কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৬২    


গত ৬১তম সংখ্যা কালিমাটি অনলাইনে কথনবিশ্ব বিভাগে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ‘কী যে বলি’ শিরোনামে। লিখেছিলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক  অধ্যাপক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়। লেখাটিতে তিনি একদিকে যেমন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেছেন, অন্যদিকে তেমনি সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন প্রথা ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপিত করেছেন প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে অথবা আরও স্পষ্ট করে বলা যায় প্রাণী হত্যার নৃশংসতার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ ও হতাশার কথা। এই লেখাটির প্রাসঙ্গিকতায় প্রকাশ করা হয়েছিল আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত একটি পুজো প্রাঙ্গনে রক্ষিত হাড়িকাঠের ছবি, একটি রক্তরঞ্জিত গরুর ছবি এবং বাকি দুটি ছবি মাংসের বাজারে টাঙানো সদ্য হনন করা প্রাণীর ছবি। ফেসবুকের টাইমলাইনে যখন এইসব ছবি সহ লেখাটি পড়ার জন্য লিঙ্ক দেওয়া হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ তিক্ততা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিলেন,  ‘নৃশংসতা। না ছাপলে ভালো করতেন’। আবার কেউ সংশয় প্রকাশ করেছিলেন,  ‘আজকের দিনেও... Digital... Science... এ যুগেও এমনটা... হবে / হয়... ভাবতে হবে’। প্রতিক্রিয়ার উত্তরে আমরা জানাতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, লেখাটা কিন্তু নৃশংসতা বিরোধী। অর্থাৎ লেখাটি হয়তো আপনারা পড়েননি এবং না পড়েই যা হোক একটা মন্তব্য লিখছেন, অথবা লেখাটি পড়েও তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেননি, তাই এই ধরনের মন্তব্য করেছেন। আর প্রকাশিত ছবিগুলো দেখে যদি নৃশংসতা বলে মনে হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয় যে, এসব নৃশংস দৃশ্যের প্রায়শই আমরা মুখোমুখি হই, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং প্রকাশ্য বাজারে ও ময়দানে। তখন কিন্তু সেই অসহায় প্রাণীগুলির হত্যাকান্ড দেখে আমরা বিচলিত হই না এবং প্রতিবাদও করি না। বরং সেই হত্যাকান্ড যদি ধর্মীয় পরিসরে ঘটে, তাহলে আমরা মনে করি, এসবই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিতআর যদি তা আমাদের খাদ্যসংস্কৃতির অন্তর্গত হয়, তাহলে আমরা নিশ্চিন্ত হই আমাদের খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের কথা মনে মনে আবৃত্তি করে। এবং একথা উল্লেখ করা বাহুল্য যে, করুণাময় ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আমরা যে প্রাণীদের হত্যা করি, সেইসব প্রাণী কিন্তু আমাদের খাদ্য-খাদকেরই তালিকাভুক্ত।  সুতরাং যে দৃশ্যাবলী আমরা প্রায় নিয়মিত দেখতে অভ্যস্ত, ফেসবুকের টাইমলাইমে তা প্রকাশিত হলে আপত্তি করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। আর তাই আমরা এটাই একান্ত ভাবে আশা করব যে, প্রত্যেক পাঠক-পাঠিকা যেন কালিমাটি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিটি লেখাই নিবিড় ভাবে পাঠ করেন  এবং সেই পড়ার প্রেক্ষিতে যা কিছু তাঁর প্রতিক্রিয়া এবং অভিমত, তা অবশ্যই প্রকাশ করেন। প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হবার সৎসাহস আমাদের সবারই থাকা একান্ত জরুরি।

বিগত ২০১৮ কলকাতা বইমেলায় ‘ধানসিড়ি প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল গল্প সংকলন ‘গল্প ২৭’। এই সংকলনে সংকলিত হয়েছিল ‘কালিমাটি’ (মুদ্রিত) পত্রিকায় প্রকাশিত ২৭টি গল্প। বইটি যে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে, এই সংবাদে আমরা খুবই আনন্দিত। প্রসঙ্গত জানাই, আগামী ২০১৯ কলকাতা বইমেলা শুরু হওয়ার আগেই ‘বৈভাষিক প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত হলো কবিতা সংকলন ‘কবিতা ডট কম’। মূলত আন্তর্জালকালিমাটি অনলাইনপত্রিকায় এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত অসংখ্য কবির অগণিত কবিতার মধ্যে থেকে আপাতত বেছে নেওয়া হয়েছে বিরাশিজন কবির কবিতাঅধুনা প্রয়াত কয়েকজন কবির কবিতা অবশ্য ‘কালিমাটি’ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এবংকালিমাটিপত্রিকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এই সংকলনেও কয়েকজন বিশিষ্ট প্রবীণ কবির পাশাপাশি মূলত তরুণ ও তরুণতর প্রজন্মের কবিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করা হয়তো বাহুল্য হবে, এই বিরাশিজন কবির কবিতার নিবিড় পাঠে সমসময়ের বাংলা  কবিতার ধারাটিকে মোটামুটি ভাবে স্পর্শ করতে পারবেন প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা প্রসঙ্গত জানাই, এই সংকলনটি শুধুমাত্র ভারতে বসবাসকারী কবিদের বাংলা কবিতার সংকলন এই বিরাশিজন কবি ছাড়াও আরও অনেক কবিকালিমাটিকালিমাটি   অনলাইনপত্রিকায় নিয়মিতভাবে কবিতা লিখেছেন ও লিখছেন এবং শুধু ভারতে বসবাসকারী কবিরাই নন, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী, বিশেষত বাংলাদেশের কবিরাকালিমাটিকে তাঁদের কবিতায় সমৃদ্ধ করেছেন আগামী কবিতা সংকলনে আমরা সেইসব কবিদের কবিতা প্রকাশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি 

সবাইকে জানাই শীতের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :   
        
08789040217 / 09835544675  

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India


<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’




