢাকার বুকে। এ প্রসঙ্গে কবি  মহাদেব সাহা বলেছেন, “গার্ড বাঁশি বাজালেন। পেছনে পড়ে রইল রাজশাহী, মতিহার, কাজলা, উন্মুক্ত উথাল পদ্মা, আমি তাকিয়ে আছি অনন্তের দিকে। আর সঙ্গে নিয়ে চলেছি বহু আনন্দ-বেদনা, ভালবাসার স্মৃতি। সবার জীবনে যেমন আমার জীবনেও তেমনি সেই উদ্দীপ্ত মুখর দিবারাত্রির কলধ্বনি নীরবে বহে চলেছিল মনে। আমি রাজশাহী ছেড়ে ঢাকা যাচ্ছি, সে ছিলো অতল জলের আহ্বান, কবিতাময় দিনরাত্রির স্বপ্ন”।

১৯৬৯-এর জুলাই মাসে দৈনিক 'পূর্বদেশ'-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন মহাদেব সাহা। ১৯৭৮ থেকে ৮৪ পর্যন্ত কাজ করেন সংবাদ পত্রিকার সাথে। ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৩০ বছর একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন ইত্তেফাক পত্রিকায়। সাহিত্যের পালাবদলে বাংলা কবিতার শাশ্বত  রূপটিকে মহাদেব সাহা স্বব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন তাঁর ৫৯টি কাব্যগ্রন্থে। এই প্রধান কবি গ্রন্থাগারে প্রথম সূচিবদ্ধ হন ১৯৭২-এ। 'এই গৃহ এই সন্ন্যাস' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা কবিতার বই ছাড়াও লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী, আত্মজীবনী, সমালোচনাসহ নানা ধরনের রচনাও। সব মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮১।

কবি মহাদেব সাহার কবিতার একটা প্রধান প্রবণতা হচ্ছে প্রেম। ব্যর্থতা ও বিষাদ, নৈঃসঙ্গ , একাকীত্ব ও বেদনাবিধুর জগতের বিদীর্ণ বেলাভূমিতে কবি ভালোবাসার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকেন। মর্ম-স্পর্শী সুখ-দুঃখ গাঁথার এক অবিরাম উপাখ্যান হয়ে উঠেছে মহাদেব সাহার কবিতা। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক মনস্কতা তাঁকে টেনে আনে মাটি আর মানুষের  কাছাকাছি। তাঁর  কবিতার শব্দনির্বাচন, ধ্বনি, চিত্রকল্প সবকিছুই যেন মৌমাছির মতো গুঞ্জরণ তোলে মানব মনেঃ , “ভালোবাসা তুমি এমনি সুদূর স্বপ্নের চে’ও দূরে/ সুনীল সাগরে তোমাকে পাবেনা আকাশে ক্লান্ত উরে/ ভালোবাসা তুমি এমনি উধাও এমনি অগোচর / তোমার ঠিকানা মানচিত্রের উড়ন্ত ডাকঘর” (ভালোবাসা), অন্য একটি কবিতায় দেখি, “তুমি যখন আমার কাছে ছিলে/ তখন গাছের কাছে গেলে আমার ভীষণ আনন্দ বোধ হতো/ তুমি না থাকলে বড়ো দুঃসময় যায়, সর্বত্র বন্ধুবিহীনভাবে বাস করি/ এই ঢাকা শহর ভীষণ রুক্ষ মনে হয়/ নিজেকেই নিজের কাছে অজানা লাগে/ মনে হয় দীর্ঘদিন থেকে আমি যেন কোনো অজ্ঞাত অসুখে ভুগছি”…  

মহাদেব সাহার কবিতার আরও একটি কেন্দ্রীয় বিষয় মানুষ। মানুষের শুভবোধ, শুভচেতনার প্রতি আস্থা, মানুষের সার্বিক মুক্তির কথা তিনি ভেবেছেন আর তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যে। মানুষের কল্যাণচিন্তা, মানবিকতা, বিপন্ন মানুষের মুক্তির  কথা তিনি বারবার তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। আত্মমুখি ও উল্লম্বধর্মী চেতনার  জগৎ থেকে কবিতার ক্ষেত্রকে তিনি প্রসারিত করেছেন জীবনের অনুভূমিক রেখার দিকে। তিনি ভেবেছেন সমাজতন্ত্র মানুষের প্রকৃত মুক্তি আনতে পারে। তাকে কষ্ট দিয়েছে মানুষের নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা, তিনি সর্বতভাবে ঘৃণা করেছেন, বিরোধিতা করেছেন যুদ্ধের ও সাম্প্রদায়িকতার। “এ কী বৈরী যুগে এসে দাঁড়ালাম আমরা সকলে/ সূর্য নিয়ত ঢাকা চিররাহুগ্রাসে, মানবিক প্রশান্ত বাতাস এখন বয় না কোনোখানে/ শুধু সর্বত্র বেড়ায় নেচে কবন্ধ-দানব” ( যদুবংশ ধ্বংসের আগে)।  অন্য একটি কবিতায় দেখি, “বড়ো ত্রাস, সদর দরজা ভেঙে / যেন হুহু করে মধ্যরাতে ঢুকে পড়ে সন্ত্রাসের ট্রাক/ অকস্মাৎ ভেঙে দেয় নিসর্গের রম্য খেলা/ জ্যোৎস্নাময় এ রাত্রি, কাঁঠালিচাঁপার বন/ বনচারী পাখিদের শান্ত ঘুম/ অবকাশ/ ত্রাস/ শুধু ত্রাস”।  “লেলিন, এই নামটি উচ্চারিত হলে/ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে প্রাণ/ দেখি ভল্গা থেকে নেমে আসে মানবিক উৎসধারা  আমাদের বঙ্গোপসাগরে” (লেলিন এই নাম উচ্চারিত হলে)।  

