কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

মুর্শিদ এ এম

 

সমকালীন ছোটগল্প


ঝাঁঝ বলতে যা বুঝি

 

ও আদা আর রসুন বিক্রি করে। আদাগুলো আদা বলেই বিক্রি করে রসুনগুলোকে রসুন নামেই বিক্রি করে। পচা আদা আর ভালো আদা, সুন্দরী আর কালো আদা, বাসি আদা, টাটকা আদা। মোটা কোয়া, সরু কোয়া, এক কোয়া, বহু কোয়াওয়ালা রসুন। আদায় ঝাঁজ থাকে। রসুনে আমিষ থাকে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে। কেউ কেউ করে না। আদাগুলো আদার মতো ঝাঁক বেঁধে, রসুনগুলো রসুনের মতো গুছি বেঁধে শুয়ে থাকে। খদ্দেরের হাতের নড়াচড়ায় নড়াচড়া করে। এপাশ-ওপাশ করতে পারে। কেননা আদা আর রসুন কোথাও যেতে পারে না, চায় না। ও বিক্রি করে বলেই কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে। যখন কেউ কিনতে আসে না, তখন ও এদিক-সেদিক তাকাতাকি করে। ফুটপাথ থেকে কাল মহাদেবের ডাবের ভ্যান উঠিয়ে নিয়ে গেছিল পুলিশে। পুলিশ আসছে কি না তাকাতাকিতে থাকে। তখন আদারা রসুনেরা সামান্য শ্বাস নেয়ার ফুরসত পায়। এ-ওর ভালোমন্দ কথা, পারিবারিক কথা, সিরিয়ালের লাস্ট এপিসোডে সুইসাইড করতে যাওয়া নায়িকাটা বেঁচে যাবে কি না—তা নিয়ে চিন্তার আদান-প্রদান করে। ফাঁকা পেয়ে লাল পাঞ্জাবি পরা একজন আসে। জিজ্ঞেস করে, কোথাকার? নাগপুরী না ইসরায়েলি? ও আদা আর রসুন বিক্রি করে। ও বলে, ইন্ডিয়ান মাল। লাল পাঞ্জাবি কিছু না-বলে মুচকি মুচকি হেসে চলে যায়। আদা হাসে রসুনও হাসে। একবার যখন ও খদ্দেরের ওপর বিরক্ত হয়ে বলেছিল, এ কি বাবার ঘরের মাল! তখন সেদিন খুব রাগ হয়েছিল আদার। ভয়ানক গোঁসা করেছিল রসুন। যখন তারপর শুনল, ইলেকট্রিক লাইন, টেলিফোন লাইন, রেলের লাইন, প্লেনের লাইন, ব্যাঙ্কের মাল সব যখন খুশি বেচে দেয়া যায়—তখন থেকে সেদিন থেকে মাল বললে আদারা হাসে। রসুনেরা মজা পায়। এক মোটা মহিলা পুলিশের ছানবিন এরিয়া পেরিয়া আসার পর মাস্ক খুলে ব্লাউজের তলায় গুঁজে রাখে। ও আদা রসুনের জামা পালটে দেয়ার কাজ ফেলে রেখে সেদিকে তাকায়। পুলিশের ছানবিন এরিয়া এগিয়ে আসছে কি না ভাবনা করে। বাইকের পেছনে বসা দুটো সুডৌল শক্ত বুক চালকের পিঠে গিঁথে রেখে চলেছে। ওর ওরকম দৃশ্যের অবতারণা করার সাধ জাগে। সাইকেলটার দিকে তাকাতাকি করে। ঠেস দেয়া আছে বন্ধ দোকানের শাটারে। ভারী লোহার ক্যারিয়ার, তাতে দড়িদড়া পেঁচানো। মাঝের রডে ফুল-ময়লা গামছা। ঘন্টির মাথায় বজরংবলীর স্টিকার। বাইকটা স্লো করে এদিকে দেখেও চালিয়ে নিয়ে গেল লোকটা। আদা কিনল না রসুন কিনল না। বন্ধ দোকানের পেছন থেকে পচা গন্ধ আসে। উঁচু ফ্ল্যাট থেকে বাসিন্দারা পোড়ো জমিতে ডিমের ক্রেট ছুড়ে ফেলে। মিনারেল ওয়াটারের খালি বোতল, ব্যগপাইপারের ফাঁকা বোতল ছুড়ে দেয়। আধখাওয়া পিৎজা, সেলিব্রেশনের মোড়ক, ভাঙা ক্রেয়ন, ছেঁড়া প্যান্টি, কুচোনো টিউবলাইট—সব এখানে ঢেলে দেয়। সম্মিলিত বসবাসের গন্ধ তৈরি হয়। এ গন্ধের জাতবিচার করা যায় না। নাকে লাগে খুব। ওর নাকে আদা আর রসুন গতর নিংড়ানো সুবাস উপহার দেয়। তা টপকেও গন্ধ আসে। গন্ধ ছড়ায়। অনেকেই মাস্ক পরে হাঁটে। গন্ধের কারণে না ভাইরাসের কারণে না পুলিশের কারণে, বোঝা যায় না। সাদা চটের বস্তায় রোদ পড়েছে। আদারা আনন্দ করছে। রসুনেরা আমোদ জুড়ে দিয়েছে। এবার ওদের ছুটি। এখন ওরা সংখ্যায় কম। বস্তা খালি করে তলানিতে ওরা শুয়ে আছে। গায়ে রোদ পড়ছে। ও বারমুডার মতো দেখতে, পাজামার মতো দেখতে, ট্র্যাক প্যান্টের মতো দেখতে পরিধেয়র পকেট হাতের তালুতে চাপে। বেশ ভারী হয়েছে। ভারী হয়েছে তলপেটও। একবার মুতে আসা দরকার। দোকানের পেছনে পোড়ো জমির গায়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করে। আদারা শুয়ে থাকে রসুনেরা শুয়ে থাকে। গতরে হাওয়া লাগে। রোদ তো লাগেই। পুলিশ দুজন এসে দাঁড়ায়।