অনুপম রায়ের সুরে ও কথায়, অনুপম রায়েরই গাওয়া একটি গান ঝাঁ করে’ সমকালের কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, এমনকি প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের মনে লেগে গিয়ে, তাকে হিট করে’ দিয়েছিল। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/ আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’— গানটির এই আপাতঃসরল কথাগুলো বোধহয় এই দেশে বহু মানুষের মনে একটা স্বাধীনতার বা ছাড়ের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছিল। কিন্তু এই গানে যে কথাটা এত আলোড়ন তুললো, সেটা ততটা লিবার্টি বা স্বতশ্চালনার অধিকারের নয়, অর্থাৎ কিছু করবার / বা কিছুর প্রতি স্বাধীনতার সম্পর্কে (‘ফ্রিডম টু’)নয়, যতটা কোনো কিছু থেকে স্বাধীনতার (ফ্রিডম ফ্রম)ইংরেজিতে এই ‘ফ্রিডম টু’ আর ‘ফ্রিডম ফ্রম’-এর  পার্থক্য নিয়ে অনেক কেতাব আছে সেগুলোয় এক্ষুনি ঢুকছি না। আপাততঃ অনেকের জানা, মার্গারেট অ্যাট্উড-এর The Handmaid’s Tale- উপন্যাসটির কথা বলি, অ্যাট্উডের যে ডিস্টোপিয়াক কাহিনীটিকে সাম্প্রতিককালে পুরস্কারজয়ী একটি মিনি ওয়েব সিরিজ আবার বাঁচিয়ে তুলেছে। সেখানে একটি চরিত্র আন্ট লিডিয়া বলছেন, ‘There is more than one kind of freedom, freedom to and freedom from. In the days of anarchy it was freedom to. Now you are being given freedom from. Don’t underrate it’ ফ্রিডম টু-ই সারা পৃথিবীতে বেশি আদৃত। সে পুরুষের কাছে হোক বা নারীদের কাছে। আমার শরীরের উপরে (তাকে দিয়ে যা খুশি করার ফ্রিডম) থেকে শুরু করে’ আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্টের উপর ফ্রিডম, যে অর্থেই হোক! অ্যাট্উড এই স্বাধীনতাকেই রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, আর তার জন্যে উপন্যাসে এক ভীতিকর অরোয়েলীয় যাজকতন্ত্রকে ‘গিলিয়াড প্রজাতন্ত্র’ নাম দিয়েছিলেন। কখন? না ১৯৮৫ সালে, যখন ধর্মীয় মৌলবাদ পৃথিবীর নতুন তরঙ্গ হিসেবে ধেয়ে আসছে। ইরানে খোমেইনির উত্থান, আমেরিকায় নৈতিক সংখ্যাগুরুর উত্থান, নতুন ভয়ের জন্ম দিচ্ছে। ফ্রিডম টু হিসেবে স্বাধীনতাকে না ভাবলে অমর্ত্য সেনের ‘development as freedom’-এর তত্ত্বকে বোঝাই যাবে না। আর অ্যাট্উডের ডিস্টোপিয়া তো এখন সারা পৃথিবীতে আরো বেশি সত্য হয়ে উঠেছে। আমেরিকা থেকে ভারত সর্বত্রই গিলিয়াড প্রজাতন্ত্রর রমরমা। ফলে ফ্রিডম টু-ই আরো বেশি করে’  দরকার! Erich Fromm তাঁর Escape from Freedom বইতে দুঃখ করেছেন যে আধুনিক পৃথিবীতে ফ্রিডম ফ্রম আর ফ্রিডম টু-র ব্যবধান খুব দ্রত বাড়ছে। সদর্থক অর্থে স্বাধীনতার, ফ্রিডম টু-র, এই কমানুপাত ইউরোপে মানুষকে প্রণোদিত করছে কোনো  বন্ধনহীন ফ্রিডম থেকে পালিয়ে নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হতে, নয়তো ফ্রিডম সম্পর্কেই উদাসীন হয়ে পড়তে।

কিন্তু এই গানটিতে কেবল চাওয়া হচ্ছে একজনের নিজের মতো থাকার অধিকার, ‘ফ্রিডম ফ্রম’, যেহেতু তিনি ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে’ নিয়েছেন। সেই নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়াটা কেমন, সেটা দেখার অধিকারও কারো নেই। কিন্তু এই অধিকারটা চাওয়া হচ্ছে কার থেকে। রাষ্ট্রের থেকে তো বটেই, কিন্তু অন্যান্য সংগঠিত বা অসংগঠিত মানুষদের থেকেও কি নয়? সে দিক থেকে এই স্বাধীনতা পুরোপুরি নজিকীয় অর্থে ‘স্বাধীনতাতান্ত্রিক’ বা libertarian তাঁর বিখ্যাত Anarchy, State and Utopia (1974) বইতে রবার্ট নজিকের বিখ্যাত একটি কথা আছে, “Individuals have rights, and there are things no person or group may do to them (without violating their rightsএর অর্থ ব্যক্তিমানুষের পক্ষে বাইরে থেকে আসা বাধার অভাবটাই একক মৌলিক অধিকার। বাকিগুলো কেবল তার থেকে আসা অনুসিদ্ধান্ত। ব্যক্তি যার কাছে ইচ্ছা, নিজের শ্রম বিক্রি করতে পারবে এবং (আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে) কিনতে পারবে। কারণ আমাদের আত্মর মালিকানা থাকা মানে আমরা নিজেদের শ্রমেরও মালিক। এর মানে এটাও যে কেউ নিজের ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে যে সব জিনিশ বৈধভাবে অর্জন করেছে, তা ইচ্ছে মতো হস্তান্তর করতে পারবে। আর সেটা করতে পারবে তার যেমন ইচ্ছা সেভাবে, যতক্ষণ না কেউ তার ফলে প্রবঞ্চিত বা ব্যাহত হয়। মানুষের উপরে কর চাপানো যাবে না। কারণ নজিকের মতে “Taxation of earnings from labouris on a par with forced labour” করের মাধ্যমে কারুর শ্রমের ফল কেড়ে নেওয়ার অর্থ তার কাজের দিন থেকে কিছু ঘণ্টা কেড়ে নেওয়া। আর সেই সব ঘণ্টা পুষিয়ে দিতে তাকে অন্য কিছু করতে বলা। যদি কেউ তোমাকে কিছু সময়ের জন্য অন্য কোনো কাজ, অথবা অপুরস্কৃত কাজ, করতে বাধ্য করে, তবে তোমাকে কী করতে হবে, আর তার উদ্দেশ্য কী হবে, সেটা তোমার নিজের সিদ্ধান্ত ছাড়া ঠিক হয়ে যাচ্ছে, অন্যের সেবার জন্যতার মানে এই পদ্ধতি যা তোমার থেকে তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে, সেটা তোমাকে নিজের কেবল আংশিক মালিক করে’ দিচ্ছে, তাদেরকে তোমার মধ্যে সম্পত্তির অধিকার দিয়ে দিচ্ছে। “Just as having such partial control and power of decision, by right, over an animal or inanimate object would be to have a property right in it”


