কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

পায়েল মণ্ডল

জয়েস, ইউলিসিস, সিলভিয়া বীচ, ফেনিগ্যান্স ওয়েক, নাজী গেস্টাপো অফিসার…




                               

“Sylvia carried pollen like a bee. She cross-fertilized these writers. She did more to link England, the United States, Ireland, and France than four great ambassadors combined. It was not merely for the pleasure of friendship that Joyce, Hemingway, Bryher, and so many others often took the path to Shakespeare and Company in the heart of Paris . . .”

-  Andre Chamson

মর্ডানিস্ট সাহিত্যের গডমাদার। মনখোলা সদা হাসিখুশি এই নারীর ভূমিকা মর্ডানিস্ট সাহিত্যের অনেক দিকপালদের জীবনে অসীম। সিলভিয়া বীচ শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী নামের ছোট্ট বুকস্টোরের সত্ত্বাধিকারী। মর্ডানিস্ট সাহিত্যের নক্ষত্র এজরা পাউন্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, টি এস এলিয়ট, জেমস জয়েসের মত লিখিয়েদের উপস্থিতিতে মুখরিত থাকতো সিলভিয়া বীচের বুকস্টোর। নিজের অজান্তেই বিশ্বসাহিত্যে জায়গা করে নেন সিলভিয়া বীচ এবং তার বুকস্টোরটি।  ১৮৮৭ সালে আমেরিকার বাল্টিমোরে জন্মগ্রহণ করেন সিলভিয়া বীচ। বীচের বাবা প্যারিসে আমেরিকান চার্চে চাকুরী করতেন। সেই সূত্রে প্যারিস আগমন। বীচ স্পানিশ, ইটালিয়ান, এবং ফ্রেঞ্চ ভাষা শিক্ষা নেন। ১৯১৭ সালে সর্বোনে ফরাসী সাহিত্যে পড়াশোনা করার সময় পরিচিত হন এইড্রিন মুনিয়ের সাথে। রুঁ-দ্যা-দিওনে তরুণী মুনিয়ে একটি বইয়ের দোকান চালাতেন। স্টোরটির নাম ছিল ‘লা মেইসন ডেস এ্যামিস দেস লিভ্রে!’ বইয়ের খোঁজে প্রায়ই আসতেন স্টোরটিতে আর এমনভাবে সখ্যতা গড়ে ওঠে মুনিয়ের সাথে। সখ্যতা গড়ায় বন্ধুত্বে যে বন্ধুত্ব অটুট থাকে আমৃত্যু। দুজনের বয়েস ছিল উনিশ বছর। মুনিয়ে মূলত মর্ডান লিটেরেচারের বই বিক্রি করতেন। ইন্টিরিয়র সাজান পেইন্টিং এবং ফটোগ্রাফ দিয়ে। গ্রাহকদের জন্য ছোট্ট চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা রাখেন যেখানে বসে ক্রেতারা বই পড়েতে পারবেন। এইড্রিন তার বই বিক্রয়ের পেশাকে বুদ্ধিদীপ্ত আর্টিস্টিক প্রফেশনের পর্যায়ে নিয়ে যান।

এইড্রিনের অনুপ্রেরণায় সিলভিয়া বীচ নিজের একটি বুকস্টোর খোলেন। শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী। বান্ধবী এইড্রিনের মতই তিনি মর্ডানিস্ট লিটেচারের বই দিয়ে দোকান সাজান। ফিতে কাটার সালটা ছিল ১৯১৯। সেসময় প্যারিস মুখরিত ছিল স্কট ফিটজেরাল্ড, এজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট, হেমিংওয়ে, গার্টুড স্টেইন, জর্জ এ্যান্টহিল, জুনা বারর্নস, মিনা লয়, ম্যানরে, জেমস জয়েসের মত লিখিয়ে শিল্পীদের উপস্থিতিতে। বান্ধবী এইড্রিন একটি পত্রিকা বের করেন যেখানে বিদেশী এই মার্ডানিস্ট লিখিয়েদের লেখা ছাপতেন ফ্রেঞ্চ রিডারদের কাছে মর্ডানিস্ট ইংরেজি সাহিত্যকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।

দুই তরুণী সিলভিয়া বীচ এবং এইড্রিন মুনিয়ে বিশ্বসাহিত্যের আভন্ট-গার্দ লিখিয়েদের বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। প্যারিসে এই দুজনের বুকস্টোরে বসে প্রবাসী উঠতি মর্ডানিস্ট লিখিয়েরা তাদের সৃষ্টিশীল চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি শুধু বইয়ের ব্যবসার জন্য দোকান খোলেননি বরং তিনি চাইছিলেন স্থানটা যেন শিল্পী সাহিত্যিকদের মিলনমেলার স্থান হয়, যেখানে তারা শান্তি করে বসে চিন্তা করতে পারবেন, পারবেন প্রকাশিত বইয়ের সাথে পরিচিত হতে। সিলভিয়া শিল্পের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দোকানে আগত শিল্পী সাহিত্যিকদের জন্য বিনা পয়সায় চা এবং স্নাক্সের ব্যবস্থা করেন। টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা রাখেন যেন তারা বসে বই পড়তে পারেন অথবা লিখতে পারেন। একজন কুরিয়ার রাখেন যার মাধ্যমে প্রয়োজন হলে চিঠিপত্র আদান প্রদান করতে পারেন এ ছাড়াও বিছানার ব্যবস্থা করেন যেন ভবঘুরে ঠিকানাবিহীন কোন লিখিয়ে দু’একদিন থাকতে চাইলে থাকতে পারেন।

১৯২০ সালে হেমিংওয়ে সিলভিয়া বীচ এবং তার বুকস্টোরকে আবিস্কার করেন। পকেটে বই কেনার মত অর্থ না থাকায় সিলভিয়া তাঁকে একগুচ্ছ বই ধার দেন। ইউরোপ এবং আমেরিকায় এমন ঘটনা ছিল বিরল, বলা যায় নেই বললেই চলে যে কোন বই বিক্রেতা বিনা পয়সায় বই দিয়ে দেন পাঠকদের। হেমিংওয়ে সিলভিয়ার এই আচরণে আপ্লূত হন। হেমিংওয়ে আমৃত্যু মনে রাখেন তার এই ক্ষুদে বান্ধবীকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘A Moveable Feast‘-এ সিলভিয়া সম্পর্কে এমন ভাবে স্মরণ করেন –‘She was kind, cheerful and interested, and loved to make jokes and gossip. No one I knew was ever nicer to me.’ হেমিংওয়ের পরিবারের সাথে বন্ধত্ব গড়ে ওঠে সিলভিয়া এনং তাঁর বান্ধবী এইড্রিনের সাথে। উইকএন্ডে হেমিংওয়ে, তাঁর স্ত্রী হেডলি, এইড্রিন এবং সিলভিয়া চলে যেতেন আউটিংএ আবার কখনো বক্সিং ম্যাচ দেখতে অথবা বাইক রেসিং দেখতে।

১৯২০ সালের জুলাইয়ের একদিন। বান্ধবী এইড্রিন সিলভিয়া বীচকে নিমন্ত্রণ করেন ফ্রেঞ্চ কবি অদ্রে স্পায়ারের বাড়িতে। ব্যাক্তিগত ভাবে অদ্রেকে চিনতেন না বীচ, তবে তাঁর কবিতা পড়েছেন। ব্যাক্তিগত পরিচয় না থাকার জন্য প্রথমে পার্টিতে যেতে চাননি বীচ।  এইড্রিনের চাপাচপিতে রাজী হন। সেই সন্ধেয় অদ্রের বাড়িতে পৌঁছলে এইড্রিন তাঁকে টেনে নিয়ে যান এক কোণে। ফিসফিস করে বলেন –‘The Irish writer James Joyce is here.’ পার্টিটি ছিল জয়েসকে প্যারিসে স্বাগত জানানোর জন্য। প্যারিসে থিতু হবার কোন পরিকল্পনা ছিল না জয়েসের। এজরা পাউন্ড জয়েসকে বুদ্ধি দেন প্যারিসের সেটেল করার জন্য। জয়েস এই শহরেই পরের কুড়ি বছর কাটান। এজরা পাউন্ড চাইছিলেন জয়েসের মত একজন লিখিয়ে যেন মর্ডানিস্টদের মক্কা প্যরিসে অবস্থান করেন। নতুন দেশে স্থানান্তরের এটাই ছিল উপযুক্ত সময়। জুরিখ থেকে জয়েস ইতিমধ্যে তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল উপন্যাস ইউলিসিসের মোট আঠারো এপিসোডের মধ্যে চোদ্দ এপিসোড লেখা শেষ করেন। ইউলিসিস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল আমেরিকার ‘লিটল রিভিউ’ পত্রিকায়।  ইতিমধ্যে ‘ডাবলিনার্স’ এবং ‘পোট্রেট অফ দ্যা আর্টিস্ট’ বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকা ইউলিসিসকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করলে মর্ডানিস্ট এই লিখিয়ে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে পড়েন। প্যারিসের সাহিত্যিক সমাজ জয়েসের স্বভাব সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন, চাষাড়ে, প্রচণ্ড ইগোয়িস্ট, ক্ষুরধার বুদ্ধি, বিশাল শব্দভাণ্ডার, এবং অসম্ভব পড়ুয়া, ভয়াবহ মদ্যপ, ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষ। সহজে কেউ জয়েসের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে চাইতেন না, সাহিত্য আলোচনা তো নয়ই কারণ সাহিত্যকে তিনি যে স্তর থেকে বুঝতেন তেমন বোঝার মানুষ হাতে গোনা কয়েকজন ছিল মাত্র।

সেদিন এজরা পাউন্ড নীল ভেল্ভেট জ্যাকেট পরে এসেছিলেন। সাথে ছিল তাঁর স্ত্রী ডরোথি পাউন্ড। তুমুল আড্ডার মাঝে ছিলেন পাউন্ড। স্ত্রী ডরোথি আর একজন মহিলার সাথে আলাপে ব্যস্ত। মহিলাটি আর কেউ নয় নোরা বার্ণাকল, জেমস জয়েসের স্ত্রী (তখনো ধর্মীয় বা আইনগত ভাবে বিয়ে হয়নি নোরা এবং জয়েসের)। অনেক দিন পরে ইংরেজিতে কথা বলার মানুষ পেয়ে নোরাকে সেই সন্ধেয় খুব খুশি মনে হচ্ছিল।  পার্টির হোস্ট স্পায়ার ডিনার টেবিলে সমবেত গেস্টদের আসবার জন্য অনুরোধ করেন। তাদের গ্লাসে নিজে ওয়াইন ঢেলে দেন। সব অতিথিদের গ্লাস ওয়াইনে পূর্ণ হলেও জয়েসের গ্লাস সুরা শূন্য। জয়েসের পরিচিতজনরা প্রচণ্ড ভাবে বিস্মিত হন। ভয়াবহ লিকারপ্রেমীর গ্লাস কিনা শূন্য। বন্ধু এজরা পাউন্ড জয়েসের সামনে এক এক করে ডজন খানেক ওয়াইনের বোতল সার করে সাজিয়ে রাখেন। এই ভয়াবহ মদ্যপ আইরিশ লিখিয়ে নাকি সন্ধে আটটার আগে মদ স্পর্শ  করেন না!  এজরা পাউন্ডের এহেন কর্ম আর জয়েসের মদ্য বর্জনে উপস্থিত অতিথিরা ভীষণ মজা পেয়েছিলেন। ডিনার শেষ হলে জয়েস ডাইনিং রুম থেকে সোজা স্পায়ারের ছোট লাইব্রেরী রুমে গিয়ে বসেন হাতে একটি বোতল নিয়ে। জয়েসকে অনুসরণ করে বীচ লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন ওর সাথে পরিচত হতে। জয়েস গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি বইয়ের উপর চোখ বুলোচ্ছিলেন। ওর মনোযোগ ভঙ্গ হয় বীচের প্রশ্নে- “Is this the great James Joyce?”

চোখ তুলে দেখতে পান শুকনো লিকলিকে এক তরুণীর হাসি মুখ। খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিলেন জয়েস-

“James Joyce.”

সেটাই ছিল জয়েস বীচের বন্ধুত্বের সূত্রপাত।

বীচের সাথে কথা বলার সময় জয়েস ছিলেন খুব সতর্ক যেন ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কথা বলছেন। আইরিশ এ্যাকসেন্টে জয়েসের ইংরেজি বীচের খুব ভালো লেগেছিল। বীচ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন জয়েসকে তাঁর পরিচয় দিতেই পকেট থেকে একটি নোট বই বের করে চোখের খুব কাছে নিয়ে মেলে ধরেন। ঠিক যেই মুহূর্তে বীচের ঠিকানা লিখতে যাবেন তখনই কুকুরের ডাক শোনা যায়। তৎক্ষণাৎ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ান জয়েস। বীচ জানালার পাশে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন স্পায়ারের কুকুর ডাকছে।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বীচকে প্রশ্ন করেছিলেন- “Is it coming in? Is it feerrce?”


বীচ জয়েসকে ছোট্ট বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করেছিলেন কুকুরটি ঘরে আসবে না তো! বীচ পরে জানতে পেরেছিলেন জয়েসের কুকুর ভীতির কথা। শৈশবে কুকুর কামড়েছিল, সেই থেকে কুকুরের ভয় তাড়া করে ফিরেছে জয়েসকে। বীচ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন কুকুরের ভয়ে জেমস জয়েস নামের বিখ্যাত বদমেজাজী লেখক কি না কুঁকড়ে গেছেন! সেই সময় খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল জয়েসকে। একেবারে শিশু! পরদিন শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানীতে যান জয়েস। পরনে ছিল ডার্কব্লু সার্জ স্যুট, মাথায় কালো হ্যাট, পায়ে জীর্ণ ক্যানভাস স্যু। স্টোরের ভেতরের দেয়ালে ঝোলানো অস্কার ওয়াইল্ড এবং ওয়াল্ট হুইটম্যানের  ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলেন। বীচ বেশ দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলেন না-জানি জয়েস কী আবার বলে ফেলেন। ভদ্রলোক আর্মচেয়ারে বসলে বীচ কিছুটা  আশ্বস্ত হন। সেদিন স্টোর থেকে বের হবার আগে জয়েস বলেছিলেন বই ভাড়া করার জন্য তিনি মাত্র এক মাসের খরচ বহন করতে পারবেন। বীচ জয়েসকে এই ব্যাপারে না ভাবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। পরে বীচ আবিষ্কার করেন এই পরিণত বয়েসেও জয়েস ভয় পান বজ্রপাতে, কুকুরকে, সাগরকে, উচ্চতাকে, ঘোড়া, এবং যন্ত্রে। খুব ছেলেমানুষ মনে হয় জয়েসকে। এজরা পাউন্ড জয়েসের জন্য যে এ্যপার্টমেন্ট খুঁজে বের করেন সেটার অবস্থান ছিল এ্যাপার্টমেন্টের পঞ্চম তলায়। খুবই ছোট ফ্লাট। বাথটব ছিল না, ছিলো না ইলেক্ট্রিসিটি। মাঝের স্পেসে কোনমতে লেখার টেবিল বসানো হয়। গ্যাস বার্ন্ট টেবিল ল্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়। জয়েস ইউলিসিস লিখছিলেন সেসময়। উপন্যাসটি শেষের দিকে। দৃষ্টিশক্তি কমে যাবার জন্য স্বল্প আলোয় লিখতে পারছিলেন না।


১৯২০। বছরটা ছিল আইরিশ লিখিয়ে জেমস জয়েসের জন্য অশুভ বছর। আমেরিকার লিটল রিভিউতে তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল উপন্যাস ইউলিসিস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হচ্ছিল (১৯১৮ – ১৯২০)। বাদ সাধে ইউ এস সেন্সরশিপ ডিপার্টমেন্ট। ‘কিয়র্কি’ এপিসোডে উপন্যাসের প্রটাগোনিস্টের প্রকাশ্যে মাস্টারবেশনের দৃশ্যের জন্য আমেরিকায় উপন্যাসটির প্রকাশ, ধারাবাহিক প্রকাশ এবং প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ভীষণ ভেঙ্গে পড়েন জয়েস।  তার আগের দুটো বই ‘ডাবলিনার্স’ এবং ‘পোট্রেট অফ আর্টিস্ট’ প্রকাশ নিয়েও প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়, বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন,  এমনকি আদালতে গড়াতে যায়। গল্পগ্রন্থ ‘ডাবলিনার্স’ প্রকাশ করতে দীর্ঘ আট বছর জয়েসকে প্রকাশকদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়।  ইউলিসিস পুরোটা প্রকাশের আগেই নিষেধাজ্ঞায় জয়েস ভীষণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েন।

সিলভিয়া বীচ তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন –

‘ইংলিশ প্রকাশকের কাছে কোন সাহায্য পান না জয়েস। তাঁর জন্য সময়টা ছিল ভয়াবহ হতাশার। এই সময় জয়েস প্রায়ই আমার বুকস্টোরে আসতেন। চুপচাপ বসে বই পড়তেন অথবা নতুন প্রকাশিত বই নেড়েচেড়ে দেখতেন। বুঝতাম আট বছর ধরে লেখা উপন্যাস ইউলিসিস আমেরিকায় প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞায় তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। ভেঙ্গে পড়েছেন আর একটি কারণে যে কোন ইংলিশ প্রকাশনী সংস্থা তাঁর এই উপন্যাস ছাপতে রাজী নয়। ওর মলিন মুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল এই জিনিয়াস লিখিয়ের জন্য আমার কিছু করা উচিৎ। একদিন বিকেলে দেখি জয়েস খুব বিষণ্ণ হয়ে স্টোরের এক কোণে বসে আছে। পরনে লন্ড্রী না করা ড্রেস। টাকার অভাবে ড্রেস লন্ড্রি করাতে পারতেন জয়েস। গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখছে। এবার আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ওর সামনে যেয়ে দাঁড়াতেই মুখ তুলে চাইলেন। সরাসরি চোখে চোখ রেখে ওঁকে বললাম - “Would you let Shakespeare and Company have the honour of bringing out your Ulysses?” আমার চোখে চোখ রেখে সেইদিন বিন্দু মাত্র সময় নষ্ট না করে আমার প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। এমন ভাবেই আমার মত এক অচেনা প্রকাশকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কম পুঁজি, প্রকাশনায় অভিজ্ঞতা ছাড়াই ইউলিসিসের মত এক মহান উপন্যাস প্রকাশের সাহস করি’।

সিলভিয়ার প্রস্তাবে জয়েস সরাসরি রাজী হন। মর্ডানিস্ট সাহিত্যের প্রতি বীচের শ্রদ্ধা এই চ্যালেঞ্জকে নিতে অনুপ্রাণিত করে। বীচ যখন ইউলিসিস প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন, শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ছিল না। তিনি অভিজ্ঞ প্রকাশকও ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন তরুণী শখের গ্রন্থ বিক্রেতা। দূর্বোধ্য এই বইটির পাণ্ডুলিপি টাইপ করতে যেয়ে ভীষণ বিপদে পড়েন সিলভিয়া বীচ। প্রাথমিক ভাবে নয়জন স্টেনোগ্রাফারকে নিয়োগ দেন ইউলিসিস টাইপ করার জন্য। বইটি ভয়াবহ দূর্বোধ্য হওয়াতে স্টেনোগ্রাফার দের স্ক্রিপ্ট টাইপ করতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। বইটি টাইপ করতে যেয়ে স্টেনোগ্রাফারদের পারিবারিক জীবন পর্যন্ত হয়ে পড়ে তিক্ত । সারাদিন জয়েসের এই দূর্বোধ্য স্ক্রিপ্ট টাইপ করতে যেয়ে তাদের মেজাজ হয়ে পড়ে খিটখিটে, বাড়ি ফিরে প্রায়শই  স্বামীদের সাথে বাধে ঝগড়া। স্বামীদের সাথে তাদের সম্পর্ক হয়ে পড়ে শীতল। একজন স্টেনোগ্রাফারের স্বামী ডিভোর্সও দেয়। স্টেনোদের কয়েকজন ইউলিসিসের কপি  সিলভিয়া বীচের দরজার সামনে রেখে যায়, সাথে নোট অন্য স্টেনো নিয়োগ দেবার অনুরোধ জানিয়ে। জয়েস বলে কথা, পারফেক্ট আর্টিস্ট বলে কথা! আর্টিস্ট হবার পথ জয়েসের জন্য সোজা ছিল না। প্রতিটি বিষয়ে তাঁকে যুদ্ধ করে এগোতে হয়েছে। যেমনটা ভাবতেন জয়েস, আর্টিস্ট হবেন, হয়েছেন, হার্ড আর্নড আর্টিস্ট।