মহাদেব সাহার বহুমাত্রিক সাহিত্যকর্ম তাঁর কবিতার নান্দনিকতা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। একদিকে তিনি প্রেমিক, রমণপ্রিয়, নারীর সৌন্দর্য ও শরীরের প্রতি আগ্রহী। আবার অন্যদিকে সামাজিক- রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন এক মানুষ। প্রেম ও রমণীর সান্নিধ্য – আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও তিনি সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে কখনই আড়াল করতে চাননি। তাই তিনি যখন দেখতে পান স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার আগেই সব স্বপ্নগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, শুরু হয়েছে স্বাধীন বাংলার পিছন দিকে পথ হাঁটা, তিনি মুষড়ে পড়েন। তিনি দেখেন বাকস্বাধীনতার মানে বন্দুকের নলের উপর বুক ঠেকিয়ে রাখা। সেই সময় দেশ ও জাতির গভীর ক্রান্তিকালে মহাদেব সাহার কবিতায় তখন উচ্চারিত হয় দ্রোহ আর প্রতিবাদ। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তখন কবিতা প্রকাশ করেন 'সংবাদ', 'সমকাল'সহ বিভিন্ন পত্রিকায়। “তাহলে কি গোলাপেরও দেশপ্রেম নেই/ যদি সে সবারে দেয় ঘ্রাণ/ কারো কথা মতো যদি সে কেবল আর নাই ফোটে রাজকীয় ভাসে/ বরং মাটির কাছে ফোটে এ অভিমানী ফুল/ তাহলে কি তারও দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ উঠবে চারদিকে?” (দেশপ্রেম)।

আপাত সরল অথচ জীবনগ্রাহী নির্মিতির মাধ্যমে বাংলা কবিতায় এক অনন্য সম্মোহনের জগত বিনির্মাণ করেছেন কবি মহাদেব সাহা। তাঁর কবিতার রয়েছে  একদিকে  আবেগ, ব্যক্তিকশূন্যতা, সঙ্কট, বিরহকাতরতা ও প্রকৃতিচেতনা। আবার অন্যদিকে মূর্ত হয়ে উঠলেও বোধের গভীরতা। শব্দের ভেতরের শব্দ, কবিতার ভেতরের কবিতাকে অনায়াসে তুলে আনার কারণে তাঁর কবিতা যেমন  স্বতন্ত্র তেমনি নান্দনিক। গভীর জীবনবোধ জারিত তাঁর প্রতিটি কবিতা তাই  সঙ্গত কারণেই মহাদেব সাহার কবিতা যেমন মানুষের মনস্তত্ত্বকে ধারণ করে; তেমনিভাবে সমাজের বিবিধ অনুষঙ্গকেও নিজস্ব বিষয়ে পরিণত করেছে।  

মহাদেব সাহা সেই প্রাণিত কবি যিনি এই সময়ের বিশুষ্ক ও বিশীর্ণ কাব্যধারায় ফিরিয়ে এনেছেন বসন্তকাল, নবজীবন। বাংলা কবিতার শাশ্বত আবেগময় রূপটিকে তুলে ধরে কবিতাকে করেছেন সজীব, হৃদয়গ্রাহী ও জনপ্রিয়। তিনি পাঠককে ফিরিয়ে এনেছেন কবিতায়। তাঁর কবিতা তাঁর নিজের সৃষ্ট এক স্বতন্ত্র  ভুবন  - যেখানে তিনি নিজেকে উন্মোচিত করেছেন পাঠকের কাছে। এই ধ্যানমগ্ন, ব্যথিত, বিভোর কবি মোহময়ী ভাষায় রচনা করেছেন আমাদের নিবিড় জীবনভাষ্য।



কবি তাঁর নিজের জীবন সম্পর্কে তাঁর কবিতাতেই স্পষ্ট করে বলে গেছেন নিজের  গোপন কথা (আমার জীবনী)।

“আমার জীবনী আমি লিখে রেখে যাবো/মাটির অন্তরে, ধুলোর পাতায়/লিখে  রেখে যাবো মেঘের হৃদয়ে/ বৃষ্টির ফোঁটায়/ হাঁসের নরম পায়ে/ হরিণশিশুর মায়াময় চোখে/ ফুলের নিবিড় পাপড়িতে আমি লিখে রেখে যাবো/আমার জীবনী/ লিখে রেখে যাবো বৃক্ষের বুকের মধ্যে/পাহাড়ী ঝর্নার ওষ্ঠে/সবুজ শস্যের নগ্নদেহে”।  

 

 

প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

 

শারদ-সাহিত্যে হেমন্ত

 


                  

উপক্রমণিকা

 

তোমারে যে চিনি চিনি, মনে-মনে কত ছবি এঁকেছি!’

জীবদ্দশায় কিম্বদন্তীতে পরিণত হওয়া সঙ্গীতশিল্পী তে চেয়েছিলেন সাহিত্যিক গানের রেকর্ড বেরোনোর আগেই (নাকি কাছাকাছি সময়?) প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর লেখা গল্প কিন্তু সরস্বতী চেয়েছিলেন অন্য কিছু, তাই তিনি য়ে গেলেন গায়ক, সুরকার (এছাড়া চলচ্চিত্র-প্রযোজক এবং একবার পরিচালকও) তাঁকে সবাই সবচেয়ে বেশী চেনেন তাঁর ঐশ্বরিক কণ্ঠের মাধ্যমে, আর, তরুণ মজুমদারের কথায়, তাঁর গান জড়িয়ে গেছে আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এক-একটি গান এক-একজনের জীবনে হয়ে উঠেছে ধ্রুবতারার মতো পথপ্রদর্শক বা নিজের অন্তরের ভাবপ্রকাশের ভাষা!

এমন একজনকে নিয়ে যে চিত্র-বিচিত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অসংখ্য আখ্যান তৈরি বে, সেটাই তো স্বাভাবিক! তাই তাঁর জন্মশতবর্ষে প্রকাশ পেয়েছে তাঁকে কেন্দ্র রে কথাসাহিত্যের সমাহার এর মধ্যে, বিগত এক বছর ধরে শরৎকালে, এবং অন্য সময়ে, রচিত সাহিত্যকর্মে হেমন্ত কীভাবে এসেছেন, তানিয়ে একটি ক্ষুদ্র আলোচনা করতে চাই, কারণ ১৯৮৯ সালের শরতেই আমরা হেমন্ত-হারা হয়েছিলাম!

আগে হেমন্তকে নিয়ে রচনাগুলি মূলত স্মৃতিচারণ-ধর্মীই ছিল, যেমন কবি সুভাষ  মুখোপাধ্যায়ের হেমন্তর কী মন্তরবা শঙ্করের চরণ ছুঁয়ে যাই’-তে হেমন্ত-অধ্যায়

 

বিগত বছর

গত বছর পুজোয় প্রকাশিত হয় সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া’, যা জানুয়ারি ২০২০-তে পুস্তকাকারে বেরিয়েছে[1] উপন্যাসটি  ইতিহাস নয়, বাস্তব থেকে কিছু নাটকীয় উপাদান নিয়ে কল্পকাহিনিই অতএব, বাস্তবের ছায়াপাতগুলি থেকে কল্পনাকে আলাদা করা আবশ্যিক তবে উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অবিস্মরণীয়েষু’-কে!

উপন্যাসে মুখ্য চরিত্র তিনটিঃ গীতিকার-সুরকার অরুণেশ গোস্বামী, গায়ক মণিময় মিত্র এবং চলচ্চিত্রাভিনেতা নীহার চট্টোপাধ্যায়। কাউকেই মনে হয় বলে দিতে হবে না কোন-কোন বাস্তব চরিত্রের ছায়া এই তিনজনের চরিত্রায়নে পড়েছে! তবে মূল নারীচরিত্রে মিশে গেছেন বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের দুই ব্যক্তিত্ব।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় কাহিনি আবর্তিত হয়েছে তিন প্রধান পুরুষ-চরিত্রের মধ্যে সম্পর্কের উত্থান-পতন ঘিরেআর এই কাহিনি যে মোটেই ইতিহাস নয় তাবোঝা যায় বেশ কিছু ঘটনা থেকে। অরুণেশের লেখা আর সুর দেওয়া গান গেয়ে মণিময় খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। এরপর যখন এক ধরনের হীনমন্যতাবোধ থেকে এবং আরও এক গূঢ় কারণে অরুণেশ মণিময়ের সংস্পর্শ ত্যাগ করেন, গায়ক তখন নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হয়ে ওঠেন সুরকার এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করেন যাতে তাঁর সুরে অরুণেশের প্রভাব না থাকে। এ হলো লেখকের ইচ্ছাকৃত সমান্তরালতা। ঠিক এইভাবেই মণিময় তাঁর গায়ক-জীবনের শুরুর পরেই আস্তে-আস্তে তাঁর নিজের আদর্শ গায়কের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই দ্বিতীয় অংশটি (যা উপন্যাসে স্বাভাবিকভাবেই আগে এসেছে) ‘ছোট-পঙ্কজেরহেমন্ত হয়ে ওঠাকেই লেখনে চিত্রিত করেছে, কিন্তু প্রথমটি একেবারেই কাল্পনিক। গীতিকার-সুরকার সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হবার অনেক আগে থেকেই হেমন্ত সুরকার-হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। আর অভিনেতা নীহার প্রথম দিকের অসাফল্যের পর দৈবাৎ একজনের বাড়ির বাইরে থেকে মণিময়ের গান শুনে সটান প্রযোজকের কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাচ্ছেন  যে, একটি নতুন ছবি করে তাতে নীহারকে নায়ক আর মণিময়কে তাঁর নেপথ্য গায়ক করতে। এ সমাপতন একেবারেই সুখ-কল্পনার ফসল, তবে লেখকের  বাস্তব থেকে বিষয়বস্তু নিয়ে তার শৈল্পিক সমন্বয় ঘটানোয় দক্ষতা প্রদর্শন করে নিঃসন্দেহে। এই সমন্বয় অন্য স্তরে পৌঁছে যায় যখন নীহারের এই ছবিতে প্রযোজক নিয়ে আসেন নতুন নায়িকা বল্লরী রায়কেএই জুটির প্রথম ছবিই  দর্শকমহলে আলোড়ন ফেলে দেয়, আর ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক থাকেন অরুণেশ! কিন্তু সাফল্যের পার্টিতে ভিড় জমে গায়ককে ঘিরে, কারণ, ‘তাঁর গানের জোরেই নাকি এমন বিপুল হিট হয়েছে এই অরুণোদয়ছবি।’ (পৃঃ ৬৯) (ছবিটির নামকরণ নীহার’-এর বাস্তব সত্তার দিকে ইঙ্গিত করে; তাঁর পিতৃদত্ত নাম তো অরুণ’-ই ছিল!) তবে, বাস্তবে এই তিনজনের সহ-উপস্থিতি কোন বাংলা ছবিতে ঘটেছিল বলে জানা নেই।

এইখানেই হয় তিন ব্যক্তিত্বের সংঘাতের সূত্রপাত। ক্ষুব্ধ অরুণে মণিময়ের ধারণা – ‘গায়কের নামেই গান চিহ্নিত হয়’ (৬৯) – খণ্ডন করে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত থেকে রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত-দাশুরায় অবধি তুলনা টেনে বলেন, “চিরকাল সং-মেকারের নামে [গান] পরিচিত হয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পরে এই লাইট মডার্ন সং-এর জমানায় এসেই... সুরকার-গীতিকার আলাদা হওয়া শুরু হল, ওমনি [যদ্দৃষ্টং] গায়ককেন্দ্রিক হয়ে গেল বাজার।” (৭০)

এরপর মণিময়ের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার ব্যাপারে আবার অরুণেশ আর নীহারের মধ্যে এসেছে, এক দিক দিয়ে সমান্তরালতা, আরেক দিকে বৈষম্য-প্রদর্শন সমান্তরালতা হলো দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নারীঘটিত সমস্যা। বৈষম্য এখানেই যে অরুণেশ ঘর ছাড়েন গায়িকা কৃষ্ণা সরকারের আকর্ষণে, আর নীহার স্ত্রী বল্লরীকে সন্দেহ করতে শুরু করেন মণিময়ের প্রতি বল্লরীর মুগ্ধতা দেখে। লেখক ঐ কৃষ্ণা চরিত্রটির মাধ্যমে যে চরিত্র মনে হয় কাল্পনিক আবার উপন্যাসের এই তিন মুখ্য পুরুষ চরিত্রকে যুক্ত করেনঃ নীহার-বল্লরী-মণিময়, আবার অরুণেশ-কৃষ্ণা-মণিময়। তার প্রতি মোহে গৃহত্যাগী অরুণেশকে হতচকিত কৃষ্ণা প্রত্যাখ্যান করে, কারণ সে যে মণিময়কে ভালোবাসে, মণিময়ের সম্পূর্ণ অজান্তে!

এরপর, অরুণেশের সংসার ভাঙার পরোক্ষ দায়বোধ এবং মণিময়ের প্রতি একমুখী ও অপরিশোধিত প্রেমের যন্ত্রণায় আত্মঘাতী হয় কৃষ্ণা। শ্মশান থেকে ফেরার সময় মদ্যপানে-প্রায়-চৈতন্যহীন অরুণেশের মুখ থেকে আসল রহস্য জেনে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান মণিময়।

উপন্যাসের শুরুই হচ্ছে মণিময়ের প্রয়াণ দিয়ে, তারপর কিছু সমসাময়িক ঘটনা আর অনেকের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে অতীত-বর্তমানের পর্যায়ানুবৃত্তির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে কাহিনি। আখ্যানের অনেকখানি গড়ে উঠেছে দুটি সাক্ষাৎকার (অরুণেশ ও নবেন্দু) এবং তিনটি আত্মগ্লানিমূলক স্বীকারোক্তি (নীহারের লেখা এবং হাসপাতালে নার্সের সামনে বলা, অতসীকে ফোন করে নবেন্দুর বলা কথা, এবং অতসীর সামনে এসে অরুণেশের স্বীকারোক্তি দেওয়া এবং ‘রহস্য উদ্ঘাটন’ সম্পর্কে অতসীর বক্তব্য শুনে বিস্মিত হওয়া) দিয়ে। উপন্যাসের শেষে আমরা শুনি সোনার তরী-গানভঙ্গকবিতায়নূতন লোক’, ‘নব নব রঙ্গের মধ্যে রাজা প্রতাপরায় আর গায়ক বরজলালের সভাগৃহ ত্যাগের উপাখ্যান।

অত্যন্ত মনোগ্রাহী রচনা, তবে লেখকের সঙ্গে একমত হয়ে বলছি, সাধারণ পাঠক যেন বইটি কল্পোপাখ্যান হিসেবেই পড়েন। যাঁরা ইতিহাস জানেন, তাঁরা অবশ্য অন্যরকমভাবে আখ্যানের রসাস্বাদন করতে পারবেন।

এই বছর

সৌরভবাবু এ বছর আর গল্পলেখেন নি, যে ঘটনাক্রম উপন্যাসেও চিত্রিত হয়েছে, সেই উত্তম-হেমন্ত দ্বৈরথ নিয়ে অন্তরীপ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় লিখেছেন বন্ধু বুঝো না ভুল’।[2]

কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬) ছবিতে উত্তমের সুরে হেমন্তকণ্ঠে আমি যাই, চলে যাই’-এর উল্লেখ এবং নেপথ্য-কাহিনি দিয়ে শুরু হয়েছে এই প্রতিবেদন। তার পরেই এসেছে (নির্মম?) পরিসংখ্যান, যা লেখাটির বাড়তি শীর্ষক উত্তম-হেমন্ত দ্বন্দ্ব’-কে বাস্তবের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০ অবধি মাত্র ১১টি ছবিতে উত্তম প্রত্যক্ষভাবে লিপ্ দিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়নে, এবং সেই গানগুলির সংখ্যা বড়জোর ২৭/২৮!’ আর ১৯৬৬-র আগে - ১৯৫৫ সালেশাপমোচনছবিতে এই জুটির বিজয়-বৈজয়ন্তী ওড়ার পর থেকে (যদিও এর চার বছর আগে প্রথমবারসহযাত্রীছবিতে তরুণ গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুটি গান ছিল নবাগত নায়কের লিপে, তেমন আলোচিত হয়নি তা) ওই ১৯৬৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ১১ বছরেই প্রায় ১৮/১৯টি ছবিতে আমরা দেখছি উত্তম-হেমন্ত চিত্রায়নের মণিকাঞ্চনএবং সংখ্যাটি? প্রায় ৫০! …অন্তত প্রথম ওই একটি স্বর্ণমণ্ডিত দশক, উত্তমের নেপথ্যকণ্ঠদানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন সব্বাইকার প্রথম পছন্দ দর্শকের, প্রযোজকের, পরিচালকের, সঙ্গীতকারের। সম্ভবত, প্রথমদিকের অনেকটা সময়, নায়কের নিজেরও। এই সময়পর্বে হেমন্ত যা- গেয়েছেন উত্তমের জন্যসব হিট। অদ্ভুত মিল ছিল গায়কের নায়কের কণ্ঠের টিম্বারে, এমনকি বাচনভঙ্গিতেও। গানের মধ্যে টুকরো সংলাপ বলেছেন হেমন্ত, একেবারে মিলে গেছে উত্তমের গলার সঙ্গে।হাত বাড়ালেই বন্ধুকিংবামায়ামৃগকিংবাদুই ভাইইত্যাদি অনেক ছবির গানে এমন নিদর্শন আছে।

১৯৬২ সালে হেমন্ত-প্রযোজিত প্রথম হিন্দী ছবি বিস সাল বাদ বম্বেতে নবাগত বিশ্বজিৎকে প্রভূত সাফল্য দেবার পরেই হেমন্ত স্থির করেন যে এর পরের ছবি শর্মিলা-র মাধ্যমে[3] তিনি উত্তমকুমারকে হিন্দী ছবির জগতে প্রতিষ্ঠা দেবেন। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে, হেমন্তর প্রভূত আর্থিক ক্ষতি ঘটিয়ে উত্তম ছবি থেকে সরে দাঁড়ান। দুই ব্যক্তিত্বের দূরত্ব চরমে পৌঁছোয় ১৯৭০-এর পর। লেখক যথার্থই বলেছেনঃ যে-জুটি একদা চার বছরে (’৫৮ থেকে৬১) মোট ১২টা ছবিতে ৩০টি  গানে জুড়ে ছিলেন, ’৭১ থেকে৭৪ এই চার বছরে তাঁদের মিলন ঘটল মাত্র দুটি ছবির চারখানি গানে! তার মধ্যে প্রথম দুবছরের স্কোরশূন্য!

আর কাল তুমি আলেয়া-র বছর, ১৯৬৬-তেই শঙ্খবেলা ছবির মাধ্যমে দর্শকমানসে উত্তম প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর বিকল্প নেপথ্য কণ্ঠকেঃ মান্না দে। লক্ষ্যণীয় যে কাল তুমি আলেয়া-তে হেমন্তের কণ্ঠ আছে বটে, কিন্তু গানটি কিন্তু কোন ভাবেই তাসের ঘর-এর শূন্যে ডানা মেলে’, বা শুধু একটি বছর-এর মোর মিলন-পিয়াসী মন’-এর মতো উত্তমের মনের কথা ব্যক্ত করছে না! গানের কথা সদ্য-প্রয়াতা এক নারীর (অভিনয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) বিদায়-গাথা - তাই, ’৬৬ সালেরকাল তুমি আলেয়াছবির ওই গানটি শুনলেই আজ কেমন অন্যরকম একটা মাত্রা যোগ হয় আমার অনুভবে। এই সেই ভাঙন-লগ্নের গান, যেন ভবিষ্যৎবাণীর ঘ্রাণ মেলে। গায়ক আর নায়কের ব্যক্তিগত সম্পর্কের যেটুকু সুরভি, তা শেষ হয়ে আসছেকাঁটাগুলি এবার প্রকট হবে। আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ফিরে ফিরে আসছে লিরিকে।আমারে খুঁজো না তুমি/ বন্ধু বুঝো না ভুল/ কাল সে আলেয়া শুধু/ আমি সে আলোর ঝরা ফুল...’

এরপর লেখক পেশ করেছেন আগের চেয়েও নির্মম এক পরিসংখ্যানঃ বোঝার সুবিধের জন্য রইল একটি চুম্বক-সার। কয়েকটি ছবির হদিশ মেলেনি, তাই approximate statistics. # ১৯৬৬-পূর্ব গান: মান্না-উত্তম= (ছবি ), হেমন্ত-উত্তম= ৫৫+ (ছবি ১৮+) # ১৯৬৬-পরবর্তী গান: মান্না-উত্তম= ৯০+ (ছবি ২৭+), হেমন্ত-উত্তম= ২৭+ (ছবি ১১+) ‘সিংহাসনচ্যুতকথাটা যে অত্যুক্তি নয় মোটেই, তা দেখাই যাচ্ছে।

সত্তরের দশকে এসেছে একাধিক ছবি যেখানে উত্তম-হেমন্ত যুগলেই উপস্থিত, কিন্তু উত্তমের কণ্ঠ মান্না দে, হেমন্ত গাইছেন অন্য শিল্পীর নেপথ্যে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ স্ত্রী, যেখানে হেমন্ত গেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। আবার সন্ন্যাসী রাজা-য় উত্তমের মুখে সমস্ত বাংলা গান মান্নার কণ্ঠে, শুধু কা তব কান্তাস্তোত্রতে আমরা পেয়েছি হেমন্তকে, আর যে স্তোত্র উত্তম-অভিনীত চরিত্রের আগেই শোনা গেছে সেই সন্ন্যাসীদলের নেতার কণ্ঠে যারা সমুদ্রতীর থেকে অর্ধমৃত জমিদার (উত্তম)-কে উদ্ধার করছে। শোনা যায় যে শঙ্খবেলা-তে সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত নাকি কে প্রথম কাছে এসেছি’-তে চেয়েছিলেন হেমন্তর রোম্যান্টিক কণ্ঠ, আর মজলিসী গান আমি আগন্তুক’-এ মান্না দে’কে। তখন  নাকি এই ছেঁদো যুক্তিতে হেমন্ত বাদ পড়েন যে এক অভিনেতার গলায় দুজন ভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠ দর্শক নাকি নেবেন না! লেখকের কথায়ঃ ১৯৬৮-চৌরঙ্গীদিয়ে এর সূচনা, তার পর একসময় যেন এটাই নিয়ম দাঁড়িয়ে গেল। উত্তমকুমার ছবিতে রয়েছেন, তবু ছবিতে হেমন্তর গান গেয়ে যাচ্ছেন অন্য অভিনেতারা! সাবরমতী, কমললতা, ধন্যি মেয়ে, স্ত্রী, অগ্নীশ্বর, ভোলা ময়রা...

উল্লেখিত ছবিগুলির মধ্যে নায়ক-গায়কের পরস্পর দূরত্ব, আমার কাছে, সবচেয়ে প্রকট সাবরমতী-তে। এখানে উত্তমের মুখে একটি গানে আমরা শুনছি কিশোরকুমারের কণ্ঠ! আর, সৌরভবাবুর ভাষায়ঃ ১৯৬৮র ছবিসাবরমতী’, অনেকেই দেখে থাকবেন গোপেন মল্লিক সুরারোপিত অপূর্ব শ্রুতিমধুর সেই গানের চিত্রায়ন, ‘শোনো গো সজনী, পোহাল রজনী, দুখনিশি হল যে ভোর হে।হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম পংক্তিগুলি যখন এক মায়াময় ঊষার প্রাকৃতিক পটভূমিতে ফুটে উঠতে থাকে, তখনও অনিশ্চিতকে লিপ্ দিচ্ছেন। কিন্তু কণ্ঠের এমনই জাদু, শুরু থেকেই আমাদের মনের মধ্যে বাজতে থাকে, আহা, উত্তম...!

 

কিন্তু, না! অচিরেই দেখা যায়, পর্দায় রয়েছেন কিন্তু লিপ্ দিচ্ছেন না উত্তমকুমার। এক বৃদ্ধ বৈষ্ণব গান গাইছেন, উত্তমকুমার দূরে দাঁড়িয়ে, সুপ্রিয়া দেবীর মুখোমুখি। ঘাড়টি ঘুরিয়ে নায়ক একবার-দুবার দেখলেন, শুনলেন গানটি, তারপর মুখটি ফের ঘুরিয়ে নিলেন নায়িকার দিকে।

 

কেমন আশ্চর্য একটা বিষণ্ণতা উঁকি দেয় এই গানটি শুনতে শুনতে। সবে ১৯৬৮, এই তো আগের বছরেওনায়িকা-সংবাদছবিতেএই পূর্ণিমা রাতগানে উত্তম-হেমন্ত রসায়ন ম্যাজিক তৈরি করেছে! ’৬৬তে নায়কের কণ্ঠদানে মান্না দে সফল হয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাই বলে হেমন্ত ছবিতে অংশ নিচ্ছেন তবু সে-গান অন্য লোকের ঠোঁটে আর উত্তম নীরব দর্শক, একই ছবিতে গান গাইবেন অন্য গায়কের গলায় এতটা প্রথম ধাক্কায় মানতে কষ্ট হয়নি কি দর্শকদের?

দুজনের এই দ্বন্দ্বের মোট তিনটি কারণ লেখক উল্লেখ করেছেন। এক, হেমন্তর শর্মিলা ছিল নায়িকা-প্রধান, কম বাজেটের, ছোট ব্যানারের ছবি। দুই, ছবিটি সফল হলে বিশ্বজিতের মতো উত্তমকুমারকেও হিন্দী ছবিতে প্রতিষ্ঠাদেবার কৃতিত্ব পাবেন হেমন্ত, উত্তম সেখানে গৌণ হয়ে যাবেন। এবং, আমার, এবং, আমার মনে হয়, সৌরভবাবুরও, মতে উত্তম যে চরম অসৌজন্যতা হেমন্তর প্রতি দেখিয়েছিলেন, তার পেছনে ছিল সেই ফরাসী প্রবচনঃ cherchez la femme, ‘নারীটির সন্ধান করুন’! এবং সে নারী সুপ্রিয়া দেবী, যাঁর বাড়িতে হেমন্ত  কলকাতার স্টুডিওর কাজ সেরে মধ্যাহ্নে বিশ্রাম নিতেন। লেখকের কথায়ঃ সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে প্রবল অধিকারবোধ ছিল উত্তমকুমারের। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থেকে নমুনা মেলে, তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিয়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সামান্যতম ঘনিষ্ঠতা এমনকী অধিক সৌজন্য পর্যন্ত দেখালে ছেলেমানুষের মতো ক্ষুণ্ণ হতেন মহানায়ক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও সম্ভবত জানতেন একথা, গুরুত্ব দেননি। ফলত তাঁকে ঘিরেও কি দূর গগনে কোনও মেঘ ঘনিয়েছিল? সুপ্রিয়া বলিউডে কাজ করতে যান, না-পসন্দ ছিল উত্তমের। সুপ্রিয়া কিছুটা তাঁকে অমান্য করেই হেমন্তর ডাকে বোম্বেতে গিয়েছিলেন। প্রিয় নারীর এহেন অবাধ্যতা, তাও আবার এমন পুরুষের প্ররোচনায় যাঁর সঙ্গে ওই বোম্বের ছবি করা নিয়েই সদ্য মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে নায়কের নিজের এর পুরো ক্রোধটি কি গিয়ে পড়েছিল ধুতি-শার্ট পরা দীর্ঘকায় মানুষটির ওপরেই?

এই প্রসঙ্গ শেষ করছি আবার লেখকের, আমার বিচারে, নির্ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েঃ

ইতিহাস শুধু বলছে এত কিছুর মধ্যেও যখনই উত্তমকুমারের জন্য গাইতে ডেকেছেন কোনও সঙ্গীত-পরিচালক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন আমন্ত্রণ। এমন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাক্ষ্যও পাওয়া যায় না যেখানে অভিমান-ক্রোধ মনে রেখেউত্তমের ছবিতে অন্য অভিনেতার কণ্ঠে, এমনকী খোদ উত্তমের হয়েও নেপথ্য-কণ্ঠদানেঅসম্মতহয়েছেন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এমনকী, উত্তম-অভিনীত ছবির সুরারোপ পর্যন্ত করেছেন, সে-সবের মধ্যে এমন ছবিও আছে যেখানে হেমন্তর নিজের গাওয়া গানে লিপ দিচ্ছেন অন্য অভিনেতা।


আমাদের মনে হয়, এই হল আদর্শ পেশাদারের মতো কাজ; সব আঘাত সব রক্তপাত জামার নীচে লুকিয়ে রেখে, শুধু কাজটুকুকেই চূড়ান্ত গুরুত্ব দেওয়া।

দুঃখের সঙ্গে আমরা মানতে বাধ্য, নায়ক সেই উদাহরণ রাখতে পারেননি সবসময়। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে তেমনটাই উঠে এল।

এক হেমন্ত-পূজারী হিসেবে সৌরভবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানাব, বাস্তবে যা হয়নি, কল্পনার জগতে তাঘটানোর জন্য। তাঁর সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া উপন্যাসে বয়স ও ব্যাধি-বিদ্ধস্ত অভিনেতা নীহার চট্টোপাধ্যায় লিখিত স্বীকারোক্তি রেখে যাচ্ছেন গায়ক মণিময়কে অন্যায়ভাবে সন্দেহ করে তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির ব্যাপারেঃ তখন সত্যিই আমার কবচকুণ্ডল খুইয়েছি মণিদাকে ছেঁটে ফেলেছি নিজেই …” (পৃঃ ১৪৬)

ছোটগল্প

পৃথা কুণ্ডুর ছোটগল্পগুলি থেকে পাঠকের যা পরম প্রাপ্তি, তা হলো, একাধিক আখ্যানে নামোল্লেখ না রেখে বা ভিন্ন নামে প্রত্যক্ষভাবে আছেন আমাদেরই হেমন্ত কখনো তিনি তাঁর উপস্থিতিতেই পাতানো বোনের বিধবা বার পর তার মানসিকএবং আর্থিকত্রাতারূপে, কখনো বা ছাত্রীস্থানীয়ার পিতৃবিয়োগের পর তার বিয়ে যাতে দাবীহীন সৎপাত্রের সঙ্গে হয় এবং তার জীবনের একমাত্র রেকর্ড যাতে সে করতে পারে তা নিশ্চিত করার কার্যকর্তা হিসেবে, কখনো আবার নিজেরই জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু কাণ্ডের সময় উপস্থিত থেকে, আর পরলোক গমনের পরে ইহলোক আর স্বর্গলোকে নানা ঘটনার সাক্ষী এবং অনুঘটক য়ে প্রতিটি গল্প  ঠিক কিভাবে একজন, যিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে একজন ‘সঙ্গীতশিল্পী’, তাঁর সুরের সঙ্গতিতে বিভিন্ন মানুষের জীবনকে বাঁধতে সাহায্য করেছেন, তাদের দুঃখ-কষ্টের সময় বিশেষ করে, তার একেকটি নিদর্শন।

‘অন্তরালে’ গল্পটি সার্থকনামা। শুনেছি বাস্তবেও অনেকের বাহ্যিক-মানসিক বটবৃক্ষ ছিলেন আমাদের মহাশিল্পী। ‘বেঙ্গল টাইমস’-এর এবারের পূজা-সংখ্যায় ‘লকডাউন, অনলাইন ক্লাস এবং...’ একটি দীর্ঘতর রচনার অংশ। এটি সে অর্থে ‘গল্প’ নয়, লেখিকার অধ্যাপনা-জীবন থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতার বর্ণনা, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কি করে তাঁর সাহিত্য-অধ্যাপনার কাজে নেমে এসেছিল শিল্পীর সাহায্য-রূপী আশীর্বাদ ‘এবং মুশায়েরা’-র শারদ সংখ্যায় ‘যে জন আছে’-তে দেখি এক দম্পতির জীবনের সুখে-দুঃখে শিল্পীর উপস্থিতি। স্ত্রী সৌভাগ্যবতী, শিল্পীর প্রত্যক্ষ দেখা পেয়েছিলেন, এমনকি বর্তমান স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারেও তাঁর পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। স্বামী বিপত্নীক হবার পর ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে অন্তাক্ষরী খেলতে গিয়ে গেয়ে ওঠেন স্ত্রীকে যে রেকর্ড শিল্পী উপহার দিয়েছিলেন, তার গানঃ ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’।

সেপ্টেম্বরে ‘অপরজন’-এ প্রকাশিত ‘কড়ি ও কোমল’-এ উন্মোচিত হয়েছে শিল্পীর সত্তার একটি অন্য দিক, যে সম্বন্ধে এই লেখক হয় কোনদিন সেভাবে ভাবে নি, বা যে ব্যাপারে সে অস্বস্তিই বোধ করেছে। যেমন, কেন ঐ শিল্পী ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ গাইতে এত ভালোবাসতেন! লেখিকা একটি গল্পের চরিত্রের চিন্তার মধ্য দিয়ে মনে করিয়েছেন, ‘একজন স্রষ্টা, একজন প্রকৃত শিল্পী নিজের মধ্যে ধারণ করেন প্রকৃতি ও পুরুষকে’, যাকে পাশ্চাত্য সমালোচক আখ্যা দিয়েছেন ‘creative androgyny’! এমন অনেক মূল্যবান উপলব্ধি ছড়িয়ে আছে কাহিনীগুলির মধ্যে। ‘প্রতিলিপি’-তে শারদ অর্ঘ্য হিসেবে প্রকাশিত ‘সাগরের ঠিকানায়’ নামের অণু-উপন্যাসে তিনি আছেন ‘অসীমাভ দেবনাথ’ (এমন নানা নামেই আমরা লেখিকার গল্পে আমাদের প্রাণের মানুষটিকে পেয়েছি)-রূপে।  দুই প্রজন্মের সাংবাদিক-জীবনের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করেছেন তিনি, এক বর্তমানে-প্রয়াতা ভক্তের সাক্ষাৎকার-এবং-বিশ্লেষণমূলক রচনার কেন্দ্ররূপে। এর মধ্যেই উঠে এসেছে লোকমুখে শোনা শিল্পীর বিভিন্ন মানবিকতা-পরোপকারিতার নিদর্শন।

এছাড়া, গল্পগুলির একটি বিশেষত্ব হ’লো, প্রতিটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে শিল্পীর একেকটি গান। গানগুলি আগে এবং পরে অন্যরা গেয়ে থাকলেও তিনি গাইবার পর সেগুলি, অন্তত হেমন্ত-ভক্তদের মনে ‘হেমন্তের গান’ বলেই রয়ে গেছে। পুজোর অনেক আগে প্রকাশিত ‘অন্তরালে’-তে সেই গান যেটি নির্বাচন করেছিলেন তরুণ মজুমদার, কিন্তু অবিস্মরণীয় করে গেছেন হেমন্তঃ ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’। ‘লকডাউন, অনলাইন ক্লাস এবং ...’-তে আছে ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’, ‘ঝড় উঠেছে, বাউল বাতাস’, আর হিন্দী ‘বাদবান’ ছবির ‘আয়া তুফান’ (যে গানের আস্থায়ী লেখিকা একটু ভুল করে লিখেছেন ‘তুফান আয়া রে’)। ‘যে জন আছে’-তে তো বিপত্নীক প্রিয়তোষ শেষে গেয়েই উঠছেন, ‘ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে’, যে গানের রেকর্ড শিল্পী উপহার দিয়েছিলেন প্রিয়তোষের প্রয়াতা স্ত্রী পূর্ণিমাকে। ‘কড়ি ও কোমল’-এ আছে ‘আমার মন মানে না’, যা এক নারীরই উক্তি, কিন্তু সফলভাবে গেয়েছেন হেমন্ত (গল্পের ‘স্নেহাংশু’), আর ‘সন্ধ্যা হ’লো গো, ও মা’ এবং ‘তুমি কেমন ক’রে গান করো হে গুণী’। ‘সাগরের ঠিকানায়’ অণু-উপন্যাসে শুধু গান নয় (রজনীকান্তের ‘আমি অকৃতী অধম’), এসেছে শিল্পীর রবীন্দ্রচেতনা।

‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যের অরুণেশ্বরকে নিয়ে তিনি সাংবাদিক রেবাকে বলেন, “...অর্জুনের মত ‘অহো, কি দুঃসহ স্পর্ধা’ বলে নিজেকে জাহির করে না। আনন্দর মত বাইরে থেকে এসে কাউকে উদ্ধার করে না...  বাল্মীকির মত হঠাৎ করে মা সরস্বতীর  আশীর্বাদ পায় নি সে উল্টে সে অভিশাপ পেয়ে নেমেছে। তার আছে কেবল সুরটুকু।...  সে বীণা বাজায়,  নিজের লিমিটস জানে। বলে, আমার গানেই তুমি আমায় দেখ। বাইরে দেখতে যেও না ।  বাইরে থেকে দেখলে ভুল হতে পারে, হয়ত নিজের লোকেও ভুল বোঝে... তবু সে নিজেকে ছোট হতে দেয় না, কাউকে ছোট করেও না। আড়ালে বসে নিজের কাজটা করে যায় আর রেকগনিশনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।” তাঁর রবীন্দ্র-অনুধ্যান কত গভীর ছিল, এই আলোচনাই তার প্রমাণ।

সব শেষে ‘পরবাস’ পত্রিকায় জুলাই মাসে প্রকাশিত হাস্যরসাত্মক ‘স্বর্গ হইতে’ গল্পে এসেছে বি আর চোপড়ার ‘লোগো’-তে শ্লোকোচ্চারণ “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে...” আর রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে’, কারণ ঠিক এইভাবেই তো শিল্পী আমাদের হৃদয় আজও দুলিয়ে চলেছেন!

দুই লেখকের তুলনা

সৌরভবাবু সমকালীন সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আলোয় অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চোখ দিয়ে হেমন্তকে দেখিয়েছেন এই সব বিখ্যাত চরিত্রের ভেতরে কি হচ্ছে, সেটা দেখাতে গিয়ে তাঁকে নিজস্ব ধারণার আশ্রয় নিতে হয়েছে অনেকটাই পৃথা ব্যবহার করেছেন খণ্ড ইতিহাসের লেন্স যাঁদের চোখ দিয়ে এই মানুষটিকে নানা রূপে দেখা, তাঁরা সবাই সাধারণ মানুষ কিন্তু তাঁরাও একধরনের 'প্যারালাল হিস্ট্রি' অংশীদার আর 'তাঁর' মনের ভেতর ঠিক কি হচ্ছে, তা বোঝানোর চেষ্টা পৃথা করেন নি উল্টোদিকের মানুষগুলো নিজেদের মত করে ভেবে চলুক পাঠকও ভাবুন ছাড়াও পৃথা হেমন্তর রবীন্দ্র-অনুধ্যানের ব্যাপারটা সামনে আনতে চেয়েছেন, খুব স্বাভাবিক ভাবে, শ্বাস প্রশ্বাসের মত আর দৈনন্দিন জীবনে মানুষটা যেভাবে কথা বলতেন, সেটা যথাসম্ভব রাখার চেষ্টা তিনি করেছেন।

উপসংহার



প্রতিটি লেখায় অন্তঃস্তলে কিন্তু আছে কোনো না কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা, যা সঙ্গে মিশেছে সামান্য কল্পনার রং যে মানুষটি প্রয়াণের একত্রিশ বছর পরেও লেখক-লেখিকা এবং বর্তমান প্রবন্ধকারের মতো অনেকের জীবনে এক উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত উপস্থিতি, তাঁর এই সশ্রদ্ধ নিবেদন প্রাপ্য ছিল

 

 

 



[1] সৌরভ মুখোপাধ্যায়, সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া (কলকাতাঃ আনন্দ, ২০২০)

[2] (Publication, Anatareep. Sharadiya Anatareep 1427: শারদীয়া অন্তরীপ ১৪২৭ (p. 22-32). Antareep Publication. Kindle Edition.)

[3] শর্মিলি’, আমার মনে হয়, অভীক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত হেমন্তবাবুর আত্মজীবনী আনন্দধারা-র ২০১৩ সালের পুনঃপ্রকাশে একটি মুদ্রণ-প্রমাদ (৭৯ পৃষ্ঠা) বইটি যখন ভাদ্র ১৩৮২ বঙ্গাব্দে (ইংরেজী ১৯৭৫ সালে) প্রথম প্রকাশিত হয়, তার ১০৩ পৃষ্ঠায় ‘শর্মিলা’ই আছে।