এই কারণেই নজিক, এক ‘nightwatchman’ রাষ্ট্রের, এক ‘minimal’ বা ‘ultra- minimal’ রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন যে নাগরিকদের আর তাদের সম্পত্তির সুরক্ষাবিধান ছাড়া কোনো রকমের পিতৃপ্রতিম (paternalistic) আইন পাশ করবে না। যেমন মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট পরতে হবে এরকম কোনো রাষ্ট্রীয় আইনের বিরুদ্ধে নজিকের গভীর আপত্তি, কারণ এতে করে’ অ্যাক্সিডেণ্টের মাধ্যমে সিরিয়াস আঘাত পাওয়ার ব্যাপারে ব্যক্তির অধিকার ও পছন্দের প্রতি ব্যতিচার করা হয়। নজিক ‘legislation of morality-রও খুবই বিরোধী। যেমন ১৯৭৪ সালেই নজিক বলেছিলেন যে সমকামী / সমকামিনীরা বিয়ে করতে এবং গার্হস্থ্য অংশিদারিত্বের জন্যে সম্পত্তির অধিকার প্রয়োগ করতে চায়, রাষ্ট্র আইন করে’ তাদের বাধা দিতে পারবে না। নজিক এও বলেছিলেন যে বৈধভাবে অধিকৃত কোনো জিনিশ কারুকে ঠকিয়ে বা কারুর কষ্টোৎপাদন না করে’ হস্তান্তর  করার উপর যদি কোনো সীমা না থাকে তবে ন্যায্য বিতরণের কোনো ধাঁচবাঁধা তত্ত্ব  চলবে না, কারণ এরকম ধাঁচ চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে কেবল এই ধাঁচ ভাঙতে পারে এমন কিছু কাজের অনুমতি না দিয়ে, যে কাজগুলি আদতে ‘forbid capitalist acts between two adultsকিন্তু মুক্ত বিনিময় সব সময়েই ন্যায্য বিতরণের তথাকথিত ন্যায্য বিতরণগুলিকে ভেঙে দেবে। বিখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় উইল্ট চেম্বারলেনের উদাহরণ দিয়ে নজিক দেখিয়েছিলেন তাঁর মতো কোনো খেলোয়াড় যদি এমন শর্ত করেন যে টুর্নামেন্টে তিনি আছেন এমন যে কোনো খেলায় দর্শকদের সাধারণ টিকিটের উপরও তাঁর জন্যে আলাদা টিকিট করতে হবে, তবে আগেকার প্রকল্পে বাকি খেলোয়াড়দের ভাগ আর দর্শকদের ভাগের পুরনো ন্যায্য বিতরণ, ‘বি-ক’, এর জায়গায় একটি নতুন বিতরণ ‘বি-খ’ আসবে, যেটা উইল্ট চেম্বারলেনকে ধনীতর আর বাকিদের দরিদ্রতর করবে, কিন্তু যাকে অন্যায্য বলা যাবে না।

এই একই যুক্তিতে নজিক মনে করতেন যে কর ব্যাপারটাই আসলে ছিনতাই, কারণ ‘seizing the results of someone’s labor is equivalent to seizing hours from him and directing him to carry on various activities’, মানে লোককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার না বাছা উদ্দেশ্যের জন্যে খাটানো, মানে এক ধরনের ক্রীতদাসত্ব চাপিয়ে দেওয়া ধাঁচবাঁধা মূলনীতি সব সময়েই কিছু লোককে অন্য কিছু লোকের শ্রমে একটা দাবি করতে সাহায্য করে। সেটা মানুষের আত্ম-মালিকানার প্রতিবন্ধক, যেটা স্বাধীনতার মূল কথা স্বাধীনতার মূল অর্থ এখানে অবশ্যই ফ্রিডম ফ্রম। সেটা কতদূর যেতে পারে? সেটাও নজিকের মতেই পাওয়া যাবে! এর জন্যে অবশ্য নজিকের আর একটা উপমার সাহায্য নিতে হবে। সেটা হলো ‘Sunset Yacht Lover’-এর উদাহরণব্যাপারটা এইরকম। মনে করুন কলকাতার বা বাংলার সব্বাই গঙ্গায় সূর্যাস্ত দেখতে ভালোবাসে। অধিকাংশই হেঁটে যায়। কিন্তু কেউ বজরা কিনে মাঝ নদীতে সূর্যাস্ত দেখতে চায়। এটা কেন হবে যে অনেকে গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত দেখবে বিনি পয়সায়। কিন্তু যে বজরা কিনে মাঝ নদীতে সূর্যাস্ত দেখতে চাইবে তাকে ট্যাক্সো দিতে হবে? যে লোকের বস্তুবাদী স্বার্থ আছে তাকে সেই স্বার্থ চরিতার্থ করতে হয় নন্দনতাত্ত্বিক জীবনশৈলী বেছে নেওয়া লোকদের থেকে অনেক বেশি খেটে। যে লোকটি বেশি খেটে বেশি টাকা উপায় করে’ একটা মুভির টিকিট কিনেছে তাকে কেন রাষ্ট্রকে ট্যাক্সো দিতে হবে “money for the needy” যোগানোর জন্যে, যেকালে যারা গাঁ-গঞ্জ বা পাশের প্রদেশ থেকে এসে গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত দেখবে বিনা পয়সায়? নজিকের আক্ষেপ কেন ‘yacht lover’-কে ছ’মাস বেশি খেটে, ট্যাক্সো  দিতে হবে বজরা কিনতে ও বজরা কিনে মাঝ নদীতে সূর্যাস্ত দেখতে, আর তার জন্যে যে গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত দেখতেই রাজি তার ভার বইতে হবে তাকে?

বন্ধু, নজিককে নিয়ে এত কথা বলতে হলো এই কারণেই যে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’-পন্থীরা সব্বাই আসলে জেনে বা না জেনে নজিকীয়। আমি গানের পরের লাইনটা — ‘যেটা ছিলো না ছিলো না সেটা না পাওয়াই থাক/ সব পেলে নষ্ট জীবন’— অগ্রাহ্য করছি কারণ অনুপম রায় অত ভেবে গানটা লেখেননি (কেই বা লেখে?)। কিন্তু এর ফাঁক দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যষ্টির স্থলে সমষ্টি সব ঢুকে যেতে পারে। কারণ ‘যেটা ছিলো না ছিলো না’ সেটা তো কারুর দেওয়া বাধার জন্যেই! ‘Sunset Yacht Lover’-রা এই লাইনটা বুঝতেই পারবেন না। কারণ তাঁদের কাছে গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত দেখার নান্দনিক আয়েসের চেয়ে অনেক বেশি দামি বজরা কিনে মাঝ নদীতে সূর্যাস্ত দেখা। আর মোটামুটি তাদেরই কথা — ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’গঙ্গাতীরে মাগনায় সূর্যাস্ত দেখা পাঁচ পাবলিকের নয়।

কিন্তু এবার অনজিকীয় প্রসঙ্গে আসি! সম্প্রতি কলকাতায় প্রথমে রবিনসন স্ট্রিটে, পরে অন্যত্রও কিছু লোক পরমাত্মীয়দের কঙ্কাল নিয়ে ঘরে বাস করেছেন। খবরের কাগজে তাঁদের জীবনযাপনের খুঁটিনাটি আপনারা কাগজে পড়েছেন, কেউ অবহেলায়, কেউ রসিয়ে রসিয়ে তারপর খবর কাগজেই  এসেছে আর এক বৃদ্ধের ‘স্টোরি’, যিনি তাঁর আধুনিক, সুযোগসুবিধাসম্বলিত শহরের ফ্ল্যাটে রাস্তার নোংরা এনে ভর্তি করতেন। রাজধানীর কাছে, নিহাড়িতে,এক বিগতযৌবন মানুষ আর তাঁর নফর শিশুকিশোরীদের নিয়ে এসে ধর্ষণ আর ভক্ষণ করতেন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ! বেশ কিছু মানুষ খাপ পঞ্চায়েতে, এবং বাইরে ইতস্ততঃ ‘মর্যাদা হত্যা’ করছেন কন্যাদের। এঁদের সকলেরই মনের কথা আমাকে আমার মতো থাকতে দাও / আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি তা, তাঁদের থাকতে দেওয়া যাবে? যদি না দেওয়া যায়, তবে আটকাবে কে? অন্য ব্যক্তিবর্গ? পরিবার? সমাজ? পুরসমাজ? রাষ্ট্র? কারুর তরফে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার ধরণটা বাকিদের পক্ষে ঠিক কিনা তা কে ঠিক করবে? ব্যক্তির অধিকারের সীমা নির্দেশ করবেই বা কে? উপরোক্তদের কে বা কারা?

কেউ এই সীমা নির্দেশ করবে কিনা, করতে পারলে কে বা কারা করবে, সে বিষয়ে যে কোনো তত্ত্বের মূলে থাকবে মানুষ সম্পর্কে অবধারণ। প্লেটো বলেছিলেন মানুষ সামাজিক জীব। সে সমাজ গড়বেই! অ্যারিসটট্‌ল বলেছিলেন মানুষ রাজনৈতিক জীব, কারণ ‘পোলিস’ বা নগররাষ্ট্র তৈরি করা তার ‘স্বভাব’ সেই দিক থেকে রাষ্ট্র স্বাভাবিক (natural) প্রতিষ্ঠান, মানুষের প্রকৃতির সাপেক্ষে। অ্যারিসটট্‌ল বলেন প্রকৃতি মানুষকে দিয়েছে বাক্‌শক্তি, হাসার ক্ষমতা, আর কপালে লিখে দিয়েছে জয়টীকা — রাষ্ট্রগঠনের ক্ষমতারএই দিক থেকে রাষ্ট্রর স্বাভাবিকতা (naturalness) দুটি শব্দ থেকে এসেছে। রোম্যান ‘natura’ বা আদি অবস্থা, আর গ্রিক ‘physis’, যার অর্থ লীন সম্ভাবনা সমূহের বাস্তবায়ন। আদি অবস্থার অর্থে না হলেও লীন সম্ভাবনা সমূহের বাস্তবায়নের অর্থে রাষ্ট্র স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান বটেইএই natura থেকে physis-এর দিকে মানুষের যাত্রাপথে কী  ঢুকে থাকে তার মার্ক্সীয় ধারণার উৎস বোঝাতে দার্শনিক বার্ট্রাণ্ড রাসেল এনেছিলেন ইহুদী ইতিহাস চেতনার কথা, যেখানে দান্তের ডিভাইনা কমেডিয়ার পর্বক্রম গ্রহণ করলে, ‘inferno’, ‘purgatorio’ হয়ে ‘paradiso’-তে পৌঁছবে মানুষ। অবশ্য মার্ক্সের কাছে বিচার্য ছিল না-রাষ্ট্র, ছিল শ্রেণিহীন সমাজকিন্তু  তাঁর গুরু হেগেলের হাতে ইতিহাসের দুই দ্বান্দ্বিক ত্রিপদীচ্ছন্দ, ব্যক্তি-পুরসমাজ-রাষ্ট্র, আর বাদ-প্রতিবাদ-সম্বাদকে অনায়াসে দান্তের কল্পনায় ঢালা ইহুদী ইতিহাস চেতনার ছাঁচে ঢালা যায় অমূর্ত ব্যক্তি অধিকার থেকে পুরসমাজ হয়ে প্রুশীয় বুর্জোয়া রাষ্ট্র সেই পথে এসেছে। হেগেলের মতে রক্তের সম্পর্কের দ্বারা ব্যক্তি অধিকারের নির্ধারণের ভিত্তিতে পরিবারের ভালোবাসার স্বার্থপরতা আর পুরসমাজের সার্বজনিক প্রতিতদ্বন্দ্বিতা দুই সংশ্লেষিত হবে সেই রাষ্ট্রের মধ্যে। এই রাষ্ট্রকেও কী ব্যক্তি বলবে, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’? অন্যান্য রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যে ধরনের ব্যক্তির ধারণা তুলে ধরে তাতেও তো রাজনৈতিক  গণতন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা রাষ্ট্রই, Rechstaat-ই ব্যক্তির স্বার্থের রক্ষক! হব্‌সের মানুষ ভীত মানুষ, যে অসহ্য প্রকৃতির অবস্থা থেকে কমনওয়েলথে প্রবেশ করেছে অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচতে। লকের হিসেবী মানুষ। সে প্রকৃতির অবস্থার অসংখ্য প্রাকৃতিক অধিকারের জায়গায় কমনওয়েলথের কিছু নিশ্চিত পৌর অধিকার বেছে নিয়েছে। রুশোর কেবল সামাজিক নয়, আত্মিকমানুষসে কমনওয়েলথের মধ্যে মহত্তর গোষ্ঠীজীবন খুঁজেছে। জেরেমি বেন্থাম জানতেন যে মানুষ এক গুচ্ছ ক্ষুধা ও কামনার নাম। সে স্বার্থপরও বটে! তার স্বার্থ সে নিজে না দেখতে পারলে সেগুলি উপেক্ষিত হবে। যাতে নিজে না পারলেও প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজের স্বার্থগুলির সুরক্ষা বিধান করতে পারবে, এই ভাবনা থেকেই তো বেন্থাম ধাপে ধাপে ভোটদান যোগ্যতার সীমা বাড়ালেন! আবার জন স্টুয়ার্ট মিল মানুষকে ক্ষুধাগুচ্ছ হিসেবে না দেখে উদ্দীপনার সমাহার হিসেবে দেখলেন। রাষ্ট্রকে দিয়ে এই উদ্দীপনার চরিতার্থতার ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে বলেই উন্নয়ক গণতন্ত্র চাই! প্লেটো থেকে মিল কেউ কিন্তু ‘ফ্রিডম ফ্রম’ থেকে ‘ফ্রিডম টু’, কোনোটাতেই রাষ্ট্রকে বাদ রাখলেন না।

যাঁরা রাষ্ট্রকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাননি, তাঁরাও কিন্তু ব্যক্তির ফ্রিডম ফ্রমথেকে ফ্রিডম টুদুটোর জন্যই সমাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এমনকি যখন সেই সমাজ বার্নার্ড ম্যান্ডেভিল, ডেভিড হিউম, অ্যাডাম স্মিথ, অ্যাডাম ফার্গুসন ইত্যাদি অষ্টাদশ শতাব্দীর কিছু লেখকের মতে ব্যক্তির স্বার্থপর কাজের অচিন্তিত, অ-অভিপ্রেত কাজের ফল। স্কটিশ আলোকোদ্ভাসের এক পুরোধা পুরুষ অ্যাডাম স্মিথ মানুষকে দেখতেন ‘bartering man’, বা বিনিময়কারী, স্বার্থপরায়ণ মানুষ হিসেবে। স্মিথ সেই সব মানুষের প্রতিযোগিতামূলক বেচাকেনার ভিত্তিতে গড়া  সময়কার বাজারকে অপ্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রের চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। কিন্তু সেই মানুষের স্বার্থচিন্তাকেও যে ‘অদৃশ্য হাত’ চালনা করে, তার নির্দেশক হলো ব্যক্তির মধ্যেকার ‘অপক্ষপাতী পর্যবেক্ষক’, যেটি আদতে ব্যক্তির সামাজিকীকৃত বিবেক
ধরে’ নিই এই রাষ্ট্র বা সমাজের বাইরে ব্যক্তি নিজেই ঠিক করে’ নেবে তার কোন্ পরিসরের ক্ষেত্রে সে বলবে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও / আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’কিন্তু এই ব্যক্তি কে? সে কিসের ভিত্তিতে ঠিক করবে তার গুছিয়ে নেওয়ার ইঁটকাঠসুরকি কী হবে? উদারনীতিবিদ্ জন রল্‌স তাঁর ATheory of Justice বইতে বলেছিলেন এটা ঠিক করবেন একদল দায়হীন সত্তা, এক কল্পিত আদি অবস্থায় (original position), যেখানে তারা নিজেদের সমাজের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, বিকাশগত অবস্থা, নিজেদের সামাজিক মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, শ্রেণি, বিশেষাধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুই না জেনে, একটা অজ্ঞতার পর্দার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকারের ও স্বাধীনতার বিষয় ঠিক করে। কিন্তু মাইকেল স্যাণ্ডেল (Liberalism and the Limits of Justice), মাইকেল ওয়ালজার (Spheres of Justice: A Defense of Pluralism and Equality) ইত্যাদি লোকসমাজবাদী বা কৌমবাদীরা দেখিয়েছিলেন এরকম ভাবে ব্যক্তিমানুষের অধিকার, স্বাধীনতার পরিধি ইত্যাদি ঠিক করা যায় না। দায়হীন, অভারবদ্ধ সত্তা হয় না। ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রকৃতি ও পরিসর ঠিক করে দেয় তার লোকসমাজ। তার বাইরে, যে অধিকারের / স্বাধীনতার চিন্তার ভিত্তিতে ব্যক্তি বলবে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ তার উৎস হবে কি অন্তর্দেশীয় আদি অবস্থার মতো বিতরণমূলক ন্যায্যতার কোনো বৈশ্বিক মূলনীতি, অর্থাৎ রল্‌সীয় ‘international original position’? লোকসমাজবাদীরা সেটাকে মানতে রাজি নন বলেই ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রকৃতি ও পরিসরটাকে ঠিক করে’ দেওয়ার অধিকার লোকসমাজকে হয়েছেন।

তার মানে কি সমাজ বা রাষ্ট্রের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যাবে ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রকৃতি ও পরিসর ছেড়ে দেওয়ার অধিকার? সেও তো সম্ভব নয়! সমাজ বা রাষ্ট্রের যে ‘প্যানোপ্টিসিজ্‌ম’ বা সর্বদর্শনের বিপদ সমন্ধে মিশেল ফুকো তাঁর Discipline and Publish বইতে আমাদের সতর্ক করে’ দিয়েছিলেন, তার কথা তো ভাবতে হবে? তাহলে উপায় কী? আমাকে আমার মতো থাকতে দাওব্যক্তির এই দাবিও মেনে নেওয়া যাবে না। তাতে ‘ফ্রিডম টু’র ক্ষতি হবে। আবার তুমি কেমন করে থাকবে, আমাদের ঠিক করতে দাও, রাষ্ট্র ও সমাজের এই দাবিও মেনে নেওয়া যাবে না। তাতে ‘ফ্রিডম ফ্রম’ বিপন্ন হবে। অথচ ফ্রিডম ফ্রম’ ‘ফ্রিডম টু’-র সোপান তো বটেই! একটা উপায় ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল দুর্খেম থেকে পাওয়া যায়। সমসময়ের ফ্রান্সে যে বিশ্লিষ্টকারী  ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সামাজিক সংহতির সমূহ ক্ষতি করছিল, এবং মানুষের মনে ‘অহংপ্রণোদিত’ (egotistic) এবং ‘নীতিমানহীনতা প্রণোদিত’ (anomic) আত্মহত্যার ইচ্ছার যে বীজ বুনছিল, তাকে আটকাতে দুর্খেম তাঁর Le Suicide বইতে মানুষের বিভিন্ন ‘occupational associations’-কে জোরদার করতে বলেছিলেন, যাদের কথা তিনি প্রথম বলেন Division of Labour in Society বইতে কিন্তু দুর্খেমের সতর্কবাণী ছিল তারা যেন মধ্যযুগের পেশাগত সমিতিগুলির মত রাষ্ট্রকে আড়াল না করে’ ফেলে। কারণ সাধারণ মানুষ আজ যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করছে তাতে ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে আসা রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণের বড় ভূমিকা ছিল। দুর্খেমের পেশাগত সমিতিগুলির দোসর আজকের পুরসমাজ। ফলে আজকে ব্যক্তির অধিকার, ‘ফ্রিডম ফ্রম’, আর  স্বতশ্চালনা বা ‘ফ্রিডম টু’ কতখানি থাকবে তা ঠিক করতে ব্যক্তি একা পারবে না, আর রাষ্ট্র বা সমাজও নয়! রাষ্ট্র আর পুরসমাজের লড়াইয়ের ও বিততির ফলে যে স্থান তৈরি হবে তাতেই সুরক্ষিত থাকবে ব্যক্তির স্পেস! অ্যালেক্সিস টকভিল থেকে শুরু করে’, দুর্খেম, ট্যালকট প্যাসন্‌স হয়ে, রবার্ট পাটন্যাম পর্যন্ত সেটাকেই উপায় হিসেবে ঠাওরানো হয়েছে। রবার্ট পাটন্যাম আমেরিকায় মানুষের যে বিশ্লিষ্টকারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যআর সামাজিক সংহতির বিপদ দেখেছিলেন, যার প্রতিফলন দেখেছিলেন একলা বোলিং-এর মধ্যে, তাঁর ‘Bowling Alone: America's Declining Social Capital’ নামের বিখ্যাত প্রবন্ধে, তার কথা মনে রেখেই ভাবতে হবে অনুপমের গানের প্রথম দুই লাইনের আর্তিতে সাড়া দেওয়া যাবে কিনা!

বিকাশ মুখোপাধ্যায়




ইতিহাসের জেরোনিমো




বিশ্বের যে গোলার্ধে আমাদের বসবাস, সেখানে ‘জেরোনিমো’ শব্দ বা নামটির সঙ্গে এই সেদিনও বহু কম মানুষই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালের ৪ঠা মে টেলিভিশনের দৌলতে সমগ্র বিশ্বের মানুষই নামটির সঙ্গে পরিচিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর বিভাগ ও পেন্টাগন কুখ্যাত আতঙ্কবাদী ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার যে পরিকল্পনা নেয়, তার গুপ্তনাম রাখা হয় ‘অপারেশন জেরোনিমো’। যাইহোক সেদিন বিশ্বের আপামর জনগণ দেখেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি স-পার্ষদ টেলিভিশনের পর্দায় অপারেশন জেরোনিমো দেখায় মগ্ন এবং সকলের মুখমন্ডলে এক পরিতৃপ্তির হাসি। সেই পরিতৃপ্তির কারণ কিন্তু এক নিষ্ঠুর আতঙ্কবাদীকে শাস্তি দেওয়ার চাইতেও বেশি তাদের অহংকারে আঘাত হানা ব্যক্তিটির প্রতি প্রতিশোধ নেওয়া। যে দেশের মাটিতে এই অপারেশন হয় সেই দেশের সরকার বা জনগণকে এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হলেও মার্কিন সৈন্যদের লাদেন বধে কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে বিরোধ বাঁধে ‘জেরোনিমো’ নামটি ঘিরে।

জেরোনিমো হলেন দক্ষিণ আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানস জনজাতির অন্তর্গত এক গোষ্ঠীর নেতা, যাঁকে সেখানকার মানুষ ভগবানের আসনে বসিয়েছেন। তাঁর নামের সঙ্গে এই অপারেশনের নাম জুড়ে দেবার বিষয়টিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। বাস্তবে জেরোনিমো বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ক্রূরতার বিরুদ্ধে উপনিবেশিক দেশের জনগণের বিদ্রোহের নাম বা প্রেরণা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেরোনিমো নামটি যে পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করেছিল, সে বিষয়ে বিশদ জানার আগে আমরা আমাদের দেশের মহান বিপ্লবী নেতা ভগবান বিরসা মুন্ডার জীবন ও সংগ্রামের কথা আলোচনা করতে চাই এবং তবেই হয়তো আমরা সাম্রাজ্যবাদী ক্রূরতার প্রকৃত স্বরূপ ও জেরোনিমো ও তাঁর অনুগামীদের প্রতি যে বর্বরোচিত প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল তা বুঝতে সুবিধা হবে। বস্তুত ভারত যদি ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ না হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ হতো, তবে অবশ্যই তারা ভগবান বিরসা মুন্ডাকেও জেরোনিমো আখ্যা দিত।


ভগবান বিরসা মুন্ডা




অধুনা ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাঁচি জেলার ‘উলিহাতু’ গ্রামে ১৮৭৫ সালের ১৫ই  নভেম্বর এক আদিবাসী তথা মুন্ডা সম্প্রদায়ের দম্পতির কোল আলো করে যে অগ্নি বালকের জন্ম, তিনিই বিরসা মুন্ডা। জন্ম মুহূর্তেই তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন জানান দিয়েছিল ‘উলগুলান’ বা বিদ্রোহের। নিজ সম্প্রদায়কে নানা কু-প্রভাব থেকে মুক্তির পথ দেখাতে গিয়ে তারুণ্যে ভরপুর এই যুবক পরবর্তীকালে দেশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থাবা থেকে মুক্ত করার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সের সংক্ষিপ্ত জীবদ্দশায় তিনি যে ধরনের দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, অদম্য সাহস তথা দেশভক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে আদিবাসী সম্প্রদায় তাঁকে ‘ধরতি আবা’ অর্থাৎ বিশ্বপিতার সম্মানে ভূষিত করে।

বিপ্লবী বিরসা মুন্ডার পিতা, সুগান মুন্ডা ছিলেন এক অতি দরিদ্র ক্ষেতমজুর। বাঁশের চাটাইয়ের দেওয়াল ও পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি ঘরে তিনি তাঁর পরিবার ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে বসবাস করতেন। পরবর্তীকালে চরম দারিদ্র্যতার কারণে তিনি সপরিবারে ঠাকুরমার বাপের বাড়ি ‘চলকত’ গ্রামে সরদার বীরসিংহ মুন্ডার শরণাপন্ন হন। সে সময় খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ছোটনাগপুরের আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে, আদিবাসীদের সভ্য করে তোলার অছিলায় ধর্মান্তরিত করার কাজে ব্রতী। সুগানা মুন্ডার পরিবারও সে সময় খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়। চলকত গ্রামের ধুলো-কাদায় বেড়ে ওঠা বিরসা মুন্ডার তাঁর নিজের সংস্কৃতি অর্থাৎ নৃত্য ও লোকগীতির প্রতি ছিল নিখাদ ভালোবাসা। কম বয়সে বিরসা মুন্ডাকে গবাদি পশু চরানোর কাজে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হতো এবং তা থেকেই ধীরে ধীরে তিনি প্রকৃতির অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠেন। বাঁশী বাজানোর দক্ষতাও তিনি রপ্ত করেছিলেন, যা তাঁকে অন্য শিশুদের থেকে আলাদা করে তোলে। তাঁর কথা, তাঁর বাঁশীর মন মাতাল করা সুর লোকেরা শুনে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত।

দারিদ্র্যতার কশাঘাত এক সময় এই মুন্ডা পরিবারকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। অগত্যা বাধ্য হয়েই সুগান মুন্ডা তাঁর ছেলেপিলেদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেন। বিরসা মুন্ডাকেও চলে যেতে হয় তাঁর মামার বাড়ি ‘আয়ুহাতু’তে।  সেখানে বছর দুয়েক থাকাকালীন তিনি ‘সালগা’ গ্রামের এক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পান। এরপর বিরসার এক মাসী, যিনি বিরসাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন, তিনি তাঁর বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ি ‘খতংগা’ গ্রামে যাবার সময়ে বিরসাকেও নিয়ে যান সঙ্গে করে।
খতংগায় খ্রিষ্টানধর্ম প্রচারকরা ইতিমধ্যেই সেখানকার বেশিরভাগ পরিবারকেই খ্রিষ্টিয় ধর্মে দীক্ষিত করেছিল। এবং এই ধর্মান্তকরণ পুরনো মুন্ডারী সমাজ ব্যবস্থাকে সমূলে আঘাত করে। খতংগাতে অবশ্য বিরসা মুন্ডা খুব বেশিদিন থাকেননি। ‘কুন্ডি’, ‘বারতোলী’ হয়ে জার্মান মিশনারীদের সঙ্গে তিনি ‘বুরুজু’ যান এবং সেখানেই তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত বিরসা মুন্ডার ঠিকানা ছিল ‘চাইবাসা’। চাইবাসায় থাকাকালীন তাঁর জীবনধারায় এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে তিনি নিজের ধর্মের মাহাত্ম্য উপলব্ধি  করেন। চাইবাসার অনতিদূরে সরদার সম্প্রদায়ের আধিক্য থাকায় এক শ্বেতকায়  মিশনারি পাদরি আদিবাসীদের সামনে ধার্মিক ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে – “আদিবাসী সম্প্রদায় তখনই তাদের হৃতগৌরব তথা হারানো প্রতিপত্তি ফিরে পাবে যখন তারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবে”। প্রথমে অনেকের মতোই বিরসা মুন্ডা এ কথায় প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই খ্রিষ্টধর্ম প্রচারকদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হন এবং তার তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। ফলস্বরূপ তাঁকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা তাঁকে আদিবাসী সরদার সম্প্রদায়ের মিশনারি তথা সরকার বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেছিল।

১৮৯০ সালে ‘বন্ধগাঁও’ থাকাকালীন বিরসা মুন্ডা বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারকদের সংস্পর্শে আসেন। এমন কী এই ধর্মের রীতিনীতি পালন করতেও শুরু করেন। কিন্তু ধর্মের বেড়াজালে ধরা দিয়ে নিজের জীবন সংকল্প থেকে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার মতো সাধারণ মানুষ তো তিনি নন, তাই কিছুদিন পরেই মোহভঙ্গ হলে আবার তিনি আদিবাসী সরদার সম্প্রদায়ের আন্দোলনে যোগ দেন। জল জঙ্গল জমির উপর আদিবাসীদের সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা জমিদার ও মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।




এক সময় আইন করে জঙ্গল ও জ্বালানী কাঠ, পশুখাদ্য, গাছের পাতা প্রভৃতি সংগ্রহের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার, যা কার্যত আদিবাসী জীবন শৈলীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই নিষেধাজ্ঞা তাদের উপর এক বিশাল আঘাত হানে। আদিবাসীদের দখলে যে বিরাট ভূখন্ড ছিল, বস্তুত তাতে তারা শুধুমাত্র নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদেই চাষাবাদ করত, এ কারণে  সরকারের তহবিলে ‘ট্যাক্স’ বা করও জমা পড়ত অল্প এবং এই ঘাটতি মেটাতে ব্রিটিশ সরকার জমিদার বা যারা আদিবাসী নয় এমন লোকদের এইসব অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা করে। নানা অজুহাতে জমি তুলে দেওয়া হয় ঠিকাদার ও মহাজনদের হাতে। এর ফলে সর্বহারা আদিবাসী সম্প্রদায় বাধ্য হয়েই নিজ  ভূমে পরবাসী হয়ে অগত্যা পেটের জ্বালায় ক্ষেতমজুরি করতে শুরু করে। বলাই বাহুল্য, মহাজন সম্প্রদায় আদিবাসীদের যার পর নেই শোষণ শুরু করে। চাবুক মেরে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া তো ছিলই, সেইসঙ্গে আদিবাসী রমণীদের উপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চলত। এমন কী কথার খেলাপ করলে প্রাণে মেরে ফেলা হতো; আর এসবই চলত ব্রিটিশ সরকারের ছত্রছায়ায়।

(ক্রমশ)


শিবাংশু দে




হরীতকী ফলের মতন - ১ 




(১)

...সংগোপন লিপ্সাময়ী, কম্পিত প্রেমিকা - তোমার কবিতা, কাব্য;

সেটা ছিলো অঘ্রাণের শেষ বেলা। সাকিন জামশেদপুর বইমেলার ধূসর আঙিনা।  তখনও বাঁধানো হাট, ঘাসের কালিন পাতা অভিরাম ঠিকানায় যায়নি আমাদের বছরকার বইয়ের সঙ্গে রোমাঞ্চিত সাতদিন।

যেসব বন্ধুদের সঙ্গে সময়হীন আড্ডা দেবার ইচ্ছে হয়, তারা তো সারা বছর এভাবে এক জায়গায় পঞ্চায়তের বটতলা পাততে পারে না এই কাজের শহরে। প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গ-প্রসঙ্গান্তর কথার মেঘে ভিজে সাতটি সন্ধেবেলা। প্রসঙ্গ তো নয়, সঙ্গই সেখানে মুখ্য লিপ্সা। আমার এক বন্ধু, মুষ্টিমেয় একজন, যার সঙ্গে মুখোস না পরে পদ্য নিয়ে আলোচনা করা যায়, তাকে বলি বিনয় মজুমদার শেষ কবে পড়েছো? আসলে 'ফিরে এসো চাকা' অনেকদিন ছাপা ছিলো না। হঠাৎ 'শতাব্দীর সেরা ভূতের গল্প', 'বিখ্যাত' শিল্পীদের আঁকা ছবিসহ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আরব্য উপন্যাস জাতীয় বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে থেকে রোগা, ম্লান, হলুদ পাতার বইটি মুখ দেখালো, অরুণা প্রকাশন থেকে  ১৯৮৩ সালের সংস্করণদাম চারটাকা। নামপাতাটি ওল্টালেই সেই  বিখ্যাত নিবেদন, 'উৎসর্গ, গায়ত্রী চক্রবর্তী'তৎক্ষণাৎ 'উৎসর্গ, পর্ণা' লিখে তাকে খুঁজে বেড়ানো ভিড়ের মধ্যে। এই সময়ই সেই বন্ধু, কী নিলে?
'ফিরে এসো'
সে কী? এতোদিন পরে?
আরে না না , একজনকে দিতে হবে।
তখনই তাকে জিগাই, শেষ কবে পড়েছো, বিনয় মজুমদার?
এভাবে গড়িয়ে যায় তার সঙ্গে কবিতার আলাপ। কতশত ঘাসজমি, লেগুন, মোহানা পেরিয়ে কবিতার স্রোত বয়ে যায় শব্দের ছলে। সময়ও যায়...

হঠাৎ দেখি অসিতদা এসে হন্তদন্ত, আরে শিবাজি চলো চলো-
বলি, কোথায়?
ঐ স্টেজে দেখছো না, গান গাইতে হবে...
বিপন্ন হয়ে এদিকওদিক....  দেখি পকেটে হাত দিয়ে সুদীপ দাঁড়িয়ে আছে। এইতো পাওয়া গেছে।
য়্যাই সুদীপ শোন শোন-
কী হলো? এগিয়ে আসে সে...
অসিতদা, সুদীপ খুব ভালো গায়। আজ ওকে দিয়ে গাওয়ান, আমি কাল আছি...
সুদীপ হতভম্ব, মানে?
যা না বে, আর নখড়া করিস না...
অসিতদা গ্রেফ্তার করে নিয়ে যান সুদীপকে, আমি বাঁচি তখনকার মতো। একটা স্টেজ বাঁধা হয় সেখানে। সবাই নিজের মতো করে বাংলা গান, পদ্য, কথা বলে মাইকের সামনে। পা ব্যথা হলে অনেকে জমিয়ে শোনে, মাঝে মাঝে আবার উঠে বইয়ের স্টলে ঢুকে যায়।

আজ এসেছে কি? কোথায় গেলো তাহলে?
মাঝে মাঝে কবিতা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ে সে। 
একবার প্রশ্ন করেছিলো, কবিতা বোঝার কোনও সরল নিয়ম আছে কি? নাকি  যে কোনও রকম নিজস্ব নিয়মে তাকে বুঝে নিতে হয়?
আমি বলেছিলুম, কবিতা তো বোঝার জন্য নয়, ছোঁয়ার জন্য। বোঝার জন্য বানানো 'বোঝা' মানুষ অনেক জড়ো করেছে। ঐ ভার থেকে মুক্তি পাবার জন্যই তো কবিতা। কোনও বুঝদার লোককে কখনো কবিতা পড়তে দেখেছো? হ্যাঁ, অনেক বাংলার অধ্যাপক পাবে, পার্ট টাইম নানা ব্যবসার ফাঁকে সুকুমারমতি বালক বালিকাদের কবিতার ব্যাখ্যা লিখিয়ে দেনপরীক্ষায় আসবে এই প্যারাটা, গ্যারান্টি...
এই সব দেখেই তো সেই বরিশালের বাঙাল অধ্যাপকটি পদ্যের মাংসকৃমি খোঁটা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়েন, ঝরে যান...
'সংশয়ে, সন্দেহে দুলে দুলে তুমি নিজে ঝরে গেছ, হরিতকী ফলের মতন।'
বরিশালে তো আমার মামার বাড়ি। তুমি কোন অধ্যাপকের কথা বলছো?
সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, আমার প্রিয়তম সেই কবিতাটি শোনাবার সুযোগ কি ছেড়ে দেওয়া যায়? 

৩রা মার্চ, ১৯৬২

ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় চিল শুধু বলেছিল, 'এই জন্মদিন'
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল বলে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান।
সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতন
ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল।'...

কবিতাটি আমি বলি, সে শোনে, কয়েক মুহূর্ত হরিতকী ফলের মতন ঝরে যায়। মনে হয় শুনি সুদূর থেকে সে বলে,  

কার লেখা?
আগে বলো, তুমি কি শুধু 'বুঝতে' পেরেছো না শব্দগুলো কোথাও ছুঁয়েছে তোমাকে?
স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে, ছুঁয়েছে, ছুঁয়েছে...
এই কবিতাটা বিনয় মজুমদারের, ওনার বিখ্যাত সংকলন 'ফিরে এসো চাকা'তে রয়েছে।
তুমি বইটা আমাকে এনে দেবে?
নিশ্চয় দেবো, যদি খুঁজে পাই...

(২)

...তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি’

কয়েকদিন তেনার খোঁজ খবর নেই। ফোনের নাগালের বাইরে থাকেন তিনি। একটা জায়গায় পাওয়া যাবে নিশ্চিত। বুধবারে একবার ট্রাই নেওয়া যাবে। পর্ণা প্রতি বুধবার বিকেলদিকে একবার ডি এম লাইব্রেরিতে নিশ্চয় আসে, রবীন্দ্রভবন থেকে গান শিখে ফেরার পথে। স্ট্রেট মাইল রোডে লাইব্রেরির উল্টোদিকে ডাক্তার চ্যাটার্জির বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে অফিস পালিয়ে অপেক্ষা করি। তিনি এলেন শেষ পর্যন্ত। দেখতে পাননি আমাকে। একটু অন্যমনস্ক, অহংকারী পা ফেলা, নীলকালো কামিজ, কাঁধের ব্যাগে গানের খাতা। বাইরেই অপেক্ষা করি। বেরিয়ে এসে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে থাকে। নিঃশব্দে পাশে পাশে হাঁটি। দেখেছে, কিন্তু তাকাচ্ছে না। কী হলো আবার? মনে হয় কিঞ্চিৎ গুরুতর ব্যাপার!

কী ব্যাপার, সব নিমন বা নু?
হ্যাঁ, দেখছই তো, ভালো আছি...
পর তনি গড়বড় লাগত...
না কোনও গড়বড় নেই...
চলো পার্কে একটু বসি
নাহ, তাড়া আছে, আজ এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে
তা ফিরবে, আমি পৌঁছে দেবো। এখানে এক মিনিট দাঁড়াও, আমি বাইকটা নিয়ে আসি...
বলছি না, আজ বসবো না কোথাও!
তুমি বসবে, আজ, এখুনি, আর কোনও কথা হবে না

থমকে দাঁড়ায়, এতক্ষণ পরে মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে-
কীসের জোর এতো তোমার? কীসের?
সেটা বলবার জন্যই তোমাকে যেতে বলছি...
কিছু বলে না, কিন্তু দাঁড়িয়ে যায়

একটু পরে জুবিলি পার্কের টাটাবাবার মূর্তির নামোদিকে দেবদারুর সারি দিয়ে ঘেরা ঘাসজাজিমে দুজনে মুখোমুখি বসে থাকি অন্তঃস্বত্ব মৌনতায়।
বলি, কিছু বলবে?
হুঁ, গত বিষ্যুদবার তোমাকে বিষ্টুপুরে মেঘানির সামনে দেখলাম, কারুর সঙ্গে কথা বলছিলে...
এতক্ষণে স্পষ্ট হয় রহস্য। হা হা করে হেসে উঠি। তুমি কোথা থেকে দেখলে আমাকে?
আমি আর পরমা হিন্দুস্তান বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম
আমায় ডাকলে না কেন?
তোমাকে ডা-ক-বো? অত ব্যস্ত ছিলে তুমি, হেসে হেসে... মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর... ও-ই কি মধুরিমা?
ঠিক বলেছো
তবে আর কী, আজ উঠি...
আরে বসো, বসো... একটা ছোট্টো কবিতা শুনিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি
কার কবিতা?
সেটাই তো তুমি বলবে...
বেশ...




‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝরে যায়-
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়েনা; তবে ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
শাশ্বত, সহজতম এই দান-শুধু অঙ্কুরের
উদ্গমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না করে শ্যামল হতে দেওয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূড়া থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাওনা, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চলে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।

কিছুক্ষণ চুপ করে বলে, এটা তো আমার কবিতা; তুমি বলছো কেন?
তাই তো, আমি ভাবলাম এটা আমার কথা তোমাকে শোনাই...
এবার হেসে ওঠে নির্ঝরের মতো শব্দ করে, অনেকক্ষণ...
মনে হচ্ছে শব্দগুলি স্পর্শ করেছে তোমায়!
করেছে, খুব করেছে, জীবনানন্দের মতো, কিন্তু জীবনানন্দ নয়...
ঠিক বলেছো, রক্তাপ্লুত ট্রাম মনে পড়ে?
হ্যাঁ, বিনয় মজুমদার...
ফুল মার্ক্স পেলে।

(ক্রমশ)