জয়েসের ইউলিসিস প্রকাশের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করার সাথে সাথে নিজের অজান্তেই সিলভিয়া বীচ বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে যান। এর আগে বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ছিল না বীচের। নিজের অর্থ খরচ করে দিন রাত খেটে বইটিকে আলোর মুখ দেখান সিলভিয়া বীচ। প্রথম এডিসনে ১০০০ কপি ছাপার পরিকল্পনা করেন এর মধ্যে ১০০ কপি ছিল লেখকের সাক্ষর যুক্ত। মজার ব্যাপার হলো কমিউনিস্ট চিন প্রথম এডিশনের ১০ কপি ইউলিসিস প্রিঅর্ডার করে। শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী থেকে ইউলিসিস প্রথম প্রকাশিত হয় জয়েসের জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে। ইউলিসিসের মত একটি মনুমেন্টাল উপন্যাসকে  পোড়ানো হয় লিখিয়ের নিজের দেশ আয়ারল্যান্ড এবং কানাডায় ১৯২২ সালে, ইংল্যন্ডে ১৯২৩ সালে। উপন্যাসটি ইংল্যান্ডে অফিশিয়ালি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ১৯২৯ সালে। সিলভিয়া বীচ জয়েসকে আগাম রয়ালটি দিয়ে সাহায্য করেন। জয়েস কিন্তু সিলভিয়া বীচের আবেগ এবং আর্থিক সহায়তার প্রতি সম্মান শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি। আমেরিকায় ইউলিসিসের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ৪৫০০০ ইউ এস ডলারে র‍্যান্ডম হাউজের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন দ্বিতীয় এডিশন প্রকাশের জন্য। সিলভিয়া বীচ খুব আশা করেছিলেন জয়েস শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানীর মাধ্যমেই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করবেন। ১৯২২ সালে ইউলিসিস বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হলে ইউরোপ এবং আমেরিকাতে রাতারাতি বিখ্যাত হন। বইটির উপর নিষেধাজ্ঞা এবং আয়ারল্যান্ড, কানাডা এবং ইংল্যান্ডে বইটি পোড়ানোর জন্য সাহিত্যবোদ্ধাদের মাঝে প্রচণ্ড আগ্রহ সৃষ্টি হয় এটা  জানার জন্য যে আসলে জয়েস উপন্যাসটিতে কী বলেছেন কেমন ভাবে উপন্যাসটি নির্মাণ করেছেন।

ইউলিসিস প্রকাশের পরে কিছুদিন রাইটার্সব্লকে পড়েন জয়েস। এই অবস্থা কাটতে বেশিদিন সময় লাগে না। এবার তিনি প্লানেট আর্থের ভয়াবহতম দূর্বোধ্য উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। নাম দেন ‘ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস’। উপন্যাসটার কাজ শুরু করে লেখা এগোলে জয়েস তার নাম ঠিক করেন। কঠিন গোপনীতায় রাখেন নামটা। বন্ধু ইউজেন জোলাসকে পড়ে শোনাতেন। জোলাস ছিলো তার ডাইহার্ড শ্রোতা। এদিকে ফোড ম্যাডক্স উপন্যাসটি তার পত্রিকা ট্রান্স আটলান্টিক রিভিউতে ধারাবাহিক ভাবে ছাপানোর জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। ম্যাডক্সকে জয়েস বলে দেন তিনি ছাপতে দেবেন কিন্তু নাম ছাড়া। সিরিজটা যাবে ‘ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস’ নামে। হ্যারিয়েট শ ওয়েভারের সাথে উপন্যাসটির নাম নিয়ে গেসিং গেম হয় জয়েসের। সেটা ছিলো মে ২৯২৭ সালে। জয়েস তাকে হিন্টস দেন যে তার এই উপন্যাসটির নাম হবে খুব সাধারণ। হ্যারিয়েট কয়েকটি নামের ধারণা করেন যেগুলো হলো – ওয়ান স্কোয়ার্ড, ডাবলিন এইল, আয়ারল্যান্ডস আই, ফিনিক্স পার্ক ও ফিন্স টাউন। এগুলোর একটিও জয়েসের গোপন রাখা নামের সাথে মেলেনি। জয়েস তার উপন্যাসটি নিয়ে গেসিং গেম খেলতে থাকলেন বন্ধুদের সাথে। জুলাই ১৯৩৮এর এক রাতে মাতাল হয়ে বন্ধু দম্পতি জোলাসদের সাথে গেসিং গেম খেলতে শুরু করলেন। জয়েস সূত্র দিচ্ছিলেন গেস করার জন্য। মারিয়া জোলাস ইউজেন জোলাসের স্ত্রী একবার সঠিক নামের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছান। ইউজেনের মাথায় ভূত চাপে জয়েসকে হারিয়ে দিতে। পুরো জুলাই মাস জুড়ে ইউজেন চিন্তা করতে থাকেন আর উপন্যাসটির ম্যান্সক্রিপ্ট বারবার পড়ে শোনেন। আগস্ট ২-এ তাঁর মাথায় একটা নাম ঝিলিক দিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় ডিনারের সময় জয়েসের সামনে নামটি উচ্চারণ করেন ইউজিন। নামটি শুনে জয়েস হতচকিত হয়ে যান। তিনি তার স্ত্রীকেও বলেননি নামটি। জয়েস ইউজিনকে জানান যে তিনি সঠিক নামটি বলেছেন। পরদিন অর্থাৎ আগস্ট ৩ তারিখে জয়েস ইউজিনের ফ্লাটে ব্যাগ হাতে হাজির হন। হাজার ফ্রাঁর কয়েন ভর্তি ব্যাগ ইউজিনকে হস্তান্তর করেন বাজীর টাকা পরিশোধ করার জন্য। জয়েস পাবলিশার্সেকেও বলেননি নাম কি হবে উপন্যাসটির তাই ইউজিনকে অনুরোধ করেন নামটি গোপন রাখার জন্য। প্রকাশক মিস ওয়েভার উপন্যাসটির নামটি দেখেন যখন তার টেবিলে টাইটেল পেজের প্রুফ কপি পান। দিনটি ছিল ফেব্রুয়ারি ৪, সাল ১৯৩৯। উপন্যাসটির নাম – ‘ফেনিগ্যান্স ওয়েক!’ ধারণা করা হয় উপন্যাসটি নিয়ে তিন শত বছর গবেষণা হবে। লন্ডনে এক সন্ধেয় ডিনার টেবিলে মাতাল জয়েস বন্ধু হ্যারি শ ওয়েভারকে উপন্যাস ফেনিগ্যান্স ওয়েকের মূল ম্যনস্ক্রিপ্টটা উপহার দেন ইউলিসিস লেখার সময় দীর্ঘ আট বছর তাঁর নিজের পরিচয় গোপন রেখে জয়েসকে সংসার খরচের অর্থ সাহায্য করার জন্য। জয়েসের কাছে এই মহান বান্ধবীর আর্থিক ঋণ শোধ দেবার মত কিছুই ছিল না, তাই তিনি ফেনিগ্যান্স ওয়েকের মূল ম্যনস্ক্রিপ্টটিই উপহার দেন যার বর্তমান অকশন মূল্য বিলিয়ন ডলারেরও উপরে। জয়েস বলে কথা!  ওর সব কিছুই আলাদা। একক ও অনন্য। উপন্যাসটি লিখতে জয়েস সময় নেন দীর্ঘ সতেরো বছর। ১৯৩৯ সালে আর এক বিশ্ব যুদ্ধের মাঝে বইটি ‘ফেনিগ্যান্স ওয়েক’ নামে প্রকাশিত হয়। লন্ডনের ফেবার এন্ড ফেবার এবং নিউইয়র্কের ভাইকিং থকে বইটি এক সাথে প্রকাশিত হয়।

‘ওয়েক’ প্রকাশের সাথে সাথে ইউরোপ এবং আমেরিকায় স্টোরগুলোতে বইটি পৌঁছে যায়। ফ্রান্সেও বইটি পরিবেশিত হয়। জয়েসের বইয়ের প্র থম প্রকাশক শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানী ফেনিগ্যান্স ওয়েক ডিসপ্লে করেন। তখনো নাজী বাহিনী প্যারিসে পৌঁছেনি। তাঁর আগেই ফেনিগ্যান্স ওয়েকের সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। সিলভিয়া বীচ একটি (নিজের কপি) কপি ডিসপ্লেতে রেখে দেন। ১৯৪০, জুন ১৪ তারিখে প্যারিস দখল করে নেয় নাজী বাহিনী। এর পরে প্রায়ই জার্মানী গেস্টাপো অফিসার এসে হানা দিতে থাকে বুক স্টোরে। তারা ইহুদি মেয়ের খোঁজ করতো। স্টোরে এক ইহুদি সেলস গার্ল কাজ করতো। প্যারিস দখলের পরে সে পালিয়ে আত্মগোপন করে। গেস্টাপোদের কাছে সেই খবর ছিল আর তাই তারা চড়াও হতো স্টোরে। একদিন মজার ঘটনা ঘটে। সেদিন গেস্টাপোরা ইহুদি সেলস গার্লের খোঁজে আসে না। আসে অন্য কিছুর দাবী নিয়ে। এক স্মার্ট গেস্টাপো অফিসার স্টোরে এসে ডিসপ্লেতে রাখা জয়েসের ফেনিগ্যান্স ওয়েক প্যাক করে দিতে বলে। আকাশ থেকে পড়েন সিলভিয়া বীচ জার্মান সেনা অফিসারের জয়েসপ্রীতি দেখে। বীচ খুনে জার্মানীদের হাতে ফেনিগ্যান্স ওয়েক তুলে দিতে চাননি। অফিসার হুমকি দিয়ে যায়। সেইদিনই বীচ স্টোরের সব বই প্যাক করে এক বান্ধবীর এ্যাপার্টমেন্টের সেলারে লুকিয়ে ফেলেন। বুকস্টোর বন্ধ করে দেন।

গেস্টাপোরা সিলভিয়া বীচকে আটক করে অন্যান্য আমেরিকান বন্দিদের সাথে চিড়িয়াখানার বাঁদরের ঘরে আটকে রাখে। একমাস চিড়িয়াখানার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রাখার পরে ভিটেলের ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয় যেখানে ১৯৪৩ সালের বসন্ত অব্দি বন্দি অবস্থায় থাকেন সিলভিয়া বিচ। ১৯৪৩ সালের বসন্তে কয়েকজন বন্ধুর সাহায্যে ছাড়া পান বীচ। প্যারিসে নিজের ফ্লাটে ফিরে আসেন বীচ। খাবার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির রেশনিং এ দিন পার করতে হয়। আগস্ট ১৯৪৪, প্যারিসের র‍্যু-দ্য-ওদিওঁ হলো প্যারিসের সর্বশেষ এলাকা যেটাকে মিত্র বাহিনী জার্মানীদের অকুপেশন থেকে মুক্ত করে। মিত্রবাহিনী যখন র‍্যু-দ্য-ওদিওঁতে প্রবেশ করে এলাকার বাসিন্দারা বারান্দায় এসে দাঁড়ায় বীরসন্তানদের  অভ্যর্থনা জানাতে। বীচ এবং এইড্রিনও সেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সিলভিয়া বীচ বলেন - “I heard a deep voice calling: Sylvia!” And everybody in the street took up the cry of Sylvia! It’s Hemingway!  It’s Hemingway! Cried Adrienne.  I flew downstairs: we met in a crash. He picked me up and swung me around and kissed me while people on the streets and in the windows cheered.”

এটা যেন ওল্ড ম্যান এন্ড সীর ম্যারিনার সান্তিয়াগোর সেই জলদগম্ভীর আহ্বান…!

 

সূত্র :

১। Shakespeare and Company by Sylvia Beach

২। Books and Their Makers: Sylvia Beach and James Joyce- By Macy Halford

৩। James Joyce by Richard Ellmann

৪। Man from Babel by Eugen Jolus


 

2 কমেন্টস্:

  1. অপূর্ব!! জেমস জয়েস ও তাঁর কৃতি ইউলিসিস নিয়ে এই অসাধারণ লেখা পড়ে ঋদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ ।

    উত্তরমুছুন
  2. বাক্যের মধ্যে 'যেয়ে' শব্দর ব্যাবহার শ্রুতিকটু

    উত্তরমুছুন