কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮

রঞ্জনা ব্যানার্জী




পাখা


বেশ ক’বার শো-পিসগুলো এদিক ওদিক করলাম, পাখাটা তাওলাল ঝালর নিয়ে  চোখে ভেসে রইলো অথচ চারমাস আগেও শো-পিসগুলোর বিন্যাস এমনই ছিল।  পাখাটা হলওয়ের দেয়ালে কোথাও আড়াআড়ি আটকাবো ঠিক করেছিলাম। ফিরেই কাজে লেগে গেলাম, সরাবার সময় হ’লো না!

এবারই দেশ থেকে এনেছিলাম পাখাটা

ভাইঝি’র বিয়ে উপলক্ষে দেশে যাওয়াআমি একটু আগেভাগেই পৌঁছে গিয়েছিলামবাকি নাইয়রীদের আসা শুরু হয়নি তখনও। বাড়ির প্রথম বিয়ে! ঘরদোরের তুমুল ঝাড়াপোঁছ চলছিল। মিনতির মা খানিক পরপর বস্তায় পুরে বাতিল জিনিস বাইরে সরাচ্ছেআমি ডাইনিংএ চায়ের অপেক্ষায় হঠাৎ বস্তার ফাঁকে লাল ঝালরে চোখে আটকালো। জিনিসটা বের করালাম পাখা! কী যত্নে মা আগলে রেখেছিলেন এই সেদিনও, আর আজ এটা বাতিল জিনিসের ফর্দে! ফেরার সময় নিয়ে এলাম

জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখেছি,  মা-বাবার শোয়ার ঘরের দেয়ালে ‘ভুলোনা আমায়’  নিয়ে ঝুলছে পাখাটা সরষে রঙের খোল ঘিরে লাল ঝালর। প্রতি বছর নববর্ষের আগে মা ওকে নামাতেন। বারান্দায় বসে সাবান-জলে পাখার হাতল আর বেতের  ধারগুলো মুছতেনকিন্তু খোলে কিংবা ঝালরে জল-সাবান লাগাতেন না। পেট্রোলে তুলো ভিজিয়ে প্রার্থনার মগ্নতায় মা এই জায়গাগুলো পরিষ্কার করতেন বলতেন,  ‘জলে ধুলে রঙ চটবে, কল্কার সুতোর আঁশ উঠে যাবে’ - মায়ের গল্পটা এই কল্কাকে
ঘিরে।

দুরারোগ্য ব্যাধিতে দিদিমা তখন শয্যাশায়ীডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছেন শেষ বিকেলে সেদিন দিদিমা মা’কে কাছে ডাকলেন চোখে জল নিয়ে পাখা হাতে বিছানা ঘেঁষে দাঁড়ালেন মা ‘ভুলোনা’ সবে সুতোয় ফুটেছেক্লাসের সবার মা কিছু না কিছু বাড়তি যোগ করেছেন পাখার সৌন্দর্যে, কেবল মায়েরটাই সাদামাটা। পরদিনই জমা  দেবার তারিখদিদিমা বসতে চাইলেন। পারলেন না। নয় বছরের একমাত্র মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে পাখাটাহাতে টেনে নিলেন, সুতোর বাক্স চাইলেনতারপরে শুয়ে শুয়েই ছোট সেই কল্কা তুললেন সুঁইয়ের নিখুঁত ফোঁড়ে

পরদিন ভোর না হতেই দিদিমা চলে গিয়েছিলেন জীবনের ওপারেপাখাটা আর স্কুলে জমা দেয়া হয়নি মা’র

পাখাটা গতকাল অন্য এক গল্পের অনুষঙ্গ হ’ল 

মিমির মামীমা’র আদিবাড়ি বাংলাদেশে। কানাডা এসেছেন বেড়াতে। কাল ডিনারে ডেকেছিলাম লিভিংরুমে ঢুকেই ম্যান্টেলের দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলেনঅস্বস্তি হচ্ছিলো। পাথরের শো-পিসের ভিড়ে পাখাটা ভারি বেমানান ঠেকছিল কৈফিয়ত দিলাম, ‘ভেতরকার দেয়ালে আটকাবো ওটা’উনি বললেন, ‘ঠিক এই রকমের একটা হাতপাখা ছিল আমাদের বাড়িতে! আরও কত কী ছিল! সব জ্বালিয়ে দিয়েছে ওরা। ভেতরে যারা ছিল তাদেরও’

সে কী! আমরা আঁতকে উঠি। সোফায় ফিরে কোলের কাছে পাখাটা ধরে বসেন উনি। এই বসার ভঙ্গি আমার চেনা একইভাবে ফেলে আসা গতকাল কোলে মা’ও উদাস হতেন স্মৃতির ঝাঁপ তোলেন তিনিও। পাকিস্তানি সৈন্যরা সেই রাতে হানা দিয়েছিল পঙ্গু মেজকাকাকে ফেলে ঠাকুরমা বাড়ি ছাড়েননি। নিশুত রাতে এক কাপড়ে পালিয়েছিল সবাই। গাঁয়ের সীমানা ছাড়ার আগেই আগুনের হল্কা আকাশ ছুঁয়েছিল। আর ক’মিনিট দেরি হলে সবাই মরতেন সেদিন।

যাওয়ার সময় জোর করেই পাখাটা তাঁকে দিলাম বললাম, ‘শেকড়টা বাঁচুক’।


4 কমেন্টস্:

  1. অসাধারণ মনছোঁয়া গল্প,রঞ্জনা'দি! কষ্টের গতকাল কোলে নিয়ে এভাবেই বসে যাই অামরাও!লিখে যান এভাবে অারো অনেক গল্প।একাত্তরের ভয়াবহ রাত গুলো তাড়া করে ফেরে নিপীড়িত নির্যাতিতদের! একালের সন্তানেরা তা কল্পনাও করতে পারবে না।ইতিহাস ফিরে অাসে বারবার! এ গল্পে সেই নিদারুণ ইতিহাস উঠে এসেছে!লাখো শহীদের রক্তে গড়া এ দেশে হায়েনারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে!জানিনা কবে এর থেকে মুক্তি পাবো অামরা! কালিমাটি কে অশেষ কৃতজ্ঞতা পাঠকদের কাছে এমন সমৃদ্ধ সম্ভার তুলে ধরার জন্যে!গল্পকার রঞ্জনা'দি, কালিমাটি সম্পাদক কাজল'দা 'র নিরন্তর শুভকামনা করছি!

    উত্তরমুছুন
  2. শেকড় উনিও, আপনিও, শেকড় বাঁচে মনে! সুতোর অসাধারণ কাজে কাকিমার ঘরে সেই রেশমি সুতোয় বোনা, ফ্রেমে বাঁধা, 'শম্ভুর পদতলে শেফালি ফুল ঝরে পড়ে', মামার বাড়িতে বোনা, ফ্রেমে বাঁধা 'সোনার হরিণ কোন বনেতে ছিল', বা 'খোলা হাতে এসেছিল্‌/ খোলা হাতে যাবে,/ তবে কেন এত মায়া।/ বিষয় বৈভবে', কোত্থাও আর নেই, আমার মনে ছাড়া।

    উত্তরমুছুন
  3. সত্যি শেকড় বাঁচে মগজে। তবে তাকে তাজা রাখতে চাই অনুষঙ্গ । হঠাৎ কোন মুখ কোন ছবি কোন চেনা গানের সুর অথবা কোন গন্ধ কিংবা কোন দৃশ্য স্মৃতির আড়মোড়া ভাঙায়। ফেলে আসা গতকাল পর্দা তোলে।

    উত্তরমুছুন