--এটা কে পেতেছে? লোক কই? কোমরে দীর্ঘকালের অব্যবহৃত পিস্তল যার ঝোলে, সে জানতে চায়। ততক্ষণে অন্যজন, যার লাঠি প্রায় চলে—বস্তাদুটোর ঘাড় মটকে ধরে। আদা চিৎকার করে। রসুন চিৎকার করে। তাদের মালিককে ডাকে। ও আসে মুতের ফোঁটা পরিধেয়তে মেখে।

--কতবার বলেছি না, এখেনে বসতে না!

--সার, সার—আর বসব না। অন্য কোথা চলে যাব। সার, কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেছে মালিক... সার পেটে তো খেতে হবে। সার—

বস্তাদুটোকে নিয়ে সেই লাঠিধারী পরিত্যক্ত ভূমিতে আছড়ে দেয়। খালি বস্তা হিঁচড়ে এনে সামনে রাখে। চলে যায় এরপর। থম মেরে কিছুক্ষণ মাটিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে ও। উবু হয়ে ফের দাঁড়ানোর সাহস চায় ও। বাইকটা ফিরে আসে। আদা কিনবে। রসুন কিনবে। আঁটোসাটো বুকদুটো আর ততটা তীব্র মনে হয় না ওর। বাইক হতাশ বদনে বিদায় নেয়।

আদারা পড়ে থাকে করোনাগ্রস্ত ডেডবডির মতো। রসুনেরা পড়ে থাকে বর্জ্য পি পি ই কিট-এর মতো। রাত রসুনের মাথায় ওঠে। অন্ধকার আদার বুকে চেপে বসে। মেঘের আড়ালে চাঁদ বাসি কাপড় আজড়ে বেরিয়ে আসে। আদারা হাসে। রসুনেরা হাসে। তাদের গতরে যৌন সুড়সুড়ির প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। শেকড় ছাড়ে। পাতা ছাড়ে। পরিত্যক্ত জমিনে জীবন রচিত হয়। অনেকদিন পর আসে ও। আদাদের দেখতে। রসুনের খোঁজ নিতে। নিভৃতবাস থেকে আদারা কি বাসায় ফিরেছে! সেফ হোম থেকে কি রসুনেরা ফিরে সন্তানকে চুমো খেয়েছে! আদারা রসুনেরা খিলখিলিয়ে হেসে ওকে স্বাগত জানায়। ও বলে, তোরা বেঁচে আছিস? ওদের পাতায়, গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে। ভালোবাসা করে। আদা আর রসুনকে ফের বলে—হোটেলের কাজ চলে যাবার সময় চুরি করে তোদের ফুঁসলে নিয়ে এসেছিলুম স্টোর থেকে। এবার মালিককে গিয়ে ফেরত দেব সব।  নিশ্চয়ই কাজের অভাব হবে না এইবার।

 


1 কমেন্টস্: