‘আমাকে
আমার মতো থাকতে দাও’
অনুপম রায়ের সুরে ও কথায়, অনুপম
রায়েরই গাওয়া একটি গান ঝাঁ করে’ সমকালের কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, এমনকি প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের মনে লেগে গিয়ে, তাকে হিট করে’ দিয়েছিল।
‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/ আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’— গানটির এই
আপাতঃসরল কথাগুলো বোধহয় এই দেশে বহু মানুষের মনে একটা স্বাধীনতার বা ছাড়ের আকাঙ্ক্ষার
প্রকাশ ঘটিয়েছিল। কিন্তু এই গানে যে কথাটা এত আলোড়ন তুললো, সেটা ততটা লিবার্টি বা
স্বতশ্চালনার অধিকারের নয়, অর্থাৎ কিছু করবার / বা কিছুর প্রতি স্বাধীনতার
সম্পর্কে (‘ফ্রিডম টু’)নয়, যতটা কোনো কিছু থেকে স্বাধীনতার (‘ফ্রিডম ফ্রম’)। ইংরেজিতে এই ‘ফ্রিডম টু’ আর
‘ফ্রিডম ফ্রম’-এর পার্থক্য নিয়ে অনেক কেতাব
আছে। সেগুলোয় এক্ষুনি ঢুকছি না। আপাততঃ অনেকের জানা,
মার্গারেট অ্যাট্উড-এর The Handmaid’s Tale- উপন্যাসটির কথা বলি, অ্যাট্উডের যে ডিস্টোপিয়াক কাহিনীটিকে সাম্প্রতিককালে পুরস্কারজয়ী একটি মিনি
ওয়েব সিরিজ আবার বাঁচিয়ে তুলেছে। সেখানে একটি চরিত্র আন্ট লিডিয়া বলছেন, ‘There is more than one kind of
freedom, freedom to and freedom from. In the days of anarchy it was freedom to.
Now you are being given freedom from. Don’t underrate it’। ‘ফ্রিডম টু’-ই সারা পৃথিবীতে বেশি আদৃত। সে
পুরুষের কাছে হোক বা নারীদের কাছে। আমার শরীরের উপরে (তাকে দিয়ে যা খুশি করার
ফ্রিডম) থেকে শুরু করে’ আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্টের উপর ফ্রিডম, যে অর্থেই হোক! অ্যাট্উড
এই স্বাধীনতাকেই রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, আর তার জন্যে উপন্যাসে এক ভীতিকর অরোয়েলীয়
যাজকতন্ত্রকে ‘গিলিয়াড প্রজাতন্ত্র’ নাম দিয়েছিলেন। কখন? না ১৯৮৫ সালে, যখন ধর্মীয়
মৌলবাদ পৃথিবীর নতুন তরঙ্গ হিসেবে ধেয়ে আসছে। ইরানে খোমেইনির উত্থান, আমেরিকায়
নৈতিক সংখ্যাগুরুর উত্থান, নতুন ভয়ের জন্ম দিচ্ছে। ‘ফ্রিডম টু’ হিসেবে
স্বাধীনতাকে না ভাবলে অমর্ত্য সেনের ‘development as freedom’-এর তত্ত্বকে বোঝাই যাবে না। আর অ্যাট্উডের ডিস্টোপিয়া
তো এখন সারা পৃথিবীতে আরো বেশি সত্য হয়ে উঠেছে। আমেরিকা থেকে ভারত সর্বত্রই
গিলিয়াড প্রজাতন্ত্রর রমরমা। ফলে ‘ফ্রিডম টু’-ই আরো বেশি করে’ দরকার! Erich Fromm তাঁর Escape from Freedom বইতে দুঃখ করেছেন যে আধুনিক পৃথিবীতে ফ্রিডম ফ্রম আর ফ্রিডম টু-র ব্যবধান খুব
দ্রত বাড়ছে। সদর্থক অর্থে স্বাধীনতার, ফ্রিডম টু-র, এই কমানুপাত ইউরোপে মানুষকে
প্রণোদিত করছে কোনো বন্ধনহীন ফ্রিডম থেকে
পালিয়ে নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হতে, নয়তো ফ্রিডম সম্পর্কেই উদাসীন হয়ে পড়তে।
কিন্তু এই গানটিতে কেবল চাওয়া
হচ্ছে একজনের নিজের মতো থাকার অধিকার, ‘ফ্রিডম ফ্রম’, যেহেতু তিনি ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে’ নিয়েছেন। সেই নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে
নেওয়াটা কেমন, সেটা দেখার অধিকারও কারো নেই। কিন্তু এই অধিকারটা চাওয়া হচ্ছে কার
থেকে। রাষ্ট্রের থেকে তো বটেই, কিন্তু অন্যান্য সংগঠিত বা অসংগঠিত মানুষদের থেকেও
কি নয়? সে দিক থেকে এই স্বাধীনতা পুরোপুরি নজিকীয় অর্থে ‘স্বাধীনতাতান্ত্রিক’ বা
libertarian। তাঁর বিখ্যাত Anarchy, State and
Utopia (1974)
বইতে রবার্ট নজিকের বিখ্যাত একটি কথা
আছে, “Individuals
have rights, and there are things no person or group may do to them (without
violating their rights।” এর অর্থ ব্যক্তিমানুষের পক্ষে বাইরে থেকে আসা বাধার অভাবটাই একক মৌলিক অধিকার। বাকিগুলো কেবল তার থেকে আসা অনুসিদ্ধান্ত।
ব্যক্তি যার কাছে ইচ্ছা, নিজের শ্রম বিক্রি করতে পারবে এবং (আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে)
কিনতে পারবে। কারণ আমাদের আত্মর মালিকানা থাকা মানে আমরা নিজেদের শ্রমেরও মালিক।
এর মানে এটাও যে কেউ নিজের ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে যে সব জিনিশ বৈধভাবে অর্জন করেছে,
তা ইচ্ছে মতো হস্তান্তর করতে পারবে। আর সেটা করতে পারবে তার যেমন ইচ্ছা সেভাবে,
যতক্ষণ না কেউ তার ফলে প্রবঞ্চিত বা ব্যাহত হয়। মানুষের উপরে কর চাপানো যাবে না।
কারণ নজিকের মতে “Taxation of earnings from
labouris on a par with forced labour”। করের মাধ্যমে কারুর শ্রমের
ফল কেড়ে নেওয়ার অর্থ তার কাজের দিন থেকে কিছু ঘণ্টা কেড়ে নেওয়া। আর সেই সব ঘণ্টা
পুষিয়ে দিতে তাকে অন্য কিছু করতে বলা। যদি কেউ তোমাকে কিছু সময়ের জন্য অন্য কোনো
কাজ, অথবা অপুরস্কৃত কাজ, করতে বাধ্য করে, তবে তোমাকে কী করতে হবে, আর তার
উদ্দেশ্য কী হবে, সেটা তোমার নিজের সিদ্ধান্ত ছাড়া ঠিক হয়ে যাচ্ছে, অন্যের সেবার
জন্য। তার
মানে এই পদ্ধতি যা তোমার থেকে তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে, সেটা তোমাকে নিজের কেবল আংশিক মালিক করে’ দিচ্ছে, তাদেরকে তোমার মধ্যে সম্পত্তির অধিকার দিয়ে দিচ্ছে।
“Just as having such partial control and power of
decision, by right, over an animal or inanimate object would be to have a
property right in it”।
এই কারণেই নজিক, এক ‘nightwatchman’ রাষ্ট্রের, এক ‘minimal’ বা ‘ultra- minimal’ রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন
যে নাগরিকদের আর তাদের সম্পত্তির সুরক্ষাবিধান ছাড়া কোনো রকমের পিতৃপ্রতিম (paternalistic) আইন পাশ করবে না। যেমন মোটরসাইকেল
আরোহীদের হেলমেট পরতে হবে এরকম কোনো রাষ্ট্রীয় আইনের বিরুদ্ধে নজিকের গভীর আপত্তি,
কারণ এতে করে’ অ্যাক্সিডেণ্টের মাধ্যমে সিরিয়াস আঘাত পাওয়ার ব্যাপারে ব্যক্তির
অধিকার ও পছন্দের প্রতি ব্যতিচার করা হয়। নজিক ‘legislation
of morality’-রও খুবই বিরোধী। যেমন ১৯৭৪ সালেই নজিক বলেছিলেন যে সমকামী / সমকামিনীরা বিয়ে করতে এবং
গার্হস্থ্য অংশিদারিত্বের জন্যে সম্পত্তির অধিকার প্রয়োগ করতে চায়, রাষ্ট্র আইন
করে’ তাদের বাধা দিতে পারবে না। নজিক এও বলেছিলেন যে বৈধভাবে অধিকৃত কোনো জিনিশ কারুকে ঠকিয়ে বা কারুর কষ্টোৎপাদন
না করে’ হস্তান্তর করার উপর যদি কোনো সীমা
না থাকে তবে ন্যায্য বিতরণের কোনো ধাঁচবাঁধা তত্ত্ব চলবে না, কারণ এরকম ধাঁচ চাপিয়ে দেওয়া যেতে
পারে কেবল এই ধাঁচ ভাঙতে পারে এমন কিছু কাজের অনুমতি না দিয়ে, যে কাজগুলি আদতে ‘forbid capitalist acts between
two adults’। কিন্তু মুক্ত বিনিময় সব সময়েই ন্যায্য বিতরণের
তথাকথিত ন্যায্য বিতরণগুলিকে ভেঙে দেবে। বিখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় উইল্ট
চেম্বারলেনের উদাহরণ দিয়ে নজিক
দেখিয়েছিলেন তাঁর মতো কোনো খেলোয়াড় যদি এমন শর্ত করেন যে টুর্নামেন্টে তিনি আছেন এমন যে কোনো খেলায় দর্শকদের
সাধারণ টিকিটের উপরও তাঁর জন্যে আলাদা টিকিট করতে হবে, তবে আগেকার প্রকল্পে বাকি
খেলোয়াড়দের ভাগ আর দর্শকদের ভাগের পুরনো ন্যায্য বিতরণ, ‘বি-ক’, এর জায়গায় একটি
নতুন বিতরণ ‘বি-খ’ আসবে, যেটা উইল্ট চেম্বারলেনকে ধনীতর আর বাকিদের দরিদ্রতর করবে,
কিন্তু যাকে অন্যায্য বলা যাবে না।
এই একই যুক্তিতে নজিক মনে করতেন যে
কর ব্যাপারটাই আসলে ছিনতাই, কারণ ‘seizing the results of someone’s labor is equivalent to seizing hours from
him and directing him to carry on various activities’, মানে লোককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার না বাছা
উদ্দেশ্যের জন্যে খাটানো, মানে এক ধরনের ক্রীতদাসত্ব চাপিয়ে দেওয়া। ধাঁচবাঁধা মূলনীতি সব সময়েই কিছু লোককে অন্য কিছু লোকের শ্রমে একটা দাবি করতে
সাহায্য করে। সেটা মানুষের আত্ম-মালিকানার প্রতিবন্ধক, যেটা স্বাধীনতার মূল কথা। স্বাধীনতার মূল অর্থ এখানে অবশ্যই ফ্রিডম ফ্রম। সেটা কতদূর যেতে পারে? সেটাও
নজিকের মতেই পাওয়া যাবে! এর জন্যে অবশ্য নজিকের আর একটা উপমার সাহায্য নিতে হবে।
সেটা হলো ‘Sunset
Yacht Lover’-এর উদাহরণ। ব্যাপারটা এইরকম। মনে করুন কলকাতার বা বাংলার সব্বাই
গঙ্গায় সূর্যাস্ত দেখতে ভালোবাসে। অধিকাংশই হেঁটে যায়। কিন্তু কেউ বজরা কিনে মাঝ
নদীতে সূর্যাস্ত দেখতে চায়। এটা কেন হবে যে অনেকে গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত দেখবে বিনি
পয়সায়। কিন্তু যে বজরা কিনে মাঝ নদীতে সূর্যাস্ত দেখতে চাইবে তাকে ট্যাক্সো দিতে
হবে? যে লোকের বস্তুবাদী স্বার্থ আছে তাকে সেই স্বার্থ চরিতার্থ করতে হয় নন্দনতাত্ত্বিক
জীবনশৈলী বেছে নেওয়া লোকদের থেকে অনেক বেশি খেটে। যে লোকটি বেশি খেটে বেশি টাকা
উপায় করে’ একটা মুভির টিকিট কিনেছে তাকে কেন রাষ্ট্রকে ট্যাক্সো দিতে হবে “money for the needy” যোগানোর জন্যে, যেকালে যারা গাঁ-গঞ্জ বা পাশের প্রদেশ থেকে এসে
গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত দেখবে বিনা পয়সায়? নজিকের আক্ষেপ কেন ‘yacht lover’-কে ছ’মাস বেশি খেটে, ট্যাক্সো দিতে হবে বজরা কিনতে ও বজরা কিনে মাঝ নদীতে
সূর্যাস্ত দেখতে, আর তার জন্যে যে গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত দেখতেই রাজি তার ভার বইতে
হবে তাকে?
বন্ধু, নজিককে নিয়ে এত কথা বলতে হলো
এই কারণেই যে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’-পন্থীরা সব্বাই আসলে জেনে বা না জেনে
নজিকীয়। আমি গানের পরের লাইনটা — ‘যেটা ছিলো না ছিলো না সেটা না পাওয়াই থাক/ সব
পেলে নষ্ট জীবন’— অগ্রাহ্য করছি। কারণ অনুপম রায় অত
ভেবে গানটা লেখেননি (কেই বা লেখে?)। কিন্তু এর ফাঁক দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যষ্টির
স্থলে সমষ্টি সব ঢুকে যেতে পারে। কারণ ‘যেটা ছিলো না ছিলো না’ সেটা তো কারুর দেওয়া
বাধার জন্যেই! ‘Sunset
Yacht Lover’-রা এই
লাইনটা বুঝতেই পারবেন না। কারণ তাঁদের কাছে গঙ্গাতীরে সূর্যাস্ত দেখার নান্দনিক
আয়েসের চেয়ে অনেক বেশি দামি বজরা কিনে মাঝ নদীতে সূর্যাস্ত দেখা। আর মোটামুটি
তাদেরই কথা — ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। গঙ্গাতীরে মাগনায় সূর্যাস্ত দেখা পাঁচ পাবলিকের নয়।
কিন্তু এবার অনজিকীয় প্রসঙ্গে আসি!
সম্প্রতি কলকাতায় প্রথমে রবিনসন স্ট্রিটে, পরে অন্যত্রও কিছু লোক পরমাত্মীয়দের
কঙ্কাল নিয়ে ঘরে বাস করেছেন। খবরের কাগজে তাঁদের জীবনযাপনের খুঁটিনাটি আপনারা
কাগজে পড়েছেন, কেউ অবহেলায়, কেউ রসিয়ে রসিয়ে। তারপর খবর কাগজেই এসেছে আর এক বৃদ্ধের ‘স্টোরি’, যিনি তাঁর
আধুনিক, সুযোগসুবিধাসম্বলিত শহরের ফ্ল্যাটে রাস্তার নোংরা এনে ভর্তি করতেন। রাজধানীর
কাছে, নিহাড়িতে,এক বিগতযৌবন মানুষ আর তাঁর নফর শিশুকিশোরীদের নিয়ে এসে ধর্ষণ আর
ভক্ষণ করতেন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ! বেশ কিছু মানুষ খাপ পঞ্চায়েতে, এবং বাইরে
ইতস্ততঃ ‘মর্যাদা হত্যা’ করছেন কন্যাদের। এঁদের সকলেরই মনের কথা ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও / আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’। তা, তাঁদের থাকতে দেওয়া যাবে? যদি না দেওয়া যায়, তবে আটকাবে কে? অন্য ব্যক্তিবর্গ?
পরিবার? সমাজ? পুরসমাজ? রাষ্ট্র? কারুর তরফে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার ধরণটা বাকিদের
পক্ষে ঠিক কিনা তা কে ঠিক করবে? ব্যক্তির অধিকারের
সীমা নির্দেশ করবেই বা কে? উপরোক্তদের কে বা কারা?
কেউ এই সীমা নির্দেশ করবে কিনা,
করতে পারলে কে বা কারা করবে, সে বিষয়ে যে কোনো তত্ত্বের মূলে থাকবে মানুষ সম্পর্কে
অবধারণ। প্লেটো বলেছিলেন মানুষ সামাজিক জীব। সে সমাজ গড়বেই! অ্যারিসটট্ল বলেছিলেন
মানুষ রাজনৈতিক জীব, কারণ ‘পোলিস’ বা নগররাষ্ট্র তৈরি করা তার ‘স্বভাব’। সেই দিক থেকে রাষ্ট্র স্বাভাবিক (natural) প্রতিষ্ঠান, মানুষের প্রকৃতির সাপেক্ষে। অ্যারিসটট্ল
বলেন প্রকৃতি মানুষকে দিয়েছে বাক্শক্তি, হাসার ক্ষমতা, আর কপালে লিখে দিয়েছে
জয়টীকা — রাষ্ট্রগঠনের ক্ষমতার। এই দিক থেকে রাষ্ট্রর
স্বাভাবিকতা (naturalness)
দুটি শব্দ থেকে এসেছে। রোম্যান ‘natura’ বা আদি অবস্থা, আর গ্রিক ‘physis’, যার অর্থ লীন সম্ভাবনা সমূহের বাস্তবায়ন। আদি অবস্থার অর্থে
না হলেও লীন সম্ভাবনা সমূহের বাস্তবায়নের অর্থে রাষ্ট্র স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান বটেই। এই natura থেকে physis-এর দিকে মানুষের যাত্রাপথে কী ঢুকে থাকে তার মার্ক্সীয় ধারণার উৎস বোঝাতে দার্শনিক
বার্ট্রাণ্ড রাসেল এনেছিলেন ইহুদী ইতিহাস চেতনার কথা, যেখানে দান্তের ডিভাইনা কমেডিয়ার পর্বক্রম গ্রহণ করলে, ‘inferno’, ‘purgatorio’ হয়ে ‘paradiso’-তে পৌঁছবে মানুষ। অবশ্য মার্ক্সের কাছে বিচার্য ছিল না-রাষ্ট্র,
ছিল শ্রেণিহীন সমাজ। কিন্তু তাঁর গুরু হেগেলের হাতে ইতিহাসের দুই
দ্বান্দ্বিক ত্রিপদীচ্ছন্দ, ব্যক্তি-পুরসমাজ-রাষ্ট্র, আর বাদ-প্রতিবাদ-সম্বাদকে
অনায়াসে দান্তের কল্পনায় ঢালা ইহুদী ইতিহাস চেতনার ছাঁচে ঢালা যায়। অমূর্ত ব্যক্তি অধিকার থেকে পুরসমাজ হয়ে প্রুশীয়
বুর্জোয়া রাষ্ট্র সেই পথে এসেছে। হেগেলের মতে রক্তের সম্পর্কের দ্বারা ব্যক্তি
অধিকারের নির্ধারণের ভিত্তিতে পরিবারের ভালোবাসার স্বার্থপরতা আর পুরসমাজের সার্বজনিক
প্রতিতদ্বন্দ্বিতা দুই সংশ্লেষিত হবে সেই রাষ্ট্রের মধ্যে। এই রাষ্ট্রকেও কী
ব্যক্তি বলবে, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’? অন্যান্য রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যে
ধরনের ব্যক্তির ধারণা তুলে ধরে তাতেও তো রাজনৈতিক গণতন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা রাষ্ট্রই, Rechstaat-ই ব্যক্তির স্বার্থের রক্ষক! হব্সের মানুষ ভীত
মানুষ, যে অসহ্য প্রকৃতির অবস্থা থেকে কমনওয়েলথে প্রবেশ করেছে অনিশ্চয়তা থেকে
বাঁচতে। লকের হিসেবী মানুষ। সে প্রকৃতির অবস্থার অসংখ্য প্রাকৃতিক অধিকারের জায়গায়
কমনওয়েলথের কিছু নিশ্চিত পৌর অধিকার বেছে নিয়েছে। রুশোর কেবল সামাজিক নয়, আত্মিকমানুষ। সে কমনওয়েলথের মধ্যে মহত্তর গোষ্ঠীজীবন খুঁজেছে। জেরেমি
বেন্থাম জানতেন যে মানুষ এক গুচ্ছ ক্ষুধা ও কামনার নাম। সে স্বার্থপরও বটে! তার
স্বার্থ সে নিজে না দেখতে পারলে সেগুলি উপেক্ষিত হবে। যাতে নিজে না পারলেও প্রতিনিধিদের
মাধ্যমে নিজের স্বার্থগুলির সুরক্ষা বিধান করতে পারবে, এই ভাবনা থেকেই তো বেন্থাম
ধাপে ধাপে ভোটদান যোগ্যতার সীমা বাড়ালেন! আবার জন স্টুয়ার্ট মিল মানুষকে ক্ষুধাগুচ্ছ
হিসেবে না দেখে উদ্দীপনার সমাহার হিসেবে দেখলেন। রাষ্ট্রকে দিয়ে এই উদ্দীপনার
চরিতার্থতার ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে বলেই উন্নয়ক গণতন্ত্র চাই! প্লেটো
থেকে মিল কেউ কিন্তু ‘ফ্রিডম ফ্রম’ থেকে ‘ফ্রিডম টু’, কোনোটাতেই রাষ্ট্রকে বাদ
রাখলেন না।
যাঁরা রাষ্ট্রকে নিয়ে বেশি মাথা
ঘামাননি, তাঁরাও কিন্তু ব্যক্তির ‘ফ্রিডম ফ্রম’ থেকে ‘ফ্রিডম টু’ দুটোর জন্যই সমাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এমনকি
যখন সেই সমাজ বার্নার্ড ম্যান্ডেভিল, ডেভিড হিউম, অ্যাডাম স্মিথ, অ্যাডাম ফার্গুসন
ইত্যাদি অষ্টাদশ শতাব্দীর কিছু লেখকের মতে ব্যক্তির স্বার্থপর কাজের অচিন্তিত,
অ-অভিপ্রেত কাজের ফল। স্কটিশ আলোকোদ্ভাসের এক পুরোধা পুরুষ অ্যাডাম স্মিথ মানুষকে
দেখতেন ‘bartering
man’, বা বিনিময়কারী, স্বার্থপরায়ণ মানুষ হিসেবে। স্মিথ সেই সব মানুষের
প্রতিযোগিতামূলক বেচাকেনার ভিত্তিতে গড়া সময়কার বাজারকে অপ্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রের
চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। কিন্তু সেই মানুষের স্বার্থচিন্তাকেও যে ‘অদৃশ্য
হাত’ চালনা করে, তার নির্দেশক হলো ব্যক্তির মধ্যেকার ‘অপক্ষপাতী পর্যবেক্ষক’, যেটি
আদতে ব্যক্তির সামাজিকীকৃত বিবেক।
ধরে’ নিই এই রাষ্ট্র বা সমাজের
বাইরে ব্যক্তি নিজেই ঠিক করে’ নেবে তার কোন্ পরিসরের ক্ষেত্রে সে বলবে ‘আমাকে আমার
মতো থাকতে দাও / আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’। কিন্তু এই ব্যক্তি কে? সে কিসের ভিত্তিতে ঠিক করবে
তার গুছিয়ে নেওয়ার ইঁটকাঠসুরকি কী হবে? উদারনীতিবিদ্ জন রল্স তাঁর ATheory of Justice বইতে বলেছিলেন এটা
ঠিক করবেন একদল দায়হীন সত্তা, এক কল্পিত আদি অবস্থায় (original position), যেখানে
তারা নিজেদের সমাজের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, বিকাশগত অবস্থা, নিজেদের
সামাজিক মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, শ্রেণি, বিশেষাধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুই না জেনে,
একটা অজ্ঞতার পর্দার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকারের ও স্বাধীনতার বিষয় ঠিক করে।
কিন্তু মাইকেল স্যাণ্ডেল (Liberalism and the Limits of
Justice),
মাইকেল ওয়ালজার (Spheres of Justice: A Defense of Pluralism and
Equality)
ইত্যাদি লোকসমাজবাদী বা কৌমবাদীরা দেখিয়েছিলেন এরকম ভাবে ব্যক্তিমানুষের অধিকার, স্বাধীনতার পরিধি ইত্যাদি ঠিক করা যায় না। দায়হীন, অভারবদ্ধ সত্তা হয় না। ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও
স্বাধীনতার প্রকৃতি ও পরিসর ঠিক করে দেয় তার লোকসমাজ। তার বাইরে, যে অধিকারের / স্বাধীনতার
চিন্তার ভিত্তিতে ব্যক্তি বলবে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ তার উৎস হবে কি অন্তর্দেশীয়
আদি অবস্থার মতো বিতরণমূলক ন্যায্যতার কোনো বৈশ্বিক মূলনীতি, অর্থাৎ রল্সীয় ‘international original
position’? লোকসমাজবাদীরা
সেটাকে মানতে রাজি নন বলেই ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রকৃতি ও
পরিসরটাকে ঠিক করে’ দেওয়ার অধিকার লোকসমাজকে হয়েছেন।
তার মানে
কি সমাজ বা রাষ্ট্রের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যাবে ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার
প্রকৃতি ও পরিসর ছেড়ে দেওয়ার অধিকার? সেও তো সম্ভব নয়! সমাজ বা রাষ্ট্রের যে ‘প্যানোপ্টিসিজ্ম’
বা সর্বদর্শনের বিপদ সমন্ধে মিশেল ফুকো তাঁর Discipline and
Publish বইতে আমাদের
সতর্ক করে’ দিয়েছিলেন, তার কথা তো ভাবতে হবে? তাহলে উপায় কী? ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ ব্যক্তির এই দাবিও মেনে নেওয়া যাবে না। তাতে ‘ফ্রিডম টু’র ক্ষতি হবে। আবার
তুমি কেমন করে থাকবে, আমাদের ঠিক করতে দাও, রাষ্ট্র ও সমাজের এই দাবিও মেনে নেওয়া
যাবে না। তাতে ‘ফ্রিডম ফ্রম’ বিপন্ন হবে। অথচ ‘ফ্রিডম ফ্রম’
‘ফ্রিডম টু’-র সোপান তো বটেই! একটা উপায় ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল
দুর্খেম থেকে পাওয়া যায়। সমসময়ের ফ্রান্সে যে বিশ্লিষ্টকারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সামাজিক সংহতির সমূহ
ক্ষতি করছিল, এবং মানুষের মনে ‘অহংপ্রণোদিত’ (egotistic) এবং ‘নীতিমানহীনতা
প্রণোদিত’ (anomic) আত্মহত্যার ইচ্ছার যে বীজ বুনছিল, তাকে আটকাতে দুর্খেম তাঁর Le Suicide বইতে
মানুষের বিভিন্ন ‘occupational
associations’-কে
জোরদার করতে বলেছিলেন, যাদের কথা তিনি প্রথম বলেন Division of Labour
in Society বইতে। কিন্তু দুর্খেমের সতর্কবাণী ছিল তারা যেন মধ্যযুগের পেশাগত সমিতিগুলির মত
রাষ্ট্রকে আড়াল না করে’ ফেলে। কারণ সাধারণ মানুষ আজ যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক
স্বাধীনতা ভোগ করছে তাতে ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে আসা রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণের বড়
ভূমিকা ছিল। দুর্খেমের পেশাগত সমিতিগুলির দোসর আজকের পুরসমাজ। ফলে আজকে ব্যক্তির
অধিকার, ‘ফ্রিডম ফ্রম’, আর স্বতশ্চালনা বা
‘ফ্রিডম টু’ কতখানি থাকবে তা ঠিক করতে ব্যক্তি একা পারবে না, আর রাষ্ট্র বা সমাজও
নয়! রাষ্ট্র আর পুরসমাজের লড়াইয়ের ও বিততির ফলে যে স্থান তৈরি হবে তাতেই সুরক্ষিত
থাকবে ব্যক্তির স্পেস! অ্যালেক্সিস টকভিল থেকে শুরু করে’, দুর্খেম, ট্যালকট
প্যাসন্স হয়ে, রবার্ট পাটন্যাম পর্যন্ত সেটাকেই উপায় হিসেবে ঠাওরানো হয়েছে। রবার্ট
পাটন্যাম আমেরিকায় মানুষের যে বিশ্লিষ্টকারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যআর সামাজিক সংহতির
বিপদ দেখেছিলেন, যার প্রতিফলন দেখেছিলেন একলা বোলিং-এর মধ্যে, তাঁর ‘Bowling Alone: America's
Declining Social Capital’ নামের বিখ্যাত প্রবন্ধে, তার কথা মনে রেখেই ভাবতে হবে অনুপমের গানের প্রথম দুই
লাইনের আর্তিতে সাড়া দেওয়া যাবে কিনা!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন