কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিকাশ মুখোপাধ্যায়




ইতিহাসের জেরোনিমো




বিশ্বের যে গোলার্ধে আমাদের বসবাস, সেখানে ‘জেরোনিমো’ শব্দ বা নামটির সঙ্গে এই সেদিনও বহু কম মানুষই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালের ৪ঠা মে টেলিভিশনের দৌলতে সমগ্র বিশ্বের মানুষই নামটির সঙ্গে পরিচিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর বিভাগ ও পেন্টাগন কুখ্যাত আতঙ্কবাদী ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার যে পরিকল্পনা নেয়, তার গুপ্তনাম রাখা হয় ‘অপারেশন জেরোনিমো’। যাইহোক সেদিন বিশ্বের আপামর জনগণ দেখেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি স-পার্ষদ টেলিভিশনের পর্দায় অপারেশন জেরোনিমো দেখায় মগ্ন এবং সকলের মুখমন্ডলে এক পরিতৃপ্তির হাসি। সেই পরিতৃপ্তির কারণ কিন্তু এক নিষ্ঠুর আতঙ্কবাদীকে শাস্তি দেওয়ার চাইতেও বেশি তাদের অহংকারে আঘাত হানা ব্যক্তিটির প্রতি প্রতিশোধ নেওয়া। যে দেশের মাটিতে এই অপারেশন হয় সেই দেশের সরকার বা জনগণকে এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হলেও মার্কিন সৈন্যদের লাদেন বধে কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে বিরোধ বাঁধে ‘জেরোনিমো’ নামটি ঘিরে।

জেরোনিমো হলেন দক্ষিণ আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানস জনজাতির অন্তর্গত এক গোষ্ঠীর নেতা, যাঁকে সেখানকার মানুষ ভগবানের আসনে বসিয়েছেন। তাঁর নামের সঙ্গে এই অপারেশনের নাম জুড়ে দেবার বিষয়টিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। বাস্তবে জেরোনিমো বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ক্রূরতার বিরুদ্ধে উপনিবেশিক দেশের জনগণের বিদ্রোহের নাম বা প্রেরণা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেরোনিমো নামটি যে পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করেছিল, সে বিষয়ে বিশদ জানার আগে আমরা আমাদের দেশের মহান বিপ্লবী নেতা ভগবান বিরসা মুন্ডার জীবন ও সংগ্রামের কথা আলোচনা করতে চাই এবং তবেই হয়তো আমরা সাম্রাজ্যবাদী ক্রূরতার প্রকৃত স্বরূপ ও জেরোনিমো ও তাঁর অনুগামীদের প্রতি যে বর্বরোচিত প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল তা বুঝতে সুবিধা হবে। বস্তুত ভারত যদি ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ না হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ হতো, তবে অবশ্যই তারা ভগবান বিরসা মুন্ডাকেও জেরোনিমো আখ্যা দিত।


ভগবান বিরসা মুন্ডা




অধুনা ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাঁচি জেলার ‘উলিহাতু’ গ্রামে ১৮৭৫ সালের ১৫ই  নভেম্বর এক আদিবাসী তথা মুন্ডা সম্প্রদায়ের দম্পতির কোল আলো করে যে অগ্নি বালকের জন্ম, তিনিই বিরসা মুন্ডা। জন্ম মুহূর্তেই তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন জানান দিয়েছিল ‘উলগুলান’ বা বিদ্রোহের। নিজ সম্প্রদায়কে নানা কু-প্রভাব থেকে মুক্তির পথ দেখাতে গিয়ে তারুণ্যে ভরপুর এই যুবক পরবর্তীকালে দেশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থাবা থেকে মুক্ত করার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সের সংক্ষিপ্ত জীবদ্দশায় তিনি যে ধরনের দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, অদম্য সাহস তথা দেশভক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে আদিবাসী সম্প্রদায় তাঁকে ‘ধরতি আবা’ অর্থাৎ বিশ্বপিতার সম্মানে ভূষিত করে।

বিপ্লবী বিরসা মুন্ডার পিতা, সুগান মুন্ডা ছিলেন এক অতি দরিদ্র ক্ষেতমজুর। বাঁশের চাটাইয়ের দেওয়াল ও পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি ঘরে তিনি তাঁর পরিবার ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে বসবাস করতেন। পরবর্তীকালে চরম দারিদ্র্যতার কারণে তিনি সপরিবারে ঠাকুরমার বাপের বাড়ি ‘চলকত’ গ্রামে সরদার বীরসিংহ মুন্ডার শরণাপন্ন হন। সে সময় খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ছোটনাগপুরের আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে, আদিবাসীদের সভ্য করে তোলার অছিলায় ধর্মান্তরিত করার কাজে ব্রতী। সুগানা মুন্ডার পরিবারও সে সময় খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়। চলকত গ্রামের ধুলো-কাদায় বেড়ে ওঠা বিরসা মুন্ডার তাঁর নিজের সংস্কৃতি অর্থাৎ নৃত্য ও লোকগীতির প্রতি ছিল নিখাদ ভালোবাসা। কম বয়সে বিরসা মুন্ডাকে গবাদি পশু চরানোর কাজে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হতো এবং তা থেকেই ধীরে ধীরে তিনি প্রকৃতির অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠেন। বাঁশী বাজানোর দক্ষতাও তিনি রপ্ত করেছিলেন, যা তাঁকে অন্য শিশুদের থেকে আলাদা করে তোলে। তাঁর কথা, তাঁর বাঁশীর মন মাতাল করা সুর লোকেরা শুনে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত।

দারিদ্র্যতার কশাঘাত এক সময় এই মুন্ডা পরিবারকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। অগত্যা বাধ্য হয়েই সুগান মুন্ডা তাঁর ছেলেপিলেদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেন। বিরসা মুন্ডাকেও চলে যেতে হয় তাঁর মামার বাড়ি ‘আয়ুহাতু’তে।  সেখানে বছর দুয়েক থাকাকালীন তিনি ‘সালগা’ গ্রামের এক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পান। এরপর বিরসার এক মাসী, যিনি বিরসাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন, তিনি তাঁর বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ি ‘খতংগা’ গ্রামে যাবার সময়ে বিরসাকেও নিয়ে যান সঙ্গে করে।
খতংগায় খ্রিষ্টানধর্ম প্রচারকরা ইতিমধ্যেই সেখানকার বেশিরভাগ পরিবারকেই খ্রিষ্টিয় ধর্মে দীক্ষিত করেছিল। এবং এই ধর্মান্তকরণ পুরনো মুন্ডারী সমাজ ব্যবস্থাকে সমূলে আঘাত করে। খতংগাতে অবশ্য বিরসা মুন্ডা খুব বেশিদিন থাকেননি। ‘কুন্ডি’, ‘বারতোলী’ হয়ে জার্মান মিশনারীদের সঙ্গে তিনি ‘বুরুজু’ যান এবং সেখানেই তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত বিরসা মুন্ডার ঠিকানা ছিল ‘চাইবাসা’। চাইবাসায় থাকাকালীন তাঁর জীবনধারায় এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে তিনি নিজের ধর্মের মাহাত্ম্য উপলব্ধি  করেন। চাইবাসার অনতিদূরে সরদার সম্প্রদায়ের আধিক্য থাকায় এক শ্বেতকায়  মিশনারি পাদরি আদিবাসীদের সামনে ধার্মিক ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে – “আদিবাসী সম্প্রদায় তখনই তাদের হৃতগৌরব তথা হারানো প্রতিপত্তি ফিরে পাবে যখন তারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবে”। প্রথমে অনেকের মতোই বিরসা মুন্ডা এ কথায় প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই খ্রিষ্টধর্ম প্রচারকদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হন এবং তার তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। ফলস্বরূপ তাঁকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা তাঁকে আদিবাসী সরদার সম্প্রদায়ের মিশনারি তথা সরকার বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেছিল।

১৮৯০ সালে ‘বন্ধগাঁও’ থাকাকালীন বিরসা মুন্ডা বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারকদের সংস্পর্শে আসেন। এমন কী এই ধর্মের রীতিনীতি পালন করতেও শুরু করেন। কিন্তু ধর্মের বেড়াজালে ধরা দিয়ে নিজের জীবন সংকল্প থেকে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার মতো সাধারণ মানুষ তো তিনি নন, তাই কিছুদিন পরেই মোহভঙ্গ হলে আবার তিনি আদিবাসী সরদার সম্প্রদায়ের আন্দোলনে যোগ দেন। জল জঙ্গল জমির উপর আদিবাসীদের সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা জমিদার ও মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।




এক সময় আইন করে জঙ্গল ও জ্বালানী কাঠ, পশুখাদ্য, গাছের পাতা প্রভৃতি সংগ্রহের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার, যা কার্যত আদিবাসী জীবন শৈলীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই নিষেধাজ্ঞা তাদের উপর এক বিশাল আঘাত হানে। আদিবাসীদের দখলে যে বিরাট ভূখন্ড ছিল, বস্তুত তাতে তারা শুধুমাত্র নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদেই চাষাবাদ করত, এ কারণে  সরকারের তহবিলে ‘ট্যাক্স’ বা করও জমা পড়ত অল্প এবং এই ঘাটতি মেটাতে ব্রিটিশ সরকার জমিদার বা যারা আদিবাসী নয় এমন লোকদের এইসব অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা করে। নানা অজুহাতে জমি তুলে দেওয়া হয় ঠিকাদার ও মহাজনদের হাতে। এর ফলে সর্বহারা আদিবাসী সম্প্রদায় বাধ্য হয়েই নিজ  ভূমে পরবাসী হয়ে অগত্যা পেটের জ্বালায় ক্ষেতমজুরি করতে শুরু করে। বলাই বাহুল্য, মহাজন সম্প্রদায় আদিবাসীদের যার পর নেই শোষণ শুরু করে। চাবুক মেরে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া তো ছিলই, সেইসঙ্গে আদিবাসী রমণীদের উপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চলত। এমন কী কথার খেলাপ করলে প্রাণে মেরে ফেলা হতো; আর এসবই চলত ব্রিটিশ সরকারের ছত্রছায়ায়।

(ক্রমশ)


2 কমেন্টস্: